কোমল গান্ধার প্রসঙ্গে: ঋত্বিক ঘটক

1824

লিখেছেন ঋত্বিক ঘটক


 

কোমল গান্ধার নির্মাণকালে কোনো সুনির্দিষ্ট তত্ত্বকে অনুসরণ করা হয়নি। সমস্ত অবরোহী তত্ত্বগুলি প্রকৃতপক্ষে বাস্তবের সুসংবদ্ধ মূল্যায়নের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সে কারণেই সব তত্ত্বই বাস্তবের তুলনায় কম নির্ভরযোগ্য। কোনো পূর্বনির্ধারিত তত্ত্বের আক্ষরিক অনুসরণ সৃষ্টিশীলতার পক্ষে বিশেষ অনুকূল নয়। তাছাড়া বিশিষ্ট শৈল্পিক সমস্যার সম্মুখীন হলে সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভঙ্গি বেছে নেওয়া আদৌ অযৌক্তিক নয়। আর সমস্ত শিল্পরীতিই কার্যকরী, যদি তার সঙ্গে জীবনের যোগ হয় নিবিড়

একটি বিশেষ বক্তব্যের উপস্থাপন এই ছবির অন্বিষ্ট; সে বক্তব্যের অবলম্বন, অনেক উপাদানের একত্র সমাবেশ। বক্তব্যের খাতিরে ঘটনাপরম্পরায় সুসজ্জিত কৌতুহলোদ্দীপক কাহিনীবিন্যাসের প্রয়োজন আদৌ অনুভূত হয়নি। কেবল একটি সুপরিচিত ত্রিকোণ কাঠামো অবলম্বিত হয়েছে– রূপকের সাহায্যে বিষয়বস্তুর গভীরে অভিনিবেশের উদ্দেশ্যে।

‘বক্তব্য’ কথাটি সাহিত্যগন্ধী। ‘রূপক’ও তাই। আধুনিক কাব্যে এমন কি নাট্যশিল্পের একটি বিশিষ্ট ধারাতেও তাদের প্রয়োগ তার উদাহরণস্বরূপ। চলচ্চিত্রশিল্প তথাকথিত ‘সাহিত্যিক’ উপায় অবলম্বনে নিঃসংকোচ, সে উপায় তির্যক কিংবা সরল যাই হোক।

সমসাময়িক বঙ্গদেশ দেশবিভাগের দায়ভাগে ক্ষতবিক্ষত, অনিশ্চিত স্বাধীনতায় দ্বন্দ্বসংকুল, রাষ্ট্রীয় ঐক্যের আদর্শ বিনা বিবেচনায় চাপিয়ে দেবার ফলে অবদমিতচিত্ত [স্বভাবতই ঐক্যাদর্শ বাস্তব জগতের অনেক স্বাভাবিক প্রবৃত্তির পরিপন্থী]; আর সেই অবদমনের ফলস্বরূপ পশ্চিমী সভ্যতার রসে পরিপুষ্টচিত্ত জাতীয় নেতাদের চিন্তারাজ্যের দেউলেপনা– ইত্যাকার দেশজ ও আন্তর্জাতিক কারণের ফলশ্রুতিতে দেশের চরম দুর্গতি। এ ছবির লক্ষ্য সেই অধোগমনের, সেই মূলহীনতা ও আশ্রয়হীনতার চিত্রায়ণ। এই বক্তব্যে নির্ভর করে ছবিটি ভাবাবেগের একটি স্তরে উন্নীত। তাতে একটি বিশেষ মনোভঙ্গি প্রতিফলিত।

বিভিন্ন স্তরে জীবনের এই অনিকেত রূপটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

কোমল গান্ধার
কোমল গান্ধার

পতিগৃহে যাত্রাকালে শকুন্তলাকে তার বহু পরিচিত জগৎ ঐ আজন্ম বাসভূমি আশ্রম থেকে নিজেকে ছিন্ন করে নিতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের শকুন্তলার প্রতিমূর্তি এ ছবির নায়িকা আর এ কালের যুবচিত্তে যে বিক্ষোভের প্রদাহ, তারই প্রকাশ নায়কের চরিত্রে। সে সম্পূর্ণ সুস্থও নয়, সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থও নয়, অবদমিত, কিছুটা বিকারগ্রস্ত।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, দীনমলিন নাট্য আন্দোলন ও দলাদলির প্রায় বাস্তবানুগ চিত্রায়ণ ও তৎসমান্তরালে কৌতুকাবহ প্রেমাখ্যান, এ সমস্তই পরিকল্পিত ও সন্নিবেশিত হয়েছে মূল পরিকল্পনা অনুসারে– রূপকগুলিকে সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। একটি বাস্তবধৃত বহুবিষয়সমন্বিত জটিল নকশা [প্যাটার্ন] প্রস্তুত করাই ছিল অভিপ্রেত।

শব্দযোজনার, বিশেষ করে শত শত বছরের পুরনো লোকগাথা ও আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত প্রয়োগের উদ্দেশ্য হলো বাস্তবে নিহিত কোনো সুপ্ত প্রেরণার প্রতি অবিরাম দিগদর্শন। তাছাড়া সে সব গান এ দেশের অতীত ও বর্তমান জীবনের মাঝে সেতুস্বরূপ। উপরন্তু এরা ছবিটির ত্রয়ীরূপকের ভাষণও বটে।

প্রথার [কনভেনশন] জন্মের কারণ সম্ভবত সামাজিক অবদমন। সমষ্টিগত অবচেতনের আদিম তাগিদ ও আর্কিটাইপাল অনুভূতির সঙ্গে তার যোগ নিবিড়। পুরাণের অলৌকিকতা ও প্রতীক প্রথাকে খাদ্য জোগায়। সময় বিশেষে তারা অমার্জিত হতে পারে, কিন্তু প্রতিপাদ্য বক্তব্যকে ধারালো করে তুলবার কাজে তাদের দান অপরিমেয়। তাছাড়া প্রথা নিকট ভবিতব্য সম্পর্কে আমাদের মনকে সুস্থির রাখে– কৌতুহলোদ্দীপক ঘটনার লোভে মনকে অস্থির করে না। শিল্পভাষার অতিব্যবহৃত কৌশলের স্থান এতে নেই।

এ ছবি উপভোগ করতে হলে মনে হয় সর্বাগ্রে মস্তিষ্কের উত্তেজনা পরিত্যাজ্য এবং কোনো পূর্বনির্দিষ্ট আশা পোষণ না করে মুক্তচিত্ত থাকলে দর্শক এ ছবি দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেন। তাই এ ছবির দর্শকদের কাছ থেকে একটি এপিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রার্থনীয়– যে দৃষ্টিভঙ্গি এ দেশে এখনও একটি প্রাণবন্ত ঐতিহ্যরূপে বিরাজমান।

কোমল গান্ধার
কোমল গান্ধার

[এই নিবন্ধে নিরুপায়ভাবেই কিছু বিদেশি শব্দ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ ওদের প্রত্যেকেরই বিশেষ বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা এবং অর্থবহতা আছে। তাদের বাংলা পারিভাষিক আনুবাদিক প্রতিশব্দ থাকতে পারে। কিন্তু আমার সেগুলি জানা নেই। বিদেশি শব্দ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে রাখছি। –লেখক]

চলচ্চিত্রে আর্কিটাইপ বা মৌল প্রতীকের প্রয়োগ কেন এবং কীভাবে– এই সম্পর্কে অনেকে অনেক সময় আমাকে প্রশ্ন করে থাকেন।

এই সম্বন্ধে বিস্তৃত অথবা সম্পূর্ণ আলোচনা করা আমার সাধ্যায়ত্ত নয়। কিন্তু সেইসঙ্গে কিছু আলোচনার সূত্রপাত করাটা আমি উত্তরোত্তর জরুরি মনে করছি। এই আলোচনা হবে নিতান্তই আমার চিন্তা, অভিজ্ঞতা এবং কর্মভিত্তিক। কারণ, এই যে বহু ব্যাপক বিষয়, এই নিয়ে দিনের পর দিন নতুনতর গবেষণা এগিয়ে চলেছে। আধুনিকতম চিন্তাধারার সঙ্গে আমার পক্ষে সব সময় যোগাযোগ রাখা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আমি চেষ্টা করব আমার নিজের কাজের মধ্যে যেটুকু ব্যবহারের প্রয়াস পেয়েছি তারই একটা খতিয়ান দিতে।

কমপেয়ারেটিভ মিথোলজি বা ‘তুলনামূলক পুরাণতত্তক’ বলে বিজ্ঞানটি ক্রমশই একটি বিচিত্র ঘটনাকে উদ্ভাসিত করে তুলছে। বিশেষ করে সি. জি. ইয়ুং সাহেব  [কার্ল ইয়ুং : সুইস মনোবিজ্ঞানী –ফিল্মফ্রি] যখন কতকগুলো সূত্র তুলে ধরলেন, এক নতুন আলোকপাত হলো মানুষের এবং প্রাণের ইতিহাস ও প্রাক-ইতিহাসের ওপর কালেকটিভ আনকনসাস বা যৌথ অবচেনতা ব্যাপারটি প্রকাশ করল এই কথা যে, আমরা আমাদের মাথার মধ্যে বহন করে চলেছি বিচিত্র সব চিত্র যাদের জড় শুধু মানুষ হবার পর থেকেই নয়, তারও আগেকার কালে বিধৃত। এই কথা জানা গেল যে, বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে কতকগুলো মূলতম আর্কিটাইপ পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। বিভিন্ন মানব সভ্যতার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা দেখি সেই একই কমপ্লেক্স, জীবনচিত্র, কীভাবে আর্কিটিপিক্যাল ইমেজ বা মৌলপ্রতিমার মধ্যে দিয়ে সিম্বলিক অর্থাৎ প্রতীকে পরিণত হতে থাকে।

মানুষের গভীরতম এবং সবচেয়ে মৌলিক যা কিছু অনুভূতি তাদের সকলেরই উৎস সেইখানে। সিম্বলের প্রকাশের পার্থক্যের মধ্যে দিয়েও বৈজ্ঞানিক ধরে ফেলতে পারেন সেই সূত্র যা এই সমস্ত পার্থক্যকে পর্যবসিত করে এক একীকরণে। প্রাচীন এবং মৃত সুমেরীয় সভ্যতার যে গিলগামেশ এপিক আর ১৯৩০ সালের পরেকার জার্মান যৌবশক্তির সামনে যে হিটলার ইমেজ– দুটোই কিন্তু সেই একই পাওয়ার কমপ্লেক্সের প্রজেকশন, শক্তিপূজার প্রকাশ– যদিও বিভিন্ন স্তরের এবং বিভিন্ন ভঙ্গির।

পোস্টার । কোমল গান্ধার
পোস্টার । কোমল গান্ধার

গ্রেট মাদার ইমেজ [অবশ্য এই শব্দটির জন্যে আমরা কবি ইয়েটসের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি এটিকে ব্যবহার করেছিলেন সর্বপ্রথম, সেই ১৮৯০ সালের কাছাকাছি], ‘মহীয়সী মাতা’ প্রতিমার যে ব্যাপকতা তা আমরা এখন জানতে পারি এরিখ ন্যুমানের [জার্মান মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক; কার্ল ইয়ুংয়ের ছাত্র –ফিল্মফ্রি] মহামূল্যবান বইটি পড়ে। অথচ এই ‘মহিয়সী মাতা’, তার যে দুই রূপ, বরাভয় এবং ভয়ংকরী [দ্য বেনেভালেন্ট অ্যান্ড দ্য টেরিবল অ্যাসপেক্টস]– এদের সঙ্গে আমাদের সভ্যতার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা সেই আদিকাল থেকে। এবং আমাদের পুরাণ, আমাদের মহাকাব্য, আমাদের শাস্ত্র ও আমাদের লোককথা, তার প্রতি স্তরে স্তরে এই মৌল প্রতীকটি আমাদের জড়িয়ে রেখেছে।

এই যে যৌথ অবচেতনার সর্বব্যাপী শাসন, আমাদের আচারে ব্যবহারে চিন্তায় বাক্যে, ধর্মে কর্মে এবং ভালোলাগা এবং না ভালো লাগায়– অবাধে রাজ্য চালিয়ে চলেছে, এই কথাটি আজকে নব মনস্তাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেল। মানুষের শেষ পুঁজি যা, তাই হচ্ছে গোটা মানুষের অস্তিত্বের নির্যাস। এবং সে পুঁজি সব সভ্যতার সব জাতির পক্ষে একই।

এখন কথা আসে, চলচ্চিত্রে এই কথাগুলো গভীরভাবে ভাবার কী প্রয়োজন ছিল।

এটা চলচ্চিত্রের কথা নয়, কথা সর্বশিল্পের। আজ পর্যন্ত যত মহৎ শিল্প রচনা হয়েছে তারা সবাই অনির্বচনীয়কে, অবাঙমানসগোচরকে উপলব্ধি করেছে, অর্জন করেছে যখনই এই সমীকরণে পৌঁছতে পেরেছে। এর ভূরিভূরি প্রমাণের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট নাই-বা হলাম। জানতে হোক, অজান্তে হোক– মানুষের সমস্ত শিল্পসৃষ্টির যে উপাসনা, তার শেষ এইখানে।

চলচ্চিত্রের এই সমস্যার মোকাবিলা করা এবং আত্মীকরণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। এবং আজ পর্যন্ত যা কিছু কালের ঘরে জমার মতো মাল ছবি থেকে বেরিয়েছে, এই পথ দিয়েই তারা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ভূরিভূরি প্রমাণ– কিন্তু বোধহয় এখানে তা স্বতঃপ্রকাশ এবং তার উল্লেখ বাহুল্যমাত্র হবে।

কোমল গান্ধার
কোমল গান্ধার

আমার ছবিতে আমি বুঁদ হয়ে এ ধরনের ঐতিহ্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু এ বড়ো কঠিন ঠাঁই। আত্মসচেতনভাবে কোনো ইমেজকে, প্রতিমাকে, তার যুক্তিযুক্ত শেষ পরিণতি পর্যন্ত নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে মৌলপ্রতীক হয় না– বড়জোর একটা অ্যালেগরি বা রূপকে পর্যবসিত হয়, তাই সেখানেই শিল্পী তাঁর প্রয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন সেখানেই তিনি ব্যর্থ। যেখানে অনুষঙ্গের ধারায় কতকগুলি প্রতিমা অনিবার্যভাবে ভেসে আসতে থাকে এবং প্রতীকে পরিণত হতে হতে কখন ইনকনসিকুয়েন্সিয়াল হয়ে অনুচ্চার প্রচ্ছন্নতায় চারিয়ে যায়– সেখানেই আর্কিটিপিক্যাল ফোর্স, মৌল প্রতীকের প্রবল শক্তি জন্মগ্রহণ করে। সব জিনিস যেখানে কার্যকারণের বাঁধা ছকে ফেলা সেখানে প্রিমর্ডিয়াল ইমেজ, আদিম প্রতিমা খেলা করতে পারে না। এইখানে স্বপ্নের সঙ্গে ব্যাপারটির বেজায় মিল। আর স্বপ্ন ব্যাপারটি নিজেই আর্কিটিপিক্যাল ইমেজের একেবারে খাস লীলাভূমি।

ওপরের কথা কয়টি মনে রেখে আমি ভাববার চেষ্টা করব কীভাবে আমার নিজের ছবিগুলোর মধ্যে এই সমস্ত চিন্তা আমাকে নিয়ে গেছে। এখন ঘটনাগুলো অতীত, হয়তো তাই খানিকটা স্পষ্টভাবে ব্যাপারটাকে কাটা-ছেঁড়া করতে পারি। জানি না কতদূর সত্যে উপনীত হতে পারব।

ধরা যাক অযান্ত্রিক। আমাকে অনেক গাল খেতে হয়েছে আদিবাসী ওরাওঁদের নাচের দৃশ্য অসংযতভাবে বড়ো হয়ে গিয়েছিল বলে। কিন্তু জানেন, আমার কাছে কখনো লাগেনি।

আমার যে প্রোটাগনিস্ট, বিমল, তাকে পাগল বলতে পারেন, শিশু বলতে পারেন, আদিবাসী বলতে পারেন। কারণ এক জায়গাতে এই তিনই এক। সেটা হচ্ছে জড়বস্তুতে প্রাণ আবেগ করার প্রবণতা। এবং এটি একটি আর্কিটিপিক্যাল রিঅ্যাকশন, আদিম প্রতিক্রিয়া। শিশুর যে কোনো অসাড় বস্তু দেখে জুজু কল্পনা করা, পাগলের মেঘ দেখে খেপে ওঠা এবং অনাহত আদিবাসীর প্রথম রেলগাড়ি দেখে তাকে দেবতা কল্পনা করা– একেবারে একই প্রক্রিয়া।

অযান্ত্রিক
অযান্ত্রিক

যে নৃত্যগীতাদির অনুষ্ঠান আমি অযান্ত্রিক-এ দেখিয়েছি তাতে– ‘কোহা বেঞ্জা’, ‘খাতুরা’, ‘চালি বেচনা’, ‘ঝুমের, ‘লুঝরি’ ইত্যাদি বহু সাংকেতিক নৃত্যের সমাবেশে মহাযাত্রা দৃশ্য সন্নিবিষ্ট জন্ম, শিকারে যাওয়া, বিবাহ, মৃত্যু, পূর্বপুরুষের প্রতি পূজা এবং নবজন্ম– এই সমস্ত সাইকেলটা।

অযান্ত্রিক-এর মেইন থিম, মৌল উপজীব্য ছিল এইটাই : যাকে আমরা দ্য ল অব লাইফ, জীবনের নিয়ম বলতে পারি। পাগলের নতুন গামলা পেয়ে পুরোনোটিকে ভুলে যাওয়ার সেই নিষ্ঠুর দৃশ্য এবং সর্বশেষে এক শিশুর হাতে জগদ্দলের ক্রেংকার ধ্বনি, যাতে বিমলকে উপলব্ধির হাসিতে ভুলিয়ে দিয়েছিল– এগুলোতে সেই কথাই প্রকাশ করছে। এ যেন ভেরিয়েশন অন অ্যা মাইনর স্কেল অব দ্য মেইন থিম, অ্যা সর্ট অব ইকো, যা যে কোনো সিম্ফনিক স্ট্রাকচারের প্রাণবস্তু।

আমার ভুল হয়েছিল, সর্বজনগ্রাহ্য বস্তুর মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটিকে টেনে আনতে পারিনি। কিন্তু উপায়ও ছিল না– বিষয়বস্তু এবং পটভূমিকার জন্যে। কাজেই ইসোটেরিক হয়ে থাকতে হলো, সাধারণগ্রাহ্য হওয়া গেল না।

বাড়ি থেকে পালিয়েতে তাই আমি এ সবের ধার-কাছ দিয়েও যাইনি।

তারপরে আসে মেঘে ঢাকা তারা, এখানে আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক। কারণ একটা ইউনিভার্সেল থিম নিয়ে আমি কাজ করছি এবং নিজেকে পরিব্যাপ্ত করে ফেলার চেষ্টা করছি আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে।

গত সাত-আটশো বছরের বাংলাদেশে একটা বড়ো মজার ব্যাপার গড়ে উঠেছিল যা একেবারেই বাঙালি। স্মার্ত প্রভাবপুষ্ট বাঙালি সমাজ গৌরীদানেতে পাগল হয়ে উঠেছিল। সেই অষ্টম বর্ষীয়া শিশু খেলার আঙিনা ছেড়ে অজানা গাঁয়ের অজানা বাড়িতে গিয়ে চারিপাশের ভ্রূকুটি-কুটিল মুখগুলো দেখে বাড়তি ভয় পেত, বড়োই তার নিজের বাড়ির জন্যে মন-কেমন করত।

এই ব্যথা আমাদের লোককথায় শাশ্বতকালের জন্যে বিধৃত হয়ে আছে। এই কান্না ঝরছে আমাদের আগমনী বিজয়াতে। তাই দুর্গা আমাদের মেয়ে, তাই আমাদের শরৎকাল বড়ো মন-কেমন-করা

গ্রেট মাদার আর্কিটাইপের এই বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ।

মেঘে ঢাকা তারা
মেঘে ঢাকা তারা

এই ছিল মেঘে ঢাকা তারার মূলতম প্রয়োজন। আরও বহু কথা হয়তো এসে গেছে; হয়তো আধুনিক জীবনের বহু পাপের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ আছে। কিন্তু ছবিটির সমৃদ্ধি ঐখানে।

তাই আমার নীতার জন্মদিন হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। তাই যক্ষ্মার আবিষ্কারের সময় মেনকার বিজয়ার বিলাপোক্তি শোনা যায় ‘আয় গো উমা কোলে লই’। নীতা মহাকাল পাহাড়কে জীবনভোর দেখতে চায়, দেখে তখনই যখন মহামিলন ঘনিয়ে আসে, মহাকালরূপী সংহারদেব তাকে আলিঙ্গন দেন সেই পরম অবলুপ্তিতে।

এ নিয়ে আমার থেকে ভালোভাবে বলবার লোক আছেন। আমি খালি অস্পষ্ট ইঙ্গিতটুকু দিলাম।

কোমল গান্ধার। এখানে আমার সমস্যা কাহিনীর তিন স্তরে বিচরণ। আমি অনসূয়ার দ্বিধা-বিভক্ত মন, বাংলার গণনাট্য আন্দোলনের দ্বিধাগ্রস্ত নেতৃত্ব এবং দ্বিধা-বিভক্ত বাংলাদেশের মর্মবেদনা, তিনটিকেই একত্রে টানতে চেয়েছিলাম। শব্দের দিক থেকে বহুশত শতাব্দীর সুর কথাকে মিলিয়ে ছবির ওপরে নতুন দ্যোতনা অভিনিবিষ্ট করতে চেষ্টা করেছিলাম।

আর্কিটিপিক্যালি, এদের বিরোধী হচ্ছে বিবাহ, মিলন।

আমের তলায় ঝামুর-ঝুমুর কলাতলায় বিয়া।
আইলেন গো সোন্দরীর জামাই মটুক মাথায় দিয়া।
মিস্ত্রী বানাইছে পীড়ি চাইর কোনা তুলিয়া।
ব্রাহ্মণে চিত্রাইছে পীড়ি মধ্যে সোনা দিয়া।
আইজ হইবো সীতার বিয়া।

–এই গানগুলির ব্যবহারের পিছনে একটি চিন্তার্থ ছিল তা হচ্ছে মিলনের ভাবখানি, যা অবশ্যাম্ভাবী। ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার মনে মনে’ –রবি ঠাকুর বলে গেছেন। বিষ্ণু দে তাকে নিয়ে এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশেতে। আমি সেইখান থেকে শুরু করেছিলাম।

কোমল গান্ধার
কোমল গান্ধার

এই ছবিতে আমি বত্তিচেলি থেকে দেগাস পর্যন্ত আমার সেই মুখটাকে খুঁজে ফিরেছি। সেই ‘ফ্লাশড্ অ্যাট সেম টাইম ওয়ার্ম’ মুখটি।

আর্কিটিপিক্যাল ইমেজ অনেক সময় শুধু একটি ছবির একক অস্তিত্বেই ব্যাপারটিকে জানান দিয়ে দিতে পারে।

এরপর যে ছবিটি আমি করেছি সেটি এখনও জনসাধারণ্যে প্রচারিত হয়নি। পরে দেখবেন, একটি শিশু মেয়ের, তার দ্যোতনাময় নাম হচ্ছে সীতা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক প্রলয় ক্ষেত্রের মধ্যে পরমানন্দে হাততালি দিয়ে গেয়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল, কালীমূর্তি– দ্য টেরিবল মাদার। মেয়েটি গেল ভয় খেয়ে। এবং পরে প্রকাশ পেল ওটি ছিল একটি বহুরূপী। যে ওকে মোটেই ভয় দেখাতে চায় না। শুধু ছোট্ট দিদিমণিটি সামনে পড়ে গিয়েছিল। আমার কেমন যেন মনে হয়, আমরাও সামনে পড়ে গিয়েছি। সুদূর অতীত থেকে যে আর্কিটিপিক্যাল ইমেজ আমাদের হান্ট করছে সে আজকে দৃঢ় পায়ে সারা জগতে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে, তার নাম হাইড্রোজেন বোম, তার নাম স্ট্রেটেজিক এয়ার কমান্ড, তার নাম হয়তো বা দু গ্যুলে [ফরাসি রাষ্ট্রপতি (শাসনকাল : ১৯৫৯-১৯৬৯) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্বাসিত-ফরাসি সরকারের প্রধান –ফিল্মফ্রি], হয়তো বা অ্যাডেন্যুর [বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রথম জার্মান চ্যান্সেলর (শাসনকাল : ১৯৪৯-১৯৬৩) –ফিল্মফ্রি], হয়তো বা উল্লেখ করা চলে না এমন কোনো নাম। পরম বিধ্বংসী এই যে সংহার শক্তি, আমরা ঐ ছোট্ট সীতার মতন হয়তো তার সামনেই পড়ে গেছি। ছবিটা তোলার সময় আমার মাথায় বোধহয় এ সব কিছুই আসেনি। তখন হয়তো খালি মনে হয়েছিল যে, এক মহাপ্রলয় পর্বের মূক সাক্ষীর ওপর দাঁড়িয়ে এত আনন্দ ভালো না। এত সরলতা ভালো না। ধাক্কা দরকার।

এখন হয়তো নানা মানে আরোপ করছি।

কিন্তু আর্কিটিপিক্যাল প্রোপান্ডিং ভীষণভাবেই দরকার মনে করি বলেই এই ইমেজগুলো আসে। হয়তো তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা অথবা তার শিল্পগত উৎকর্ষে উন্নীত হওয়া সব সময় হয়ে ওঠে না। তবু চেষ্টা করি।


গ্রন্থসূত্র : চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু/ ঋত্বিক ঘটক। প্রথম প্রকাশ : আষাঢ় ১৩৮২
Print Friendly, PDF & Email
ঋত্বিক ঘটক । ভারতীয় মাস্টার ফিল্মমেকার । জন্ম : ৪ নভেম্বর ১৯২৫; ঢাকা, বাংলাদেশ । মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬; পশ্চিমবঙ্গ, ভারত । ফিচার ফিল্ম : নাগরিক [১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭]; অযান্ত্রিক [১৯৫৮]; বাড়ি থেকে পালিয়ে [১৯৫৮]; মেঘে ঢাকা তারা [১৯৬০]; কোমল গান্ধার [১৯৬১]; সুবর্ণরেখা [১৯৬২]; তিতাস একটি নদীর নাম [১৯৭৩]; যুক্তি তক্কো আর গপ্পো [১৯৭৭] । শর্টফিল্ম ও ডকুফিল্ম : দ্য লাইফ অব দ্য আদিবাসিজ [১৯৯৫]; প্লেসেস অব হিস্টোরিক ইন্টারেস্ট ইন বিহার [১৯৫৫]; সিজার্স [১৯৬২]; ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান [১৯৬৩]; ফিয়ার [১৯৬৫]; রঁদেভু [১৯৬৫]; সিভিল ডিফেন্স [১৯৬৫]; সায়েন্টিস্টস অব টুমরো [১৯৬৭]; ইয়ে কওন [হোয়াই/ দ্য কোয়েশ্চন; ১৯৭০]; আমার লেলিন [১৯৭০]; পুরুলিয়ার ছৌ [দ্য ছৌ ড্যান্স অব পুরুলিয়া; ১৯৭০]; দুর্বার গতি পদ্মা [দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা; ১৯৭১] । অসমাপ্ত ফিল্ম : বেদেনি [১৯৫১]; কত অজানারে [১৯৫৯]; বগলার বঙ্গদর্শন [১৯৬৪-৬৫]; রঙের গোলাপ [১৯৬৮]; রামকিঙ্কর [১৯৭৫]

3 মন্তব্যগুলো

  1. ”রঙের গোলাপ” নয় ওটা ”রঙের গোলাম” হবে।

Leave a Reply to ঋত্বিকের ভার্চুয়াল উপস্থিতি : নামজপ বনাম ঋত্বিক বাহাস/ বেলায়াত হোসেন মামুন | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here