টার্টলস ক্যান ফ্লাই অরিজিনাল শিরোনাম • Kûsî Jî Dikarin Bifirin স্ক্রিপ্টরাইটার ও ফিল্মমেকার • বাহমান গোবাদি প্রডিউসার • বাবাক আমিনি, হামিদ গোবাদি, হামিদ গাভামি, বাহমান গোবাদি অভিনয় • সোরান ইব্রাহিম, আভাজ লতিফ, হিরেশ ফয়সাল, আবদুল রহমান করিম, আজিল জিবারি সিনেমাটোগ্রাফার • শাহরিয়াহ আসাদি মিউজিক • হোসেইন আলিজাদেহ প্রোডাকশন কোম্পানি • মিজ ফিল্ম কোং; বাক ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর • আইএফসি ফিল্মস [যুক্তরাষ্ট্র] রানিংটাইম • ৯৭ মিনিট ভাষা • কুর্দিশ দেশ • ইরান, ফ্রান্স, ইরাক মুক্তি • ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৪ [টরোন্টো]; ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ [যুক্তরাষ্ট্র]; ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ [ফ্রান্স]
মূল । রজার ইবার্ট • অনুবাদ । রুদ্র আরিফ
ইরাক যুদ্ধ নিয়ে যাদের কিছু বলার আছে, তাদের প্রত্যেকেরই টার্টলস ক্যান ফ্লাই ফিল্মটি দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। হোয়াইট হাউস ও মার্কিন কংগ্রেসের সবার পাশাপাশি সংবাদপত্রের লেখক ও টেলিভিশনের পণ্ডিত, রেডিওর আলোচক থেকে শুরু করে প্রিয় পাঠক, বিশেষ করে আপনারও দেখা উচিত; কেননা, আপনারা এ লেখাটি পড়ছেন, কিন্তু তারা হয়তো পড়ছে না। ফিল্মটিকে আপনি যদি জর্জ ডব্লিউ বুশের পলিসির প্রতি একটি মারাত্মক আক্রমণ বলে ধরে নেন, তাহলে ভুল করবেন। বরং আমেরিকা আক্রমণ শুরু করার আগের কাহিনী এটি; আর এর চরিত্রেরা রয়েছে সেই আক্রমণের প্রতীক্ষায় এবং সাদ্দাম হোসেনের পতনের দিকে তাকিয়ে। অথচ আক্রমণের পরেও যুদ্ধের প্রতি এই ফিল্মের অভিমত কোনোভাবেই বদলে যায়নি। এর কাহিনী আসলে শরণার্থীদের প্রকৃত জীবনাবস্থা নিয়ে– কোনো মত দেবার মতো বিলাসিতা যাদেরকে মানায় না; কেননা, তারা বেঁচে আছে এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে তাদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গাই নেই।

তুরস্ক-ইরাক সীমান্তের কোনো এক জায়গার একটি কুর্দি শরণার্থী শিবিরের প্রেক্ষাপটে এ ফিল্ম। সে অর্থে বলা যায়, এর প্রেক্ষাপট ‘কুর্দিস্তান’– যে স্বদেশের অবস্থান কুর্দিদের মনের ভেতর; যদিও এ অঞ্চলের অন্যসব সরকারই কুর্দিদেরকে রাষ্ট্রহীন করে রেখেছে। ফিল্মটির চরিত্রেরা শিশু ও কিশোর। তারা সবাই এতিম। শরণার্থী শিবিরে যদিও বয়স্কেরাও আছে, তবুও এই শিশুদের নিজ জীবনের সব ভার বইতে হয় তাদের নিজেদেরকেই। বিশেষ করে, তা স্যাটেলাইট [সোরান ইব্রাহিম অভিনীত] নামের এক প্রাণবন্ত কিশোরের হুইলার-ডিলারের অধীনে। অন্য শিশুদের জন্য কাজের ব্যবস্থা সে-ই করে দেয়। কিন্তু তাদের কাজ কী? ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ল্যান্ড-মাইন কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলো নিরস্ত্র করে– যেন নিকটবর্তী শহরে গিয়ে আর্মস ডিলারদের কাছে বিক্রি করতে পারে। এই ল্যান্ড-মাইনগুলোর নাম, ‘আমেরিকান’; তবে এ নামকরণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সমালোচনা নয়, বরং মাইনগুলোর গুণমানের একটি প্রতিফলন মাত্র। এই এলাকায় মাইনগুলো ফেলিয়েছিলেন সাদ্দাম হোসেন– কুর্দি ও তুর্কিদের প্রতি তার প্রতিহিংসার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ফিল্মটির শুরুতে আমরা হায়েনকভ [হিরেশ ফয়সাল অভিনীত] নামে একটি চরিত্রের দেখা পাই, যার কোনো হাত নেই; তাকে দেখি ঠোঁট দিয়ে ফায়ারিং পিন খুলে একটি মাইনকে খুব ধীরেসুস্থে নিরস্ত্র করতে।
অ্যাগ্রিন [আভাজ লতিফ অভিনীত] নামের একটি মেয়ের প্রতি স্যাটেলাইটকে বিশেষ নজর দিতে দেখি আমরা; মেয়েটি হায়েনকভের বোন। রিজা নামে তাদের ছোট্ট একটা ভাইও আছে, যে হাত-বিহীন ভাই হায়েনকভের কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে ঘুরে। তাকে আমরা ওদের ভাই-ই ভাবি, যতক্ষণ না জানতে পারি, সে আসলে অ্যাগ্রিনেরই সন্তান : যে কিনা অনেকটা শিশু থাকাকালেই ইরাকি সৈনিকদের ধর্ষণের শিকার হয়ে এই শিশুর জন্ম দিয়েছে। হাত-বিহীন ছেলেটা রিজাকে খুবই পছন্দ করে; কিন্তু তার বোন ওকে দেখতে পারে না, মেরে ফেলতে চায়; কেননা, ওকে দেখলে তার সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

প্রিয় পাঠক, এ জগতটা কি আপনার মনে কোনো আকার নিতে শুরু করেছে? এই শরণার্থীদের বসবাস– তাঁবু ও কুঁড়েঘরে। যখন যা কাজ পায়, তা-ই করে টাকা কামায় তারা। ক্যাম্পে স্যাটেলাইটই হলো সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। সে-ই এটা-সেটা ঘোষণা করে, মিটিং ডাকে, কাজ দেয়, এবং বাইসাইকেলের দুই প্রান্তে ফিতা ও ঝকমকে পদক ঝুলিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘুরে বেড়ায়। সারাক্ষণ বকবক, চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে সে। তার গলা উঁচু থেকে উচ্চস্বরে ওঠে। এভাবেই নিজ জীবনের দুর্দশার উপর প্রতিফলন ফেলতে নিজেকে এতটা ব্যস্ত রাখে সে।
আমেরিকার আসন্ন আক্রমণের খবর নিতে পুরো গ্রামটি এক সময় উদগ্রীব হয়ে ওঠে। টিভি অ্যান্টেনা ঠিক করার জন্য প্রত্যেকটি বাড়িরই কেউ না কেউ পাহাড়ের উপর এসে হাজির হয়, আর ‘বায়ে ঘুরাও! আরেকটু ডানে!’ –এইসব নির্দেশনা দেয়; অথচ কোনো সিগন্যালই পাওয়া যায় না– এই দৃশ্যটিতে হিউম্যান কমেডি ফুটে আছে। এ পর্যায়ে স্যাটেলাইট ঘোষণা দেয়, সে নিজে শহরে যাবে এবং বিনিময়-প্রথায় একটি স্যাটেলাইট ডিশ নিয়ে আসবে। আর তা নিয়ে সে যখন ফেরে, তখন একটি সংবেদনশীলতার সৃষ্টি হয়। সে যখন সিগন্যাল ঠিক করে, তখন মুরুব্বিরা এসে জড়ো হয়। যৌনাবেদনময় মিউজিক ভিডিও চ্যানেলগুলো নিষিদ্ধ হলেও সেগুলো দেখার জন্য মুরুব্বিদের মধ্যে উসখুশ শুরু হয়ে যায়– যতক্ষণ না সিএনএন চ্যানেলটি ধরতে পারে স্যাটেলাইট। এরপর তারা নিজেদের সাধ্যমতো ইংরেজি শব্দগুলোর অর্থোদ্ধারে মত্ত হয়। তারা সাদ্দামকে ঘৃণা করে, আর আমেরিকানদের জন্য অধীরভাবে করে অপেক্ষা।

কিন্তু আমেরিকানরা তাদের জন্য কী করবে? কুর্দি জনগণের দুরাবস্থা এমনই যে, কেউ তাদের জন্য কিছু করতে চায় বলে মনে হয় না। যদিও ইরাকের হাই-অফিসে সম্প্রতি একজন কুর্দি নির্বাচিত হয়েছেন, তবু তিনি যে একজন আপসকামী প্রার্থী ছিলেন, তাকে যে যাচাই বাছাই করেই নেওয়া হয়েছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি; কেননা, তার লোকজন সব ক্ষমতাহীন। কুর্দিরা বছরের পর বছর এ অঞ্চলের তুরস্ক, ইরাক ও অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে– নিজেদের স্বদেশের সীমারেখা নির্ধারণ করার জন্য– যা অন্যরা মেনে নিতে রাজি হচ্ছে না। সময়ে সময়ে কুর্দিদের লক্ষ্য অন্যদের লক্ষ্যের চাপে পড়ে বদলে যায়। তারা যখন সাদ্দামের বিরুদ্ধে লড়ছিল, বুশ সিনিয়রের প্রশাসন তখন তাদেরকে সাহায্য করেছে। কিন্তু তারা যখন আমেরিকার মিত্র তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, আমেরিকা তখন তাদের বিরোধিতা করেছে।
সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন-এ ইব্রাহিম পার্লাককে নিয়ে কাভার স্টোরি করা হয়েছে। এই লোকটি মিশিগানের হারবার্টে দশ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে একটি কুর্দি রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে ফেডারেল সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং কুর্দি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ততার দায়ে নির্বাসনে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। এ ক্ষেত্রে আমি ইব্রাহিমের পক্ষে দাঁড়ানোয় ডানপন্থি পত্রিকায় ‘রজার ইবার্ট সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিচ্ছেন’ ধরনের শিরোনামের খবর হতে হয়েছে আমাকে। সেই কলামের লেখিকা ডেবি ক্লুসের টার্টলস্ ক্যান ফ্লাই ফিল্মটি দেখবেন– এ আশা করছি। তার কিংবা আমার– দুজনের একজনেরও রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে এই ফিল্ম সহমত পোষণ করে না। এটি স্রেফ আমরা যেটিকে নিরপেক্ষতা বলি– সেটির অবয়বে আরেকটি পালক যোগ করেছে। ফিল্মটির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন ও নির্মাণ করেছেন বাহমান গোবাদি। তার অ্যা টাইম ফর ড্রাংকেন হর্সেসও [২০০২] একই সীমারেখায় কুর্দিদের জীবনসংগ্রামের পটভূমিতে নির্মিত।

টার্টলস ক্যান ফ্লাই-এ স্যাটেলাইটের মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই। না আছে হাত-বিহীন ছেলেটার মধ্যে, না আছে তার বোনের মধ্যে, এমনকি নেই ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুটির মধ্যেও। তারা স্রেফ ইতিহাসের বাইরের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে।
সম্প্রতি কলার্যাডো ইউনিভার্সিটির একটি প্যানেলে আমি হাজির হয়েছিলাম। সেখানে একজন অডিয়েন্স মেম্বার সিনেমার সমালোচনা করছিলেন, ছোট ছোট কাহিনীগুলোতে নৃশংসতার বিশালত্বকে কমিয়ে আনার দায়ে। কিন্তু আমি মনে করি নৃশংসতার শিকার হওয়া মানুষদের সবগুলো ধাপকে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের জীবনে ভালো ও মন্দ বয়ে আনা সব মানুষকে যথেষ্ট বড় করে দেখানোর মানে নেই। আমাদের মাথা এত বেশি কাহিনীর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। আমরা যা বুঝতে পারি, তা হলো– যে ল্যান্ডমাইনে নিজের দুটি হাতই হারিয়েছে হাত-বিহীন ছেলেটা, বাঁচার জন্য তাকে সেই মাইন-ই নিরস্ত্র করতে হয়। আর যে স্যাটেলাইট শহরে গিয়ে একজন লোককে বলেছিল, একটা স্যাটেলাইট ডিশের বিনিময়ে সে ১৫টি রেডিও আর কিছু টাকা দেবে, এই ১৫টা রেডিও কোথায় পেয়েছে সে? কেন পেয়েছে? আপনারও লাগবে নাকি কয়েকটা রেডিও?
সূত্র : রজার ইবার্টের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট । ১৪ এপ্রিল ২০০৫