বক্তব্য রেখেছেন । প্রসূন রহমান
আয়োজন । তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণে স্মৃতিতর্পণ এবং 'তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা ২০১৭' আয়োজক । মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি; বাংলাদেশ স্থান । শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা সময়কাল । ১৩ আগস্ট ২০১৭; বিকাল ৫টা
আজকের আলোচনা অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় অতিথিবৃন্দ এবং উপস্থিত আমার সহযোদ্ধা চলচ্চিত্রকর্মি, চলচ্চিত্র বোদ্ধা এবং চলচ্চিত্রপ্রেমী বন্ধুরা। সবাইকে স্বাগত জানাই।
তারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্বক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তার ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরী হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্থতা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোথিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়। পুরো আলোচনায় আমি হয়তো তারেক ভাই বলেই তাকে উদ্ধৃত করব।
তারেক ভাই আমাদের মাঝে নেই আজ ৬ বছর। ম্যুভিয়ানার উদ্যোগে স্মারক বক্তৃতা আয়োজিত হচ্ছে চতুর্থবারের মতো। আমি প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে চাই, তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এবং ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটিকে। ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার শিক্ষক ক্যাথরীন মাসুদ এবং ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি বেলায়াত হোসেন মামুনকে যারা আমাকে আজকের এই তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
প্রথমেই বলে নেওয়া প্রয়োজন, আমার বক্তৃতা আসলে তাত্ত্বিক আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি স্মৃতিচারণমূলক হবে। ফলে সেটি হয়তো আর বক্তৃতা থাকবে না। অথবা কে জানে, বক্তৃতা ব্যাপারটায় হয়তো আমার নিজেরই খানিকটা অস্বস্তি আছে। এটি কথামালা হলে বোধহয় আমার জন্যে অনেক সহনীয় শোনায়।
…শুধু নির্মাতা
হিসেবে নয়, সৃজনশীল
মানুষ হিসেবে, মেধাবি মানুষ
হিসেবে, ভাষ্যকার হিসেবে
তিনি প্রতিদিনই আমার
কাছে নতুন
ছিলেন…
তো যাইহোক, আজ কিছু কথা নিয়ে, এরইমধ্যে আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত। আজকের এই স্মরণ আলোচনার শুরুতে আমার যে ৫ মিনিটের একটি অডিওভিস্যুয়াল প্রেজেন্টেশন দেখেছেন, হয়তো সেটাই আমার মূল বক্তব্য। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমি আসলে বক্তা নই। অডিওভিস্যুয়ালের মানুষ।
আমরা যখন তারেক ভাইকে নিয়ে আলোচনা করি, তার চলচ্চিত্র প্রদর্শন করি, আমরা আসলে তার সৃজনশীলতাকেই উদযাপন করি, তার স্পিরিটকে উদযাপন করি, তার চিন্তা ও দর্শনকে পাঠ করি। তার চলচ্চিত্র সবসময় আমাদের মুক্তির কথা বলে যায়, আত্মোপলব্ধির কথা বলে যায়, জাতীয় ও আত্মপরিচয় অত্মঅনুসন্ধানের কথা বলে যায়, তার প্রতিটি কাজ গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসারিত দার্শনিক বিশ্লেষণের সুযোগ রেখে যায়।
এই পাঠ ও পূনঃপাঠের প্রক্রিয়া নানাভাবে নানা মাধ্যমে চলমান। তাকে নিয়ে লেখায়, তার কাজ নিয়ে গবেষণায়, তাকে নিয়ে আলোচনার এই প্রক্রিয়ার মাঝেই তিনি এবং তার স্পিরিট আমাদের মাঝে বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকবে।
…ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে
মহীরূহের পাশে দাঁড়িয়ে
কতটুকু নিতে পেরেছি,
তা আমি নিজেও
ভালো করে
জানি না…
চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদকে বেঁচে থাকতেই কয়েক দফা পূনঃআবিস্কারের অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। শুধু নির্মাতা হিসেবে নয়, সৃজনশীল মানুষ হিসেবে, মেধাবি মানুষ হিসেবে, ভাষ্যকার হিসেবে তিনি প্রতিদিনই আমার কাছে নতুন ছিলেন। তার জীবনের শেষ কয়েকটি বছর তার বেশীরভাগ কাজের সঙ্গী থাকবার সুযোগ হয়েছিল। সেটি নির্মাণ প্রক্রিয়া, সেটি লেখার প্রক্রিয়া, সেটি অন্যদের কাজ দেখার প্রক্রিয়া, সেটি আলোচনার প্রক্রিয়া, সেটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রক্রিয়া, প্রায় সব কাজেই আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। সে সময় যা বলতেন, যে বিষয়েই বলতেন প্রতিটি কথাই কোট করবার মতো, ডকুমেন্টেশন করবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতো। কিন্তু সব তো আর ধরে রাখা যায় না! ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে মহীরূহের পাশে দাঁড়িয়ে কতটুকু নিতে পেরেছি, তা আমি নিজেও ভালো করে জানি না। শুধু মনে হতো, এই কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ, এই কথাগুলো সকলের জানা উচিত, সবাইকে জানানো উচিত। জগতের এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয়ে তার বিশেষ মতামত ছিল না।
বলছিলাম কয়েকদফা নতুন করে আবিস্কার করবার কথা। আদম সুরত-এর নির্মাতাকে নতুন করে আবিস্কার করেছিলাম মুক্তির গান-এর নির্মাতা হিসেবে। এরপর মুক্তির গান-এর নির্মাতাকে আবিস্কার করেছি মাটির ময়নার নির্মাতা হিসেবে। এরপর পাই দুটি কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে। ততদিনে অন্তর্যাত্রা নির্মিত হয়েছে। প্রতিবারই তিনি নতুন। এর মাঝে আমিও পড়তে গিয়েছিলাম দেশের বাইরে। দেশে ফিরি ২০০৬-এর মাঝামাঝি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দীর্ঘমেয়াদি শাসনকাল চলছে।

একদিন দুপুরবেলায় দেখি বাংলাদেশ থেকে বিবিসির লাইভ টক শো হচ্ছে। কেন্দ্র বাংলাদেশের– বিআইসিসি। শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। বিবিসির হার্ড টক-এর উপস্থাপক স্টিফেন সাকুরে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অতিথি আলোচকদের সাথে। আলোচনার বিষয় : “বাংলাদেশ ক্যান ডেমোক্রেসি ডেলিভার”। আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে আলোচনায় উপস্থিত আছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। বিএনপি’র পক্ষ থেকে উপস্থিত আছেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। আর নিরপেক্ষ বক্তা হিসেবে যাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তার নাম তারেক মাসুদ। দুজন ওয়েস্টার্ন এডুকেটেড ঝানু রাজনীতিবিদের মাঝখানে বসেছেন তিনি। যিনি ঐ মুহুর্তে পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তার পরিচয়, তিনি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। সেদিন দেখেছিলাম, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনার অন্তর্গত শক্তি, তার শিক্ষা ও মেধার স্ফূরণ, তার ব্যক্তিত্ব ও যুক্তি উপস্থানের ধার। অন্য ভাষার উপরে তার দখল ও যথার্থ শব্দপ্রয়োগের প্রতিক্রিয়া। সেদিন জেনেছিলাম, একজন সত্যিকার চলচ্চিত্র নির্মাতার সংজ্ঞা ও পরিচয়। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে যে জগতের সকল বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হয়, সবার চাইতে স্মার্ট ও মেধাবী হতে হয়– সেটাও জেনেছিলাম।
…তিনি
রবীন্দ্ররচনাবলীর মতো,
শেক্সপিয়র রচনাসমগ্রের মতো,
পড়তে পড়তেও মনে হয়
ঠিক মতো বুঝলাম কিনা,
পড়তে পড়তেই মনে হয়
পড়ে শেষ করা
মুশকিল…
এরপরে একসাথে কাজ কারতে গিয়ে আরো অনেকবার তাকে নতুন করে আবিস্কার করেছি। এবং বুঝতে পেরেছি, হি হিমসেল্ফ ইজ লার্জার দ্যান লাইফ। তিনি রবীন্দ্ররচনাবলীর মতো, শেক্সপিয়র রচনাসমগ্রের মতো, পড়তে পড়তেও মনে হয় ঠিক মতো বুঝলাম কিনা, পড়তে পড়তেই মনে হয় পড়ে শেষ করা মুশকিল। শুধু এটুকু বুঝেছিলাম, তাকে পাঠ করবার এই প্রক্রিয়া চলবে।
কারণ, তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙতেন, গড়তেন, বদলাতেন, আপগ্রেড করতেন। যে কারণে প্রতিবারই তাকে নতুন মনে হতো, আধুনিক মনে হতো, তরুণতর মনে হতো, ফ্রেশ মনে হতো। তরুণরা যেমন তাকে পছন্দ করতো, তেমনি তরুণদেরও তিনি পছন্দ করতেন। ভাবনার আদান-প্রদানে নিজেকেও এগিয়ে নিতেন। নতুন প্রযুক্তি, নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তার সাথে পাল্লা দিয়েই তিনি এগিয়ে থাকতেন সবসময়। আবার তরুণদের সাথে পাল্লা দেয়ার নিজের এই চেষ্টাকে তিনি শিং ভেঙে বাছুর হওয়ার চেষ্টা বলেও স্যাটায়ার করতেন।
ভাবনার বিষয়, চলচ্চিত্রের বিষয়, বা শিল্পে তুলে আনবার বিষয় হিসেবে ৩টি বিষয়ের প্রতি তারেক ভাইয়ের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। বিষয় ৩টি হলো– মুক্তিযুদ্ধ, নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। শুধু তার মুখ থেকে শোনা নয়, তার কাজের দিকে তাকালেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমান ভাবেই। মুক্তির গান থেকে শুরু করে শেষদিকের নির্মাণ নরসুন্দর কিংবা রানওয়েসহ প্রতিটি নির্মাণেই এই বিষয়গুলোর যে কোনো একটি, কখনোবা একাধিক বিষয়ের উপস্থিতি দেখা যায়।

অবশ্য বিষয় ভাবনা হিসেবে এর প্রতিটি বিষয়ই এতো ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে, একটি মাত্র ছবিতে তার সামান্যই তুলে আনা সম্ভব হয়। প্রতিটি বিষয়ই এই ভূখণ্ডের সামগ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতির সকল অনুসর্গ এবং উপসর্গের সাথে সম্পৃক্ত। আর একজন সমাজ সচেতন চলচ্চিত্রকারের তখন দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাকে যথার্থভাবে শিল্পে তুলে আনবার।
…চলচ্চিত্র ছিল তার
সমাজ ভাবনা, তার
রাজনৈতিক বক্তব্য
এবং
দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের
মাধ্যম…
তারেক ভাইয়ের কাছে চলচ্চিত্র শুধু চলমানচিত্র ছিল না, চলচ্চিত্র ছিল তার জীবনচর্চার অংশ। চলচ্চিত্র ছিল তার সমাজ ভাবনা, তার রাজনৈতিক বক্তব্য এবং দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম।
একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, চলচ্চিত্রকার না হলে কী হতেন? বলেছিলেন, হয়তো লেখক হতাম। লেখালেখি কম করতেন বলে এক ধরনের যন্ত্রণা ছিল তার মাঝে। তবু আমরা যা পেয়েছি, তার দিকে তাকালেও আমরা তারেক মাসুদ নামের মহিরূহটি দেখতে পাই। তিনি বলেছেন অনেক, অনেকের কাছে। তার সেসব কথামালা ছাপার অক্ষরে বিভিন্ন দৈনিকে, সাময়িকীতে প্রকাশও হয়েছে অনেক। এবার বই আকারেও সংকলিত হয়ে আসছে। চলচ্চিত্রযাত্রা ছিল তার চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখার সংকলন। চলচ্চিত্রলেখা হচ্ছে তার সকল চিত্রনাট্য ও গানের সংকলন। দুটি বই-ই প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। আগামি ডিসেম্বরে প্রকাশিত হবে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তার চলচ্চিত্রবিষয়ক বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারের সংকলন। নাম– চলচ্চিত্রকথা। প্রকাশিত হবে কথাপ্রকাশ থেকে।
ফেরা চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে সময় ধারন করা আছে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার কথামালা। সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য ৪০ মিনিট নিয়ে নির্মিত হয়েছে, ফেরা। গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েই সেখানে তার বক্তব্য আছে। শেষ সময়টায় দেখেছি, শুধু লিখবার জন্যে নয়, বলবার জন্যেও ছটফট করেছেন তিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, তার সব কথা আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
সত্যজিৎ রায়ের সাথে আব্বাস কিয়ারোস্তামির একটি বিশেষ মিল আছে। দুজনেই চলচ্চিত্র নিয়ে সক্রিয় ছিলেন ৪০ বছর কাল এবং নির্মাণ করেছেন সর্বসাকূল্যে ৩৯টি করে নানাধরনের নানা দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। প্রসঙ্গক্রমে, দুজনেই তারেক ভাইয়ের প্রিয় চলচ্চিত্রকার।
চলচ্চিত্র নিয়ে তারেক ভাইয়ের সক্রিয় সময়কাল ৩ দশক। ৩ দশকে সব মিলিয়ে তার সর্বমোট নির্মাণ ২০টির মতো। নির্মাণাধীন এবং পরিকল্পনায় যা ছিল, সে অনুযাযী আর ১ দশক বেঁচে থাকলে তার নির্মাণও হয়তো ৩০ পেরুত। এই ২০টি নির্মাণে আমরা কী পেয়েছি, সকলেই সেটা জানি। তবুও পূনঃপাঠের প্রস্তুতি হিসেবে আসুন আরেকবার চোখ বোলানো যাক–
আমরা পেয়েছি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র: আদম সুরত, মুক্তির গান, মুক্তির কথা, নারীর কথা, শিশুকন্ঠ, নিরাপত্তার নামে, অন্য শৈশব, কানসাটের পথে, আহ আমেরিকা এবং কৃষ্ণনগরে একদিন। এর মাঝে শেষোক্ত দুটি যৌথনির্মাণ। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে পেয়েছি– সে এবং নরসুন্দর। এর মাঝে সে যৌথনির্মাণ।
পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র পেয়েছি– মাটির ময়না, অন্তর্যাত্রা এবং রানওয়ে। এছাড়াও কয়েকটি বক্তব্যধর্মী মিউিজিক ভিডিওর পাশাপাশি রয়েছে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের অ্যনিমেশন ম্যুভি। এর একটির নাম, গণতন্ত্র মুক্তি পাক; আরেকটির নাম, ইউনিসন। এর মাঝে ইউনিসন আলাদাভাবে খানিকটা আলোচনার দাবী রাখে।
…আইকনগুলোর মতো
সাউন্ডও
একটা থেকে ধীরলয়ে
আরেকটায়
বিবর্তিত হয়ে যায়…
ভারতের একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অনুরোধে উৎসবরে লোগো ফিল্ম হিসেবে এর নির্মাণ। ১৯৯১-এ সে ফেস্টিভালে আদম সুরত চলচ্চিত্রটি বিশেষ সম্মাননা পায়। সে বছর ভারতে দাঙ্গায় যখন বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা মাথায় রেখে সেটি তৈরি হয়। এর নির্মাণকাল ১৯৯২। তার মানে, অ্যনিমেশন প্রো সফ্টওয়ারে এটি প্রথম প্রজন্মের নির্মাণ। যেখানে দেখা যায়, সব ধর্মের যত আইকন আছে, সেগুলো একটা থেকে আরেকটায় মডিফায়েড হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে। শুধুমাত্র, চাঁদতারা, ত্রিশুল, ক্রিসেন্ট আর ক্রস নয়। অসংখ্য আইকন। এগুলো একটা অর্ডার থেকে আরেকটা অর্ডারে বিবর্তিত হতে থাকে। সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর হিসেবে আছে সব ধরনের ধর্মীয় চ্যান্টস্। এর মধ্যে আযান যেমন আছে, তেমনি আছে কীর্তনের সুর; বুড্ডিষ্ট চ্যান্ট যেমন আছে, তেমনি আছে গ্রেগরিয়ান চ্যান্ট, জুডায়িক চ্যান্ট। আইকনগুলোর মতো সাউন্ডও একটা থেকে ধীরলয়ে আরেকটায় বিবর্তিত হয়ে যায়।

ঐ আইকনগুলোর সমন্বয়ে একটা মাদার আইকন তৈরি করেছিলেন ক্যাথরীন। যেটা একটা লোগার মতো, নিউমোনিকের মতো। সেই লোগো দিয়ে একটা পোস্টার হয়েছিল এবং তাদের ভিজিটিং কার্ডও তৈরি করেছিলেন। বলা প্রয়োজন, তারেক ভাই ও ক্যাথরীন দুজনে একই ভিজিটিং কার্ড ব্যবহার করতেন। যার একপাশে ছিল তারেক ভাইয়ের নাম, আরেকপাশে ক্যাথরীনের। লোগোসহ সেই কার্ডটি নিশ্চিত ভাবেই একটা স্টেটমেন্টও বহন করে, যেখানে তার বিশ্বাস, তার চিন্তা ও দর্শনেরও বিশেষ প্রতিফলন থাকে।
এবার আমরা যদি একে এক তার আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দিকে তাকাই, তাহলে প্রথমেই আসে আদম সুরত।
প্রসঙ্গ : আদম সুরত
আদম সুরত তারেক ভাইয়ের প্রথম নির্মাণ। ১৯৮২-তে শুরু করে শেষ করতে পেরেছিলেন ৮৯-তে। মূলত আর্থিক কারণেই এই দীর্ঘসময়। কিন্তু সেটি হয়তো অন্যগল্প। এতদিনে সেটি আমরা সকলেই জানি।
আমরা যদি জানতে চাই, কেন তিনি সুলতানকে নিয়ে তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন, সে প্রশ্নের উত্তরও তিনি দিয়ে গেছেন। নিজের লেখায় তিনি বলেছেন, সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ভাগে শিল্প-সংস্কৃতির সব শাখায় নতুন করে শিকড় সন্ধানের ব্যষ্টিক ও ব্যক্তিক উদ্যোগ দেখা যায়। শুধু শিকড় নয়, প্রতিটি মাধ্যমে নতুন শিল্পভাষা সৃষ্টির তাগিদও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। চিত্রকলার বিমূর্তপ্রধান আধুনিকতাবাদী গণ্ডিকে অতিক্রম করে একদল প্রতিভাবান তরুণ চিত্রশিল্পী মূর্ততার দিকে ফিরে গিয়ে আখ্যান নির্মাণে কেবল স্পেস নয়, সময়কেও ধারন করবার উদ্যোগ নেন। আর ওদিকে চলচ্চিত্র মাধ্যমটি তখনো শিকড়বাকরহীন। এর শুধু ভিত ও ভাষা নয়, পুরো মাধ্যমটির খোল-নলচে বদলানো জরুরি হয়ে পড়েছিল। ফলে সুলতানকে নিয়ে ছবি বানানো কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ বা একক ভাবনার ফল নয়। তখন বেশ কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্রকর্মী সুলতানকে নিয়ে ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখছিলেন।
…সমাজ ও সময়
একজন শিল্পীকে
বদলে দেয়ার
ঢের
শক্তি রাখে…
তারেক ভাই বলেছিলেন, যখন শিল্পী সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন, তখন অনেক গুণীজন প্রশ্ন করেছেন, জীবিত-মৃত আরো এত খ্যাতিমান শিল্পী থাকতে কেন সুলতান? অনেকটা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো তাকে উত্তর দিতে হয়েছে সেসবের। উনি বলেছেন, “সুলতানকে নিয়ে ছবি করতে চাই এ কারণে নয় যে, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। বরং এ কারণে যে, তথাকথিত উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া কৃষিপ্রধান একটি দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃৃতিক প্রেক্ষাপটে সুলতানের জীবন ও কর্ম প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার কৃষকসমাজ একজন বড় শিল্পীকে মহৎ শিল্পীতে পরিণত করেছে। একজন শিল্পী তার সমাজকে বদলানোর যে ক্ষমতা রাখেন, তার চেয়ে বরং সমাজ ও সময় একজন শিল্পীকে বদলে দেয়ার ঢের শক্তি রাখে। সুলতান তার দৃষ্টান্ত।”

তারেক ভাই অনেক জায়গাতেই উল্লেখ করেছেন, শুটিংয়ের আগে আদম সুরত-এর জন্যে প্রথাগত কোনো চিত্রনাট্য ছিল না। একটা ভাবনা, একটা গাইডলাইন ছিল মাত্র। সিদ্ধান্ত ছিল, ছবিটি সুলতানের জীবনীনির্ভর হবে না। শিল্পীর একক জীবন বৃত্তান্ত বলবার জন্যে ছবি নির্মাণ নয়। ছবিটি হবে সুলতানের চোখ দিয়ে দেখা বাংলার কৃষি ও গ্রামীণ সংস্কৃতি। যে কারণে ছবিটির টাইটেলেই সুলতানের জীবন পরিচিতির পাট চুকিয়ে দেয়া হয়।
নিজের লেখায় তারেক ভাই বলছেন, “আমি যখন ছবিটি শুরু করি, তখন নাগরিক সমাজে সুলতান কিংবদন্তির মতো। তাকে নিয়ে তখন প্রচুর মিথ প্রচলিত। তার অতীত এমনকি বর্তমান জীবন নিয়ে অতিমানবীয় গল্পের শেষ নেই। আমি এই মিথের মিথ্যাকে এড়িয়ে, বর্ণাঢ্য অতিপ্রাকৃতিক ভাবমূর্তি ছাড়িয়ে শিল্পীর বাস্তবজীবন ও শিল্প অন্বেষণের সিরিয়াস দিকটার প্রতি নজর দিতে চেয়েছি।”
…ছবি থেকে জীবন
অনেক বড়। সেটা
দেখার জন্যে
ক্যামেরার
প্রয়োজন নেই…
তবে সুলতান নিজেও সারাক্ষণ তার দিকে ক্যামেরা তাক করা অবস্থাটি পছন্দ করতেন না। বলতেন, বাংলার কৃষকই হচ্ছে আসল। আমাকে সেখানে একজন ক্যাটালিস্ট হিসেবে রাখতে পারো। সুলতান বলতেন, ছবি থেকে জীবন অনেক বড়। সেটা দেখার জন্যে ক্যামেরার প্রয়োজন নেই। সে কারণে ছবি নির্মাণের সময় শুটিংয়ের চেয়ে বেশি সময় নির্মাতাদল সুলতানের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে কাটিয়েছেন। কখনো মেলায়, কখনো বিজয় সরকারের বাড়িতে লোকজ গানের আয়োজনে, কখনো কৃষকের উঠোনে, ক্ষেতখামারে।
ছবিতে এক জায়গায় আমরা সুলতানের মুখে শুনতে পাই, “দেশের কর্মক্লান্ত মানুষের জীবনটা বড় দুর্বিসহ এবং সময়ের বিভিন্ন চাপে ওরা নিষ্পেষিত। সারাদিন খেটেও ২ সের চাল উপার্জন করতে পারে না। তাতে যদি আমি বাংলার কৃষককে আঁকতে যাই, তাহলে খুব গরীব, জীর্ণ শীর্ণ আঁকতে হয়। কিন্ত আমার চোখে আর আমার চিন্তায় আমি ওদের জীর্ণশীর্ণ দেখতে চাই না। ওরা সময়কে ফেস করতে পারে, স্ট্রগল করতে পারে, সেইজন্য ওরা প্রস্তুতও থাকে। সেই জন্যেই আমার ছবিতে ওরা পেশীবহুল, যা প্রমাণ করে– ওরা ঠিকই সুস্থ আছে, সবল আছে। কিন্তু নানা মাধ্যমে একটা প্রহসন চলছে ওদের নিয়ে। তাই আমিও ওদের মাসলটা আরো বড় করি, আরো মজবুত করি।”
আর তারেক ভাই বলছেন, “আদম সুরত ছবিটা বানাতে গিয়ে আমি যতই বাস্তবতাবর্জিত কাজ করে থাকি না কেন, সুলতানের মতো এমন আলোকপ্রাপ্ত মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকা ও চলার ফলে আমার যে আত্মোন্নয়ন ঘটেছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। শুধু গ্রামবাংলা নয়, শিল্প সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা আমার মধ্যে বিকশিত হয়েছে। নিজের মধ্যে এক ধরনের স্থৈর্য এসেছে, আত্মবিশ্বাস জন্মেছে এবং একটুকুতেই ভেঙে না পড়ার শক্তি জন্মেছে। তাছাড়া শিল্পী সুলতানের সংস্পর্শে আসায় আমার মধ্যে খুব দ্রুত চলচ্চিত্রকার হওয়া এবং নাম বা যশের পেছনে দৌড়ানোর যে মানসিকতা, সেটা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি।”
তিনি আরো বলছেন, “আমি এখনো পেশাদার চলচ্চিত্রকার নই। প্রতিবছরই একটার পর একটা ছবি আমি বানাই না। বরং আমার উপলব্ধিতে যে বিষয়টি নাড়া দেয়, সে বিষয়ের উপর সময় নিয়ে শুদ্ধভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করি। একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে এই যে এক ধরনের উপলব্ধি তৈরি হয়েছে, সেটাকে আমি তুলনামূলকভাবে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করি।”
ফলে আদম সুরত কেবল মাত্র সুলতানের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র নয়, একই সাথে গ্রাম বাংলার কৃষকদের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আসলে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নিজেকেও নির্মাণ করেছেন। প্রস্তুত করেছেন।

মুক্তির গান, মুক্তির কথা ও নারীর কথা : ট্রিলজি
বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শুধুমাত্র কাহিনীচিত্রেরই ট্রিলজি নির্মিত হয়েছে-হচ্ছে, এমন নয়। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রেরও ট্রিলজি আছে। এর মাঝে, কাটসি ট্রিলজি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি। গডফ্রে রেজিও নির্মিত কাটসি ট্রিলজির ছবি ৩টি হচ্ছে– কয়ানিসকাস্তি, পাওয়াকাস্তি ও নাকাওয়াকাস্তি। যে ছবিগুলোর সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন রন ফ্রিক। যিনি পরবর্তীকালে বারাকা নামে নিজে আরেকটি অসাধারণ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।
মুক্তির গান, মুক্তির কথা এবং নারীর কথাও এক ধরনের ট্রিলজি। ডকুমেন্টারি ট্রিলজি। এর মাঝে একটি ধারাবাহিকতা যেমন আছে, তেমনি ৩টি চলচ্চিত্র একসাথে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল।
তারেক ভাই বলতেন, ৩টিকে একসাথে ট্রায়াড বলা যায়। থিসিস, এন্টিথিসিস ও সিনথেসিস। এই ট্রায়াডের তত্ত্ব জার্মান দার্শনিক হেগেলের চিন্তা থেকে উৎসারিত বলে ধারণা করা হয়। তবে প্রচারিত হয় আরেক দার্শনিক জোহান ফিচতের উচ্চারণে।
…ট্রায়াড মেথডের কথা
মনে রেখে আমরা যদি
৩টি চলচ্চিত্রকে একসাথে
আরেকবার দেখতে বসি,
হয়তো
নতুন করে ইতিহাস পাঠের
অভিজ্ঞতা হতে
পারে…
ট্রায়াড থিওরিকে আরেকভাবে ডায়ালেকটিক্যাল মেথডও বলা হয়। যা ৩টি বিমূর্ত বিষয়ের মাঝে আর্ন্তসম্পর্কের স্বরূপকে চিহ্নিত করে। যা বিশ্লেষণ করা হয় এইভাবে, থিসিস হচ্ছে– বিগিনিং প্রপোজিশন। এন্টিথিসিস হচ্ছে– নেগেশন অফ দ্যাট থিসিস। আর সিনথিসিস হচ্ছে– রিকনসিলড অফ দ্যাট টু কনফ্লিক্টিং আইডিয়া। সে অনুযায়ী মুক্তির গান যদি থিসিস হয়, তাহলে মুক্তির কথা হচ্ছে এন্টিথিসিস এবং নারীর কথা হচ্ছে সিনথেসিস। ৩টি প্রামাণ্যচলচ্চিত্রের মাঝে মুক্তির গান হয়তো সকলেরই দেখা। মুক্তির কথাও অনেকেরই। নারীর কথা হয়তো সকলের নয়। এই ট্রায়াড মেথডের কথা মনে রেখে আমরা যদি ৩টি চলচ্চিত্রকে একসাথে আরেকবার দেখতে বসি, হয়তো নতুন করে ইতিহাস পাঠের অভিজ্ঞতা হতে পারে।

তারেক ভাইয়ের সুযোগ হয়েছিল, পাকিস্তানে মুক্তির গান ও মুক্তির কথা একসাথে প্রদর্শনের। সেখানে তিনি যে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, সেটা তাকে একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এরপর থেকে দেশে মুক্তির গান-এর যতো প্রদর্শনী হয়েছে, চেষ্টা করেছেন ৩টিকে একসাথে ধারাবাহিকভাবে প্রদর্শনের।
অন্যদিকে। ৩৫ মিলিমিটারে তার প্রথম প্র্যাকটিসিং ফিল্ম ছিল– সে। নির্মাতা শামিম আখতারের সাথে এটি যৌথনির্মাণ। নগর সংস্কৃতিতে একজন শিক্ষিত নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার, নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জনের গল্প। ৩৫ মিমি ফিল্মে সাদাকালোয় নির্মিত ছবিটির দৈর্ঘ্য ৯ মিনিট। এটি ছিল দুজন নির্মাতারই ৩৫ মিলিমিটারে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ। অল্প কয়েকটি শটে, খুবই সীমিত সংলাপ ও শব্দের প্রয়োগে মিনিমালিস্ট ভঙ্গিতে গল্প বলে যাওয়া।
তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেলে তার বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই এখন দেওয়া আছে। যে কেউ যে কোনো সময় এখন সেসব দেখে নিতে পারেন।
প্রসঙ্গ: মাটির ময়না
মাটির ময়নাকে অনেকেই তারেক ভাইয়ের আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র হিসেবে দেখছেন, পাঠ করছেন, লেখছেন। গণমাধ্যমে এ কথাটাই বেশি প্রচারিত। কিন্তু তারেক ভাই নিজে সবসময় বলবার চেষ্টা করেছেন, এটা তার আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র নয়। বরং এটা তার শৈশবের স্মৃতি-অভিজ্ঞতা ভিত্তিক চলচ্চিত্র। এক ধরনের কামিং টার্মস উইথ চাইল্ডহুড ট্রমা। এখানে নির্মাতা তারেক মাসুদ ও কিশোর আনুর মধ্যে সম্পর্কটা হচ্ছে শৈশবের সাথে বয়োপ্রাপ্ত মানুষের বোঝাপড়া।
…রোকনের কাছে
হয়তো
পুরো পৃথিবীটাই
মাদ্রাসার মেটাফর…
আত্মজৈবনিক হলে আনুর চরিত্রটি প্রোটাগনিষ্ট বা প্রধান চরিত্র হবার কথা। কিন্তু এখানে আনু প্রেটাগনিষ্ট নয়, ক্যাটালিস্ট একটি চরিত্র। তারেক ভাই বলতেন, মিরর ক্যারেক্টার। আনুর চরিত্রটি ঘটনাবহুল নয়, ভয়ার। যে অনেকটা লেন্সের মতো। যার চোখ দিয়ে দর্শক সবকিছু দেখতে পায়। আনু যখন মাদ্রাসায় যায়, তখন মাদ্রাসা দেখতে পাই। আনু যখন নৌকা বাইচ দেখতে যায় বা চড়ক পূজায় যায়, তখন সেসব দেখতে পাই। সে যখন বাজারে যাচ্ছে, মিটিং মিছিল, রাজনৈতিক উত্তাপ দেখছে সেটা তাকে স্পর্শ করছে। তবে তিনি মনে করতেন, আনুর চেয়ে আনুর বন্ধু রোকন এখানে অনেক নাটকীয় ও প্রধান ভূমিকায় উপস্থিত। সেখানে আনুর নিজের জীবন ও তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা চারপাশের মধ্যে কিছুটা তার প্রতিফলন থাকতেই পারে। কিন্তু রোকন যেভাবে তার প্রতিপার্শ্বকে দেখছে, তাতে হয়তো গোটা পৃথিবীটাই একটা মাদ্রাসা হিসেবে ধরা দেয়। মানুষ যেভাবে এখানে ক্ষুধার বিরুদ্ধে, দারিদ্রের বিরুদ্ধে, জরার বিরুদ্ধে লড়ছে, রোকনও সেখানে লড়ছে। রোকনের কাছে হয়তো পুরো পৃথিবীটাই মাদ্রাসার মেটাফর। সে মাদ্রাসার হুজুরের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। সে হয়তো বিপ্লব করছে না; কিন্তু সারভাইব করছে।

মাটির ময়নার ব্যাকড্রপে আছে মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ আনুকেও মাদ্রাসার বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিয়েছে। তবে রোকনের কী হয়, আমরা তা জানি না। মাটির ময়নার শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, আনুদের গ্রামে পাকসেনাদের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। আনুদের বাড়িতেও তারা আগুন দেয়। আনু এবং আনুর মা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও আনুর বাবা সে ভগ্নস্তুপের মাঝেই থেকে যান।
তারেক ভাই বলেন, এই অংশটুকুও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। বাস্তবজীবনে তার বাবাকে পরদিন পালাতে কনভিন্স করতে পেরেছিলেন। কিন্তু মাটির ময়নায় ইচ্ছে করেই আনুর বাবাকে ওখানে রেখে ছবি শেষ করেছিলেন, যাতে তার প্রতি দর্শকের অনুকম্পা তৈরি হয়। উনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আগে আমি যে মানুষটা ছিলাম, নয় মাস পরে আমি অনেকটা বদলে গেছি। জাতির ক্ষেত্রেও কিন্তু একই হয়েছে। একটা জাতি ইনটেনসিটির দিক দিয়ে নয় মাসের মধ্যে নয় বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।”
মাটির ময়না নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচুর লেখালেছি হয়েছে। মাটির ময়না নিয়ে কলকাতায় বসবাসকারী কানাডিয়ান ফিল্ম স্কলার ফাদার গাস্তন রর্বেজেরও একটি লেখা আছে। সেটা কলকাতার একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মাটির ময়না ভারতে মুক্তির সময়ে ফাদার প্রেস কনফারেন্সে এসেছিলেন। পরে আমরা যখন ওনার সাথে দেখা করতে যাই, তখন সেই লেখাটি আমাদের দিয়েছিলেন। কলকাতায় থাকাকালীন সময়েই আমি সেটা অনুবাদ করেছিলাম। যেটি পরে প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপা হয়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, মাটির ময়না হয়তো পথের পাঁচালির প্রতি তারেক মাসুদের শিল্পিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। পথের পাঁচালির সাথে মাটির ময়নার চরিত্র ও গঠনগত একটি মিলের কথাও তিনি উল্লেখ করেছিলেন সে লেখায়। যেমন অপুর সাথে মিল রয়েছে আনুর। রয়েছে একটি বোন যে পরে মারা যায়। দুজনের জীবনেই বাবা থেকেও যেন অনুপস্থিত। মায়ের সেই নিরন্তর সংগ্রাম। এরপর এক ধরনের মুক্তি।
এ সম্পর্কে তারেক ভাইয়ের নিজেরও বক্তব্য ছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “গল্প নির্বাচনে আমি কল্পিত কাহিনীর উপর ভরসা না করে নিজের জীবনের দিকে গিয়েছি। পথের পাঁচালীর গল্পের সঙ্গে আমার নিজের জীবনের অনেক মিল আছে। তবে পথের পাঁচালী হিন্দু নিম্নমধ্যবিত্তের পাঁচালী, ওখানে গোটা বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্তের পাঁচালীটা নেই। থাকা সম্ভবও নয়। বাকি বাংলার যে গল্প, বিশেষ করে মুসলমান বাঙালি নিম্নবিত্তের যে গল্প, সেই গল্পের খণ্ডাংশ হলেও মাটির ময়নায় উঠে এসছে। যেটা পথের পাঁচালীতে পাওয়া যায় না। অতএব দুটোর মধ্যে একটা মিউচ্যুয়াল এক্সক্লুসিভনেস আছে, অর্থাৎ, একটার মধ্যে যা নেই, আরেকটার মধ্যে তা আছে। অনেকটা সম্পূরকের মতো। পথের পাাঁচালীর অপুর লড়াই আর আনুর লড়াইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু দুটো মিলে যদি আপনি দেখেন, তাহলে পূর্ণাঙ্গ বাংলার, বৃহত্তর বাংলার একটা ছবি উঠে আসতে পারে।”

প্রসঙ্গ : অন্তর্যাত্রা
তারেক ভাইয়ের বেশিরভাগ ছবিতেই রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমি খুব গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সে অনুযায়ী অন্তর্যাত্রা ছবিটি খানিকটা ব্যতিক্রম। সেখানে সমাজ ও রাজনৈতিক পটভূমির চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক সম্পর্ক, মানবিক সম্পর্ক এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেক বেশি দৃশ্যমান। এবং সেটাও বড় ক্যানভাসে নয়, একটি পরিবারের তথা প্রবাসী মা ও ছেলের কয়েকদিনের জন্যে দেশে ফেরার গল্প অন্তর্যাত্রা। অর্থাৎ, এটা যতোটা না ভৌগোলিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক অভিযাত্রা। চলচ্চিত্রে যে জার্নিটি সারাক্ষণ চলতে থাকে, সেটা বাহ্যিক জার্নির চেয়ে অনেক বেশি অন্তর্গত।
আরেকটি তথ্য হলো হলো, ডিজিটাল ফরম্যাটে নির্মিত এটি বাংলাদেশের প্রথম ছবি। তারেক ভাই ফরম্যাট নিয়ে সবসময় নীরিক্ষা করতে পছন্দ করেছেন। নতুন যে ফরম্যাটই এসেছে, সেটা তিনি আগে ব্যবহার করে দেখতে চেয়েছেন– এ থেকে নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সৃজনশীল স্বাধীনতা প্রয়োগ কতো বেশি ঘটানো যায়।
অন্তর্যাত্রা সম্পর্কে তারেক ভাই নিজে বলেন, “আমাদের অন্য চলচ্চিত্রগুলো থেকে অন্তর্যাত্রা একটু ভিন্নতর হলেও একদিক থেকে অভিন্নতাও রয়েছে। আমাদের সব ছবিতেই প্রধান যে সুরটি থাকে, সেটা হলো– শেকড় সন্ধান। এক ধরনের ইতিহাসচারিতা, এক ধরনের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন খোঁজা। সেটা মুক্তির গান হোক, মাটির ময়না হোক আর অন্তর্যাত্রা হোক, সবগুলোর মধ্যেই একটা কমন অ্যাট্রিবিউট। অন্তর্যাত্রায় আত্মপরিচয়– বিশেষ করে অভিবাসী জীবন এবং সে জীবনের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট ও এক ধরনের সম্ভাবনা ছবির মূল বিষয়। এক ধরনের স্থানচ্যুতি যেমন এ ছবির বিষয়, তেমনি শেকড়ের প্রতি টানও আরেকটি ব্যাপার।”
…একইসঙ্গে
সেন্স অব বিলংগিং
এবং
সেন্স অব আউটসাইডার,
এই দুটি পরস্পরবিরোধী
দোলাচলের মধ্যে আমাদের
অভিজ্ঞতা
নিহিত…
অন্তর্যাত্রা নিয়ে তারেক ভাই তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে এর সংযোগের ব্যাপারটিও শেয়ার করেছেন। এ ছবির সহ-পরিচালক এবং সহ-চিত্রনাট্যকার ক্যাথরীন মাসুদ। তিনি প্রায় ২ দশকের বেশি সময় এ দেশে। ফলে এক অর্থে সাংস্কৃতিকভাবে এখানেই তার শিকড় প্রোথিত হয়ে পড়েছে। আবার তার জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্রও তার জন্যে একটি বাস্তবতা। এই যে একইসঙ্গে সেন্স অব বিলংগিং এবং সেন্স অব আউটসাইডার, এই দুটি পরস্পরবিরোধী দোলাচলের মধ্যে আমাদের অভিজ্ঞতা নিহিত।
তারেক ভাই বলেন, “আমি যখন নিউইয়র্কে ছিলাম, তখন বিদেশে থাকার কারণে দেশকে বোঝার ও ভালোবাসার একটা বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছিল। এই এক্সট্রা পারস্পেক্টিভটা শুধু অন্তর্যাত্রার ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত, তা নয়; মাটির ময়নাও হয়তো তা রয়েছে। আমি দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় মাটির ময়নার চিত্র্যনাট্য যদি রচনা না হতো, তাহলে যে দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আমার দেশ, আমার সংস্কৃতি, এবং আমার শৈশবকে দেখেছি, মাটির ময়নায় সেভাবে হয়তো দেখা হতো না। তাই অন্তর্যাত্রা শুধু সোহেল বা শিরিনের অন্তর্যাত্রা নয়, আমার এবং ক্যাথরীনেরও অন্তর্যাত্রা।

প্রসঙ্গ : রানওয়ে
যদি রানওয়ের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে বিতর্ক হতে পারে এর বিষয় নিয়ে, বিতর্ক হতে পারে এর গল্প নিয়ে, গল্পের কাঠামো নিয়ে, গল্পের বিস্তৃৃতি নিয়ে। বহুমাত্রিকতা তারেক ভাইয়ের আরেকটি শক্তিমত্তার দিক। যদি একটি বিষয় বা চরিত্রকে কেন্দ্র করে বহুর্মুখী বিষয়ের উপর আলো ফেলা যায়, ক্ষতি কী! একটি টেক্সটকে অনেকগুলো সাবটেক্সটসহ ব্যাখ্যা করবার প্রবণতা আমরা তার কাজে দেখতে পাই।
রানওয়ে একটি পরিবারের গল্প। পরিবারকে ঘিরে বাংলাদেশের গল্প। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক সঙ্কট, ক্ষুদ্র ঋণ, পোষাক শিল্পের অস্থিরতা, ধর্মের নামে রাজনৈতিক হানাহানি, বোমাবাজি– এ তো আমাদের দৈনন্দিন বিষয়। এর পেছনে যেসব আর্থ-সামাজিক কারণ, আর্ন্তজাতিক ঘটনাবলীর প্রভাব, কারণের পেছনে যে কারণ– সেসব বিষয়েও আলো পড়ে সহজেই। সে সবগুলো বিষয় নিয়েই আমাদের দিনযাপনের ইতিহাস লেখা হচ্ছে মহাকালের ডায়েরিতে। এই সবকিছুর একটি সমন্বিত শিল্পরূপ আমরা দেখতে পাই রানওয়ে ছবিতে।
…নেতিবাচক বিষয়ের বিপরীতে
জীবনের সৌন্দর্য
কতটা প্রতিভাত হয়েছে,
সেটাই এখানে
মুখ্য হতে পারে…
রানওয়ের গল্পের একটি বৃহৎ জায়গা জুড়ে আছে কেন্দ্রীয় চরিত্র রুহুলের ধর্মনির্ভর উগ্র রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়া এবং তাদের ভেতরকার স্বরূপ আবিস্কারের বিশ্বাসযোগ্য চিত্রায়ণ। তাদের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া, ট্রেনিং, আত্মঘাতী বাহিনীর কর্মকাণ্ডের দৃশ্যপট রয়েছে বলেই একে জঙ্গিবাদবিষয়ক বা, জঙ্গিবাদবিরোধী ছবি বলে ফেলাটা অতিসরলীকরণ হয়ে যায়। বরঞ্চ নেতিবাচক বিষয়ের বিপরীতে জীবনের সৌন্দর্য কতটা প্রতিভাত হয়েছে, সেটাই এখানে মুখ্য হতে পারে।
রানওয়ের গল্প ও চরিত্রের বিন্যাস আমাদেরকে আরো দুটি ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়, অনায়াসে। তার প্রথমটি, একই নির্মাতার, মাটির ময়না। সেখানে বারো-তেরো বছরের যে আনুকে দেখি ৭১ সালে, মাদ্রাসায় পড়া সে আনু হয়তো ২০০৪ এর গল্পে আরেকটু বড় হতো। সেক্ষেত্রে রানওয়ের রুহুলের যে পরিণতি, তার চাইতে ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। মায়ের সে একাকিত্ব আর নিজস্ব সংগ্রাম এখানেও বলবৎ। বাবার দায়িত্বহীনতা, ছোটোবোনের অসহায়ত্ব এখানেও বর্তমান। রানওয়ের গল্পটা সামান্য একটু বদলে নিলে অনায়াসে মাটির ময়নার সিক্যুয়াল হয়ে উঠত।
রানওয়ে একইসাথে আবারো পথের পাঁচালীর কথাও মনে করিয়ে দেয়। এখানেও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াই। অপু আর দুর্গা এখানে রুহুল আর ফাতেমা। হরিহরের মতো বাবা এখানেও অনুপস্থিত, অর্থ উপাজর্নের নিমিত্তে অন্যত্র অবস্থান। বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুন এখানে বৃদ্ধ দাদা। মায়ের নিরন্তর সংগ্রাম এখানেও চলছে। শুধু সময়টা ভিন্ন, অবস্থান ভিন্ন, সঙ্কটগুলো একই। সময় হয়তো বদলাচ্ছে, সময়ের রঙ বদলাচ্ছে, এই উপমহাদেশিক জীবনের যে অর্ন্তগত বৈশিষ্ট্য, সামাজিক মূল্যবোধের যে সুর, পারিবারিক জীবনাচরণের যে বিধি সেটা এখনো একইভাবে বর্তমান।
…তারেক ভাইয়ের প্রধান
শক্তিমত্তার দিকগুলোর
আরেকটি– তার
পরিমিতিবোধ…
চলচ্চিত্রকে রন্ধন শিল্পের সাথে তুলনা করে দেখতে চেয়েছেন অনেক বোদ্বা। নির্মাতা এখানে প্রধান পাচকের ভুমিকায়। সকল উপাদানের পরিমাণমতো ব্যবহার এবং যথাসময়ে আঁচ উস্কে না দিলে যেমন ব্যাঞ্জনটি স্বাদের হয় না, তেমনি যথাসময়ে আঁচ নামিয়ে না আনলেও সেটি নষ্ট হবার আশঙ্কা থাকে। যখন সময়জ্ঞান ও পরিমিতিজ্ঞানের সফল সমন্বয় ঘটে, তখনি সে ব্যাঞ্জনটি উপাদেয় হয়ে উঠে সকলের কাছে; এবং পাচক পান শিল্পীর মর্যাদা। তারেক ভাইয়ের প্রধান শক্তিমত্তার দিকগুলোর আরেকটি– তার পরিমিতিবোধ। বাস্তবতা এখানে সত্য প্রকাশে তৎপর; অথচ এর প্রকাশ কখনো রূঢ় হয়ে ওঠে না। আবেগ এখানে অর্ন্তজগতকে ছুঁয়ে যায়, তবে কখনো স্যাঁতস্যাতে হয়ে ওঠে না। কৌতুকপূর্ণ বিদ্রূপ এসে সূক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে যায়, হাসি কখনো বেয়াড়া হয়ে ওঠে না। চাপাকান্না এসে জমতে থাকে বুকের ভেতর, তরল প্রকাশে গলে গলে পড়ে না। অভাব এসে থমকে দাঁড়ায় রুহুলদের দরজায়, আরোপিত উপোস এসে বেঁচে থাকা রুদ্ধ করে রাখে না। একটি বিরাজমান সমস্যাকে গভীর থেকে দেখবার অন্তর্দৃষ্টি, সমাজ ও সময়ের পুরো চেহারাটা পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা ও তাকে শিল্পে তুলে আনবার যথার্থ কৌশল– সবই নির্মাতার করায়ত্ত।
≈≈≈

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নিয়েও একটি ট্রিলজি নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তারেক ভাইয়ের। নরসুন্দর— সে ট্রিলজির দ্বিতীয় গল্প। নরসুন্দর-এ আমরা যে সেলুন ম্যানেজারকে দেখি মুক্তিযোদ্ধা তরুণকে বাঁচিয়ে দেয়, প্রিক্যুয়াল গল্পটি ছিল তার কিশোর বেলার গল্প। দেশভাগের সময় সে তার পরিবারের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে আসে। তখন এমনিভাবে এক রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার তাকে বাঁচিয়ে দেয়। আর নরসুন্দর-এর প্রিক্যুয়াল গল্পটির প্রাথমিক ভাবনা ছিল ৯০-এর গণআন্দোলনের সময়ের। তবে প্রিক্যুয়াল গল্পটির মূল ভাবনা এক পৃষ্ঠায় সিনোপসিস আকারে লেখা থাকলেও, সিক্যুয়ালের গল্পটির ভাবনা কখনো লেখা হয়নি।
তারেক ভাইয়ের চেষ্টা থাকত, প্রতিবার বড় কোনো প্রজেক্টে হাত দেওয়ার আগে সেই টিম নিয়ে ছোট কোনো প্রজেক্ট করা। তারেকে ভাই সেটাকে ওয়ার্ম-আপ প্রজেক্ট বলতেন। সেই ওয়ার্ম-আপ প্রজেক্টের অংশ হিসেবে নির্মিত হয় নরসুন্দর। আমার সুযোগ হয়েছিল এর পাণ্ডুলিপি তৈরির প্রথম খসড়া থেকে ছবি নির্মাণের শেষ ধাপ ক্রেডিট টাইটেল লেখা পর্যন্ত প্রধান সহযোগী হিসেবে পাশে থাকবার।
…কাজের দিকে থেকে
প্রতিটা সৃজনশীল মানুষের
৩
ধরনের পরিকল্পনা থাকা
উচিত…
তারেক ভাই বলতেন, কাজের দিকে থেকে প্রতিটা সৃজনশীল মানুষের ৩ ধরনের পরিকল্পনা থাকা উচিত। স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী। এবং এই বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনারও অপশন থাকতে পারে। সে অনুযায়ী কাগজের ফুল-এর নির্মাণ কাজ যখন পর পর ২ বার পিছিয়ে দিতে হয়, তখন তিনি উদ্যোগ নেন রানওয়ে নির্মাণের। রানওয়ে যেহেতু বিকল্প অপশন হিসেবে এসেছে, তাই এটাকে বলতেন– অন্তরবর্তীকালীন প্রজেক্ট।
পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, যদি কাগজের ফুল কোনো কারণে আরো একবার পোস্টপন্ড করতে হয়, তাহলে নতুন একটি প্রজেক্ট হাতে নেবেন। সেটি হবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরেকটি পূর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র। প্রাথমিক ভাবে গল্প নির্বাচন করা ছিল আগে থেকেই। তবে সেটি বলা বারণ ছিল বলে, আজো অনুক্তই থাকুক।
অসমাপ্ত কাজসহ নির্মাণ পরিকল্পনার তালিকায় যা ছিল, তাও খুব ছোটো নয়। ভাষা আন্দোলন এবং সংখ্যালঘু উচ্ছেদের ওপর ২টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রায় অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তার পরিকল্পনায় ছিল বাংলাদেশের উৎসব নিয়ে একটি পুর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের। স্বপ্ন ছিল, ৩ “দিন/দ্বীন”-এর উপর একটা তথ্যচিত্র নির্মাণের। অর্থাৎ, জয়নুল আবেদীন, জসিমউদদীন এবং আব্বাস উদ্দীনের উপর। কোন স্বপ্ন ও পরিকল্পনা সফল হতো, কোনটা হতো না– আমরা জানি না। কিন্তু আমরা হারিয়েছি স্বপ্ন দেখবার মানুষটাও।
≈≈≈

তারেক ভাই বলতেন, “একজন সমাজসচেতন চলচ্চিত্র নির্মাতার কাজ হচ্ছে, দর্শকের মনে অস্বস্তি তৈরি করা। প্রশ্ন তৈরি করা। প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দর্শক আরো কিছুক্ষণ বসে থাকবে। হাততালি দিতে ভুলে যাবে। কী যেন নেই, কী যেন থাকার কথা ছিল, অথবা নিশ্চিত হতে না পারা একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে খানিক বাদে ভ্রূ কুঁচকে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাবে। সে ভাবনাটা হয়তো পরবর্তী কয়েকদিন তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে।”
মাটির ময়না বোধহয় তেমনই একটি চলচ্চিত্র, শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এর রেশ থেকে যায়। বুকের ভেতর খানিকটা শূন্যতা এসে ভর করে। প্রদর্শনী শেষে হাততালি দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু ভাবনার খোরাক হাতে আসে অনেক। রানওয়ে বোধহয় ভাবনার খোরাক যোগায় আরেকটু বেশি। রানওয়ে হয়তো এই অন্ধ-বন্ধ সময়ের ভিস্যুয়াল মেটাফর।
…শিল্পের সবগুলো শাখা
যেখানে এসে
মিলিত হয়, সেটি
চলচ্চিত্র…
আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন চলচ্চিত্র আমরা প্রতি দশকে একটার বেশি পাই না। সবাই আমাদের বিনোদন দিতে চায়। কেউ গলা ফাটিয়ে বিনোদন দিতে চায়, কেউ শরীর দেখিয়ে বিনোদন দিতে চায়, কেউ সুড়সুড়ি দিয়ে বিনোদন দিতে চায়, কেউ অস্ত্রের হিংস্রতা আর রক্তারক্তি দেখিয়ে বিনোদন দিতে চায়। বেশির ভাগ আবার এর সবকিছু একসাথে মিশিয়ে ঘোল বানিয়ে বিনোদন দিতে চায়। তবে পরিণত মানুষের বিনোদন যে পরিণত চিন্তার আশ্রয়ে হতে পারে, এ কথা বোধহয় সবাইকে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। শিল্পের সবগুলো শাখা যেখানে এসে মিলিত হয়, সেটি চলচ্চিত্র। এটাকে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম মনে করা হলে এর শক্তিমত্তার দিকটিকে অস্বীকার করা হয়। যা আসলে হয়তো বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা। আর এই উপমহদেশে এখনো প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পূর্বে জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হয়। আমাদের নির্মাতাদের মনে রাখতে হবে, জাতীয় পতাকা প্রদর্শণের পর আমি আসলে পর্দায় কী দেখাতে পারি।
একজন নির্মাতার ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠার পথে যে যাত্রা, যে নিরন্তর সংগ্রাম, সে সংগ্রাম তার একান্ত নিজস্ব হলেও তা থেকে যে প্রাপ্তি ঘটে, তা অন্য সকলের। তার সমাজের, তার দর্শকের, তার সহযোগীসহ সকলের। কিন্তু পরিণত হয়ে ওঠার পর যখন তার সবচেয়ে ক্ষুরধার কাজটি করবার সময় আসে, আর তখনই যদি সে হারিয়ে যায়, সে ক্ষতিটাও আসলে সকলের। তারেক মাসুদ বোধহয় পরিণত হয়ে ওঠার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। এই দেশে একজন সৃজনশীল মানুষ যতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। তার সৃজনশীল উচ্চতার সর্বোচ্চ প্রকাশ হয়তো ঘটতো দেশভাগের গল্প নিয়ে তার শেষ নির্মাণ কাগজের ফুল-এ। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হলাম।

সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজির মতো একটা অসাধারণ ট্রিলজি নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তারেক ভাই। সেই ভাবনা থেকেই কাগজের ফুল-এর বীজবপন। এটা হতো প্রিক্যুয়াল। জানতে চেয়েছিলাম, “যখন মাটির ময়নার সিক্যুয়াল নির্মাণ করবেন তখন কোন গল্পটা বেছে নেবেন?” প্রথমবার বলেছিলেন, “এতদিন কী বাঁচবো?” উত্তরের জন্যে নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিলাম। “যদি বাঁচেন, তাহলে কোন গল্পটা বেছে নেবেন?” চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলেছিলেন, “মাটির ময়নার আনুর বড় হয়ে ওঠার গল্প। আমার যৌবনের গল্প।” সেই যৌবনের গল্প আমরা কিছুটা জেনেছিলাম। মাদ্রাসার ছাত্র মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধে। তারপর একদিন সে হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র নির্মাতা। সিনেমার মতোই গল্প। অথবা, গল্পের চেয়ে বেশিকিছু। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হলাম সেই ট্রিলজি থেকে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যোগ হওয়ার মতো আরো দুটি স্বর্ণপালক আগস্টের সেই বৃষ্টির দিনে মহাসড়কের পিচঢালা পথে মাহাপ্রাণের সাথে মিলিয়ে গেলো।
…ফিল্মমেকিং ইজ আ
আগলি প্রসেস
হুইচ ইন্টেন্ডিং টু
ক্রিয়েট আ গ্রেটার
বিউটি…
গত বছর চলে গেলেন তারেক ভাইয়ের আরেক প্রিয় নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামিও। যাকে আমাদেরও অনেকর চেনা হয়েছিল তারেক ভাইয়ের চোখ দিয়ে। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামির একটি কথা তারেক ভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল। কিয়ারোস্তামি বলেছিলেন, “ফিল্মমেকিং ইজ আ চেইন অব লাই, হুইচ ইন্টেন্ডিং টু ক্রিয়েট আ গ্রেটার ট্রুথ।” কিয়ারোস্তামির এই কথাটি তারেক ভাই রিফ্রেজ করে বলতেন, “ফিল্মমেকিং ইজ আ আগলি প্রসেস হুইচ ইন্টেন্ডিং টু ক্রিয়েট আ গ্রেটার বিউটি।” বলবার জায়গা থেকে দুজনের পার্সপেক্টিভ ভিন্ন হলেও দুটো কথাই প্রয়োজনীয়, দুটো কথাই তাদের অভিজ্ঞতাজাত সৃজনশীল অভিজ্ঞান। নিজেদের কাজটুকু করতে গিয়ে তাদের এসব কথার আক্ষরিক প্রমাণ আমরা সবসময়েই পেয়ে যাচ্ছি।
≈≈≈

কম লিখতেন বলে এক ধরনের যন্ত্রণা ছিল তারেক ভাইয়ের মাঝে। আমরাও প্রয়োজনীয় বিষয়ে তার লেখা পাওয়ার জন্যে যন্ত্রণাটা মাঝে মাঝে উস্কে দিতাম। তিনি সেটা উপভোগই করতেন। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে যেমন তিনি সময় নিতেন অনেক, তেমনি গুছিয়ে লিখবার বেলায়ও সময় নিতেন বেশ। অসংখ্য সংশোধনীর পর একেকটি লেখা প্রকাশের জন্যে তৈরি হতো। প্রকাশিত লেখা এবং নির্বাচিত সাক্ষাৎকার নিয়ে বেশ কয়েকবার প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েও সময়ের অভাবে শেষ পর্যন্ত গুছিয়ে উঠতে পারেননি। কাগজের ফুল দ্বিতীয়বার স্থগিত হওয়ার কারণে ২০০৯-এর শেষভাগে কিছুটা অবসর পাওয়া যায়।
গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে তখন অনেক কথা বলতেন। যার প্রতিটি কথাই প্রামাণ্যকরণের উপযোগী এবং প্রয়োজন বলে মনে হতো। সেই অবসরে উদ্যোগ নিই একটি সাক্ষাৎকারধর্মী প্রকাশনার, যেখানে তার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ও কাজের ক্ষেত্র নিয়ে সমগ্র জীবনটাই ধরবার প্রয়াস থাকবে। সেই প্রকাশনার প্রয়োজনে শুরু হয় শব্দধারনের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার গ্রহনের কাজ। সেই প্রক্রিয়া যখন মাঝামাঝি, তখন হঠাৎই বিশেষ প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে তার। ততদিনে একটি প্রকাশনী সংস্থার সাথে প্রাথমিক চুক্তিপত্র হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার দিনক্ষণ যখন চূড়ান্ত, তখনই একদিন ভাবনাটা আসে– লিখিত সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি একটি ভিস্যুয়াল সাক্ষাৎকারও আমরা ধারন করবো। যেটি ডিভিডি আকারে বইয়ের সাথে প্যাকেজের অন্তর্ভূক্ত হবে। তবে সেই ভিস্যুয়াল সাক্ষাৎকার বাসায় বসে নয়, গৃহীত হবে যাত্রাপথে। সে ভাবনা থেকেই নির্মিত হয়, ফেরা।
দিনটি ছিল ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর। বৃষ্টিস্নাত এক ভোরবেলা আমরা সেই মাইক্রোবাস নিয়ে রওনা হই তারেক ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে তিনি কথা বলেন– তার ছেলেবেলা, তার মাদ্রাসাজীবন, প্রথম ঢাকায় আসার স্মৃতি, ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট হওয়া এবং চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার গল্প। বলেন, সুলতানের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে নতুন করে গ্রামকে আবিস্কার করবার গল্প। ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টিপাতের মধ্যে স্পিডবোটে পদ্মা পার হতে হতে তিনি সেলফোনে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা ক্যাথরীনের সাথে। ভাঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে তিনি বাবা-মার সাথে কথা বলেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের খোঁজখবর নেন। দুপরের আহার-পর্ব শেষে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুরু হয় ফেরার পথে যাত্রা।
ঢাকায় ফিরতে ফিরতে তিনি কথা বলেন চলচ্চিত্রের নানা অনুসঙ্গ নিয়ে। কথা বলেন– ডিজিটাল চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা, সিনেপ্লেক্সের প্রয়োজনীয়তা, উপমহাদেশের চলচ্চিত্র বিনিময় ও ট্যাক্সপ্রথা, ভবিষ্যতের চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুতসহ দেশীয় চলচ্চিত্রের নানা সঙ্কট ও সম্ভাবনার বিষয়ে। যাওয়া-আসার দীর্ঘ ১১ ঘন্টার ভ্রমণকালীন সময়ে তার সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার মতো। সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য ৪০ মিনিটের সংকলন নিয়ে নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র ফেরা। তার মৃত্যুর প্রায় ২ বছর আগে ধারণকৃত এই সাক্ষাৎকারটি কখনো মূল্যবান তথ্যচিত্র হয়ে উঠবে– এমন ভাবনা কখনো মাথায় আসেনি। এটি অবশ্যই তারেক মাসুদ নামের মহিরূহকে সামগ্রিকভাবে ধারন করে না। এটি একদিনের ভ্রমণে তার মূল্যবান কথোপকথনের নির্যাস মাত্র। তবে তারেক মাসুদকে জানবার জন্যে, তার সৃষ্টিকর্মকে জানবার জন্যে, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট নানাবিষয়ে তার ভাবনা ও মতামতকে পাঠ করবার জন্যে এটি একটি আলোর রেখা হতে পারে বৈকি।
…মানুষের শেকড়
অনেক
জায়গায়
প্রোথিত হয়…
যাত্রাপথে তিনি বলছিলেন, “মানুষের শেকড় অনেক জায়গায় প্রোথিত হয়। সেই শেকড়ের টানে আমরা সবসময় কোথাও না কোথাও যাচ্ছি, কোথাও না কোথাও ফিরছি।” কারো কারো জন্যে সেই ফেরা হয়ে ওঠে অনন্তকালের। কারো কারো ফিরে যাওয়া বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্যে তৈরী করে গভীর শূন্যতা। সেই শূন্যতার পথ ধরে যে আলোকরশ্মি আসে, সেই আলোর পথ ধরে আমরাও পথচলি অন্য কোথাও ফিরবো বলে।

শেষ কথা
দুর্বল অবকাঠামোর ভিড়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি তারেক মাসুদকে। কিন্তু তার স্পিরিট আছে সবখানে। তিনি তার কাজে এবং জীবনযাপনে যেভাবে বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করতেন, যেভাবে সকলকে একসাথে ধারণ করতেন, তাকেও আমরা ধারণ করি সকলে। তাকে পাঠের এই প্রক্রিয়া আসলে চলমান। তিনি বলতেন, “সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা হচ্ছে রিলে-রেসের মতো। এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে যায়।” তারেক মাসুদকে পাঠের এই প্রক্রিয়ায়ও একপ্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে নিশ্চয়।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।