এই রচনা রাজ্জাক-মঙ্গল নয়

649
রাজ্জাক
[আব্দুর রাজ্জাক]
জন্ম । ২৩ জানুয়ারি ১৯৪২; পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মৃত্যু । ২১ আগস্ট ২০১৭; ঢাকা, বাংলাদেশ

 

লিখেছেন বিধান রিবেরু


 

নায়ক প্রতীতির সঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র জড়িয়ে গেছে ওতোপ্রোতভাবে। এর কারণ এখানে নায়ক একজন ব্যক্তিই হন, তিনিই হয়ে ওঠেন সকল মুশকিল আসানকারী। ব্যক্তিবাদ চর্চিত বুর্জোয়া সমাজে তাই নায়কই সর্বশক্তিমান, মহামানব, সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যান। বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিনির্ভর এই সমাজে তাই সমষ্টি নয়, নায়ক হয় একলা অতিমানব ধরনের কোনো মানুষ। যৌথতার চিন্তা নয়, এসব ছবিতে হয় ‘আমি’ ও ‘আমিত্বে’র জয়গান; নয়তো ব্যক্তির দুঃখ বেদনাকেই বড় করে দেখানো হয় সর্বক্ষণ।

এই ব্যক্তিবাদী বুর্জোয়া সিনেমার নায়ক কোনো-না-কোনোভাবে শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়াদেরই সুরক্ষা দেয়। সেটা একটি শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ক্যাথারসিস বা নিষ্ক্রান্তি ঘটানোর মাধ্যমেই হোক, বা আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখিয়ে হোক। আখেরে এসব ছবি শ্রেণী-শত্রুর বিরুদ্ধে দর্শককে সক্রিয় করে তুলতে চায় না। সক্রিয়তার বদলে দর্শককে নিষ্ক্রিয় ও বাধাধরা সূত্রের ভেতরে রেখে পরিতৃপ্ত করতে চায়। কখনো সেখানে প্রেম আসে, কখনো বা সহিংসতা, কখনো আবার কৌতুক। মুনাফাভিত্তিক এসব ছবিতে নায়কের ভাবমূর্তিতে তাই শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া ভাবধারারই রূপ ও রস পেয়ে বিস্তার লাভ করে, নায়ক ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে মহানায়ক বা নায়করাজ।

…যুগ-যুগ ধরেই
বুর্জোয়া রীতিতে
নায়কের প্রয়োজন
হয়, নায়করাজের
প্রয়োজন হয়…

কারখানাই এমন তারকা ভাবমূর্তি তৈরি করে, নিজের মুনাফার স্বার্থেই। অবশ্য বিদ্যমান বুর্জোয়া সমাজেও তো এমন মহাতারকার প্রয়োজন হয়, নয়তো সাধারণের যে আবেগীয় নিষ্ক্রান্তি সেটা কোথায় হবে, কে হবে সেই কাণ্ডারি, যার হাত ধরে বিষবাষ্প বলি, বা বাসনার ফুল বলি, নির্গত হবে বা প্রস্ফূটিত হবে? তাই যুগ-যুগ ধরেই বুর্জোয়া রীতিতে নায়কের প্রয়োজন হয়, নায়করাজের প্রয়োজন হয়। সেখানে সমষ্টি কখনো নায়কের আসনে বসে না। সেখানে মুষ্টিমেয় এলিট গোষ্ঠীর দিকে প্রকৃত কোনো চ্যালেঞ্জ সংবাহিত হয় না।

Filmfree Jibon Theke nea
জীবন থেকে নেয়া

সদ্যপ্রয়াত ঢাকাই ছবির কিংবদন্তি নায়ক আব্দুর রাজ্জাকও আর দশটা বুর্জোয়া চলচ্চিত্র কারখানা থেকে উৎপাদিত এক তারকা বৈ কিছু নন। তারপরও তিনি কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন, চলচ্চিত্র ও চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। যদিও তাকে দিয়ে মুনাফা অর্জনই ছিল এই কারখানার মুখ্য উদ্দেশ্য, তারপরও তিনি সেই উদ্দেশ্যের বাইরে গেছেন। রাজ্জাক চেষ্টা করেছেন ব্যবসায়িক বিবেচনার পাশাপাশি, সময় যেভাবে আন্দোলিত করেছে সমাজের মানুষকে, ঠিক সেটিরই চারিত্রিক প্রতিফলন ঘটাতে রুপালি পর্দায়, তবে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম মেনেই। বাণিজ্যিক সূত্রের বাইরে না গিয়ে দর্শককে হলমুখী করেছেন, হলমুখী দর্শককে আবার ভিন্ন কিছু দেয়ারও চেষ্টা করেছেন। সেসব কাজ কিন্তু কখনোই এই বুর্জোয়া সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি, একমাত্র জীবন থেকে নেয়া ছবিটি ছাড়া। যাহোক, তার দীর্ঘ কর্মের মাধ্যমেই তিনি গত সাড়ে চার দশকে অর্জন করেছেন দর্শকপ্রিয়তা, পেয়েছেন ব্যবসায়িক সাফল্য।

বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের কাছে রাজ্জাক সাদাকালো যুগের এক রোমান্টিক নায়ক। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে শুধু অভিনেতা পরিচয়ের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ রাখেননি। পরিচালনা করেছেন, প্রযোজনা করেছেন, এমনকি পরিবেশক হিসেবেও যুক্ত থেকেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্র কারখানায়। বলা যায় চলচ্চিত্র ব্যবসায় বেশ ভালোভাবেই রাজ্জাক জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। যেহেতু চলচ্চিত্র ব্যবসায় তার লগ্নি প্রবেশ করতে থাকে, যেহেতু বরাবরই তিনি বাণিজ্যিক ছবির নায়ক, তাই বলা যায় ছবি সংক্রান্ত তার ভাবনার ভরকেন্দ্র যতটা না আর্ট অর্থে শিল্পে ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল মুনাফায়। মজার বিষয় তার এই ভরকেন্দ্র একটা সময়ের পর কিছুটা সরে যায় বটে, আবার ফিরেও আসে আগের জায়গায়।

ষাটের দশক পুরোটা রাজ্জাকের অভিনেতা ও রোমান্টিক নায়ক হিসেবে কারখানায় ভাবমূর্তি বা ইমেজ সৃষ্টির চেষ্টা চোখে পড়ে। সত্তরের দশকে দেশপ্রেমমূলক কিছু ছবিতে অভিনয় করেন, পাশাপাশি ধীরে ধীরে রাজ্জাক চলচ্চিত্র ব্যবসায় নিজেকে জড়াতে থাকেন, রোমান্টিক ভাবমূর্তি থেকেও বেরুতে শুরু করেন তিনি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাজ্জাক চলচ্চিত্র ব্যবসার পাশাপাশি নিজের ভাবমূর্তিকে বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, সমসাময়িক করে উপস্থাপন করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাজ্জাক সেভাবে আর সক্রিয় থাকতে পারেননি। তারপরও ২০০০ সালের পর মরণ নিয়ে খেলা, আমি বাঁচতে চাই, মন দিয়েছি তোমাকে ইত্যাদি ছবি নির্মাণ করেন, যার কোনোটাই সাফল্যের মুখ দেখেনি। কোটি টাকার কাবিন ছবিটি অবশ্য বিরাট সাফল্য পায়। ২০১৩ সালের পর থেকে অসুস্থতা তাকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে দেয়। রাজ্জাকের কর্মজীবন তাই বিশ্লেষণ করলে মোটা দাগে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।

…আর্থিকভাবে সাবলম্বী
হওয়ার পর রাজ্জাককে
দেখা যায় এমন কিছু
চরিত্রে কাজ করছেন,
যেগুলো গতানুগতিক নয়। সেসব
চরিত্র করে তিনি চলচ্চিত্রে
স্থায়ী আসন তৈরির
চেষ্টাই করেছেন…

আমরা দেখব এই চার পর্বে রাজ্জাক চলচ্চিত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, নায়ক হয়েছেন। এরপর সত্তরের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্মিত চলচ্চিত্রে দেশপ্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে ছবিতে লগ্নি করেছেন, সময় ও দর্শকের মর্জি বুঝে কাহিনী ও চরিত্র বাছাই করেছেন। হয়েছেন নায়করাজ। আর্থিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার পর রাজ্জাককে দেখা যায় এমন কিছু চরিত্রে কাজ করছেন, যেগুলো গতানুগতিক নয়। সেসব চরিত্র করে তিনি চলচ্চিত্রে স্থায়ী আসন তৈরির চেষ্টাই করেছেন। এবং সফল হয়েছেন। এই নিবন্ধে সংক্ষেপে রাজ্জাকের এই চলচ্চিত্র যাত্রাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করব।

BEHULA
বেহুলা

১.

১৯৬৬ সালে জহির রায়হানের হাত ধরে রাজ্জাক নায়ক হিসেবে বড় পর্দায় আবির্ভূত হন। যদিও লোককাহিনী নির্ভর সেই চলচ্চিত্রে লখিন্দররূপী রাজ্জাকের ভূমিকা খুব কম ছিল। আসলে বেহুলা নামের সেই ছবিতে তিন-চারটি দৃশ্যে রাজ্জাকের মতো নতুন কাউকে নায়ক করা ছাড়া জহির রায়হানের কোনো বিকল্প ছিল না; কারণ ছবিটি ছিল একেবারেই নারী নির্ভর একটি ছবি। যেখানে অ্যান্টাগনিস্ট মনসা দেবী, আর প্রোটাগনিস্ট বেহুলা– দুজনই নারী। এই দুই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জহির রায়হানের প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী, যথাক্রমে সুমিতা দেবী ও সুচন্দা।

নায়ক হিসেবে প্রথম ছবিতে রাজ্জাকের উপর সেভাবে আলোকপাত না হলেও জহির রায়হানের পরবর্তী ছবি আনোয়ারাতে [১৯৬৭] নিজের অভিনয়-প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পান রাজ্জাক। যদিও এই ছবিটিও নারী প্রধান, এবং বেহুলার মতোই সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয় স্ত্রীরূপী সুচন্দাকে।

আনোয়ারা মুক্তির পরের বছরই কবরীর সঙ্গে অভিনয় করে নিজের রোমান্টিক ইমেজকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন রাজ্জাক। আরেক গুণী পরিচালক সুভাষ দত্তের আবির্ভাব [১৯৬৮] ছবিতে রাজ্জাক নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে ফিরে পাওয়ার অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেন। এই ছবিতে কবরী যেন চার্লি চ্যাপলিনের দ্য কিড ছবির সেই নারী, যে নিজের সন্তানকে অচেনা বড়লোকের হাতে সপে দিয়েছিল। সুভাষ দত্তের এই ছবি দিয়েই রাজ্জাক-কবরী জুটি জনপ্রিয়তা পায়।

Nil akasher niche
নীল আকাশের নীচে

একই দশকেই রাজ্জাক-কবরীর আরেকটি সাড়া জাগানো ছবি নীল আকাশের নীচে [১৯৬৯] মুক্তি পায়। এই ছবিতে দেখা যায় ট্যাক্সিচালক কিন্তু মেধাবী ছাত্র রাজ্জাকের প্রেমে পড়ে কবরী। এই ছবিতে ব্যবহৃত প্রায় সব গানই সে সময় মানুষের মুখে-মুখে ফিরেছে। যেমন ‘নীল আকাশের নীচে’ বা ‘প্রেমেরই নাম বেদনা’ ইত্যাদি। কাজেই বলা যায়, ষাটের দশকের শেষ চার বছরে রাজ্জাক মোটামুটি নিজেকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। পরবর্তী দশকে রাজ্জাক যেসব চরিত্র করবেন, সেগুলো বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে হবে প্রতিবাদী বা রাজনীতি সচেতন।

২.

জহির রায়হানের উল্লিখিত দুই ছবিতে রাজ্জাক অভিনেতা হিসেবে, বিশেষ করে বললে নায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। সুচন্দার সঙ্গে রাজ্জাকের আরো একবার জুটি হয় জহির রায়হানেরই কালোত্তীর্ণ ও রূপকধর্মী জীবন থেকে নেয়া [১৯৭০] ছবিতে। রায়হানের এই ছবিতে এসে রাজ্জাককে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠতে দেখা যায়। অবশ্যই সেটা পরিচালকের গুণে। ছবির কাহিনীতে দেখা যায়, বিয়ের পর সুচন্দাকে রাজ্জাক বলছেন স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের দাবিতে মিছিল হচ্ছে, সেখানে তাকে যোগ দিতেই হবে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কথা মাথায় রেখে ছবিটি তৈরি করেছিলেন জহির রায়হান। তাই এই ছবিতে শুধু নায়ক নয়, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে দেখা যায় রাজ্জাককে। অবশ্য এই ছবিতে রাজ্জাককে নায়ক বললে ঠিক বলা হবে না। এখানে রায়হান এক যৌথ-চেতনার কথাই বলেছেন। এই ছবির নায়ক তাই সেই যৌথ-চেতনা; রাজ্জাক নন।

…সত্তর দশকের
প্রথম ভাগে
রাজ্জাককে
ঠিক বাণিজ্যিক ছবির
অভিনেতা মনে হয়
না…

জীবন থেকে নেয়া মুক্তির পরের বছরই তো মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে এই ভূখণ্ডের মানুষ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গৃহবন্দী থাকেন রাজ্জাক। এ সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন তিনি। মাঝে নির্যাতনের শিকারও হন রাজ্জাক। যুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীন দেশে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন [১৯৭২] নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। সেই ছবিতেও নির্যাতনের এক দৃশ্যে অভিনয় করেন রাজ্জাক। অবশ্য ঐ ছবিতে খসরুই মূল চরিত্রে অভিনয় করেন।

যুদ্ধের পর পুরো দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলীরই প্রতিফলন ঘটছিল চলচ্চিত্রে। যেমন, খান আতাউর রহমান বানিয়েছিলেন আবার তোরা মানুষ হ। এই ছবিতে নায়ক ছিলেন ফারুক। সমকালের সেসব ছবিতে রাজ্জাকও থেকেছেন কালের স্বাক্ষী হয়ে। এই পর্বে, অর্থাৎ সত্তর দশকের প্রথম ভাগে রাজ্জাককে ঠিক বাণিজ্যিক ছবির অভিনেতা মনে হয় না। অবশ্য বলা বাহুল্য নয় যে, সেসময় বাংলাদেশ সদ্য জন্ম নিয়েছে। সর্বক্ষেত্রেই তাই দেশপ্রেম কাজ করছিল। তাই তো মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ছবি আলোর মিছিল-এ [১৯৭৪] রাজ্জাককে দেখা যায় দেশপ্রেমিকের চরিত্রে। বড় ভাই মজুতদারী ব্যবসা করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। আর সেটারই প্রতিবাদ করে রাজ্জাক। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ওই ছবিতে তৎকালের বাস্তবতাকেই তুলে ধরা হয়েছিল। তখন একদল মানুষ কম সময়ে ধনী হওয়ার বাসনায় কালোবাজারি ও মজুতদারি ব্যবসা শুরু করে। তাদেরকে তখন কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

alor michil
আলোর মিছিল

আলোর মিছিল ছবিটির আগে রংবাজ [১৯৭৩] নামের একটি ছবিতেও দেখা যায়, রাজ্জাকের চরিত্রটি জনদরদী। ছবির প্রথম দৃশ্যে গুণ্ডারূপী রাজ্জাক দোকানদারদের জিজ্ঞেস করছেন জিনিসপত্রে ভেজাল মেশাচ্ছে কিনা, বা দাম বেশি রাখছে কিনা। তিনি যেন যুদ্ধপরবর্তী দেশের রবিন হুড। ভালো লোকদের লুট করার পর তার আফসোস হয়, পরে আবার সে যা নিয়েছে, তার বেশিই ফিরিয়ে দেয়।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর চলচ্চিত্র শিল্পেও এর প্রভাব পড়ে। কেউ আর সহজে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বানাতে এগিয়ে আসেনি বহুদিন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দুই বছর পর পরিস্থিতি যখন কিছুটা থিতু হয়ে এসেছে, তখন রাজ্জাক এক প্রেমের ছবি পরিচালনা করলেন, প্রথমবারের মতো, নাম অনন্ত প্রেম [১৯৭৭]। এর অর্থ, পুনরায় বাণিজ্য-লক্ষ্মীর দিকে মুখ ফেরালেন রাজ্জাক। এই ছবির মাধ্যমে আবারো যেন তিনি বিক্রি করতে চাইলেন ষাটের দশকের সেই রোমান্টিক নায়ক রাজ্জাকের ভাবমূর্তিকে। তাই নায়িকা হিসেবে নিলেন সে সময়ের সবচেয়ে গ্ল্যামার নায়িকা ববিতাকে। ছবিতে ববিতার সঙ্গে চুম্বনদৃশ্যে অভিনয় করে নতুন করে আলোচনায় আসেন রাজ্জাক। যদিও দৃশ্যটি শেষ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে রাখা হয়নি। তারপরও ছবিটি দিয়ে বাণিজ্য করার প্রবণতা ধরা পড়ে ছবির গানের দৃশ্যায়নে।

ananta-prem
অনন্ত প্রেম

৩.

আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে রাজ্জাক চরিত্রনাভিনেতা হিসেবে মূর্ত হন পর্দায়। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া আজিজুর রহমান পরিচালিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ছুটির ঘণ্টায় দপ্তরির চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক। যদিও তার বিপরীতে শাবানা অভিনয় করেছেন, কিন্তু তারপরও এটি রোমান্টিক কোনো ছবি নয়। একজন দপ্তরি ও স্কুলছাত্রের মধ্যকার স্নেহের সম্পর্ক ও শেষ পর্যন্ত একটি ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছবিটি।

…নায়ক
হিসেবে নয়, যেন
একটি কালোত্তীর্ণ চরিত্রে
অভিনয়ের মাধ্যমেই রাজ্জাক
কিংবদন্তি হওয়ার
প্রয়াস পান…

নায়ক হিসেবে নয়, যেন একটি কালোত্তীর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই রাজ্জাক কিংবদন্তি হওয়ার প্রয়াস পান এই দুই দশকে। তাই দেখা যায় দুই বছর পরই, ১৯৮৩ সালে বড় ভালো লোক ছিলো চলচ্চিত্রে আবারো এক ট্র্যাজিক চরিত্রে অভিনয় করছেন রাজ্জাক। সে এমন এক চরিত্র, যে চরিত্র নিজের পীর বাবার অবর্তমানে নিজ এলাকায় আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, আবার সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার তীব্র বাসনাও থাকে তার। বাংলাদেশি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন জটিল চরিত্র খুব একটা দেখা যায় না। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।

আশির দশকে চরিত্রনাভিনেতা ছাড়াও রাজ্জাক লোককাহিনী ও সাহিত্য ভিত্তিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যেমন লাইলী মজনু, শুভদা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত ইত্যাদি চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করা যায়।

নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে রাজ্জাক কিছুটা বিরতি নেন। তাছাড়া চলচ্চিত্র কারখানার চেহারা ও চরিত্র ততদিনে অনেকটাই বদলে গেছে। নতুন নায়ক ও অভিনেতাদের আগমনে রাজ্জাকের রাজত্ব ততদিনে হাতছাড়া। ফারুক, সোহেল রানা, ওয়াসিমের পর আশি ও নব্বইয়ের দশকে ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল, জসিম, মান্না, সালমান শাহ প্রমুখ নায়কদের আগমন ঘটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তখন নিজের বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজ্জাক অভিনয় করেন জজসাহেব বা বাবা কেন চাকর-এর মতো ছবিগুলোতে। রাজ্জাক পরিচালিত বাবা কেন চাকর [১৯৯৭] তো এপার ও ওপার বাংলায় ব্যবসায়িকভাবে দারুণ সফল হয়। সামর্থবান তিন ছেলে ও এক মেয়ে থাকার পরও একজন বয়স্ক লোকের জীবনসংগ্রামের মেলোড্রামাটিক উপস্থাপনের মাধ্যমে ছবিটি বক্স-অফিসে সাফল্য পায়। এই ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ দেখে রাজ্জাক আরো নির্মাণ করেন শান্ত কেন মাস্তান, বাবা কেন আসামী ধরনের ছবিগুলো। তবে সেগুলো বাবা কেন চাকর-এর মতো সাড়া জাগাতে পারেনি।

৪.

একবিংশ শতাব্দীতে একদিকে যেমন রাজ্জাকের সক্রিয়তা কমতে থাকে, তেমনি যে কয়টি ছবি করেছেন, সেগুলোও বক্স-অফিসে খুব একটা সফল হয়নি, কয়েকটি ছাড়া। ব্যবসা-সফল ছবির কথা বললে বলতে হয় এফ আই মানিকের কোটি টাকার কাবিন ছবিটির কথা। এই ছবির মাধ্যমেই নায়ক শাকিব খান ও নায়িকা অপু বিশ্বাস প্রথম জুটি বাঁধেন।

এই শতাব্দীর প্রথম দশকে কিছুটা সক্রিয় থাকলেও দ্বিতীয় দশকে অসুস্থতার কারণে রাজ্জাক প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে ছেলেদের বিভিন্ন প্রযোজনায় তিনি কাজ করেছেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এ বছর শরীর আরো খারাপ হয়ে যায়, বলতে গেলে ক্যামেরাকে বিদায়ই জানান তিনি। আর ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট তো মারাই গেলেন রাজ্জাক।

rongbaz
রংবাজ

৫.

আজীবন রাজ্জাক চলচ্চিত্রের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট থাকার চেষ্টা করেছেন। সময় ও বয়স পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে যেমন পরিবর্তন করেছেন, তেমনি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে বাছাই করেছেন চলচ্চিত্র ও চরিত্র। পুরো ক্যারিয়ারে রাজ্জাককে মানুষ যদিও একজন সাদাকালোর যুগের রোমান্টিক নায়ক হিসেবে মনে রাখবে, তবে তার চরিত্রের বৈচিত্র অনেক– প্রেমিক থেকে গুন্ডা, দেশপ্রেমিক থেকে আধ্যাত্মিক পুরুষ, গাড়ির চালক থেকে দপ্তরি– এমন অজস্র চরিত্রের দেখা মিলবে রাজ্জাকের করা ছবিতে।

…”আমাকে চিন্তা করতে
হবে দর্শক কী
খাচ্ছে। একেবারে
উলঙ্গ বানাব না,
কম্প্রোমাইজ করেই
কিন্তু দর্শকদের
কিছু খোরাক দিতে
হবে”…

শুধু অভিনয় নয়, রাজ্জাক পরিচালনা করেছেন ১৬টি ছবিও। প্রযোজনাও করেছেন তিনি। তাই রাজ্জাক চলচ্চিত্রকে প্রধানত ব্যবসা হিসেবেই গণ্য করেছেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথাও নয়। তাই এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, “আমাকে চিন্তা করতে হবে দর্শক কী খাচ্ছে। একেবারে উলঙ্গ বানাব না, কম্প্রোমাইজ করেই কিন্তু দর্শকদের কিছু খোরাক দিতে হবে। পাবলিককে প্রথমে হলে ঢুকাতে হবে।”*

সাক্ষাৎকারে ব্যবহৃত দুটি শব্দ থেকেই রাজ্জাকের ‘কমিটমেন্ট’ পরিষ্কার হয়ে যায়। একটি হলো ‘কম্প্রোমাইজ’ ও অন্যটি হলো ‘পাবলিক’। প্রশ্ন হলো রাজ্জাকের কিসের সঙ্গে কম্প্রোমাইজের কথা বলেছেন? দর্শক যা খাচ্ছে সেটার সঙ্গে, বা ঘুরিয়ে বললে বলতে পারি শিল্পের সঙ্গে? কাজেই আপসকামী রাজ্জাক যে দর্শককে কম বুঝদার ‘পাবলিক’ হিসেবেই গণ্য করেন, বুদ্ধিমান দর্শক ও বোদ্ধা দর্শক যে তার মনে নেই, সেটা সহজেই বোঝা যায়। ঢাকাই চলচ্চিত্র কারখানায় ‘পাবলিক’ একটা হরেদরে ব্যবহার করা শব্দ, মানে আমজনতা আরকি, যে আমজনতা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর।

এই আমজনতা কোনটা চাচ্ছে– সেটার দিকে নজর রেখেই রাজ্জাকের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার এগিয়েছে বেশিরভাগ সময়। তবে জহির রায়হান, সুভাষ দত্ত বা নারায়ণ ঘোষ মিতার মতো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার বিষয়টি আলাদা। এইসব পরিচালকের সঙ্গে রাজ্জাক যেসব ছবি করেছেন, সেগুলো বাণিজ্য করার জন্য তৈরি হয়নি, ছবি দেখলে অতোটুকু বোঝা যায় সহজেই। তবে জহির রায়হানের বেহুলা বা আনোয়ারাকে অবাণিজ্যিক বা সমান্তরাল ছবি বলা যাবে না। জীবন থেকে নেয়া ছবি থেকেই রায়হান রাজনৈতিক ছবি তৈরিতে হাত দেন। এই ছবিটি ও যুদ্ধ পরবর্তী কয়েকটি ছবি বাদ দিলে রাজ্জাক মূলত বাণিজ্যিক ছবিরই নায়ক ও অভিনেতা। যদিও তিনি ব্যতিক্রম চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেই আলাপ আগেই করেছি, সেটি তিনি করেছেন নিজেকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। অনেক কিংবদন্তি অভিনেতাই এই কাজটি করেন। প্রথমে বাণিজ্যিক কারণে চরিত্র বাছাই করলেও, সুযোগ পেলে তারা কাজ করেন ‘সিরিয়াস’ চরিত্রে, যে চরিত্রকে দেখতে ‘পাবলিক’ পয়সা দিয়ে টিকিট কাটবে না। কিন্তু সেসব চরিত্র করলে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজের নামটি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। অর্থাৎ পপুলার আর্ট ও হাই আর্ট দুটোই করার চেষ্টা করেন বড় মাপের অভিনেতারা। রাজ্জাকও বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন।

Baba keno chakor
বাবা কেন চাকর

আরেকটি প্রসঙ্গ টেনেই এই লেখার ইতি টানব। অনেকেই বলে থাকেন, রাজ্জাক মেলোড্রামা থেকে মুক্ত ছিলেন। বিষয়টি ভুল। আলোর মিছিল ছবিতে বড় ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর কান্নাকাটির যে অভিনয়, বা ছুটির ঘণ্টা ছবির শুরুতে উন্মাদপ্রায় বৃদ্ধের যে আহাজারি– সেগুলোকে কী বলবেন, মেলোড্রামা নয়? এমনকি শেষের দিককার ছবি বাবা কেন চাকর ছবিতেও বড় ছেলে ও ছেলের বউয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর বাড়ি ছাড়ার সময় রাজ্জাককে কান্নামিশ্রিত চড়া সুরে সংলাপ বলতে দেখা যায়। খুঁজলে এমন বহু উদাহরণ দেয়া যাবে।

…রাজ্জাক
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের
এক
গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের
নাম…

যাহোক, সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এটাই বলতে হয়, রাজ্জাক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নাম। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে একসময় আর্থিক দিক থেকে চাঙ্গা রেখেছেন। নিজে ঝুঁকি নিয়ে সিনেমা শিল্পে লগ্নি করেছেন। এরই ফাঁকে ফাঁকে তিনি ভিন্নধর্মী, ব্যতিক্রমী চরিত্রেও কাজ করেছেন। চার শতাধিক ছবিতে কাজ করে জনপ্রিয়তা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে তৈরি করেছেন স্থায়ী আসন । নিজের বড় ও ছোট ছেলেকেও যুক্ত করেছেন চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে। সব মিলিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়, সেই উজ্জ্বল অধ্যায়টির নাম নায়করাজ রাজ্জাক।


বোধিনী
নাসরিন হক, নায়ক যখন পরিচালক, রঙের মেলা, কালের কণ্ঠ [২৪ আগস্ট ২০১৭]

দোহাই
নন্দন [রাজ্জাককে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা], সমকাল [২৪ আগস্ট ২০১৭]
আনন্দ [রাজ্জাককে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা], প্রথম আলো [২৪ আগস্ট ২০১৭]
আনন্দ বিনোদন [রাজ্জাককে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা], ইত্তেফাক [২৪ আগস্ট ২০১৭]
Print Friendly, PDF & Email
লেখক, সাংবাদিক, সিনে-সমালোচক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সিনে-গ্রন্থ : চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা; চলচ্চিত্র বিচার; বলিউড বাহাস; উসমান সেমবেনের চলচ্চিত্র হালা

3 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to ঈদে সিনেমা দেখার স্মৃতি/ প্রসূন রহমান | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here