আলমগীর কবির: বায়োস্কোপের দেশে একজন অথর পরিচালক [২/৩]

592

লিখেছেন তানভীর মোকাম্মেল


আলমগীর কবির [২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৮-২০ জানুআরি ১৯৮৯]। আমাদের সিনেমার এই মাস্টার ফিল্মমেকারের শিল্পজগত নিয়ে আরেক মাস্টার ফিল্মমেকার তানভীর মোকাম্মেল রচিত এই মহাগুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ নিবন্ধটি তিন কিস্তিতে ভাগ করে পুনঃমুদ্রণ করা হলো। প্রিয় পাঠক/দর্শক, আসুন, আলমগীর কবিরের জন্মদিন সামনে রেখে, তাকে পাঠ করার দ্বিতীয় কিস্তিতে মগ্ন হওয়া যাক…

   আগের কিস্তি   
সূর্যকন্যা : লেনিন যখন গণনেতা!

সূর্যকন্যা ও নারীমুক্তির বন্দনা

সহায় পথচারীর উপর শক্তিশালী ছিনতাইকারীর হামলা দেখে কল্পনাপ্রবণ এক যুবক প্রতিবাদে রুখে ওঠে, শূন্য স্টেডিয়ামে বায়বীয় বলে ব্যাট হাঁকিয়ে বেশুমার বাউন্ডারী-ওভারবাউন্ডারী মারে, ইন্দিরা মঞ্চে টোকাইদের সামনে হাত-পা ছুঁড়ে গণনেতার বক্তৃতা দেয়। শুরু থেকেই দর্শকদের এই স্বপ্নপ্রিয় প্রটাগনিস্টটিকে ভালো লাগবে, বাংলা চলচ্চিত্রে যাকে সাধারণত নায়ক বলা হয়। নাম তার লেনিন। আমরা দেখব অন্যত্রও এই নামটি আলমগীর কবির ব্যবহার করেছেন। তাঁর মানসলোকের নায়ক যেন– লেনিন, একটা আর্কিটাইপ। তবে এই লেনিন কোনো বিপ্লবী নয়, একজন সংবেদনশীল শিল্পী মাত্র, যে কল্পনাপ্রবণ, কখনো হয়তো কিছুটা সিজোফ্রেনিয়াতেই ভোগে। সময় ও স্পেস যার কাছে কখনো কখনো থমকে দাঁড়ায়, আগে পিছে হয়। তবে বস্তুসর্বস্ব মধ্যবিত্ত গেরস্ত জীবনের বিপরীতে, ছোট ভাই বুলুর হিসেবী বাস্তবতাবোধ যার প্রতীক, তার রয়েছে এক অনুভূতিময় রোমান্টিক মন। রূপালী সৈকতের লেনিন উঁচু মাচায় বসে শ্যামের বাঁশির মতো মাউথঅর্গ্যান বাজালেও প্রেম তার কাছে গৌণ। মুখ্য– মানুষের মুক্তি। কিন্তু সূর্যকন্যার লেনিন চিরন্তন প্রেমিক পুরুষ। ইলিউশন আর রিয়ালিটি, স্বপ্ন ও বাস্তবের ঘোর লাগা, চিরকালের শিল্পী পুরুষ সে।

আসলে লেনিনের যে সিজোফ্রেনিয়া তা শিল্পীর চিরকালের সৌন্দর্য-তৃষ্ণা মাত্র, যা সে শিল্পের মাঝে খুঁজে পেতে চায়, পেতে চায় নারীর কাছেও। কলেজের সেই সে মেয়েটির [আজ তার নামও মনে পড়ে না ঠিকমতো!] নিশ্চয়ই এতদিনে কোনো আমলা-টামলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে! বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে বোধহয় মুটিয়েও গেছে। দুই বন্ধুর স্মৃতিচারণ। এ ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান রাসলের প্রশ্ন, ‘কী রে! এখনও ভার্জিন রয়ে গেছিস নাকি! এবং ‘এ রকম ধোপদুরস্ত চরিত্র নিয়ে কি করবি বলতো’র জবাবে আমাদের লেনিনের সখেদ উত্তর– ‘চরিত্র মানেই তো সুযোগের অভাব’। বোঝাই যায়, আর দশটা বাঙালি মধ্যবিত্ত যুবকের মতোই নারীসঙ্গ বঞ্চিত বেচারা লেনিন। আর তার এই সকল বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ সে অবচেতন মনে করে নেয় এক স্বপ্নলোকের মানসসুন্দরী সৃষ্টি করে, দোকানের ডিসপ্লের ম্যানেকিন মূর্তিটির একদিন জীবন্ত হয়ে যে মানবীর রূপ নিয়ে তার জীবনে এসে উপস্থিত হয়। এই নারী শিল্পীর চিরন্তন সৌন্দর্যসুষমা; অর্ধেক কল্পনা অর্ধেক বাস্তবের পুরুষ মনের চিরন্তন প্রেয়সী– কখনো লাবণ্য, কখনো ইউরিডিস, কখনো তানিয়া, কখনো ভেনাস। এত রূপ, এত গল্প! রবীন্দ্রনাথের কাছে সে ছিল দূরে-বহুদূরে-স্বপ্নলোকে-উজ্জয়িনীপুরের প্রথম জনমের প্রথমা প্রিয়া, আলমগীর কবিরের কাছে সে যেন ছেলেবেলার টিনের ছাদে কূল গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া শিশিরের টিপ টিপ শব্দ কিংবা শৈশব স্মৃতির সেই মন-সুদূরে-টানা স্টিমারের বাঁশির নস্টালজিক হাতছানি। লেনিন তার এই মানবীকে বলেছিল : ‘…অপেক্ষা করে যাব অনন্তকাল ধরে। কিচ্ছু করব না। কিচ্ছু বলব না। কেবল ভালোবেসে যাব। নীল যেমন ভালোবাসে শরতের মেঘকে, সবুজ যেমন বসন্তকে, তেমনই নিবিড় করে বিলীন হয়ে ভালোবেসে যাব তোমায়, কেবলই তোমায়…।’ চমৎকার লিরিক্যাল এই সংলাপের মাঝে শুধু শিল্পী লেনিন নয়, তার স্রষ্টার রোমান্টিক মনের আবেগটাও যেন চাপা থাকে না।

সূর্যকন্যা : লেনিন ও ম্যানেকিন

‘তুমি কে?’ –লেনিনের সেই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তরে স্বপ্নলোকের মানবী বলে চলে নারীর বন্দিনী হওয়ার সেই নির্মম ইতিহাস। কীভাবে যাদেরকে শরীরের প্রতি অণু-পরমাণু দিয়ে তিল তিল করে সৃষ্টি করেছে, হৃদয়ে দিয়েছে ভালোবাসা, মুখে দিয়েছে ভাষা, সেই শক্তিতে মত্ত পুরুষ একদিন বন্দি করেছে নারীকে। এ পর্যায়ে এক প্রাচীন প্রাসাদের অলিন্দে মানবী সূর্যকন্যার শটগুলির ভিজুয়াল ভারী চমৎকার!

ভোর চারটে পর্যন্ত আয়ু ম্যানেকিন মানবীর। সূর্যের আলো দেখার অধিকার নেই তার। এও তো প্রতীকি। অসূর্যস্পর্শার যুগ আর নেই। কিন্তু নারী কি আজো বন্দিনী নয়? আঁধারে?

লেনিনের ইতিহাসের অধ্যাপক মামা বলে চলেন কীভাবে কৃষিসভ্যতার স্রষ্টা নারীজাতির বন্দিদশা ঘটল পুরুষের হাতে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের উত্তরাধিকার নির্ণয়ে নিশ্চিন্ত হতে পুরুষ বন্দি করল নারীকে। তথাকথিত সতীত্ব সম্পর্কে নানা মূল্যবোধ চাপিয়ে দিলো নারীর উপর। নারী হয়ে উঠল আরেকটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি মাত্র। এই পর্যায়ে অ্যানিমেশন চিত্রের মাঝ দিয়ে প্রকাশিত ব্যাখ্যাটির সঙ্গে এ যুগের ফেমিনিস্টরা হয়তো একমত হবেন না; তবে এই ছবির অ্যানিমেশন চিত্রের ব্যবহার আমার জানামতে, এপার বাংলায় কাহিনীচিত্রে অ্যানিমেশন চিত্রের প্রথম প্রয়োগ। এ ব্যাপারেও আলমগীর কবির পাইওনিয়ার।

সূর্যকন্যা : অ্যানিমেশনে নারীর বন্দিত্বের ইতিহাস

অর্ফিউস হারিয়েছিল তার ইউরিডিসকে। পুরুষ-পুঙ্গব লেনিনও প্রতিশ্রুতিমতো ভোর চারটের আগে পৌঁছাতে পারেনি তার মানবীর কাছে। তবে এক উজ্জ্বল জীবনবোধ ও কৌতুকবোধের পরিচয় দিয়েও পরিচালক লেনিনের সেই ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটি ছবিতে রেখেছেন। বোন ক্লিওর বান্ধবী সুজলা মিষ্টি স্নিগ্ধ বাঙালি মেয়ে, চিরকালের সেই পাশের বাড়ির মেয়েটির মাঝেই তো খুঁজে পেতে হবে স্বপ্নের মানবীকে। লেনিন তা পায়ও। শেষদৃশ্যে যেভাবে সুজলার চোখের ক্লোজ-আপে পরিচালক ছবিটি শেষ করেন, তা একজন ‘অথর’ পরিচালক হিসেবে তাঁর আত্মবিশ্বাসেরই পরিচায়ক; এই আত্মবিশ্বাস যে, এতক্ষণ যে কাহিনী তিনি শোনালেন তা একটা উপভোগ্য পরিণতিতে পৌঁছেছে। তাই শুধুমাত্র দুটি চোখের ক্লোজ-আপেই ছবির সমাপ্তি টানবার সাহস পান।

লেনিন-মানবীর রোমান্টিক বিমূর্ত প্রেমের সমান্তরাল রাসেল-মনিকার জাগতিক প্রেমের যে উপকাহিনীটি চলচ্চিত্রকার রেখেছেন, তা নারী-পুরুষের সম্পর্ককে আরেকটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছে। রাসেলের মধ্যে আমরা উন্মুললক্ষণাক্রান্ত বুর্জোয়ার একাকীত্ব দেখতে পাই– নারী সম্পর্কে যার দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই ভোগবাদী, যে হোটেলের ডাবল ডিলাক্স রুমে তার দোকানের কর্মচারী মনিকাকে নিয়ে শারীরিক প্রেম করে এবং বিয়ের প্রশ্নে এড়িয়ে যায়। ফেমিনিস্টদের ভাষায় এই রাসেল যথার্থই একজন এমসিপি। তবে নারীর প্রতি এই শুধুই ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ছবির শেষে সত্যিকারের প্রেমবোধ ও মনিকাকে শ্রদ্ধা করতে পারার রাসেলের যে উত্তরণ, তা নিঃসন্দেহে পরিচালকের প্রাগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। তবে নির্জন হোটেল কক্ষে রাসেল মনিকাকে একদিন তৃতীয় রিচার্ড থেকে অভিনয় করে দেখিয়েছিল। তাঁর একটা সংবেদনশীল মনের পরিচায়ক পরিচালক আগেই রাখেন, ফলে শেষের দিকে মনিকার কাছে তার প্রত্যাবর্তন খুব একটা অবাস্তব ঠেকে না।

সূর্যকন্যা : হোটেল রুম এবং মনিকা ও রাসেল

ছবিটিতে ভাঙনমুখী মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতার কিছু দিকও এসেছে, বাংলা চলচ্চিত্রের সেই পরিচিত Milieu, যেমনটি পরবর্তীতে আমরা কিছুটা দেখব শেখ নিয়ামত আলীদহন-এও। কলেজের চাকুরিটার কী হলো– বাবার এই প্রশ্নে বেকার যুবক পুত্রের উত্তর ‘মিনিস্টার-ফিনিস্টার না ধরলে চাকুরি আজকাল হয় না’। এ ঘটনা মধ্যবিত্তের জীবনে যেমন ১৯৭৪-এ সত্য, আজও সত্য।

আর দশটি শিল্প-মাধ্যমের চেয়ে চলচ্চিত্রের একটি বাড়তি সুবিধা রয়েছে যে, তা সময়কে একটা প্লাস্টিক উপাদান হিসেবে ভাঙতে পারে, এগোতে পারে, পিছাতে পারে, থমকে দাঁড় করাতেও পারে। লেনিনের মনোজগতে মানবীর আগমনের cut away শটগুলির মন্তাজের মাধ্যমে পরিচালক সময় ও স্পেসকে যে রকম প্রয়োজনানুযায়ী ভেঙেছেন, তাও ‘অথর’ পরিচালকদের এক প্রায়শঃব্যবহৃত পদ্ধতি।

রাসেলের স্বপ্নে মনিকা আসে নেগেটিভ ইমেজে। রূপালী সৈকতেও নেগেটিভ ইমেজ নিয়ে কিছু কাজ করেছেন আলমগীর কবির। আসলে দুর্বল রসায়ণাগারের এই দেশে অপটিক্যালে বৈচিত্র্য আনতে নেগেটিভ ইমেজ, অ্যানিমেশন, প্রামাণ্য চিত্রাংশ বা ফ্রিজ– এ জাতীয় কয়েকটি আঙ্গিকের উপরই মাত্র পরিচালককে নির্ভর করতে হয়। আরো মনে রাখার ব্যাপার, আলমগীর কবিরের ছবিগুলি খুব স্বল্প বাজেটের ছবি। ব্যয়বহুল কোনো অপটিক্যাল নিরীক্ষার সুযোগ তাঁর তেমন ছিল না।

সূর্যকন্যা : লেনিনের চোখের সামনে, অথবা কল্পনারাজ্যে ম্যানেকিনের মানবী হোয়ে ওঠা

বাংলাদেশের বায়োস্কোপ-জাতীয় চলচ্চিত্রে কৌতুকরস বলতে যেখানে বোঝায় শুধুই স্থূল ভাঁড়ামি, সেখানে সূর্যকন্যায় নবরসের এই রসটিকেও আলমগীর কবির তুলে ধরেছেন এক নির্মল রূচিশীলতায়। শপ ম্যানেজার রবিন গোমেজের ভূমিকায় অজয় ব্যানার্জীর অভিনয়ের কথা স্মরণ করুন, কিংবা অন্য ছবিগুলিতে বরিশালী টোনে আশীষ কুমার লোহের কথা।

লেনিন যেদিন চাকুরি পায়, সেদিন বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির মাঝে মানবী আসে তার জীবনে। বৃষ্টির ছাঁটে লেনিন প্রেমাবেগের জোয়ার অনুভব করে দেহে মনে। বৃষ্টি নিয়ে একটা বক্তব্য যেন ছিল আলমগীর কবিরের। বাংলার বৃষ্টি, একটি পুনরুজ্জীবক শক্তি যেন। স্মরণ করুন রূপালী সৈকতের বৃষ্টির মাঝে পশ্চিম পাকিস্তানি মেয়েটির শটটির কথা। এই বৃষ্টিতে যেন কিছুটা বেমানান সে; বাংলার বৃষ্টি যেন তাকে প্রত্যাখ্যান করল– লেনিনের মতোই। এবং রূপালী সৈকতেই, সেতারে যুগলবন্ধীতে মেঘমল্লার রাগে বৃষ্টি আনে লেনিন ও শরমিন। পর্দায় ইমেজে দেখি বৃষ্টিভেজা কাক, লংশটে আজিমপুরের আকাশ, পথে রিক্সা, ভেজা রাস্তা, ছাতা মাথায় রমণী– হাজার বছরের বাঙলার বর্ষা। একান্তই বাঙালির নিজস্ব।

সীমানা পেরিয়েস্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝখানে টিনা

জলোচ্ছ্বাস ও শ্রেণীর সীমানা পেরিয়ে

সীমানা পেরিয়ে [১৯৭৭] ছবিটি সম্পর্কে আলমগীর কবিরের নিজের বক্তব্য :

১৯৭৩-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পর এক জোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের দক্ষিণের একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে কোনোরকমে বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ঢাকার তৎকালীন সংবাদপত্রে ঘটনাটির বিবরণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে ছবিটির treatment ইচ্ছাকৃতভাবে contrived। যৌন আকর্ষণ বা ভায়োলেন্স ছাড়াও সমাজের ওপর এবং নীচতলার দুটি মানুষের মধ্যে, শ্রেণীগত পর্যায়ে নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো আন্তরিক সম্পর্ক সম্ভব কিনা– এটা পর্যালোচনা করাই এই কার্যত fantasy চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল। আমার মতে এই সম্পর্ক সম্ভব, তবে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শ্রেণীটি তা সহ্য করতে চাইবে না। ব্যবসায়ী পুঁজির চাপে ছবিটির বক্তব্য এবং গতি কিঞ্চিৎ ছিন্নভিন্ন।  ৩ 

দার্জিলিংয়ে ছয় বছর, লন্ডনে রয়েল একাডেমী অফ ড্রামাটিক আর্টসে বৃত্তি, ছবিটির নায়িকা টিনার যে সামাজিক আবহ– তা পুরোপুরিই এক অবক্ষয়ী বুর্জোয়া-আবহ, যেখানে তরুণী মেয়েরা পিতার বয়সী ধনী কোনো ব্যক্তিকেও সহজেই বিয়ে করে, হিসেব কষে। বিয়েটাও তাদের কাছে একটা ক্যারিয়ারমাত্র। বাংলা চলচ্চিত্রে ক্লাব-পার্টি-ড্রিঙ্কসের এই বুর্জোয়া শ্রেণীটিকে সর্বদাই দেখানো হয় এক উদ্ভট অবাস্তবতায়। আসলে অধিকাংশ পরিচালকের ব্যক্তিগত গ্রাম্যতা ও মফস্বলীয়তা এই শ্রেণীটিকে কাছ থেকে চেনা-জানার ব্যাপারে একটা দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে। তবে তৃতীয় বিশ্বের উপরমহলের এই যে এলিট শ্রেণীটি– আলমগীর কবির এই শ্রেণীটিকে চিনতেন, জানতেন; ফলে তাদের এই চিত্রায়ণ, সংলাপ ও আচরণে, তাঁর হাতে সর্বদাই বাস্তবানুগ থেকেছে; যদিও বিশেষ অভিনেত্রীটির ম্যানারিজম বুর্জোয়া তরুণীটির চরিত্রে পূর্ণতা আনতে কিছুটা কৃত্রিমতা সৃষ্টি করেছে।

সীমানা পেরিয়ে : স্টিমারে টিনা ও তার মা

স্টিমার এই ছবিতেও রয়েছে। মেঘনারই বুকে। টিনা ওর মায়ের সঙ্গে গ্রামে চলেছে। সূর্যকন্যার লেনিনের ছেলেবেলার স্মৃতিতেও মিশে ছিল স্টিমার, স্টিমারের হুইসেল। আলমগীর কবির শৈশবে বরিশালের বাসিন্দা ছিলেন। এসব অভিজ্ঞতা হয়তো আত্মজৈবনিকই। ছবিতে ফিরে ফিরে শৈশব-কৈশোরের আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতাসমূহ তুলে ধরতে চাওয়া ‘অথর’ চলচ্চিত্রকারদের আরেক বৈশিষ্ট্য।

অহংসর্বস্ব পিতা ব্যারিস্টার চৌধুরীর ম্রিয়মান স্ত্রী টিনার মা। একটি শটে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়ির ক্ষয়িষ্ণু ঘাটে মা ও মেয়ে বসে। পাশে ফ্রেমে দীঘিতে কচুরীপানা। কচুরীপানা– বন্ধ্যাত্ব ও ডেকাডেন্ট ক্ষয়িষ্ণুতার এক খুবই কার্যকর দৃশ্যগত প্রতীক হয়ে উঠেছে। মায়ের প্রাক্তন প্রেমিক, বামপন্থী রাজনীতি করা রতন মাস্টার, টিনার ‘I hate politics’-এর জবাবে সাগরপারে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল : ‘কেবল ঘৃণা করলেই কি রাজনীতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়? যাদের সবকিছু আছে আর যাদের কিছুই নেই– সমাজের এই দুই অংশের মধ্যে যে সংঘাত নিরন্তর চলছে, তা থেকে তুমি চাও আর নাই-ই চাও, নিস্তার পাবে না। হ্যাঁ, কিছুদিন এড়িয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু believe me, একদিন না একদিন তোমাকে সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে।’ দুদিন পরেই সমুদ্রের এক জনমানবশূন্য দ্বীপে টিনাকে সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করালেন পরিচালক।

সীমানা পেরিয়ে : রতন মাস্টার ও টিনা

মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর, ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর এ দেশের উপকূলীয় জেলাগুলিতে যে প্রলয়ঙ্কারী জলোচ্ছ্বাস ঘটে গিয়েছিল, যাতে প্রাণ হারিয়েছিল কয়েক লক্ষ মানুষ, সে দুর্ঘটনা এই প্রজন্মের মানুষ তো প্রায় ভুলেই যেতে বসেছে। জাতি হিসেবে আমাদের স্মৃতিশক্তি কতই না ক্ষীণ! পরপর কয়েকটি মন্তাজ শটে সেই জলোচ্ছ্বাসের দৃশ্যাবলী এবং নেপথ্যে ভূপেন হাজারিকার চমৎকার সঙ্গীতটির মাধ্যমে আলমগীর কবির সেই গভীর ট্রাজেডির রূপটিকে তুলে ধরে রেখে তাঁর মানবিক দায়বদ্ধতা পালন করে গেলেন।

এই জলোচ্ছ্বাসে এক জনমানবহীন দ্বীপে ভেসে আসে টিনা এবং কালু; কালু পেশায় মাঝি, টিনার দাদা জমিদার বুড়ো চৌধুরী এক দুর্ভিক্ষের সময় খাজনা দিতে না পারায় এই কালুর দাদা ও বাপকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। এই জনহীন দ্বীপে নিজেদেরকে আবিষ্কার করে দুজনের প্রতিক্রিয়া দু’রকম। টিনা তার গার্লস গাইড ট্রেনিং নিয়ে ‘রেসকিউ পার্টি কল করা’র কথা ভাবে; বোতলে এস-ও-এস পাঠাতে চায়; বাঁশের ডগায় নিশান ওড়ায়– যা মূলত প্রকৃতির বুকে তার নাগরিক অসহায়তাকেই তুলে ধরে। আর অন্যদিকে, দুজনের জীবনধারনের নানা টুকিটাকি কাজের মাঝে কালুর সংশয়– ‘… পোড়া কপাল আর কারে কয়! কোনোদিন যদি দ্যাশে ফিরি– সে জমিদারের নাতনি, সত্য-মিথ্য দশখান বানাইয়া কওন খুবই সম্ভব। বড় লোকের মাইয়া। নালিশ করলে আমার মতো গরিব মাঝির কথা কেডা বিশ্বাস করবে!’

সীমানা পেরিয়ে : জনশূন্য দ্বীপে প্রথম দিন– কালু ও টিনা

তবে রতন মাস্টারের গোপন রাজনৈতিক দলের কর্মী কালু রতন মাস্টারের কাছ থেকে বৃথা শিক্ষা পায়নি। তার রয়েছে পরিশ্রমী মানুষের সহজাত মানবিকতাবোধ ও একটি সংবেদনশীল মন। দুজনের পাহাড়ে ওঠার প্রতীকী দৃশ্যটির কথা স্মরণ করুন। কালু দড়ির উপরে। যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত শ্রেণীর একজন হয়েও সে টিনার চেয়ে এগিয়ে আছে, উপরে আছে। এমনকি তার পূর্ব পুরুষদের প্রতি টিনার শ্রেণীর এত অত্যাচারকে ক্ষমা করেই সে নিচে টিনার দিকে বাড়িয়ে দেয় সহমর্মিতার হাত। সে যেন টিনার উত্তরণ চায় তার সামাজিক সীমাবদ্ধতাগুলি থেকে। পরিশ্রমকাতর টিনার প্রশ্নও যেন প্রতীকী অর্থেই, ‘আর কতদূর?’ আর প্রতীকী অর্থেই কালুর আশ্বাস, ‘আর একটু।’ এবং পাহাড়ে ওঠার পর যখন সাউন্ডট্র্যাকে পল রবসনের হিউম্যান ব্রাদারহুড সঙ্গীতটি ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে হামিং হয়ে ভেসে আসে, তখন পাহাড়ে ওঠার এই গোটা সিকোয়েন্সটিতে পরিচালকের রূপক বক্তব্যটি বলার প্রয়াস পূর্ণতা পায়।

কালু পাহাড়ের ওপর দুটি ঘর বানিয়েছিল। ওর ভাষায়, ‘ঐডা অইলো আপনার ঘর। এই অইলো আমার ঘর। [দা দিয়ে উঠোনের মাঝামাঝি দাগ কেটে–] আর এই অইলো সীমানা। এই পারে আপনে থাকবেন। আমি যামু না। রাইতে দাওডা আপনেই রাইখেন।’

এ পর্যন্ত কাহিনী বেশ তরতরিয়ে এগিয়ে যায়। তবে চরিত্রদের পোশাক, চুলের ধরন– এসব ডিটেলসের কাজে অবহেলা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়; কালুকে জেলে নৌকার অশিক্ষিত মাঝি হিসেবে কখনোই মনে হয় না। আর সাম্পানের জিনিসপত্র দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং ফরেস্ট অফিসারের বউয়ের জন্য দেয়া শাড়ি, ব্লাউজ ও অন্যান্য জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছবির কাহিনীতে আগে বলে রাখলেও এত বড় প্রলয়ঙ্কারী জলোচ্ছ্বাসের পরও কালু ও টিনার পোশাক-আশাক ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসপত্রের উপস্থিতির ফলে তাদের জীবনধারণ মোটেই বানে ভেসে আসা মানুষের মতো মনে হয়নি। চলচ্চিত্রে চোখে দেখার ভিজুয়াল সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। তা বাস্তবে দৃঢ়বদ্ধ না হলে দর্শকের মন বক্তব্যের গভীরে ঢুকতে চায় না। সীমানা পেরিয়ে ছবিটির এটি এক বড় সীমাবদ্ধতা

সীমানা পেরিয়ে : কালু ও টিনা– প্রকৃতির নিয়মেই কাছে আসা

যাহোক, প্রাকৃতিক নিয়মেই এই দুই নারী-পুরুষ একদিন কাছে আসে; যদিও বৈরী শ্রেণীগত অবস্থান এই দুজন মানব-মানবীর মনে দীর্ঘদিন ধরে পরস্পরের প্রতি সংশয় আর অবিশ্বাস জাগিয়ে রেখেছিল। সুসজ্জিতা টিনা এক সন্ধ্যায় মাঝের সীমানার বাঁশটি তুলে ফেলে কালুর হাত ধরে নিয়ে আসে উঠোনের মাঝামাঝি। নিয়মভাঙার এই নিয়মে শ্রেণী-সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এই দুই ব্যক্তিমানুষের মিল ঘটে, ঘটে দুই নর-নারীর মিলন– মালাবদলের বিয়ের মাধ্যমে। তবে কালু যেমন তার শ্রমজীবী অবস্থানের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে যে, সমাজ তাদের এই দুদিনের খেলাঘরকে স্বীকৃতি দেবে না, তেমনি টিনারও উপলব্ধি ঘটে : ‘আমরা যদি ফিরে যাই তাহলে ওই সমাজ কি আমাদের এই বিয়ে মেনে নেবে? ভেঙে চুরমার করে দেবে না? আমাদের এই দ্বীপের অস্তিত্ব নিশ্চয়ই কেউ জানে না। আমরা এখানেই থাকব। চাষবাস করব। ঘুণে ধরা সমাজের চোখ-রাঙানি এখানে থাকবে না। থাকবে না কোনো শ্রেণী-বিভেদ।’ একটি শ্রেণী-উর্ধ্ব ‘ঘেরাটোপ’-এর ইউরোপীয় স্বপ্ন যেন তা। আর তাতেই উদ্ধারকারী জাহাজটি দেখে ওরা দৌড়ে পালাতে চায়। পালাতে চায় মানুষের সমাজ থেকে– যা শ্রেণী-বিভেদে কলুষিত।

আর পরিশেষে ওরা যখন এই সমাজে ফিরে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিলো, তখনই টিনার বাবার স্বরূপে সামাজিক এসটাব্লিশমেন্ট কালুকে গুলি করে হত্যা করল/কাট/টিনার ফ্রিজশট। এবং সাউন্ডট্র্যাকে টিনার ‘না…’ বলে আর্তচিৎকারটি ফিরে আসে থাকে বারবার। দুটি নর-নারীর শ্রেণী-উর্ধ্ব জীবনের স্বপ্ন বাস্তবতার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। কালুর স্থানীয় প্রেমিকা মাথিনের চরিত্রে টিনা এবং সমুর চরিত্রে কালুকে দিয়েই অভিনয় করিয়ে পরিচালক হয়তো এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, টিনা তার নিজের শ্রেণীতে যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিল, সে দেখতে হুবহু কালুর মতো হলেও ‘নিম্ন’ শ্রেণীর হওয়াতে কালুর প্রতি টিনার কোনো প্রেমাবেগ বোধ করা সম্ভব ছিল না। একইভাবে, হুবহু টিনার মতো দেখতে একটি মেয়েকে অতীতে ভালোবাসলেও, টিনাকে সেই চোখে দেখার কথা কালুও প্রথমে ভাবতে পারেনি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে তথাকথিত প্রেমবোধও শ্রেণীনির্ভর

ওদের মুক্তমঞ্চে নাগরিক টিনার আয়োজিত প্রতি সন্ধ্যায় একটি করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কালুর রবীন্দ্রনাথ, টিনার শেক্সপিয়ার থেকে আবৃত্তির ব্যাপারটিতে বিশ্বাসযোগ্যতার কিছুটা ঘাটতি রইলেও তা হলিউডের ব্লু ল্যাগুন-এর মতো দুই তরুণ-তরুণীর শুধুই পরস্পরের শরীর-আবিষ্কার সর্বস্বতার উর্ধ্বে উঠেছে নিশ্চয়ই। আর কালুর জবানীতে চাকর নীলমণি কর্তৃক খাটের পায়া ধরে ‘দাদাবাবু, দাদাবাবু’ জাতীয় যে নাটকীয় সংলাপ, বাংলা-বায়োস্কোপের এই অতিনাটকীয় ধারার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আলমগীর কবিরের। সুযোগ বুঝে কিছুটা লাগসই ঠাট্টা করে নিয়েছেন আর কি!



পদটীকা
৩. চিত্রনাট্য/ আলমগীর কবির। [প্রাসঙ্গিক কথা অংশ]। প্রকাশক : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৭৯

গ্রন্থসূত্র • সিনেমার শিল্পরূপ/ তানভীর মোকাম্মেল। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮
লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত
  পরের কিস্তি  

Print Friendly, PDF & Email
চলচ্চিত্রকার; চলচ্চিত্র লেখক; চলচ্চিত্র-শিক্ষক। জন্ম : ৮ মার্চ ১৯৫৫; খুলনা, বাংলাদেশ।। ফিচার ফিল্ম : নদীর নাম মধুমতি [১৯৯৫]; চিত্রা নদীর পারে [১৯৯৮], লালসালু [২০০১]; লালন [২০০৪]; রাবেয়া [২০০৮]; জীবনঢুলী [২০১৩]।। ডকু-ফিল্ম : স্মৃতি একাত্তর [১৯৯১]; একটি গলির আত্মকাহিনী [১৯৯৩]; অচিনপাখী [১৯৯৬]; স্বপ্নার স্কুল [১৯৯৬]; ইমেজেস অ্যান্ড ইমপেশনস [১৯৯৯]; অয়ি যমুনা [২০০২]; কর্ণফুলীর কান্না [২০০৫]; বনযাত্রী [২০০৫]; বস্ত্রবালিকারা [২০০৭]; তাজউদ্দীন আহমদ-- নিঃসঙ্গ সারথি [২০০৭]; স্বপ্নভূমি [২০০৭]; ১৯৭১ [২০১১]; জাপানী বধূ [২০১২]।। শর্টফিল্ম : হুলিয়া [১৯৮৪]।। ফিল্ম-অ্যাওয়ার্ড : জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার [শ্রেষ্ঠ পরিচালক (চিত্রা নদীর পারে; লালসালু]।। সিনেমার বই : চলচ্চিত্র ও বার জন ডিরেক্টর [সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৮৫]; চলচ্চিত্র [বাংলা একাডেমি, ১৯৮৭]; ভবঘুরের দিগ্বিজয় [সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৯৬]; সিনেমার শিল্পরূপ [আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮]।। চলচ্চিত্র-শিক্ষকতা : ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট [বিএফআই]।। চলচ্চিত্র সংগঠন : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম [১৯৮৫-১৯৮৭; ১৯৯৫-১৯৯৭]; জুরি মেম্বার, ১৫তম রাবাত ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল [২০০৯]; ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্টার [বিএফসি]।। অফিসিয়াল ওয়েবসাইট : www.tanvirmokammel.com

2 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here