সাক্ষাৎকার গ্রহণ । ফিলিপ এহেমকে ও মার্টিন ভলফ ।। অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
রোমান পোলান্সকি। জন্ম : ১৮ আগস্ট ১৯৩৩; প্যারিস, ফ্রান্স। পাম দি’অর ও অস্কারজয়ী কিংবদন্তি পোলিশ ফিল্মমেকার। রিপালশন; রোজমেরি’স বেবি; চায়নাটাউন; টেস; বিটার মুন; দ্য পিয়ানিস্ট; অলিভার টুইস্ট; দ্য গোস্ট রাইটার; ভেনাস ইন ফিউর প্রভৃতি সিনেমার নির্মাতা, সিনেবিশ্বের এই মহান সিনিয়র সিটিজেনের জীবনের নানা ট্র্যাজেডির ওপর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জার্মান ম্যাগাজিন স্পিগেল-এর দুই প্রতিনিধি। সাক্ষাৎকারটির তিন কিস্তির শেষটি হাজির করা হলো এখানে…

সা ক্ষা ৎ কা র
স্পিগেল : সেই স্ক্যান্ডালের পরপরই নাস্তাৎসিয়া কিন্সকিকে অভিনয়ে নিয়ে আপনি টেস সিনেমাটির শুটিং করেছিলেন। ঘটনাক্রমে, এটির কাহিনী ছিল যৌন-নিগ্রহের শিকার হওয়া ও সেই ভোগান্তি আজীবন নিজের মধ্যে বয়ে বেড়ানো এক তরুণীকে ঘিরে। এটি কি আপনার তরফ থেকে ছিল এক ধরনের মার্জনা চাওয়ার মতো ব্যাপার?
পোলান্সকি : আমি জানি না! টেস বানিয়েছিলাম একটা উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে; বইটির কথা শ্যারন আমাকে বলেছিল। এ সব বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার যথাযথ লোক কিন্তু আমি নই। আপনি বারবার আমার কাছে আমারই ফিল্মের ব্যাখ্যা চাইছেন। এ যেন কোনো কবির কাছে তারই কবিতার ব্যাখ্যা চাওয়ার মতো ব্যাপার। জানি, আপনার কাছে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনার সমস্যাটা এখানেই!
স্পিগেল : আচ্ছা, আরেকটার কথা বলি : দ্য গোস্ট রাইটার-এ [২০১০] আপনি এমন এক বিখ্যাত লোকের গল্প দেখিয়েছেন– যে কিনা আইনি-ঝামেলার কারণে বিদেশ যেতে পারে না। এই বিষয়টিও কোনো-না-কোনোভাবে আপনার সঙ্গে মিলে যায়।
পোলান্সকি : নিশ্চয়ই আপনি যেহেতু সাংবাদিক, তাই এটি [এ ধরনের প্রশ্নবান] কোনো ঘটনাচক্র হতে পারে না।
স্পিগেল : দশকের পর দশক ধরে আপনি স্বাধীনমতো বিদেশভ্রমণ করতে পারছেন না। দ্য গোস্ট রাইটার-এর শুটিং শেষ করার পরপরই, গেইমার-মামলায় সুইজারল্যান্ডে আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই ফিল্মটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি যে দুর্ভোগের শিকার হয়, ব্যক্তিজীবনে আপনাকেও তেমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
পোলান্সকি : হ্যাঁ; এবং এখন আমি ঘটনাচক্রের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি! আমার সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলার এটিও একটি কারণ। সাক্ষাৎকার দেওয়ার কাজটি আমার ভালোলাগে না। কেন নিজেকে আমি এ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেবো? এই যে এই সাক্ষাৎকারে, বারবার ঘুরে-ফিরে নিজ জীবনের ট্র্যাজেডিগুলো খুঁড়ে বের করা– এ বিষয়টিও নিশ্চিতভাবেই আমার ভালোলাগছে না। সামান্থার সঙ্গে সেই ঘটনাটির এ গল্পের কোনো শেষ নেই। আর এখন তো সামান্থার লেখা বইও ছাপা হয়ে গেছে। এর কখনোই শেষ হবে না। ত্রিশটা বছর স্বাধীনভাবে জীবন কাটানোর পর, কোন আক্কেলে হুট করেই তারা আমাকে গ্রেফতার করে বসল?

স্পিগেল : লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি চেয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হতে। আপনাকে গ্রেফতার করাটা তার জন্য একটা ভালো প্রচারণা বলেই মনে হয়।
পোলান্সকি : আর আমি হয়ে গেলাম যুদ্ধের ঘোড়া!
স্পিগেল : ২০০৯ সালে সুইজারল্যান্ডের কারাগারে কাটানো দুটি মাস, এবং এরপরের সাতটা মাস গৃহবন্দি হয়ে থাকা– দিনগুলো কেমন ছিল?
পোলান্সকি : এ প্রশ্নটা করায় ধন্যবাদ। আপনার কী মনে হয়, কেমন ছিল? আমার পরিবারের জন্য, বিশেষ করে আমার সন্তানদের জন্য খুবই বাজে ব্যাপার ছিল এটি। অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে ওদের। এ বয়সে নিজের বাবাকে এক বছরের জন্য খুইয়ে ফেলা খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তাছাড়া, দ্য গোস্ট রাইটার-এর এডিটিংয়ের কাজ বাকি ছিল। এ রকম জঘন্য একটি ঘটনার পর ফিল্মটিতে মন দিতে পারছিলাম না। শত-শত মানুষের জীবন ও প্রচুর অর্থ নির্ভর করে ছিল ফিল্মটির ওপর। কারাগারে আমার জন্য পুরনো একটা কম্পিউটার ছিল ঠিকই; তবে সেটিতে কোনো ইন্টারনেট কানেকশন ছিল না।
স্পিগেল : কারণ, সেটা তো একটা কারাগার।
পোলান্সকি : কারাগারে আমার কাছে ডিভিডিতে করে [ফিল্মটির] রাফ-কাট পাঠানো হয়েছিল। কী কী এডিট করতে হবে– সেই নোট লিখে নিয়েছিলাম আমি। তারপর নোটগুলো দিয়েছিলাম আমার অ্যাটর্নিকে; তিনি জানালেন, পুলিশকে দেখাতে হবে এগুলো। অবশ্য তারা কোনো ঝামেলা পাকায়নি। অবশেষে আমার অ্যাটর্নি এই নোটগুলো আমার ফিল্ম-এডিটরের কাছে পাঠাতে পেরেছিলেন– যিনি আমার দেওয়া চেঞ্জগুলো বাস্তবায়ন করেছেন। ভীষণ জটিল প্রক্রিয়া ছিল এটি। এক পর্যায়ে ওয়ার্ডেনের [কারাগার-পরিচালক] সঙ্গে কথা বলেছি আমি। আমাকে আটকে রাখায় তিনি অনেকটা বিব্রতবোধ করছিলেন। তিনি বলেছেন, এটা কোনো সমস্যা নয়; বলেছেন, আমার এডিটর কারাগারে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন, সঙ্গে নিয়ে আসতে পারবেন তার এডিটিং কম্পিউটারও। ফলে কারাবন্দিরা সাধারণত যে ঘরটিতে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ায়, সেখানে বসেই ফিল্মটির এডিট করতে পেরেছি। পেঁয়াজের বিশ্রি গন্ধে মৌ মৌ করছিল আশপাশ। ওয়ার্ডেনটি আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।

স্পিগেল : বন্ধু?
পোলান্সকি : হ্যাঁ। রোববারের দিনগুলোতে কারাগারে আমরা দাবা খেলতাম। আমি মুক্তি পাবার পর, তিনি প্যারিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন; এমনকি গ্যস্তাদে আমার বাসায়ও এসেছেন।
স্পিগেল : আপনার অনেক পুরনো বন্ধু, প্রডিউসার অ্যান্ড্রু ব্রাউন্সবার্গ একবার বলেছিলেন, জীবনের এমন বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে আপনার মতো আর কাউকে দেখেননি তিনি।
পোলান্সকি : এটা কিন্তু অতিরঞ্জন! আমার চেয়েও অনেক বেশি যন্ত্রণা সহ্য করেছেন– এমন মানুষও আছেন। একটা ব্যাপার হলো, আমি বরাবরই স্বাস্থ্যবান থেকেছি। অন্য লোকগুলোর দিকে যখন তাকাই, অপরাধবোধে ভুগতে থাকি।
স্পিগেল : আপনি কি মনে করেন, জীবনের এই দুর্যোগগুলো আপনাকে কোনো-না-কোনোভাবে বর্তমানের এমন একজন শিল্পীতে পরিণত করে তুলেছে?
পোলান্সকি : তার মানে আপনি সেই লোকগুলোরই একজন– যারা ভাবেন, শিল্পীকে দুর্ভোগের ভেতর দিয়েই যেতে হয়। তার মানে, আমার দুর্ভোগ বেশি ছিল বলে আমি সৌভাগ্যবান?
স্পিগেল : বিষয়টা খানিকটা বিদ্রূপাত্মক।
পোলান্সকি : বিদ্রূপ আমি করছি না।
স্পিগেল : এ সবকিছু সত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত আপনি একজন সুখী মানুষ হতে পেরেছেন?
পোলান্সকি : হ্যাঁ; যদিও জীবনের কিছু পর্যায়ে এমনটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

স্পিগেল : আপনি একবার বলেছিলেন, সবকিছুই সম্ভবত পূর্বনির্ধারিত বিষয়।
পোলান্সকি : হ্যাঁ, সম্ভবত। আমি ধার্মিক নই। তবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। ঈশ্বরই সবকিছু নির্ধারণ করেন– এ কথা যদি আপনি বিশ্বাস না করে থাকেন, তাহলে বিজ্ঞানে বিশ্বাস আপনার। তাহলে বিগ-ব্যাঙে বিশ্বাস রাখতে হবে আমাদের। আর বিগ-ব্যাঙের হিসেবে, বস্তুকণার প্রত্যেকটি অংশই সেটির অবস্থানের নিজস্ব সম্পদ।
স্পিগেল : তার মানে, আপনি আশাবাদী মানুষ।
পোলান্সকি : তা-না-হলে তো আজকে আপনার সঙ্গে কথা বলতাম না। আমার সন্দেহ, আমাকে সম্ভবত নৈরাশ্যবাদী মানুষ হিসেবেই ভাবে সবাই।
স্পিগেল : শ্যারন টেটকে অভিনয়ে নিয়ে বানানো দ্য ফিয়ারলেস ভ্যাম্পায়ার কিলারস ফিল্মটি কি আর দেখতে পারেন?
পোলান্সকি : ওহ, এই যে শেলফে পাম দি’অর, অস্কার, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বিয়ার [গোল্ডেন বিয়ার]– এই যে পদকগুলো, এগুলো পাওয়ার কারণগুলোর একটি তো এটি। এগুলো এখানেই থাকে। যখন কোনো অ্যাওয়ার্ডের দিকে তাকাই, মনে হয়, এগুলো হাতে তুলে নেওয়ার মুহূর্তটিতে নিজের অনুভূতি কেমন ছিল– তা স্মরণ করা উচিত আমার। কিন্তু তার কোনো মানে নেই। এগুলো স্রেফ ধূলি বাড়াচ্ছে। কাউকে ধূলির মধ্যে ফেলে দিতে চাইলে, নিজেকে নিয়েই ভাবতে হবে আপনাকে।
সূত্র • স্পিগেল। ম্যাগাজিন, জার্মানি। ১২ নভেম্বর ২০১৩
[…] পরবর্তী কিস্তি […]