লিখেছেন । প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য
বাকিটা ব্যক্তিগত
কাহিনি, চিত্রনাট্য, সম্পাদনা, পরিচালনা : প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য
প্রযোজনা : সত্রাজিৎ সেন
শব্দগ্রহণ, বিন্যাস ও মিশ্রণ : পার্থপ্রতিম বর্মন
আলোকচিত্র শিল্পী : শুভঙ্কর ভড়
আবহসঙ্গীত : অনিন্দ্যসুন্দর চক্রবর্তী; প্রচলিত
শিল্প নির্দেশনা : শুভাশিস চক্রবর্তী
স্থিরচিত্র : পার্থ ঘোষ
আলোকসজ্জা : উজ্জ্বল রায়
ব্যবস্থাপনা : অতনু মণ্ডল; মৃত্যুঞ্জয় প্রামাণিক
অভিনয় : ঋত্বিক চক্রবর্তী; অপরাজিতা ঘোষ দাস; অমিত সাহা; সুপ্রিয় দত্ত; মাধবী মুখোপাধ্যায়
ধরন : ফিচার ফিল্ম
রঙ : রঙিন
সময়-দৈর্ঘ্য : ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট
ভাষা : বাংলা
দেশ : ভারত
মুক্তি : ২০১৩
অর্জন : বেস্ট ফিচার ফিল্ম ইন বাংলা [ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড; ভারত]
ক ন সে প্ট
আমার আদি বাড়ি নদীয়ার তেহট্ট। বাবা চাকরি সূত্রে বহরমপুরে চলে আসেন। মায়ের সঙ্গে প্রেম, বিবাহ বহরমপুরেই। আমার জন্ম এবং বড় হওয়া বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। কলকাতা আসার পর প্রথমবার তেহট্ট যাচ্ছি। বহরমপুর থেকে তেহট্টর রুটটা চিনতাম। কলকাতা থেকে চিনতাম না। খোঁজ করে জানলাম, ধর্মতলা থেকে শীকারপুরের বাস ছাড়ে। তেহট্ট থামে। বাসে চড়ে পড়লাম।
তেহট্ট নামলাম। কিন্তু কিছুই চিনতে পারছি না। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করলাম। সেইসময় রাস্তাঘাট নির্জন। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমি কিছুই চিনতে পারছি না। টেনশনে পড়ে গেলাম : কোথায় এলামরে বাবা! [তখন মোবাইল ছিল না; ১৯৯৮-৯৯ হবে।] খানিকক্ষণ মনে হলো, তেহট্টটা উবে গেল নাকি? অনেকক্ষণ ধরে একজনকে দেখতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এটাই কি তেহট্ট? সে বলল, এটা তো নাজিরপুর [ছবিতে এই নামই ব্যবহার করেছি], তেহট্ট তো ফেলে এসেছেন। ফিরতি বাস ধরুন। ততক্ষণে প্রায় মিটির ২০ কেটে গ্যাছে। ফিরতি বাস ধরে তেহট্ট এলাম [গ্রামের গোটা শুটিংটাই তেহট্ট, নাজিরপুর এবং তার আশেপাশে]। আমার মনে হয়, বাকিটা ব্যক্তিগতর শুরু এখান থেকেই।

১৯৯৭-এ বহরমপুর থেকে কলকাতা আসার পর থেকে বাসে করে দীর্ঘ জার্নি– বহরমপুর টু কলকাতা। কলকাতা টু বহরমপুর। গত ১৫ বছর ধরে। হয়তো বছরখানের আগে কারও সঙ্গে দেখা হয়েছিল; এ বছর গিয়ে দেখলাম নেই, মারা গ্যাছে।
বাবা, মা, কাকা, জ্যাঠা, পিসিদের কাছে শোনা সব রূপকথার গল্প, ভুতুড়ে গল্প, তেহট্টে চালু অবিশ্বাস্য ম্যাজিক রিয়াল গল্প, এবং বাবা-কাকাদেরই বানানো নিজেদের জীবনের অত্যদ্ভূত সমস্ত গল্প শোনার প্রভাব আছে বলে মনে হয়। দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুরমার ঝুলি। অতিলৌকিক এবং অলৌকিক বিষয় আমাদের রক্তে।
এই ছবিটা প্রেম নিয়ে নয় আদৌ। এটা একটা জার্নি। খোঁজা।
খুঁজি– যেখানে পৌঁছোতে চাই… পৌঁছেও যাই হয়তো। হারিয়ে ফেলি। আবার খুঁজতে শুরু করি। প্রেমে, জীবনে, গ্রামে, শহরে, মদে, সিগারেটে, নদীতে, নারীতে… [এটা বাজে বকলাম!]।
কলকাতাকে কীভাবে দেখি, তেহট্টকে কীভাবে দেখি, মানুষজনকে কীভাবে দেখি– সেটাই আবিষ্কার করতে চাইছিলাম।
বোলান গান, হাপুগান, কৃষ্ণযাত্রা, ঝুলন– সবই উঠে যেতে বসেছে। একটু ধরে রাখা গেল আরকি।
স্বপ্ন আমি খুব পছন্দ করি। দেখতে এবং দেখাতে। রিয়েলিটির মধ্যে থেকেই।
জাদুবাস্তব নয়। আশ্চর্যবাস্তব। [এটা ইয়ার্কি মারলাম!]

ফ র্ম
সত্যিকারের মানুষজন আর তাদের অভিজ্ঞতাকে গল্পের সঙ্গে মেশাতে চাইছিলাম। তাই ডকুমেন্টারি ফরম্যাটটা। আর বেশকিছু ডকুমেন্টারি এডিট করেছি। একটা-দুটো নিজেও পরিচালনা করেছি। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়েছি। আর আমার বাংলা সিনেমার অভিনয়ের আরোপিত ন্যাকামি পছন্দ হয় না; চাইছিলাম অভিনয়টা আমরা যেভাবে কথা বলি, সেরকম হোক। রিয়েল ফিলটা থাকবে।
প্রথমে [২০০৯-এ] তো হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে করতে চাইছিলাম। প্রচুর ক্যানডিড শট লাগবে। ডকুমেন্টারির মধ্যে ফিকশনও থাকবে। অভিনেতারা কখনো ছবির চরিত্রের অভিনয় করবে, কখনো নিজের বাস্তব-জীবনের চরিত্র হয়ে উঠবে। ক্যামেরা এবং ক্যামেরাম্যানও চরিত্র হয়ে উঠবে [সিনেমাটোগ্রাফারকেও অভিনেতাদের মতো প্রায় অভিনয় করতে হয়েছে, অপেশাদার ক্যামেরাম্যানের চরিত্রে, কখনো কেঁপে যাচ্ছে, কখনো অটোফোকাসে। অটোএক্সপোজারে তুলছে, ক্যামেরা অফ করতে ভুলে যাচ্ছে– এগুলো ছবির সিনেমাটোগ্রাফার নয়, আমাদের আসল সিনেমাটোগ্রাফারকেই করতে হয়েছে। ছবির সিনেমাটোগ্রাফারের চরিত্রের মতো ক্যামেরা নিয়ে লম্ফঝম্ফ করতে হয়েছে।] আমার সিনেমাটোগ্রাফার শুভঙ্কর ভড় বলল, না, করো না। কোয়ালিটি খুব খারাপ হবে। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট পার্থ প্রতিম বর্মন [যিনি ছবির সাউন্ড ডিজাইনও করেছেন] বললেন যে, একটা নতুন ক্যামেরা বেরিয়েছে। ক্যানন ৭ডি ক্যামেরা, ডিএসএলআর। ক্যামেরা নিয়ে টেস্ট করলাম [এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন কিউ]। দুর্দান্ত। পরে আমরা ৩৫ মি.মি.ও টেস্ট করেছি।
যেহেতু পুরো ছবিটাই ডকুমেন্টারি ফরম্যাটে, এবং বেশ খানিকটা ইমপ্রোভাইজেশনের ব্যাপার থাকবে সত্যিকারের লোকজনদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন, তাদের সঙ্গে এবং তাদেরকে দিয়েই অভিনয় করাতে হবে, পারফরম্যান্স থাকবে, তাই চাইছিলাম সিঙ্ক-সাউন্ড হোক। আমাদের এখানে সিঙ্ক-সাউন্ড করা চাট্টিখানি কথা নয়। মাত্র দুজন লোক মিলে গোটা ছবিটা সিঙ্ক-সাউন্ডে রেকর্ড করেছেন। যেখানে বোম্বেতে অনেককিছু থাকে, সিঙ্ক-সিকিউরিটি থেকে শুরু করে ব্যুম-ম্যান থেকে সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, তার অনেক সহকারী– সে এক বিরাট টিম। আমাদের মাত্র দুজন। এবং শেষ অবধি একটুও ডাবিং এবং ফলি করতে হয়নি।
কোনো আলোর ব্যবহার করা হয়নি। পুরোটাই ন্যাচারাল লাইট। ঠিক করেছিলাম, কোনো কৃত্রিম আলো ব্যবহার করব না। লোকেশনও পুরোটাই প্রায় রিয়েল লোকশন। একটি জায়গা [মনু মুখার্জীর ঘর] ছাড়া কোথাও সাজিয়ে তোলা হয়নি। সেট তো পড়েইনি।

অভিনয়ে পেশাদার অভিনেতা, সাধারণ মানুষ, আমার বন্ধু, কাকা, কাকার বন্ধু, বৌদি, পিসি– সবাইকেই প্রায় ব্যবহার করেছি [শহরে-গ্রামে– দু’জায়গাতেই]। পেশাদার অভিনেতারা যারা ছিলেন, যেমন– ঋত্বিক, অপরাজিতা, অমিত আমার বহুদিনের বন্ধু। ঋত্বিক তো ছবির কনসেপ্ট করার সময় থেকেই আছে। ক্রু-মেম্বারররাও আমার খুব ঘনিষ্ঠ। ফলত, ছবিতে একটা আন্তরিকভাব এসেছে বলে আমার মনে হয়।
শহরের গানগুলো ছাড়া বাদবাকি গান সব লোকশনে গিয়ে শ্যুট। গান ব্যবহার করি আমার ভালোলাগে বলে [মিউজিক্যাল ছাড়াও গান ব্যবহার করা যায়]।
ঠিকই করেছিলাম, সব দৃশ্য একটা করে শটে নেব। কাটব না। ডকুমেন্টারি ফিলটা থাকবে। ফলত, ছবিতে ক্লাসিকাল ফিকশনাল শটও নেই, কাটিংও নেই। সবই ডকুমেন্টারিতে যে ধরনের কাটিং হয় সেরকম। ফলত এটা জাম্পকাট, ওটা ম্যাচকাট– এ আলোচনা করা বৃথা।
বিভিন্ন লোকনাট্য এবং লোকগীতির ব্যবহার করেছি। বেশি বেশি করে করেছি। ভালো করেছি বলেই মনে হয়।
খুব ছোট টিম ছিল। যার ফলে ছবিটা করে ফেলা গেল।
সিনেমার থিওরি-টিওরি মাথার মধ্যে একদম কাজ করেনি। এটা একটা খাঁটি কাহিনিচিত্র। এক্সপেরিমেন্ট বলা যেতে পারে। তবে সেটা নিজেদের কাছে এক্সপেরিমেন্ট। যেহেতু এর আগে এই প্রসেসে আমরা কোনো কাজ করিনি।
ছবিটা ভালো হয়েছে
নতুন আবিস্কারের আনন্দ পাওয়া যায়- সিনেমাটা দেখে…!!
ছবিটা এইমাত্র দেখে শেষ করলাম। ছবিটার ফর্ম, যা আপনি বলতে চাচ্ছেন তা ছবিটা দেখে যা ভেবেছিলাম আপনার এই লেখার সাথে তার প্রায় সবই মিলে যাচ্ছে।
ভাল লাগল।