লিখেছেন । তারেক মাসুদ
সৌজন্যে • তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট
প্রাচীন সিনেমা মরে গেছে– সিনেমা দীর্ঘজীবী হোক! আমাদের চলচ্চিত্র-জগৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার প্রধান ও একমাত্র কারণটি হলো আমাদের সিনেমা-শিল্পের পুরো কাঠামো আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায়। আশা করি, ধ্বংসের ছাই থেকে একটি ফিনিক্সের উত্থান হবে। তথাকথিত ‘বাণিজ্যিক ছবি’ আর বাণিজ্যিকভাবে সফল নয়। নতুন বোতলে পুরনো মদ খাইয়ে মানুষকে আর বোকা বানানো যাবে না। এমনকি রিকশাঅলা দর্শকেরাও সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করেছে। ফলাফল হচ্ছে, এফডিসিতে প্রতিবছর বানানো ৮০টির মতো ছবির প্রায় ৮০ শতাংশ তার মূলধন ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিবছর এত ছবি তৈরি হওয়ার একমাত্র কারণ দুর্নীতির মাধ্যমে সিনেমাকে দেওয়া সরকারের অঘোষিত ভর্তুকি। কিন্তু এই শিল্পটি যে কেবল ভেতরে ভেতরেই ক্ষয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, একে অনেক বাইরের বিপদও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একদিকে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের ‘আকাশ সংস্কৃতি’ ক্রমপ্রসারিত হয়ে সিনেমার বাঁধা দর্শকদের সরিয়ে নিচ্ছে; অন্যদিকে আছে বেসরকারি ও স্বাধীন উদ্যোগে তৈরি সিনেমা, দর্শকেরা যেগুলো সিনেমা হলে গিয়ে দেখতে পছন্দ করছে। তাই সিনেমা-শিল্পের পতন মানেই সবকিছুর শেষ নয়, বরং এটা নতুন আশাবাদের একটা লক্ষণ। চলচ্চিত্রের নতুন করে বেঁচে ওঠার অনেক প্রতিশ্রুতি চোখে পড়ছে।

ছোট পর্দা বড় হচ্ছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ছবি প্রযোজনার উদ্যোগ। গত বছর কেবল একটি চ্যানেলই প্রায় এক ডজন ছবি প্রযোজনা করেছে; আরও এক ডজন আসতে যাচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে একটি বিকল্প সিনেমা-শিল্প প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়ায় বহু পুরনো প্রজন্মের চলচ্চিত্রকার, যারা হতাশা ও ক্লান্তিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিলেন এত দিন, তাঁরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। একই সঙ্গে অনেক তরুণ মানসম্পন্ন নির্মাতা, যাঁরা কেবল টেলিভিশনের জন্য ভিডিও ফরম্যাটের নাটক বানিয়েই তাঁদের চলচ্চিত্র বানানোর পিপাসা মিটিয়ে এসেছেন, তাঁরাও বড় পর্দায় কাজ করার একটা সুযোগ পাচ্ছেন। বাইরের দেশগুলোয় প্রযোজনার ভার নিয়ে ভালো ছবি তৈরিতে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর গর্বিত ইতিহাস আছে। ১৯৬০-এর দশকে জার্মান টেলিভিশন ভেরনার হেরজগ, ফাসবিন্ডার, ভিন ভেন্ডার্সের মতো চলচ্চিত্রকারদের সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়ে একটি বিশ্বখ্যাত আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ছবি বানানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলোর প্রতিশ্রুতিশীল ভূমিকার ব্যাপারে অতি-আশাবাদী হওয়ার আগে কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে। প্রথমত, একটা গল্পকে কেবল সেলুলয়েডে তুলে আনলেই তা সিনেমা হয় না। চলচ্চিত্রকারদের ছবি বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও অর্থ দিতে হবে, না হলে তাঁরা কেবল টিভি ধারাবাহিক অথবা নাটককে বড় পর্দায় রূপান্তর করে ফেলবেন। এর পাশাপাশি প্রযোজনার জন্য ছবি নির্বাচনের বেলায় শক্ত কিছু শর্ত মেনে চলা প্রয়োজন, যেন টেলিভিশন প্রযোজিত ছবিগুলো এফডিসির মেলোড্রামার আরেকটি সংস্করণ হয়ে না দাঁড়ায়।

উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা
একসময়ের প্রথাগত প্রযোজকেরা যখন ‘ভালো’ সিনেমার জন্য কলকাতার দিকে তাকিয়ে আছেন, আশার কথা হলো নতুন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বাধীন ছবিতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অঞ্জন চৌধুরীর মতো শিল্পোদ্যক্তা লালসালুর মতো মানসম্পন্ন ছবিতে সরাসরি জড়িত হয়েছেন। আরও একধরনের পরোক্ষ বিনিয়োগ আছে, যেমন টেলিভিশনে স্বাধীন ধারার ছবির প্রচারে করপোরেট বিজ্ঞাপন। অবশ্যই উদ্যোক্তারা লাভ চাইবেন এবং আমাদের যত্নশীল হতে হবে যেন এই বাড়তে থাকা আগ্রহ অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়।

নতুন স্পৃহার নতুন প্রজন্ম
ইতিমধ্যে একটি নতুন প্রজন্ম সিনেমা বানাতে আসছে, আশা করা যায় তারা চলচ্চিত্রের অঙ্গনে উজ্জ্বল মেধার দীপ্তি ছড়াবে। প্রযুক্তি তাদের পক্ষে; এক দশক আগেও ছবি তৈরির উপায়গুলো ছিল ব্যয়বহুল ও দুষ্প্রাপ্য। ছবি বানাতে আগ্রহী তরুণদের সুযোগ ছিল খুব সীমিত। কিন্তু আজ স্বল্প মূল্যের এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য ডিজিটাল ফরম্যাটের ক্যামেরা এবং ছবি সম্পাদনার জন্য পিসিতে ব্যবহারোপযোগী সস্তা সফটওয়্যার সহজলভ্য হওয়ায় আগ্রহী তরুণদের জন্য ছবি নিয়ে নিরীক্ষা করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। কম্পিউটার-শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম অ্যানালগ উপকরণগুলোর ঝামেলা থেকে মুক্ত, এবং অন্যান্য দেশে যা ঘটছে বাংলাদেশেও তা হচ্ছে– ডিজিটাল ছবি নির্মাণ মূল জায়গাটা দখল করছে।

সিনেমা-কাম-শপিং কমপ্লেক্স
ছবি প্রযোজনায় অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনব্যবস্থার পরিবর্তনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক দশকে সিনেমা-শিল্পের পাশাপাশি সিনেমা হলগুলোর অবক্ষয় ঘটলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আশাব্যঞ্জক পরিবর্তনও ঘটেছে। প্রথমত, স্বাধীন ধারার ছবির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলাফল হিসেবে কিছু পুরনো ভেন্যু, যেমন ‘বলাকা’ সিনেমা হল মধ্যবিত্ত দর্শকদের জন্য নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স উদ্বোধনের মাধ্যমে অন্য দেশগুলোয় খুবই সফল হওয়া শপিং কমপ্লেক্স-কাম-সিনেপ্লেক্সের ধারণা অবশেষে বাংলাদেশেও জায়গা করে নিতে পেরেছে। আশা করা যায়, এটা একটা ধারাবাহিক প্রবণতার শুরু মাত্র। মধ্যবিত্তের সর্বভুক ও বর্ধিষ্ণু চাহিদা মেটানোর জন্য শপিং কমপ্লেক্স তৈরির পাশাপাশি এই দর্শকগোষ্ঠীর বিনোদন ক্ষুধা মেটানোর দিকটাও ভেবে দেখা দরকার।

বর্ধিষ্ণু দর্শক
যদিও রাজধানীর কয়েকটা হলেই এখনো ব্যাপারটা সীমিত, তারপরও দীর্ঘদিনের হল-বিমুখ দর্শকদের বিনোদনের পুরনো আশ্রয় সিনেমা হলে ফেরার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু স্বাধীন ধারার ছবির সফলতার পর ছবির পুরনো পৃষ্ঠপোষক নারী তাঁর পরিবারসমেত অনেক দশকের বিচ্ছেদ কাটিয়ে হলে ফিরছেন। ফলাফল হিসেবে সিনেমা হলগুলো নিজেদের মেরামতে আগ্রহী হয়েছে, যাতে তারা আগ্রহী দর্শকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কেবল দেশীয় দর্শকই বাড়ছে না, গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ছবি বাইরের পৃথিবীতেও ছড়িয়ে পড়েছে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ‘আর্ট হাউস’ ছবির যথাযোগ্য বাজারেও পা রাখছে। এই বৃহত্তর সীমানাবিহীন বাজারের কথা মাথায় রেখে প্রযোজকেরা তাঁদের আর্থিক বিনিয়োগের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে আরও আগ্রহী হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ইরানের চলচ্চিত্রের সাফল্য একটি দৃষ্টান্ত।

রাষ্ট্রীয় সহায়তা
এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় যে আমি যে কয়েকটি আশা জাগানো লক্ষণ তুলে ধরলাম, তার একটিও সরকারের তরফের নয়। অনেক দেশেই চলচ্চিত্রকারেরা উৎসাহ ও সহযোগিতা পাওয়ার জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারের হস্তক্ষেপ কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা সব সময়ই যেন মৃত্যুর চুম্বনের মতো। এফডিসি ও জাতীয় আর্কাইভস তার বড় উদাহরণ। যখনই কোনো সরকার সিনেমাকে উৎসাহিত করতে কিংবা সিনেমা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়তে সক্রিয় হয়েছে, তখনই দুর্যোগ নেমে এসেছে। যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি তারা যত্নশীল হতে গেছে, তাদের আগ্রহ সেই প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরানি, ফরাসি কিংবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় ভর্তুকিপ্রাপ্ত ছবির সফলতার উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারটা মাপা যাবে না। এটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের অদক্ষতা আর অযোগ্যতা থেকে তৈরি একটি সমস্যা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকার সিনেমা থেকে যত দূরে থাকে ততই মঙ্গল। গত কয়েক বছরে চলচ্চিত্র যতটুকু সম্মান ও গৌরব দেশের জন্য বয়ে এনেছে, পুরোটাই রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের তৈরি প্রতিকূলতা আর বাধা ডিঙিয়ে। আপাতবিরোধী হলেও এই প্রতিকূলতাই হয়তো চলচ্চিত্রকারদের সাফল্যের জন্য আরও বেশি প্রেরণা জুগিয়েছে এবং স্থির সংকল্প করেছে।
গ্রন্থসূত্র • চলচ্চিত্রযাত্রা/ তারেক মাসুদ । প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ । ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট-এর অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত