ব্ল্যাকআউট স্ক্রিপ্টরাইটার ও ফিল্মমেকার • টোকন ঠাকুর সিনেমাটোগ্রাফি ও এডিটিং • সামির আহমেদ মিউজিক • অর্ণব আর্ট ডিরেক্টর • আব্দুল হালিম চঞ্চল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান • আস্তাবল অভিনয় • তানভীর হাসান, রাহুল আনন্দ, তিনা, ধ্রুব এষ, কফিল আহমেদ স্টিল ফটোগ্রাফি • রিচার্ড রোজারিও ফরম্যাট • ভিডিও ফরম্যাট রানিংটাইম • ৯৭ মিনিট ভাষা • বাংলা দেশ • বাংলাদেশ নির্মাণকাল • ২০০৬ •• ফিল্মটি এখনো বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায়নি
লিখেছেন । বখতিয়ার আহমেদ
গত মাস কয়েক ধরে পত্রিকান্তরে রাষ্ট্র হলো কবি, গল্পকার-গদ্যকার টোকন ঠাকুর সিনেমা লিখেছেন। দেড় দশক ধরে বর্ণভাষার তেজারতি পেরিয়ে দৃশ্যভাষার অকুল পাথারে নেমেছেন তিনি, ছবি লিখবেন বলে। ছবি লিখবেন মানে তো তিনি একা নয়, অনেকে মিলে লিখবেন। সেই অনেকদেরও বেশির ভাগকেই জানা গেল পত্রিকার পাতাতে, ঢাকাই শিল্প-সাহিত্যপাড়ার বচনে-বয়ানে, টোকন ঠাকুরের নিজের লেখালেখি, এমনকি কবিতাতেও। ছবির নামও জানা গেল– ব্ল্যাকআউট। ঠাকুরের কবিতা ‘নয়া ফিল্ম ডিরেক্টর’ই যখন সাক্ষ্য দেয় ‘ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানো এক নিঃসঙ্গ উম্মাদের ডাক নাম ডিরেক্টর’– তখন বান্ধুবকূলে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা তো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই। সেই উৎকন্ঠার শীর্ষ পেরিয়েই অবশেষে ব্ল্যাকআউট আলোতে আসল গত ১৩ সেপ্টেম্বর, রাশান কালচারাল সেন্টারে, মোটামুটি ‘অভিনব’ দর্শক সমাবেশের মধ্য দিয়ে।

ব্ল্যাকআউট একটি যুদ্ধকালিন শব্দ যার মানে ছিল শত্রু-বিমানের লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার জন্য লোকালয়ের বাতিগুলো সামরিক তত্ত্বাবধানে নিভিয়ে ফেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নগর কোলকাতার কোলে নেমে এপার বাংলায় এসে ব্ল্যাকআউট শব্দটির কপালে একটি মনো-দৈহিক মানে জুটেছে– একটু কচলে নিলে যার মানে করা যায়– স্মৃতিভ্রম। টোকন ঠাকুর রচিত ও পরিচালিত ভিডিও ফিল্ম ব্ল্যাকআউট-এর প্রিমিয়ার শোতে বসে বোঝা গেল, এটি আজকের এই শূন্য দশকের সাহিত্য-শিল্প-কলার নাগরিক ‘রুলস অফ দি গেম’-এ অপাংক্তেয় দুই যুবকের উপাখ্যান– একজন কবি, আরেকজন আর্টিস্ট। ডকু-ফিকশন ধারার তুরীয় ধাঁচে বানানো ফিল্মটি এই দুই সদ্যতারুণ্য পেরুনো যুবকের পুরুষালি মনো-দৈহিক প্রাত্যহিকতার অকপট ও নির্জলা বিবরণ, যার শ্রুতি-দৃশ্যভাষ্যটি নিঃসন্দেহে সাহসী, সফল ও শৈল্পিক। একটু ভয়ে ভয়েই বলি– সম্ভবত ইহাই ফিল্ম।

ঢাকাই নাগরিক-মধ্যবিত্ত ফিল্মপাড়ায় ডকু-ফিকশন নিয়ে বিরাজমান তাত্ত্বিক ডামাডোলেও দিশে না হারিয়ে নিজের প্রথম ফিল্মটি বানাতে গিয়ে টোকন বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে সহজ পথটি– নিজেকেই ভেঙ্গে ফেলা। তিনি নিজে বৃত্তিসূত্রে কবি, বিদ্যাসুত্রে আর্টিস্ট, যা ব্ল্যাকআউট-এর নামচরিত্র দুটির যোগফল। এদের প্রথমজন মাদল, আর্টিস্ট বন্ধু রাফির সাথে যার নগরের এক চিলেকোঠার বাসায় বহুচিলতে বসবাস। এই বসবাসে জীবন পোড়ানো আছে, শিল্পের যাপন-উদযাপন-প্রত্যাখ্যান আছে, নিঃশব্দ নিরীক্ষা আছে, বঞ্চনা-পীড়িত পুরুষালি কাম আছে, এলিয়েনের মতো আগন্তুক নারী আছে, হতাশা আছে, কফিল আহমেদের সুরে জ্বলে উঠা তরল আগুন আছে, আর সবকিছু থেমে গেলে আছে স্মৃতির হুলিয়া কাঁধে ফেরার হয়ে যাওয়া, আত্মরতিতে গলে গলে মোম হয়ে যাওয়া। সোজা কথায় ব্ল্যাকআউট-এর ক্যামেরা আর কলাকুশলীদের নিয়ে টোকন হেঁটেছেন এই শুন্য দশকের প্রথমার্ধে নাগরিক আর্ট-কালচার বলয়ে নির্মল বাতাসের জন্য খাবি খেতে থাকা দুই কবি এবং শিল্পী বন্ধুর জীবনের অলিগলিতে।

ব্ল্যাকআউট-এর গল্প শুরুটাও স্মৃতিভ্রমের। কবি মাদলের শহুরে ভোরেও নাক গলায় গ্রামীণ শৈশবের কুয়াশার ঘোর লাগা ভোরের স্মৃতি। মায়ের বাগ না মেনে লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকা কিশোর, পরিণামে যাকে নাকে খৎ দিতে হয়, কিম্বা সেই সদ্যতরুণী– যে তাঁকে প্রথম কৈশোরের সাঁকো পার করিয়ে তরুণ করে দিয়েছিল– এইসব স্বপ্নস্মৃতির ধাওয়া খেয়ে ঘটমান বাস্তবের ছাইদানি উল্টে দিয়ে মাদলের সকাল শুরু হয় শহরের চিলেকোঠায়, বেলা হয়তো তখন বারোটা বেজে বিশ মিনিট। হয়তো এই শহরে সে এসেছিল ফুলপাতা আঁকা তোরঙ্গে বন্দী কবিতাকেই পুঁজি করে। জানা যায়, সেই কবিতাও যখন তাকে ছেড়ে যায়, সেই নিঃসঙ্গ উম্মাদনার মাঝরাতে খোলা ছাদে বসে সে কাঙাল আলিঙ্গনে বাঁধে কোনো প্রহেলিকাময় বৃক্ষ, তার বুকের অজগর বা বাস্তবের কফিল ভাইকে। অন্যদিকে বন্ধু রাফি তখন প্রেমে পড়েছে নগরের পেলব আভিজাত্যের সীমাতেই বেড়ে উঠা, বড় হলে মডেল হতে চায় এমন এক অনিন্দ্য সুন্দরী– মিটির। সময়ের সবুজ ডাইনি যখন কবি মাদলের কাঁধে প্রেতের মতো সওয়ার হয়, নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলো যখন এক অজানা কারণে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে, তখন বন্ধুর এই প্রেম মাদলের রক্তমাংশেরও কোথায় কোথায় যেন তীব্র হ্রেষা ছড়ায়… অতঃপর আত্মরতিতেই ঘটে আত্মসমর্পণ, নিজেকে নিজেই ভেঙ্গে ফেলে বিহ্বল হয়ে থাকা। অন্যদিকে রাফিও লাল ঘোর লাগা চোখে এঁকে ফেলতে চায় মিটিকে, নিজের ক্যানভাসে পেতে চায় কল্পনার রঙে গুলিয়ে। রাফি মিটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আর মিটি দেখে মডেল হওয়ার স্বপ্ন। মিটি রাফির মডেল হয় বটে, কিন্তু তার কল্পনার রঙের সাথে মিশ খায় না। কারণ, সে শিল্পকলা না জানলেও মডেল হওয়ার রুলস অফ দি গেম জানে, অ্যাডফিল্মের মডেল হয়ে শুট্যিংয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে। ফানুস ভেসে গেলে পড়ে রাফিও ফেরে তাদের আসমানদারির চিলেকোঠায়, মিটিও মাদলের শালমলীর মতো রাফির মনে না থাকার অন্তর্গত হয়ে যায়, কখনবা কেবলমাত্র মনে পড়াতেই ফিরে আসে।

গল্পটি সমাজের এই গোত্রের বাসিন্দাদের, এমনকি যারা তাদের খানিকটা হলেও জানেন, তাদের কাছেও একেবারেই আটপৌরে একটি গল্প। তাহলে ব্ল্যাকআউট-এর মাহত্ম কী? সেটা লিখে বোঝানো গেলে টোকন নিজেই হয়তো ফিল্ম না বানিয়ে লিখে ছাপতে দিতেন গল্পটি। সেটা যখন করেননি, তখন বুঝতে হচ্ছে, কবি এবার কবিতা লিখেননি, সেকেন্ড প্রতি হিসেবে প্রবহমান ফ্রেমে ফ্রেমে কবিতা এঁকেছেন। সেটা করতে গিয়ে ব্ল্যাকআউট যা দাঁড়িয়েছে, তা ভিডিও ফিল্মের বাজার ও পুঁজি সঞ্চালন সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল, তাদের কাছে পাগলামিই ঠেকে বটে; কিন্তু এই ‘বই’টি দেখার সময় ফিল্ম যে একটি স্বতন্ত্র ভাষিক অভিজ্ঞতা– তা ঢের বেশি টের পাওয়া যায়।
শিল্পী মাত্রই একটি উপাদানের অন্তর্নিহিত সম্ভবনাকে আবিষ্কার করেন তার বাস্তব-কল্পের মধ্য দিয়ে। ব্ল্যাকআউট-এর চরিত্রগুলোও জীবনের আটপৌরে উপাদানগুলোর অপ্রচল সম্ভবনার সাথেই অনায়াস লীলা করে, যার ফলে অবলীলায় এন্টিকাটারে প্লাস্টিক বোতল কাটা পড়ে মদ্যপানের গ্লাস হয়ে উঠে, শরীরের কামজ প্রেম ক্যানভাসে ছড়িয়ে পড়ে দারুণ আক্রোশে, নেশার ঘোর তুঙ্গে উঠলে পরে কিভাবে শীত অসাড়তা জেঁকে বসে, ইত্যাকার বিস্তৃত সফল বিবরণে ভরা ব্লাকআউট। বিজলির আলোর পলকে দেখার মতো নারী শরীরের অনুরণনশীল প্রত্যঙ্গ, কাঁটাবনের লাভ বার্ডদের প্রতিবেশী বিদেশী কুকুর, রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক নজরদারি-খবরদারি, বহুতল দালানের বারান্দায় গ্রিল বন্দী বালিকা, আর্ট কলেজের মডেল দাদু, বাড়ি ভাড়া যোগাড়ের বিবমিষাময় ক্লান্তি– জীবনের এ রকম অসংখ্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা দারুণ তাচিছল্যে ব্ল্যাকআউট-এর ফ্রেমে ফ্রেমে ঠাঁই নিয়ে যখন মন্ময় ব্যঞ্জনায় নিষিক্ত হয়– দর্শকদের তখন শিকার হতে হয় নিরুপায় তন্ময়তার।

সমসাময়িক ভিডিও ফিল্মগুলোর ক্যামেরা স্বর্বস্বতাকেও দারুণভাবে এড়িয়ে গেছে ব্লাকআউট। ধারণকৃত দৃশ্যমালার মধ্য দিয়ে যদি এই গল্পের কংকালটি তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয়, তাতে রক্ত-মাংশ লেগেছে আর্ট ডিরেক্টর আব্দুল হালিম চঞ্চল এবং চিত্রগ্রাহক-সম্পাদক সামির আহমেদের মুন্সিয়ানায়। এদের শিল্পবোধের নির্যাস যেমন ফিল্মটিকে বহুমাত্রিকতায় নিয়ে এসেছে, তেমনি তার সাথে যুক্ত হয়েছে স্থিরচিত্রের প্রাণবন্ত আত্মীকরণ– যেখানে দারুণ রকমের সফল রিচার্ড রোজারিও। আর সর্বোপরি আবহ সঙ্গীত এবং দুই দুইটি গান নিয়ে ব্ল্যাকআউট-এ মজেছেন এই সময়ের আলোচিত বাজনদার অর্ণব, বিশেষত রণজিৎ দাশের কবিতা সময় সবুজ ডাইনিকে অর্ণব প্রায় মানুষের নিওলিথিক স্মৃতির হাহাকারে পরিণত করেছেন, যার অনিবার্য অনুভবই হচ্ছে শিহরণ। ব্ল্যাকআউট-এর প্রযোজনাগৃহ আস্তাবল-এর একটি অসাধারণ লগো অ্যানিমেশন করেছেন চিন্ময় দেবর্ষি। ক্যামেরায় গাঁথা কুশীলবদের মাঝে মাদল চরিত্রে পুরোটাই হজম হয়ে গেছেন রাহুল আনন্দ, নিজের চরিত্রটিতে সপ্রতিভ অভিনয় করেছেন মিটিরুপী তিনা, পেশীগুলো পুরো ছাড়তে না পারলেও রাফি চরিত্রে উতরে গেছেন তানভীরও। নিজের বাস্তব চরিত্রে হাজির থেকে ধ্রুব এষ, কফিল আহমেদ, আবুল কালাম আজাদসহ আর সব পার্শ্বচরিত্রও পুরোমাত্রায় মিশেছেন মূল কহতব্যের সাথে। এই নিটোল সামগ্রিকতাই ব্ল্যাকআউট-এর মূল শক্তিমত্তা, নবাগত পরিচালক-কলাকুশীলবদের কাজ হিসেব যা প্রায় তেলেসমাতির পর্যায়ে পড়ে।

ছবিটির সমস্যা যেখানে হয়েছে, তা হচ্ছে– এটির পা সামাজিক বা বাজারি জুতার মাপে কেটেছেঁটে বানানো হয়নি; ফলে পুরো ব্যাপারটি খুব একটা সহজপাচ্য নয়। স্বভাবতই বিফল তো বটেই, অনেক সফল নিরীক্ষারও প্রথম বলি হয় ছবির প্রযোজনা, সে বিচারে ব্ল্যাকআউট নিয়ে এ উৎকণ্ঠা থেকেই যেতে পারে– এই কুশীলবদের আরো কাজ দেখতে পেতে আমাদের কতটা অপেক্ষায় থাকতে হবে?
প্রথম প্রকাশ : কালের খেয়া; সমকাল । ২০০৬
[…] ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুরের ব্ল্যাকআউট-এর [আনরিলিজড] স্মৃতি আজও মনে […]
[…] আমরা প্রাসঙ্গিকভাবেই দেখতে পাই ব্ল্যাকআউট সিনেমার বাঁকে […]