অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
১৯৯০ সালের অক্টোবরের কোনো একদিন। সাহিত্যে নোবেলজয়ী, কলম্বিয়ান কিংবদন্তি কথাশিল্পী গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস [১৯২৭-২০১৪], জাপানের টোকিওতে হাজির হয়েছিলেন পাম দি’অর ও অস্কারজয়ী কিংবদন্তি ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়ার [১৯১০-১৯৯৮] সঙ্গে আলাপ করতে। কুরোসাওয়া তখন র্যাপসোডি ইন আগস্ট সিনেমার শুটিংয়ে ব্যস্ত। সেটে বসেই দীর্ঘ আলাপ জমে এই দুই কিংবদন্তির। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকার ২৩ জুন ১৯৯১ সংখ্যায় মুদ্রিত হয় তার চুম্বক অংশ…
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আমি চাই না আমাদের এই দুই বন্ধুর আলাপটিকে পত্রিকার সাক্ষাৎকারের মতো লাগুক; তবে ব্যক্তি আপনার, এবং আপনার কাজের অনেকগুলো দিক নিয়ে জানার ব্যাপারে আমার মধ্যে এক সুতীব্র কৌতূহল কাজ করছে। আলাপের শুরুতে আমি আপনার স্ক্রিপ্ট লেখার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। এর প্রথম কারণ, আমি নিজেও একজন স্ক্রিপ্টরাইটার। আর দ্বিতীয় কারণ, সাহিত্যকর্ম অবলম্বনে আপনি তুখোড় সব সিনেমা বানিয়েছেন, অথচ আমার লেখা অবলম্বনে যে সব সিনেমা বানানো হয়েছে কিংবা কোনো সিনেমা আদৌ বানানো সম্ভব কিনা– সেসব ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
আকিরা কুরোসাওয়া
সিনেমার স্ক্রিপ্টে রূপান্তর ঘটাতে চাই– এমন কোনো মৌলিক আইডিয়া যখন আমি পেয়ে যাই, কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে নিজেকে কোনো হোটেলে বন্দি করে ফেলি। সেই সময়টিতে প্লটটি সম্পর্কে আমার একটা জেনারেল আইডিয়া থাকে, এবং সেটির সমাপ্তি কীভাবে ঘটবে– কমবেশি জানা থাকে তা-ও। ঠিক কোন দৃশ্যটি দিয়ে শুরু করব– তা যদি না জেনে থাকি, সে ক্ষেত্রে আইডিয়াটির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহমানতা অনুসরণ করে যাই।

গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আইডিয়া নাকি ইমেজ– আপনার মাথায় কোনটি আগে আসে?
আকিরা কুরোসাওয়া
আমি তা ঠিকঠাক বলতে পারব না; তবে আমার ধারণা, বিক্ষিপ্ত কিছু ইমেজের সমারোহেই এ সবের শুরুটা হয়ে যায়। অন্যদিকে আমি জানি, এখানে, জাপানে স্ক্রিপ্টরাইটারেরা প্রথমে স্ক্রিপ্টের একটি সামগ্রিক কাঠামো সৃষ্টি করে নেন : সেটির দৃশ্যগুলোকে সাজিয়ে নিয়ে, এবং প্লটটিকে নিয়মনিষ্ঠ করার পরই তারা লিখতে শুরু করেন। তবে আমরা যেহেতু ঈশ্বর নই, ফলে এটিকে আমার কাছে সঠিক রাস্তা বলে মনে হয় না।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আপনি যখন শেক্সপিয়ার কিংবা গোর্কি কিংবা দস্তোয়েভস্কির সাহিত্যকর্ম অবলম্বনে স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, তখনই কি নিজের এই সহজাত কর্মপন্থাটি অবলম্বন করেছেন?
…যে ফিল্মমেকারেরা
আধাআধিভাবে সিনেমা বানান,
তারা হয়তো বুঝতেই
পারেন না যে,
সাহিত্যের ইমেজকে
সিনেমাটিক ইমেজের ভেতর দিয়ে
দর্শকের কাছে পৌঁছানো
কতটা দুরূহ কাজ…
আকিরা কুরোসাওয়া
যে ফিল্মমেকারেরা আধাআধিভাবে সিনেমা বানান, তারা হয়তো বুঝতেই পারেন না যে, সাহিত্যের ইমেজকে সিনেমাটিক ইমেজের ভেতর দিয়ে দর্শকের কাছে পৌঁছানো কতটা দুরূহ কাজ। যেমন ধরুন, রেললাইনের পাশে একটি লাশ পড়ে আছে– এমন এক গোয়েন্দা উপন্যাস অবলম্বনে স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে জনৈক তরুণ ফিল্মমেকার একেবারেই সুনির্দিষ্ট সেই জায়গাটির ওপর জোর দিতে চাইলেন– উপন্যাসে যে জায়গাটিতে লাশটি থাকার কথা লেখা ছিল। আমি বললাম, “তুমি ভুল করছো। সমস্যাটা হলো, তুমি তো উপন্যাসটি ইতোমধ্যেই পড়ে ফেলেছ, ফলে তুমি জানো, রেললাইনের পাশেই একটি লাশ পাওয়া যাবে। কিন্তু যারা এটি পড়েনি, তাদের কাছে তো এই জায়গাটির কোনো বিশেষত্ব নেই।” সিনেমাটিক ইমেজকে একটি একেবারেই ভিন্ন রাস্তায় প্রকাশ করা লাগে– এ সত্য উপলব্ধি না করেই, সেই তরুণ ফিল্মমেকারটি সাহিত্যের জাদুকরি শক্তির বশীভূত হয়ে গিয়েছিলেন।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আপনি কি বাস্তব জীবনের এমন কোনো ইমেজের কথা মনে করতে পারেন, যেটিকে সিনেমায় প্রকাশ করা অসম্ভব বলে ধারণা করেন?
আকিরা কুরোসাওয়া
হ্যাঁ। ইলিদাচি নামে একটা খনির শহর আছে, অল্প বয়সে সেখানে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছিলাম আমি। প্রথম দর্শনেই ডিরেক্টর জানান দিয়েছিলেন, এই পরিবেশ চমৎকার ও বিস্ময়কর; আর সে কারণেই এটির শুটিং করছি আমরা। কিন্তু ইমেজগুলোতে সেটিকে একেবারেই মামুলি একটা শহরের মতোই লেগেছিল; আমাদের জানাশোনার মধ্যে কিছু একটা ঘাটতি রয়ে গিয়েছিল : আর তা হলো– শহরটিতে কাজের পরিস্থিতি ছিল বেশ বিপজ্জনক, এবং খনি শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সদা আতঙ্কে জীবন কাটছিল নারী ও শিশুদের। কেউ যখন এ গ্রামটির দিকে তাকাবে, সে তখন ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে অনুভূতির গোলমাল বাঁধিয়ে ফেলবে, এবং এটি বাস্তবিক যেমন, তার চেয়েও বিস্ময়কর হিসেবে ধরে নেবে একে। কিন্তু ক্যামেরার চোখ তো আর সেভাবে দেখে না।

গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
সত্য হলো, আমার জানামতে নিজেদের সাহিত্যকর্ম অবলম্বনে বানানো সিনেমা খুব অল্পসংখ্যক ঔপন্যাসিককেই তৃপ্ত করতে পেরেছে। সাহিত্য অবলম্বনে নিজের বানানো সিনেমাগুলো নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
আকিরা কুরোসাওয়া
আমাকে আগে একটা প্রশ্ন করতে দিন : আমার রেড বিয়ার্ড সিনেমাটি দেখেছেন নাকি?
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
গত বিশ বছরে এই ফিল্মটি আমি ছয় বার দেখেছে, এবং আমার সন্তানরা দেখার আগপর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই ওদেরকে এটার কথা বলেছি। ফলে এটি আমার পরিবার ও আমার নিজের কাছে আপনার বানানো ফিল্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পছন্দের একটিই শুধু নয়, বরং সিনেমার সমগ্র ইতিহাসের মধ্যে আমার প্রিয় ফিল্মগুলোর অন্যতমও বটে।
…সেই বিস্ফোরণের
৪৫ বছর পরও,
রেডিয়েশনের প্রভাবে নিদারুণ যন্ত্রণায়
অ্যাটোমিক বোম্ব হসপিটালে
মৃত্যুর অপেক্ষায় ছটফট করছেন
২৭০০ রোগী…
আকিরা কুরোসাওয়া
রেড বিয়ার্ড আমার বিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে গড়ে উঠেছে। এটির আগে যত সিনেমা আমি বানিয়েছি, সেগুলো এটির পরে বানানো ফিল্মগুলোর চেয়ে আলাদা। এটি ছিল একটি পর্যায়কালের সমাপ্তি এবং আরেকটির সূচনা।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
তা তো পরিষ্কার। তাছাড়া, এই একই সিনেমায় দুটি দৃশ্য রয়েছে– যেগুলো আপনার কাজের সামগ্রিক-রূপের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে সম্পৃক্ত, এবং দুটি দৃশ্যই অবিস্মরণীয়। একটি হলো প্রার্থিত পতঙ্গের এপিসোড, এবং আরেকটি হাসপাতালের আঙ্গিনার ক্যারাটে ফাইট।
আকিরা কুরোসাওয়া
হ্যাঁ, তবে আপনাকে আমি যে কথাটি বলতে চাচ্ছিলাম, তা হলো– এই গ্রন্থটির লেখক, শুগুরো ইয়ামামোতো তার নিজের লেখা উপন্যাসগুলোকে সিনেমায় রূপান্তরিত করার ব্যাপারে বরাবরই বিরোধিতা করে এসেছেন। শুধুমাত্র রেড বিয়ার্ড-এর বেলায়ই তার অবস্থান ছিল ব্যতিক্রম; কেননা, [উপন্যাসটিকে সিনেমা-স্ক্রিপ্টে রূপান্তর ঘটাতে] সফল হওয়ার আগপর্যন্ত আমি আধাজল খেয়ে খেটে গেছি। আর ফিল্মটি দেখা শেষ করেই তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলেছিলেন, “বাহ, এটি তো দেখি আমার উপন্যাসটির চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং।”

গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আমার কাছে অবাক লাগছে, কেন এটিকে তিনি এতটাই পছন্দ করলেন?
আকিরা কুরোসাওয়া
কেননা, সিনেমার সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট সচেতনাবোধ ছিল তার মধ্যে। তিনি আমার কাছে একটা মাত্রই অনুরোধ রেখেছিলেন : কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে তিনি যেহেতু একজন সম্পূর্ণ ব্যর্থ নারী হিসেবে গড়ে তুলেছেন, আমি যেন তাকে [চরিত্রটিকে] ভীষণ সতর্কতার সঙ্গে সামলাই। তবে আজব ব্যাপার হলো, এই যে একজন ব্যর্থ নারীর আইডিয়া– এ ব্যাপারটি কিন্তু তার উপন্যাসটিতে স্পষ্ট ছিল না।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
হয়তো তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তা ছিল। আমাদের, মানে ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রে এমনটা প্রায়ই ঘটে।
আকিরা কুরোসাওয়া
হ্যাঁ, তাই। আসলে, নিজেদের লেখা সাহিত্যকর্ম অবলম্বনে বানানো সিনেমাগুলো দেখে, কিছু কিছু লেখক বলে থাকেন : “আমার উপন্যাসটির এ অংশটি বেশ ভালোভাবেই দেখানো হয়েছে।” কিন্তু তারা এমন কোনো অংশের উল্লেখ করেন, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে ফিল্মমেকার নিজে সংযুক্ত করেছিলেন। তারা আসলে কী বলতে চাচ্ছেন– আমি তা বুঝতে পারি; কেননা, তারা যা বোঝাতে চেয়েছিলেন, অথচ লিখে ওঠতে সক্ষম হননি– সে রকম অংশ ফিল্মমেকারকে বেশ স্পষ্টভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে দেখেই বোধ করি তারা এমনটা বলে থাকেন।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
“কবিরা হলেন বিষের সংমিশ্রণ”– এটা তো জানা কথাই। তবে, আপনার বর্তমান ফিল্মটির কাছে ফিরে জানতে চাই, ঘূর্ণিঝড়ের শুটিং করাটাই কি সবচেয়ে দুরূহ হয়ে উঠবে?
আকিরা কুরোসাওয়া
না। জীব-জন্তুর সঙ্গে কাজ করাটা সবচেয়ে দুরূহ ছিল। জলের সাপ; গোলাপ-খেকো পিঁপড়া। ডাঙ্গার সাপগুলো মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি অভ্যস্ত; তারা মানুষ দেখলে সাধারণত দৌড়ে পালায় না; এবং তারা অনেকটা বানমাছের মতোই আচরণ করে। অতিকার এক বুনো সাপকে বশ করার দরকার পড়েছিল আমাদের, সেটি পালানোর সম্ভবপর সব প্রচেষ্টাই করছিল এবং পুরোপুরি ঘাবড়ে গিয়েছিল। ফলে নিজ ভূমিকায় এটির অভিনয়টা ভালোই করেছে। অন্যদিকে পিঁপড়ের ক্ষেত্রে, একটা গোলাপের চূড়োয় পৌঁছানোর আগপর্যন্ত গোলাপঝাড় ধরে এগুলোর বেয়ে ওঠার ব্যাপার ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ওদেরকে দিয়ে সেটা করানো যাচ্ছিল না; অবশেষে ডাঁটাটিতে আমরা মধু দিয়ে একটা রেখা টেনে দিলাম, তারপরই পিঁপড়াগুলো বেয়ে উঠেছিল। আসলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমাদের; তবে তা ফলও দিয়েছে। কেননা, পিঁপড়া সম্পর্কে অনেক বড় একটা শিক্ষা আমরা লাভ করতে পেরেছি।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
হ্যাঁ, আমিও সেটা খেয়াল করেছি। কিন্তু পিঁপড়া নিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতোই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে– এটা কেমনতর সিনেমা? এর প্লট কী?
আকিরা কুরোসাওয়া
অল্পকথায় সেটা বলা খুব কঠিন।

গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
কেউ কাউকে মেরে ফেলছে?
আকিরা কুরোসাওয়া
না। এটি স্রেফ অ্যাটম বোমার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া নাগাসাকি অঞ্চলের এক বৃদ্ধার গল্প, গত গ্রীষ্মে যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার নাতি-নাতনিরা। অসহনীয় হয়ে ওঠতে পারে– এমনতর গায়ে কাটা দেওয়ার মতো বাস্তবধর্মী দৃশ্যের শুটিং আমি করিনি, এবং কাহিনীটির ভয়বহতা সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যাও রাখিনি, এমনকি ওদেরকে [নাতি-নাতনি] সম্পৃক্তও করিনি। আমাদের মানুষগুলোর হৃদয়ে অ্যাটমিক বোমা কী ক্ষত রেখে গেছে, এবং কীভাবে তারা তা ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলতে শিখেছে– সেটিই আমি ধারণ করতে চেয়েছিলাম। বোমা বর্ষণের দিনটি আমার স্পষ্ট মনে আছে, এবং আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না, বাস্তব দুনিয়ায় এমন কিছু ঘটা সম্ভব। তবে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, জাপানিরা এ ঘটনাটি ইতোমধ্যেই ভুলতে বসেছে।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
জাপানি মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে, জাপানের ভবিষ্যতের প্রশ্নে, এই ঐতিহাসিক স্মৃতিভ্রংশের অর্থ কী?
আকিরা কুরোসাওয়া
জাপানিরা এ বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে বিশেষ করে আমাদের রাজনীতিকেরা নিশ্চুপ থাকেন। শুধু বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ত্বরান্বিত করার উদ্দেশেই অ্যাটম বোমাটি নিক্ষেপের আশ্রয় নিয়েছিলেন– [মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি] ট্রুম্যানের এ ব্যাখ্যাটি তারা [জাপানি রাজনীতিকেরা] বোধ করি মেনে নিয়েছেন। তবু আমাদের জন্য যুদ্ধ থেমে যায়নি। হিরোশিমা ও নাগাসাকিকে নিহতের সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে ২ লাখ ৩০ হাজার হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে নিহত হয়েছিলেন ৫ লাখেরও বেশি মানুষ। এবং এখনো, সেই বিস্ফোরণের ৪৫ বছর পরও, রেডিয়েশনের প্রভাবে নিদারুণ যন্ত্রণায় অ্যাটোমিক বোম্ব হসপিটালে মৃত্যুর অপেক্ষায় ছটফট করছেন ২৭০০ রোগী। অন্যভাবে বললে, অ্যাটম বোমাটি এখনো জাপানিদের খুন করে চলেছে।
…পারমাণবিক শক্তির জন্মই হয়েছে
একটা অভিশপ্ত শক্তি হিসেবে;
এবং
কোনো অভিশাপের অধীনে জন্ম নেওয়া
কোনো শক্তি তো
কুরোসাওয়ার জন্য
একটি পারফেক্ট থিম…
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
নিজেদের আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন জাপানের দখল নিতে না পারে, এ আতঙ্কেই যুক্তরাষ্ট্র আসলে [অ্যাটম] বোমাটি ফেলে যুদ্ধের সমাপ্তি ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিল– এমন ব্যাখ্যাকেই সবচেয়ে যৌক্তিক মনে হয়।
আকিরা কুরোসাওয়া
হ্যাঁ; কিন্তু যে শহরটির অধিবাসীদের যুদ্ধের সঙ্গে কোনো লেনদেন নেই, যারা স্রেফ সাধারণ সভ্য জীবনে অভ্যস্ত– এমন একটি শহরকে কেন তারা বেছে নিল? বস্তুতপক্ষে যুদ্ধের ঢাক বাজানো, মিলিটারি সমাবেশগুলো তো ছিলই।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
এমনকি তারা সেটি ইমপেরিয়াল প্যালেসের [রাজভবন] ওপরও ফেলেনি– যেটি কিনা টোকিওর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত, এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্পট। আমি মনে করি, এইসব ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে তারা বস্তুতপক্ষে রাজনৈতিক শক্তি ও সামরিক শক্তিগুলোকে অক্ষত রাখতে চেয়েছিলেন, যেন নিজেদের মিত্রপক্ষগুলোর সঙ্গে নিজেদের লুণ্ঠন-সামগ্রীর কোনো ভাগ না করেই একটা দ্রুত বোঝাপড়ায় চলে যেতে পারেন। মানব ইতিহাসে আর কোনো রাষ্ট্র আর কখনোই এ ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়নি। তাহলে কথা হলো : অ্যাটম বোমা ছাড়াই যদি জাপান আত্মসমর্পণ করত, তাহলে জাপানের অবস্থা কি এখনকার মতোই হতো?
আকিরা কুরোসাওয়া
সে কথা বলা কঠিন। নাগাসাকি ঘটনায় যারা বেঁচে গেছেন, তারা আর সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে চান না; কেননা, তাদের অধিকাংশকেই, নিজে বেঁচে গেলেও, নিজের বাবা-মা, নিজের সন্তান, নিজের ভাই-বোন বিসর্জন দিয়ে আসতে হয়েছিল। তাদের মনে এখনো সুতীব্র এক অনুশোচনাবোধ কাজ করে। পরবর্তীকালে, যে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী ছয় বছরের জন্য এ দেশটির দখল নিয়েছিল, তারা এ স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়ার নানা ফন্দি-ফিকির করেছে, এবং তাদেরকে সহযোগিতা করেছে জাপানি সরকার। যুদ্ধের ডেকে আনা এই অনস্বীকার্য ট্র্যাজেডিটির অংশ হিসেবে, পুরো বিষয়টিকে আমি ঠিকঠাক বুঝে ওঠতে চাই। কিন্তু আমার ধারণা, যে রাষ্ট্রটি এই বোমা বর্ষণ করেছে, তাদের তো জাপানি নাগরিকদের কাছে অন্তত ক্ষমা চাওয়া উচিত। তা যতদিন না ঘটছে, এ কাহিনীর কোনো শেষ হবে না।

গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
এ টুকুই? সুদীর্ঘকালের হাসিমুখ কেড়ে নেওয়ার ক্ষতিপূরণ কি কিছুতে আদৌ হবে?
আকিরা কুরোসাওয়া
অ্যাটোমিক বোমার মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ ও অস্ত্র-দৌড়ের সূচনা ঘটে গেছে; এবং পারমাণবিক শক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়া ও তার ব্যবহারের সূচনাবিন্দুও হয়ে উঠেছে এটি। প্রকৃত হাসিমুখের দেখা বোধহয় আর কোনোদিনই পাওয়া যাবে না।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
তাই তো! পারমাণবিক শক্তির জন্মই হয়েছে একটা অভিশপ্ত শক্তি হিসেবে; এবং কোনো অভিশাপের অধীনে জন্ম নেওয়া কোনো শক্তি তো কুরোসাওয়ার জন্য একটি পারফেক্ট থিম। কিন্তু আমার কাছে ভাবনার ব্যাপার হলো, আপনি স্বয়ং পারমাণবিক শক্তিকে নয়, বরং একেবারে শুরু থেকেই যেভাবে সেটির অপব্যবহার করা হচ্ছে– সেটিকে দোষারোপ করছেন : বৈদ্যুতিক চেয়ারের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও, বিদ্যুৎ তো ভালো জিনিসই।
আকিরা কুরোসাওয়া
এ দুটো এক বিষয় নয়। আমার ধারণা, পারমাণবিক শক্তির যে প্রতিষ্ঠা মানুষ করেছে, তা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রাখে। পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থাপনায় যদি কোনো ত্রুটি ঘটে যায়, তাহলে তা মুহূর্তেই অপরিমেয় বিপর্যয় ডেকে আনবে, এবং সেটির রেডিওঅ্যাকটিভিটি শত-শত প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে থাকার আশঙ্কা প্রবল। অন্যদিকে, পানি যখন ফুটানো হয়, প্রয়োজন ফুরানোর পর সেটিকে ঠাণ্ডাও করে ফেলা যায়– যার ফলে বিপদের কোনো ভয় থাকে না। হাজার হাজার বছর ধরে ফুটন্তই থেকে যাবে– এমন উপাদানের ব্যবহার থামানো জরুরি।
…মানব-সভ্যতার প্রতি
আমার নিজের
বিশ্বাসের একটি বড় অংশের
জন্য
আমি
কুরোসাওয়ার সিনেমাগুলোর
প্রতি ঋণী…
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
মানব-সভ্যতার প্রতি আমার নিজের বিশ্বাসের একটি বড় অংশের জন্য আমি কুরোসাওয়ার সিনেমাগুলোর প্রতি ঋণী। তবে শুধুমাত্র জনসাধারণের ওপরই অ্যাটম বোমা ব্যবহার করা এবং জাপানকে সে ঘটনা ভুলিয়ে দিতে আমেরিকান ও জাপানিদের গোপন আঁতাত– এই নিষ্ঠুর অবিচারের প্রতি আপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটাও আমি বুঝতে পারি। কিন্তু মানব-সভ্যতার জন্য একটি ভয়াবহ বেসামরিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকতে পারে– এ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে, পারমাণবিক শক্তিকে চিরকালের জন্য দোষারোপ করাটা আমার কাছে সমান অবিচার বলে মনে হয়। যেহেতু আপনি জানেন, জাপানিরা ভুলে গেছে, এবং যেহেতু যারা অপরাধী, সেই যুক্তরাষ্ট্র এখনো নিজের অপরাধ স্বীকার করেনি, কিংবা জাপানি জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি– ফলে এখানে অনুভূতিগুলোর মধ্যে এমন একটা সংঘাত রয়ে গেছে, যা আপনাকে জ্বালাতন করে।
আকিরা কুরোসাওয়া
মানুষ যখন ভুল প্রলোভনে ভেসে না গিয়ে বাস্তবতার আসল চেহারা উপলব্ধি করতে পারবে, তখন তারা আরও বেশি “মানুষ” হয়ে ওঠবে। চারনোবিলে [সোভিয়েত-ইউক্রেনের এ অঞ্চলে ১৯৮৬ সালে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল] যা হচ্ছে, তেমন মলদ্বার-বিহীন মানব-সন্তান কিংবা আট-পেয়ে ঘোড়া জন্ম দেওয়ার কোনো অধিকার আমাদের রয়েছে বলে আমি মনে করি না। তবে আমার ধারণা, আমাদের এই আলাপচারিতাটি এখন সিরিয়াস হয়ে গেছে, যদিও সে উদ্দেশ্য আমার ছিল না।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আমরা ঠিকই করেছি। যখন কোনো টপিকই এমনতর সিরিয়াস হয়ে থাকে, তখন সেটির ব্যাপারে সিরিয়ালসি আলাপ না করে কোনো উপায় নেই। আপনি এখন সে সিনেমাটির নির্মাণ প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, সেটিতে এই বিষয়টি নিয়ে আপনার ভাবনার কোনো আলো পড়বে কি?
আকিরা কুরোসাওয়া
সরাসরি পড়বে না। বোমাটি যখন পড়েছিল, তখন আমি ছিলাম একজন অল্পবয়সী সাংবাদিক; এবং যা ঘটেছে– তা নিয়ে আর্টিক্যাল লেখার ইচ্ছে ছিল আমার; কিন্তু [মার্কিন] দখলদারিত্ব শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এখন, এই ফিল্মটি বানাতে এসে, আমি আবারও এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা ও পড়াশোনা শুরু করেছি, এবং এ ব্যাপারে তখন যতটুকু জানতাম, এখন তারচেয়েও বেশি জেনেছি। কিন্তু আমি যদি সিনেমাটিতে নিজের ভাবনা সরাসরি প্রকাশ করি, তাহলে সেটি বর্তমানের জাপানে কিংবা অন্য কোনোখানেও দেখানো যাবে না।

গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আমাদের এই আলাপচারিতার কোনো অনুলিপি কখনো প্রকাশ হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন?
আকিরা কুরোসাওয়া
আমার কোনো আপত্তি নাই। অন্যদিকে, এ এমনই একটি বিষয়– যেটির ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়াই পৃথিবীর নানাপ্রান্তের নানা মানুষের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করা জরুরি।
গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। সকল বিষয় বিবেচনা করে আমার মনে হয়, আমি যদি জাপানি হতাম, তাহলে এই বিষয়বস্তুটির ওপর আপনার মতো আমিও নিশ্চয়ই আলো ফেলতাম। আমি আপনাকে পুরোপুরিই বুঝতে পারছি। কোনো যুদ্ধই কারও জন্য মঙ্গল নয়।
আকিরা কুরোসাওয়া
ঠিক তাই। ঝামেলা বাঁধে তখনই, যখন কোনো উল্কাপিণ্ড, এমনকি যিশুখ্রিস্ট ও দেব-দেবীরাও সামরিক কর্মকর্তাদের মতো হয়ে ওঠে!
প্রথম প্রকাশ ।। শিল্প-সাহিত্য । প্রথম আলো । জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, বাংলাদেশ ।। ২৮ এপ্রিল ২০১৭
[…] দেবার মতন মানসিকতা তার ছিল না। মার্কেজের মতন সাহিত্যিকের প্রস্তাব […]