ইনটু দ্য ওয়াইল্ড: অন্তর্গত বুনো বাঁশির সুরগ্রস্ত সন্ত

869

লিখেছেন জাহেদ আহমদ


ইনটু দ্য ওয়াইল্ড
Into the Wild
স্ক্রিনরাইটার, ফিল্মমেকার । শন পেন
উৎস-গ্রন্থ । ইনটু দ্য ওয়াইল্ড/ জন ক্রেইকর
প্রডিউসার । শন পেন, আর্ট লিনসন, বিল পোল্যাড
সিনেমাটোগ্রাফার । এরিখ গ্যতিয়া
এডিটর । জে ক্যাসিডি
মিউজিক । মাইকেল ব্রুক, ক্যাকি কিং, এডি ভেডার
অভিনয় [চরিত্র] । এমিল হির্শ [ক্রিস ম্যাক্যান্ডলেস]; মার্সিয়া গে হার্ডেন [বিলি ম্যাক্যান্ডলেস]; উইলিয়াম হার্ট [ওয়াল্ট ম্যাক্যান্ডলেস]; জেনা মেলন [কারিন ম্যাক্যান্ডলেস]; ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট [ট্র্যাসি ট্যাট্রো]প্রোডাকশন কোম্পানি । রিভার রোড এন্টারটেইনমেন্ট; স্কয়ার ওয়ান সি.আই.এইচ.; লিনসন ফিল্ম
ডিস্ট্রিবিউশন । প্যারামাউন্ট ভ্যানটেজ
ধরন । ফিচার ফিল্ম
কালার । রঙিন
ভাষা । ইংরেজি
দেশ । যুক্তরাষ্ট্র
রানিংটাইম । ১৪৮ মিনিট
মুক্তি । ২১ সেপ্টেম্বর ২০০৭

ন্ পেন্ এইটা বানিয়েছেন ২০০৭ সালে, যাকে বলে সত্যি-ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র, ইনটু দ্য ওয়াইল্ড সেই সিনেমার নাম। সমনামী একটা আখ্যানগ্রন্থ অনুসৃত ম্যুভিতে এর লেখ্যরূপের আখ্যানকার জন্ ক্রেইকর ক্রেডিটলাইনে অ্যাক্নোলেজমেন্ট পেলেও শন্ পেন্ ম্যুভিটা বানিয়েছেন চলচ্চিত্রিক চোখ বজায় রেখেই। ননলিনিয়ার ন্যারেটিভে এগিয়েছে সিনেমা, আগুপিছু গল্পের সুতা নানান জায়গায় ছিটিয়ে-ছড়িয়ে, কিন্তু করতে যেয়ে সিনেমাকারের কের্দানি দেখাইতে ব্যস্ত হন নাই ডিরেক্টর। ফলে এইটা অ্যালাস্কা ট্র্যাভলগ ম্যুভি হিশেবে একটা আনফোর্গেটেবল ম্যাগন্যামোপাস্। সোজা বাংলায় আমরা বায়োপিক্ বললেই রিলেট করার সম্ভবত অধিকতর সুবিধা। বায়োগ্র্যাফিক্যাল্ ড্রামা আঙ্গিকের ম্যুভি। কিন্তু বায়োপিকগুলোতে যে-একঘেয়ে ভারিক্কি ভাব রাখা হয়, একটা খামাখা গাম্ভীর্য, এইখানে সেইটা হারাম দুইফোঁটাও নাই। বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়ার অভিজ্ঞতা আপনার যদি ইতোমধ্যে বাই-অ্যানি-চান্স হয়ে যেয়ে থাকে, এই সিনেমাটা তাহলে সেই দিক থেকে চেনাজানা করানো সহজতর হবে এই রিপোর্টারের পক্ষে। ব্যানার্জিবাবুর আরণ্যক পড়ে সেরে সেই বিপন্ন বিস্ময় থেকে একজীবনে বেরোনো সম্ভব হয় না যেমন কারো কারো পক্ষে, এই সিনেমাও তদ্রুপ আঁতান্তরে ফেলে দেবে আপনারে। এবং মনে হবে, যেমন মনে হয়েছিল আরণ্যক পড়ে উঠে, এইটা কি সিনেমা? না উপন্যাস? কবিতা নয়? না ডায়রি? কিংবা আমারই জীবন নয় এ? এ নয় আমার আরাধনার ভাবনাজীবনী? কি আমি হয়েছি তা আলাপগ্রাহ্য নয়, কি আমি হতে চেয়েছিনু তা-ই যেন দরিশন করে উঠি ইনটু দ্য ওয়াইল্ড ম্যুভিটায়।

…বায়োপিকগুলোতে যে-একঘেয়ে
ভারিক্কি ভাব রাখা হয়,
একটা খামাখা গাম্ভীর্য,
এইখানে সেইটা
হারাম দুইফোঁটাও নাই…

ক্রিস্টোফার ম্যাক্যান্ডলেস্ নামে এক তেইশবর্ষীয় তরুণের বিয়োগান্ত অভিযানোপাখ্যান। গৌতম বুদ্ধের ন্যায় একদিন সহসা সেই তরুণ ক্রিস্, সদ্য গ্র্যাজুয়েশন্ কম্প্লিট-করা ঝাঁ-চকচকে অ্যামেরিক্যান্ উচ্ছ্বল যুবা, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সারাক্ষণ-ঝগড়াঝাটিরত ধনাঢ্য বাপ-মা আর একমাত্র ছোটবোন কাউকে কিচ্ছুটি না-জানিয়ে, ঘটনাটা নব্বইয়ের গোড়ার দিককার, বেরোবার আগে স্বেচ্ছায় নিজেকে কপর্দকশূন্য করে নেয় ক্রিস্। অক্সফ্যাম চ্যারিটি ফান্ডে নিজের ব্যাঙ্কব্যালেন্স ডোনেইট করে, সেইভিংস্ যেটুকু হয়েছিল স্টুডেন্ট লাইফের স্টাইপেন্ড বা মা-বাপের গিফটমানি ইত্যাদি দিয়ে, একবস্ত্রে সে বেরিয়ে পড়ে অগস্ত্য মুণির ন্যায়। নিজের তেইশতম জন্মদিনে প্যারেন্টসের উপহার-দেয়া গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে একটা ব্যারেন্ ল্যান্ডের রুখো রোদে গাড়ি রেখে চাবি উড়িয়ে দ্যায় দূরে, এবং উঠে এসে দাঁড়ায় গাড়িবিরল হাইওয়েতে। একটি হিচহাইক্ দিয়ে ক্রিসের আরাধ্য নতুন জীবনের গেইটওয়ে ওপেন্ হয় এইভাবে।

ইনটু দ্য ওয়াইল্ড

এরপর দু-বছর ধরে তার অভিযান আমরা দেখতে পাই ক্রিসেরই দিনলিপি ফলো করে যেতে যেতে, যে-দিনলিপিটি ক্রিস্ লিখে গেছে প্রতিদিন শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গভীর ধ্যানের সঙ্গে, ধূলিঝড় আর তুষারঝঞ্ঝা সমস্তকিছুর ফাঁকে-ফাঁকে, এই দিনলিপি ভর করেই ১৯৯৬ সালে জন্ ক্রেইকর তাঁর উপন্যাসখানা লেখেন মর্মে আমরা সিনেমার ক্রেডিটকার্ডে দেখে উঠব অন্তিমে, এবং শন্ পেন্ ম্যুভি বাঁধেন ক্রিস-পরিবারের সকলের সম্মতি ও সাপোর্ট নিয়ে ২০০৭-এ এসে। উল্লেখ্য, ক্রিস্ গোড়া থেকেই চেয়েছে অ্যালাস্কায় যেয়ে ইনটু দ্য ওয়াইল্ড বসবাস করবে, ন্যাচারের সঙ্গে নিজেরে লেপ্টে লাইফ লিড্ করবে। বহু ঘটনার পরে সে পৌঁছায় অ্যালাস্কা অঞ্চলে। এই পৌঁছানোর অন্তর্বর্তী পথে-পথে সে পেয়ে যায় এক অপার অগাধ জীবনের দরোজা, পায় যে-জীবন দোয়েল-ফড়িঙের এবং রক্তের-অন্তর্গত-বিস্ময়ে-ব্যথাপ্রীত অনেক মানুষের দেখা, আর এই পথে-পাওয়া যাবতীয় বোধিগুচ্ছ নোট করে যেতে থাকে সে তার সঙ্গী দিনপত্রীতে। একের পর এক ডায়রিপৃষ্ঠা আমাদের চোখের সামনে এসে ভাসে, লেখাগুলো পড়তে একটুও অসুবিধা হয় না স্ক্রিনে, দেখার ব্যাঘাতও ঘটে না বটে। সেইসঙ্গে ভয়েস-ওভারে ক্রিসের কণ্ঠে একেকটা মায়াবী লীলাখণ্ডের রিফ্লেকশ্যন্ শুনে যেতে থাকি কান পেতে। দেখা, পড়া এবং শোনা সাংঘর্ষিক হয় না একটাবারের জন্যও। শুধু কবিতাই নয়, জীবনানন্দ স্মর্তব্য, ম্যুভিনির্মাণও অনেক রকম কথাটা আরেকবার মনে পড়ে এই সিনেমা দেখে যেতে যেতে।

একটা পার্বত্য জঙ্গুলে ব্যারেন্ জায়গায় শেষমেশ পরিত্যক্ত একটা গাড়ির ভেতরে সে তার আস্তানা/ক্যাম্পকটেজ্ বানায়ে নেয়, যে-বাসগাড়িটাকে ক্রিস্ তার ডায়রিতে উল্লেখ করেছে ‘ম্যাজিক্ বাস্’ বলে, দুই-বছরের একটু অধিক কালের শেষটায় ক্রিস্ ঘটনাচক্রে পয়জোনাস্ প্ল্যান্ট খেয়ে ধীরে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। মৃত্যুর দু-হপ্তা বাদে এক শিকারীদলের মারফতে দুনিয়া জানতে পারে এই বুদ্ধপ্রতিম গৃহত্যাগী অ্যালাস্কাফ্যাসিনেইটেড অভিযাত্রীর খোঁজ। পাওয়া যায় তার বইপত্র, অল্প কয়েকটা জামাকাপড়, খাদ্য সংগ্রহের নিমিত্তে হাতে-বানানো সরল অস্ত্র গুটিকয়, শিকারযোগ্য পয়েন্ট-টুটু ক্যালিবার একটা রাইফেল্, ক্যামেরা, এবং পাওয়া যায় ক্যামেরার আনডেভেল্যপড ফিল্মের ভেতর ক্রিসের একটা সেল্ফপোর্ট্রেইট ফোটোগ্রাফ, যেখানে ম্যাজিক বাসের গায়ে হেলান-দিয়া হাসিমুখ বহুদিনের-না-কামানো শ্মশ্রুমণ্ডিত বিষণ্ন-অথচ-সুখী ক্রিস্, পাওয়া যায় পানির জ্যারিক্যান্, নোটবুকগুলো আর কাঠখণ্ডে-গাছবাকলে লেখা আরও কত কথাবার্তা ক্রিসের প্রকৃতিজীবনের!

ইনটু দ্য ওয়াইল্ড

ক্রিসের দেহাবশেষছাই নিয়া তার সহোদরা অ্যালাস্কা অঞ্চলে ছিটাইয়া দিয়া আসেন পরে, হেলিকপ্টারের উইন্ডো দিয়ে, এইটা সিনেমার এন্ডনোটে লিখে দেখানো হয়। এবং এই সিনেমার গান আর গতি আর সুর! অনন্যসাধারণভাবে পার্ফেক্টলি পুট করা হয়েছে এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। নামভূমিকায় টেরিফিক্ অভিনয় করেছেন এমিল্ হির্শ। রয়েছেন ক্যাথ্রিন্ কিনার, অনেকটা জায়গা জুড়ে, যারা সাধারণ-সুরতে-ও-বেশভূষায় অসাধারণ এই প্রায়-প্রৌঢ় অভিনেত্রীটির প্রেমিক তারা অনেকদিন পরে একটা ম্যুভিতে দেখবেন তাঁকে যথারীতি সুন্দর ও স্নিগ্ধ অর্থে সম্মোহনীয়। অবয়বে-ও-অভিনয়ে পিচ্চি ক্রিস্টেন্ স্ট্যুয়ার্ট ছোট্ট একটা রোলে অ্যাক্টিং করেছেন, যথাপূর্ববৎ, নট সো ইম্প্রেসিভ। সর্বোপরি এখানে অভিনয় করেছে ক্রিসের ডায়রিগুলো, বইগুলো, সেই জিপ্সি ওয়াগনভ্যানগুলো, জঙ্গলে অ্যাব্যান্ডোন্ড সেই ম্যাজিক্ বাস্, বরফপাথারের ধু ধু, পথঘাটের গাড়িঘোড়ামানববিরল ট্রেইলগুলো। সর্বোপরি অভিনয় করেছেন সুমহান-সুকান্তকায়া অ্যালাস্কা।

…আগাগোড়া জীবনানন্দ-কবিতার লাইন
ছবির অন্তরালে ছবি হয়ে
ভেসে রয়, যেমনটা
আকাশের ওপারে আকাশ,
সেই ভরভরন্ত সংসার পাশে রেখে
ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
ভূতে-ধরা মানুষটার কথা
বারেবারে পড়ে মনে…

সিনেমাটা দেখতে দেখতে কত-না হাজার সমাত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা হাতছানি দিয়া যাবে আপনাকে ক্ষণে ক্ষণে! এবং আগাগোড়া জীবনানন্দ-কবিতার লাইন ছবির অন্তরালে ছবি হয়ে ভেসে রয়, যেমনটা আকাশের ওপারে আকাশ, সেই ভরভরন্ত সংসার পাশে রেখে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে ভূতে-ধরা মানুষটার কথা বারেবারে পড়ে মনে। ক্রিস্ তো তা-ই করে, ইন্ ওয়ান্ ফাইন্ মর্নিং, এক রবিকরোজ্জ্বল প্রভাতপাখির সকালে, বেরিয়ে পড়ে জীবনের ভিতর থেকে জীবন্ত বনের গভীরে। অ্যালাস্কা শুধু নয়, এই সিনেমায় আমরা যেন রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার লাইনে লাইনে লেগে-লেপ্টে-থাকা আচ্ছন্ন তুষারের প্রকৃতিনিসর্গমোড়ানো ভুবনের সমগ্র দেখে যেতে থাকি। কিংবা সিনেমার প্রত্যেকটা হরফে যেন জন্ ডেনভারের গানের লাইন গাঢ় অন্তর্লেপ দিয়ে রেখেছে। অ্যালাস্কা ছাড়াও কলোর‍্যাডো, রকি মাউন্টেনগুলো, ওয়েস্ট-ভার্জিনিয়া, ডেনভার অঞ্চল, টেক্সাস্ বা মেক্সিক্যান্ বর্ডার টেরিটোরির লোক্যালিটি সিনেমার স্ক্রিন্ জুড়ে ব্যাপ্ত রয় যেন কতশত যুগযুগান্ত! ঘুরে ঘুরে যেতে থাকে সেইসব এলাকার রৌদ্রবৃষ্টিগুলো, অটম ও স্প্রিংগুলো, ঝকমকা পাহাড়চূড়া আর অগোছানো রুখোশুখো প্রস্তরবন্ধুর পথের পাশের গিরিশৃঙ্গগুলো, বরফস্তূপ আর অগ্নিগিরিখাতগুলোর লাভাঢাকা মুখগুলো।

ইনটু দ্য ওয়াইল্ড

শুধু শন্ পেনের ম্যুভিটাতেই নয়, এই জায়গাটায় এর আগেও হয়তো-বা ট্র্যাভেল্ করেছেন আপনি। জিয়োগ্র্যাফিগ্রন্থ তথা ভূগোল বইয়ের তথ্য অনুসরণ করে গেলে অ্যালাস্কা জায়গাটা পাওয়া যাবে অ্যামেরিকায়। এইটা অ্যামেরিকার দুইটামাত্র স্টেইটের মধ্যে একটা যার চারধার খোলা, মানে এর সীমান্তরেখায় বেষ্টন-করা অন্য কোনো স্টেইট নাই, অ্যামেরিকার স্টেইটগুলোর মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যের দ্বিতীয় ভূমিখণ্ড হলো হাওয়াই। অ্যামেরিকার অন্য যে-কোনো অঙ্গরাজ্যের তুলনায় এখানে, এই অ্যালাস্কায়, সমুদ্রোপকূলরেখা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বেশি। এর সাউথে আছে প্যাসিফিক্ ওশ্যান্ এবং নর্থে আপনি পাবেন অ্যার্কটিক্ ওশ্যান্। ল্যান্ড অ্যারিয়ার দিক থেকে অ্যালাস্কা হচ্ছে অ্যামেরিকার লার্জেস্ট স্টেইট। আয়তন ৫,৭০,৩৮০ বর্গমাইল তথা ১৪,৭৭,৩০০ বর্গকিলোমিটার। দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেইট হচ্ছে টেক্সাস্। আয়তনের দিক থেকে টেক্সাসের দুই গুণেরও অধিক অ্যালাস্কাভূখণ্ড। ভূখণ্ড না-বলে জলখণ্ড বললেও হয়, কিংবা হিমবাহখণ্ড, কেননা অ্যালাস্কার বৃহত্তর অংশই তো বরফ। বরফের বন, বরফপাহাড়, বরফেরই উপত্যকা-অধিত্যকা আর চড়াই-উৎরাই। ফ্রোজেন্ ওয়াটার, গ্লেসিয়ার/হিমবাহ ফর্মে, অ্যালাস্কার ওয়াইল্ডার্নেস্ অধিকতর দুর্ধর্ষ করে রেখেছে। অ্যাপ্রোক্সিমেইটলি ১৬০০০ স্কয়ারমাইল বা ৪১০০০ স্কয়ারকিলোমিটার জুড়ে রেখেছে গ্লেসিয়ারগুলো। ফলে এখানকার রোদ, এখানকার ঝড়, এখানকার রাত্রি ও সন্ধ্যা ও দুপুরগুলো আপনি কল্পনা করে নিতে পারেন। অভিযানপ্রিয় হলে সেই কল্পনায় আপনি অ্যালাস্কার খানিকটা টেইস্ট জিভে পেয়ে যেতে পারেন বৈকি।

…আপনি বাধ্য হবেন পয়সা
ও প্রেরণার অভাবে অ্যালাস্কাস্বাদ
সিলেটের দুর্গম হামহাম ঝর্ণা
বা বিছনাকান্দি কিংবা জাফলং-জৈন্তা
এলাকায় যেয়ে বা উল্টোদিকে
যেমনটা বান্দরবানের নীলগিরি বা খাগড়াছড়ির
কোনো ওয়াইল্ড সেটিংসে যেয়ে
মেটাতে…

কিন্তু ভূগোলবইয়ের বাইরে একটা অ্যালাস্কা আছে, সেইটে পেতে পারেন আপনি সিনেমায়, সেই অ্যালাস্কা আপনার দু-নয়নে ঘোর ঘনায়ে আনবে, আপনার নিদ্রা হারাম করে তুলবে, আপনার পায়ের তলায় সর্ষের সুড়সুড়ি দিয়া আপনেরে দিব্যোন্মাদ বানায়ে ফেলবে, শেষমেশ আপনি বাধ্য হবেন পয়সা ও প্রেরণার অভাবে অ্যালাস্কাস্বাদ সিলেটের দুর্গম হামহাম ঝর্ণা বা বিছনাকান্দি কিংবা জাফলং-জৈন্তা এলাকায় যেয়ে বা উল্টোদিকে যেমনটা বান্দরবানের নীলগিরি বা খাগড়াছড়ির কোনো ওয়াইল্ড সেটিংসে যেয়ে মেটাতে। এখন দুধের স্বাদ ঘোলে হইলেও মেটাতে পারা গেলেই তো হলো। তো, ম্যুভিতে আপনি অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে অসংখ্য ফ্রেমে পেয়েছেন অ্যালাস্কার দেখা। অ্যালাস্কার ক্যাল্ভিং গ্লেসিয়ার, ম্যাটানাস্কা গ্লেসিয়ার, তার কিন্যাই পেনিন্সুলা আর কিন্যাই নদীটি, তার মাউন্ট স্যানফোর্ড, সাউথইস্ট অ্যালাস্কার নয়নাভিরাম ঝিমলাগা পাথুরে-বরফভেদ্য নদীদৃশ্যাবলি, বিশালাকার ওই দ্বীপমহারাজ্য জুড়ে ছড়ানো জ্যান্ত অগ্নিগিরিগুলো, টেক্সাস-ক্যালিফোর্নিয়া-স্যানফ্র্যান্সিস্কো অঞ্চলের ওয়াইল্ড ওয়েস্টার্ন অ্যাটমোস্ফিয়ার আপনি পেয়েছেন প্রচুর ম্যুভিতে। এর মধ্যে একটি সিনেমা, তাৎপর্যপূর্ণ সিনেমা, এইখানে একটু স্মরণ করা হলো।

ইনটু দ্য ওয়াইল্ড

ম্যুভিটার একজায়গায় একটি দৃশ্য আছে যেখানে দেখা যায় ক্রিস্ অনেকটা পায়ে হেঁটে অনেকটা হিচহাইক্ করে এসে পৌঁছায় আদিগন্তব্যাপ্ত বরফভুবনে, যেখানে সামনে-পেছনে ডানে-বাঁয়ে কিচ্ছুটি নেই আর কেবল পদতলে বরফ এবং মাথার উপরে বরফশাদা আসমান ছাড়া, সমুখে কেবল ধু ধু সমুদ্রজলরাশির ন্যায় প্রশস্ত বরফের পারাবার। মনেহয় যেন-বা মায়ানৃশংস দুনিয়াদারির বাইরেকার কোনো পরাজাগতিকতা। ক্রিস্ তার অভিযানের প্রথম ও অন্তিম ক্লাইমেক্সে যেয়ে দাঁড়ায়। পা ফালায়, আইসব্যুটপরা পা, চাঁদপৃষ্ঠে অবতরণকারীর ন্যায় হাঁটতে থাকে থপাস-থপাস বরফের উপর দিয়ে। এক-সময় দীর্ঘদূরে অপস্রিয়মাণ ক্রিসকে দেখানো হয় লং-শটে, দেখানো হয় টপ-অ্যাঙ্গেলে অ্যারিয়্যাল্ ভিয়্যু, এবং তখন মনে পড়ে জেমসের একটা গানলাইন ‘অসীম আমি ঈশ্বরের মতো’। মনেহয়, যে জানে সে জানে এইসমস্ত অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব আস্তিক্য-নাস্তিক্য কপ্চাকপ্চি খাম্চাখাম্চি আর চোয়ালে চাপাতিকোপানির বাইরেই বিরাজিত সত্যবস্তু। মনেহয়, ক্রিস্ যদি ধার্মিক না-হয় তাহলে কে ধার্মিক অধিকতর? ওই বুজরুকিপূর্ণ ধর্মগুরু? ওই বিষাক্ত অণ্ডকোষলটকানো ধর্মসৈনিকগুলো? রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ ধারণাটি ইয়াদ হচ্ছিল। ঠাকুর বেঁচে থাকলে এই জীবনীসিনেমা দেখে ক্রিসকে জীবনধার্মিক বলতেন হয়তো।

শন্ পেনের ম্যুভিতে, ডেনভারের গানে, রবার্ট ফ্রস্টের কবিতায় যে-অ্যালাস্কা আছে, সেই অ্যালাস্কা সামগ্রিক অর্থে না-হলেও ধরাছোঁয়া যায় এবং টু-অ্যা-গ্রেইট-এক্সটেন্ট ম্যুভি থেকে গান থেকে কবিতা থেকে সেই অ্যালাস্কা বের করে এনে পার্শ্ববর্তিণীকে দেখানোও যায়। কিন্তু আপনার ভেতরে যে-অ্যালাস্কা বিরাজে– মনের মণিকোঠা বা মনের বাইরেকার মুকুরের ন্যায় ট্র্যাশ জায়গাগুলোর কথা বলছি না, বলছি আপনার ভেতরের কথা– ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’– এই অ্যালাস্কা আপনি কীভাবে দেখাইবেন সখি? জীবনভর আকুলিবিকুলিয়া যাবেন, মনিবের উদ্ভট ভ্রমণগপ্পোগুলের খান্দানি চিপায় ক্ল্যাসিক্যাল্ হরিপদ কেরানির কলে-পড়া জন্তুজন্ম যাপিয়া যাইবেন, অ্যালাস্কা যাওয়া আপনার হবে না আর। না-গেলেন, মনে করেন, হঠাৎ-পাওয়া আলস্যরঙিন শুক্কুরবারে কিংবা অন্য কোনো ছুটিদিনে এমিল্ হির্শ অভিনীত ইনটু দ্য ওয়াইল্ড দেখতে দেখতে ব্যাকপ্যাক্ বেঁধেছেঁদে রাখতে তো আপনেরে কেউ মানা করে নাই। মনে মনে। মেলিয়া রাখুন আকাশপারের আস্ত ডানাটাই। ইনটু দি ডিপ ইনসাইড।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here