বার্গম্যান অথবা বারিমনের আত্মজীবনী [কিস্তি-৭]

393

ইংমার বারিমন। ইংরেজি উচ্চারণ ইঙ্গমার বার্গম্যান নামে অধিক পরিচিত সুইডিস মাস্টার ফিল্মমেকার। দ্য ম্যাজিক লেন্টার্ন শিরোনামে প্রকাশিত তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি সিনেবিশ্বের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটবুকও বটে। সেই গ্রন্থের এই ধারাবাহিক অনুবাদ…

আগের কিস্তি । প্রেতিনীগন

কার্ল মামা, অথবা জীবনের পাশে থাকা জনৈক উন্মাদ উদ্ভাবক

নানীর গালাগাল শুনে, নানীর সবুজ সোফার উপর বসে ছিলেন কার্ল মামা। মোটাসোটা এই লোকটার, বিশাল কপাল জুড়ে দুশ্চিন্তার রেখা। তার মাথায় বাদামি দাগ ভরা, আর ঘাড়ের পেছনের দিকে অল্প কয়েকটা প্যাঁচানো চুল। চুলে ভরা তার কান দুটো রক্তাভ লাল। তার গোলগাল ভুড়িটা উপচে পড়ছে নিজেরই উরুর ওপর; আর গোঁফের ওপর চেপে বসা চশমা দিয়েছে কোমল বেগুনী-নীলচে চোখ দুটিকে ঢেকে। হাঁটুর কাছে, নিজের মোটাসোটা হাত দুটোকে জড়ো করে রেখেছিলেন তিনি।

ড্রয়িংরুমের টেবিলের সামনে, আর্মচেয়ারে বসে সরাসরি তাকিয়ে ছিলেন নানী। তর্জনী উঠিয়ে বলছিলেন কথা। মাঝে মধ্যে কোনো শব্দের ওপর জোর দিতে গিয়ে, টেবিলে মারছিলেন টোকা। বরাবরেরই মতো, পরনে তার একটা সাদা কলার আর একটা ক্যামিও ব্রোচ-অলা কালো পোশাক। নীল-সাদা ডোরাকাটা প্রাত্যহিক অ্যাপ্রোন গায়ে; সূর্যের কিরণে, তার ঘন-সাদা চুলগুলো চিকচিক করছিল। শীতকালের এক হিমশীতল দিন ছিল সেটি। স্টোভে গর্জে বেড়াচ্ছিল আগুন। জানালার বাইরেটা ছিল তুষারঢাকা ফুলে ভরা। কাচের ঘেরাটোপের ভেতর থেকে ঘড়িটা জানান দিলো– বারোটা বেজে গেছে; নিজের কাউবয়ের উদ্দেশে, নেচে ওঠল উর্বশী। সদর দরজার সামনে দিয়ে ছুটে গেলো একটা স্লেজগাড়ি– ঝুনঝুন ঘণ্টি বাজিয়ে; ভারি ক্ষুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

লাগোয়া একটি রুমে, ফ্লোরে বসে ছিলাম আমি। ট্রেনে আসা আমাদের ভীষণ ধনী আন্টি– অ্যানার পাঠানো ক্রিসমাসের উপহার নিয়ে, কিছুক্ষণ আগেই আমি আর কার্ল মামা রেললাইন ধরে হেঁটে এসেছিলাম। দরজার সামনে, হুট করেই সামনে এসে দাঁড়ান নানী; তারপর কার্ল মামার ওপর গলা ফাটিয়ে চিল্লাতে শুরু করেন। বেকায়দায় পড়ে যান মামা; দীর্ঘশ্বাস ফেলে, জ্যাকেট হাতে তুলে নিয়ে, ওয়েস্টকোট পেটের মধ্যে পুড়ে দেন। তারপর তারা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসেন। দরজাটা নানী বন্ধ করে দিলেও, খানিকটা খোলা ছিল। ফলে তাদের কথাবার্তার সব শব্দই কানে আসছিল আমার।

নানী কথা বলছিলেন, আর কার্ল মামা নিজের নীলাভ-লাল ঠোঁটগুলো কামড়ে ধরে, মাথা নিজের কাঁধের নিচে নামিয়ে, নিচু করে রেখেছিলেন। কার্ল মামা ছিলেন আসলে সৎ-মামা; তিনি ছিলেন নানীর সবচেয়ে বড় সৎ-ছেলে : বয়সে নানীর চেয়ে খুব একটা ছোট নন।

মামার খুব ভক্ত ছিলাম আমি...
মামার খুব ভক্ত ছিলাম আমি…

নানী ছিলেন মামার অভিভাবিকা। মাথায় একটু গোলমাল ছিল তার। নিজের দেখভাল করার ক্ষমতা রাখতেন না। মাঝে মধ্যে তাকে একটা পাগলাগারদেও পাঠানো হয়েছে; তবে বেশির ভাগ সময় তিনি পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতেন– বেডা আন্টি ও ইস্টার আন্টি নামে পরিচিত দুই মধ্যবয়সী নারীর বাসায়; তারাই মামার পুরোদস্তুর দেখাশোনা করতেন। মামা ছিলেন যেন বিশালদেহী কোনো কুকুরের মতোই অনুরক্ত ও ভদ্র; তবে এখন তার অবস্থা বেশ গোলমেলে। একদিন সকালে তো কোনো লং আন্ডারপ্যান্ট কিংবা ট্রাউজার না পরেই, নিজের রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিলেন বাইরে; আর বেডা আন্টিকে ভয়ানকভাবে চুম্বন ও বিশ্রী গালাগাল করতে থাকেন। বেডা আন্টি অবশ্য ভড়কে যাননি; বরং ডাক্তারের পরামর্শ মাথায় রেখে মামাকে শান্ত করে, তার জন্য যোগ্য জায়গাটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ফোনে জানিয়েছেন নানীকে।

নিদারুণ মনস্তাপে, কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন কার্ল মামা। শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। প্রত্যেক রোববারে, ইস্টার আন্টি ও বেডা আন্টির সঙ্গে মিশন চার্চে যেতেন, আর পরিচ্ছন্ন ডার্ক স্যুটে তাকে দেখতে বেশ ভদ্র লাগতো। তার ছিল সুমধুর ভরাট কণ্ঠ– যেন যথার্থ কোনো ধর্মযাজকের মতোই। বিনাশ্রমের কর্মচারীর মতো, সব কাজ যথাযথভাবে পালন করতেন তিনি। কফি পার্টি ও সেলাই কাজ দেখাশোনা করতেন; আর হস্তশিল্পে আত্মনিয়োজিত নারীদের উচ্চস্বরে পড়ে শোনাতেন ধর্মবাণী।

কার্ল মামা একজন সত্যিকারের উদ্ভাবক ছিলেন। ড্রয়িং ও ব্যাখ্যার ঢালি নিয়ে রয়েল প্যাটেন্ট অফিসে আনা-গোনা ছিল তার; কিন্তু খুব একটা সফল হননি। তার শতাধিক আবেদনপত্র থেকে মাত্র দুটি গৃহীত হয়েছিল; এর মধ্যে একটা ছিল এমন এক যন্ত্র– যেটি সব আলুকে একই আকারের করে ফেলতে সক্ষম; আর অন্যটি ছিল একটি অটোমেটিক ল্যাভাটরি বা শৌচাগারের ব্রাশ।

কার্ল মামা ভীষণ রকম সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। তার সর্বশেষ আইডিয়াগুলো কেউ চুরি করে ফেলতে পারে– এ উদ্বেগে উন্মাদপ্রায় ছিলেন তিনি। ফলে সেগুলোকে একটি ওয়েলক্লথে মুড়িয়ে, নিজের প্যান্ট আর লং আন্ডারপ্যান্টের মাঝখানে লুকিয়ে বয়ে বেড়াতেন। এই ওয়েলক্লথটির জন্যই ইউরিনোম্যানিয়ায় ভুগতে হয়েছে কার্ল মামাকে। কখনো কখনো, বিশেষ করে কোনো বড় জনসমাগমে, নিজের এই গোপন প্যাশনকে তিনি লুকিয়ে রাখতে পারতেন না। চেয়ারের পায়ার সঙ্গে নিজের ডান পা’টি ভেজিয়ে রেখে, আরেক পা একটুখানি ওপরে তুলে, নিজের ট্রাউজার ও আন্ডারপ্যান্ট ভিজিয়ে, শান্তভাবে আত্ম-নিষিক্ত জলের বন্যা বইয়ে দিতেন!

মামার এই দুর্বলতার কথা নানী আর ইস্টার ও বেডা আন্টির জানা ছিল। এই বেটে তীক্ষ্ণ ‘কার্ল’-এর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে সক্ষম ছিলেন তারা। কিন্তু একদিন গরম স্টোভ থেকে কোনো একটি ভাজাপোড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে আঁকতে ওঠেন মিস অ্যাগডা। গিয়ে দেখেন, কার্ল মামা কাঁদছেন আর বললেন, ‘হায় রে, আমি তো প্যানকেক বানাচ্ছিলাম!’

কার্ল মামাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম; আর আমার আন্তরিক আস্থা ছিল সিগনা খালামণির ওপর– যিনি কিনা তিন ভাইয়ের মধ্যে কার্লকে সবচেয়ে প্রতিভাধর মনে করতেন; কিন্তু ঈর্ষাকাতর হয়ে অ্যালবার্ট মামা তার এই বড় ভাইয়ের মাথায় একদিন একটা হাতুড়ির বাড়ি বসিয়ে দিলে, বেচারাকে সারাটা জীবন মাথার সমস্যায় ভুগতে হয়েছে।

পাগলাটে এক উদ্ভাবক ছিলেন মামা
পাগলাটে এক উদ্ভাবক ছিলেন মামা

আমার ম্যাজিক ল্যানটার্ন ও আমার সিনেমাটোগ্রাফের জন্য নানা জিনিস উদ্ভাবন করে দিয়েছেন বলে কার্ল মামার ভক্ত ছিলাম আমি। স্লাইড হোল্ডার আর লেন্স ঠিক করে দিয়েছিলেন তিনি; ভেতরে সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন একটা আয়নার খিলান; তারপর কাঁচের টুকরোগুলোকে আরও বেশি সচল হওয়ার উপযোগী করে দেওয়ার পাশাপাশি, সেগুলোতে রঙ করে দিয়েছিলেন নিজেই। এভাবেই তিনি ফিগারগুলোর ব্যাকগ্রান্ডগুলোকে দ্রুত চলনশীল করে তুলেছিলেন। ওদের [ফিগার] নাকগুলো ফুটে ওঠেছিল, এগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল; ফলে চন্দ্রালোকিত কবর থেকে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল ভূত, ডুবতে পারছিল জাহাজগুলো, আর তখন ঢেউয়ের ভেতর ডুবে যাওয়ার আগপর্যন্ত এক ডুবন্ত মা তার সন্তানকে নিজের মাথার ওপর তুলে রাখতে পারছিল।

পাঁচটি আকরিক সম্পন্ন এক মিটারের ফিল্ম-স্ট্রিপগুলো কিনে এনেছিলেন কার্ল মামা; পরে গরম সোডা-পানিতে ডুবিয়ে সেগুলোকে ইমালশন মুক্ত করেছেন। স্ট্রিপগুলো শুকানোর সময়, ইন্ডিয়ান কালি দিয়ে ফিল্মের গায়ে সরাসরি এঁকে দিয়েছেন নানা মুভিং পিকচার। কখনো কখনো নন-ফিগারেটিভ প্যাটার্নও আঁকতেন তিনি– যেগুলো রূপান্তরিত, বিস্ফোরিত, স্ফীত ও কুঞ্চিত হতেও সক্ষম ছিল।

আসবাবপত্রে ভরা একটি রুমে, নিজের ওয়ার্কটেবিলে বসে নিরলসভাবে কাজ করতেন তিনি; নিচে উদ্ভাসিত হওয়া কাচের একটা ম্যাট শিটের উপর রেখে দিতেন ফিল্মটি; কপালে তুলে রাখতেন চশমা, আর নিজের ডান চোখের সামনে সেঁটে নিতেন একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। ছোট্ট একটা বাঁকা পাইপ দিয়ে ধূমপান করতেন তিনি; আর একই ধরনের বেশ কিছু পাইপ সাজানো থাকত টেবিলে, তার চোখের সামনে– সবগুলোই পরিষ্কার ও পরিপূর্ণ। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, ফ্রেমগুলো থেকে কোনো দ্বিধা ছাড়াই ক্ষিপ্রবেগে আবির্ভূত হচ্ছে ছোট ফিগারগুলো। কার্ল মামা যখন কাজ করতেন, পাইপে টান দিতে দিতে, অনর্থক বকবক করতে থাকতেন। তার বকবকানি আর গুঞ্জন আর [পাইপ] ফুঁকা চলতেই থাকত : “এই হলো টেডি, সার্কাসের পুঁচকে কুকুর, এগিয়ে যাচ্ছে ডিগবাজি দিতে। ভালোই দিচ্ছে সে। কাজটা সে ভালোভাবেই জানে। এবার পাষাণ রিংমাস্টার এই বেচারা কুকুরটাকে উল্টো-ডিগবাজি খেতে বলবে। কিন্তু টেডি তো এটা পারে না। রিংয়ের মধ্যেই রিংমাস্টার কুকুরটার মাথায় মেরে বসল। বেচারা এখন একসাথে সূর্যও দেখছে, তারাও দেখছে। আরেক রঙের তারা লাগবে আমাদের। এগুলো লাল। এবার ওর মাথায় একটা দড়াম করে আঘাত পড়ল। এটাও লাল। আমার মনে হয় না তোমার ইস্টার আর বেডা আন্টি এখন বাড়িতে আছে। ডাইনিং রুমে যাও তো; বাফেটের বাম দিকের ছোট্ট ড্রয়ারটা খুলো। দেখবে, সেখানে চকলেট ক্রিমের একটা ব্যাগ ওরা লুকিয়ে রেখেছে। কারণ, মা বলেছেন, আমি মিষ্টি কোনো কিছু খেতে পারব না। যাও, চারটা চকলেট ক্রিম নিয়ে আসো; কিন্তু সাবধান, ওরা যেন পরে ধরতে না পারে।”

আমাকে দেওয়া দায়িত্বটা আমি পালন করতাম; পরিণামে একটা চকলেট ক্রিম জুটত আমার কপালে। বাকিগুলো তিনি নিজের মোটা ঠোঁটের ফাঁকে পুরে দিতেন; তারপর মুখের এক কোণায় নিয়ে, লালা জড়িয়ে খেতেন। আর ফিরে আসতেন নিজের চেয়ারে। বাইরে ততক্ষণে শীতের ধূসর আঁধার নেমে আসত। হুট করেই বলে ওঠতেন, “তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। কিন্তু মাকে কিছুতেই বলতে পারবে না।” তিনি উঠে দাঁড়াতেন। সেন্ট্রাল ল্যাম্পের নিচে থাকা টেবিলটির ওপরে গিয়ে ওঠতেন, আর ল্যাম্পটি জ্বালিয়ে দিতেন। টেবিলক্লথের উজ্জ্বল নকশার ওপর খেলে যেত হলুদ রঙ। তিনি বসে পড়তেন, আর আমাকে বলতেন তার মুখোমুখি বসতে। তারপর এক টুকরো ক্লথ দিয়ে নিজের বাম হাতের কবজি মুড়িয়ে ফেলতেন, খুব সতর্কভাবে শুরু করলেও এরপর দ্রুততার সঙ্গে পেচাতেন, পেচাতেই থাকতেন। শেষ পর্যন্ত তার হাত ও কবজি এক পর্যায়ে শ্রান্ত হয়ে যেত, আর টেবিলক্লথের ওপর একটা মেঘাচ্ছন্ন তরলের কয়েকটি ফোঁটা ছড়িয়ে পড়ত। কিংবা, অন্তত তেমনটাই মনে হতো দেখতে।

“দুইটা স্যুট আছে আমার। প্রত্যেক শুক্রবার আমি তোমার নানীকে বলতে যাই, যেন আমার আন্ডারক্লথ আর স্যুটটি বদলে দেন। উনত্রিশ বছর ধরেই চলে আসছে এটা। আমি যদি শিশু হতাম, তাহলে এটা ছিড়েই ফেলতাম। ঈশ্বর তাকে শাস্তি দেবেন। ক্ষমতাঅলা লোকদের শাস্তি দেন ঈশ্বর।… দেখো দেখো, বাড়িটার উল্টোদিকে আগুন দেখা যাচ্ছে।” লৌহ-ধূসর মেঘামালা ফুটো করে বেড়িয়ে এসেছিল শীতের সূর্যটি; আর গামলা অ্যাগাটানের বিপরীতের বিল্ডিংটির জানালার শার্সিতে সরাসরি পড়ছিল রোদ। নিকষ হলুদ স্কয়ার জুড়ে রিফ্লেকশনটি ওয়ালপেপারের নকশা এঁকে দিয়েছিল, আর কার্ল মামার মুখের অর্ধেকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল আলোয়। টেবিলের ওপর আমাদের মাঝামাঝি পড়ে ছিল ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে যাওয়া হাতটি। কিংবা, দেখতে অনেকটা সে রকমই লাগছিল।

নানী মারা যাওয়ার পর, আমার মা হয়ে ওঠেন কার্ল মামার অভিভাবিকা। স্টকহোমে চলে আসেন মামা, গয়সিনসের একেবারেই কাছাকাছি, রিংভ্যাগেনের বাস করা বুড়ো এক ‘ফ্রি চার্চ’ নারীর কাছ থেকে ছোট্ট দুটি রুম ভাড়া করেছিলেন। রুটিন একই রকম চলতে থাকল। প্রতি শুক্রবার তিনি পারসোনেজে আসতেন, একেবারেই নতুনের মতো পরিপাটি করে রাখা স্যুটের বদলে তাকে পরিচ্ছন্ন আন্ডারক্লথ দেওয়া হতো, এবং আমাদের পরিবারের সঙ্গে তিনি ডিনার সারতেন। তার অবয়বে কোনো বদল ঘটেনি; তার শরীর আগের মতোই ভারী ও গোলগাল, তার চেহারা গোলাপের মতো, পুরো চশমার পেছনে তার শান্ত বেগুনি-চোখ। হন্তদন্ত হয়ে, নিজের উদ্ভাবনগুলো নিয়ে প্যাটেন্ট অফিসে ছুটতেন তিনি; আর রোববারগুলোতে মিশন চার্চে গাইতেন ধর্মগীত। তার টাকা-পয়সার ব্যাপারটা মা-ই দেখতেন, তাকে পকেট খরচ দেওয়া হতো। মাকে ‘সিস্টার কারিন’ নামে ডাকতেন তিনি; এবং পরিহাসের ব্যাপার হলো, মা প্রায়শই নানীর মতো হয়ে ওঠতেন। মামা তখন বলতেন, “তুমি সৎমা হওয়ার চেষ্টা করছো। এমনটা করো না। তোমার স্বভাব-চরিত্র তার চেয়ে অনেক ভালো। যদিও মা-ও খুব একটা খারাপ ছিলেন না।”

প্রিয় রেলওয়ে টানেলে ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ পড়ে থাকে তার
প্রিয় রেলওয়ে টানেলে ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ পড়ে থাকে তার

কোনো এক শুক্রবারে, কার্ল মামার বাড়িঅলি এসে হাজির হলেন; মার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বললেন তিনি। বাড়িঅলি খুব চিৎকার করে কাঁদছিলেন। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার কান্নার শব্দ। দুয়েক ঘণ্টা পর তিনি চলে গেলেন; কাঁদতে কাঁদতে মুখটা ফুলে ফেঁপে লাল হয়ে গিয়েছিল তার। এরপর মা এলেন রান্নাঘরে, লালার কাছে; একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে হাসতে শুরু করলেন। বললেন, “নিজের চেয়ে ত্রিশ বছরের ছোট কোন মেয়ের সঙ্গে নাকি কার্লের বাগদান হয়েছে!”

কয়েক সপ্তাহ পরে, নতুন সম্পর্কে জড়ানো এই যুগলটি আমাদের এখানে ঘুরতে এলেন। তারা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন; সেটি খুব সিম্পল হলেও, হাই চার্চে হওয়া চাই। কার্ল মামার পোশাক বেশ ক্যাজুয়াল ছিল : পরনে স্পোর্টস শার্ট, কোনো টাই নেই, একটা চেক ব্লেজার, আর কোন দাগ নেই– বেশ পরিপাটি এমন ফ্লানেল টাউজার। নিজের পুরনো ধাঁচের চশমা বদলিয়ে, আধুনিক হর্ন-রিমড্ চশমা পরেছেন; আর পায়ে পরেছেন লোফারের বাটন-বুট। খুব একটা কথা বলছিলেন না মামা, যেন কবরের নৈঃশব্দ নেমে এসেছিল তার মনে; তার মুখ থেকে দ্বিধার কিংবা অবান্তর কোনো শব্দই বের হয়নি। সোফিয়া চার্চে ভারজার বা নিম্নপদস্থ কর্মচারীল চাকরি পেয়েছেন তিনি। উদ্ভাবনী কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছেন : “এটা একটা মোহ ছিল, বুঝলে শওয়েস্টারচেন!”

তার বাগদত্তার বয়স মাত্রই ত্রিশ পেরিয়েছে; চিকন ও ছোটখাট, তীর্যক কাঁধ আর লম্বাটে সরু পা। বড় বড় সাদা দাঁত, এক গাঁদা মধু-রঙা চুল, বিশাল খাড়া নাক, ছোটখাট মুখ আর গোলগাল চিবুক। তার চোখ দুটো গাঢ় হলেও ভীষণ উজ্জ্বল। অধিকারের সকল আবেগ নিয়ে নিজের বাগদত্তার পাশে বসেছিলেন এ নারী– মামার হাঁটুর মধ্যে নিজের হাত শক্তভাবে রেখে। তিনি ছিলেন একজন জিম-টিচার।

[মামার] সারাজীবনের অভিভাবকত্ব বদলের সময় হয়ে এসেছিল : “আমার মানসিক অবস্থা নিয়ে আমার সৎমার ধারণাটি ছিল তার নেহায়েতই একটা বিভ্রান্তি। খুব ক্ষমতাধর মানুষ ছিলেন তিনি। যেন কারও ওপর তাকে ছড়ি ঘোরাতে হতোই। শওয়েস্টারচেন কখনোই সৎমার মতো হবে না, তা সে যত চেষ্টাই করুক না কেন। এটা একটা বিভ্রান্তি।” জবাবে কোনো কিছু না বলে, বড় বড় চোখ করে পরিবারটির সবাইকে দেখছিলেন মামার বাগদত্তা।

কয়েক মাস পরে তাদের বাগদান ভেঙে যায়। কার্ল মামা রিংভ্যাগেনে নিজের রুমগুলোতে ফিরে যান; ছেড়ে দেন সোফিয়া চার্চের চাকরি। মাকে তিনি বলেন, তার বাগদত্তা তার উদ্ভাবনের কাজে বাধা দিচ্ছিল। চিৎকার-চ্যাঁচামেচি আর হাতাহাতির মধ্য দিয়ে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। পরিণামে, কার্ল মামার গালে জমা পড়ে থাকে বেশকিছু আঁচড়ের দাগ : “আমিও ভেবেছিলাম, উদ্ভাবনের কাজ থামিয়ে দেবো। এটা একটা মোহ ছিল।”

মা আবারও তার অভিভাবিকা হয়ে ওঠেন। প্রতি শুক্রবার কার্ল মামা আসেন পারসোনেজে; নিজের স্যুট ও আন্ডারক্লথ বদলিয়ে নিয়ে, পরিবারের সঙ্গে ডিনার করেন। তবে নিজের শরীরে প্রস্রাব করে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার বাড়তেই থাকে!

তার আরেকটি, অপেক্ষাকৃত অধিক বিপজ্জনক অভ্যাস ছিল। রয়্যেল লাইব্রেরি কিংবা সিটি লাইব্রেরিতে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন তিনি। সেসব জায়গায় যাওয়ার সময় সাউদার্ন স্টকহোমের নিচ দিয়ে যাওয়া রেলওয়ের টানেল ধরে শর্টকাট পথ বেছে নিতেন। যেহেতু ক্রিলবে ও ইন্সয়োসের মধ্যকার রেলওয়ে নির্মাণকারী একজন ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে তিনি, ফলে ট্রেন ভীষণ ভালোবাসতেন। টানেলের মধ্যে তুমুল গর্জন করে ট্রেনগুলো যখন ছুটে যেত, তিনি তখন পাথুরে দেয়ালে নিজেকে সেঁটে রাখতেন; এই শব্দটি তার খুব প্রিয় ছিল, প্রাগৈতিহাসিক পাথুরে কম্পন আর ধুলো ও ধোঁয়া তাকে উন্মত্ত করত।

বসন্তের কোনো একদিন, তাকে পাওয়া যায় ট্র্যাকের মাঝখানে পড়ে থাকা অবস্থায় : শরীরে অনেকগুলো ক্ষত। তার ট্রাউজারের ভেতরে, ওয়েলক্লথে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়– স্ট্রিটল্যাম্পের লাইট বাল্ব বদলে দেওয়ার সুবিধাঅলা একটি ডিজাইন।

অনুবাদ রুদ্র আরিফ

পরের কিস্তি; আসছে শিগগিরই…

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here