আলমগীর কবির: বায়োস্কোপের দেশে একজন অথর পরিচালক [১/৩]

1023

লিখেছেন তানভীর মোকাম্মেল


আলমগীর কবির [২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৮-২০ জানুআরি ১৯৮৯]। আমাদের সিনেমার এই মাস্টার ফিল্মমেকারের শিল্পজগত নিয়ে আরেক মাস্টার ফিল্মমেকার তানভীর মোকাম্মেল রচিত এই মহাগুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ নিবন্ধটি তিন কিস্তিতে ভাগ করে পুনঃমুদ্রণ করা হলো। প্রিয় পাঠক/দর্শক, আসুন, আলমগীর কবিরের জন্মদিন সামনে রেখে, তাকে পাঠ করার প্রথম কিস্তিতে মগ্ন হওয়া যাক…

আলমগীর কবির

It [Auteur Cinema] consists, in short, of choosing the personal factor in artistic creation as a standard of reference and then of assuming that, it continues, and even progresses, from one film to the next.
–Andre Bazin

লমগীর কবিরের ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ডজন খানেক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপটে অনেক বৈচিত্র্য থাকলেও, তাঁর চলচ্চিত্রগুলির টাইটেল কার্ডে একটি সাধারণ সাযুজ্য রয়ে গেছে, তা হচ্ছে প্রায় সব ছবিগুলিরই ‘রচনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও চলচ্চিত্রায়নে– আলমগীর কবির’। অর্থাৎ শুধুমাত্র পরিচালনা নয়, গোটা চলচ্চিত্রটিকে চিত্রনাট্যসহ নিজের মধ্যে ধারণ করা ও নির্মাণ করা। অনেকটা একজন লেখক যেমনটি তার বইয়ের ক্ষেত্রে করে থাকেন। আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষায় ‘অথর’ [Auteur] পরিচালক।

বিশ্ব চলচ্চিত্রের হাল আমলের খবরাদি যারা জ্ঞাত তারা জানেন যে, পঞ্চাশের দশকের সিনেমা ভেরিতে [Cinema Verite] থেকে উদ্ভূত হয় সিনেমা ডিরেক্ট [Cinema Direct]। সিনেমা ডিরেক্ট-এর মূল চরিত্র্যলক্ষণ হচ্ছে যে, তা এক ধরনের কোলাজ চলচ্চিত্র। কাহিনীর মাঝে মাঝে সচেতনভাবে ব্যবহার করা হয় প্রামাণ্য ফুটেজ/এক ধরনের ডকু-ফিকশন যেন তা এবং বক্তব্য প্রায়শই তীক্ষ্ণভাবে– রাজনৈতিক। ইতালীর ফ্রানসেসকো রোজি, ফ্রান্সের ক্রিস মার্কার, জঁ রুশ, মার্কিন রিচার্ড লীকক, রবার্ট ডু এবং সাম্প্রতিককালের সাড়া জাগানো কস্টা গাভরাস এই সিনেমা ডিরেক্ট ধারার বড় সব উদাহরণ, যাঁদের ছবিতে বাস্তব ঘটনাবলী ও কাহিনীচিত্র একত্রে পরিবেশিত, গাভরাসের জেড ছবিটি যে ধারার একটি সর্বোত্তম সৃষ্টি বলে সব মহলে স্বীকৃত। আর চরিত্রগতভাবেই এই সিনেমা ডিরেক্ট হচ্ছে ‘অথর’ সিনেমা। কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, সঙ্গীত এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে চিত্রগ্রহণও পরিচালকের নিজস্ব সৃষ্টি। আলমগীর কবির এই ধারারই একজন পরিচালক ছিলেন, অন্ততঃ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ছিলেন।

এক সর্বগ্রাসী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বিপরীতে ভারতবর্ষে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ত্রয়ীর ছবি একটা দৃঢ় অবস্থানে আজ দাঁড়িয়ে গেছে। এঁদেরকে ধারণ ও ক্ষেত্রবিশেষে ছাপিয়েই, ভারতবর্ষে এক নব-প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের আমরা দেখছি– গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, গোবিন্দ নিহালনী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ‘অথর’ ধারার প্রতি যাঁরা অনেকেই তাঁদের আগ্রহ দেখিয়েছেন। সময়ের বিচারে ভারতের এই দ্বিতীয় সিনেমা আলমগীর কবিরের প্রায় সমসাময়িক হলেও আমাদের এই মফস্বলী বাংলাদেশ তো অনেকদিক দিয়েই পিছিয়ে রয়েছে। সে দিক থেকে এ দেশে আলমগীর কবিরই ‘অথর’ ধারার পাইওনিয়ার নিশ্চয়ই, বিশেষ করে আমরা যদি মনে রাখি ধীরে বহে মেঘনা নির্মিত হয়েছে সেই ১৯৭৩ সালে।

প্রসঙ্গঃ আলমগীর কবির। বক্তাঃ তানভীর মোকাম্মেল

প্রথম যৌবনে পশ্চিমের ছোঁয়া ও যে চলচ্চিত্রিক আবহে আলমগীর কবির নিজেকে পেতে চেয়েছেন, তাতে তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকই ছিল প্রচলিত ধারায় গল্প বলার চেয়ে ষাট দশকের রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকারদের প্রিয় মাধ্যম সিনেমা ভেরিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা। এ সম্বন্ধে আলমগীর কবিরের নিজের বক্তব্য :

প্রথমে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন সাংবাদিক ও পরে চলচ্চিত্র-ছাত্র হিসেবে ফর্মটি স্বভাবতঃই আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। নিজ জন্মভূমির হাজারো সমস্যার প্রেক্ষিতে এটিকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অতীব প্রয়োজনীয় চলচ্চিত্র ফর্ম বলে মনে হয়। আমার প্রথম ছবি ধীরে বহে মেঘনা [১৯৭৩] থেকেই পূর্ণদৈর্ঘ্যরে অবয়বে সিনেমা ডিরেক্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরম্ভ করি। বলাবাহুল্য যাত্রাপথ ছিল কণ্টাকাকীর্ণ। বক্তব্য কিছু থাক বা না থাক, ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা চলচ্চিত্রশিল্প একটি বিশেষ কারণে এখনও ১৯৪৭-পূর্ব কলকাতা-স্টুডিও কেন্দ্রিক বায়োস্কোপের রীতিনীতি দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত। তেমন অঙ্গনে সিনেমা ডিরেক্ট নিয়ে পরীক্ষা করতে যাওয়া অনেকটা জেনে শুনেই আঁভা গার্দ জাতীয় সুইসাইড প্রচেষ্টার সামিল। তাই বায়োস্কোপে নভেল জাতীয় গল্প বিস্তর দেখতে অভ্যস্ত এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-ফর্মের বিবর্তন সম্পর্কে অচেতন দর্শক-সমালোচক উভয়েরই কাছেই ছবিটি দুর্বোধ্য রয়ে গেল। প্রদর্শক পরিবেশকদের আস্থা কিছুটা পুনরুদ্ধারের মানসে পরপর দুটি ‘নরম’ ছবি বানালাম– সূর্যকন্যা [১৯৭৬] ও সীমানা পেরিয়ে [১৯৭৭]। ১৯৭৯-তে সুযোগ বুঝে দর্শক-সমালোচক অসহনশীলতার প্রাচীরে আবার কামান দাগালাম– রূপালী সৈকতে। এবার প্রাচীরে উল্লেখযোগ্য ফাটল ধরলো। ১৯৭৩-এর তুলনায় দর্শক প্রতিক্রিয়া অধিতকর উৎসাহব্যঞ্জক। দুর্বোধ্য কারণে সমালোচক অনীহা রয়েই গেল। ১৯৮২-তে নিয়ে এলাম মোহনা। এবার দর্শকদের সাথে সমালোচকরাও নরম হলেন।  

দৃশ্য : ধীরে বহে মেঘনা

বহমান মেঘনা ও সাম্প্রদায়িকতার বেনোজল

ধীরে বহে মেঘনা একটি পুরোপুরিই ‘অথর’ সিনেমা। যেমন রূপালী সৈকতেও। যতটা হয়তো বলা যাবে না সূর্যকন্যা কিংবা সীমানা পেরিয়ে সম্পর্কে। ছবিটির শুরুতেই দিল্লী থেকে আগত অনিতার অফ-ভয়েসে স্বগতোক্তি। ফ্রেমের পরপর স্থিরচিত্রে দেখানো হয় অনিতার মা, বোন, বোনের প্রেমিকের ছবি। এবার ভেসে ওঠে দিল্লী ও ঢাকা নগরীর কিছু প্রামাণ্যচিত্র– সিনেমা ভেরিতে স্টাইলটা প্রথমেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এই দেশে, যেখানে সিনেমা বলতে এখনও বোঝায় প্রথমেশ বড়ুয়া যুগ– উচ্চকিত নাটকীয় সংলাপ ও ক্যামেরা-থিয়েটার।

সুমিত কর্তৃক অনিতাকে মুক্তিযুদ্ধে সময়কার কিছু প্রামাণ্যচিত্রের রাশ দেখানোর সিচুয়েশন তৈরি ও ওই রাশ দেখানোর মাঝে সুমিতের ন্যারেশনে ৭১-এর ভয়াবহ কিছু ছবি– চোখবাঁধা অবস্থায় নিহত বুদ্ধিজীবী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ– এই গোটা সিকোয়েন্সটি নিঃসন্দেহে সিনেমা ভেরিতের বুদ্ধিদীপ্ত এক ব্যবহার। সুমিতের বর্ণনার প্রেক্ষিতে পরিচালক প্রামাণ্যচিত্রে দেখিয়ে যান মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গেরিলা-যুদ্ধের ট্রেনিং, গণহত্যা, পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ, যৌথ কনভয়ের অগ্রগতি; বিধ্বস্ত জনপদ, ব্রীজ, রেলগাড়ি, দালান-কোঠা; মুক্ত যশোরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা, মুজিবনগর সরকারের ঢাকা প্রত্যাবর্তন, মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের করমর্দন; নেপথ্যে সঙ্গীত ‘সাগর ভেঙে বন্যার বেগে আয়/আকাশ ভেঙে ঝঞ্ঝার বেগে আয়’। যা আমাদের অনেক দুঃখে-গড়া ইতিহাস, নয় মাসের সেই প্রামাণ্য দৃশ্যাবলীকে সিনেমা-ভেরিতে স্টাইলে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের শরীরে আলমগীর কবির গেঁথে দিয়েছেন, যে কাজটি তিনি অন্যত্রও করেছেন– অত্যন্ত দক্ষতার সাথে

রাজাকারের প্রহরায় শরণার্থীদের নৌকা সীমান্তের পথে ধায়। মানবেন্দ্রের সংলাপ, ‘ও রাজাকার। টাকা পেলেই খুশী। ওরাই বর্ডার অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসে।… ওখানকার পীস কমিটির চেয়ারম্যান মালেক মণ্ডল এসব ব্যবস্থা করে দেয়। মাথাপিছু একশ টাকা। তাছাড়া টুকটাক আরও দিতে হয়।’ কিংবা সংলাপের ওই অংশটা, ‘খান সেনারা বোমা মেরে মানুষ-সমেত নৌকাটা উড়িয়ে দিয়েছিল’; কিংবা ওই মেয়েটির স্থিরচিত্র– যেখানে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে বাঙালি পিতা নিজের হাতেই নিজের মেয়েকে গুলি করে/কাট/নাজমা ও তার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট স্বামীর যুগল ফটো; আবহসঙ্গীতে সেই একই ট্রাজেডির সুর; ১৯৭১ সাল, আমাদের জীবনে যখন নেমেছিল এক অদ্ভুত আঁধার– প্রতিটি জীবনই যখন বিপণ্ন।

এবং নিশীথ রাত্রিতে দরজায় করাঘাত। একাত্তরের রাত্রি– দরজায় তো নয়, এ তো আমার অস্তিত্বের গভীরেই করাঘাত। বাইরে অপেক্ষমান মিলিটারির জীপ। বাঙালি বিমান অফিসারকে ধরে নিতে এসেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। নাজমা বন্দিনী। আরো দুই লক্ষ হতভাগিনী বাঙালি নারীর আরেকজন হওয়া থেকে যার বেঁচে যাওয়া কিছুটা উপস্থিত বুদ্ধি ও কিছুটা বরাত জোর মাত্র।

ধীরে বহে মেঘনা‘য় যুদ্ধের ফুটেজ

খণ্ড খণ্ড চিত্রে আলমগীর কবির মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলির যন্ত্রণা, বেদনা, আতঙ্ক এবং গৌরবকেও এ ছবিতে উপস্থিত করেছেন, এ দেশের চলচ্চিত্রে যে মুক্তিযুদ্ধের অনুপস্থিতি, সর্বদাই আমাদের এক বড় ক্ষোভের কারণ।

সমাজবাদী নেতা মানবেন্দ্র চৌধুরী বা মানুদা চরিত্রটি আলমগীর কবিরের ছবিতে অন্যত্রও দেখছি, যেমন সীমানা পেরিয়ের রতন মাস্টার একই ধরনের চরিত্র, একই অভিনেতা– গোলাম মুস্তাফা। কিছুটা আর্কিটাইপ যেন, যেমনটি ঋত্বিকের ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য্য।

মানব ও মাধবীর দাম্পত্য জীবনের দৃশ্যটিতে মাধবী যেভাবে খাটের মাথার কাছে গিয়ে পোষাক বদলায়, ব্লাউজ খুলে শোবার জন্যে প্রস্তুত হয়, টয়লেটে যায় এবং পরে বিছানার ওপরের কাপড়টি সরিয়ে বালিশে কাত হয়ে শরীরের আবেদন দিয়ে মানবের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, তা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এ পর্যন্ত আমার দেখা সবচে বাস্তবধর্মী ও আবেদনময়ী দাম্পত্য দৃশ্য এবং আধুনিকও। আধুনিক এই অর্থেও, যেখানে বোন হাসুর ভিন্ন ধর্মের কারো সঙ্গে প্রেমে পড়া নিয়ে মানব বলে : ‘যদি হাসু কাউকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে আর প্রতিদানে তাই পায়, তাহলে ছেলেটি এস্কিমো হলেও আমার আপত্তি নেই।’

তবে ‘যদি ধর্মে না মেলে’— মাধবীর এই উদ্বিগ্ন প্রশ্নেরও একটা গভীর সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে বৈকি! বিশেষ করে, এ দেশের আন্তঃসম্প্রদায়গত সম্পর্কের জটিল ইতিহাসটা যদি আমরা স্মরণ রাখি। ধীরে বহে মেঘনা ছবিটির এক বড় সাফল্য হচ্ছে যে, মূলতঃ একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হয়েও সাম্প্রদায়িকতার মতো সুগভীর এক সামাজিক সমস্যাকে তা খুব বড়ভাবেই ছুঁতে পেরেছে।

মানুদার পার্টির কাজে সুমিত জড়িত ছিল। রাজনীতি সচেতন এক তরুণ সে, যে খুঁজে বের করেছে পঁয়ষট্টি সাল থেকে তখন [১৯৭১ সাল] অবধি মোট দু’হাজার তেরজন রাজবন্দি ঢাকা জেলে ছিলেন। জেল খাটা, সাংবাদিকতা, সুমিতের আদলে ব্যক্তি আলমগীর কবিরকে কিছুটা পাওয়া যায় যেন, যদিও তা রূপালী সৈকতের লেনিন চৌধুরীর মতো হয়তো অতটা আত্মজৈবনিক নয়।

কফির কাপে চামচ নাড়ার ফাঁকে ‘বিস্কিট ফুরিয়ে গেছে। নন্দটা যে সেই কখন গেছে’— এ জাতীয় অসংলগ্ন কথার মাঝে একরাশ রজনীগন্ধার মতোই সারল্যে ভরা, সদ্য প্রেমে পড়া তরুণী হাসুর কাছে সুমিতের নিজের হৃদয়ের দুর্বলতা ব্যক্ত করা ও দুজনের প্রেমালিঙ্গন যেমন বাস্তবতায় দৃঢ়, তেমনি রোমান্টিকতায় মিষ্টি। পার্কে ঘুরে ঘুরে গান নেই, নাচ নেই– অথচ কী ব্যঞ্জনাময় রোমান্টিক এই প্রেম-দৃশ্য! মিষ্টি এবং একইসঙ্গে কোথায় যেন গভীর বেদনারও। ওদের ওই সারল্য ভরা প্রেমের দৃশ্যটি চলচ্চিত্রকার যেন নির্মাণই করেন পরের সিকোয়েন্সের ভয়াবহতার অভিঘাতকে আরো তীক্ষ্ণ করতে। হাসু আর নন্দকে ২৫শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে হত্যা করে রেখে যায়; কারণ, একে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তদুপরি রাজনৈতিক কর্মী মানুদার নাম ছিল সেনাবাহিনীর তালিকায়।

দৃশ্য : ধীরে বহে মেঘনা

নয় মাস যন্ত্রণার এক সাগর পাড়ি দিয়ে সুমিতের মতো আমরাও একদিন বুঝলাম, একদিন দেশ কেমন করে চূড়ান্তভাবে স্বাধীন হয়, তার তার জন্যে কী ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়! ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট, অনিতার প্রেমিক প্রদীপ মারা গেছে ঢাকার আকাশ-যুদ্ধে। বাংলাদেশে তাই অনিতার আসা নিজের অস্তিত্বের খোঁজেই যেন। কান্নায় ভেঙে পরে অনিতা বলে : ‘বাংলাদেশ যখন জয়ের আনন্দে মত্ত, তখন আমি নিজেকে ঘৃণা করেছি, বাংলাদেশকে ঘৃণা করেছি। আমার চোখেও ঘুম ছিল না। থাকতে না পেরে সোজা চলে এসেছি এখানে। দেখতে, বুঝতে, বাংলাদেশ কী এমন জিনিস, যার জন্যে চিরকাল এমনি দগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে। আজ মেঘনার বুকে ভাসতে ভাসতে যেন আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম। হঠাৎ যেন বুঝতে পারলাম, এমন দেশের মুক্তির জন্যে যে কোনো মূল্য দেয়া যায়। মেঘনা আমায় নতুন করে বাঁচতে শেখাল সুমিতদা।’

স্টিমারের ডেকে অনিতার ‘কী-ভাবছ-মানুদা’— এই প্রশ্নের জবাবে মানবেন্দ্র বলেছিল, ‘ভাবছি এই মেঘনার কথা। নদী তো নয়, যেন কালের ইতিহাস। [নদীর বিভিন্ন লং-শট।]… শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদেশী দস্যুর দল এই মোহনা দিয়ে ঢুকে লুটতরাজ, হত্যা, নির্যাতন চালিয়েছে দু’কূল ধরে। কিন্তু পারেনি এর দুর্বার গতিকে রোধ করতে, পারেনি এর জনপদকে নিশ্চিহ্ন করতে। নিজেরাই হারিয়ে গেছে কোথায়। দুর্জয় বাংলার মাটির মতোই মেঘনা রয়েছে চির অপরাজিতা। জানো, বিদেশীরা অনেক সময় বুঝতেই পারে না– এত দুঃখ, এত দারিদ্র, তবু বাঙালিরা এত সংগ্রামী শক্তি পায় কোথায়? বুঝলে অনিতা, এই-ই হচ্ছে সেই শক্তির উৎস।’

নেপথ্যে সঙ্গীত রাখেন আলমগীর কবির,
‘…কত যে ধীরে বহে মেঘনা
শান্ত, তবু সুপ্ত সে নয়…’

মেঘনা! যদি এ দেশের কোনো ছবির নাম তার বিষয়বস্তুর সঙ্গে এমন যৌক্তিকভাবে গেঁথে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে ধীরে বহে মেঘনা। কবিরের ছবিগুলো স্মরণ করুন– ধীরে বহে মেঘনা, মোহনা, রূপালী সৈকতে, সীমানা পেরিয়ে— নদী নিয়ে একটা দ্যোতক অর্থ, একটা দর্শনমতো বলার চেষ্টা ছিল তাঁর। বাঙলার নদীগুলি! এবং পরিশেষে নিজেরও যমুনায় ডুবে মৃত্যু– বড়ই প্রতীকী যেন তাঁর এই শেষ বিদায়।

দৃশ্য : ধীরে বহে মেঘনা

ধীরে বহে মেঘনা ছবিটির দর্শক গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আলমগীর কবিরের নিজের বক্তব্য ছিল :

যা আমার কাছে সবচেয়ে পীড়াদায়ক, তা তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীভুক্ত লোকের মনোভাব। বাংলাদেশের ছবি এখনও অবিভক্ত বাংলার ছবির যুগেই থেকে গেছে। যতক্ষণ না অত্যন্ত সরলভাবে শরৎচন্দ্রের গপ্পোকেন্দ্রিক ধরনের ছবির কাঠামো হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই আপাত শিক্ষিত দর্শক সমাজ অত্যন্ত অনুৎসাহী বোধ করে। তার পরিবর্তে আমি কল্পমূর্তির মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশের আহত ক্ষতকে, আর শত বাধা সত্ত্বেও তার বাঁচার শক্তিকে। অম্লমিষ্টি স্মৃতির মধ্যে স্বাধীনতা পরবর্তী অধ্যায়ে নতুন দেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং ভারত-বাংলার গণমানুষের বন্ধুত্বের টুকরো টুকরো অনুক্রম নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই চিত্রনাট্য। চরিত্রগুলোকে হিন্দু-মুসলমান তৈরি না করে, যতখানি সম্ভব মানবিক ধর্মনিরপেক্ষ করা হয়েছিল।  ২  

আমার মতে, ধীরে বহে মেঘনা যে এ দেশের এলিট শ্রেণীটি তেমন পছন্দ করেনি, তার কারণ শুধুই এ দেশের এলিটদের সাধারণ ফিলিস্টিনিজম এবং চলচ্চিত্র তথা সাংস্কৃতিকবোধের অভাব নয়, আরো গভীর একটি সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণও এর পেছনে কাজ করেছে; তা হচ্ছে, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা। যে সহজ সাবলীলতায় আলমগীর কবির হিন্দু-মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্পর্ক গড়েছেন, তা এই এলিট শ্রেণীর প্রিয় ছিল কি? সাম্প্রদায়িকতার কল্যাণে ৪৭-এর দেশভাগ, যার কল্যাণে আজ তাদের বাড়ি-গাড়ি-বিদেশভ্রমণ-বিলাস-ব্যসন, ফলে পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ প্রসার করবে যে চলচ্চিত্র, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার গোড়ায় আঘাত হানতে চাইবে যে শিল্পকর্ম, তা তাদের প্রিয় না হওয়ারই কথা। শুধুমাত্র চলচ্চিত্রিক ফর্মটাই হয়তো এ ক্ষেত্রে একমাত্র অন্তরায় ছিল না।

এ দেশের রাজনীতি যারা জানেন, তারা জানেন যে, বাংলাদেশে যে সস্তা ভারতবিরোধিতা করে, কিছু দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল, পত্রিকা বা সামাজিক গ্রুপ বেশ ‘করে খাচ্ছে’ সেই ভারতবিরোধিতা, অনেক ক্ষেত্রেই এক সম্প্রসারিত সাম্প্রদায়িকবোধ মাত্র এবং এর সঙ্গে দেশপ্রেমের যোগ সামান্যই। শুধু কোনো বড় রাষ্ট্রের পাশের ছোট রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সহজাত হীনমন্যতাবোধও নয় তা। পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ একজন শিল্পী আলমগীর কবিরের মানস এসব সকল ধরনের হীনমন্যতাবোধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল, এবং রাজনীতি-সচেতন চলচ্চিত্রকার বলেই, ভারতের সহায়তায় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই দেশটির একটি সদা-বিতর্কিত বিষয়, সেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে তিনি একটি যুক্তিসম্মত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েই বুঝতে চেয়েছেন। আর সিনেমা ভেরিতেতে কোনো তাৎক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরার সুযোগও রয়ে গেছে। যদিও অবশ্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুধুমাত্র সেই ১৯৭৩ সালেই নয়, আজকে এবং আগামীতেও এ দেশের রাজনীতি ও সমাজ-জীবনে একটা গুরুত্ববহ বিষয় হয়ে রইবে। যাহোক, সুমিতের পত্রিকার সাব-এডিটর রহিমুল্লাহ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে, দুর্বল বাংলাদেশ কি ভারতের তাবেদারীতে পরিণত হবে? সুমিতের কাছে তার প্রশ্ন ছিল :

রহিমুল্লাহ : ভারতকে ভালো না বাসলে কি দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না?
সুমিত : দেখুন, দেশপ্রেম শব্দটা বড় গোলমেলে। এরই নামে ইয়াহিয়া খান এ দেশের ত্রিশ লক্ষ পুরুষ, মহিলা আর শিশুকে হত্যা করেছে। আবার এরই জন্য লক্ষ লক্ষ বীর বাঙালি অস্ত্র তুলে নিয়েছে এবং জীবন দিয়ে দেশকে মুক্ত করেছে।… ভারত-বাংলাদেশ ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত সোজা। যেভাবে কয়েকটি বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, তাতে ভারতের সাহায্য ছাড়া এই মুহূর্তে দেশ স্বাধীন করা হয়তো অসম্ভব ছিল। এটা স্বীকার করতে লজ্জার কিছু নেই; বরং আত্মবিশ্বাসেরই পরিচয় দেয়।
রহিমুল্লাহ : কিন্তু এর মানে কি এই নয় যে, বাংলাদেশকে চিরকাল একটা দুর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র হয়ে থাকতে হবে?
সুমিত : হবে। যদি বাঙালি তার স্বকীয়তা রাখতে না জানে। একটা কথা মনে রাখা ভালো। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস কেবল মাত্র দু’এক বছর বা দু’এক দশকের ইতিহাস নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলার নিরীহ, শান্তিপ্রিয় মানুষ, বিদেশী এবং দেশী শোষকদের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে শোষণের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সত্যি কথা বলতে কি, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ সত্যিকারের জয়ের পথে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এর পরের লক্ষ্য একটি শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা। এরই মধ্য দিয়ে বাঙালিকে অনুপ্রেরণা যোগাতে হবে বিশ্বের লক্ষ কোটি নিপীড়িত মানুষের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, বর্ণবৈষম্যবিরোধী এবং শোষণবিরোধী সংগ্রামে। অত ভাবার কিছু নেই। ভারতের সাথে যারা হাজার বছরের যুদ্ধ করতে চায়, তারা করুক গিয়ে। আমাদের দরকার নেই।

কিছুটা বক্তব্যের ঢংয়ে ও কিছুটা দীর্ঘ হলেও, সুমিতের এই উদ্ধৃতিটি তুলে ধরা হলো ধীরে বহে মেঘনা ছবিটির সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটাকে এবং কবিরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটাকেও আরো সঠিকভাবে বুঝতে।

দৃশ্য : ধীরে বহে মেঘনা

অনিতার প্রেমিক ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট প্রদীপ যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তেমনি এ দেশের হাজার হাজার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্তের সাথে মিশে আছে ভারতীয় বাহিনীরও বহু জোয়ান ও অফিসারের রক্ত ও ঘাম। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি না হলে নিশ্চয়ই এই আত্মত্যাগের কথা ভুলব না। রক্তের বন্ধনেই ঘটেছে দুই দেশের সম্পর্কের রাখীবন্ধন। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকের সেই সংলাপ যেন, ‘বুলেট দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন। ইচ্ছা করলেও আলাদা হওয়া যায় না।’ সাম্প্রদায়িকতার সকল বেনোজলের উর্ধ্বে, জিন্নাহ সাহেবের দ্বি-জাতি তত্ত্বকে কবর দিয়েই, গড়ে ওঠা মৈত্রীর এই রাখীবন্ধন।

একটি সিকোয়েন্সে যুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত মূল্যবোধ ও অপচয়িত তারুণ্যের প্রতীক দুজন হাইজ্যাকারকে দেখি আমরা : ‘হালায় জীবনের ঝক্কি লইয়া দ্যাশ স্বাধীন কইরা অহনে অইলাম কিনা ডাকাইত। হাইজ্যাকার! যুদ্ধটা বড় তাড়াতাড়ি শ্যাস হইয়া গেছে।’ আবার পরক্ষণেই বিবেকবোধের উপলব্ধি : ‘…হইছি, বেশ করছি। দ্যাশের লাইগা অ্যাতো করলাম। দ্যাশ আমারে কী দিছে? [একটু হেসে] ধুর! দ্যাশ আবার কী দিবো? পুরস্কার? মায়েরে বাঁচাবার লাইগা পুরস্কার চামু? হালায় কুত্তা নাকি!’ পরে লোভ ও বিবেকবোধের দ্বন্ধে দুই হাইজ্যাকার পরস্পর গুলিবিদ্ধ। মন্তাজে বৈদ্যুতিক তারে ঝোলানো মৃত বাদুড়। ইতিহাসের বৈরী সময়ের বলি এক প্রজন্ম যেন, ভাইদাঅ্যাসেজ অ্যান্ড ডায়মন্ডস-এর মতোই।

শেষদৃশ্যে এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে সুমিত অনিতাকে ড্রাইভ করে নিয়ে চলেছে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের, ভিন্ন রাষ্ট্রের দুই তরুণ-তরুণীর মধ্যে একটা সম্ভাবনাময় সম্পর্ক হতে পারতো। কিন্তু জোলো প্রেমে বিশ্বাসী নন আলমগীর কবির। বরং এই দুটি নারী-পুরুষের সম্পর্কের প্রতীকে গভীর রাষ্ট্রনৈতিক সত্যের অন্বেষাতেই তাঁর আগ্রহ। অভিমানে সুমিত কথা বলছে না। অনিতার অফ-ভয়েসে শোনা যাবে ওর মনের কথা :

অনিতা [অফ-ভয়েস] : রাগ কোর না বন্ধু। এত বড় কঠিন পরীক্ষা উৎড়ে বন্ধুত্বের যে সূত্র আমরা খুঁজে পেলাম, তা চিরকাল অটুট থাক– এই কামনাই করি। সব মিলনই তো সত্যিকারের মিলন নয়। আবার সব বিচ্ছেদই চূড়ান্ত বিচ্ছেদ নয়। তুমি, আমি, তোমরা নতুন করে বুঝতে শিখেছি যে, সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয় মানুষে মানুষে; প্রাসাদে প্রাসাদে নয়। ভ্রান্তির কুয়াশা পেরিয়ে আবার যখন একে অপরের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি, তখন আর ভয় নেই। ভয় নেই বন্ধু।

দৃশ্য : ধীরে বহে মেঘনা

গোটা চলচ্চিত্রটির শরীরে ক্ষুদ্র অনুক্রমগুলিতে বেদনা ও বিষাদময়তার তীব্র কিছু চিত্রকল্প ছড়িয়ে রেখেও, জীবনের প্রতি কমিটেড একজন শিল্পী হিসেবে, শেষদৃশ্যে আলমগীর কবির আশাবাদী

ধীরে বহে মেঘনা ছবিটির আরেকটি দিক নিঃসন্দেহে কাব্যে উপেক্ষিতা আমাদের এই ঢাকা নগরী, তার গলি-ঘুপচি, রিক্সা, বৃষ্টিভেজা পথসহ প্রায় ভৌগোলিক এক উপস্থিতি, যা কবিরের অন্য ছবিগুলোতেও, বিশেষ করে সূর্যকন্যা রূপালী সৈকতেও আমরা দেখেছি। এ শহরটিকে কবির ভালোবাসতেন। ধীরে বহে মেঘনার অন্তিম শটগুলি স্মরণ করুন। শেষদৃশ্যে লং-শটে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের বোয়িং বিমানটি অনিতাকে নিয়ে আকাশে উড়লো। ঢাকার বুকে সন্ধ্যা নেমে আসার প্রস্তুতি চলছে। বুড়িগঙ্গার ওপারে সূর্যাস্তের আভা। ঘিঞ্জি পুরনো ঢাকার এক ফালি আকাশ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। রাস্তার ধারে হাপরের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। আর বুড়িগঙ্গার জলে অস্তমিত সূর্যের প্রতিবিম্ব জ্বলছে ঝিমমিক। চমৎকার কয়েকটি ইমেজ। আশাবাদেরও। জন্ম নিয়েছে নতুন এক দেশ।



পদটীকা
১. অন্য চলচ্চিত্র। ভূমিকা অংশ, চিত্রনাট্য 'মোহনা'। ভিনটেজ প্রকাশনী; ঢাকা, ১৯৮৪
২. আন্তর্জাতিক আঙ্গিক। কলকাতা, বসন্ত ১৩৭৯-গ্রীষ্ম ১৩৮০; ইংরেজি ১৯৭৩


গ্রন্থসূত্র • সিনেমার শিল্পরূপ/ তানভীর মোকাম্মেল। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮
লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত

পরের কিস্তি 

Print Friendly, PDF & Email
চলচ্চিত্রকার; চলচ্চিত্র লেখক; চলচ্চিত্র-শিক্ষক। জন্ম : ৮ মার্চ ১৯৫৫; খুলনা, বাংলাদেশ।। ফিচার ফিল্ম : নদীর নাম মধুমতি [১৯৯৫]; চিত্রা নদীর পারে [১৯৯৮], লালসালু [২০০১]; লালন [২০০৪]; রাবেয়া [২০০৮]; জীবনঢুলী [২০১৩]।। ডকু-ফিল্ম : স্মৃতি একাত্তর [১৯৯১]; একটি গলির আত্মকাহিনী [১৯৯৩]; অচিনপাখী [১৯৯৬]; স্বপ্নার স্কুল [১৯৯৬]; ইমেজেস অ্যান্ড ইমপেশনস [১৯৯৯]; অয়ি যমুনা [২০০২]; কর্ণফুলীর কান্না [২০০৫]; বনযাত্রী [২০০৫]; বস্ত্রবালিকারা [২০০৭]; তাজউদ্দীন আহমদ-- নিঃসঙ্গ সারথি [২০০৭]; স্বপ্নভূমি [২০০৭]; ১৯৭১ [২০১১]; জাপানী বধূ [২০১২]।। শর্টফিল্ম : হুলিয়া [১৯৮৪]।। ফিল্ম-অ্যাওয়ার্ড : জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার [শ্রেষ্ঠ পরিচালক (চিত্রা নদীর পারে; লালসালু]।। সিনেমার বই : চলচ্চিত্র ও বার জন ডিরেক্টর [সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৮৫]; চলচ্চিত্র [বাংলা একাডেমি, ১৯৮৭]; ভবঘুরের দিগ্বিজয় [সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৯৬]; সিনেমার শিল্পরূপ [আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮]।। চলচ্চিত্র-শিক্ষকতা : ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট [বিএফআই]।। চলচ্চিত্র সংগঠন : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম [১৯৮৫-১৯৮৭; ১৯৯৫-১৯৯৭]; জুরি মেম্বার, ১৫তম রাবাত ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল [২০০৯]; ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্টার [বিএফসি]।। অফিসিয়াল ওয়েবসাইট : www.tanvirmokammel.com

8 মন্তব্যগুলো

  1. […] ধীরে বহে মেঘনা এই উপলব্ধিরই প্রথম প্রচেষ্টা। এর অধিকাংশ ঘটনা সত্য এবং সমকালীন রূঢ় বাস্তব থেকে সংগ্রহ করা। সেই recreated reality-র সাথে সমন্বিত হয়েছে সমকালীন প্রামাণ্যচিত্র– যা কোনো স্টক-শট নয়। গল্পের কাঠামোটি constructed। সূর্যকন্যাও একই আদলের, যদিও treatment আলাদা পর্যায়ের। সীমানা পেরিয়ের আখ্যানের মূল ঘটনাও বাস্তব উদ্ভূত। ১৯৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পরে একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের দক্ষিণের একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ঢাকার তৎকালীন সংবাদপত্রে ঘটনাটির বিবরণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে ছবিটির treatment ইচ্ছাকৃতভাবে contrived। যৌন আকর্ষণ বা ভায়োলেনস ছাড়াও সমাজের ওপর এবং নীচতলার দুটি মানুষের মধ্যে, শ্রেণীগত পর্যায়ে নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো আন্তরিক সম্পর্ক সম্ভব কিনা– এটা পর্যালোচনা করাই এই কার্যত fantasy চলচ্চিত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। আমার মতে এই সম্পর্ক সম্ভব, তবে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শ্রেণীটি তা সহ্য করতে চাইবে না। ব্যবসায়ী পুঁজির চাপে ছবিটির বক্তব্য এবং গতি কিঞ্চিৎ ছিন্নভিন্ন। কিন্তু এর মূল ভার্সনও আছে। এই গ্রন্থে মুদ্রিত চিত্রনাট্যটি তারই। […]

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here