তারকোভস্কিকে দেখা: আকিরা কুরোসাওয়া

1023

মূল • আকিরা কুরোসাওয়া । অনুবাদ • রুদ্র আরিফ


একজন আকিরা কুরোসাওয়া [২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮]। এশীয় সিনেমাকে দুনিয়ার বুকে আত্মপরিচয়ে জানান দেওয়ার অগ্রপথিক। জাপানি তথা বিশ্ব-সিনেমার ইতিহাসের সর্বকালের সেরা প্রভাববিস্তারী, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ফিল্মমেকারদের অন্যতম। আরেকজন আন্দ্রেই তারকোভস্কি [৪ এপ্রিল ১৯৩২-২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৬]। সোভিয়েত-রাশিয়ান, তথা বিশ্ব-সিনেমার আরেক সেরা প্রভাববিস্তারী, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ফিল্মমেকারই শুধু নন, বরং অধিকাংশ সিনে-সমালোচক ও সিনেবোদ্ধার মতে, শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক কবিও বটে। অনুজপ্রতিম তারকোভস্কির সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়, একসঙ্গে সময় কাটানো ও তার অকালমৃত্যুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া– দুটি আলাদা সময়ে অগ্রজপ্রতিম কুরোসাওয়ার লেখা/বলা দুটি আলাদা স্মৃতিকথার এ অনুবাদ…

আকিরা কুরোসাওয়া ও আন্দ্রেই তারকোভস্কি
আকিরা কুরোসাওয়া ও আন্দ্রেই তারকোভস্কি

তারকোভস্কিকে দেখা 

সেটি ছিল সোভিয়েত-রাশিয়ায় আমার প্রথম সফর। মসফিল্ম-এ [রাশিয়া ও ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও পুরনো ফিল্ম-স্টুডিও] হাজির হলে, আমার সৌজন্যে যে মধ্যাহ্নভোজ পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেই তারকোভস্কির সঙ্গে দেখা। ছোটখাট, পাতলা, দেখতে খানিকটা রোগাটে, অথচ একইসঙ্গে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, এবং অসাধারণ রকমের বিচক্ষণ ও সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন তিনি। তাকে দেখে কেন যেন তরু তাকেমিৎসুর [জাপানি কম্পোজার; ১৯৩০-১৯৯৬] মতো মনে হলো আমার; তবে কেন মনে হলো– জানি না। যখন তিনি মার্জনা চেয়ে বললেন, ‘এখনো অনেক কাজ পড়ে আছে’; আর বলেই হাওয়া হয়ে গেলেন, এর কিছুক্ষণ পর আমার কানে ভেসে এলো ডাইনিং-হলের জানালার সব কাচ ভেঙে দেওয়ার মতো কম্পন তোলা বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দ। আমাকে চমকে পেছনে তাকাতে দেখে, মসফিল্ম-এর প্রধানকর্তা অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বললেন, ‘দেখুন, আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়নি! বরং তারকোভস্কি এইমাত্র একটি রকেট উৎক্ষেপন করলেন। অবশ্য তারকোভস্কির এই কাজটি আমাকে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের কথাই মনে করিয়ে দেয়।’ এভাবেই আমি জানতে পারলাম, সোলারিস [Solyaris; ১৯৭২] ফিল্মের শুটিং করছেন তারকোভস্কি।

মধ্যাহ্নভোজের সেই পার্টি শেষে, আমি গিয়ে হাজির হলাম সোলারিস-এর সেটে। সেখানে কাজ চলছিল। পুড়ে যাওয়া একটি রকেট আমি পড়ে থাকতে দেখলাম স্পেস স্টেশন সেটের এক কোণায়। সেটের মধ্যে রকেট উৎক্ষেপনের শুটিংটি তিনি কীভাবে করেছেন, এ প্রশ্ন তাকে করতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে আমি দুঃখিত। স্যাটেলাইট বেসের সেই চমৎকার সেটটি অনেক টাকা খরচ করে বানানো হয়েছিল; এর পুরোটাই জমাট ডুরালুমিন দিয়ে তৈরি।

শীতল মেটালিক সিলভার লাইটে চিকচিক করছিল এটি; সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো যন্ত্রপাতির মাপানুসারে জ্বালিয়ে রাখা বৈদ্যুতিক বাতি থেকে সূক্ষ্মভাবে পিটপিট করা কিংবা ঢেউ খেলে যাওয়া লাল, কিংবা নীল কিংবা সবুজ আলোর রশ্মি চোখে পড়ল আমার। করিডোরের সিলিংয়ের ওপরে ছিল দুটি ডুরালুমিন রেলপথ– যেখানে ক্যামেরার একটি ছোট্ট চাকা ঝুলে ছিল, যেন স্যাটেলাইট বেসের ভেতরে সেটিকে অবাধে মুভ করানো যায়।

সোলারিস-এর সেটে তারকোভস্কি
সোলারিস-এর সেটে, ডিরেক্টর’স চেয়ারে তারকোভস্কি

তারকোভস্কি আমাকে সেটটি ঘুরিয়ে দেখালেন; নিজের প্রিয় কোনো খেলনা কাউকে দেখানোর সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া অল্পবয়সী বালকের মতোই উচ্ছ্বাস নিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করছিলেন আমার কাছে। আমার সঙ্গে আসা বন্দারচুক [সের্গেই বন্দারচুক; সোভিয়েত ফিল্মমেকার; ১৯২০-১৯৯৪] সেটটির খরচের কথা জানতে চাইলে, তারকোভস্কি যখন তা জানাচ্ছিলেন, তখন চোখ ছাড়াবড়া হয়ে গিয়েছিল তার [বন্দারচুকের]। খরচের পরিমাণ ছিল বিশাল : প্রায় ৬০ কোটি ইয়েনের [জাপানি মুদ্রা] সমান; এ কথা জানতে পেরে, ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর [Voyna i mir; ১৯৬৬] মতো ঝমকালো সিনেমার নির্মাতা বন্দারচুকের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল।

এবার আমি পুরোপুরি বুঝতে পারলাম, কেন মসফিল্ম-এর প্রধানকর্তাটি এটিকে ‘আমার কাছে একটি বিশ্বযুদ্ধের মতো’ ব্যাপার বলে অভিহীত করেছিলেন। তবে এমন বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করার পেছনে নিয়োজিত হয়েছিল একটি বিরাট প্রতিভা ও উদ্যম। তিনি [তারকোভস্কি] যখন প্রবল উৎসাহে আমাকে সেট ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, সেদিকে গভীরভাবে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম, ‘এটি বিস্ময়কর এক কাজ’।

সোলারিস সম্পর্কে অনেককেই অভিযোগ তুলতে শুনেছি– এটি নাকি অনেক বেশি দীর্ঘ [রানিংটাইম : ২ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট]; কিন্তু আমার তা মনে হয়নি। তাদের কাছে বিশেষ করে ভূমিকাপর্বের দৃশ্যগুলোর বর্ণনার ধরণকে অনেকবেশি দীর্ঘ মনে হলেও, বস্তুতপক্ষে স্যাটেলাইট স্টেশন বেসের মধ্যকার একটি রকেটের মধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে ঢুকিয়ে দিয়ে, মহাবিশ্বের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পর কাহিনীটির তলানির গভীরে নিজেদেরকে নিমজ্জিত করার এই জাগতিক স্বভাবের প্রতি বিদায়কালীন স্মৃতির এইসব স্তরগুলো; এবং হোমসিকনেসের মতো, মাতৃতুল্য পৃথিবীর প্রকৃতির প্রতি একধরনের দুর্নিবার নস্টালজিয়ার বিষয়গুলো দর্শকের আত্মায় অনেকটা যন্ত্রণা তৈরি করেছে। একটি দীর্ঘ ভূমিকাপর্ব হিসেবে সৌন্দর্যময় প্রাকৃতিক সিকুয়েন্সগুলোকে যদি এখানে উপস্থাপন করা না হতো, তাহলে বরং স্যাটেলাইট বেসটির ভেতরে মানুষের ‘কারাবন্দি’ দশা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই– এই বোধটি দর্শক প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন না

সোলারিস-এর সেটে তারকোভস্কি
সোলারিস-এর সেটে, ক্যামেরার পেছনে তারকোভস্কি

এই ফিল্মটি আমি প্রথম দেখেছি মস্কোর একটি প্রিভিউ রুমে, কোনো এক শেষ রাতে; আর মুহূর্তেই টের পেয়েছি, যতদ্রুত সম্ভব পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য আমার মন যন্ত্রণায় নিদারুণ দড়পাচ্ছে। বিজ্ঞানের তুখোড় অগ্রগতি আমরা উপভোগ করছি ঠিকই, কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত মনুষ্যজাতিকে কোথায় নিয়ে ফেলবে? এই সিনেমাটি আমাদের আত্মায় নির্ভেজাল ভীতিপ্রদ আবেগের ভেলকি দেখিয়েছে সফলভাবে। এটি [এই বৈশিষ্ট্য] না থাকলে, কোনো সায়েন্স ফিকশন ফিল্মের পক্ষে একটি মামুলি খেয়ালপনার চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, এ ভাবনাগুলোই মনে আসছিল আমার। তারকোভস্কি তখন আমার কাছেই ছিলেন। স্টুডিওটির এক কোণায় বসে ছিলেন তিনি। ফিল্মটি শেষ হতেই, উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন তিনি সচকিত। তাকে বললাম, ‘বেশ ভালো তো! এটি আমাকে সত্যিকারের ভয় পাইয়ে দিয়েছে।’ তারকোভস্কি লাজুক হাসলেন; তবে খুশিমনেই। ফিল্ম ইনস্টিটিউটটির রেস্টুরেন্টে গিয়ে, আমরা ভোদকা খেলাম। তারকোভস্কি সাধারণত মদপান না করলেও, প্রচুর পরিমাণ ভোদকা খেলেন সেদিন; আর উঠে গিয়ে, যে স্পিকার থেকে বাজানো মিউজিক ভেসে বেড়াচ্ছিল রেস্টুরেন্টটিতে, সেটি বন্ধ করে দিলেন; তারপর উঁচুগলায় সেভেন সামুরাই-এর [আকিরা কুরোসাওয়া; ১৯৫৭] সামুরাই-থিমটি গাইতে থাকলেন। যেন তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই, আমিও গলা মেলালাম। সেই মুহূর্তটিতে, পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছি বলে, নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হলো আমার

সোলারিস একজন দর্শকের মনে এই অনুভূতিটিই এনে দেয়; আর এই একটিমাত্র ঘটনাই আমাদের জানিয়ে দেয়– সোলারিস কোনো গতানুগতিক সায়েন্স-ফিকশন ফিল্ম নয়। এটি সত্যিকার অর্থেই কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের আত্মায় নিখাঁদ আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেয়। আর তা পরিপূর্ণভাবে বশ মানে তারকোভস্কির গভীরতর অন্তর্দৃষ্টির ভেতরে।

দৃশ্য : সোলারিস [আন্দ্রেই তারকোভস্কি]
দৃশ্য : সোলারিস [আন্দ্রেই তারকোভস্কি]

এ পৃথিবীতে মনুষ্যজাতি সম্পর্কে এখনো অনেক, অ-নে-ক কিছুই জানা বাকি : মহাবিশ্বের অতল-গহীনে একজন মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে স্যাটেলাইট বেসে আগন্তুক পরিদর্শকেরা, সময় উল্টো ঘুরছে– মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে, বায়ুমণ্ডলের উথাল-পাতালে বিস্ময়করভাবে ঘুরে যাচ্ছে… স্যাটেলাইট স্টেশনে থাকা কেন্দ্রীয় চরিত্রটির চিন্তারাজ্যে তার নিজের বাড়ি– জলে ভিজে একাকার! এই যে সে সর্বাত্মকভাবে নিজের মর্মঘাতী অন্তর্বেদনাকে নিংড়ে ফেলতে চাচ্ছে– এটি দেখে আমিও যেন ঘেমে যাচ্ছি; ভিজে যাচ্ছি কান্নার জলে। আর জাপানের টোকিওর আকাসাকা-মিৎসুকের [সাবওয়ে স্টেশন] লোকেশনটির শট দেখে আমাদের শিহরিত হওয়ার অবস্থা। আয়নার এক তুখোড় ব্যবহার ঘটিয়ে, তিনি [তারকোভস্কি] গাড়িগুলোর হেডলাইড ও ট্রেইল-ল্যাম্পগুলোকে প্রবাহিত করার মাধ্যমে, ভবিষ্যৎ-শহরের একটি ভিনটেজ-ইমেজের মধ্যে এটিকে [আকাসাকা-মিৎসুক] গুণিত ও বিবর্ধিত করেছেন। সোলারিস-এর প্রত্যেকটি শটই, তারকোভস্কির অন্তর্নিহিত দীপ্তিমান প্রতিভার একেকটি সাক্ষ্য বহন করে।

অনেকেই নালিশ তোলেন, তারকোভস্কির সিনেমাগুলো নাকি দুর্বোধ্য; অথচ আমার তা মনে হয় না। তার সিনেমাগুলো স্রেফ দেখিয়ে দেয়– তারকোভস্কি স্বয়ং কতটা অতুলনীয় সংবেদনশীলসোলারিস-এর পর মিরর [Zerkalo; ১৯৭৫] নামে একটি সিনেমা বানিয়েছেন তিনি। নিজের শৈশবের লালিত স্মৃতি নিয়ে মিরর; এবং অনেকেই আবারও অভিযোগ তুলেছেন, এই ফিল্মটিও নাকি বাজে-রকমের দুর্বোধ্য। হ্যাঁ, এক পলকে দেখলে এটিতে স্টোরিটেলিংয়ে কোনো যুক্তিসঙ্গত বিকাশ ঘটেনি বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত : আমাদের আত্মায় আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলোর পক্ষে কোনো স্থির, যৌক্তিক সিকুয়েন্স হিসেবে বিন্যস্ত থাকা সম্ভব নয়।

প্রথমদিকের স্মৃতির ইমেজগুলোর নানা টুকরোর একটি বিস্ময়কর সারি ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যেতে পারে, আর সেই ভাঙনটি আমাদের শৈশব ঘিরে জন্ম দিতে পারে কোনো কবিতার। এই সত্যবাদিতাকে আপনি যখন একবার মেনে নিতে পারবেন, দেখবেন, মিরর আপনার কাছে হয়ে ওঠবে বোঝার পক্ষে সবচেয়ে সহজতর ফিল্ম। কিন্তু মুখ ফুটে এ ধরনের কোনো কথা একদমই না বলে, তারকোভস্কি বরং নিশ্চুপ থেকেছেন। তার এই মনোভাব আমার মনে এই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে– ভবিষ্যতে তার অভূতপূর্ব সম্ভাবনা রয়েছে।

যারা নিজের সিনেমা সম্পর্কে সবকিছু ব্যাখ্যা করে দিতে প্রস্তুত, তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই উজ্জ্বল হতে পারে না

প্রথম প্রকাশ • আশাহি শিমবুন । জাতীয় দৈনিক; জাপান । ১৩ মে ১৯৭৭

 

দৃশ্য : আন্দ্রেই রুবলেভ [আন্দ্রেই তারকোভস্কি]
দৃশ্য : আন্দ্রেই রুবলেভ [আন্দ্রেই তারকোভস্কি]

তারকোভস্কির জন্য এলিজি

তারকোভস্কির সঙ্গে ভীষণ ঘনিষ্ঠতা ছিল আমার। আকাসাকা প্রিন্স হোটেলের পুরনো বিল্ডিংটিতে আমার অফিস। সেখানেই থাকতাম আমি। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার ব্যবস্থা করলেন। সেটি ছিল আমাদের প্রথম মুখোমুখি হওয়া। তারপর তিনি দেখলেন, রাত নেমে এলে আকাসাকাকে কেমন দেখায়। হয়তো আপনারা বুঝতে পারছেন, সোলারিস-এ সেটি দেখানোর প্রসঙ্গেই এ কথা বলছি। রাতের আকাসাকার এক চমৎকার ব্যবহার তিনি করেছেন [ফিল্মটিতে]; যদিও সেগুলো ফুটিয়ে তুলেছিলেন আয়নার সামনে ইমেজগুলোর প্রতিফলন ঘটানোর মধ্য দিয়ে। মেট্রোপলিটন হাইওয়ের রাতের দৃশ্যটি উজ্জ্বল লাল ট্রেইল-ল্যাম্পের আলোর চলাচলের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের শহুরে জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আপনারা জানেন, ফিল্মটি আমি প্রথম দেখেছি মস্কোতে, এটির প্রিভিউতে; তখনই হাইওয়ের দৃশ্যটি চোখে পড়ে আমার। আমাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে, এটি আমার অফিসে যাওয়ার রুটটির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল! ‘আরে, আমি তো এখন আমার অফিসের দিকেই যাচ্ছি’– মস্কোতে থাকার সময়, এমনটাই মনে হয়েছে আমার।

তারকোভস্কির প্রত্যেকটি সিনেমাই অবশ্য দুর্দান্ত। বিশেষ করে, ওয়াটার এলিমেন্টকে তিনি তুখোড়ভাবে সামলিয়েছেন; উদাহরণস্বরূপ সোলারিস ও সেক্রিফাইস [Offret; ১৯৮৬] ফিল্ম দুটির নাম নেওয়া যায়। কোনো ডোবা কিংবা ওয়াটারপুলে তিনি এমনভাবে শুটিং করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেন সেটির একেবারেই গভীর তলদেশও আমাদের চোখে স্বচ্ছভাবে ধরা পড়ে। জানেন তো, আপনি যদি এ কাজটি গতানুগতিকভাবে করেন, পানির উপরিভাগে আকাশের প্রতিফলনের দেখা সে ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই পাবেন। পানির শুটিং আমি ঠিক তার মতো করেই করতে চেয়েছিলাম, ড্রিমস-এর [Yume; আকিরা কুরোসাওয়া; ১৯৯০] ভিলেজ অব ওয়াটারমিলস এপিসোডে। ভাবতে পারেন, কী করে সেটি অর্জন করলাম আমরা? পানির উপরিভাগে পড়া আকাশের প্রতিফলন এড়ানোর জন্য বিশাল এক কালো কাপড় দিয়ে আকাশ ঢেকে দিতে, উড্ডয়নরত বিরাট ক্রেনের সেটআপ করেছিলাম। এরপরই নদীপথটি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

জানেন তো, সোলারিস-এ  স্পেস স্টেশনের কলা-কুশলীদের পৃথিবী নামক গ্রহটিতে ফিরে আসার জন্য ভুগতে হয়েছে। এ কারণেই, নদীর ওপর আলতো করে ঢেউ নেচে যাচ্ছে– পৃথিবীর প্রকৃতির এ রকম দীর্ঘ, সুদীর্ঘ একগুচ্ছ সিকুয়েন্সের দেখা আমরা পাই। এটি দর্শককে বস্তুতপক্ষে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে চায়। [ফিল্মটির] জাপানি ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানি আমাকে বলেছিল, এটি যেন খানিকটা ছোট করে দিই; কেননা, প্রকৃতির শটগুলো ভীষণ দীর্ঘ ছিল। কেউ যদি তা করতে যান, ফিল্মটি তাহলে অর্থহীন হয়ে পড়বে। অনেক পীড়াপীড়ির পর, কাটছাটের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত ফিল্মটিকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম আমি।

দৃশ্য : সেভেন সামুরাই [আকিরা কুরোসাওয়া]
দৃশ্য : সেভেন সামুরাই [আকিরা কুরোসাওয়া]

এতেই বোঝা যায়, তার সিনেমাগুলো সম্পর্ককে খানিকটা দুর্বোধ্যতা রয়ে গেছে। আমি অবশ্য নিশ্চিতভাবেই জানি, এটি তার অবিশ্বাস্য যোগ্যতারই ফল। সহজেই বুঝে ফেলা যায়, এ রকম অনেক অর্ডিনারি ফিল্মের চেয়ে, তার সিনেমাগুলো কোনো-না-কোনোভাবে খানিকটা আলাদা। শুনেছি, তার বাবা একজন বিখ্যাত কবি [আর্সেনি তারকোভস্কি]। ফলে আন্দ্রেইয়ের মধ্যে একটি অসাধারণ কাব্যিক প্রতিভা ও গুণাবলি ছিল।

তারকোভস্কি আমাকে বলেছিলেন, নিজের নতুন কোনো সিনেমার শুটিং শুরুর আগে তিনি, সবসময়ই সেভেন সামুরাই দেখে নেন। আমি বলতে চাই, শুটিং শুরু করার আগে, সবসময়ই তার আন্দ্রেই রুবলেভ [Andrey Rublyov; ১৯৬৬] দেখে নিই আমি।…

আন্দ্রেই ছিলেন একজন অমায়িক, মনোমুগ্ধকর মানুষ। প্যারিসের হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন– এ খবরটি আমি ইউরোপে থাকার সময়েই পেয়েছিলাম। তার অবস্থা জানার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম; এবং ফিরতিপথের বিমানটি ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্তও মরিয়াভাবে চেষ্টা করেছি হাসপাতালটির খোঁজ পাবার।… এর কিছুদিন পরই তার মৃত্যুসংবাদ কানে এলো। দেখুন, এককথায় বললে, তাকে আমার সবসময়ই, কোনো-না-কোনোভাবে নিজের আপন ছোটভাই বলে মনে হয়েছে

প্রথম প্রকাশ • অ্যা ড্রিম ইজ অ্যা জিনিয়াস/ আকিরা কুরোসাওয়া । ফিল্ম-বুক । ১৯৯৯
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

3 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to ডুব : বায়োপিকে প্রবেশ/ মাহবুব মোর্শেদ | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here