বাংলা চলচ্চিত্রের শুদ্ধ নির্মাতা সুভাষ দত্ত

825
সুভাষ দত্ত
জন্ম । ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০; দিনাজপুর, বাংলাদেশ
মৃত্যু । ১৬ নভেম্বর ২০১২; ঢাকা, বাংলাদেশ

লিখেছেন । মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন


বাংলা চলচ্চিত্রের শুদ্ধ নির্মাতা সুভাষ দত্ত [১৯৩০-২০১২]। পাকিস্তান আমলের ঘোর দুর্দিনে বাংলা চলচ্চিত্র টিকবে কি টিকবে না, চলবে কি চলবে না– সবার মনে এই সংশয়। বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের যখন এই ভয়ানক দুরবস্থা, তখন এহতেশাম-মুস্তাফিজ ভাইদের নেতৃত্বে নির্মাতারা মহা উৎসাহে উর্দু ছবি বানাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এমন কি জহির রায়হানও উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণে গা ভাসিয়েছেন, সুভাষ দত্ত তখন বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণের সংকল্পে অটল ছিলেন। তাঁর প্রথম ছবি সুতরাংই [১৯৬৪] প্রথম শিল্পসম্মত ও বাণিজ্যসফল বাংলা সিনেমা। সুতরাং-এর সাফল্যের ফলেই নির্মাতারা সবাই বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকলেন। বেঁচে গেল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। সুতরাং তাই বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণের চ্যালেঞ্জ অতিক্রমের মাইলফলক। আমার প্রশ্ন, বেঁচে থাকতে সুভাষ দত্তকে আমরা কেন চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননা দিতে ব্যর্থ হলাম?

কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি

সুভাষ দত্তের জন্ম দিনাজপুরে মামা বাড়িতে, ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। পৈত্রিক বাড়ি বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দিতে। শৈশব-কৌশোর কেটেছে তাঁর মামা বাড়িতেই। শৈশবে নাটকে অভিনয় এবং নাট্য নির্দেশনা দিলেও সুভাষ দত্তের পেশাগত জীবন শুরু হয় একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে। এসব কথা সবারই জানা। ছোটবেলা থেকেইে তাঁর নাম শুনে এসেছি, কিন্তু তাঁকে চোখে দেখিনি, কিন্তু তাঁর ছবির গান আমাদের মুখে মুখে– ‘এমন মজা হয় না…’

…অনমনীয় ছিলেন
বলেই তাঁর চলচ্চিত্রেও
আমরা ঋজুত্বের
স্পষ্ট লক্ষণ
ফুটে উঠতে
দেখি…
সুতরাং ।। সহশিল্পী, কবরী ও সুভাষ দত্ত

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে কাজের সুবাদে ২০০৩ সাল থেকে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে, ঘনিষ্ঠভাবে তাঁকে জানার সুযোগ হয়। সদালাপী ও শুদ্ধভাষী সুভাষ দত্তের সাথে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডেও কাজ করেছি। তখনো তাঁকে প্রতিবাদী ও আপসহীন দেখেছি। মুখের ওপর অপ্রিয় সত্যটাও অবলীলায় বলতে পারতেন। একবার বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। ভাষা ব্যবহার ও উচ্চারণের বিষয়ে ছিল তাঁর বিশেষ সতর্কতা। একবার অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানকে মৃদুস্বরে ধমকাচ্ছেন তিনি। বেচারা ভাইস চেয়ারম্যান কিছু শব্দ উচ্চারণে আঞ্চলিকতার প্রভাব কিছুতেই দূর করতে পারছে না, কিন্তু সে মনে করে তার উচ্চারণ প্রমিত মানের। আর দত্তদা নিরলসভাবে উচ্চারণ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ওর কী সমস্যা। লোকটা কিছুতেই ধরতে পারছে না, তার ত্রুটি কোনখানে। কিন্তু নিজেকে সংশোধনও করতে পারছে না। দত্তদাও নাছোড়বান্দা, শেষ পর্যন্ত শিখিয়ে ছাড়লেন। মনে হয়, এ রকম অনমনীয় ছিলেন বলেই তাঁর চলচ্চিত্রেও আমরা ঋজুত্বের স্পষ্ট লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখি।

দৃঢ়তার পাশাপাশি কোমলতা ও আবেগের দারুণ বহিঃপ্রকাশও দেখেছি সুভাষ দত্তের আচরণে। তিনি শুধু বলতেন, ‘যখন সুতরাং নির্মাণ করলাম, তখন ফিল্ম আর্কাইভ আমাদের ঢাকায় হয়নি। সুতরাং যখন ফ্রাঙ্কফুট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় পুরস্কার পেল, তখন আমি এর নেগেটিভ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রডিউসার ও এফডিসি’র কর্মকর্তাদের অনেক বলেছি। কেউ আমার কথা শোনেনি। তখন টিনের ক্যানে নেগেটিভ থাকতো। জং ধরে পুরো নেগেটিভটাই নষ্ট হয়ে গেল।’

সবার হয়তো জানা নেই, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সুভাষ দত্তের প্রথম চলচ্চিত্র সুতরাং-এর একমাত্র প্রিন্টটিও হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছ থেকে। কোনো প্রিন্ট অথবা নেগেটিভ কিছুই ছিল না তাঁর কাছে। তাঁর প্রথম কাজ সুতরাং সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে শুধু উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন বাকরুদ্ধভাবে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সংগ্রাহক ফখরুল আলমের তৎপরতায় ২০০৫ সালে সুতরাং-এর একটি প্রিন্ট পুনরুদ্ধার হলো এক সিনেমা হলের পরিত্যক্ত গুদাম থেকে। আমি তখন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের পরিচালক। দত্তদাকে খবর দেওয়া হলো। তিনি এলেন, রিলগুলো স্পর্শ করলেন, অঝোর ধারায় ঝরছে তখন অশ্রুপ্রবাহ। অনেকক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারলেন না। অবশেষে অস্ফূট উচ্চারণ করলেন, ‘৩৪ বছর পর আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিলেন আপনারা, ফিল্ম আর্কাইভের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নাই।’ একই কথা তিনি বহুবার বলেছেন বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে, টিভি চ্যানেলে, পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে। প্রতিবারই এসব কথা বলার সময় চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করতে দেখেছি। এ সময়ই আমি উপলব্ধি করি, নিজের সৃষ্টিকে সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন সুভাষ দত্ত।

…বলতেন,
মেডিকেল কলেজ
আর হাসপাতালের যে
সম্পর্ক, চলচ্চিত্র শিক্ষার
প্রতিষ্ঠান আর ফিল্ম আর্কাইভের
সম্পর্কও ঠিক
তেমনই…
ডুমুরের ফুল

সাত্ত্বিক ও শুদ্ধ স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি, ছিলেন স্বল্পভাষী, খাদ্য গ্রহণ করতেন খুবই সামান্য পরিমাণ। সপ্তাহে একদিন উপবাস ব্রত পালন করতেন। কথাবার্তায় সংযম অনুসরণ ও অনুশীলন করতেন। প্রতিদিন সকাল ১১টা পর্যন্ত নির্বাক থাকার কথা তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা অনেকেই জানেন হয়তো। সবকিছুর ঊর্ধ্বে সত্য ও সততা ছিল তাঁর জীবনের আরাধ্য। তাই তো ২০০৪ সালে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ২৫ বছর রজতজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ’-এ নিজের স্মৃতিচারণমূলক লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দের সেই অমৃতবাণী– ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনোকিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’

সুভাষ দত্ত মনে করতেন চলচ্চিত্র একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পমাধ্যম। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ইউডা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন জীবন সায়াহ্নে এসে। তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কিছুদিন পরপরই আসতেন ফিল্ম আর্কাইভে। তাদেরকে আর্কাইভের সংগ্রহ ঘুরে ঘুরে দেখাতেন। বলতেন, মেডিকেল কলেজ আর হাসপাতালের যে সম্পর্ক, চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রতিষ্ঠান আর ফিল্ম আর্কাইভের সম্পর্কও ঠিক তেমনই। আমার আজ খুব দুঃখ হয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলো ২০১৩ সালের ১ নভেম্বর, মাত্র এক বছরের জন্য তিনি তা দেখে যেতে পারলেন না। ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। সুভাষ দত্ত চলে গেছেন মৃত্যুর যবনিকার আড়ালে। কিন্তু এ দেশের চলচ্চিত্র জগতে তিনি অমর হয়ে আছেন তাঁর কালজয়ী সৃষ্টির মাঝে।

সুতরাং-এর খুঁটিনাটি

সুভাষ দত্ত নির্মিত সুতরাং স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যসফল বাংলা চলচ্চিত্র। রুচিশীলতার বিবেচনায় সুতরাং নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও শিল্পমান-সম্পন্ন এক সফল ও দর্শক নন্দিত চলচ্চিত্র। আগেই বলেছি, এ দেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত তখন আশা-নিরাশার সংশয়ে দোদুল্যমান। এহতেশাম ও মুস্তাফিজ ভ্রাতৃদ্বয় তখন উর্দু চলচ্চিত্রের নির্মাণের মাধ্যমেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যবসায়িক ভবিষ্যত নির্ভরশীল– এই তত্ত্ব হাজির করে ফেলেছেন। এ. জে. কারদারের জাগো হুয়া সাভেরার [১৯৫৯] আন্তর্জাতিক সাফল্যের পর তাঁরা ততদিনের ঢাকা এফডিসি থেকে উর্দু ছবি চান্দা [১৯৬২] ও তালাশ [১৯৬৩] নির্মাণ করে পাকিস্তানের উভয় অংশে একযোগে মুক্তি দিয়েছিলেন। দারুণ ব্যবসায়িক সাফল্যও লাভ করছে উর্দু ছবিগুলো। সবাই দলে দলে উর্দু ছবি নির্মাণের হুজুগে মেতেছেন। এমনকি আমরা যাকে নিয়ে গর্ব করি, সেই জহির রায়হানও সঙ্গম [১৯৬৪] নির্মাণ করে বাণিজ্য-লক্ষ্মীর সাধনায় যোগ দিয়েছেন উর্দু ছবি নির্মাণের মিছিলে। বাংলা চলচ্চিত্র টিকবে কি টিকবে না, চলবে কি চলবে না– সবার মনে এমন ঘোর সংশয়। আমাদের চলচ্চিত্রের সূচনাকালের এই ঘোরসঙ্কটময় ক্রান্তিকালে স্রোতের বিপরীতে সুতরাং নির্মাণ করে প্রতিকূলের যাত্রী হয়েছিলেন সুভাষ দত্ত। তিনি সুতরাং নির্মাণ করলে এ দেশের দর্শক-সমাজে তা বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। সুতরাং সুন্দর, জীবনীধর্মী ও পরিচ্ছন্ন চলচ্চিত্র হিসেবে বাংলাদেশের দর্শক-সমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাংলা চলচ্চিত্রের সাফল্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে আশাবাদী হয়ে ওঠেন পুঁজি লগ্নিকারক নির্মাতা প্রযোজকেরা। এরপর বংলা চলচ্চিত্রকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের বছরই সালাহ্উদ্দিন লোককাহিনিভিত্তিক বাংলা ছবি রূপবান [১৯৬৫] নির্মাণ করে বাংলা চলচ্চিত্রের বাণিজ্য সফলতার রেকর্ড সৃষ্টি করে ফেলেন। অতঃপর এক সময়ে ষাটের দশকেই সূচনা ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি অধ্যায়েরও। তাই বলা যেতে পারে, সুতরাং এবং রূপবান হলো বাংলা চলচ্চিত্রের ঘোর দুর্দশার প্রান্ত থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর টার্নিং পয়েন্ট।

ছবি ও কোলাজ : যায় যায় দিন-এর সৌজন্যে
…বাংলা চলচ্চিত্র টিকবে কি টিকবে না,
চলবে কি চলবে না– সবার মনে
এমন ঘোর সংশয়। আমাদের চলচ্চিত্রের
সূচনাকালের এই ঘোরসঙ্কটময়
ক্রান্তিকালে স্রোতের বিপরীতে
সুতরাং নির্মাণ করে
প্রতিকূলের যাত্রী হয়েছিলেন
সুভাষ দত্ত…

ওয়ারিতে ১৯৫৭ সালে ভারতীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে দেখানো হয় সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী [১৯৫৫]। অসাধারণ এই চলচ্চিত্রটি দেখে সুভাষ দত্ত ছবি নির্মাণে অনুপ্রাণিত হন, তখন থেকেই নীরবে চলতে থাকে প্রস্তুতি। এর মধ্যে এহতেশামের এদেশ তোমার আমার [১৯৫৯] ছবিতে কমেডিয়ান হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ পান। এরপর ১৯৬২ সালের শেষদিকে এসে শচীন ভৌমিকের একটি গল্পের চিত্রনাট্য সৈয়দ শামসুল হককে দেখালেন। তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। এরপর সত্য সাহার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনিই চট্টগ্রামের একটি মেয়ের কথা বলেন। নায়িকা নির্বাচিত হলো। ১৯৬৩ সালের মে মাসে তিনি চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ছবি শেষ, মুক্তি পেল ১৯৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী আর চট্টগ্রামে। ছবি সুপারহিট। হিট এ ছবির নায়িকা কবরীও। ছবির প্রধান অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেন পরিচালক নিজে।

সুতরাং ছবিতে একটি গ্রামের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন সুভাষ দত্ত। ছবির অন্যান্য প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী, রানী সরকার, মেছবাহ, বেবী জামান, মঞ্জুশ্রী, সিরাজ, খান জয়নুল প্রমুখ এবং ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন বাংলাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা।

সুভাষ দত্ত এক বহুমুখী প্রতিভার নাম

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে সুভাষ দত্ত একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের চলচ্চিত্রের জন্য। চিত্রশিল্প, অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা, চিত্রনাট্য ও শিল্পনির্দেশনায় তিনি একইসঙ্গে সাফল্যের পরিচয় রেখেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর সৃজনশীল কর্মের ঈর্ষণীয় সাফল্য।

বিশেষত চলচ্চিত্র নির্মাণে সুভাষ দত্ত ছিলেন অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরুর পর থেকে তিনি একে একে ২৪টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন– সুতরাং [১৯৬৪], কাগজের নৌকা [১৯৬৬], আয়না ও অবশিষ্ট [১৯৬৭], আবির্ভাব [১৯৬৮], পালাবদল [১৯৬৯], আলিঙ্গন [১৯৬৯], বিনিময় [১৯৭০], অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী [১৯৭২], বলাকা মন [১৯৭৩], আকাঙ্ক্ষা [১৯৭৬], বসুন্ধরা [১৯৭৭], ডুমুরের ফুল [১৯৭৮], বুজ সাথী [১৯৮২], সোহাগ মিলন [১৯৮২], নাজমা [১৯৮৩], সকাল সন্ধ্যা [১৯৮৪], ফুলশয্যা [১৯৮৬] ও আমার ছেলে [২০০৮] ইত্যাদি।

…ঢাকার চলচ্চিত্রে
আধুনিক পোস্টার শিল্পের
সূচনাকারী শিল্পী
হলেন চলচ্চিত্রকার
সুভাষ দত্ত…

সুভাষ দত্ত একজন দক্ষ অভিনয় শিল্পী হিসেবেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি অভিনয়ও করেন এদেশ তোমার আমার [১৯৫৯], হারানো দিন [১৯৬১], সুতরাং [১৯৬৪], নদী ও নারী [১৯৬৫], চান্দা [১৯৬২], তালাশ [১৯৬৩], আবির্ভাব [১৯৬৮], রাজধানীর বুকে [১৯৬০], বসুন্ধরাসহ [১৯৭৭ ২৪টি সিনেমায়। চলচ্চিত্রে তিনি কৌতূকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেও প্রশংসা অর্জন করেছেন। ১৯৭২ সালে আরণ্যক নাট্যদলের প্রথম প্রযোজনা কবর নাটক দিয়ে শুরু হয় তাঁর মঞ্চাভিনয়।

বসুন্ধরা

এ দেশে সিনেমা-পোস্টার শিল্পের পথিকৃৎ ছিলেন সুভাষ দত্ত। মুখ ও মুখোশ-এর পরে ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নির্মিত ২০৪টি ছবি মুক্তি পায়। এসব ছবির প্রধান প্রচার মাধ্যম ছিল পোস্টার। ঐ সময়ে চলচ্চিত্রের পোস্টার আঁকতেন সুভাষ দত্ত, নিতুন কুণ্ডু, আজিজুর রহমান, আবদুল মালেক, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান প্রমুখ শিল্পী।

ঢাকার চলচ্চিত্রে আধুনিক পোস্টার শিল্পের সূচনাকারী শিল্পী হলেন চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত। তাঁর প্রথম জীবনে, পঞ্চশের দশকের গোড়ার দিকে, বোম্বেতে PAMART নামের একটি সিনেমা পাবলিসিটি স্টুডিওতে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় ফিরেও তিনি যোগ দেন প্রচার সংস্থা এভারগ্রিন-এ, এরপর যৌথভাবে কামার্ট [KAMART] নামে একটি পাবলিসিটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংস্থায় চলচ্চিত্রের পোস্টার আঁকার মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর পাবলিসিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, পোস্টার ও শোকার্ড ডিজাইন করেন এবং টাইটেল কার্ড তৈরি করেন। এছাড়াও তিনি জাগো হুয়া সাভেরা [১৯৫৯], এদেশ তোমার আমার [১৯৫৯], মাটির পাহাড় [১৯৫৯], আকাশ আর মাটি [১৯৫৯], রাজধানীর বুকে [১৯৬০], হারানো দিন [১৯৬১] ইত্যাদি বিখ্যাত সব সিনেমার পোস্টার আঁকেন। এছাড়া সুতরাং [১৯৬৪], কাগজের নৌকা [১৯৬৬], আয়না ও অবশিষ্ট [১৯৬৭], আবিষ্কার [১৯৬৮], পালাবদল [১৯৬৯], আলিঙ্গন [১৯৬৯], বিনিময় [১৯৭০], অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী [১৯৭২], বলাকা মন [১৯৭৩], বসুন্ধরা [১৯৭৭], নাজমাসহ [১৯৮৩] তাঁর নিজের পরিচালিত সমস্ত সিনেমারও পোস্টার আঁকেন তিনি। কামার্ট, এভারগ্রিন, জুপিটার, এলাইড, চিত্রকর– এসব হলো ষাটের দশকের ঢাকার বিখ্যাত সব পাবলিসিটি হাউস; অনেকটা এখনকার অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির মতো। কমার্শিয়াল আর্টিস্টরা তখন সাইনবোর্ড লিখতেন, সিনেমার পোস্টার, ফটোসেট, ব্যানার আঁকতেন এসব হাউসের হয়ে।

ঢাকার অনেক আধুনিক ভাষ্কর্যের স্থপতি ও বিখ্যাত শিল্পী নিতুন কুণ্ডুকে ঢাকায় এনেছিলেন সুভাষ দত্ত, তাঁর জন্য এভারগ্রিন পাবলিসিটিতে কাজও জোগাড় করে দেন তিনি। সিনেমার পোস্টার আঁকার মাধ্যমে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ছবি আঁকায় নিতুন কুণ্ডুর মুন্সিয়ানা দেখে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাঁকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে নেন। স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের কর্মজীবনও শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোস্টার আঁকার মাধ্যমে। বগুড়ার একটি সিনেমা হলে তাঁর হাতে আঁকা ব্যানার দেখে মুগ্ধ হয়ে সুভাষ দত্ত তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। চান্দা [১৯৬২], তালাশ [১৯৬৩], ডাকবাবু [১৯৬৬], সমাধান [১৯৭২], স্বীকৃতি [১৯৭২], অপরাধ [১৯৭৫], গরমিল [১৯৭৬], অগ্নিশিখা [১৯৭৮], অশিক্ষিত [১৯৭৮], জনতা এক্সপ্রেস [১৯৮১], ছুটির ঘণ্টা [১৯৮০], মেহমানসহ [১৯৮৩] বহু বিখ্যাত সিনেমার পোস্টার আঁকেন তিনি।

সঙ্গীতে অবদানে

সুতরাং ছবিতে ব্যবহৃত– ‘এমন মজা হয় না/ গায়ে সোনার গয়না/ ও বুবু তোর বিয়ে হবে/ বাজবে কত বাজনা’— গানটি তখন লোকমুখে অত্যন্ত জনপ্রিয় গানে পরিণত হয়। গানটি তখন মানুষের মুখে মুখে গীত হতো। ছবিটির কিশোরী নায়িকা কবরীর ঠোঁটে কন্ঠ দিয়েছিলেন রীবন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ কলিম শরাফীর কন্যা– আরেক কিশোরী কণ্ঠশিল্পী আলিয়া শরাফী। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী।

সুভাষ দত্তের বিনিময় ছবির একটি গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়– ‘জানতাম যদি, শুভঙ্করের ফাঁকি/ আমার ঘরে পড়তো না হয় শূন্য’। পর্দায় গানটির দৃশ্যে অভিনয় করেন সুভাষ দত্ত।

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবির গান আজও আমাদেরকে সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিয়ে যায় সেই অনন্য গানের ভাষায়– ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি/ মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’। ছবির নির্মাতা সুভাষ দত্ত এভাবেই বেঁচে আছেন তাঁর নির্মিত শুদ্ধ-সুন্দর বহু ছবির ভেতর জীবনধর্মী চরিত্রের মধ্য দিয়ে।

সম্মাননা

১৯৬৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে সুতরাং দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়া মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব [১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯] ও নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে [১৯৬৮] পুরস্কৃত হয় সুভাষ দত্তের কয়েকটি চলচ্চিত্র। সুতরাং পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতার পুরস্কার [১৯৬৫] অর্জন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে ঘোষিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ সুভাষ দত্তের প্রযোজনা-পরিচালনায় নির্মিত বসুন্ধরা চলচ্চিত্রটি সেরা পরিচালক ও প্রযোজক-সহ মোট পাঁচটি পুরস্কার লাভ করে।

পরিচালক ও অভিনেতা
সুভাষ দত্তের হাত ধরেই
রূপালি জগতে পা রাখেন
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের
মহাতারকা
কবরী…

সুভাষ দত্ত চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একুশে পদক-এ ভূষিত হন। তিনি ২০০৩ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।

সুতরাং-এ কবরী

নতুন মুখের সন্ধানে

সুতরাং ছবিতে পরিচালক ও অভিনেতা সুভাষ দত্তের হাত ধরেই রূপালি জগতে পা রাখেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মহাতারকা কবরী। এখানে কবরীর বিপরীতে অভিনয়ও করেন তিনি।

ছবির নায়িকা চট্টগ্রামের মিনা পাল, কবরী নাম ধারণ করে কিশোরী বয়সেই চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। তিনি সুতরাং ছবিতে অভিনয় করার প্রথম সুযোগেই দর্শক নন্দিত নায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হন। এরপর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি আর।

সুভাষ দত্তের আয়না ও অবশিষ্ট ছবিতে আরেকজন নতুন নায়িকা শর্মিলীর চলচ্চিত্রে অভিষেক, এটিও দর্শক নন্দিত হয়। কাগজের নৌকা ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে সুচন্দার আগমন। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবির মধ্য দিয়ে নায়ক উজ্জ্বল চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন। বসুন্ধরা ছবিতে সুভাষ দত্তের হাত ধরে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তাঁর হাত ধরেই চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে আহমেদ শরীফ ও মন্দিরার।

…সুভাষ দত্ত
সব চলচ্চিত্রে মানুষের
জীবনের সাধারণ আবেগ,
ভালোবাসা, যন্ত্রণা,
মূল্যবোধের
গল্প বলেছেন…

শেষ কথা

সুভাষ দত্ত সব চলচ্চিত্রে মানুষের জীবনের সাধারণ আবেগ, ভালোবাসা, যন্ত্রণা, মূল্যবোধের গল্প বলেছেন। তিনি বাণিজ্যিক ঘরানার ছবিই নির্মাণ করেছেন, তবে সেখানে তিনি সাধারণ মানুষকে দিয়েছেন নির্মল বিনোদন। সেই বিনোদনের ভেতরেই শিল্প ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়েছে। বলিউডের ছবি রিমেইক, ধুমধাড়াক্কা মারপিট ও উদ্ভট নাচ-গানের বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের গল্প সাদামাটা ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য রূপালি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সেই প্রথম যুগের এক সফল কিংবদন্তির নাম সুভাষ দত্ত।


সূত্র । বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল; জুন ২০১৭ সংখ্যা
লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত
Print Friendly, PDF & Email
চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক; বাংলাদেশ ।। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ । সাবেক প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট । সাবেক প্রধান তথ্যকর্মকর্তা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

2 মন্তব্যগুলো

  1. দুটি ভুলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-
    ১) সুভাষ দত্তের “আয়না ও অবশিষ্ট” (১৯৬৭) এর নায়িকা কেন, কোন চরিত্রেই ‘শরমিলী আহমেদ’ অভিনয় করেন নি। ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ দুইটি দুই খন্ডের শর্ট ফিল্মে নায়িকা ছিলেন – ‘আয়না’ অংশে ‘সুচন্দা’ এবং ‘অবশিষ্ট’ অংশে ‘সুজাতা’। ‘শরমিলী’র প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’ (অসমাপ্ত) রয়ে যায়। তবে তিনি সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’ (১৯৬৮) দিয়েই পরিচিতি লাভ করেন।
    ২) নায়ক ‘উজ্জ্বল’এর আগমন সুভাষ দত্তের হাত ধরে হলেও তা কোন ভাবেই ‘অরুনাদবয়ের অগ্নিসাক্কী’ (১৯৭২) দিয়ে নয়, এটি উজ্জবলের ৫ নম্বার চলচ্চিত্র। উজ্জবলের আগমন ঘটে ‘বিনিময়’ (১৯৭০) দিয়ে।

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here