সেৎসুকো হারা: জাপানি সিনেমার শাশ্বত কুমারী

431
সেৎসুকো হারা
জন্ম : ১৭ জুন ১৯২০ । ইয়োকোহামা, কানাগাওয়া, জাপান
মৃত্যু : ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ । কানাগাওয়া, জাপান

লেখা জেমস কির্কাপ ।। অনুবাদ রুদ্র আরিফ


তিনি ছিলেন জাপানে গ্রিটা গার্বো [সুইডিশ-আমেরিকান অভিনেত্রী; ১৯০৫-১৯৯০]; জাপানি ফিল্মমেকিংয়ের স্বর্ণযুগের তুমুল উজ্জ্বল তারা। সিডনি পোলকের [আমেরিকান ফিল্মমেকার; ১৯৩৪-২০০৮] দ্য ইয়াকুজা [১৯৭৪] সিনেমায় অভিনয় করে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা জাপানি অভিনেতা কেন তাকাকুরা [১৯৩১-২০১৪] আত্মজীবনীতে গভীর মমতা নিয়ে বর্ণনা করেছেন, শিনজুকু স্টেশনে যাত্রীদের সঙ্গে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় একাকার হয়ে সেৎসুকো হারার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য : লোকজনের ভিড়ে রহস্যময়তার এক অবর্ণীয় দ্যুতি নিয়ে, শারীরিক ভাষায় প্রবল বিচক্ষণতা ছড়িয়ে দিয়ে, মিশে গেছেন তিনি– যেমনটার দেখা এখন বলতে গেলে পাওয়া দুষ্কর। নিষ্কলুষতা ও মরমি নিষ্পাপের যে আবহ তাকে ঘিরে রেখেছিল, সেটি তার ব্যক্তিগত জীবনেরও খানিকটা প্রতিফলন : সিনেমাকে বিদায় জানানোর পর, আমৃত্যু সদা-সতর্কতায় নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি

প্রচার-প্রচারণা এড়িয়ে যেতেন সেৎসুকো; সাক্ষাৎকারও দেননি খুব-একটা। কখনোই বিয়ে করেননি; এবং তার কোনো প্রেমের সম্পর্কের নিশ্চিত খবরও জানা যায়নি কখনো। যার পরিচালনায় জীবনের সবচেয়ে চমৎকার সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেছেন, সেই ইয়াসুজিরো ওজুকে তিনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন– এমন একটা গুজব চাউর থাকলেও, তা শেষ পর্যন্ত সেটি গুজব হয়েই রয়। “শাশ্বত কুমারী” নামে পরম শ্রদ্ধায় এবং একইসঙ্গে মনোবেদনায় পরিচিত ছিলেন তিনি।

১৯৩৩ সালে সেৎসুকো ভর্তি হয়েছিলেন ইয়োমায়া লেডিস সেমিনারিতে। ১৯৩৪ সালের আগস্টে তার অনভিজ্ঞ, বিনম্র অথচ প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব এবং তার প্রদীপ্তময় সহজ-সরল সৌন্দর্য তাকে নিক্কাৎসু মুভি কোম্পানির ‘নতুন মুখ’-এর তালিকায় জায়গা করে দেয়।

নো রিগ্রেটস ফর আওয়ার ইয়ুথ

তার বাবা ফুজিনোসুকে আইদা ছিলেন স্বল্প-আয়ের মানুষ; অথচ এই ভদ্রলোকের দ্বিতীয় কন্যাটি হয়ে উঠেছিলেন একজন অভিনেত্রী, এবং তরুণ ফিল্মমেকার হিসাতোরা কুমাগাইয়ের [১৯০৪-১৯৮৬] স্ত্রী। সেৎসুকোর আমোদপ্রবণ চাঞ্চল্য ও শিশুতোষ স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি তাকে শিশুদের জগতে জনপ্রিয় করে তোলে; ফলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন স্কুলশিক্ষিকা হওয়ার। কিন্তু পরিবারের আর্থিক সঙ্কটের কারণে উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাননি তিনি।

তার তোলা কাস্টিং ফটোগুলোতে তার ত্বকের রঙ বরং অনেকটা কালো এসেছিল। যদিও চেহারা দেখিয়েছে সুন্দর, তবু ফ্রন্টাল শটগুলোতে তাকে ভীষণ শুকনো ও অপরিণত ঠেকেছে। তারপরও তার দুলাভাই– হিসাতোরা বুঝে গিয়েছিলেন, সেৎসুকোর পক্ষে একজন ভালো অভিনেত্রী হওয়া সম্ভব; ফলে ফিল্প কোম্পানিটির কাস্টিং ডিরেক্টরদের তিনি নিজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে সেৎসুকোর সঙ্গে অপেক্ষাকৃত স্বস্তিদায়ক পরিবেশে পরিচয় করিয়ে দেন। তার চেহারা থেকে যে সূক্ষ্ম-দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল, এ যাত্রায় সেটিই ছিল যথেষ্ট।

সে সময় নিক্কাৎসুতে কমবয়সী প্রতিভাবান অভিনেত্রীর সংখ্যা ছিল কম; ফলে চিরাচরিত জাপানি বালিকার যে নির্দিষ্ট ধরন, সেটি সেৎসুকোকে দিয়ে যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব বলে বিবেচনা করেছিলেন স্টুডিও কর্তৃপক্ষ। ১৯৩৫ সালের আগস্টে, পনের বছর বয়সে, সিনেমায় অভিষেক ঘটে তার : ফিল্মের নাম, ডোন্ট হেজিটেট ইয়ং পিপল! [Tamerau nakare wakodo yo]; ফিল্মমেকার তেৎসু তাগুচি। তরুণ প্রজন্মের কাহিনি নিয়ে নির্মিত এই ফিল্মটিতে, অভিনেত্রী হিসেবে নিজের নাম ‘সেৎসুকো হারা’ ধারণ করেন জন্মগতভাবে মাসায়ে আইদা নামের এই কিশোরী। সেই একই বছর, গ্রিন হরিজন [Midori no Chiheisen] সিনেমার কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের জন্য চুক্তিবদ্ধ অভিনেত্রীটি আত্মহত্যা করলে, তার জায়গায় এই প্রথম শ্রেণির ফিল্মটিতে অভিনয়ের সুযোগ পান সেৎসুকো। নিষ্পাপ হাসিখুশি মুখ, জ্বাজ্বল্যমান টানা-টানা চোখ ও ধ্রূপদী চেহারা– সব মিলিয়ে, অভিনয় দিয়ে নিজেকে একজন সম্ভাবনাময় তারকা হিসেবে জানান দেন তিনি

দ্য ডটার অব দ্য সামুরাই

১৯৩৭ সালে আর্নল্ড ফ্রাঙ্ক [১৮৮৯-১৯৭৪] ও মানসাকু ইতামির [১৯০০-১৯৪৬] যৌথ নির্মাণে, জার্মান-জাপানি কো-প্রোডাকশন দ্য ডটার অব দ্য সামুরাই [Die Tochter des Samurai] অভিনয় করে অভিনেত্রী হিসেবে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পরিস্ফূটন ঘটান তিনি। বলে রাখা ভালো, ফিল্মটি জাপানে দ্য নিউ আর্থ [Atarashiki Tsuchi] শিরোনামে মুক্তি পেয়েছিল। এই ফিল্মের ওপেনিং-শোতে অংশ নিতে জার্মান যান সেৎসুকো, এবং একমাস ধরে জার্মান ভাষা শিখে, সেই ভাষায় চলনসই কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করেন। তার লাবণ্য, তারুণ্য, সমুজ্জ্বল হাসি ও বিনয়ী চালচলন তাকে রাতারাতি জার্মানদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে।

এরপর প্যারিস হয়ে নিউইয়র্ক ও হলিউডে পাড়ি জমান তিনি; সেখানে তার দেখা হয় জোসেফ ফন স্টের্নহার্গ [অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান ফিল্মমেকার; ১৮৯৪-১৯৬৯], মারলেন ডিয়েট্রিশ [জার্মান অভিনেত্রী; ১৯০১-১৯৯২], বারবারা স্ট্যানভিক [আমেরিকান অভিনেত্রী; ১৯০৭-১৯৯০] ও লুইস রেইনারের [জার্মান-আমেরিকান অভিনেত্রী; ১৯১০-২০১৪] সঙ্গে; কিন্তু প্যারিস কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেস– কোথাও কোনো সিনেমার সঙ্গে তাকে চুক্তিবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেননি কেউ।

বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত, ক্যারিয়ারের খোলস তিনি ছড়াতে পারেননি। অবশেষে কুরোসাওয়ার নো রিগ্রেটস ফর আওয়ার ইয়ুথ [Waga seishu ni kuinashi; ১৯৪৬] সিনেমার মাধ্যমে সেই সুযোগটি ঘটে। এ ফিল্মে মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে অভিনয় করেন তিনি। হৃদয়গ্রাহী কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র ছিল সেটি; আর তার জনপ্রিয়তা এর মাধ্যমে হু-হু করে বাড়তে থাকে। সিনেমা পর্দায় তার উপস্থিতি বরাবরই ঘটেছে একজন বুদ্ধিমতি, পরিমার্জিত, সুরুচিসম্পন্ন, সিরিয়াস, কমবয়সী তরুণী হিসেবে। জাপানের বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের সামাজিক বিপ্লব তাকে স্পর্শ করতে পারেনি; এবং সেই প্রবল অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কালে তিনি নিজের মনোমুগ্ধকর মুচকি হাসি দিয়ে যেন দেশটির জনগণকে সান্ত্বনা দেওয়া ও সুন্দর ভবিষ্যতের আশা দেখানোর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যুদ্ধোত্তর সমাজের নানাবিধ দ্বিধা-দ্বন্ধের ভেতর, তার মার্জিত ও মমতাপ্রবণ অবয়ব একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

লেট স্প্রিং

অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ার তিনি বরং অনেকটাই দৃঢ়, যান্ত্রিক টেকনিক দিয়েই শুরু করেছিলেন; তবে অভিজ্ঞতা তার স্টাইলের মধ্যে কোমলতা এনে দেয়, এবং ইয়াসুজিরো ওজুর লেট স্প্রিং [Banshun; ১৯৪৯] সিনেমায়, অধ্যাপক বাবার সঙ্গে জীবন কাটানো, নিখাঁদ মমতা ও আত্মসচেতনায় বাবার খেয়াল রাখা, আর সে কারণে বিয়ের সুযোগ নষ্ট করে দেওয়া এক মাতৃহীন কন্যার চরিত্রে তার অভিনয় সর্বস্তরের দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়; এবং অভিনেত্রী হিসেবে তার সত্যিকারের উত্থান ঘটে। ওজুর পরিচালনায় বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করার এই সূচনা-ফিল্মটি দর্শকের ভোটে সে বছরের বর্ষসেরা ফিল্মের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল। বলা বাহুল্য, ওজুর সঙ্গে কাজ শুরু করার আগে, প্রায় ৬৭টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি।

সেৎসুকো তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেছেন ১৯৫০ দশকেই। ১৯৫১ সালে ফিওদর দস্তোয়েভস্কির [রাশিয়ান সাহিত্যিক; ১৮২১-১৮৮১] দ্য ইডিয়ট উপন্যাসটি অবলম্বনে, একই শিরোনামে [জাপানি শিরোনাম, Hakuchi] বানানো কুরোসাওয়ার ফিল্মটিতে, বিশুদ্ধ জীবনযাপনের অঙ্গিকারবদ্ধ এক ধনকুবেরের স্ত্রী– নাতাশার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। একই বছর ওজুর সঙ্গে নিজের দ্বিতীয় ফিল্মে হাজির হন সেৎসুকো; শিরোনাম, আর্লি সামার [Bakusha]– যেটি সে বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা হিসেবে নির্বাচিত হয়; আর সে বছর এ তালিকায় দ্বিতীয় সেরার স্থানটি অধিকার করা মিকিও নারুসের [১৯০৫-১৯৬৯] রিপাস্ট-এ [Meshi] জীবনের অন্যতম সেরা পারফর্ম জাহির করেন এই অভিনেত্রী। এই তিনটি সিনেমাই জাপানি সিনেমার ইতিহাসে ক্লাসিক সিনেমা হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে পরিগণিত হয়ে থাকে।

সেৎসুকো সম্পর্কে ফিল্মমেকার ওজু একবার মন্তব্য করেন,
“অন্তরের একেবারেই  অন্তঃস্থল থেকে অভিনয় করার ক্ষমতা রাখেন তিনি, এবং খুব দ্রুততার সঙ্গেই নিজের চরিত্রটির সঙ্গে বোঝাপড়া করে ফেলেন। তাকে যখনই আমি নির্দেশনা দিই, তিনি সবসময়ই বুদ্ধিমত্তা ও স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সাড়া দেন; সত্যিকারের এক সহজাত অভিনেত্রী তিনি।”
ওজুর ট্রেডিশনাল জাপানি ইন্টারিয়র, তাতামি ফ্লোর-লেভেল থেকে শট-ধারণ– সবকিছুর সঙ্গেই নিখুঁতভাবে মানিয়ে যেতেন তিনি।

টোকিও স্টোরি

‘ওজু/সেৎসুকো’ জুটির শ্রেষ্ঠতম ফিল্মটি নির্মিত হয় ১৯৫৩ সালে– টোকিও স্টোরি [Tokyo Monogatari]। ফিল্মটির শুটিং শুরু হয় জুন মাসে; ওজুর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে হারার দুলাভাই শুট করছিলেন; আর ক্যামেরাম্যান হিসেবে ছিলেন হারার মেঝ ভাই। গোতেম্বা স্টেশনে একটি ছুটে আসা ট্রেনের শট নিচ্ছিলেন সেৎসুকোর ভাইটি; কিন্তু ট্রেনটি ঠিক সময়ে না থেমে বরং তার ওপর দিয়েই উঠে যায়, এবং তিনি নিহত হন। এই দুঃখজনক ঘটনাটির সবিশেষ প্রভাব এই ফিল্মটির মন-খারাপ করা কাহিনিকে প্রভাবিত করে; একজন যুদ্ধ-বিধবা তরুণী, এবং টোকিও শহরের আবদ্ধ জীবনে সংসার করা নিজেদের ছেলে ও রুক্ষ কন্যার বাসায় কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসা বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুরীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ পুত্রবধূর চরিত্রে সেৎসুকো তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠতম অভিনয়ের জাদু দেখিয়েছেন। শ্বশুর-শ্বাশুরী চরিত্রে যথাক্রমে চিশু রিয়ু [১৯০৪-১৯৯৩] ও চেইকো হিগাশিয়ামার [১৮৯০-১৯৮০] তুখোড় অভিনয়ের জবাব বেশ দুর্দান্তভাবেই যেন দিয়েছেন সেৎসুকো, এই গভীর মর্মভেদী সিনেমাটিতে। আবেদনের বিচারে টোকিও স্টোরি একটি সার্বজনীন সিনেমা; এবং জাপানি সিনেমাটিক আর্টের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ মাস্টারপিস।

১৯৫৪ সালে মিকিও নারুসের পরিচালনায় আরেকটি সিনেমায় অভিনয় করেন সেৎসুকো– সাউন্ড অব দ্য মাউন্টেনস [Yama no oto]। অভিনেত্রী হিসেবে সেৎসুকোর অবস্থান যখন চূড়োয়, বয়স তখন তার ৩৪ বছর; এবং নিজের শিল্পের প্রতি আধ্যাত্মিক স্বাতন্ত্রের এক অসাধারণ রকমের অপার্থিব মাত্রা ছড়িয়ে দিতেই বোধ করি চিরকুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তার মায়াবী চোখ দুটো তখনো মমতায় ভরা, এবং অনিষ্টকারী গুজবের স্ফূলিঙ্গ ছড়াচ্ছিল। তবে ততদিনে তার বাম চোখে ছানি পড়তে থাকে : যদিও অপারেশন সফল হয়েছিল, তবু চোখটি হয়ে উঠেছিল যেন শকুনির মতো।

এরপর জনপ্রিয় শিশুতোষ ক্লাসিক কাহিনি অবলম্বনে, হিসাতোরা কুমাগাইয়ের [১৯০৪-১৯৮৬] নবুকো রাইডস অন অ্যা ক্লাউডস [Non-chan kumo ni noru; ১৯৫৫] ফিল্মে অভিনয় করেন সেৎসুকো। সংবাদপত্রে বেশ আনন্দের সঙ্গে শিরোনাম লেখা হয় : ‘সিনেমার পর্দায় ফিরে এলো সৌন্দর্যভরা চোখ দুটো!’ এই ফিল্মটি তার ক্যারিয়ারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদচিহ্ন হিসেবে সণাক্ত হয়ে আছে : এই প্রথমবার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করলেন তিনি। এরপর ওজু নির্মিত শোকাতুর শরৎকালিন মাস্টারপিস ফিল্মগুলোতে অভিনয় করেন সেৎসুকো : টোকিও টোয়াইলাইট [Tokyo boshoku; ১৯৫৭], অটাম স্কাইস [Aki biyori; ১৯৬০] ও অটাম অব দ্য কোহায়াগাওয়া ফ্যামিলি [Kohayagawake no aki; ১৯৬১]। সেৎসুকো তার নিশ্চুপ, সম্মোহনকারী তীক্ষনতা ও লাবণ্য দিয়ে, সিনেমার পর্দায় নিজের আরেকটি বয়সের সূচনা ঘটাতে থাকেন এ ফিল্মটির মধ্য দিয়ে।

ওজু ও সেৎসুকো

সেৎসুকো ও ওজু : এই দুই চিরকুমার শিল্পীর জীবনের গোপনীয়তা নিয়ে এক ধরনের জ্বালাতনকারী গুজব ডালপালা মেলতে থাকে, আর দর্শকদের সামনে তাদের অবস্থার একটি আবেগাত্মক ভিন্নতার বিষাদ এবং যৌন বিকৃতির অবর্ণনীয় অনাচার ছড়িয়ে পড়ে। তারা যেন আমাদের জানান দিচ্ছিলেন, দেখতে যেমন লাগে– মানবজীবন আসলে তেমন নয়; এবং কোনো সামাজিক স্বীকৃতিই শেষ কথা নয়।

ওজুকে নিয়ে লেখা এক মনোমুগ্ধকর গ্রন্থে শিগেহিকো হাসুমি [১৯৩৬-] প্রশ্ন তুলেছেন পল শ্যরেডার [১৯৪৬-], ডোলান্ড রিচি [১৯২৪-২০১৩] ও অডি বকের [১৯৪৬] মতো আমেরিকান সমালোচকদের বিরুদ্ধে– সেৎসুকো হারাকে নিয়ে এই ফিল্মমেকার যত সিনেমা বানিয়েছেন, তার সব ক’টাই সহজ-মধুরতা ও আলোর খেলা নয়। হারা আসলে ওজুর প্রেমে মগ্ন ছিলেন, এবং বয়সে অনেক বড় ও পিতৃতুল্য ওজু সে কারণেই অন্য কাউকে বিয়েও করেননি, আবার এই অভিনেত্রীর সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে গেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে হাসুমির সঙ্গে একমত নই; বরং আমার ধারণা, তাদের সম্পর্কটি হয়তো ছিল লেট স্প্রিং-এ দেখা মেলা দায়িত্ববতী কন্যা ও বুড়ো বাবার মতো : যৌন প্রয়োজনীয়তাকে পাশ কাটিয়ে একেবারেই নিবেদিতপ্রাণ সম্পর্ক সে এক

১৯৬২ সালে জীবনের শেষ ফিল্মটিতে অভিনয় করেন সেৎসুকো। ঐতিহাসিক মহাকাব্য চুশিঙ্গুয়া অবলম্বনে নির্মিত এ ফিল্মটিতে অভিনয়ের সময় আক্ষরিকঅর্থেই অস্বস্তিতে ভোগেন তিনি। ৪২ বছর বয়সে সিনেমার দুনিয়াকে বিদায় জানান, অভিনয় করার আর কোনো চরিত্র অবশিষ্ট নেই– এই ধারণা নিয়ে। যে ধরনের তরুণী ও রমনী চরিত্রে তিনি অভিনয় করতে অভ্যস্ত ছিলেন, তা ততদিনে আধুনিক জাপানের সমাজ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। গার্বো ও ডিয়েট্রিশের মতোই, তিনি শুধু সিনেমার পর্দা থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেননি, বরং নিয়েছিলেন জনসমক্ষ থেকে। এরপর জাপানি পাপারাজ্জিদের পক্ষে মাত্র একবারই বাড়িতে থাকা অবস্থায় তার একটি ছবি তোলা সম্ভব হয়েছিল; নিজের সৌন্দর্যের অবক্ষয় তিনি ভক্তদের সামনে উপস্থাপন করতে চাননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, নিজের রহস্যের মায়াবী পর্দা অক্ষতই রেখে গেছেন এই শাশ্বত কুমারী।


সেৎসুকো হারার নির্বাচিত ফিল্মোগ্রাফি

১৯৩৬ । প্রিস্টস অব ডার্কনেস [Kōchiyama Sōshun; ফিল্মমেকার : সাদাও ইয়ামানাকা]
১৩৯৭ । দ্য ডটার অব সামুরাই [Die Tochter des Samurai; আর্নল্ড ফ্রাঙ্ক/মান্সাকু ইতামি]
১৯৪০ । ওয়েডিং ডে [Totsugu hi made; ইয়াসুজিরো শিমাজু]
১৯৪৩ । দ্য ওপিয়াম ওয়ার [Ahen senso; মাসাহিরো মাকিনো]
১৯৪৬ । নো রিগ্রেটস ফর আওয়ার ইয়ুথ [Waga seishun ni kuinashi; আকিরা কুরোসাওয়া]
১৯৪৭ । অ্যা বল অ্যাট দ্য আঞ্জো হাউস [Anjō-ke no butōkai; কোজাবুরো ইয়োশিমুরা]
১৯৪৯ । ব্লু মাউন্টেন রেঞ্জ [Aoi sanmyaku; তাদাশি ইমাই]
১৯৪৯ । লেট স্প্রিং [Banshun; ইয়াসুজিরো ওজু] 
১৯৫১ । দ্য ইডিয়ট [Hakuchi; আকিরা কুরোসাওয়া]
১৯৫১ । রিপাস্ট [Meshi; মিকিও নারুসে]
১৯৫১ । আর্লি সামার [Bakushū; ইয়াসুজিরো ওজু] 
১৯৫৩ । টোকিও স্টোরি [Tōkyō Monogatari; ইয়াসুজিরো ওজু] 
১৯৫৪ । সাউন্ড অব দ্য মাউন্টেন [Yama no Oto; মিকিও নারুসে]
১৯৫৫ । নবুকো রাইডস অন অ্যা ক্লাউড [Non-chan Kumo ni Noru; ফুমিতো কুরাতা]
১৯৫৬ । সাডেন রেইন [Shūu; মিকিও নারুসে]
১৯৫৭ । টোকিও টোয়াইলাইট [Tōkyō boshoku; ইয়াসুজিরো ওজু]
১৯৬০ । লেট অটাম [Akibiyori; ইয়াসুজিরো ওজু]
১৯৬১ । দ্য এন্ড অব দ্য সামার [Kohayagawa-ke no aki; ইয়াসুজিরো ওযু]
১৯৬২ । চুশিঙ্গুরা [Chūshingura: Hana no Maki, Yuki no Maki; হিরোশি ইনাগাকি]

** সেৎসুকো অভিনীত ফিল্মের সংখ্যা প্রায় ৯৭টি


জেমস কির্কাপ । ১৯১৮-২০০৯ । ব্রিটিশ কবি, অনুবাদক, লেখক
সূত্র । ইনডিপেনডেন্ট । জাতীয় দৈনিক, যুক্তরাজ্য  

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৩ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here