আলো ক্রমে আসিতেছে : সুব্রত মিত্র/ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

1971
সুব্রত মিত্র
জন্ম : ১২ অক্টোবর ১৯৩০ । কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মৃত্যু : ৭ ডিসেম্বর ২০০১ । কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

লিখেছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়


কজন লেখকের স্বাধীনতা কী যে পারাপারহীন। অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের সূচনায় কমলকুমার মজুমদার লিখে চলেন– ‘এই নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনর্বার আমরা, প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।’ এই আলো যা পৃথিবীর নয়, সমুদ্রেরও নয়– লেখক তা অনুভব করে নেন। অথবা আর একটি দৃষ্টান্ত দিই। ‘সন্ধ্যার উড্ডীন কেশপাশ’– এই ‘উড্ডীন’ বিশেষণটি খুঁজে পাওয়ার জন্য কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত শ্রান্তিহীনভাবে নাকি ব্যয় করেছিলেন সমগ্র সন্ধ্যা। শব্দের জন্য এই তপস্যা লেখককে মানায়; কেননা, শব্দের বাস্তব যে মায়াকাননের ফুল তা আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু যন্ত্রকে এ রকম স্বরাজ দিতে আমরা একটু দ্বিধা করি। ক্যামেরা নামের যন্ত্রটি তো আমাদের সন্দেহ থেকে মুক্ত নয়। বাস্তবের একটি প্রামাণ্য নকল রচনা করা যার কাজ, তাকে আমরা কলম বা তুলিম সম্মান দেব কেন? আর তাই একটি সাদা-কালো বিজ্ঞাপনচিত্রের চায়ের লিকারের যথার্থ রং পাওয়ার জন্য সুব্রত মিত্র যখন অকাতরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন, তখন আমরা ভুরু কুঁচকে ভাবতাম– ভদ্রলোকের কি মাথা খারাপ? যিনি পথের পাঁচালী বা চারুলতার মতো অসামান্য ছায়াছবির আলোকচিত্রী, তাকেও চট করে দাম দিতে আমাদের অস্বস্তি হয়েছে; মনে হয়েছে নিখুঁত হওয়ার জন্য সুব্রত মিত্রের প্রয়াস হয়তো বাড়াবাড়ি রকমের বাতিক। যন্ত্র সাহেবদের সূত্রে এদেশে এসেছিল বলেই যন্ত্র প্রসঙ্গে আমাদের উদাসীনতা। হয়তো সুব্রত মিত্র কিছুটা পাগল; কিন্তু ভুললে চলবে না, আমৃত্যু তার চিত্রমালা পাগলামির কারুশিল্প। প্রয়াত সুব্রত মিত্র প্রকৃতই অযান্ত্রিক।

পথের পাঁচালী

এরপরে যা জরুরি প্রশ্ন, তা হলো, সুব্রত মিত্র ছায়াছবিতে ক্যামেরাম্যান ছিলেন; আর মনে রাখার যে, সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত প্রথম পর্বের, পথের পাঁচালী [১৯৫৫] থেকে নায়ক [১৯৬৬], তিনিই ছিলেন প্রধান আলোকচিত্রী। তবু আমরা তার বিষয়ে কিছু উচ্ছ্বসিত মন্তব্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে চাই না কেন? এর একটা কারণ হতে পারে, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ; আর একটা কারণ হতে পারে তার অভিমান; আর একটা কারণ হতে পারে ছোট এই শহরের গেরস্থালিতে তার অপটু জনসংযোগ ও অতিরিক্ত আত্মসচেতনতা। সে যা-ই হোক, বাংলা ছবির ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তির অধিক; শুধু তাই নয়, আমাদের ধুলোমাটিতে একটি মিচেল বা অরিফ্লেক্স ক্যামেরার সৌজন্যে আন্তর্জাতিকতার আকাশেও নক্ষত্র।

অথচ সুব্রত মিত্রের [১৯৩০-২০০১] জীবন তো শুরু হয়েছিল অন্য ছন্দে। জন্মেছিলেন মিশ্র ঘরানার একটি বাঙালি পরিবারে– যেখানে রক্ষণশীলতা আর বিলেতি শিক্ষার সহাবস্থান। মাতুতালয়– জলসাঘর-এর জমিদারবাড়ির মতো থাম আর খিলানের; দাদু কিছুদিন আঁকা শিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে। বালক সুব্রত সে বাড়ির আলো-আঁধারি নিজের স্মৃতির সঞ্চয় করে রেখেছিলেন নিশ্চয়। অন্যদিকে ঠাকুরদাদা ছিলেন বিলেত-ফেরত ডাক্তার। ১৮৮৬-৮৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাওয়া তার সোনার মেডেল থেকে গেছে নাতির জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার’। রবিবার সকালে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে কখনও সাইকেলে চেপে চলে যেতেন কাছের সিনেমা-হলের সকালবেলার শো’তে। ভবিষ্যতে যার সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতায় সুব্রত বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠবেন, সেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে তার অবিশ্বাস্য মিল।

সুব্রত মিত্র নিজেই জানাচ্ছেন, গ্রেট এক্সপেকটেশনস [১৯৪৬] ও অলিভার টুইস্ট [১৯৪৮]– চার্লস ডিকেন্সের এই কাহিনী দুটির যে চিত্ররূপ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পরিচালক ডেভিড লিন, তা তাকে টেনেছিল। উপন্যাসের আখ্যান কীভাবে চলচ্চিত্রে বদলাতে থাকে– এই জানারও থেকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো গাই গ্রিনের অল্প আলোর লাইটিং। পরের বছর দেখলেন পরিচালক ক্যারল রিডের দি থার্ড ম্যান [১৯৪৯]। সুব্রত কিন্তু আসলে দেখলেন রবার্ট ক্রাসকারের ক্যামেরা। যেমন মঁসিয়ো ভিনসেন্ট [১৯৪৭] দেখার সময় তন্ময় হয়েছিলেন ক্লোদ রনোয়ার অস্বাভাবিক ক্যামেরা নৈপুণ্যে। স্বপ্নে-জাগরণে ক্যামেরা তাকে হাতছানি দিতে শুরু করল। আর কী ছিল বিধাতার মনে, একদা কী করিয়া মিলন হলো দোঁহে– ক্লোদ রনোয়ার সঙ্গে তরুণ সুব্রত মিত্রের দেখা হয়ে গেল সিন্ধুপারে নয়, কলকাতার রৌদ্রালোকিত রাজপথে। আসলে সিনেমার ইতিহাসে যিনি দেবতার মর্যাদা পান, ফরাসি দেশের অবিনশ্বর চলচ্চিত্রস্রষ্টা জঁ রনোয়া তার দি রিভার ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে আলোকচিত্রী ভাইপো ক্লোদ। প্রথমে নিজেই চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু বিফল হন। অবশেষে তার বাবার সর্নিবন্ধ অনুরোধে জঁ রনোয়া নেহাতই দরাপরবশ হয়ে সুব্রতকে ‘অবজার্ভার’ হিসেবে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। কী আশ্চয! সুব্রত, যেন তপোবনে ঋষিকুমার, ছবি এঁকে এঁকে আলোর ব্যবহার, অভিনেতাদের চলাচল, ক্যামেরার অবস্থান সম্পর্কে অবিরত ও অক্লান্ত নোট নিতে থাকলেন। একদিন তার ডাক পড়ল ভিতর সভার মাঝে। স্বয়ং জঁ রনোয়া মুগ্ধ হয়েছেন তার পর্যবেক্ষণে। এরপর ক্লোদ রনোয়া লাইট কনটিউনিটির জন্য তার এই খাতার শরণাপন্ন হবেন। এই ছবি বস্তুত ভারতীয় চলচ্চিত্রে আধুনিকতার আঁতুড়ঘর। এখানেই সুব্রতর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তের– যিনি সেটের কাজ করেছিলেন। আর এখানেই রবিবার, সাপ্তাহান্তিক ছুটির দিনে, শুটিং দেখতে আসতেন তরুণ চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী সত্যজিৎ রায়। সুব্রত আগন্তুককে অক্লান্তভাবে বুঝিয়ে যেতেন বাস্তবের অনুপুঙ্খ। অবশেষে সত্যজিৎ মেনে নিলেন– ‘আপনার দেখার চোখ এখন সম্পূর্ণ’। আর তাই মাত্র একুশ বছর বয়সে, কোনওরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই অথবা, শুধু স্থিরচিত্রের অভিজ্ঞতা নিয়েই, সুব্রত মিত্র দায়িত্ব নিলেন সেই ছবির চিত্রগ্রহণের– যা বিশ্বচলচ্চিত্রের একটি ক্রোশপ্রস্তর। ভূমিষ্ঠ হলো পথের পাঁচালী সত্যজিৎ রায় অবশ্য, পথের পাঁচালীর জন্য প্রথম ঠিক করেছিলেন ছিন্নমূলখ্যাত নিমাই ঘোষের নাম। তামিল সিনেমার চাপ নিমাইবাবুকে অব্যাহতি দিলো না। ফলে সেই শূন্যস্থান ভরাট করতে হলো সুব্রত মিত্রকে।

শেক্সপিয়ারওয়ালা

কিন্তু সুব্রত মিত্র তো শেষবিচারে একজন চিত্রগ্রাহক। বড়জোর তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে অপুত্রয়ীসহ দশটি ছবি করেছেন। জেমস আইভরির সঙ্গে শেক্সপিয়ারওয়ালাসহ চারটি ছবি, বাসু ভট্টাচার্যের তিসরি কসম [১৯৬৫], রমেশ শর্মার নিউ দিল্লি টাইমস [১৯৮৫]– আরও কয়েকটি ছবি নিশ্চয়ই যোগ করা যেতে পারে; তবু সুব্রত মিত্র সংখ্যায় পরিব্যাপ্ত নন। তাহলে তাকে আমরা এত গুরুত্ব দেব কেন? একটিও উত্তর : সুব্রত মিত্র ছবির পর্দায় এমন মায়াবী আলো, এমন কনে দেখা আলো খুঁজে পেয়েছিলেন যে, দুনিয়ার চলচ্ছবিও জানল আলোর স্বরলিপি কী-রকম চলমান রূপের কথায় ঝলমল করে ওঠেপথের পাঁচালীতে যখন অপু চোখ মেলল, তখন ভারতীয় সিনেমাও প্রথম দৃষ্টির ঐশ্বর্য খুঁজে পেল। ছায়াছবি যে মূলত ইমেজের, আর সেই ইমেজ যে মূলত আলোর মলাটে ধৃত দৃশ্যের প্রতিমা– এ কথা সুব্রত মিত্রের আগে কোনও বাঙালি সিনেমাটোগ্রাফার বুঝতে পারেননি– না প্রমথেশ বড়ুয়া, না নীতিন বসু।

গ্যালিলেওর জীবন নাটকে বোর্টোল্ট ব্রেশট এক জায়গায় লেখেন– ‘অনেক সময় আমি ভাবি যে, সানন্দে ভূগর্ভের অতল তিমিরে বদ্ধ থাকব, যদি পরিবর্তে জানতে পারি– আলো বলতে কী বোঝায়?’ চলচ্চিত্র যদি আলোর পট হয়, তবে সিনেমা নানাভাবে আলোর দিকে তাকিয়েছে। আদিযুগের ছবিতে আলোর নিয়ন্ত্রণই ছিল না; তারপরে শিল্পীদের স্টুডিয়োতে যেমন হয় সাদা ক্যানভাসের মধ্য দিয়ে সূর্যরশ্মিকে ফিল্টার করিয়ে খানিকটা নরম ও ছায়াহীন ইমেজ তৈরি হওয়া শুরু হলো। জার্মান অভিব্যক্তিবাদীরা আলো ও ছায়াকে দিয়ে নকশা বানালেন, যাকে বলে ক্যারোস্কুরো। রেমব্রানটের পটে এই আঁধারঘন নাটকীয়তার সূত্রপাত আর তা আতঙ্ক আর রহস্য ছড়াল দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী জার্মান সিনেমায়। হলিউড অতঃপর ফ্রেমে গল্পের আদল ও বাস্তবের আয়তনের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার কারণে আবিষ্কার করল সুপরিচিত আলোক-রচনা– যেখানে আলোর উৎস মোটামুটি চারটি :
ক. কি-লাইট– যা দ্রষ্টব্যকে আকার দেয়
খ. ফিলিং লাইট– যা অনভিপ্রেত ছায়া অপসারণ করে
গ. ব্যাক লাইট– যা ক্যামেরার উল্টোদিক থেকে এসে দ্রষ্টব্যকে পটভূমি থেকে আলাদা করে দেয়, এবং
ঘ. ব্যাকগ্রাউন্ড লাইট– যা সেটের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে।

নায়ক

পৃথিবীর অন্যতম নামী ও দামি ক্যামেরাম্যান নেস্তর আলমানদ্রোস চলচ্চিত্রের আলো ব্যবহারকে এইভাবেই বর্ণনা করেন ১৯৫৯ সালে ফিল্ম কালচার পত্রিকায়। কিন্তু সবকিছু পাল্টে গেল দুজন মহৎ সিনেমাটোগ্রাফারের আবির্ভাবে– ঠিক যেন বেতার সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ইতালীয় মার্কিনি ও ভারতীয় জগদীশচন্দ্র– ভিসকন্তির সাদা-কালো লা তেরা ত্রেমা [১৯৪৮] ও রঙিন সেনসো [১৯৫৪] আর ডি সিকার উমবার্তো ডিতে [১৯৫২] নিতান্ত অনভিজ্ঞ জি আর আলডো প্রাকৃতিক আলোর সঙ্গে নির্দিষ্ট মাত্রার কৃত্রিম আলো যোগ করে অতিরিক্ত আলো বাউন্স অফ করিয়ে দিলেন; আর এই পরীক্ষা বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিত থেকেও ভারতীয় যুবক সুব্রত মিত্র ডিফিউজড লাইটিং-এর উদ্ভাবন করলেন সত্যজিৎ রায় কৃত অপরাজিত [১৯৫৬] ছবিতে। আলডো যেমন রং বিষয়ে তার অন্যরকম স্বাক্ষর রাখেন সেনসোতে, সুব্রত তেমনই বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল ছেপে দিলেন সত্যজিতের প্রথম রঙিন ছবি কাঞ্চনজঙ্ঘায় [১৯৬২]।

সুব্রত আলডোর মতোই চলচ্চিত্রজীবনের আগে স্থির চিত্রগ্রাহক ছিলেন। হয়তো সেজন্যই তারা দুজনেই আলোর মুগ্ধ প্রণয়ী ছিলেন। কিন্তু আমি সুব্রতবাবুকে অধিকতর কৃতিত্ব দেবো; কেননা, আলডো যদিও আলোকে হলিউডের নাটুকেপনা থেকে আলাদা করে অন্যরকম জলবায়ুতে নিয়ে এলেন, কিন্তু যতদিন পর্যন্ত না ফ্রান্সে নবতরঙ্গ আন্দোলনের সূত্রে ষাট দশকে রাউল কুতার মূলত গোদার, ত্রুফো ও রোমারের ছবিতে সেট ছাড়া স্বাভাবিক পরিবেশে [সেটে ছাদ থাকত না, কিন্তু মূলত জ্যঁ-লুক গোদার সিলিং যুক্ত করে শুটিং চালু করায় আলোর বিন্যাস পাল্টে, প্রতিফলিত আলোর ওপর জোর পড়া শুরু হয়] আলোর অবস্থানই পাল্টে ফেলে রেখাচিত্রের বদলে ঘনত্বে গুরুত্ব আরোপ করলেন ততদিন পর্যন্ত নববাস্তববাদী আলোর রাজ্যভিষেক সম্পূর্ণ হলো না। অপরদিকে ভারতীয় বাস্তববাদী সুব্রত মিত্রকে অপরাজিত ও জলসাঘর [১৯৫৮], কাঞ্চনজঙ্ঘা ও নায়ক ছবিতে সব্যসাচীর মতো এই দুটি দায়িত্বই পালন করতে হয়েছে। আমাদের আলোর সাম্রাজ্যে নব ভগীরথ তিনিই। আলো প্রয়োগের আধুনিকতা আলডো ও কুতারের সঙ্গে তার নাম বন্ধনীভুক্ত করে ধন্য হয়। অকারণে ইস্টম্যান কোডাক তাকে জীবনের পড়ন্ত রোদ্দুরে [১৯৯২] লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দেয়নি হাওয়াই দীপপুঞ্জে ডেকে নিয়ে। অকারণে নেস্তর আলমানদ্রোসের মতো ক্যামেরা-প্রতিভা সবিনয়ে দ্রোণাচার্য সুব্রত মিত্রকে না চিনেও একলব্যের মতো তার শিষ্য হওয়ার দাবি করতে না, গোবিন্দ নিলাহনি আমাদের এ তথ্য জানান। আর রমেশ শর্মাকে একলা পেয়ে আশির দশকের প্রান্তে স্বয়ং আলমানদ্রোস বিদেশ থেকে পাঠিয়ে দেন একটি অসামান্য প্রণামপত্র। তাতে ছিল, ‘To a maestro from a student with admiration’। হতেই পারে সুব্রত মিত্র একবারের বেশি জাতীয় পুরস্কার পাননি। তাও শেষদিকে রমেশ শর্মার নিউ দিল্লি টাইমস-এর মতো অকিঞ্চিৎকর ছবির জন্য। কিন্তু আলমানদ্রোস বা স্তোরারোর মতো দিকপাল সিনেমাটোগ্রাফার পশ্চিমা গোলার্ধ্ব থেকে যাকে ‘শ্রীচরণেষু’ বলেন, তিনি তো মহাকালে অর্ঘ্যই পেয়ে গেলেন; জাতীয় পুরস্কার কর্তৃপক্ষের ষড়যন্ত্রী মশাইরা বরং মূর্খতার শিরোপা পেয়ে স্মরণীয় হবেন– লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গাও তো তাদের নেই আর।

শুটিংয়ে সুব্রত মিত্র ও সত্যজিৎ রায়

আলমান্দ্রোস একবার বলেছিলেন, ক্যামেরাম্যানই প্রথম দর্শক। অর্থাৎ দৃশ্যের কৌমার্যমোচন ক্যামেরারই কাজ। সুব্রত ‘লুক থ্রু’র সময় আসলে যা খেয়াল করতেন, তা হচ্ছে চোখের অভ্যুত্থানের ক্ষমতা, যাকে ধীমান ফরাসি চলচ্চিত্রস্রষ্টা রবের ব্রেঁস বলবেন, ‘ইজ্যাকুলেটরি কোর্স অব দ্য আই’। সুব্রত মিত্র যে এত নৈপুণ্যের পক্ষপাতী ছিলেন, তারও কারণ তিনি জানতেন তিনিই দর্শককে চক্ষুদান করবেন, প্রথম প্রেমিক তিনি– তাকে ছাড়া দর্শক সৌন্দর্যের আধ্যাত্মিক মাত্রা বুঝতে পারবে না।

মনে পড়ে পথের পাঁচালীর সেইসব আউটডোর। বালিকা দুর্গা যখন কচুপাতায় মুখ লাগায়, তখন সূর্যরশ্মিও কী রকম তরুণ হয়ে ওঠে। হয়তো সুবত জঁ রনোয়ার পাঠশালাতেই এসব শিক্ষা লাভ করেন, তবু এ রকম ইমপ্রেশনিস্ট ক্যামেরা আমরা আগে দেখেছি কি? একদিকে এদুয়ার মানে-এর মতো ইমপ্রেশনিজমের প্রাথমিক শর্ত– প্রকৃতিতে রেখা নেই, সেই মেঘলা আলো আর বিস্তৃত ধানক্ষেতে অপু, অন্যদিকে কাশবনে সাদা-কালোর ঐতিহাসিক জ্যামিতি, সামান্য দুটি সরকারি আর্কল্যাম্পের সাহায্যে অসুস্থ দুর্গার ঘর থেকে চিনিবাসের চিত্রগ্রহণ অন্ধকার ও আলোয় একটি প্রায় অলীক সেতুবন্ধন। আমাদের নবমেঘদূত কি সুব্রত মিত্র ছাড়া সম্ভব হতো? অথবা ধরা যাক অপরাজিতর কথা, যেখানে একটি জীর্ণ অরিফ্রেক্স ক্যামেরার দাক্ষিণ্যে বাউন্সড ডিফিউডজ লাইট-এর প্রাচ্যরীতি আবিষ্কৃত হলো।

কী যে কালীদাসের উপমার মতো উপমারহিত দৃশ্যপর্যায় : হরিহর স্নানান্তে দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে উঠে আসে, পথে পা দেয়। শুধু আলোর একটি আয়তক্ষেত্র বলে দেয় সময়ের লয়; ভোর শেষ হয়ে গেল। এরপর হরিহরের অন্তঃপুর। কিন্তু অনিবার্যকারণে বংশী চন্দ্রগুপ্তকে সর্বজয়ার উঠোন সেটে বানাতে হলো আর ইতিহাসের অলৌকিক চক্রান্তে সুব্রত মিত্র সাদা কাপড় থেকে আলো প্রতিফলিত করে উদ্ভাবন করলেন পেলব, বারাণসীর প্রায়ান্ধকার বাড়িতে যে কোমল আলো থাকে– সেই আলো। এই আলোর তারতম্য বলে দিলো, কাশীর উষা কতটা আলাদা প্রদোষের হয়। চারুলতার জন্য সুব্রতকে কিন্তু অন্য কৌশল নিতে হলো। যেহেতু সত্যজিৎ স্থানের গুরুত্ব ও মাত্রা বাড়াতে চাইছিলেন, সুতরাং সুব্রত কাঠের বাক্সের সাহায্যে বাউন্স লাইটিং-এর ছলনা নির্মাণ করে দিলেন। আর কাঞ্চনজঙ্ঘাতে তো রং অজানা অধ্যায় রচনা করে দিলো। কুয়াশার মধ্যে রঙের যে অস্বচ্ছতা– যেন বৃষ্টি ভেজা গাড়ির জানলা দিয়ে দেখা রঙিন পৃথিবী– এ তো সাদা-কালো আর রঙের অন্তর্বর্তী স্তর– রঙিন ফটোগ্রাফিক এমন আশ্চর্য রূপসী পাহাড়কে কে কবে দেখেছে দুনিয়ার বায়োস্কোপে?

অপরাজিত 

যে পারে, সে পারে! শিল্পীরাই পারে নক্ষত্রনারীর কেশপাশ বিন্যাস্ত করতে। কুরোসাওয়ার রশোমন ছবিতে যখন অশরীরা আবির্ভূত হয়, আমরা ভুলে যাই অন্ধকারে থাকার কথা ছিল, নেই; আছে চড়া আলো। এই আর্য প্রয়োগ কুরোসাওয়াকেই মানায়। যেমন সুব্রত মিত্র– তিনি নব্যবাস্তববাদী ব্যাকরণ অনুযায়ী সাধারণত একটি বিশ্বাসযোগ্য আলোর উৎস ফ্রেমে রাখেন, পছন্দ করেন না তীব্র কনট্রাস্ট। কিন্তু ইন্দির ঠাকরুন যখন বালক অপুকে রূপকথার গল্প শোনান, তার মিচেল ক্যামেরা অভাবনীয়রূপে রচনা করে দেওয়ালে ছমছম করা ছায়ামূর্তি– ব্রেমবান্ট এফেক্ট।

শেক্সপিয়ারওয়ালায় তার ডোর যেন মনোক্রমের আনন্দভৈরবী। পাহাড়ের বৃষ্টির ইন্দ্রিয় শিহরণ চুম্বন করে তার ক্যামেরা। আসলে সুব্রত মিত্র তো ছবি তোলার আগে সেতার বাজাতেন। দি রিভার ছবিতে জঁ রনোয়া তাকে দিয়ে টাইটেল মিউজিক করেন। আর অনেকেই জানেন না, পথের পাঁচালী ছবিতে সেই বাঁকে করে মিঠাইওয়ালার চলে যাওয়ার অবিস্মরণীয় দৃশ্যতে যে সঙ্গীত– তা সুব্রত মিত্রেরই রচনা। রবিশঙ্কর বিদেশে থাকায় সত্যজিৎ রায়কে এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু এসব দৃষ্টান্ত আমাদের বলে দেবে যে, ক্যামেরার গতি তারপক্ষে হয়ে উঠবে আলোর অপেরা। একবার আমাদের বন্ধু চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ সুব্রত মিত্রর প্রসঙ্গে এক আড্ডায় বলেছিলেন, সুব্রতবাবুর কাছে ক্যামেরার লেন্স হচ্ছে স্বরলিপির নোট। টেলি থেকে ওয়াইড পর্যন্ত যেভাবে দৃশ্যগ্রহণের পরিকল্পনা করা হবে, বা লং-ফোকাস কীভাবে ইমেজকে অর্থময় করে দেবে– এসব জিজ্ঞাসার মধ্যেই স্বরলিপির মতো অঙ্ক রয়েছে। সুব্রত মিত্র ছাত্রদের খুব সুন্দরভাবে শেখাতেন– আলোর রেশিও হচ্ছে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা। মানে এই যে গ্রে স্কেল, কালো থেকে সাদার আসা– এটা যেন সাতটা নোট– তার মধ্যেই মেজর-মাইনর যা-কিছু। চারুলতা ছবিটি দেখতে দেখতে, বিশেষত সূচনায়, আমার মনে হয় নিঃসঙ্গ যুবতী আর তাকে ঘিরে থাকা বস্তুর স্তূপ সব একই গতির মহিমা পাচ্ছে ক্যামেরার থেকে। আর যখন চারুলতার সামনে ও পেছনে আলোর ঘনত্ব একই রেখে তিনি চারুলতাকে দামি আসবাব ও গৃহসজ্জায় বন্দি করে ফেলেন, আমরা বুঝে ফেলি ওই নারীর যন্ত্রণার উৎস : ভূপতির পরিবারে থরে থরে সাজানো সম্পদের দারিদ্র্য; এত জিনিসপত্র যে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘উচ্ছ্রিয়া উঠিবে বিশ্ব পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুর পর্বতে’।

চারুলতা

জঁ রনোয়ার লোকেশনে বিদ্যার্থী হিসেবে সুব্রত মিত্র যৌবনের শুরুতেই বুঝেছিলেন– সন্ন্যাসীরা যেভাবে অঞ্জলি দেন, শিল্পীরা সেভাবেই ক্যামেরায় চোখ রাখেন। কারিগরি বিদ্যা ও উত্তম কৃৎকুশলতা তাদের অন্বিষ্ট নয়। ফলে সুব্রত মিত্র আজীবন দৃশ্যের অরণ্যে যা পাখির চোখ অর্থাৎ দৃশ্যের মর্ম উদ্ধার করার চেষ্টায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। হয়ে উঠেছেন নিজেই ‘প্রিসিশন ইনস্ট্রুমেন্ট’। স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই তিনি সভয়ে পরিহার করেছেন স্বভাবের দাসত্ব। মাধবী মুখোপাধ্যায়কে তো আমরা অনেক দেখেছি; তাহলে চারুলতায় তাকে দেখে মনে হলো কেন– প্রিয়তমা, সুন্দরীতমা, যে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার। আর তিসরি কসম-এ ওয়াহিদা রহমানকে নশ্বরতার দরজা পার করে দিলেন তেমনভাবেই। রাজকাপুরের সঙ্গে তাকে দেখে মনে হলো– সে আর সপ্তমীতিথি : চাঁদ।

হয়তো সুব্রত মিত্র বুঝতে পেরেছিলেন আলোর এই ঝরণাস্রোত আমাদের মনের দরজায় অথবা ছবিঘরের পর্দায় ঠিকমতো পৌঁছবে না। বার্গম্যানের ক্যামেরা পরিচালক নিকভিস্ট ছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয় আলোকচিত্রী। তার ছবিও প্রোজেকশনের দুর্দশায় তিনি দেখতে পারতেন না। অসহ্য মনে হতো। তবু সুব্রত চশমার লেন্সের মধ্য দিয়ে আজীবন দেখে গেছেন। প্ররোচিত করেছেন অপ্রত্যাশিতকে, প্রত্যাশা করেছেন অপ্রত্যাশিতের। যদি একদিন অপু-দুর্গার মতো তারও জীবনরহস্য আলোকযাত্রায় চলে যায় অজানা গন্তব্যের দিকে। সত্য অননুকরণীয়; মিথ্যা অপরিবর্তনীয়– এই জেনে আলোর আশ্রয়ে ধার্মিকের মতন অবিচল থেকে গেলেন তিনি


সুব্রত মিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি

১৯৫৫ । পথের পাঁচালী [সত্যজিৎ রায়]
১৯৫৬ । অপরাজিত [সত্যজিৎ রায়]
১৯৫৭ । পরশ পাথর [সত্যজিৎ রায়]
১৯৫৮ । জলসাঘর [সত্যজিৎ রায়]
১৯৫৯ । অপুর সংসার [সত্যজিৎ রায়]
১৯৬০ । দেবী [সত্যজিৎ রায়]
১৯৬২ । কাঞ্চনজঙ্ঘা [সত্যজিৎ রায়]
১৯৬৩ । দ্য হাউসহোল্ডার [জেমস আইভরি]
১৯৬৩ । মহানগর [সত্যজিৎ রায়]
১৯৬৪ । চারুলতা [সত্যজিৎ রায়]
১৯৬৫ । শেক্সপিয়ারওয়ালা [জেমস আইভরি]
১৯৬৬ । নায়ক [সত্যজিৎ রায়]
১৯৬৬ । তিসরি কসম [বসু ভট্টাচার্য]
১৯৬৯ । দ্য আর্চ [তাং সু সুয়েন]
১৯৬৯ । দ্য গুরু [জেমস আইভরি]
১৯৭০ । বোম্বে টকি [জেমস আইভরি]
১৯৭৪ । মহাত্মা অ্যান্ড দ্য ম্যাড বয় [ইসমাইল মার্চেন্ট]
১৯৮৫ । নিউ দিল্লি টাইমস [রমেশ শর্মা]
Print Friendly, PDF & Email
জন্ম : ১৯৫২। প্রাবন্ধিক, সমালোচক, অনুবাদক, শিক্ষক, প্রশাসক, বক্তা; পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। এমন একজন লেখক, যার বাক্য পাঠককে উত্তেজিত ও তার্কিক করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও তার লেখায় কোনো একাডেমিক জীবাশ্ম নেই; আর থরে থরে সাজানো আছে মেধার নুড়ি-পাথর। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা অন্তত দশটি। কলকাতাতেই তার ঘর-গেরস্থালি। গ্রন্থ : নাশকতার দেবদূত; সিনেমার রূপকথা; তিন তরঙ্গ; বুনো স্ট্রবেরি; ঋত্বিকতন্ত্র; পাতালের চিরকুট; হে চলমান চিত্রমালা; স্থানাঙ্ক নির্ণয়; বার্গমান বিষয়ক; অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন; ইবলিসের আত্মদর্শন সম্পর্কিত

১টি কমেন্ট

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here