আলমগীর কবির: বায়োস্কোপের দেশে একজন অথর পরিচালক [৩/৩]

470

লিখেছেন • তানভীর মোকাম্মেল


আলমগীর কবির [২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৮-২০ জানুআরি ১৯৮৯]। আমাদের সিনেমার এই মাস্টার ফিল্মমেকারের শিল্পজগত নিয়ে আরেক মাস্টার ফিল্মমেকার তানভীর মোকাম্মেল রচিত এই মহাগুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ নিবন্ধটি তিন কিস্তিতে ভাগ করে পুনঃমুদ্রণ করা হলো। প্রিয় পাঠক/দর্শক, আসুন, আলমগীর কবিরের জন্মদিন সামনে রেখে, তাকে পাঠ করার তৃতীয় ও শেষ কিস্তিতে মগ্ন হওয়া যাক…

   আগের কিস্তি   

অস্থির ষাট দশক ও অস্তিত্বের রূপালী সৈকতে

প্রবাল সৈকতের স্থিরচিত্র তুলে বেড়ায় এক তরুণ সাংবাদিক। নাম, হ্যাঁ– লেনিন চৌধুরী। প্রবাল সৈকতের শটগুলি টেক্সচার ও কম্পোজিশনে খুবই সিনেমাটিক; কিংবা সূর্যোদয়ের প্রথম দৃশ্যটি। সাদা-কালো ফটোগ্রাফির শিল্পিত সব ইমেজ। এই সৈকতেই একটি ভিন্নধর্মী গেস্টহাউস। আর্ট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক ম্যানুয়েল ওর্তিসের বিধবা স্ত্রী ও তরুণী কন্যার গেস্টহাউস, যে ম্যানুয়েল ওর্তিস একদিন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে স্ত্রী-কন্যার সম্ভ্রম রক্ষা করতে যেয়ে নিহত হয়েছিলেন। এই ঘটনাটি দেখানো হয় নেগেটিভে; যে রকম নেগেটিভ ইমেজ চলচ্চিত্রকার অন্যত্রও ব্যবহার করেছেন, দক্ষতার সাথে।

তবে এ ছবির মূল বিষয় যা, তা ১৯৬৬-৭০ ঝঞ্ঝাময় রাজনৈতিক সময়কাল। সময়ই যেন নায়ক। একজন সংবেদনশীল বাঙালি সাংবাদিক হিসেবে লেনিন চৌধুরী সক্রিয় অংশ নিচ্ছে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সেই জটিল ঘটনাবর্তে। একদিকে পূর্ববাংলার জনগণের বিভিন্ন অংশের ক্ষোভ ধুমায়িত হচ্ছে, অন্যদিকে চলছে নানারকম চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল। অস্থির সেই ষাট দশক। বৈচিত্র্যময়ও। ‘কী যে হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু একটা কিছু হচ্ছে এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটি পূর্ববাংলায় আর টিকে থাকতে পারবে না’’– জেলবাসী লেনিনের এই ধারণার বিপক্ষে পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের অফিসার সাইদ রিজভী অজান্তেই বলে ফেলে, ‘হ্যাঁ পারবে। পাকিস্তান আর্মি পারবে। দেয়ার ইজ অ্যা মাস্টার প্ল্যান!’ লেনিন তার রাজনৈতিক বোধ দিয়ে উপলব্ধি করে যে, ‘যদি সত্যি সত্যিই ওরা আঘাত হানে, তবে নরম বা গরম কোনো বাঙালিকেই ওরা ছাড়বে না।’ এবং জানে যে, ‘ল্যাজা বল্লম দিয়ে গুপ্তহত্যা করা যায়, কিন্তু পাক-আর্মিকে হারানো যাবে না।’ তার বিবেচনায় রাজনীতিবিদেরা এই মহাবিপদের অবস্থা সম্পর্কে তেমন সচেতন নয়। বামপন্থীরাও ততটা সংগঠিত নয়। এক পক্ষ অবশ্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে থেকেছে, কিন্তু আরেক পক্ষ ছয় দফাকে ‘সিআইএ-র দলিল’ আখ্যা দিয়ে পূর্ববাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছে এবং নিজেদের অজান্তেই হয়তো পরোক্ষ পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে কাজ করে ফেলেছে। এ দেশের রাজনীতিকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে প্রয়োজন ষাট দশকটাকে যথার্থভাবে বুঝতে পারা। একজন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে আলমগীর কবিরের গুরুত্ব এই সত্যে নিহিত যে, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি ষাট দশকের অস্থির সময়ের নাড়িটিকে ছুঁতে পেরেছেন। আর এটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল তার কারণ, এ ছবির অনেক ঘটনাই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা, আত্মজৈবনিক।

রূপালী সৈকতে

সাংবাদিক লেনিনের মতো আলমগীর কবিরও এক সময় বৃটেনের বামপন্থী পত্রিকায় কাজ করেছেন, লন্ডনের ইস্ট পাকিস্তান হাউসে সংগঠন করেছেন। আর ষাট দশকে ঢাকার রাজনীতিবিদ ও সংবাদপত্রে জগতের মানুষদের তো তিনি খুব কাছ থেকেই দেখেছেন। আর তাই তো এই ছবিটিতে প্রামাণ্যতার অংশগুলি একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে বিদ্যমান; কারণ, লেনিনের উপলব্ধিজাত ও ব্যক্ত সকল অভিজ্ঞতাই জাতি হিসেবেই আমাদের যৌথ-অভিজ্ঞতা। সিনেমা ভেরিতের এক চমৎকার সুযোগ নেন পরিচালক ১৬ মিঃ মিঃ-এ জহির রায়হানকে তাঁর জীবন থেকে নেয়া ছবির সেটে ধারণ করে; পেছনে আবহসঙ্গীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, বাঙালিমাত্রকেই আপ্লুত করবে সিকোয়েন্সটি। কিংবা মোনায়েম খানের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী এনএসএফ-এর হাতে প্রহৃত ড. আবু মাহমুদের সাক্ষাৎকারটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য এই বাঙালি অর্থনীতিবিদের পূর্ববাংলার সপক্ষে বক্তব্য প্রিয় ছিল না আইয়ুব সরকারের। আইয়ুব-মোনায়েমী আমলে মানুষের রাজনৈতিক শুধু নয়, সামাজিক নিরাপত্তাও যে কতখানি বিপন্ন হয়েছিল, তা সাদু নামক মোনায়েমী ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর এক প্রতিপত্তিশালী মস্তান কর্তৃক সরকারেরই সমর্থক জনৈক অধ্যাপক মিজানের স্ত্রীকে অপহরণের অধ্যায়টিতে প্রমাণ। দেশের সকল নাগরিকের অসহায়তার প্রতীক হিসেবে অধ্যাপক মিজান যখন স্ত্রীকে উদ্ধার করতে একটির পর একটি টেলিফোন নম্বরে ডায়াল করতে থাকে, এবং পরিশেষে গভর্নর হাউস থেকেও প্রত্যাখ্যাত হয়, তখন এক ফিল্ড মার্শালের রাজত্বের শ্বেত-সন্ত্রাসের স্বরূপটি, আপাতঃ আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়েই যথার্থভাবে ফুটে ওঠে।

আইয়ুবের এক বড় সাফল্য ছিল যে, সে এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের এক বড় অংশকে কিনে ফেলতে পেরেছিল, তাদেরকে করে তুলতে পেরেছিল মেরুদণ্ডহীন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সাহসী লেখকও আজ রাওয়ালপিন্ডির চাপের কাছে এক শিরদাঁড়াহীন সম্পাদক মাত্র। আর এই সামগ্রিক শারীরিক ও মানসিক সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটেই জেলের ভেতরে গোয়েন্দা অফিসারের ‘আপনি ঠিক কী চান, বলেন তো?’— এই প্রশ্নের জবাবে লেনিন যখন বলে, ‘My right to dissent, to say ‘No’“– তখন তা একটি গভীর প্রতিবাদী তাৎপর্য পায়। রাজনীতির এই সামগ্রিক প্রেক্ষিতেই লেনিনের ‘পূর্ববাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট’ সংগঠন করা। তার ভাষায়, লিবারেশন ফ্রন্ট সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাস করে না। যা করতে চায়, জনগণকে সাথে নিয়েই করতে চায়।’ তবে বৃহত্তর জনগণের সঙ্গে এই সংগঠনের কোনো যোগসূত্র চোখে পড়ে না। বোঝাই যায় এর সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে যতটা না রোমান্টিক ভাবপ্রবণতা, ততটা দৃঢ় কোনো সাংগঠনিক বাস্তবতা নয়। ফলে প্রকৃতিগতভাবেই সংগঠনটি রয়ে যায় জনবিচ্ছিন্ন। জেলবাসী লেনিনকে স্নেহময়ী বোনটির ভাষায়, ‘তোর দলের লোকজন সব কই? কাউকেই তো কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না!’

রূপালী সৈকতে

বস্তুতঃ আমাদের প্রোটাগনস্টিটি, লেনিন, যে গ্রামবাংলার পথের প্রকৃতির অনবদ্য দৃশ্যাবলী দেখে মাউথ অর্গানে বাজায়, ‘এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি…’, তার মাঝে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও কমিটমেন্টের যে সুগভীর আগ্রহ, তা যেন একই। সংগঠন ভিত্তি কখনোই পায় না তা। লেনিনের প্রিয় লেখক দেখছি হেমিংওয়ে এবং জ্যঁ পল সার্ত্র। গোয়েন্দা অফিসারটিকে তার প্রশ্ন, ‘আপনি জ্যঁ পল সার্ত্রের নাম শুনেছেন?’ ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের এবং পরে পাক-আর্মির ইন্টেলিজেন্সের লোক আর যাই হোক, ইন্টেলেকচুয়াল– এই অপবাদ তাদেরকে কেউ দিতে পারবে না। ফলে গোয়েন্দা অফিসারের পাল্টা প্রশ্ন, ‘Is he a film-star?’ ষাট দশকে সার্ত্রের মতো অস্তিত্ববাদী হওয়া যুগের হাওয়া ছিল। লেনিন তার থেকে ব্যতিক্রম নয়; তার সংগঠনও তাই রয়ে যায় ‘ওয়ান-ম্যান-পার্টি’মাত্র। জনবিচ্ছিন্ন।

লেনিনের এই যে একাকীত্ব, এই এক ধরনের আত্মসর্বস্বতা, তা সবচেয়ে বেশী বাজে তার প্রাক্তন প্রেমিকা, বাঙালি পুঁজিপতির মেয়ে, শরমিনকে। শরমিনের ভাষায়, ‘বোধ হয় নিজেকে ছাড়া তুমি আর কাউকেই ভালোবাসো না।’ কিংবা, ‘…তুমি এতই আত্মকেন্দ্রিক যে, কারো ভালোবাসার মর্যাদা দেয়ার মতো ব্যাপ্তিও তোমার নেই।’ তবে আমরা ক্রমান্বয়ে দেখব যে, লেনিনের এই আত্মপরতা নিছক স্বার্থপরতা নয়। নিজ দেশের দুর্ভাগা জনগণ, তথা ষাট দশকের ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন, আলজেরিয়া, লেবানন– গোটা তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের প্রতি সম্প্রসারিত বিপদ পর্যন্ত। শুধুমাত্র এক নারীর সঙ্গে সাংসারিক জোটবাঁধার মাঝে এ ধরনের মানুষের ভালোবাসা কি তৃপ্তি পেতে পারে? তবে একাকীত্ব সম্পর্কে আলমগীর কবির যেন আরো একটু গভীরে যেতে চেয়েছিলেন। আনোয়ার বলেছিল, ‘সাগরের ঢেউ দেখলেই সিসিফাসের কথা মনে পড়ে। আমরা যা করি, তা সবই যেন অর্থহীন।’ এবং বলা হয়, ‘আমরা একা। হয়তো আমরা সবাই একা।’ সন্দেহ কি, এই লেনিনের প্রিয় লেখক– জ্যঁ পল সার্ত্র।

শেষ দৃশ্যে আনাকেও পেল না লেনিন। তাকে একাই চলে যেতে হলো। তবে এ যাওয়া কোনো পরাজিতের ফিরে যাওয়া নয়, দুর্গম পদযাত্রার পরিব্রাজকের যাওয়া, যার পথ চলাতেই আনন্দ, যার পার হতে হবে এক অনন্ত দুর্গম পথ। শেষ শটটিতে দূরে দিগন্তে এক পর্বতশৃঙ্গ। লেনিন একাকী সে দিকেই হেঁটে চলেছে, নেপথ্যে আবৃত্তি :
‘এগিয়ে চলেছি নিরন্তর।
অন্তহীন

সম্মুখে একটি উদ্যত পথশৃঙ্গ।’

রূপালী সৈকতে

ছবিতে বেশ কয়েকটি শট বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। যেভাবে গ্রামবাংলার আখ মাড়াইয়ের কলটিও, ক্ষণিকে ক্ষেপণাস্ত্রের ইমেজ সৃষ্টি করে, তা অস্ত্র-প্রতিযোগিতায় আকীর্ণ বর্তমান বিশ্বের আতঙ্কের আবহটাকে চমৎকারে মেলে ধরে। কিংবা জেলখানায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা অফিসোরের সঙ্গে [যে চরিত্রটি একটি চমৎকার টাইপেজের উদাহরণ] লেনিনের সাক্ষাৎকারের গোটা দৃশ্যটি। পাশে ফ্রেমে ধরা আইয়ুব খানের ‘Friends Not Masters’ বইটি। গোয়েন্দা অফিসার লেনিনের উপর নির্যাতনের কারণে সমবেদনা জানায়, ‘পিন্ডিতে হলে এ রকম হতো না’; জবাবে লেনিনের উত্তর, ‘হাসান নাসিরকে মেরে লাহোর ফোর্টে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।’ মুহূর্তে ভেসে ওঠে পাকিস্তানের গোটা আমলটাতে কমিউনিস্টদের উপর প্রশাসনের মধ্যযুগীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের গোটা চিত্রটি। সংলাপও বৃদ্ধিদীপ্ত। যেমন, পিআইডি’র ওই সরকারী আমলা বলছে, ‘যখন এই দেশটি [পাকিস্তান] থাকবে না, তখনও আমরা থাকব!’ আমলাতন্ত্রে জর্জরিত আজকের বাংলাদেশে কতই না সত্য এ কথাটি!

তবে কিছু ছাড় আলমগীর কবির দিয়েছেন এ ছবিতে। যেমন, ভিন্ন কারো কণ্ঠস্বরে গান, কিংবা অঞ্জনার নাচ। তবে বরিশালী টোনে দুলাভাই আশীষ কুমারের কৌতুক আনন্দ দেয়। যিনি মার্কস-লেনিন-সার্ত্র পড়া শ্যালকপ্রবরকে বিবাহ সম্পর্কে তার গেরস্থ জীবনের অভিজ্ঞতার সার কথাটি গভীর রাত্রিতে শুনিয়ে দিয়ে যান, ‘বিয়ে করে পাঠায়!’

বোন সেতার বাজায়। বোনের স্বামী তবলা। তানপুরা হাতে তরুণী। সঙ্গে যুবক ধরে গান। যুগলবন্দি। একান্তই বাঙালির সন্ধ্যা এ। একটির পর একটি শটে বৃষ্টির ইমেজ। মধ্যবিত্ত শক্তি পায় সংস্কৃতি থেকে। ‘মোহনা’ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনো এক বৃষ্টির দিনে গান ধরেছিল ড. ইলিয়াসও। রবীন্দ্রসঙ্গীত।
“আমি যখন ছিলেম মগন ঘুমের ঘোরে
যখন বৃষ্টি নামলো
তিমির নিবিড় রাতে যখন বৃষ্টি নামলো…”
–বৃষ্টি ও বৃষ্টির গান, একটা Leit Motif-এর মতোই ঘুরে ঘুরে আসে আলমগীর কবিরের ছবিগুলিতে। সংস্কৃতি যোগায় শক্তি। এই সঙ্গীত, এই সংস্কৃতি যতদিন আছে, বাঙালিকে কেউ পদানত রাখতে পারবে না

আলমগীর কবিরের কোলে কন্যা ইলোরা

মোহনার আবর্ত ও সংস্কারবাদের সীমানা

মোহনা ছবির কাহিনী সম্পর্কে আলমগীর কবিরের বক্তব্য :

মোহনার আখ্যান কিছুটা ঢাকার সন্নিকটস্থ নয়ারহাট গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীদের প্রাথমিক অভিজ্ঞতানির্ভর।” [৪] 

এনজিওদের নিয়ে এ দেশের রাজনৈতিক মহলে নানা বিতর্ক আছে। একটি এনজিও হিসেবে সাভার ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ও বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, আলমগীর কবির গোটা ব্যাপারটি কোন দৃষ্টিতে দেখেছেন। একজন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে এ ব্যাপারে আলমগীর কবিরের দৃষ্টিভঙ্গিটি দ্বান্দ্বিক। প্রথম পর্যায়ে মনে হতে পারে, ছবিটি এনজিওদের বক্তব্যের স্বপক্ষে নির্মিত। যেমন, টাইটেল কার্ডের পরে ধারাবিবরণীতে বলা হচ্ছে : “স্বাধীনতার কিছুকাল পর কিছু সংখ্যক আদর্শবাদী ডাক্তার, নার্স, সমাজকর্মী গ্রামে যান কাজ করতে। তাদের মূল উদ্দেশ্য গ্রামবাংলার মানুষকে বুঝিয়ে দেয়া যে, স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কেবল শাসক বদল নয়। সাধারণ মানুষ তা বোঝে। কিন্তু প্রভাবশালীরা বুঝতে চায় না।”

গ্রামের জোতদার-চেয়ারম্যান-দুর্নীতিবাজ আইনবিদ-এলিট শ্রেণীর এই শক্তিকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেই দাঁড়াতে থাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। চিকিৎসার সাথে সাথে তা গ্রামীণ জনগণ, বিশেষ করে নারীদের সচেতনায়নের লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। দুঃস্থ নারীদের অর্থনৈতিক অন্বেষা সামাজিক বিধি-নিষেধকে চ্যালেঞ্জ করেই বেড়ে ওঠে। ময়না জিজ্ঞেস করেছিল কুলসুমকে–

ময়না : স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাম করলে মাইনষে বদনাম দিব না?
কুলসুম : গেরামের মাইনষে খাইতে দিব? ইজ্জত লইয়া কম করতে দিব! থোও ফেলাইয়া।

কিছুটা বিবেকবার গফুর মাস্টার তার দীর্ঘ গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতায় জানে যে, “গাঙ্গে মাছ অনেক, কিন্তু রাজত্ব করে গোটা চাইরেক কুম্ভীর।” স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারকে সে গ্রামের কায়েমী স্বার্থবাদীদের সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে চায়, “তা কথা কি ডাক্তার সাহেব, নদীতে যখন নামছেন, সাবধানে সাঁতরাইয়েন।” আর গাঁয়ের উঠতি তরুণ মজিদের কথা, “আপনারা বিপ্লব করতাছেন, ভালা। কিন্তু বড় স্লো। আমার অত সময় নাই। আমার অনেক ট্যাকার দরকার অহনি।”

গাঁয়ের নিস্তরঙ্গ জীবনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির আবির্ভাব বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে কী কী অভিঘাত সৃষ্টি করে, সে পর্যায়ে আলমগীর কবিরের চিত্রনাট্য বুদ্ধিদীপ্ত। সোলেমান উকিল চিন্তাগ্রস্ত যে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারটি পাছে বেশী জনপ্রিয় হয়ে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে তাকে হারিয়ে দেয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিরুদ্ধে কি করা যায়, সে ব্যাপারে নির্বাচন সচেতন উকিল চেয়ারম্যানকে বলে : “যাই-ই করেন, সাত গেরামের মাইনষেরে লইয়া করতে অইব। খেয়াল করছেন তো, এরা গেরামের বাড়িতে বাড়িতে যায়, চিকিৎসা করে! আপনে-আমি কী করি?”

আর চেয়ারম্যান আতঙ্কিত– পাছে তার শক্তিকাঠামোতে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চিড় ধরায়। গ্রামের কায়েমী স্বার্থবাদীদের কাছে তাই এই এনজিও কর্মীরা ‘কম্যুনিস্ট’, ‘নকশাল’ ইত্যাদি আখ্যা পায়। তাদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার অপপ্রচার চলতে থাকে। ভাড়াটে ডাকাত দল দিয়ে এনজিও কর্মীদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালানো হয় এবং এক পর্যায়ে ক্যাম্পের তরুণ ডাক্তার ইলিয়াস চেয়ারম্যানের ভাড়াটে খুনীদের দ্বারা নিহত হয়, যে ধরনের একটি ঘটনা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির ইতিহাসে বাস্তবেও ঘটেছিল বলে জানা যায় এবং একটি সিনেমা ডিরেক্ট চলচ্চিত্র হিসেবে মোহনাতে পরিচালক কাহিনীর সঙ্গে এইসব বাস্তব ঘটনাগুলিকে মেলাতে চেয়েছেন। আর এই সবকিছুর ব্যাপারে থানার দারোগা, যিনি একাত্তরের পঁচিশের রাতে রাজারবাগ পুলিশ রেসিস্ট্যান্সে ছিলেন, তিনিও ড. মুস্তফাকে শুধুমাত্র সতর্ক করে দেওয়ার বেশী কিছু করতে পারেন না! কারণ, এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও গ্রাম-সমাজের মুক্তি কাঠামোটা তো রয়ে গেছে আগের মতোই।

গ্রামের এলিটদের সভায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য ড. মুস্তফা বর্ধিত আরো কিছু জমি চান : “চেয়ারম্যান সাহেব, আমাদের ক্যাম্পের দক্ষিণে আপনার যে অনাবাদী জমিটুকু পড়ে আছে, ওটা পেলে এখনই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওয়ার্কশপ তৈরির কাজে হাত দিতে পারি।” পরবর্তীতে পত্রিকায় বাস্তবে আমরা দেখব যে, এই জমি প্রশ্নে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির সঙ্গে এলাকাবাসীদের বিরোধের একটি সত্য ঘটনার বিবরণ। বস্তুতঃ এনজিও বিষয়ে ও তাদের উন্নয়নের মডেল বিষয়ে যেসব বিতর্ক আজ আমাদের সমাজে চলছে, তার অনেক কিছুর প্রতিই সেই ১৯৮২ সালেই আলমগীর কবির ইঙ্গিত করে গেলেন; যেমন, এদের বিদেশ-নির্ভরতা–

চেয়ারম্যান : এতসব দালানকোঠা বানাইয়া যন্ত্রপাতি বওয়াইতে তো অনেক টাকা লাগনের কতা!
মুস্তফা : হ্যাঁ, ৫০/৬০ লাখ তো লাগবেই।
অ্যাডভোকেট : ওরে বাবা! এত টাকা দেবে কে? গভমেন্ট?
মুস্তফা : গভর্নমেন্ট এক জমি ছাড়া আর কিছু দেবে না। কয়েকটা বিদেশী সাহায্য-সংস্থার সঙ্গে কথা চলছে।

বস্তুতঃ স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির দর্শন ও কর্মপদ্ধতির যা সীমাবদ্ধতা, তা সকল সংস্কারবাদী কার্যক্রমেরই সীমাবদ্ধতা। এবং আগেই বলেছি, এ ব্যাপারে আলমগীর কবিরের দৃষ্টিভঙ্গিটি দ্বান্দ্বিক। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির ইতিবাচক দিকগুলি যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি এর নেতিবাচক কিছু দিক দেখাতেও ভোলেননি। যেমন, ড. মুস্তফাকে বলতে শুনি, ‘মেয়েকে দেখতে আমাকে একটু ইংল্যান্ডে যেতে হবে’— মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে ডাক্তারের নিজস্ব শ্রেণী-অবস্থানটি। গ্রামবাংলার নারীদের মুক্তির জন্যে যিনি কাতর, তার নিজের পরিবারকে কিন্তু তিনি সুখে-স্বাচ্ছন্দেই রেখেছেন– বিলাতে। এই স্ববিরোধিতা, এনজিওতে কর্মরত প্রায় সকল এলিটদেরই স্ববিরোধিতা। শেষের দিকে ময়না মজিদদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ডাক্তার পলায়নরত। এ পর্যায়ে চমৎকার একটি টপ-শট ব্যবহার করেছেন আলমগীর কবির। ডাক্তার ও মুকুন্দ নৌকায়। ডাক্তারের চোখে মুখে পরাজয় ও পলায়নের ছাপ সুস্পষ্ট। ক্যামেরা নদীর পার থেকে ডাক্তারকে ধরে জলের বিপরীতে। চমৎকার সিনেমাটিক একটি শট– আমার বিবেচনায়, কবিরের সৃষ্টি-সম্ভারে অন্যতম সেরা একক অর্থবহ শট এটি।

আর সচেতনায়নের দিক দিয়ে একজন সরলা গ্রাম্য তরুণী ময়নার একজন আত্মনির্ভরশীল নারীতে পরিণত হওয়া, ময়নার এই ‘হয়ে ওঠা’ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। অবশ্য ময়নার একটি সংবেদনশীল মনের পরিচয় পরিচালক আমাদের আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। যে গ্রাম্য মেয়েটি একা একা তার খাতায় লিখেছিল, ‘যাহার কাছে খাদ্যই স্বর্গ, তাহার কাছে ক্ষুধাই নরক’ কিংবা, ‘শিশু তার খেলা খেলিয়া বেড়ায়, বয়স্ক তার খেলনা গোপন করে’, তার পরিণত-মনস্কতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না, এবং তার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সম্পর্কেও। আর ময়নার বোকা হাবা স্বামী মজনুর নদীতে কুসংস্কারের তাবিজ ছুঁড়ে ফেলে সারল্য থেকে অভিজ্ঞতার স্তরে উত্তরণের যে সচেতনায়ন– তাও ইতিবাচক।

গোটা মোহনা ছবিটির বিষয়বস্তুর একটি বড় দিক আবর্তিত হয়েছে সমাজে নারীর অবস্থান বিষয়ে, যার অন্যতম বাহ্যিক রূপটি হচ্ছে– যৌতুক। ধনী চেয়ারম্যান পুত্রের যৌতুক হিসেবে কন্যাদায়গ্রস্ত অসহায় গ্রাম্য মাস্টারের কাছে কিছুই চায় না : ‘ময়নারে আপনাগো কিছুই দেওন লাগবে না। আমাগো ঘরের বউ আমরাই সাজাইয়া লইয়া যামু। আপনে শুধু আমার মজনুরে একখান মোটর সাইকেল, একটা সিকো ঘড়ি আর একটু স্যুট পিস দিয়া সমাজে আমার মুখখান রক্ষা কইরেন!’

হিন্দুঘরের চিরদুঃখী মেয়ে সবিতা। পনের টাকা অসহায় পিতা যোগাতে পারেনি বলে হবু বর বিয়ের আসর থেকে উঠে চলে গিয়েছিল। অনেক দুঃখেই বলেছিল সবিতা : ‘নিজের পছন্দ-অপছন্দ করার অধিকার কুকুর-বিড়ালেরও আছে। কিন্তু আমার ছিল না।’ সবিতা ময়নাকে আরো বলে যে, শুধু গ্রামে নয়, শহরেও [এবং শিক্ষিত হলেও] নারীর সমস্যার অন্ত নেই : ‘পুরুষ মানুষ চাকুরি পাইল, সকাল থিইক্যা আট ঘণ্টা ঠিকমতো কাম করলো তো অইলো। মাইয়া মানুষের চাকরি দিলো তো ঘাড়ে চইড়া বইল। অফিসের কাম তো করবাই; তারপর বড় সাহেবের গেস্ট আইলো তো চা-কফি বানাইয়া খাওয়াও। অফিসের পর সাহেবের লগে সাইজা গুইজা রেস্টুরেন্টে খাইতে যাও। আর তা না অইলে চাকরি নাই।’

বোনের যৌতুকের টাকা উপার্জনে ভাইয়ের মধ্যপ্রাচ্য যাবার প্রচেষ্টা। মধ্যপ্রাচ্য– আজকের গ্রামবাংলায় এও এক বাস্তবতা। একে রয়েছে পেট্রো-ডলারের হাতছানি, তার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে মিলেছে দুম্বা-উটের ধর্মের ভিয়েন। মানিকগঞ্জের এন্তাজ মিয়ার মতো আড়কাঠিরা তাই আজ বেশ সফলভাবেই ঘুরছে গ্রামের আনাচে-কানাচে। আরবীয় পোশাকের ছদ্মবেশে ‘আবুধাবী কনস্ট্রাকশন কোম্পানী’র এ দেশীয় আদম-ব্যাপারী ও দেশী টাউটেরা মিলে যেভাবে সর্বস্বান্ত করল সরল মজিদকে, সে সিকোয়েন্সের একটা সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে বৈকি।

ময়নার সখী সিনেমা-আক্রান্ত সকিনা। প্রতীকে চলচ্চিত্র নামক এই চকমকে মাধ্যমটি ও তারো চেয়ে চকমকে তারকাদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিকারগ্রস্ত মোহ। সকিনার ভাষায়– ‘আমার কাছে ববিতারে যা ভালা লাগে না! খালি ইচ্ছা করে হের মতো কতা কই। হের মতো শাড়ি বেলাউজ পরি। জানস, এইবার না চাইরডা বেলাউজ বানাইছি ববিতার ডিজাইন দেইখ্যা!’ তাঁর প্রিয় ঠাট্টার বিষয়, বাংলা-বায়োস্কোপকে সুযোগ বুঝে আবারো একহাত ঠাট্টা করে নিলেন আলমগীর কবির।

পরিপূর্ণভাবে একটি ‘অথর’ চলচ্চিত্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় এ ছবির চিত্রগ্রাহণের কাজও আলমগীর কবির নিজেই করেছেন। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য :

“…এইসব তথ্য মনে রেখেই মোহনা নির্মিত হয়। উপরে বর্ণিত ক্যামেরার কাজ নিজেই করেছি। সম্পাদনাও। গতানুগতিক সকল ক্যামেরা মুভমেন্ট, যেমন– pan, tilt, trolly প্রভৃতি ইচ্ছাকৃতভাবেই বর্জন করা হয়েছে। কেবল ব্যবহৃত হয়েছে space। ক্যামেরা কখনো মাটিতে, কখনো গাছের ডগায়। ফলাফল মিশ্র। এই টেকনিকে কম্পোজিশনের সীমাহীন সৃজনী সুযোগ পূর্বে অনাবিষ্কৃত দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আবার কোনো কোনো সময় অনেক সাধারণ সোজা শট যা হয়তো সামান্য একটি tilt বা pan-এ সম্পন্ন করা যেত, সেটি ‘অনড়’ ক্যামেরায় নিতে গিয়ে ঘর্মাক্ত হতে হয়েছে।”  [৫] 

নিরীক্ষার এই উদ্যোগী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বলব যে, চিত্রগ্রহণ এই ছবির সবল কোনো দিক নয়। চলচ্চিত্র আলোকচিত্রিক মাধ্যম। সেই ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়ে গেলে তা শিল্পকর্ম হিসেবেও দুর্বল হতে বাধ্য। একজন ‘অথর’ চলচ্চিত্রকার হিসেবে গৌতম ঘোষ চিত্রগ্রহণে যে পরিপূর্ণতা দেখিয়েছেন অন্তর্জলী যাত্রা দখল-এ, আলমগীর কবিরের সাফল্য সে তুলনায় নগণ্য। ছবিটির আরেকটি দুর্বল দিক নিঃসন্দেহে চরিত্রদের পোশাক-আশাক-চুলের স্টাইল এবং অন্যান্য বিবিধ ডিটেলস, যা তাদেরকে গ্রামীণ ভাবতে বাধার সৃষ্টি করেছে। ছবিটি রঙিন হওয়ায়, রঙের ঔজ্জ্বল্য হেতু বিশ্বাসযোগ্যতার বাধাটি আরো বেড়েছে।

আলমগীর কবিরের পারিবারিক সময় : স্ত্রী মঞ্জুরা, কন্যা ইলোরা ও অজন্তার সঙ্গে

স্বল্পদৈর্ঘ্য ব্যাপ্তি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের ছবিকে বায়োস্কোপের যুগ থেকে আধুনিক চলচ্চিত্রে আনার ক্ষেত্রে সাদেক খানের নদী ও নারী ও শাকের-নিয়ামতের সূর্যদীঘল বাড়ীর ব্যতিক্রম দুটি বাদে, জহির রায়হানের পরে যাঁর সবচেয়ে বড় অবদান, তিনি নিঃসন্দেহে আলমগীর কবির। এ দেশে চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা প্রতিষ্ঠায় তাঁর সংগ্রাম চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর স্থানকে সুনিশ্চিত করেছে, যদিও শেষ পর্যায়ে বাণিজ্য-পুঁজির ঘাটে সাময়িকভাবে ঠেকে যেয়ে পরিণীতার মতো সরল-গল্প-বলাটা তাঁর পক্ষে কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তবে এই ছবিটি ব্যতিক্রম; কবিরের মূল স্রোত তা নয়।

চলচ্চিত্র শুধু দৃশ্যগত নয়, শ্রাব্য-মাধ্যমও বটে। সে ক্ষেত্রে এই গ্রাম্যতার দেশে আলমগীর কবিরের ছবিগুলির রুচিশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ নিঃসন্দেহে এক বড় প্রাপ্তি। সাউন্ডট্র্যাকে আবহসঙ্গীতের আকারে কখনো ভূপেন হাজারিকা, কখনো হেমন্ত বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পাওয়াও এক প্রাপ্তি। সিনেমা ভেরিতে ধারার একজন পরিচালকের ছবিতে সঙ্গীত কাঙ্ক্ষিত নয় আদৌ। তবে আলমগীর কবিরের পক্ষে যুক্তি এটুকু যে, এ দেশের চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের ব্যবহারের ঐতিহ্যকে মনে রেখে যে কয়েকবার তিনি সঙ্গীতকে ব্যবহার করেছেন, তা করেছেন মূলত রুচিশীলতার মানটি বজায় রেখেই।

চলচ্চিত্রের আরেকটি যে মাধ্যম, প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য, সেখানে আলমগীর কবিরের পদচারণা বলিষ্ঠ। স্বল্পদৈর্ঘ্য লিবারেশন ফাইটার্স, প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বা মণিকাঞ্চন— কবির সর্বদাই তীক্ষ্ণভাবে রাজনৈতিক। আর তাই আমাদের এখানে নির্মিত এ যাবৎকালের সেরা প্রামাণ্য ছবিটি, জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড-এ তাঁর সম্পৃক্তি যেন স্বতঃসিদ্ধই। তাঁর সর্বশেষ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটি মণিকাঞ্চন-এর কথাই ধরা যাক। প্রথম শটেই দুর্নীতিবাজ আমলাটিকে যেভাবে ফ্রেমে ধরা হয়, তা মুহূর্তে তার শ্রেণী অবস্থানকে ফুটিয়ে তোলে। এবং নদী থেকে দেখা যায় নগরীর ফ্লাটবাড়িসমূহ– ঢাকার ক্রমঅপসৃয়মান আকাশ-সীমানা [আবারও তাঁর প্রিয় ঢাকা নগর!]। এবং এ দেশের নব্যধনী ও পরশ্রমজীবী বুর্জোয়া নারী-পুরুষদের নানা দুর্নীতি ও নষ্টামির মাঝে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের ইনসার্ট শটগুলি– এ সবই তাঁর সমাজবোধেরই প্রকাশ। এবং তাই-ই যেন সামরিক সরকারের মন্ত্রী টাউট রাজনীতিবিদটি যখন ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করার ব্যাপারে বলে, ‘They can join army and capture power‘, তখন সেই প্রশ্নকর্তা বিদেশী সাংবাদিকটি হয়ে যান আলমগীর কবির নিজেই, আমাদের বিবেকেরই প্রতিনিধি যেন।

শিল্প সৃষ্টি ছাড়াও একজন শিল্পীর কিছু সামাজিক দায়ভার থাকে। সাংগঠিক আলমগীর কবিরের চেয়ে ক’জন চলচ্চিত্রকারই বা এর বেশী সে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন? চলচ্চিত্রের নামে এ দেশের ফিলিস্টাইন বাণিজ্যিক বায়োস্কোপের অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরতে কলম ধরে তিনি এ দেশের চলচ্চিত্র সমালোচনাকেই একটা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করে গেছেন। লিখেছেন একাধিক পুস্তক। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে সংগঠন করতে ঘুরেছের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যমুনায় দুঃখজনক মৃত্যু বগুড়া থেকে সেই কাজেই ফেরার পথে। প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ প্রদান করে গেছেন নব-প্রজন্মের একঝাঁক তরুণকে আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষা প্রয়োগে। এসবই কম কী!… এবং রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের সেই দিনগুলিতে, আমাদের সবচেয়ে গৌরবের, সবচেয়ে যন্ত্রণার সেই দিনগুলিতে ক্যামেরা হাতে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা! এবং কণ্ঠেও : ‘This is Radio Bangladesh’ কে ভুলতে পারে! মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন– মুক্তিযুদ্ধ আজো শেষ হয়নি। মানুষের মুক্তির সংগ্রাম, তার কি শেষ আছে? সেই সংগ্রামে ছিলেন আজীবন। এক নোংরা বাণিজ্য পুঁজি-চক্রের বিরুদ্ধে, ফিলিস্টাইন দর্শক-সমালোচকদের বিরুদ্ধে, এবং নিজের বিরুদ্ধেও নিয়ত সংগ্রামরত এক অবরুদ্ধ হারকিউলিস যেন। ঈজিয়নের আস্তাবল পরিষ্কার করার কঠিন কাজটি মাঝপথে অসম্পূর্ণ রেখেই যাঁকে চলে যেতে হলো।

পদটীকা
৪. ভূমিকা। চিত্রনাট্য-- মোহনা। ভিন্টেজ প্রকাশনী, ১৯৮৪
৫. ভূমিকা। চিত্রনাট্য-- মোহনা। ভিন্টেজ প্রকাশনী, ১৯৮৪

গ্রন্থসূত্র • সিনেমার শিল্পরূপ/ তানভীর মোকাম্মেল। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮
লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত

Print Friendly, PDF & Email
চলচ্চিত্রকার; চলচ্চিত্র লেখক; চলচ্চিত্র-শিক্ষক। জন্ম : ৮ মার্চ ১৯৫৫; খুলনা, বাংলাদেশ।। ফিচার ফিল্ম : নদীর নাম মধুমতি [১৯৯৫]; চিত্রা নদীর পারে [১৯৯৮], লালসালু [২০০১]; লালন [২০০৪]; রাবেয়া [২০০৮]; জীবনঢুলী [২০১৩]।। ডকু-ফিল্ম : স্মৃতি একাত্তর [১৯৯১]; একটি গলির আত্মকাহিনী [১৯৯৩]; অচিনপাখী [১৯৯৬]; স্বপ্নার স্কুল [১৯৯৬]; ইমেজেস অ্যান্ড ইমপেশনস [১৯৯৯]; অয়ি যমুনা [২০০২]; কর্ণফুলীর কান্না [২০০৫]; বনযাত্রী [২০০৫]; বস্ত্রবালিকারা [২০০৭]; তাজউদ্দীন আহমদ-- নিঃসঙ্গ সারথি [২০০৭]; স্বপ্নভূমি [২০০৭]; ১৯৭১ [২০১১]; জাপানী বধূ [২০১২]।। শর্টফিল্ম : হুলিয়া [১৯৮৪]।। ফিল্ম-অ্যাওয়ার্ড : জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার [শ্রেষ্ঠ পরিচালক (চিত্রা নদীর পারে; লালসালু]।। সিনেমার বই : চলচ্চিত্র ও বার জন ডিরেক্টর [সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৮৫]; চলচ্চিত্র [বাংলা একাডেমি, ১৯৮৭]; ভবঘুরের দিগ্বিজয় [সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৯৬]; সিনেমার শিল্পরূপ [আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮]।। চলচ্চিত্র-শিক্ষকতা : ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট [বিএফআই]।। চলচ্চিত্র সংগঠন : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম [১৯৮৫-১৯৮৭; ১৯৯৫-১৯৯৭]; জুরি মেম্বার, ১৫তম রাবাত ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল [২০০৯]; ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্টার [বিএফসি]।। অফিসিয়াল ওয়েবসাইট : www.tanvirmokammel.com

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here