বার্গম্যান অথবা বারিমনের আত্মজীবনী [কিস্তি-৫]

366

ইংমার বারিমন। ইংরেজি উচ্চারণ ইঙ্গমার বার্গম্যান নামে অধিক পরিচিত সুইডিস মাস্টার ফিল্মমেকার। দ্য ম্যাজিক লেন্টার্ন শিরোনামে প্রকাশিত তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি সিনেবিশ্বের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটবুকও বটে। সেই গ্রন্থের এই ধারাবাহিক অনুবাদ…

আগের কিস্তি প্রথম জ্বর, প্রথম শিহরণ

আতঙ্ক ও বিস্ময়ের পারদ

সোফিয়াহেমেটের পারসোনেজের কৃপা ও আনুকূল্যে আমার শৈশবের দিনগুলো ছিল প্রত্যহিক ছন্দ, জন্মদিনোৎসব, গির্জার নানা উৎসব আর রোববারের আনুষ্ঠানিকতায় ভরা। ছিল দায়িত্ব, খেলাধুলা, স্বাধীনতা, নিয়মানুবর্তিতা আর নিশ্চয়তার চক্র। ছিল শীতকালে কুয়াশাচ্ছন্ন দীর্ঘ পথ ধরে স্কুলে যাওয়া, বসন্তকালে মার্বেল খেলা ও বাইসাইকেলে চড়া, আর শরৎকালের রোববারের সন্ধ্যাগুলোতে আগুনের পাশে বসে শব্দ করে পড়তে থাকা।

মা যে গভীর এক পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেছেন, কিংবা বাবা যে ভুগছেন ভয়াবহ বিষণ্নতায়– এর কিছুই টের পাইনি আমরা। সংসার ভেঙে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মা; আর বাবা দিচ্ছিলেন আত্মহননের হুমকি। তারা আবার একমত হলেন; ঠিক করলেন, ‘সন্তানদের দোহাইয়ে’ এই একসঙ্গে জীবনের পথচলাটা চালু রাখবেন। এসবের কিছুই টের পাইনি আমরা; কিংবা বলে যেতে পারে, পেয়েছি খুবই সামান্য।

শরতের এক সন্ধ্যায়, নার্সারি রুমে নিজের ফিল্ম-যন্ত্রটি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম আমি। বোনটি ঘুমিয়ে ছিল মায়ের রুমে; আর শুটিংয়ের প্র্যাকটিস করতে ভাইয়া ছিল বাসার বাইরে। হুট করেই নিচতলা থেকে প্রচণ্ড ঝগড়ার শব্দ কানে এলো : মা কাঁদছিলেন, আর বাবা কথা বলছিলেন খুব রেগে গিয়ে। এ রকম মারমুখো শব্দ এর আগে কোনোদিনই শুনিনি আমি। হামাগুড়ি দিয়ে, সিঁড়ির কাছে এলাম; দেখি, হলরুমে হিংস্রভাবে ঝগড়া করছেন বাবা-মা। মা চেষ্টা করছেন নিজের কোটটা ছাড়িয়ে নিতে; অথচ, বাবা সেটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। অতঃপর কোটটা নিজের কবজায় নিতে পারলেন মা; আর ছুটলেন বাইরের দিকে। কিন্তু তার আগেই সেখানে পৌঁছে গেলেন বাবা; মাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এলেন ঘরের ভেতরে; তারপর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার সামনে। বাবাকে সরিয়ে, বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন মা; ধস্তাধস্তি হলো দুজনের। এক পর্যায়ে, বাবার মুখে আঘাত করে বসলেন মা; আর মাকে জোরসে দেয়ালের দিকে ধাক্কা দিলেন বাবা। ভারসাম্য হারিয়ে, মা মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। এই হট্টগোলে ঘুম ভেঙে গেল বোনের; রুম থেকে বের হয়ে এসে, কাঁদতে শুরু করে দিলো সে। আর তখনই বাবা-মা চুপ মেরে গেলেন।

এরপর ঠিক কী হলো– স্পষ্ট মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে, নিজের রুমের সোফায় বসে ছিলেন মা; তার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। আমার বোনটিকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। আর আমি নার্সারি রুমে ফিরে গিয়েছিলাম, নিজের সিনেমাটোগ্রাফটির কাছে। [এতক্ষণ হামাগুড়ি দিয়ে থাকায়] হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা করছিল আমার; ঈশ্বরের কাছে মিনতি করলাম, যেন আমার সব ফিল্ম আর সব যন্ত্রপাতির বদলে হলেও, বাবা-মার সম্পর্কটা আবার বন্ধুত্বপূর্ণ করে দেন তিনি।

মঞ্জুর হয়েছিল সেই প্রার্থনা। হেডভিগ এলেওনোরার প্যাস্টরের [বাবার উর্ধ্বতন কর্তা] মধ্যস্থতায়, বাবা-মার মধ্যে আবার মিল হয়ে গিয়েছিল; আর আমাদের সেই ভীষণ ধনী আন্টি– অ্যানা, বাবা-মাকে একটা লম্বা ছুটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন ইতালিতে। আমাদের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন নানী; তার আশ্রয়ে কাটছিল দিনগুলো।

এ রকম মারমুখো শব্দ এর আগে কোনোদিনই শুনিনি...
এ রকম মারমুখো শব্দ এর আগে কোনোদিনই শুনিনি…

ΞΞΞ

নানী বেশিরভাগ সময়ই মূলত উপসালায় থাকতেন; তবে দালার্নাতেও একটা গ্রামের বাড়ির মালিকানা ছিল তার। বিধবা হওয়ার কালে তার বয়স ছিল মাত্র ত্রিশের মতো। ট্র্যাডগার্ডসগ্যাটানের একটা চমৎকার অ্যাপার্টমেন্টকে দুইভাগ করে, পাঁচটা রুম, একটা কিচেন আর কাজের মানুষের একটা রুম নিজের জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন তিনি। আমার বয়স যখন খুবই কম, তার সঙ্গে তখন মিস ইলেন নিলসন নামের, স্ম্যল্যান্ড রাজ্য থেকে আসা এক চমৎকার কাজের মহিলা থাকতেন– অসাধারণ রান্না করতেন তিনি; আর আমাদের, মানে, শিশুদের করে রাখতেন কড়াকড়িভাবে ধর্মানুসারী। নানী মারা যাওয়ার পর, আমার মায়ের কাছে চলে এসেছিলেন তিনি; পারস্পরিক মমত্ব ও আতঙ্কবোধে দিন কাটছিল তাদের। পঁচাত্তর বছর বয়সে তিনি গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন; তারপর নিজের রুমটি সাফ করে ফেলে, একটা উইল লিখে দিয়ে, তার জন্য মায়ের কিনে আনা সেকেন্ড ক্লাস টিকেটটা বদলে থার্ড ক্লাস করিয়ে, প্যারাহোমে নিজের বোনের কাছে চলে গিয়েছিলেন। এর কয়েক মাস পর সেখানেই মারা যান মিস ইলেন। তাকে আমরা, শিশুরা ‘লালা’ নামে ডাকতাম। আমার নানী ও মায়ের পরিবারে, পঞ্চাশ বছরেরও অধিককাল কাটিয়ে গেছেন এই নারী।

পারস্পরিক এক মেজাজি অথচ বোঝাপড়ামূলক নির্ভরতার জীবন কাটিয়ে গেছেন নানী আর লালা; আর তা তাদের বেঁচে থাকায় রেখেছে এক প্রাণবন্ত ভূমিকা; তবে সেটিকে কেউই দোষারোপ করেননি কখনো। আমার কাছে সেই বিশাল [হয়তো অতটা বিশাল নয়] মনে হওয়া অ্যাপার্টমেন্টটি ছিল, ট্র্যাডগার্ডসগাটানের এক নির্জন এলাকায়, নিরাপত্তা ও জাদুকরি চুম্বকক্ষেত্রের মতো : সময় পরিমাপের জন্য সেখানে ছিল অসংখ্য ঘড়ি; কার্পেটের অশেষ সবুজ জুড়ে আছড়ে পড়তো সূর্যের আলো; টালি-অলা স্টোভগুলো থেকে ঠিকরে পড়ত অগ্নিশিখা; ছিল ধোয়া নির্গমন পাইপের গর্জন আর ছোট্ট স্টোভগুলোর টুং-টাং ধ্বনি। রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যেই ঝনঝন ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে যেত একটা ঘোড়ায় টানা স্লেজগাড়ি; ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা কোনো শেষকৃত্য উপলক্ষে বেজে ওঠত ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাগুলো; আর সকাল ও সন্ধ্যা হলে, দূর থেকে ভেসে আসা গুনিলা বেলের মৃদু শব্দও যেত শোনা।

পুরনো আসবাবপত্র, ভারি ভারি পর্দা, ঝাপসা যতো ছবি। বিশাল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হলরুমটির শেষ প্রান্তে ছিল কৌতুহল-জাগানিয়া একটা রুম; ফ্লোরের কাছে, সেটির দরজায় ছিল চারটা ফুটো, আর লাল ওয়ালপেপার, একটা মেহগনি কাঠে তৈরি সিংহাসনের মতো দেখতে চেয়ার– যেটি ছিল ব্রাশ ফিটিং ও নানা অলংকরণে ঋদ্ধ। সিংহাসনটির দুটি পা ছিল নরম কার্পেটে মোড়া; চেয়ারের সেই ভারি আবরণটি খুলে ফেললে, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও গন্ধ ভরা গহবরের দেখা মিলত। নানীর সেই সিংসাহনে  কেউ বসতে চাইলে বুকে পর্যাপ্ত সাহস রাখা দরকার ছিল!

হলরুমের একটা লম্বাটে আয়রন স্টোভ থেকে ভেসে আসতো কয়েল পোড়ার ও গরম ধাতুর নিজস্ব একটি বিশেষ ঘ্রাণ। রান্নাঘরে লালা যখন ডিনার, মানে, একটা নার্সিং ক্যাবেজ স্যুপ বানাতেন– তার সুবাস খুব সুমিষ্ঠভাবে ছড়িয়ে পরতো পুরো অ্যাপার্টমেন্টে; আর সেই গোপন রুমটির মৃদু ঘ্রাণের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত তা।

বারো বছর বয়সে বারিমন
বারো বছর বয়সে বারিমন

ছোট নাকের কারও জন্য, মাটির কাছাকাছি নাক নিয়ে, টাটকা ও ঝাঁঝালো ঘ্রাণ নিতে নিতেই কাটিয়ে দিতে হতো গ্রীষ্মের দিনগুলো। প্রত্যেক শুক্রবারে, মোম ও তারপিনের দিয়ে পুরনো নকশাকাটা ফ্লোরগুলো মুছে দিতেন লালা; এক ঝাঁঝালো সুবাস ছিল সেটির। কাঠের তৈরি ফ্লোরগুলোর ঘ্রাণ ছিল কাচা-সাবানের মতো; আর টক হয়ে যাওয়া দুধ ও পানির একটা বিশ্রি গন্ধময় মিশ্রণ দিয়ে মুছে দেওয়া হতো ঘরের মেঝে। পাউডার, পারফিউম, আলকাতরা, মূত্র, যৌনতা, ঘাম, পমেটম, পোড়া সলতে আর রান্নার একটি সংমিশ্রিত ঘ্রাণে ভরে থাকত অ্যাপার্টমেন্টটি। কিছু ঘ্রাণ ছিল মানুষের জন্যে স্বাভাবিক, কিছু ছিল নিরাপদ, আর কিছু– আতঙ্ক-জাগানিয়া। বাবার মোটাসোটা আন্টি– এমা বিশাল একটা পরচুলা পরতেন; সেটিকে নিজের টাকমাথায় একটা বিশেষ ধরনের আঠা দিয়ে আটকে রাখতেন তিনি। এমা আন্টির শরীর থেকে শুধু সেই আঠার ঘ্রাণটাই আসত। নানীর শরীর থেকে আসত– গ্লিসারিন ও গোলাপ জলের ঘ্রাণ; কারণ, জনৈক কেমিস্টের কাছ থেকে এই লোশনের খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ ছিল ভ্যানিলার মতো মিষ্টি; তিনি যখন ঠোঁটের উপরে কী যেন মাখতেন, তখন অভাবনীয় এক জাদুকরি ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। আমার প্রিয় ছিল অবশ্য ম্যারিট নামের এক লালচুলের হৃষ্টপুষ্ট, অথচ পঙ্গু তরুণী নার্সের শরীরের ঘ্রাণ। তার বিছানায়, তার বাহুডোরে শুয়ে, তার খসখসে নাইটগাউনে নাক গুঁজে দিয়ে থাকাটা ছিল আমার কাছে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা জিনিস।

আলো, সুবাস আর শব্দে নিমজ্জিত এক পৃথিবী ছিল সেটি। এ সময়ে এসে, শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যেতে চাইলে, সেই রুমগুলোতে [মনে মনে] এখনো ছুটে বেড়াতে পারি আমি; পারি দেখে নিতে সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ; পারি ঠিকঠাক করতে অনুভব। নানীর বাড়ির সেই নৈঃশব্দের ভেতরই বোধের উন্মেষ ঘটেছিল আমার; আর সেটি নিজের ভেতর সযত্নে রেখে দিয়েছি আমি চিরদিনের জন্য। সবকিছু হারালো কোথায়? আমার এইসব বোধের কোনো ছাপ কি কখনোই আমার কোনো সন্তান পারবে অধিকার করতে? পারবে কেউ পেতে সেইসব বোধ, অভিজ্ঞতা, অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হতে?

নানীর কাছে যে দিনগুলো, সপ্তাহগুলো, মাসগুলো আমি কাটিয়েছি, তা আমার ভেতর নীরবতা, নিয়মনিষ্ঠতা ও শৃঙ্খলার অটল ও জেদি প্রয়োজনীয়তাকে চরিতার্থ করতে দিয়েছে। নানী যখন কালো পোশাকের ওপর বিশাল একটা নীল ও সাদা ডোরাকাটা অ্যাপ্রোন পরে, ডাইনিংরুমে নিজের ডেস্কে বসে থাকতেন– আমার সেই একলা খেলার দিনগুলোতে কারও সাহচর্যের আকাঙ্ক্ষা আমি করিনি। তিনি হয় বই পড়তেন, নয়তো কলমের স্টিল নিবটি কাগজের ওপর ক্ষীণভাবে ঘষে ঘষে কষতেন হিসেব, বা কাউকে লিখতেন চিঠি। লালা হয়তো তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত; আনমনে গুনগুনিয়ে যেতেন কোনো গান। আর আমি ব্যস্ত হয়ে রইতাম নিজের খেলনা থিয়েটার নিয়ে; পর্দা উড়িয়ে আপন মনে রূপকথা রেড রাইডিং হুড-এর অন্ধকারাচ্ছন্ন বন কিংবা সিন্ডারেলার আলোকোজ্জ্বল বলরুমের আবহ সৃষ্টি করে, নিজেকে এ খেলার পরিচালকের অবস্থায় নিয়ে গিয়ে, নিজের কল্পনাশক্তিকে ঝালিয়ে তুলতাম।

'ব্যস্ত রইতাম নিজের খেলনা থিয়েটার নিয়ে' [দৃশ্য । আলেক্সান্ডার অ্যান্ড ফ্যানি]
ব্যস্ত রইতাম নিজের খেলনা থিয়েটার নিয়ে’ [দৃশ্য । আলেক্সান্ডার অ্যান্ড ফ্যানি]

ΞΞΞ

এক রোববারের কথা মনে পড়ে। গলা ব্যথা নিয়ে শুয়ে ছিলাম আমি। এই অজুহাতে এড়ানো গেল মর্নিং সার্ভিস। ফলে অ্যাপার্টমেন্টে একাই রইলাম। বসন্তকাল তখন এসেছে কেবল। ঘরের পর্দা আর দেয়ালের ছবিগুলোর ওপর, নিঃশব্দে আনাগোনা করছিল রোদ। আমার মাথার ওপরে বিশাল ডাইনিংরুমের টেবিল টাওয়ার; সেটির একটি মোটাসোটা পায়ায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম আমি। টেবিলটি ঘিরে ছিল চেয়ারগুলো; আর দেয়ালগুলো ঢাকা ছিল– সময়ের প্রবাহে কালসিটে হয়ে যাওয়া, পুরাতনের ঘ্রাণ ছড়ানো হলুদ চামড়ায়। সাইডবোর্ডটি আমার পেছনে যেন দাঁড়িয়ে ছিল দুর্গের মতো; আলোর বদলে যাওয়ার মধ্যে, জার ও খোদাইকৃত কাচের গ্লাসগুলোয় খেলে যাচ্ছিল পলকা আলো। আমার বামপাশে, দীর্ঘ দেয়ালে ঝুলে ছিল– নীল পানির ভেতর থেকে উঠে আসা বিশাল একটা সাদা, হলুদ ও লাল রঙের ঘরবাড়ি আর পানিতে ভাসা নৌকার ছবি।

সিলিংয়ের অলংকার হিসেবে ঝুলে থাকা ডাইনিংরুমের ঘড়িটি যেন নিজেকেই শোনাচ্ছিল কোনো বিষাদ ও অন্তর্মুখী কাহিনী। যেখানে বসে ছিলাম, সেখান থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম– ড্রয়িংরুমের ধিকিধিকি সবুজ আলো, সবুজ দেয়াল, মাদুর, ফার্নিচার, পর্দা আর সবুজ পাত্রের মধ্যে ফার্ন। দেখতে পাচ্ছিলাম– হাতকাটা, নগ্ন সাদা নারীটিকে। সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে ছিল সে; যেন মুখে হাসি নিয়ে দেখছিল আমাকে। স্ফিত এক দফতরে, স্বর্ণের ফিটিং ও পা নিয়ে, কাচের গম্বুজাকৃতির স্ট্যান্ডের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল একটি স্বর্ণমণ্ডিত ঘড়ি। ঘড়ির মুখে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিল এক তরুণ। তার কাছেই, মাথায় বিশাল এক হ্যাট আর পরনে একটা শর্ট ওয়াইড স্কার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট এক নারী। এরা দুজনেই স্বর্ণে মোড়ানো। ঘড়িতে যখনই বারোটা বাজত, তরুণটি তখন বাঁশি বাজাত আর মেয়েটি নেচে ওঠত

সূর্যের আলো ঝলন্ত হয়ে ওঠলে, ঝুলন্ত ঝাড়বাতির কাচ ঝিমমিক করে ওঠত; আর যেন পানি থেকে ভেসে ওঠত বাড়ির ছবিটি, আর একটা সাদাটে মহিমায় ছড়াতো স্নেহ। তারপর ঘড়িগুলোর বেজে ওঠা, সোনালী মেয়েটির নেচে ওঠা, ছেলেটির বাঁশি বাজানো, নগ্ন নারীটির মাথা ঘুরিয়ে যেন আমার দিয়ে সায় দেওয়া; আর অন্ধকারাচ্ছল্প বারান্দায়– মেঝে জুড়ে কাস্তে হাতে তার মৃত্যুর দাগ কেটে যাওয়া। এখনো তাকে দেখতে পাই আমি; হলুদ খুলির ওপর তার হাসিমুখ, আর অন্ধকারাচ্ছন্ন যান্ত্রিক শরীর দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে– কাচের ভেতর।

অনুবাদরুদ্র আরিফ

 পরের কিস্তি  প্রেতিনীগণ 
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

2 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to বার্গম্যান অথবা বারিমনের আত্মজীবনী [কিস্তি-৬] | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here