স্মিতা পাতিলের শেষ মুহূর্তগুলো

806
স্মিতা পাতিল
জন্ম  ১৭ অক্টোবর ১৯৫৫; পুনে, মহারাষ্ট্র, ভারত
মৃত্যু  ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮৬; মুম্বাই, মহারাষ্ট্র, ভারত

মূল ভাবনা সোম ।। অনুবাদ  আশিকুর রহমান তানিম


১৩ ডিসেম্বর ১৯৮৬। ঘুমকাতুরে চোখে শহরটি প্রাত্যাহিক কাজকর্ম শুরু করতে না করতেই ভয়াবহ এক শোকবার্তার পূর্বাভাস চলে এলো। পিটিআই ফ্ল্যাশের পর বিকালের পেপার বিক্রেতারা হাঁক দিচ্ছিলেন– ‘স্মিতা পাতিলের অবস্থা আশঙ্কাজনক!’ উত্তেজনা চলে সারা সন্ধ্যায়ই; অতঃপর রাত সাড়ে বারোটার দিকে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে, ‘সব শেষ!’ মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই এক অজানা আশঙ্কা পরিণত হয় চিরন্তন সত্যে– স্মিতা পাতিল আর নেই। পুরো শহর তখন স্তব্ধ। দুই দশক আগে গুরু দত্তের প্রয়াণের পর সম্ভবত সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আঘাত হানলো [ভারতীয়] চলচ্চিত্র জগতে। মাত্র ৩১ বছর বয়সে স্মিতা একজন কাল্ট কিংবদন্তী, একজন আইডল হিসেবে বিদায় নিলেন– নিজের জীবনের ব্যাপ্তি সমাধি থেকেও বহুগুণ বিস্তৃত করে। যেমন কাইফি আজমি একটা চ্যারিটি অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেছিলেন– ‘স্মিতা পাতিল মারা যাননি। তার সন্তান তো এখনো আমাদের সাথে আছে!’

১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিনটি শুরু হয়েছিল অন্যান্য আট দশটা সাধারণ দিনের মতোই। ভোর ছ’টায় শিশুটির কান্নার আওয়াজে স্মিতার ঘুম ভাঙ্গল– একটু শারীরিক দুর্বল অবস্থায়। তারপর খুব সন্তর্পর্ণে বিছানা ছাড়লেন তিনি, যেন স্বামী রাজের ঘুম না ভাঙ্গে; কেননা, রাজ সারারাত হোপ ’৮৬ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তারপর ধীরে ধীরে শিশু সন্তানটিকে কোলে নিয়ে অন্য রুমে গেলেন স্মিতা। বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে ওকে স্তন্যদান করলেন; আর সহস্রতম বারের জন্য ভাবতে লাগলেন, যখন তার ছেলেটি বড় হবে– কতকিছুই না ওর সাথে শেয়ার করবেন তিনি!

…মাত্র ৩১ বছর বয়সে
স্মিতা
একজন কাল্ট কিংবদন্তী,
একজন আইডল হিসেবে
বিদায় নিলেন– নিজের জীবনের ব্যাপ্তি
সমাধি থেকেও বহুগুণ বিস্তৃত করে…

সন্তানটি যে একজন মহৎ মানুষ হবে– স্মিতা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আর কোনো শিশুই মাত্র ৬ দিন বয়েসে ওর মতো মাথা তুলে কিংবা চোখ পিটপিট করে তাকাতে পারেনি নিশ্চয়ই। স্মিতা প্রায়ই ভাবেন, ও কি বাবা-মার মতো অভিনেতা হবে? নাকি দাদার মতো রাজনীতিবিদ? ওর প্রতীক নামটা স্মিতার খুবই পছন্দ। ওর ছোট ছোট হাত ধরে যখন খেলা করেন, হাসেন, স্মিতা তখন মাঝে মাঝেই ওকে প্রতীক বলে ডাকেন, নিজেকে তখন তার দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়! কিন্তু শিশুটি বোধহয় ঠিক মুডে নেই, কিছুটা পরিশ্রান্তও মনে হয়; [দুধ খেতে খেতে] ও অন্যদিকে তাকাতে থাকে কেবল।

স্মিতা পাতিল

স্মিতা টের পান, আসলে তার গায়ের উত্তাপই ছেলের এ বিরক্তির কারণ। গত দুদিন ধরেই কেমন জ্বর জ্বর লাগছিল তার; এজন্য শিশুটিকেও ধরেননি– যদি ভাইরাস পেয়ে বসে ওকেও! কিন্তু আজ সিদ্ধান্ত নিলেন, ওকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। তাই স্মিতা ওকে একটি ভেজা কাপড়ে জড়িয়ে, খাওয়ালেন। এতে কাজও হলো। একটু পরই ঘুমিয়ে পড়ল শিশুটি। এরপর রাজকে জাগিয়ে দিতে গেলেন স্মিতা; ওর আবার ১০ টায় অ্যাকশন কমিটির মিটিংয়ে উপস্থিত হতে হবে। রাজের কপালে হাতটা রেখে স্মিতা দেখলেন, জ্বরটা কমেছে কিনা। ‘ধন্যবাদ ঠাকুর’– তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে মনে মনে বললেন। রাজের জন্য দিনটা খুব ক্লান্তিকর হতে যাচ্ছে। গত এক মাস ধরে রাজ শো’টির জন্য প্রাণপণে খেটে যাচ্ছেন; অন্তত ওর জন্য হলেও স্মিতা চাইছেন যেন সবকিছু ঠিকঠাক হয়। এই প্রথমবার রাজ এ রকম কিছুর সাথে সরাসরি জড়াল।

এক ঘণ্টা পর রাজ যখন বেরিয়ে গেলেন, দৈনন্দিন কাজকর্ম করা শুরু করলেন স্মিতা। চুল ধুঁতে গিয়ে বরাবরের মতোই পড়ে যেতে থাকা চুলগুলোর জন্য দুশ্চিন্তায় ভুগলেন। তার মনে পড়ে গেল, ভিগি পালকে ছবির সেটে রাজের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম মুহূর্তের কথা : ‘তোমার চোখে প্রাচীন পৃথিবীর দৃষ্টি লুকিয়ে আছে’, তাকে বলেছিলেন রাজ। স্মিতার নস্টালজিক লাগতে থাকে। পুরনো স্মৃতির অলিন্দ খুলে তার মনে পড়ে নিজের বোনদের কথা। আনিতা– যাকে স্মিতা ‘তাই’ [মা] ডাকনামে ডাকেন, যিনি ছেলেবেলায় খেলাচ্ছলে স্মিতার সৎ-মা হতেন; আর ছোট বোন মান্যর মা হতেন স্মিতা। তার মনে পড়ে শৈশবে পুনেতে তাদের পুরনো বাড়ির পেছনের দিকে বটগাছটার নিচে খেলতেন তারা সবাই; আর তাদের মা গাইতেন মারাঠি লোকগান।

…সন্ধ্যার দিকে স্মিতার
একটু বিষাদগ্রস্ত লাগতে
থাকে। শরীরের কোথায়
যেন একটা চিনচিনে ব্যাথা
জেগে ওঠে…

চুল ঝাড়তে ঝাড়তে তার মনে হলো, আজকেই সব গানগুলো নোটবুকে টুকে নেওয়া দরকার। তার মা এ রকম হঠাৎ জেগে ওঠা খেয়াল দেখে অবাক হলেন : ‘এগুলোর এখন কী দরকার?’ স্মিতা উত্তর দিলেন, ‘এমনিতেই গাইতে ইচ্ছা হলো আবার।’ অতঃপর স্মিতা পাতিলের সকালের একটা বিশাল সময় কেটে গেল মার মুখ থেকে গানগুলো নোটবুকে তুলতে তুলতে। পুরনো দিনগুলোর মতোই মা আর মেয়ে জানালার পাশে বসে, বিশাল মগ ভর্তি চা খেতে থাকলেন।

স্মিতা পাতিল

সন্ধ্যার দিকে স্মিতার একটু বিষাদগ্রস্ত লাগতে থাকে। শরীরের কোথায় যেন একটা চিনচিনে ব্যাথা জেগে ওঠে।সাড়ে দশটা নাগাদ ডাক্তার আসেন রেগুলার চেক-আপ করতে। ‘একটু জ্বর আছে, তবে ও তেমন কিছু না’– স্মিতাকে স্যালাইন দিয়ে বলেন তিনি। অতঃপর ডাক্তার চলে যান তার গন্তব্যে। হয়তো স্মিতার একটু বিশ্রাম দরকার। স্মিতা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে একটু পড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ। স্যালাইনের বোতল থেকে বিন্দু বিন্দু তরলের স্রোত দেখে তার হাজারও পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

…কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্মিতা
যোগ করেন, ‘মায়া,
আমার ভালোলাগছে না।
আমার জন্য দোয়া করিসরে!
আমি যেন তাড়াতাড়ি
সেরে উঠি’…

মায়া, স্মিতার চুল-পরিচর্যাকারী, গোদভারাই উৎসবের একটা ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে উপস্থিত হন তার বাসায়।ভিডিওটা কেবল ৩০ মিনিটের– মায়া জানান। ‘তাই আর মান্য এলে ছেলের নাম-উৎসবের সময় পুরোটা কমপ্লিট করব। ওদের তো বাবুর সাথে কোনো ছবিই নাই।’– স্মিতা বলেন। এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্মিতা যোগ করেন, ‘মায়া, আমার ভালোলাগছে না। আমার জন্য দোয়া করিসরে! আমি যেন তাড়াতাড়ি সেরে উঠি।’ মায়া প্রশ্রয়ের হাসিতে উত্তর দেন, ‘আরে বোকামেয়ে, কিচ্ছু হয়নি তোমার।’ মায়া স্মিতার চুলগুলো একটু উশকো-খুশকো করে দেন। যদিও মাত্র দুই বছর হলো এই দুজন একসাথে কাজ করেন; তবু ইতোমধ্যেই দুজনের মধ্যে একটা অন্য রকম বন্ধন গড়ে উঠেছে।

গত দুই বছর স্মিতার জন্য একটু বেশিই কষ্টের গেছে। মায়া প্রায়ই দেখেছেন স্মিতার বিষাদমাখা মলিন চেহারা। মাঝে মধ্যে সান্ত্বনাও দিয়েছেন। মাতৃসুলভ একটা টান ছিল বলে মায়া স্মিতাকে অনর্থক দুশ্চিন্তা করতে দেখলে বকাও দিয়েছেন! আজকেও সে রকমভাবে তাকে বলে উঠলেন, ‘তুমি কি পাগল? তোমার কী এমন হয়েছে যে মন খারাপ করে আছো, শুনি?’

স্মিতা খুব বেশি চিন্তা কিংবা দুশ্চিন্তা না করার চেষ্টা করতে থাকেন। দু’ঘণ্টা পর স্যালাইনের বোতলটা শেষ হওয়ায় রুম বদলানোর জন্য জোরাজুরি শুরু করেন স্মিতা। মাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মা, গত দুই বছরে তোমার সাথে খুব ভালো আচরণ করিনি। সারাক্ষণই ঝগড়া করেছি। আমি শোধরানোর চেষ্টা করছি, এখন থেকে সবকিছু ঠিকঠাক চলবে।’ স্মিতার বড্ড পরিশ্রান্ত লাগতে থাকে। দুপুর তিনটার দিকে পুনম ধীলন কল দিলে স্মিতা তাকে জানান, শরীর খুব একটা ভালো ঠেকছে না। পুনম হেসে উড়িয়ে দেন; বলেন, ‘প্রেগন্যান্সির পর সবারই অমন লাগে। তাছাড়া, তুমি যা চেয়েছিলে সারাজীবন, তা তো পেয়েছই; এত দুশ্চিন্তা কীসের?’ স্মিতা মিনমিন করে বলেন, ‘তা ঠিক। কিন্তু আমার কেন যেন ভালো লাগছে না। তুমি বাসায় চলে আসো না? দুজন একসাথে আড্ডা দেই। আমার তাহলে ভালো লাগবে।’

স্বামী-স্ত্রী । স্মিতা পাতিল-রাজ বাবর

পুনম শ্যুটিং সেট থেকে কল দিয়েছিলেন। স্মিতাকে কথা দেন, ফেরার পথে দেখা করে যাবেন। ফোন রাখার সময় পুনম একটু কেশে উঠলে উন্মত্ত মায়ের মতো স্মিতা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘তোমার জ্বর থাকলে এসো না। আমি চাই না আমার বাবুর ইনফেকশন হোক।’ তারপর আবার হেসে যোগ করেন, ‘আমি একটু পরই ঠিক হয়ে যাব। আমার সবসময়ই এ রকম হয়।’

…স্মিতার মুখ খড়িমাটির মতো
সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
ব্যাথায় কুঁকড়ে আছেন স্মিতা।
কাঁদছেন।
করছেন রক্তবমি…

সন্ধ্যায় রাজ ফিরতে ফিরতে স্মিতার স্যালাইনের নল খুলে ফেলা হয়েছিল, আর একটু ভালোও বোধ করছেন তিনি। গুনগুন করতে করতে রাজের পোশাক বের করে দেন– যেগুলো হোপ ‘৮৬ অনুষ্ঠানের জন্য পরবেন বলে ঠিক করা ছিল।স্মিতা রাজকে অনুরোধ করেন, তাকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য, ‘আমার এখন একটু ভালোই লাগছে। তোমার সাথে থাকলে সবসময়ই ভালোলাগে। আমাকেও নিয়ে যাও। আর কখনো কি এ রকম অনুষ্ঠান দেখতে পাব?’ কিন্তু রাজের তাতে সায় ছিল না। তিনি স্মিতাকে বিছানায় শুইয়ে, কম্বল মুড়িয়ে দিয়ে, বাথরুমে গোসল করতে যান। আর তার ১০ মিনিট বাদে বের হয়েই দেখেন, স্মিতার মুখ খড়িমাটির মতো সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ব্যাথায় কুঁকড়ে আছেন স্মিতা। কাঁদছেন। করছেন রক্তবমি। রাজের হাত পা অসাড় হয়ে যায় স্ত্রীকে এ রকম দেখে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার ছুটে আসেন।

স্ট্রেচারে উঠালে স্মিতা মিনতি করতে থাকেন, ‘আমি হাসপাতালে যাব না। আমার বাবুটার কাছ থেকে দূরে যেতে চাই না। আমাকে হাসপাতালে নিও না। আমি সবার সাথে বাসায় থাকতে চাই।’ তার স্নায়ুবিকারগ্রস্ততা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে রাজ আর নিজের মায়ের সঙ্গে তর্ক করতে করতে। তারপর এই উন্মত্ততা এক সময় ক্লান্তি বয়ে নিয়ে আসে; আর স্মিতাও রাজের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরই কেবল তারা বুঝতে পারেন, স্মিতা আসলে কোমায় চলে গেছেন।

স্মিতা পাতিল

স্মিতার এই অবস্থার কথা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আর সংবাদমাধ্যমের অনেক মানুষ এসে জড়ো হন। সবার তখন একটাই প্রশ্ন– ‘এখন কী অবস্থা?’ হাসপাতালের পক্ষ থেকে উত্তরও একটাই– ‘আগের মতোই।’ উদ্বিগ্ন দর্শনার্থীরা যা করতে পারতেন, সবই করেছেন কিছু জানার জন্য। একেকজন তার অসুস্থতা নিয়ে একেক কথা বলতে লাগলেন। কেউ বলছেন– মেনিনজাইটিস; কেউ– ভাইরাল এনসেফালাইটিস; কেউ বললেন– ডিএসসি; আর কেউবা–মানসিক চাপ। অনুমান চলতেই লাগল; সেইসাথে প্রতি আধঘণ্টা পরপর বিশেষ বুলেটিন।

সন্ধ্যার শেষদিকে কেউ একজন বের হয়ে এসে বললেন, তার রক্তক্ষরণ থেমেছে, কিন্তু এখন আবার রক্তচাপ একদম কমে যাচ্ছে। স্মিতা রেসপাইরেটরে আছেন, আর বিশজনের মতো ডাক্তার তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কেউ কেউ বলছিলেন, তার মস্তিষ্ক আর কাজ করছেন; তবে ডাক্তাররা তখনও আশাবাদী।

…’ওর মস্তিষ্ক হেরে গেল’–
তার মা
বলেছিলেন পরের দিনসকালে…

শ্বেতশুভ্র পোশাকের মানুষে ভর্তি ঘরটায় যখন বিদ্যা পাতিল জেগে উঠলেন প্রায় কয়েক ঘণ্টা অচেতন থাকার পর, তারপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন নিজের মেয়ের নিথর ছবির দিকে। ‘ওর মস্তিষ্ক হেরে গেল’– তার মা বলেছিলেন পরের দিন সকালে, স্মিতার বান্দ্রার বাসায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলার সময়, ‘আমার মেয়ে বরাবরই একজন যোদ্ধা। এইবারও হয়তো যুদ্ধ চালিয়ে যেত, যদি ওর মস্তিষ্ক এভাবে হার মেনে না নিত।’ এতটুকু বলেই ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। শিবাজী পাতিল– স্মিতার বাবা, এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিজের স্ত্রীকে দেখছিলেন কেবল; একেবারেই আবেগবর্জিত নির্লিপ্ত চেহারায়। কিংবা কে জানে, আবেগ সব বোধহয় চাপা দিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন বেচারা!

স্মিতা পাতিল । ফিল্ম : আকালের সন্ধানে

দর্শনার্থীরা সময়ের সাথে সাথে আরও আসতে লাগলেন। বিদ্যা পাতিলকে যতই সান্ত্বনা দেওয়া হক, মায়ের মন কিছুতেই মানছিল না। শিবাজী পাতিল আস্তে আস্তে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে হাত দুটো ধরে বসলেন– ‘যা গেছে, আমাদেরই গেছে।’ মারাঠি বাসায় ফিসফিস করলেন স্ত্রীর উদ্দেশ্যে আরও বললেন, ‘পৃথিবী পৃথিবীর নিয়মে ঠিকই চলবে। এটাই কষ্টের যে, স্মিতা আমাদের অবহেলাতেই চলে গেল! আমরা যদি আরেকটু যত্ন নিতাম!’

লোকমুখে শোনা যায়– স্মিতার হাত দেখে তার কাছের এক বন্ধু একবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তিনি অল্প বয়েসেই মারা যাবেন। স্মিতা খুব একটা অবাক হননি তাতে– ‘সমস্যা নেই। কিন্তু যতদিন বাঁচি, নিজের মতো আনন্দ আর সুস্বাস্থ্য নিয়ে বাঁচতে চাই। আমি যে জীবনে বিশ্বাস করি, ঠিক ও রকম একটি জীবন চাই। আমি যদি ত্রিশ পেরোতে পারি, তাতে খুশি!’ স্মিতা একবার এক ইন্টারভিউতেও বলেছিলেন এমন কথা।

হয়তোবা স্মিতা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন অকালপ্রয়াণের আশঙ্কা। আর এ জন্যই তার জীবনের ঘোড়দৌড়ে সেটির একটা ছাপ পড়েছিল। মাত্র এক দশকে স্মিতা একজন টিভি উপস্থাপিকা থেকে সময়ের জনপ্রিয়তম নায়িকা হয়েছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সে পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী পদক। প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে বিদেশেও অর্জন করেছিলেন সম্মান। এমনকি ওর সমালোচকেরা বলেছিলেন– ‘এত সম্মানের জন্য ওর বয়েসটা একদমই অল্প নয় কি? ওর ক্যারিয়ার তো মাত্রই দশ বছরের। এত তাড়া কীসের?’

কিন্তু কেউ একজন জানতেন– সময় বড্ড অল্প। আর ঈশ্বর চেয়েছিলেন, এ সময়েরই মধ্যেই স্মিতা সম্পূর্ণ ও ভাবাবেগময় একটা জীবন কাটাক– যেভাবে স্মিতা চাইতেন।



স্মিতা পাতিলের ফিল্মোগ্রাফি•
১৯৭৪ । মেরে সাথ চল [সুরেশ কুমার শর্মা । হিন্দি]
১৯৭৪ । সামনা [জব্বর পাটেল । মারাঠি]
১৯৭৫ । নিশান্ত [শ্যাম বেনেগাল। হিন্দি]
১৯৭৫ । চরণদাস চোর [শ্যাম বেনেগাল । হিন্দি]
১৯৭৬ । মন্থন [শ্যাম বেনেগাল । হিন্দি]
১৯৭৭ । ভূমিকা [শ্যাম বেনেগাল । হিন্দি]
১৯৭৭ । জিত রে জিত [জব্বর পাটেল । মারাঠি]
১৯৭৭ । সাল সলভান চাদা [সুরিন্দর সিং । পাঞ্জাবি]
১৯৭৮ । কুণ্ডুরা [শ্যাম বেনেগাল । হিন্দি, তেলুগু]
১৯৭৮ । গমন [মুজাফফর আলী । হিন্দি, উর্দু]
১৯৭৮ । সর্বসাক্ষী [রামদাস ফুটানে । মারাঠি]
১৯৮০ । ভাবনি ভাবাই [কেতন মেহতা । গুজরাটি]
১৯৮০ । আক্রোশ [গোবিন্দ নিহালানি । হিন্দি]
১৯৮০ । আলবার্ট পিন্টো কো গোস্যা কিউ আতা হে [সাঈদ আখতার মির্জা । হিন্দি]
১৯৮০ । দ্য নকশালিটস [খাজা আহমাদ আব্বাস । হিন্দি]
১৯৮০ । অন্বেষণ [টি.এস. নাগাভারানা । কান্নাদা]
১৯৮০ । চক্র [রবীন্দ্র ধর্মরাজ । হিন্দি]
১৯৮০ । আকালের সন্ধানে [মৃণাল সেন । বাংলা]
১৯৮১ । সদ্গতি [সত্যজিৎ রায় । হিন্দি]
১৯৮১ । তাজুর্বা [নিখিল সাইনি । হিন্দি]
১৯৮২ । অর্থ [মহেশ ভাট । হিন্দি]
১৯৮২ । বদলা কি আগ [রাজকুমার কোহলি । হিন্দি]
১৯৮২ । বাজার [সাগর সর্হাদি । হিন্দি, উর্দু]
১৯৮২ । ভিগি পলকে [শিশির মিশ্র । হিন্দি]
১৯৮২ । দর্দ কা রিশতা [সুনীল দত্ত । হিন্দি]
১৯৮২ । দিল-ই-নাদান [সি.ভি. শ্রীধর । হিন্দি]
১৯৮২ । নমক হালাল [প্রকাশ মেহরা । হিন্দি]
১৯৮২ । শক্তি [রমেশ সিপ্পি । হিন্দি]
১৯৮২ । সিতুম [অরুণা রাজে । হিন্দি]
১৯৮২ । উম্বারাথা [জব্বর পাটেল । মারাঠি]
১৯৮৩ । মান্দি [শ্যাম বেনেগাল । হিন্দি]
১৯৮৩ । ঘুঙরু [রাম শেঠি । হিন্দি]
১৯৮৩ । অর্ধ সত্য [গোবিন্দ নিহালানি । হিন্দি]
১৯৮৩ । কিয়ামত [রাজ এন. সিপ্পি । হিন্দি]
১৯৮৩ । হার্শা [আকবর খান । হিন্দি]
১৯৮৩ । চটপটি [ভি. রবীন্দ্র । হিন্দি]
১৯৮৪ । আজ কি আওয়াজ [বি.আর. চোপরা । হিন্দি]
১৯৮৪ । রাবণ [জনি বকশি । হিন্দি]
১৯৮৪ । পেট পেয়ার অর পাপ [দুরাই । হিন্দি]
১৯৮৪ । মেরা দোস্ত মেরা দুশমন [রাজ খোসলা । হিন্দি]
১৯৮৪ । তারাং [কুমার শাহানি । হিন্দি]
১৯৮৪ । শপথ [রাজিব বাবর । হিন্দি]
১৯৮৪ । কানুন মেরে মুঠঠি মে [কে. প্রসাদ । হিন্দি]
১৯৮৪ । ঘিড় [টি.এস. রঙ্গ । হিন্দি]
১৯৮৪ । আনন্দ অর আনন্দ [দেব আনন্দ । হিন্দি]
১৯৮৪ । ফারিশতা [সুনীল সিকান্দ । হিন্দি]
১৯৮৪ । হাম দো হামারে দো [বি.আর. ইশারা । হিন্দি]
১৯৮৪ । কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি [বাবর সুভাষ । হিন্দি]
১৯৮৫ । চিদাম্বরম [জি. অরবিন্দন । মালায়াম]
১৯৮৫ । গুলামি [জি.পি. দত্ত । হিন্দি]
১৯৮৫ । দেবশিশু [উৎপলেন্দু চক্রবর্তী । হিন্দি]
১৯৮৫ । আখির কিও? [জে. ওম প্রকাশ । হিন্দি]
১৯৮৫ । মেরা ঘর মেরা বাচ্চে [চন্দর বোড়া । হিন্দি]
১৯৮৫ । জওয়াব [রবি ট্যান্ডন । হিন্দি]
১৯৮৬ । আপ কে সাথ [জে. ওম প্রকাশ । হিন্দি]
১৯৮৬ । অমৃত [মোহন কুমার । হিন্দি]
১৯৮৬ । দিলওয়ালা [কে. মুরালি মোহন রাও । হিন্দি]
১৯৮৬ । দেহলিজ [রবি চোপড়া । হিন্দি]
১৯৮৬ । অঙ্গারে [রাজেশ শেঠি । হিন্দি]
১৯৮৬ । কাচ কি দিওয়ার [এম.এন. ইয়াসিন । হিন্দি]
১৯৮৬ । আনোখা রিশতা [আই.ভি. সাসি । হিন্দি]
১৯৮৬ । তিসরা কিনারা [কৃষ্ণকান্ত । হিন্দি]
১৯৮৭ । মির্চ মাসালা [কেতন মেহতা । হিন্দি]
১৯৮৭ । ড্যান্স ড্যান্স [বাবর সুভাষ । হিন্দি]
১৯৮৭ । ঠিকানা [মহেশ ভাট । হিন্দি]
১৯৮৭ । সূত্রধর । চন্দ্রকান্ত যোশী । হিন্দি]
১৯৮৭ । ইনসানিয়াত কি দুশমন [রাজকুমার কোহলি । হিন্দি]
১৯৮৭ । আহসান [বলবান্ত দুলাত । হিন্দি]
১৯৮৭ । রাহি [রমন কুমার । হিন্দি]
১৯৮৭ । নাজরানা [রবি ট্যান্ডন । হিন্দি]
১৯৮৭ । অভম [বি.আর. চোপড়া । হিন্দি]
১৯৮৭ । শের শিবাজি [রাম নারায়ণ গাবালে । হিন্দি]
১৯৮৮ । ওয়ারিশ [রবীন্দ্র পিপাট । হিন্দি]
১৯৮৮ । হাম ফারিশতে নেহি [যতীন কুমার । হিন্দি]
১৯৮৮ । আকর্ষণ [তানভীর আহমেদ । হিন্দি]
১৯৮৯ । গলিও কা বাদশা [শের জাং সিং । হিন্দি] 

* তালিকাটি অসম্পূর্ণ

ভাবনা সোম । পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত ভারতীয় সিনে-সাংবাদিক, সমালোচক, লেখক
সূত্রদ্য কুইন্ট । সংবাদমাধ্যম, ভারত । ১২ ডিসেম্বর ২০১৬

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here