চান্তাল আকেরমানের সঙ্গে আলাপ । কিস্তি-১ [৮]

397

সাক্ষাৎকারগ্রহণ নিকোল ব্রেনেজ ।। অনুবাদ রুদ্র আরিফ


অনুবাদকের নোট
চান্তাল আকেরমান [৬ জুন ১৯৫০-৫ অক্টোবর ২০১৫]। বেলজিয়ান ফিল্মমেকার। সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র বিপ্লবী অ্যাকটর-ডিরেক্টর। ২০১১ সালের গ্রীষ্মকালে, সদ্যনির্মিত সিনেমা আলমেয়ার’স ফলির সূত্রধরে, নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। দীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকারটির প্রথমাংশ প্রকাশিত হলো এখানে…


সা ক্ষা কা র

প্রসঙ্গ : আকেরমান

নিকোল ব্রেনেজ  
এ ফর আকেরমান– এ কথাটি যৌক্তিক। চলুন এই সাক্ষাৎকারটিকে একটি জমাটবদ্ধ, ঐতিহাসিক কাঠামোর মধ্যে আটকানো যাক : এখন ২০১১ সালের জুলাই মাস, আপনি আলমেয়ার’স ফলির কাজ সদ্যই শেষ করেছেন, এবং সহিংস অর্থনৈতিক সঙ্কট ও বিপ্লবের একটি দৃশ্যপটের বিরুদ্ধে আমরা কথা বলছি। আপনি এগুলোকে কীভাবে নিচ্ছেন?

চান্তাল আকেরমান •
১৯৫০ সালে, একেবারেই হতদরিদ্র এক পরিবারে জন্মেছি আমি; তবে যুদ্ধোত্তর যুগের প্রেক্ষাপটে, অন্তত পশ্চিমাবিশ্ব, পরিস্থিতি দিনদিন উন্নত হচ্ছিল। আজকের দিনে এসে কারও পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন, মানুষকে আধা-ভদ্রস্থভাব আত্মস্থ করাতে গিয়ে আমাদেরকে একদা কীভাবে সবকিছু দমিয়ে রাখতে হয়েছিল। কিংবা, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটা কল্পনা করা হয়তো খুব একটা কঠিনও নয়।

নিকোল ব্রেনেজ  
আরব স্প্রিং বস্তুত পক্ষে মৌলবাদের অবদমনের শিকার হচ্ছে বলে, পরবর্তী বিপ্লবটি ইউরোপের চরম ডানপন্থিদের ভেতর থেকেই যে ঘটতে যাচ্ছে– আপনি কি তা মনে করেন
?

চান্তাল আকেরমান •
হয়তো, সম্ভবত তা-ই; মাঝেমধ্যে নিজেকে আমি এ কথাই বলি। সব সময়ই খারাপ কিছুর আশঙ্কা করি আমি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইতিহাসই আমার ভেতর এ প্রবণতার জন্ম দিয়েছে। ১৯৪১ সালে আমেরিকানরা জেনে গিয়েছিল, যুদ্ধে তারা জিতে গেছে, এবং ভ্যাটিকানের মাধ্যমে নাৎসি-প্রধানদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে শুরু করেছিল তারা। ১৯৭২ সালে তারা স্টর্মট্রুপারসের [প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বিশেষ সৈন্যবাহিনী] একজন অপরাধী, এক বুড়ো কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিল জাতিসংঘের প্রধান হিসেবে [কুর্ট ভাল্ডহেইম; মহাসচিব : ১৯৭২-৮১]। ক্ষমতার কোনো আত্মা নেই। আপনাকে কোনোকিছু দিয়েই দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আজকের দিনে নব্য-উদারপন্থী তদবিরগুলো আমাদের ওপর চাপ তৈরি করে দরিদ্রতম মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সহযোগিতামূলক, এক কথায়, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার মতো যে কোনো খাতে বাজেট কমিয়ে দিতে।

দুই বছর আগে, প্রথম সঙ্কটটির কালে, আমি মায়ামিতে ছিলাম; হাইতি অধ্যুষিত অঞ্চলে দেখেঝি– মিশ্র-বর্ণের মানুষদের সবগুলো বাড়ি দেওয়া হয়েছে বন্ধ করে, রাখা হয়েছে ব্যারিকেড দিয়ে। এই বাড়িগুলোর যারা অধিবাসী ছিলেন– তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে– কিছু কাগজের ওপর বিভিন্ন রঙে সেই ছবি এঁকে ও একটি সাউন্ডট্র্যাক তৈরি করে, একটা ইনস্টলেশন বানাতে চেয়েছিলাম আমি।

নিকোল ব্রেনেজ  
বানালেন না কেন?

চান্তাল আকেরমান •
যখন কোনোকিছু ঠিক পথে চলে না, আমিও গতি হারিয়ে ফেলি। তাছাড়া, আলমেয়ার-এর প্রস্তুতি নেওয়ার তাড়া ছিল আমার। তবে কাজটি করিনি বলে আমি অনুতপ্ত।

আলমেয়ার’স ফলি

প্রসঙ্গ : আমোর ফ্যু

নিকোল ব্রেনেজ  
‘মালায়ায় একজন ইউরোপিয়ানের পতন। আলমেয়ার‘স ফলি বইটি যখন লিখতে শুরু করেছিলেন [জোসেফ] কনর‍্যাড, তখন তিনি এ কথাটিই লিখতে চেয়েছিলেন।’ –এই ফিল্মটির ক্ষেত্রে নিজের নোটের শুরু আপনি এভাবেই করেছিলেন, শুটিং শুরু করার আগে।

চান্তাল আকেরমান •
হ্যাঁ, প্রথম নোট এটিই ছিল। আরও অনেকগুলো নোট ছিল।

নিকোল ব্রেনেজ  
আমি নিজে যা দেখেছি, তা হলো– এ এমনই এক ফিল্ম, যা প্রাগৈতিহাসিক অনুভূতিগুলোকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত; এ ‘লা আমোর ফু’ বা ‘পাগল-করা প্রেম’ বিষয়ক এক ফিল্ম; নিজের কন্যার প্রতি ভয়ানক ভালোবাসায় জড়িত এক পুরুষের এ একটি প্রতিকৃতি। এটি কি কোনোভাবে আপনার নিজের বাবার কোনো আদর্শ প্রতিকৃতির সমতুল্য?

চান্তাল আকেরমান •
না, না; কোনোভাবেই নয়। আমার মনে হয় না, আমার আত্মজীবনীর মধ্যে আমাদের গুলি চালানোর কোনো দরকার আছে। এ তো কারারুদ্ধকর ব্যাপার।

এটি ভালোবাসার সার্বজনীন সমস্যা : এ তো নিশ্চয় অন্য কোনো লোকের কিংবা নিজের সমস্যাই নয় কেবল? নিজের কন্যার প্রতি যে ভালোবাসা মনে ধারণ করে, সেটি নিয়েই দিনযাপন করে আলমেয়ার; নিজের সর্বনাশা জীবনের প্রতি আচ্ছন্ন হয়ে, তার আর কিছুই করার থাকে না। সে এমন এক উদ্বেগ ও মনমরা দিকের প্রতিনিধিত্ব করে– যেটি তার কন্যাকে স্পর্শ করে না।

আলমেয়ার আর তার কন্যা বস্তুত পক্ষে আমার নিজেই ভিন্ন দুই বৈশিষ্ট্য ও দিকের প্রতিনিধি : কন্যাটি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সাহস দেখায়– যেমনটা আমি দেখিয়েছিলাম কৈশোরে; আর মনমরা পিতাটিও আমারই মতো, যার ভেতর থেকে হারানোর নিজস্ব বেদনাবোধ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। আমরা একটা আত্মজীবনীর মধ্যে পড়ে যাই। না পড়লেই বরং ভালো হতো। যাই হোক, এই মুহূর্তে এই ফিল্মটি নিয়ে এবং এটি বানানোর আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আমার পক্ষে এ ব্যাখ্যাটুকুই দাঁড় করানো সম্ভব; তবে সবকিছু নিশ্চয়ই বরাবরই জটিলতর খুব। কিংবা সহজতর!

কনর‌্যাডের বইটি যখন পড়েছিলাম, সেখানে একটি দৃশ্য আমাকে থমকে দিয়েছিল : বাবাটি তার কন্যার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছে, যেন সে [কন্যা] তার [বাবা] কাছে এসে থাকে, যেন সে বাড়ি ফিরে আসে। এ অংশটি পড়ে কান্নায় ভেসে গেছি আমি। কেন বা কীভাবে– তা জানি না, তবে এই অনুভূতিটির প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আস্থা রয়েছে আমার। ঔপনিবেশিকতার প্রতি আমার যে আগ্রহ রয়েছে– তা কিন্তু নয়। সেই একই রাতে মুরন্যুর ট্যাবু [১৯৩১] সিনেমাটিও দেখেছি আমি। আর এ দৃশ্যটি ও ট্যাবুর মধ্যে একই ধরনের স্ফূলিঙ্গ অনুভব করেছি। আর সেই স্ফূলিঙ্গই আমার ভেতর এই সিনেমাটি বানানোর আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছে।

নিকোল ব্রেনেজ  
আলমেয়ার তার কন্যার জন্য আসলে ঠিক কী করতে চেয়েছিল?

চান্তাল আকেরমান •
তার কন্যার জন্য ঠিক কী করতে চেয়েছিল– আমি জানি না; বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য একটা কারণ থাকার দরকার ছিলই তার কাছে। নিজের কন্যাকে সে কী-ই-বা দিতে পারত? কিছুই না।

ভালোবাসে না– এমন এক ছেলের সঙ্গে মেয়েটি যখন ঘর ছাড়ল, সেটির কারণ ছিল– নিজের বাবার কাছে থাকার চেয়ে অন্য যে কোনো কিছুই নিশ্চয়ই তার জন্য ভালো হবে। তার মা-ই তাকে উসকানি দিয়েছে, তার মা ছিল মানুষ হিসেবে অপেক্ষাকৃত অধিক বাস্তববাদী। ঠিক যেন অ্যারেঞ্জ ম্যারিজের সঙ্গে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার এটি– ভবিষ্যতে কেউ নিশ্চয়ই তাদের ভালোবাসবে, এ ভাবনাটি ভাবা হয়তো ভালোই ছিল। ধীরে ধীরে তারা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে। হুম, পরে কখনো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলে কী ঘটল, আমি জানি না।

চান্তাল আকেরমান

প্রসঙ্গ : আর্ট মার্কেট

নিকোল ব্রেনেজ  
একেবারেই নিজের মতো করে সিনেমার ময়দানে আপনি প্রবেশ করেছেন : কখনো কোনো ফিল্ম স্কুল বা ইনস্টিটিউট বা গ্রুপে যাননি, এবং কখনো ন্যূনতম আপস না করেই আপনি ধীরে ধীরে নিজের মর্জিমতো নিজের পথটি তৈরি করে নিয়েছেন। প্ল্যাস্টিক আর্টের পরিমণ্ডলে কীভাবে ঢুকে পড়লেন?

চান্তাল আকেরমান •
ঘটনাচক্রে। নিজেকে কখনোই আর্টিস্ট ভাবি না আমি। একটি জাদুঘরে কর্মরত ক্যাথি হলব্রিচ [আমেরিকান আর্ট কিউরেটর] আমাকে কিছু একটা করতে বলেছিলেন। নিজেকে আমি সেটির সঙ্গে মানিয়ে নিলাম। এভাবে কাজটি শুরু হলো। আর উপভোগ করেছি বলে করতে থাকলাম।

‘আর্ট’ করাটা এমনিতে বেশ চমৎকার ব্যাপার। তবে আর্ট মার্কেট তো অন্য জিনিস। এটি অনেক সময়ই ক্ষমতার সঙ্গে, পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে বাঁধা থাকে; তবে সব সময় নয়।

সিনেমার ক্ষেত্রে, আপনি যখন একটি সিনেমা বানাবেন, হোক তা চারজনের জন্যই, যে কেউ চাইলে সিনেমা-হলের অন্ধকার ঘরে ঢুকে যেতে পারবে; এটি গণতান্ত্রিক বিষয়। আর্টের ক্ষেত্রে, এখানে একটি আভিজাত্যিক ব্যাপার থাকে– যা কখনো কখনো থাকে পুঁজির সুতোয় বাঁধা। সৌভাগ্যক্রমে, সব সময় নয়। রেনেসাঁর বেলায়, মিকেলাঞ্জেলোকে দ্য স্লেভস-এর মতো বৈপ্লবিক কাজগুলো করতে দিয়েছিল মেদিসিস। অন্যদিকে ক্লুদ বেরি ছিলেন অনেকটা আমার বাবার মতোই, ছোটখাট একজন ইহুদি– যিনি এসেছিলেন চামড়া ও পশম থেকে, উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তিনি নিজের ইভেস ক্লেইনের আঁকা ছবিগুলো খুঁজছেন। সেগুলো তারই ছিল। তিনি আসলে কী খুঁজছিলেন– পেইন্টিং নাকি সেগুলোর মূল্যমান? উভয়ই যে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই; তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটি হৃদয়ছোঁয়া এক ব্যাপার।

জীবনের শেষ বেলায় পৌঁছে আমার বাবা নিজেও পেইন্টিং কিনতে শুরু করেছিলেন। বাজে পেইন্টিং; তবে সেগুলো তার পছন্দের ছিল। এ বিষয়টি আমার কাছে দারুণ লেগেছে।

নিকোল ব্রেনেজ  
এখনকার দিনে দর্শককেরা নিজে যে ছবিগুলো পছন্দ করে, সেগুলো কেনে না; তারা একটি তালিকার মধ্যে নিজেদের নাম তুলে দেয় এবং কোনো বিশিষ্ট শিল্পীর আঁকা সেই পেইন্টিংটি হাতে পাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে– যেটি নিজে আগে দেখেনি।

চান্তাল আকেরমান •
সৌভাগ্যক্রমে, সবাই-ই এ রকম নন। তবে এ কথা কিন্তু সত্য; উদাহরণ হিসেবে নিলাম থেকে আকাশসম দামে পেইন্টিং কেনার বিষয়টি টানা যেতে পারে।

বিপ্লবের পর, সত্যিকারঅর্থে এ রকম একটি ছিল ডাচ্যাম্পের [মার্সেল ডাচ্যাম্প, আমেরিকান-ফ্রেঞ্চ পেইন্টার] ছবি, এক ধরনের বিকৃত মেজাজ নিয়ে সর্বত্র বিরাজমান করছে এবং সবকিছুকেই আর্ট বলে মনে করা হয়। যেমন ধরুন, স্টিভ ম্যাককুইন [আমেরিকান অভিনেতা] মাটিতে থুতু ফেলে দাবী করলেন, এটাই শিল্প। আমি জানি একটি উসকানি; তবে এটিই এমনতর একমাত্র বিষয় নয়।

আলমেয়ার’স ফলি

নিকোল ব্রেনেজ  
তাহলে, আধুনিক আর্ট মার্কেটের প্রেক্ষাপটে আপনি কীভাবে কাজ করতে পারলেন?

চান্তাল আকেরমান •
ব্যাপারটি হলো, আমি এখন পর্যন্ত, যাদের শ্রদ্ধা করি– তাদের মধ্যস্থতাতেই কাজ করে যেতে পারছি। শুধু পাবলিক মিউজিয়ামগুলোতেই নয়, প্রাইভেট মার্কেটগুলোতেও। সুজান পেজকে আমি শ্রদ্ধা করি, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট-এর ডিরেক্টর হিসেবে এক পর্যায়ে তিনি [বার্নার্ড] আর্নল্টকে উপদেশ দিয়েছেন। এখানে মাঝে মধ্যে সত্যিকারের আধুনিক পৃষ্ঠপোষকদেরও দেখা মেলে, যেমন সিলভিনা বসোনা [ফরাসি ফিল্ম প্রডিউসার], শ্যলুমবার্গার কোম্পানির উত্তরাধিকারীগণ– যারা জাঞ্জিবার গ্রুপকে স্পন্সর করেছেন, এবং তারপর, দুর্ভাগ্যক্রমে, ‘সাইকোঅ্যানারাইসি অ্যান্ড পলিটিকস’ গ্রুপটি। কিংবা দু মেনি’রা [আমেরিকান-ফ্রেঞ্চ আর্ট কালেক্টর দমিনিক দু মেনি]– যারাও কিনা শ্যলুমবার্গার পরিবার থেকে এসেছেন, নিজেদের কর্মযজ্ঞে তালা সাঁটার বদলে তারা ‘ডিআইএ বীকন’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং নিউইয়র্কের খুব কাছাকাছি পুরনো একটি নাবিস্কো ফ্যাক্টরিকে এক্সিবিশন স্পেসে রূপান্তরিত করেছেন।

তবে শেষ পর্যন্ত, আর্ট মূলত ধনী ও পুরুষতন্ত্রের সেবায়ই নিয়োজিত। শিল্পকে ভালোবাসেন– এমন সংগ্রাহকদের দেখা বস্তুত পক্ষে কালেভদ্রেই পাওয়া পায়। তবু, কোনোকিছুই সহজ-সরল নয়। যুদ্ধের আগে, গ্যালারির মালিকেরা শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতেন শুধুমাত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমেই নয়, বরং শিল্পী ও তাদের শিল্পকর্মের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে। এমনকি যখন নানা জায়গায় প্রদর্শিতও হয়, তবু শিল্প হয়ে উঠেছে সীমাহীন অহমিকার এক প্রদর্শনী মাত্র। তবে সবই সমান; দেখানো হচ্ছে– ভালো বলতে এটুকুই সান্ত্বনা।

নিকোল ব্রেনেজ  
ম্যানকিউইচের [আমেরিকান ফিল্মমেকার জোসেফ এল. ম্যানকিউইচ] ক্লিওপেট্রা [১৯৬৩] ফিল্মটি সম্পর্কে জোনাস মেকাসের একটি উক্তি আছে : পর্দায় এ সমস্ত বিলাসবহুল উন্মত্ততাকে কেন স্রেফ স্বর্ণের একটি বড় দলার ভেতর দিয়ে, এবং এতটা সরাসরিভাবে দেখানো হলো?

চান্তাল আকেরমান •
ওহ, কথাটি আমি শুনিনি। স্বর্ণের বাছুর [ধর্মীয় মিথ]। প্রতিমাপূজা। তবে স্বর্ণের বাছুর, ক্রিসদাসত্ব ও পিরামিডের গল্পের আগে, এক্সোদাস-এর কাহিনীটি আমাদের আরেকবার পড়ে নিতে হবে। এটি একেবারেই সত্য হয়ে রয়েছে।

পোলান্সকির দ্য পিয়ানিস্ট-এর [২০০২] সঙ্গে আমি একমত নই : শিল্প কোনো ক্ষমতাধর উদ্দেশ্যকে হাসিল করে না, এটি মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে পুনর্মিলিত করে না। ইউরোপিয়ান আর্ট তো নয়ই। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, জার্মান রোমান্টিসিজম বস্তুত পক্ষে যুদ্ধকে [বিশ্বযুদ্ধ] এগিয়ে নিয়েছে । তবে এটি হতে পারে স্রেফ একটি ধারণামাত্রই।

আলমেয়ার’স ফলি

প্রসঙ্গ : বইপত্র

নিকোল ব্রেনেজ  
দ্য মিটিং অব আনা [Les rendez-vous d’Anna; ১৯৭৮] কিংবা অ্যা কোচ ইন নিউইয়র্ক-এর [Un divan à New York; ১৯৯৬] ফিল্মের স্ক্রিপ্টের পাশাপাশি, আপনার আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে; একটি নাটকের– নাইট লবি [Hall de nuit; ১৯৯২], আরেকটি গল্পের– অ্যা ফ্যামিলি ইন ব্রাসেলস [Une famille à Bruxelles; ১৯৯৮]।

চান্তাল আকেরমান •
নানা কারণেই আমি ইমেজের চেয়ে বরং বইয়ের ওপর বেশি আস্থাশীল। ইমেজ হলো কোনো পৌত্তলিক জগতের একটি পুতুল। চরিত্রগুলোকে আপনি পুতলীয় করে তুলতে পারলেও, বইয়ের মধ্যে পুতুলবাজির জায়গা নেই। বইয়ের প্রতি আস্থা রয়েছে আমার; যখন আপনি বিশাল কোনো বইয়ের মধ্যে নিজেকে মগ্ন করবেন, তা হয়ে ওঠবে একটি অসাধারণ ঘটনার মতো।

নিকোল ব্রেনেজ  
কোন বইগুলো আপনার কাছে ঘটনার মতো ছিল?

চান্তাল আকেরমান •
আমি যখন অল্পবয়সী ছিলাম, তখন এমনটা বেশি ঘটত। গত কয়েক বছরের মধ্যে, ভাসিলি গ্রসমানের লেখা লাইফ অ্যান্ড ফেইট বইটির ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে; এটি তার মৃত্যুর ১৫ বছর পর প্রকাশিত হয়েছিল। আরও আছে ভারলাম শালামভের দ্য কলিমা টেলস

নিকোল ব্রেনেজ  
যুদ্ধ ও ক্যাম্প ফুটিয়ে তোলা দুটি রাশিয়ান কাহিনী।

চান্তাল আকেরমান •
হ্যাঁ, ঠিক তাই। ক্যাম্পগুলোতে থাকতেন নায়কেরা। আমার মা, ১৫ বছর বয়সে ক্যাম্পে ছিলেন, ক্রুপদের জন্য যুদ্ধকালীন জিনিসপত্র তৈরি করে রাত কাটত তার। জনৈক ভেরমাশ [জার্মান আর্মড ফোর্স] সৈন্য ক্যাম্পে এসে বলেছিলেন, ‘রাতে কাজ করাটা কোনো শিশুর পক্ষে স্বাভাবিক ঘটনা নয়’; এবং তিনি মাকে দিনের শিফটে বদলি করে দিয়েছিলেন। তবে এটি ছাড়া বাকি সবকিছু– বন্দিত্ব, নিপীড়ন, মৃত্যু– সবই ছিল স্বাভাবিক! আমার মা ও তার আন্টিদের দেখে রাখতেন এক বুড়ি; তিনি তাদের জন্য খানিকটা রুটি বাঁচিয়ে রাখতেন, যেন তারা বেঁচে থাকতে পারেন। ডেথ মার্চের সময়, নাৎসিরা যখন টের পেল, আমেরিকান ও রাশিয়ান সৈন্যরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তখন তারা ক্যাম্পগুলো খালি করে দিল, এবং বন্দিদের খালি পায়ে, কিংবা পায়ের মধ্যে স্রেফ কোনো কাগজ মুড়িয়ে, হাঁটিয়ে নিয়ে গেল এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে। মার কিছু মনে নেই; কেননা, তিনি জ্ঞান হারালে তার আন্টিরা তাকে সাহায্য করেছিলেন; যেন তিনি গিলতে পারেন– সে জন্য তার খাবার তারা চিবিয়ে দিতেন।

নিকোল ব্রেনেজ  
পল সেরান [জার্মান কবি] লিখে গেছেন, ‘পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই আর; তোমাকে বয়ে নেওয়ার দায় আমার।’

চান্তাল আকেরমান •
চলতি পথে কয়েক জন ফরাসি সৈনিক যখন ফ্রেঞ্চ ভাষায় এই নারীদের কথা বলতে শোনেন, এসে তাদের উদ্ধার করেন; সৈন্যরা থেমে গিয়ে, নিজেদের ওভারকোটে তাদেরকে [নারীদের] মুড়িয়ে, নিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিমেন ব্রিজে– আমেরিকানদের অংশে। তারপর তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং অল্প অল্প করে খেতে দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা হয়। ভীষণ দ্রুত খেতে গিয়ে কত মানুষেরই যে মৃত্যু ঘটেছিল তখন!


সাক্ষাৎকার গ্রহণকাল । ১৫ জুলাই ও ৬ আগস্ট ২০১১; প্যারিস, ফ্রান্স
সূত্র । লোলা জার্নাল

দ্বিতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন এই বাক্যে

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

2 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to চান্তাল আকেরমানের সঙ্গে আলাপ । কিস্তি-২ [৭] | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here