কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী । কিস্তি-১

630
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া [২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮]। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন রশোমন, সেভেন সামুরাই, ড্রিমসসহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের এই পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদটি, কুরোসাওয়া কথা শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে এনটিভি অনলাইন-এর শিল্প ও সাহিত্য বিভাগে…

প্রিয় শৈশব

য়াশটাবে ন্যাংটো ছিলাম আমি। জায়গাটি ছিল আধো আলো-আঁধারিতে ভরা। গরম জলে ভেজা ছিল আমার শরীর। টাবের কোণা ধরে দোল খাচ্ছিলাম। টাবটির নিচের দিকটি দুটি স্লপিং বোর্ডের ওপর ঝুলানো; দোলা দিতেই জলোচ্ছটার মৃদু শব্দ তৈরি হচ্ছিল। শরীরের সব শক্তি দিয়ে, টাবটি দোলাতে থাকলাম। আচমকাই উল্টে গেল সেটি। আমার নগ্ন ত্বকের সঙ্গে ভেজা ও পিচ্ছিল জায়গাটির একটি সংবেদনশীলতা, এবং মাথার ওপরে বেদনাদায়ক কোনো উজ্জ্বল কিছুর দিকে তাকাতে চাওয়ার সেই মুহূর্তটিতে ঘাবড়ে যাওয়ার ও হতভম্ব হয়ে পড়ার এক ভীষণ অবিস্মরণীয় স্মৃতি আমার মনে আছে।

বোধগম্যের বয়সে পৌঁছানোর পর, এই ঘটনাটির স্মৃৃতি হরহামেশাই আমার মনে পড়ত। কিন্তু এটিকে নিজের কাছেই তুচ্ছ ব্যাপার বলে মনে হতো; ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগপর্যন্ত এ কথা আমি কাউকেই বলিনি। মাঝখানে সম্ভবত বিশ বছরের মতো কেটে যাওয়ার পর একদিন মাকে সেদিনের সেই সংবেদনশীল অনুভূতিগুলোর কথা বলেছিলাম। মুহূর্তেই আমার দিকে চোখ বড়-বড় করে তাকিয়েছিলেন তিনি; তারপর জানিয়ে দিলেন, এ ঘটনাটি সম্ভবত তখনকার, যখন আমার বাবার জন্মভিটা আকিতা প্রিফেকচার এলাকার উত্তরাঞ্চলে দাদার এক স্মরণসভায় যোগ দিয়েছিলাম আমরা। আমার বয়স ছিল তখন এক বছর।

আধো আলো-অন্ধকারের সেই জায়গাটিতে দুটি বোর্ডের মধ্যে স্থাপিত যে টাবটিতে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, সেটি ছিল রান্নাঘর ও স্নানঘর– উভয় ঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হওয়া সেই বাড়িটির সেই রুম– যে বাড়িতেই জন্মেছিলেন বাবা। মা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গোসল করাতে; কিন্তু আমাকে টাবের গরম পানিতে নামিয়ে রেখে, নিজের কিমোনো [লম্বা ঝুলওয়ালা ঢিলেঢালা জাপানি পোশাক] খুলে আসতে পাশের ঘরে গিয়েছিলেন তিনি। আচমকাই তিনি শুনতে পান, আমি তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছি। তিনি পড়িমরি ছুটে এসে আমাকে আবিষ্কার করেছিলেন, টাব থেকে পড়ে গিয়ে ফ্লোরে লুটোপুটি খাওয়া অবস্থায়। মাথার ওপর বেদনাদায়ক উজ্জ্বল, রৌদ্রদীপ্ত যে বিষয়টির কথা বলেছিলাম, মা জানালেন, যখন আমি শিশু ছিলাম, তখন এ ধরনের একটা ঝুলন্ত ওয়েল-ল্যাম্প সাধারণত ঝুলিয়ে রাখা হতো।

তিন বছর বয়সে, বড়ভাইয়ের সঙ্গে কুরোসাওয়া

ওয়াশটাবের এই ঘটনাটি আমার মনে গেথে থাকা নিজ জীবনের একেবারেই প্রথম স্মৃতি। স্বভাবতই, নিজের জন্মমুহূর্তের স্মৃতি আমার মনে নেই! আমার সবচেয়ে বড় বোন, যিনি এখন আর বেঁচে নেই, তিনি অবশ্য প্রায়শই বলতেন, “তুমি ছিলে একটা আজব বাচ্চা!” দৃশ্যত কোনো রকম শব্দ না করেই মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম আমি; কিন্তু আমার হাতদুটো একসঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। সবাই যখন হাত দুটোকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, আমার দুই হাতের তালু হয়ে গিয়েছিল ক্ষত-বিক্ষত।

আমার ধারণা, এই গল্পটি হয়তো মিথ্যে। আমাকে ক্ষেপানোর জন্যই হয়তো এই গল্প বানানো হয়েছিল; কেননা, আমি ছিলাম সংসারের সবচেয়ে ছোট সন্তান। তাছাড়া, আমি যদি সত্যিকারঅর্থেই একজন নাছোড়বান্দা মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে থাকি, তাহলে এতদিনে তো আমার কোটিপতি হয়ে যাওয়ার কথা, আর অন্তত একটি রোলস-রয়েস গাড়ির মালিকানা আমার থাকা উচিত ছিল!

জীবনের প্রথম বছরের সেই ওয়াশটাব ঘটনাটির পর, শিশুকালের মাত্র দুয়েকটি ঘটনাই আমি এখন মনে করতে পারি; আর তা যেন ফিল্ম ফুটেজের খানিকটা আউট-অব-ফোকাস ফর্মের মতো করেই। এ সবই যেন আমি দেখি আমার নার্সের কাঁধে মাথা রেখে, নিজের নাবালক দৃষ্টিশক্তির ভেতর দিয়ে।

সেই স্মৃতিগুলোর একটি যেন কোনো এক টেলিগ্রামের তারের ভেতর দিয়ে আমার কাছে ধরা দেয়। সাদা পোশাকের লোকগুলো একটা লাঠি দিয়ে একটি বলকে বেদম পেটাচ্ছে, আর সেটির পেছনে ছুটে-ছুটে যাচ্ছে যেন বাতাসে নাচতে নাচতে, ওড়তে ওড়তে; আর বলটির নাগাল পেলেই আবার মেরে ছুটিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য কোনোদিকে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, এ দৃশ্যটি সেই জিমনেস্টিক স্কুলটির বেসবল ফিল্ডের নেটের আড়াল থেকে আমি দেখেছিলাম, যে স্কুলটির শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা। ফলে বলতেই পারি, এই যে এখনো আমি বেসবল খেলা পছন্দ করি, এর শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত; দৃশ্যতই শিশুকাল থেকেই আমি এই খেলাটি দেখে আসছি।

শিশুকালের আরেকটি স্মৃতি মনে পড়ে; সেটিও দেখেছিলাম আমার নার্সের কাঁধে মাথা রেখে : অনেক দূরে কোথাও আগুন জ্বলছে। আমাদের আর আগুনের মাঝখানে ছিল সুবিস্তৃত এক কালো জলাধার। টোকিওর ওমোরি অঞ্চলে আমাদের বাড়ি; ফলে টোকিও উপসাগরের ওমোরি সৈতকেই সম্ভবত ঘটেছিল ব্যাপারটি; আর যেহেতু আগুনটি অনেক দূরে জ্বলছিল, সে ক্ষেত্রে এটি সম্ভবত হানেদার [এখনকার হিসেবে এ জায়গাটি টোকিওর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টগুলোর একটি] কাছাকাছি ঘটেছিল। এত দূর থেকেও আগুন দেখে আমি ভড়কে গিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। এখনও আগুন আমার ভীষণ অপ্রিয় জিনিস; বিশেষ করে, রাতের আকাশে অগ্নিশিখা দেখলেই আমি আতঙ্কে শিউড়ে উঠি।

নার্সের কোলে, শৈশব… [স্কেচটি প্রতীকী]

শিশুকালের আর একটা স্মৃতিই মনে আছে এখনো। এ ঘটনারটির সময়ও আমার অবস্থান ছিল আমার নার্সের কাঁধে মাথা রাখা; ক্ষণে ক্ষণে ছোট্ট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি ঘরে ঢুকছিলাম আমরা। এ ঘটনার বছরের পর বছর ধরে আমার মনে এ স্মৃতি হরহামেশাই উঁকি দিতে বেড়াত, আর আমি অবাক হয়ে যেতাম। তারপর একদিন, শার্লক হোমস যেভাবে কোনো রহস্যের কিনারা করে, ঠিক তেমনিভাবেই যেন বুঝে গেলাম : নার্সটি আমাকে কাঁধে নিয়েই টয়লেটে আসা-যাওয়া করছিলেন। এ কী অপমান রে বাবা!

এ ঘটনার অনেক বছর পর সেই নার্স এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। এসে তিনি যে মানুষটির দেখা পেলেন, সেই আমি ইতোমধ্যেই লম্বায় প্রায় ছয় ফুট আর ওজনে ৬৮ কেজির চেয়েও বেশি হয়ে গেছি। দেখে বললেন, “ও বাবুটা, তুমি কত্ত বড় হয়ে গেছ!” আমার হাঁটু জড়িয়ে ধরে, কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। অতীতে যে অসম্মানটা তিনি আমাকে করেছিলেন, তার প্রতিশোধ নিতে আমি মরিয়া ছিলাম ঠিকই, কিন্তু আচমকাই খেয়াল করলাম, এই বুড়িটিকে চিনতে পারছি না; ফলে তার দিকে উদাসিনভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।

কিছু কারণে, আমার হাঁটতে শেখার ও নার্সারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্যকার সময়কালটির স্মৃতিগুলো আমার শিশুকালের স্মৃতির চেয়ে কম টাটকা হয়ে আছে। এ সময়কালটির শুধুমাত্র একটি দৃশ্যই আমার মনে পড়ে; তবে তা মনে পড়ে এর নানাবিধ প্রকারে।

লোকেশনটি একটি স্ট্রিটকার ক্রসিং। ট্র্যাকের অপর প্রান্তে, বন্ধ রেলওয়ে ক্রসিংটির কাছে আমার বাবা, মা আর ভাই-বোনেরা। এ প্রান্তে আমি একা দাঁড়িয়ে। আমার দিকটির আর আমার পরিবারটির মাঝখানে একটি সাদা কুকুর নিজের লেজ নাড়িয়ে, লাফালাফি করে একবার এদিকে আসছে তো ওদিকে যাচ্ছে। এ কাণ্ডটি বেশ কয়েকবার ঘটানোর পর, কুকুরটি যখন আমার দিকে ফিরে আসছিল, আচমকাই ছুটে গেল এক ট্রেন। আমার চোখের সামনে কুকুরটি কাটা পড়ে গেল; হয়ে গেল দুই টুকরো। সাশিমির [খাবার বিশেষ] জন্য কেটে রাখা টুনা মাছের চিলতেগুলোর মতোই যেন টাটকা লালরঙ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল খুন হয়ে যাওয়া জন্তুটির শরীর।

এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটির পরে ঠিক কী ঘটেছিল– মনে পড়ে না। হয়তো মনে আমি এতটাই অভিঘাত পেয়েছিলাম যে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে পরবর্তীকালে ঝুলিভর্তি, কিংবা কারও কোলে থাকা, কিংবা শিকল-বাঁধা কোনো সাদা কুকুর দেখলেই ঘটনাটি মনে পড়ে যেত। আমার বাবা-মা খুব সম্ভবত আমার চোখের সামনে মরে যাওয়া কুকুরটিই মতোই একটা কুকুর খুঁজছিলেন। আমার বড়বোনদের ভাষ্যমতে, তাদের সেই প্রচেষ্টার প্রতি আমি কোনো সায় দিইনি। অন্যদিকে, সাদা কুকুর দেখামাত্রই আমি পাগলের মতো লাফিয়ে ওঠে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতাম, “না! না!”

সাদা কুকুর না দিয়ে কালো কুকুর আনা যায় না আমার জন্য? সাদা কুকুর দেখলেই আমার কেবল সেই ঘটনাটির কথা মনে পড়ে না? সেই ঘটনার পর ত্রিশ বছরের অধিককাল ধরে লালরঙা মাছে বানানো সাশিমি কিংবা সুশি জাতীয় কোনো খাবার আমি খেতে পারিনি।

চার বছর বয়সে, পরিবারিক ছবিতে, বাবার সামনে দাঁড়িয়ে, মায়ের কোলে হাত রেখে, কুরোসাওয়া…

এই স্মৃতিগুলোই আমাকে পরবর্তী সময়ে শক খাওয়ার মুহূর্তগুলোকে সিনেমায় ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আমার এই স্মৃতির ভিড়ে অনেক বিশ্রী একটা ঘটনাও ছিল : রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজে মোড়ানো মাথায় আমার ভাইয়ের শরীরটি বাড়িতে আনার একটি দৃশ্য। আমার চেয়ে চার বছরের বড় ছিলেন তিনি; তখনো আমি স্কুলে ভর্তি হইনি, তিনি পড়তেন প্রথম কি দ্বিতীয় শ্রেণিতে। জিমনেস্টিক স্কুলে একটা হাই ব্যালেন্স বিমের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়, বাতাসের তোড়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর ঠিক একচুল দূরত্ব থেকে বেঁচে এসেছিলেন সেবার। স্পষ্ট মনে আছে, আমার বড়বোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটজন ভাইয়ার এই রক্তাক্ত অবস্থা থেকে আচমকাই চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, “ওকে শান্তিতে মরতে দাও!” সেই পরিস্থিতির কারণেই এ বাক্যটি তিনি বলেছেন বলে আমার ধারণা। মানুষ বেশিরভাগ সময়ই সংবেদনশীলতা ও মহানুভবতা নিয়ে আমাদের প্রশংসা করে; কিন্তু নিজেদের রক্তের মধ্যে আবেগপ্রবণতা ও উদ্ভটত্বের একটি পরিমাপ আমরা খুঁজে পাই বলেই আমার ধারণা।

মোরিমুরা গাকুয়েন স্কুল সংযুক্ত নার্সারি স্কুলটিতে আমাকে ভর্তি করা হয়েছিল; তবে সেখানকার দিনগুলোর কথা বলতে গেলে আমার কিছুই মনে নেই। শুধু একটা বিষয়ই মনে করতে পারি : আমাদের একটি সবজির বাগান করতে হয়েছিল, এবং আমি চিনাবাদামের চারা রুয়েছিলাম। আমার এমনটা করার কারণ সম্ভবত, সে বয়সে আমার হজম-ক্ষমতা ছিল খুব খারাপ, একসঙ্গে অল্প কয়েকটার বেশি চিনাবাদাম খাওয়ার অনুমতি ছিল না আমার। ফলে নিজে নিজে অনেকগুলো চিনাবাদাম উৎপন্ন করার পরিকল্পনা ছিল নিশ্চয়। তবে চিনাবাদামের চাষ থেকে কোনো ফসল নিজে তুলতে পেরেছিলাম কিনা– মনে নেই।

আমার ধারণা, এ সময়েই জীবনের প্রথম সিনেমা কিংবা “মোশন পিকচার”টি আমি দেখেছিলাম। আমাদের ওমোরির বাড়ি থেকে আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম তাচিয়াইগাওয়া স্টেশনে; সেখান থেকে শিনাগাওয়াগামী এক ট্রেনে চেপে বসেছিলাম, নেমে গিয়েছিলাম আওমোনো ইয়োচো নামের এক স্টেশনে– যেখানে একটা মুভি-থিয়েটার ছিল। সেটির ব্যালকনির একদম মাঝামাঝি সেকশনটি ছিল কার্পেটে মোড়ানো; সেখানকার ফ্লোরে বসে জাপানি স্টাইলে সপরিবারে শো দেখেছি আমরা।

নার্সারি ও প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সেই দিনগুলোতে ঠিক কী সিনেমা দেখেছিলাম– মনে নেই। শুধু এটুকুই মনে আছে, এক ধরনের স্ল্যাপস্টিক কমেডি ফিল্ম ছিল; আর তা আমার বেশ মজাই লেগেছিল। একটি দৃশ্য মনে আছে, যেখানে কারাগারের বিশাল এক দেয়াল বেয়ে একটা লোক পালিয়ে যায়। সে ছাদে উঠে, নিচের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন নালায় লাফিয়ে পড়ে। এটি সম্ভবত ভিক্তোরান জাসি নির্মিত ফ্রেঞ্চ ক্রাইম-অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম জিগোমার-এর [Zigomar contre Nick Carter] দৃশ্য ছিল; ১৯১১ সালের নভেম্বরে জাপানে প্রথমবারের মতো মুক্তি পেয়েছিল ফিল্মটি।

জিগোমার । কুরোসাওয়ার শৈশবে দেখা সিনেমা

আরেকটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে, যেখানে একটি জাহাজে এক বালক ও এক বালিকার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। জাহাজটি ডুবতে বসেছিল; আর কাণায় কাণায় ভরে ওঠা লাইফবোটটির দিকে পা বাড়াতে গিয়ে ছেলেটি দেখতে পায়, মেয়েটি তখনো জাহাজে। মেয়েটির জন্য লাইফবোটে নিজের জায়গাটি ছেড়ে দেয় ছেলেটি, আর নিজে রয়ে যায় জাহাজেই, আর হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাতে থাকে। এটি সম্ভবত ইতালিয়ান উপন্যাস দ্য হার্ট অবলম্বনে নির্মিত কোনো সিনেমার দৃশ্য।

তবে কমেডিই আমার ভালোলাগত। একদিন সিনেমা-হলে গিয়ে আমরা জানতে পারলাম, তারা কোনো কমেডি দেখাবে না; শুনেই আমি কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলাম আর সবাইকে অতীষ্ঠ করে তুলেছিলাম। মনে পড়ে, বড় বোনেরা পরে বলেছেন, আমি এতটাই স্টুপিড ও অবাধ্য হয়ে উঠেছিলাম যে, পুলিশ এসে আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

যাইহোক, সে বয়সে সিনেমার সঙ্গে আমার এই সম্পর্কের অবশ্য পরবর্তীকালে আমার ফিল্মমেকার হয়ে ওঠার কোনো যোগসূত্র রয়েছে বলে আমি মনে করি না। প্রাত্যহিক জীবনের গতানুগতিকতার ভেতর নানাবিধ ও আনন্দদায়ক উদ্দীপনা তৈরি করে দিয়েছিল বলেই কেবল মোশন-পিকচার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা আমি উপভোগ করতাম। দেখতে দেখতে হেসে ওঠতাম, ভড়কে যেতাম, মন খারাপ করতাম আর ভেঙে পড়তাম কান্নায়।

অতীতের পানে তাকিয়ে, আর সেটির ওপর আলো ফেলতে গিয়ে, আমার মনে হয়, সিনেমার প্রতি নিজের বাবার মনোভাব আমাকে আজকের এ অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করানোর পেছনে অনুরাগ ও প্রেরণা জুগিয়েছে। সামরিক ব্যাকগ্রাউন্ডের একজন কড়া লোক ছিলেন তিনি; তবে একইসঙ্গে যখন সিনেমা দেখাটাকে সমাজের শিক্ষিত লোক ঠিক ভালোচোখে দেখত না, তখন তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিয়মিতই সিনেমা দেখতে যেতেন। পরবর্তীকালে অপেক্ষকৃত অধিক প্রতিক্রিয়াশীল সময়ে তিনি অবিচলিতভাবে সমন্বয় করেছেন নিজের এই প্রত্যয়কে যে, সিনেমা দেখতে যাওয়ার মধ্যেও একটি শিক্ষামূলক মূল্যবোধ রয়েছে; তিনি কখনোই বদলাননি।

বাবার চিন্তা-চেতনার আরেকটি দিক আমার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল; আর তা হলো– খেলাধূলার প্রতি তার মনোভাব। আর্মি একাডেমি ছেড়ে আসার পর তিনি একটি জিমন্যাস্টিক স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন, যেখানে তিনি জুডো ও কেন্ডো সোর্ডফাইটিংয়ের মতো শুধুমাত্র ট্র্যাডিশনাল জাপানি মার্শাল আর্টসের জন্যই সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেননি, বরং সব ধরনের খেলাধূলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। জাপানের প্রথম সুইমিংপুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি; এবং বেসবল খেলাকে জনপ্রিয় করার নেপথ্যে কাজ করে গেছেন। সব ধরনের খেলাধূলায় উৎসাহ যোগানোর ক্ষেত্রে তার যে উদ্যম ও আইডিয়া ছিল, সেগুলো আমার সঙ্গে রয়ে যায়। আমি যখন ছোট ছিলাম, ছিলাম খুবই দুর্বল ও রোগাটে। তবু এ নিয়ে অনুযোগের স্বরে তিনি প্রায়শই বলতেন, “তুমি যখন শিশু ছিলে, ইয়োকোজুনা [চ্যাম্পিয়ন সুমো রেসলার] উমেহাতানি তোমাকে কোলে নিয়েছিলেন– যেন তুমি শক্তিমান হয়ে বড় হতে পারো”। আমি তো আমার বাবার সন্তান। আমিও খেলা দেখতে ও খেলাধূলা করতে পছন্দ করি; এবং খেলাধূলাকে আমি একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি নিবেদিত বিষয় হিসেবে অকপটে ধারণ করি। এটি স্পষ্টতই আমার বাবার প্রভাব।

অনুবাদ  রুদ্র আরিফ

প্রথম প্রকাশ • এনটিভি অনলাইন । নিউজ পোর্টাল, বাংলাদেশ । ১৮ মার্চ ২০১৭


আকিরা কুরোসাওয়া
 » এনটিভি অনলাইন-এ প্রকাশিত বাকি কিস্তিগুলো পড়তে ক্লিক করুন » 

কিস্তি-২ • মোরিমুরা গাকুয়েনের প্রাথমিক বিদ্যালয় 
কিস্তি-৩ •  ছিঁচকাঁদুনে
কিস্তি-৪ • ছিঁচকাঁদুনের দ্বিতীয় জার্নাল
কিস্তি-৫ • ঘূর্ণিঝড়
কিস্তি-৬ • কেন্দোর পাঠশালা
কিস্তি-৭ • ওচিয়াই ফেন্সিং স্কুল
কিস্তি-৮ • ক্যালিগ্রাফি
কিস্তি-৯ • মুরাসাকি ও শোনাগন
কিস্তি-১০ • মেইজির সুবাস, তাইশোর শব্দ
কিস্তি-১১ • স্টোরিটেলার
কিস্তি-১২ • অপদেবতার নাক
কিস্তি-১৩ • জোনাকির আলো
কিস্তি-১৪ • কেইকা মিডল স্কুল
কিস্তি-১৫ • লাল ইটের দীর্ঘ এক দেয়াল
কিস্তি-১৬ • ১ সেপ্টেম্বর ১৯২৩
কিস্তি-১৭ • অন্ধকারাচ্ছন্নতা ও মানবতা
কিস্তি-১৮ • ভয়ংকর এক অভিযান
কিস্তি-১৯ • মর্যাদা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

 

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here