পিয়ের পাওলো পাসোলিনি: সিনেমা ও সাহিত্যের চরম নৈরাজ্যবাদী মাস্টার

873
পিয়ের পাওলো পাসোলিনি
জন্ম । ৫ মার্চ ১৯২২; বলোগ্না, ইতালি
মৃত্যু । ২ নভেম্বর ১৯৭৫; রোম, ইতালি

লিখেছেন । রুদ্র আরিফ


যদি মৃত্যু, জীবনান্তে মহৎ কারুকাজ বা সমাহিত সত্য হিসাবে প্রতিস্থাপিত হয়, তবে পাসোলিনির ক্ষেত্রে তা ছিল বীভৎস, তিক্ত, রক্তাক্ত প্রতিশোধের নিদারুণ প্রতিফলন। বৈপরীত্য বা বিপ্রতীপতার প্রতিটি কণা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি দ্বিধাসমতায় আকুল করে রেখেছিল নৈরাজ্যবাদীদের প্রাণসখা এই চরম সিনেসন্ত্রাসবাদী কবি চলচ্চিত্রকারকে।
–সিনে-সন্ত্রাসবাদী পিয়ের পাওলো পাসোলিনি/ ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়

ভারতীয় বাংলাভাষী সিনেমাটোগ্রাফার ও ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার ল্যাডলী তার সিনেমা দেখা সিনেমা পড়া [২০১১] গ্রন্থে যথার্থ ভূমিকাই লিখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালিয়ান সাহিত্য ও সিনে-জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব পিয়ের পাওলো পাসোলিনি সম্পর্কে। প্রকৃতঅর্থেই কবি-সাহিত্যিক হিসেবে কলমকে আর পরবর্তী সময়ে ফিল্মমেকার হিসেবে ক্যামেরাকে বন্দুকের মতো ব্যবহার করে গেছেন তিনি। তবে এ ব্যবহার কিন্তু সর্বদাই দায়িত্ববান কোনো নিরাপত্তারক্ষীর মতো নয়; বরং অধিকাংশ সময়েই হয়ে উঠেছে উন্মাদ বন্দুকবাজের মতো। তাই একটা সিনেমা বানানোর অপরাধে, নৃশংসভাবে খুন হয়ে যাওয়া এই কবি-ফিল্মমেকারকে বোধ করি তার সবচেয়ে একনিষ্ঠ অনুরাগীর পক্ষেও সম্পূর্ণভাবে ও নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা সম্ভব নয়; অন্যদিকে, তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা বা অপছন্দ করা কোনো পাঠক-দর্শকের পক্ষেও তাকে একেবারেই বর্জন বা বাতিলজ্ঞান করা অসম্ভবপ্রায়। আর অধিকাংশ বোদ্ধারা তো একবাক্যেই স্বীকার করেন, ফিল্মমেকার, কবি, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, সাংবাদিক, দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব– এক কথায়, বহুর্মুখী প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তিই ছিলেন যুদ্ধোত্তর ইতালির প্রধান প্রথাবিরোধী কণ্ঠস্বর।

আকাত্তোন

ইতালিতে ফ্যাসিবাদীরা যে বছর ক্ষমতায় আসে, সেই ১৯২২ সালেরই ৫ মার্চ ফ্যাসিবাদের প্রতি অনুগত পদাতিক সৈনিক পিতা কার্লো আলবের্তো পাসোলিনি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষিকা জননী সুজানা কলুসির সংসারে প্রথম সন্তান হিসেবে জন্ম নেন তিনি। তার জন্মস্থান– দেশটির সবচেয়ে বামপন্থি রাজনীতিমুখর শহরগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিচিত– বলোগ্না। বাবার সামরিক চাকরির কারণে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন ছোট শহরে কাটতে থাকে তার শৈশব। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না তিনি; বরং মায়ের প্রতিই ছিল অগাধ টান। এই মা ছিলেন ভীষণ রকম কবিতাপ্রেমী। এই স্কুলশিক্ষিকা নারীই নিজের সন্তানের মননে গেঁথে দিয়েছিলেন কবিতার বীজ। কে জানত, এ বীজ এক সময় বিস্ফোরক হয়ে ওঠবে!

সাহিত্যের পাসোলিনি

তোমার কথাই ভাবছি আমি; আর বলছি নিজেকে : ‘তাকে তো ফেলেছি হারিয়ে’
এ যন্ত্রণা সহ্যের অধিক; তারচেয়ে মৃত্যুই ভালো। তারপর এক মিনিট
কিংবা কয়েক মুহূর্ত পেরোনোর পর ভাবনাটা উল্টে গেলো– আনন্দে

তোমার ছবি দেখে জড়ো করি শক্তি– ভেতরে আমার। কাঁদতে তো চাই না আমি।
ঘটে গেছে মনে বদল। তারপর আবারও–
ভেবে তোমায়– নিজেকে নিঃস্ব আর একা লাগে খুব!

কে এই কুৎসিত লোক?
কে এই– তাকে যে এতো ভাবি– বুঝে না মোটেও? তুমিই কি সে?
নাকি তুমি নও, অন্যকেউ?

না মরে গিয়ে, সে তো বারবার খুইয়ে বসে নিজেকে।
সে তো আমারই দ্বৈতসত্তা : আমি তো গোঁড়া এক; আর সে– নিয়মবিরোধী।

তার কথা ভেবে সবকিছু উলট-পালট– এ জীবনে। অথচ
বলেছে সে– হারিয়ে ফেললে নিজেকে আমি, খুঁজে নেবে ঠিক।
সে তো জানেই– যখন পাবে খুঁজে আমাকে, আমি তখন থাকব মৃত।

–স্নান/ পিয়ের পাওলো পাসোলিনি। ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

পাসোলিনির নানাবাড়ি ছিল কাসার্সায়। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ তাকে অল্প বয়সেই বিমোহিত করে ফেলে। যতদূর জানা যায়, প্রথম কবিতাটি তিনি লিখেন সাত বছর বয়সে। প্রথমদিকে কবিতায় তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা– ফরাসি কিংবদন্তি কবি আর্তুর র্যাঁবো। আর কথাসাহিত্যে তাকে প্রেরণা যোগাত রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তোয়েভস্কি ও লিও তলস্তয় এবং ব্রিটিশ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও স্যামুয়েল টেইলর কলরিজের লেখা।

অ্যারাবিয়ান নাইটস

চৌদ্দটি কবিতা নিয়ে পাসোলিনির প্রথম কাব্যগ্রন্থ Poesie a Casarsa [সম্ভাব্য বাংলা ভাষান্তর, কাসার্সার কবিতা] প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। এ বইয়ের কবিতাগুলো নিজের মায়ের আঞ্চলিক ভাষা ‘ফ্রিউলিয়ান’-এ লিখেছিলেন তিনি। রাষ্ট্রভাষায় কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়ে ওঠার সহজ পথ না খুঁজে, বরং প্রকৃত ‘মায়ের ভাষা’ বা ‘মাতৃভাষা’য় নিজের আবেগ, অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তির কাব্যিক বিকাশ ঘটানোর এই যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি– এর মধ্যেই ভবিষ্যতে তার একজন প্রবল প্রথাবিরোধী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত টের পাওয়া যায়। এরপর জীবদ্দশায় আরও দশটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে– La meglio gioventù [সম্ভাব্য বাংলা ভাষান্তর, সেরা তারুণ্য; প্রকাশকাল : ১৯৫৪]; Le ceneri di Gramsci [গ্রামসির ছাইভস্ম; ১৯৫৭]; L’usignolo della chiesa cattolica [ক্যাথলিক চার্চের পাখি; ১৯৫৮]; La religione del mio tempo [এ সময়ের ধর্ম; ১৯৬১]; Poesia in forma di rosa [গোলাপের কাঠামোতে কবিতা; ১৯৬৪]; La nuova gioventù [নবতারুণ্য; ১৯৭৫] প্রভৃতি। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে দ্য সিলেক্টেড পোয়েট্রি অব পিয়ের পাওলো পাসোলিনি : অ্যা বিলিঙ্গুয়াল এডিশন শিরোনামে প্রকাশিত হয় তার নির্বাচিত কবিতার ইংরেজিতে অনূদিত সংকলন।

কবিতা ছাড়াও, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তুখোড় ছিল পাসোলিনির কলম। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে– Ragazzi di vita [বারবণিতাগণ; ১৯৫৬]; Una vita violenta [যে জীবন ভয়াবহ; ১৯৫৯] প্রভৃতি। মূলত শহরতলীর মানুষের, বিশেষ করে বস্তিবাসীর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের তীর্যক বাস্তবতার নিদারুণ ও নৃশংস চিত্র ফুটে আছে তার সাহিত্যকর্মে। বলে রাখা ভালো, কবিতা-উপন্যাসের বাইরে, বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ, গদ্য ও সমালোচনা গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে তার। আর পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে অসংখ্য তীর্যক কলাম।

সিনেমার পাসোলিনি

যখনই কোনো সিনেমা বানাই, সব সময় ঠিক আপনাদের মতোই গাছের সঙ্গে ও মানুষের সঙ্গে, বাস্তবতার মধ্যেই রয়ে যাই আমি। সাহিত্যে যেমন প্রতীকধর্মী কিংবা প্রচলিত ছাকনি থাকে, এ ক্ষেত্রে আমার আর বাস্তবতার মধ্যে তেমন কোনো বালাই নেই। সিনেমা হলো বাস্তবতার প্রতি আমার ভালোবাসার একটা বিস্ফোরণ।
–পিয়ের পাওলো পাসোলিনি

ইতালির এই প্রধান প্রথাবিরোধী সাহিত্যিকটি সিনেমা বানাতে এসে যথার্থই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। ইউরোপের এই দেশটির সে প্রজন্মের ফিল্মমেকারেরা যখন নিওরিয়ালিজম নামের অবিস্মরণীয় এক সিনে-আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়ে সিনে-জগতে তুমুল আলোড়ন তুলেছিলেন, পাসোলিনি তখন সেই নির্মল ও কাব্যিক বাস্তববাদের পথে হাঁটেননি। বরং নিজের সাহিত্যকর্মের মতো তার সিনেমাও শুরু থেকেই হয়ে উঠেছে ‘পাসোলিনিধর্মী’। প্রথম যৌবনে ‘ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি’র [পিসিআই] সক্রিয় সদস্য থাকা এ মানুষটি ক্যামেরার পেছনে চোখ রাখার পর হয়ে ওঠেন এক যথার্থ ‘অ্যানারকিস্ট’ বা ‘নৈরাজ্যবাদী’।

থিওরেম

রোমান বস্তির একটি পেটি-ক্রিমিনাল আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রেক্ষাপটে লেখা নিজেরই উপন্যাস অবলম্বনে, আরেক তরুণ কবি ও পরবর্তী সময়ের কিংবদন্তি ফিল্মমেকার বের্নার্দো বের্তোলুচ্চিকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে সঙ্গে নিয়ে, ১৯৬০ সালে তিনি নির্মাণ শুরু করেন আকাত্তোন সিনেমাটি। আকাত্তন– বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ভিখারি– এটি আসলে ভিত্তোরিও নামের এক কুচক্রি তরুণের ডাকনাম! মাদ্দালেনা নামের নিজের অধীনস্থ পতিতার উপার্জনে, বস্তিতে জীবনটা ভালোই কাটছিল তার। কিন্তু একদিন প্রতিদ্বন্দ্বীরা মেয়েটিকে আক্রমণ করলে ও জেলে পাঠিয়ে দিলে, পরিস্থিতি বদলে যায়। এরপর ‘করে’ খাওয়ার মতো নানা কাজ খুঁজতে থাকলেও ব্যর্থ হয় সে। অবশেষে স্তেল্লা নামের এক সাদাসিদে মেয়েকে টোপে ফেলে, মাদ্দালেনার অভাব পূরণে আপাত-সফল সে হয় ঠিকই, কিন্তু জনৈক খদ্দেরের আঘাতে এই মেয়েটিকে কাঁদতে কাঁদতে গাড়ি থেকে নেমে পড়লে, ভিত্তোরিও পৃথিবীটা আবারও নড়ে ওঠে। তারপর মোটরসাইকেল চুরি করে পুলিশের ধাওয়া থেকে ‘বাঁচতে’ গিয়ে, সড়ক দুর্ঘটনায় এ তরুণের প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া ফিল্মটি।

পরের বছর মুক্তি পাওয়া তার দ্বিতীয় সিনেমা মামা রোমার প্রেক্ষাপটও রোম শহর। এই নামচরিত্রটি একজন প্রাক্তন পতিতা। ১৬ বছর বয়সী ছেলে এত্তোরেকে নিয়ে, সবজি বিক্রি করে, জীবনটাকে নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু পরে ছেলেটি যখন মায়ের অন্ধকার অতীতের কথা জানতে পারে, তখন হয়ে ওঠে বেপরোয়া এক কিশোর অপরাধী। হাসপাতাল থেকে রেডিও চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেলবাসী হয় সে। আর মা তখন চেষ্টা করে যে কোনো উপায়ে ছেলেকে জেল থেকে বের করে আনতে– যেন জীবনটা নতুন করে শুরু করা যায়, আবারও। এ ফিল্মটিকে সমালোচকেরা গণ্য করেন ফ্যাসিবাদী শাসনামলে মানুষের অমানুষিক জীবনযুদ্ধের একটি ভিজ্যুয়াল এভিডেন্স হিসেবে।

রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে, নাজারেথের যিশুখ্রীস্ট যখন ফিলিস্তিনে ঘুরে ঘুরে কাছে ঈশ্বরের বাণী প্রচার ও মানুষের আত্মার মুক্তিলাভের উপায় বয়ান করছিলেন, তখন তার কথা বিশ্বাস করেনি অনেকেই। রোমানরা তাকে গ্রেফতার ও ক্রুশবিদ্ধ করে। মৃত্যুর তিনদিন পর পুনরুত্থান ঘটে তার। এই ধর্মীয় কাহিনী গোস্পেল অব ম্যাথু থেকে প্রত্যক্ষভাবে ধারণ করে, দ্য গোস্পেল অ্যাকরডিং টু সেন্ট ম্যাথু সিনেমাটি নির্মাণ করেন পাসোলিনি। “ইমেজের পক্ষে কখনোই লিখিত বাক্যের কাব্যিক উচ্চতা অর্জন করা সম্ভব নয়” –নিজের এই বিশ্বাসে ভর দিয়ে, ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া ফিল্মটিতে উৎস-গ্রন্থের বাক্যকে সংলাপ হিসেবে সরাসরি ব্যবহার করেছেন তিনি। ফিল্মটি পচিশতম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে স্পেশাল জুরি প্রাইজ লাভ করে।

দ্য ক্যান্টারবুরি টেলস

এরপর রিয়েলিস্টিক স্টাইল থেকে সরে এসে তিনি নির্মাণ করেন ক্রিশ্চিয়ানিটি ও মার্কসবাদী এক উদ্ভট কমিক সিনেমা– দ্য হকস অ্যান্ড দ্য স্প্যারো। এখানে রোমের শহরতলিতে দিনমান হেঁটে যাওয়া দুই মানুষ– পিতা ও পুত্রের সঙ্গী হয় কথা-বলা এক কাক। তারপর ঘটতে থাকে একের পর এক উদ্ভট ঘটনা। এরইমধ্যে কাকের শোনানো কাহিনী ধরে চলতে থাকে কিংবদন্তি ধর্মগুরু সেন্ট ফ্রান্সিসের দুই অনুসারীর ধর্মপরীক্ষার ‘অতীত’ ও রূপক নিদর্শন; আর মাঝখানে জুড়ে দেওয়া হয় ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘদিনের নেতা পালমিরো তোজলিয়াত্তির অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার নিউজরিল বা বাস্তব ফুটেজ। শেষবেলায়, চলতি পথে পিতা ও পুত্রের সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য দেখা হয় এক পতিতার। তারপর কাকের নীতিকথায় ক্ষুব্দ হয়ে পিতা-পুত্র সেটিকে মেরে, খেয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই দ্ব্যার্থক সিনেমাটি।

সফোক্লেসের লেখা গ্রিক ট্রাজেডি দিপাস দ্য কিং অবলম্বনে, ১৯৬৭ সালে ঈদিপাস রেক্স নামের বিখ্যাত সিনেমাটি নির্মাণ করেন পাসোলিনি। এর প্রেক্ষাপট– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব ইতালি। এক তরুণ দম্পতির ঘরে পুত্র সন্তান জন্ম নিলে, ঈর্ষাকাতর পিতা নিজের এ বাচ্চাটিকে ফেলে আসে মরুভূমিতে। এ বেলা ফিল্মের প্রেক্ষাপট পরিণত হয় আদিম যুগে। করিন্থ [গ্রিস] অঞ্চলের রাজা পলিবাস ও রানী মেরোপ এই শিশুটিকে উদ্ধার করে, নিজেদের সন্তান হিসেবে বড় করতে থাকে। ঈদিপো [ঈদিপাস] নামের এই ছেলে যখন নিজের হাতে পিতাকে খুন করে মাকে বিয়ে করার জঘণ্য ভবিষ্যৎবাণী জানতে পারে, পলিবাস ও মেরোপকে নিজের আসল পিতা-মাতা ধরে নিয়ে সে করিন্থ থেকে পালিয়ে যায়। থেবসে [মিসর] যাওয়া পথে, নিজের জৈবিক পিতা লাইউসের সঙ্গে দেখা হয় তার; আর ঘটনাক্রমে তর্কে জড়িয়ে পড়ে তাকে মেরে ফেলে। তারপর মানুষের মাথা আর সিংহের শরীরওয়ালা পৌরাণিক জন্তু স্পিংক্সের ধাধার সমাধান দিয়ে, এই জন্তুর অভিশাপ থেকে থেবস রাজ্যকে মুক্ত করে। আর পুরস্কার হিসেবে পায় রাজত্ব, এবং বিয়ে করে রানী জোকাস্তাকে– যে কিনা তারই জৈবিক জননী। এই নৃশংস সত্য আবিষ্কারের পর ঈদিপো নিজেকে অন্ধ করে ফেলে; অন্যদিকে, জোকাস্তা করে আত্মহনন। মূলত মরোক্কো শুটিং করা এ সিনেমা ফিল্মমেকার হিসেবে পাসোলিনিকে এক মহাকাব্যিক উচ্চতায় নিয়ে যায়।

১৯৬৮ সালে প্রকাশিত নিজেরই উপন্যাস থিওরেম অবলম্বনে, একই বছরে, একই শিরোনামে নিজের ষষ্ঠ ফিচার ফিল্মটি নির্মাণ করেই এই ফিল্ম-মাস্টার। সিনেমায় এবারই প্রথম পেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেন তিনি। মিলানের একটি উচ্চবিত্ত পরিবারের ঐশ্বিক ক্ষমতার সাক্ষাৎ পাওয়া এবং পরে পরিত্যাজ্য হওয়ার একটি যথার্থ প্যারাবল এটি। একদিন পরিবারটিতে হাজির হয় এক যুবক– যেন সাক্ষাৎ দেবদূত। তারপর কিছুদিন থেকে গিয়ে একে একে কাজের মহিলা, পুত্র, গৃহকর্ত্রী, কন্যা ও সবশেষে গৃহকর্তা– পরিবারের সবাইকে বিপথগামী করে সে চলে যায়। কিন্তু কে ছিল সে? স্রেফ কোনো অতিথি, নাকি স্বয়ং ঈশ্বর? সেই ভাবনায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে ওঠা ভোগবাদী পরিবারের প্রতি এ যেন একটি দ্ব্যর্থক কষাঘাত। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ইন্টারন্যাশনাল ক্যাথলিক ফিল্ম অফিস এটিকে প্রথমে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হলেও, অতিরিক্ত যৌন-ব্যভিচার দেখানোর অভিযোগে ভ্যাটিকেন সিটি কর্তৃপক্ষ ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো ফুঁসে ওঠলে, বাধ্য হয়ে সে পুরস্কার বাতিল করা হয়! মূলত এটিই ছিল সিনেমার ক্যামেরায় পাসোলিনির ‘অন্ধের মতো গুলিবর্ষণের’ প্রথম যথার্থ উদাহরণ; এরপর তিনি আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন!

পাসোলিনির দুর্বোধ্য সিনেমার শীর্ষবিন্দুর প্রতিনিধি হলো পিগস্টাই। অল্টারনেটিভ মন্তাজের ভেতর দিয়ে একইসঙ্গে কমিক ও হরিফিক এই ফিল্মটি দুটি আলাদা কাহিনীকে সমান্তরালভাবে ধারণ করে আছে। সামাজিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ করার ও বিধ্বংসী হয়ে ওঠার সক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে এ ফিল্মের একটি কাহিনী; আর অন্য কাহিনীটি প্রতীকিভাবে জানান দেয়, বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরের রাষ্ট্রীয় অবস্থার একটি সংযোগস্থলের।

সালো, অর দ্য ১২০ ডেজ অব সডম

এরপর একইরকম আক্রোশ ও ইয়ার্কি নিয়ে, একটানা মেদেয়া; দ্য ডিক্যামেরন; দ্য ক্যান্টারবুরি টেইলস ও অ্যারাবিয়ান নাইটস নির্মাণের পর, অনেকের বিবেচনায় পাসোলিনি তার সর্বশ্রেষ্ঠ নৈরাজ্যবাদী সিনেমাটি নির্মাণ করেন ফরাসি কিংবদন্তি সাহিত্যিক মার্কি দা সাদের বিতর্কিত উপন্যাস দ্য ১২০ ডেজ অব সডম অবলম্বনে– সালো, অর দ্য ১২০ ডেজ অব সডম। ইতালিয়ান সোস্যাল রিপাবলিকের [১৯৪৩-১৯৪৫] প্রেক্ষাপটে এর কাহিনী। রাষ্ট্রের চার প্রবল ক্ষমতাধর ও বিত্তশালী ব্যক্তিত্ব– ডিউক, বিশপ, ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রেসিডেন্ট– একটি বিকৃত মানসিকতার রেওয়াজ চালু করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, পরস্পর পরস্পরের কন্যাদের বিয়ে করার ব্যাপারে একমত হয়। গার্ড হিসেবে চারজন কিশোর ও সৈনিক হিসেবে চারজন যুবককে একটি বিকৃত পন্থায় বাছাই করে তারা। এরপর নয় জোড়া কিশোর-কিশোরীকে তুলে নিয়ে এসে, নিজেদের গোপন আখড়ায় নগ্ন করে আটকে রাখে। আর চারজন মধ্যবয়স্কা পতিতাকে নিয়ে আসে, জঘণ্যভাবে ‘পুরুষবধে’র ‘কৃতিত্বের’ নিজ নিজ কাহিনী শোনানোর জন্য। আর বন্দিদের ওপর চলতে থাকে নানাবিধ নিকৃষ্টতম পৈশাচিক নিপীড়ন। এই নিপীড়নই যেন পুলকিত করে এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের। সমাজ-ব্যবস্থার প্রতি, রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি, ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতি, মনুষ্যত্বের অধঃপতনের প্রতি পাসোলিনির এই ধারালো অথচ ‘বিকৃত’ আঘাত ভালোভাবে নিতে পারেনি তেমন কেউ। শুটিংয়ের শুরু থেকেই এ নিয়ে নানা সংবাদমাধ্যমে ছাপা হতে থাকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে ঘৃণা ও সন্দেহমিশ্রিত অসংখ্য লেখা। আর এটি মুক্তি পাওয়ার অল্প কিছুদিন আগে, ২ নভেম্বর ১৯৭৫, পিচঢালা সড়কে নিজেরই গাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে, মুহুর্মুহু চাপা দিয়ে পিষ্ঠ করে এই ফিল্মমেকারকে হত্যা করা হয়, এমনকি মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয় আংশিক; আততায়ীর হাতে তার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পেছনে এ ফিল্মটির ভ‚মিকা প্রবল বলেই মনে করেন অনেকে। কেননা, মুখোশ সরিয়ে দেখানো নগ্ন সত্যকে সহ্য করার ক্ষমতা যে নেই নানা মুখোশে মনুষ্যত্ব খোয়ানো মানুষের– সে প্রমাণ তো পৃথিবীতে প্রতিনিয়তই দেখতে পাওয়া যায়।

তবু, গাড়িচাপা দিলেও, চাপা দেওয়া যায়নি পাসোলিনিবাদকে। বারবার পুনরুত্থান ঘটেছে তার। তিনি হয়ে আছেন বিশ্ব-সিনেমার এক প্রবল প্রভাবশালী মাস্টার ফিল্মমেকার। এ প্রসঙ্গে সিনে-সমালোচক জিনো মলিতার্নো যথার্থই বলেছেন :

পাসোলিনি ও তার সিনেমা এখনো আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে : কেননা, এইসব ক্রুব্ধ, প্রচলিত ধর্মবিরোধী, নিন্দা কুড়ানো সিনেমা– মার্কসবাদ ও ধর্মবিষয়ক বোধ এবং বিপ্লব আনা ও পুরাণে ফেরা– উভয়কেই শুধু জাহির করে না; বরং সর্বোপরি সিনেমা ও জীবন এবং শিল্প ও বাস্তবতার মধ্যে পূর্ণাঙ্গতাও তৈরি করে দেয়।


পিয়ের পাওলো পাসোলিনির ফিল্মোগ্রাফি
১৯৬১ । আকাত্তোন [Accattone]
১৯৬২ । মামা রোমা [Mamma Roma]
১৯৬৪ । দ্য গোস্পেল অ্যাকরডিং টু সেন্ট ম্যাথু [Il vangelo secondo Matteo]
১৯৬৬ । দ্য হকস অ্যান্ড দ্য স্প্যারোস [Uccellacci e uccellini]
১৯৬৭ । ঈদিপাস রেক্স [Edipo re]
১৯৬৮ । থিওরেম [Teorema]
১৯৬৯ । পিগস্টাই [Porcile]
১৯৬৯ । মেদেয়া [Medea]
১৯৭১ । দ্য ডিক্যামেরন [Il Decameron]
১৯৭২ । দ্য ক্যান্টারবুরি টেলস [I racconti di Canterbury]
১৯৭৪ । অ্যারাবিয়ান নাইটস ওরফে অ্যা থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস [Il fiore delle Mille e una Notte]
১৯৭৫ । সালো, অর দ্য ১২০ ডেজ অব সডম [Salò o le 120 giornate di Sodoma]


প্রথম প্রকাশ • ইত্তেফাক । জাতীয় দৈনিক, বাংলাদেশ । ৭ অক্টোবর ২০১৬ 

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

১টি কমেন্ট

  1. […] লুই বুনুয়েল, ইঙ্গমার বার্গম্যান, পিয়ের পাওলো পাসোলিনি, রবার্তো ফেল্লিনি, উডি অ্যালেন… আরও […]

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here