বার্গম্যান অথবা বারিমনের আত্মজীবনী [কিস্তি-৪]

336

ইংমার বারিমন। ইংরেজি উচ্চারণ ইঙ্গমার বার্গম্যান নামে অধিক পরিচিত সুইডিস মাস্টার ফিল্মমেকার। দ্য ম্যাজিক লেন্টার্ন শিরোনামে প্রকাশিত তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি সিনেবিশ্বের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটবুকও বটে। সেই গ্রন্থের এই ধারাবাহিক অনুবাদ…

আগের কিস্তি । আমার পাপ, আমার প্রতারণা


প্রথম জ্বর, প্রথম শিহরণ

য়েল হসপিটাল– সোফিয়াহেমেটের পার্কটি বিশাল; সামনের দিকে ভালহালাভেগেন স্ট্রিট, একদিকে স্টেডিয়াম, আর অন্যদিকে টেকনোলজি কলেজ। এটি ঢুকে গেছে লিল-জান্সকোগেন পার্কের গভীরে। বিল্ডিংগুলো ঠিক তখনকার দিনের মতো নয়; বরং রোলিং ল্যান্ডস্কেপের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যেন।

আমি সেখানে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতাম; নিবিড়ভাবে দেখে নিতাম– যা যা আছে, সবকিছু। পার্কটির ভেতরে থাকা ইটে গড়া ছোট্ট চ্যাপেল বা প্রার্থনালয় বিল্ডিংটির প্রতি আমার ছিল বিশেষ আগ্রহ। হাসপাতাল ও চ্যাপেলে আসা-যাওয়ার ট্রান্সপোর্টের দায়িত্বে ছিলেন যিনি, হাসপাতালের সেই কেয়ারটেয়ারের সঙ্গে সখ্যতা করে নিয়ে, কত যে ভালো ভালো গল্প শুনে নিয়েছি তার কাছ থেকে! তিনিই আমাকে পচা-গলা নানা অবস্থায় থাকা কত যে লাশ দেখতে দিয়েছেন! আরেকটা বিল্ডিংয়ে ঢোকা ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ; চারটা বিশাল বিশাল গর্জনমুখর চুল্লিতে ভরা ছিল সেটির বয়লার রুমটি। ট্রলি দিয়ে কয়লা আনা হতো সেখানে, আর কালো-কালো মানুষগুলো চুল্লিতে সেগুলো ঢেলে দিতেন। বিশাল দেহী আর্ডেনেস ঘোড়ায় টানা সুসজ্জিত গাড়িগুলো আসতো প্রতি সপ্তাহে কয়েক দিন করে; মুখ ঢেকে রাখা মানুষগুলো চুল্লির স্টিলের দরজাগুলো খুলে দিয়ে, বয়ে আনা বস্তাগুলো ভেতরে ঢুকাতেন। রক্তাক্ত আর কাটাছেড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ভরা সেই গোপন বস্তাগুলোর দাহ করা হতো চুল্লিতে

প্রত্যেক রোববার, হাসপাতালের চ্যাপেলে ধর্মসভা পরিচালনা করতেন বাবা। গায়ে রোববারের বিশেষ কালো ইউনিফর্ম ও সাদা অ্যাপ্রোন, আর মাথায় সোপিয়াহেমেটের ক্যাপ পরা সুপ্রশিক্ষিত নার্সরা জড়ো হতেন সেখানে। সোলহেমেটের উল্টোদিকে ছিল পারসোনেজ বা ধর্মযাজকের বাসভবন; হাসপাতালে কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করা, অশীতিপর বৃদ্ধা নার্সরা থাকতেন সেখানে। কঠোর ধর্মনীতি পালনকারী নান-দের মতোই দেখতে লাগত তাদের। সোলহেমেটের বাসিন্দারা পারসোনেজের দেখাশোনা করতে পারতেন। তারা তা করতেনও।

সুপ্রশিক্ষিত নার্সরা জড়ো হতেন প্রার্থনায়...
সুপ্রশিক্ষিত নার্সরা জড়ো হতেন প্রার্থনায়…

সত্যি কথা বলতে, নিজের অতীতে, জীবনের একেবারেই শুরুর দিকের দিনগুলোর পানে ফিরে তাকালে আমার বেশ উচ্ছ্বাস ও কৌতুহল জাগে মনে। আমার কল্পনা ও বোধশক্তিতে পুষ্টি জুগিয়েছে সেই দিনগুলো; আর মনে পড়ে, অপ্রত্যাশিত কিছু দেখার ও জাদুকরি কোনো মুহূর্ত খুঁজে নেওয়ার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো যে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টাগুলো আমি কাটিয়েছি– সেগুলো কিছুতেই একঘেয়ে ছিল না। আমি এখনো আমার শৈশবের ল্যান্ডস্কেপে ঘুরে বেড়াতে পারি, এবং এখনো নিতে পারি– আলো, ঘ্রাণ, মানুষ, রুম, মুহূর্ত, ইশারা এবং কণ্ঠ ও অবজেক্টের নানা স্তরের অভিজ্ঞতা। এইসব স্মৃতির কদাচিৎ কোনো নির্দিষ্ট অর্থ থাকতে পারে হয়তো; তবে যেন কোনো সূচনাবিন্দু ছাড়াই, ইচ্ছেমতো শুট করে বানানো কোনো শর্ট কিংবা লং ফিল্মের মতোই এগুলো।

শৈশবের বিশেষ মর্যাদা হলো জাদু ও ওটমিল বা জইচূর্ণের পুরিজ বা জাউয়ের মধ্যে, অনিঃশেষ আতঙ্ক ও অবারিত আনন্দের মধ্যে অনর্গল আসা-যাওয়ার ক্ষমতা। আবছায়া ও ভীষণ রকম অবোধ্য বিধিনিষেধ ও রীতিনীতি ছাড়া আর কোনো সীমারেখা ছিল না সেখানে। যেমন ধরুন, সময় সম্পর্কে ধারণা তখনো আমার মধ্যে জন্মায়নি। ‘তোমাকে সময়নিষ্ঠ হওয়া শিখতেই হবে। তোমাকে একটা ঘড়ি দেওয়া হলো, যেন বুঝতে পারো সময়ের হিসেব।’ কিন্তু সময়ের হিসেব তো অস্তিত্বকে থামিয়ে দেয়; বরং নিজের ভেতরের কোনো একটা গোলমালই আমাকে জানান দিয়ে দিতো, ক্ষুধা পেয়ে গেছে।

কোনটা অলীক কল্পনা আর কোনটা বাস্তবতা– এ দুটির মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে নেওয়া কঠিন ছিল খুব। সেই চেষ্টা যদি আমি করতাম, তাহলে হয়তো বাস্তবকে বাস্তবই রাখার ক্ষমতা হয়ে যেতো আমার। কিন্তু, ভূত ও আত্মারও তো উপস্থিতি ছিল; ওদেরকে আমি করতাম কী তাহলে? তাছাড়া কিচ্ছা-কাহিনীগুলো– ওগুলো কি বাস্তব ছিল? ঈশ্বর ও দেবতাগণ? যিশু খ্রিষ্ট? অ্যাডাম ও ইভ? মহাপ্রলয়? আব্রাহাম আর ইসাকের মধ্যে সত্যি কি এ রকম কিছু ঘটেছিল? তিনি কি ‘সত্যি সত্যি’ ইসাকের গলা কাটতে গিয়েছিলেন? নিজেকে ইসাক ধরে নিয়ে, ডোরের খোদাইয়ের কথা ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছিলাম আমি। সেটা সত্য ছিল। ইংমারের গলা কাটতে যাচ্ছিলেন বাবা! দেবতা আসতে যদি দেরি করে ফেলতেন, কী হতো তখন? তাদের তো কান্না করা ছাড়া উপায় থাকত না আর! রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, আর ইংমার হাসছে বিবর্ণমুখে। বাস্তবতা! এরপরই এলো সিনেমাটোগ্রাফ।

»»»»»»»»»»»»»»»»»»

প্রথম দেখা সিনেমাটি ছিল ঘোড়া নিয়ে
প্রথম দেখা সিনেমাটি ছিল ঘোড়া নিয়ে

ক্রিসমাসের কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। আমাদের ভীষণ ধনি আন্টি– অ্যানা ইতোমধ্যেই এক ঢালি উপহার পাঠিয়ে দিয়েছেন। স্বভাবতই, ক্রিসমাস প্রেজেন্ট বাস্কেটের মধ্যে রেখে, সিঁড়ির নিচের আলমারিতে রেখে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো। এর মধ্যে একটা পার্সেলের প্রতি আমার ভীষণকৌতুহল তৈরি হতে থাকে। ‘ফর্সনার্স’ লেখা র‌্যাপিং পেপারে মোড়া, বাদামি ও কৌণিক ছিল সেটা। ফর্সনার্স ছিল হামগাটানে অবস্টি’ত একটা ফটোগ্রাফিক স্টোর; তারা শুধু ক্যামেরাই নয়, আসল সিনেমাটোগ্রাফসও বিক্রি করত।

অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে, একটা সিনেমাটোগ্রাফেরই আকাঙ্ক্ষা আমার সবচেয়ে বেশি ছিল। এর এক বছর আগে, জীবনে প্রথমবার সিনেমা-হলে গিয়েছিলাম আমি; দেখেছি ঘোড়া নিয়ে বানানো একটা সিনেমা। যদ্দূর মনে পড়ে, ফিল্মটির নাম ছিল ব্ল্যাক বিউটি; বিখ্যাত এক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। স্টুর সিনেমা-হলে দেখেছিলাম ফিল্মটি; আমরা বসেছিলাম সার্কেলের প্রথম সারিতে। আমার কাছে, এ ছিল একটি সূচনা। তারপর সেই জ্বরে এতটাই কাবু হয়ে গিয়েছিলাম যে, জ্বরটা আর কোনোদিনই সারেনি আমার! নির্বাক ছায়াগুলো তাদের নিষ্প্রাণ মুখ নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছিল, আর শ্রবণাতীত কণ্ঠে বলে দিচ্ছিল আমার সবচেয়ে গোপন অনুভূতিগুলোর কথা। ষাট বছর কেটে গেছে তার পর, অথচ কোনো কিছুই বদলায়নি; সেই জ্বরটা এখনো তেমনই আছে।

সেই শরৎকালের পরে, সিনেমাটোগ্রাফ আছে– আমার এমন এক স্কুলফ্রেন্ডের বাড়ি গিয়েছিলাম; দেখেছি অল্প কয়েকটি ফিল্ম। টিপ্যান আর আমার প্রতি একটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে সে। আমাদের এই নিমন্ত্রণকর্তা যখন টিপ্যানের গলা জড়িয়ে ধরেছে, আমি তখন ম্যাশিনটিতে বাতাস দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।

ক্রিসমাস মানেই ছিল আনন্দের একটা বিস্ফোরণ। মা তার আদুরে হাতে সবকিছু সামলাতেন; আর আথিতেয়তা, খাবার-দাবার, আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, ক্রিসমাস উপহার ও গির্জার আয়োজনের এই মহাযজ্ঞ ছাপিয়ে, সবকিছু ঠিকঠাক মতো করার একটা বাধ্যবাধকতার চাপ ছিল তার কাঁধে।

বাড়িতে, ক্রিসমাস ইভ ছিল একটা যথেষ্ট শান্ত ঘটনা : সন্ধ্যা পাঁচটায় গির্জায় প্রার্থনা দিয়ে শুরু হতো এটি, তারপর আনন্দময় অথচ সংযমী খাবার, ক্রিসমাস ট্রিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, ক্রিসমাস স্টোরি পড়া আর তাড়াতাড়ি ঘুমুতে যাওয়া। [পরের দিন খুব সকালে উঠতে হতো আমাদের; তখনকার দিনের হিসেবে, অনেক বেশি সকালেই।] কোনো উপহারই হাতে তুলে দেওয়া হতো না তখন; তবে সন্ধ্যাটা ছিল আনন্দমুখর– ক্রিসমাস ডে উৎসবের এক রোমাঞ্চকর উপলক্ষণ। মোমবাতি হাতে সকাল সকাল গির্জায় প্রার্থনা করা, আর তারপর ডঙ্কা শুনে ক্রিসমাস ব্রেকফাস্ট খেতে বসা। এরপর বাবা তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে মন দিতেন; তার আগে নিজের স্মোকিং জ্যাকেট খুলে, ক্যাসসক বা আলখিল্লা পরে নিতেন। তখনই সবচেয়ে প্রফুল্ল মেজাজে থাকতেন তিনি; আমাদের অতিথিদের সামনে জাহির করতেন তার কাব্যময় তাৎক্ষণিক বয়ান, গাইতেন এই বিশেষ দিনটি উপলক্ষে রচিত কোনো গান, সবাইকে সুরা পান করাতেন, নিজের সহকর্মীদের নকল করে দেখাতেন আর হাসিয়ে তুলতেন সবাইকে। তার প্রাণবন্ত আন্তরিকতা, তার উদারতা, বন্ধুত্বপরায়নতা ও বেহিসেবিপনা নিয়ে মাঝে মধ্যে ভাবি আমি; অন্ধকারাচ্ছন্নতা, নির্দয়তা, নিষ্ঠুরতা আর দুর্বোধ্যতাকে এভাবে, কী করে যে ছাপিয়ে যেতেন তিনি! আমার ধারণা, আমার স্মৃতি বলে, বাবার প্রতি আমি অহরহই অবিচার করে গেছি আমি

ইংমারের বাবা-মা
ইংমারের বাবা-মা

ব্রেকফাস্টের পর সবাই বিছানায় চলে যেত, কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে। অভ্যন্তরীন গৃহস্থালী রুটিন মানা হতো ঠিকঠাক– দুপুর দুইটায় উঠে পরা, আর আকাশ একটু আবছা হয়ে এলে, বিকেলের কফি পরিবেশন। আমাদের বাড়িটি ছিল সবার জন্য খোলা; যার ইচ্ছে– চলে আসতো, আর পারসোনেজে জানিয়ে যেত ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা। আমার কিছু বন্ধু গান-বাজনা করত; তাদের অংশগ্রহণে, বিকেলের উৎসব পরিণত হতো একটা তাৎক্ষণিক কনসার্টে। এরপর সময় হতো ক্রিসমাস ডে’র মহার্ঘ মুহূর্তের : খাবার-দাবার। আমাদের বিস্তৃত রান্নাঘরেই অনুষ্ঠিত হতো এটি; সেখানে সামাজিক যাজকতন্ত্রের আসন পাতা হতো এক পাশে, অস্থায়ীভাবে। একটা সার্ভিং টেবিলে বিছিয়ে রাখা হতো খাবার, ওপরটা ঢেকে রাখা; আর ক্রিসমাসের উপহারগুলো বিতরণ করা হতো ডাইনিং-রুম টেবিলে। ঝুড়িগুলো নিয়ে আসা হলে, বাবা একটা সিগারেট ধরাতেন, আর হাতে নিতেন মিষ্টি পানীয়ের গ্লাস। তারপর সশব্দে, আনন্দ ও টিপ্পনী-সহকারে, কাব্যময় করে তুলে দিতেন উপহারগুলো। কোনো উপহারই, কাব্য না করে তুলে দিতেন না তিনি।

সিনেমাটোগ্রাফটির দেখা মেলে ঠিক তখনই। এটি পেয়েছিলেন আমার ভাই। তা দেখে, মুহূর্তেই আমি হাঙ্গামা লাগিয়ে দিই। আমাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় টেবিলের নিচে। বলা হয়, যেন শান্ত হয়ে যাই। নার্সারিতে ছুটে যাই আমি, গালাগাল আর শাপ-শাপান্ত করতে থাকি; তারপর এক সময় ক্লান্ত হয়ে, ভীষণ দুঃখে ঘুমিয়ে পড়ি।

পার্টি চলতে থাকে।

পরে, সন্ধ্যেবেলা ঘুম ভাঙে আমার। নিচতলায় তখন লোকগান গাইছিলেন গার্টরুড; নৈশবাতিগুলো জ্বলে উঠেছিল। প্রার্থনায় স্বদেশি দৃশ্যের একটা স্বচ্ছতা ও রাখাল বালকেরা– ক্ষীণ আলোয় বেহুসের মতো পড়ে ছিল বিশাল ড্রয়ারগুলোর বুকে। আমার ভাইয়ের পাওয়া অন্যান্য ক্রিসমাস উপহারের সাথে, বক্রাকার চুঙ্গি, চমৎকার আকারের ব্রাস লেন্স, আর ফিল্ম লুপের রেক নিয়ে, সিনেমাটোগ্রাফটা পড়ে ছিল সাদা পা-অলা টেবিলটির উপর

মুহূর্তেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই আমি। ভাইকে ঘুম থেকে তুলে, দেন-দরবার শুরু করে দিই। আমার কাছে থাকা টিনের শত সৈন্যের বিনিময়ে, সিনেমাটোগ্রাফটি চেয়ে বসি। ড্যাগের যেহেতু বিশাল একটি আর্মি আছে, আর সে যেহেতু বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করে বেড়ায় সব সময়, এই প্রস্তাব উভয়পক্ষকেই খুশি করে।

সিনেমাটোগ্রাফটি হয়ে যায় আমার

তৃণভূমিতে শুয়ে আছে এক তরুণী
তৃণভূমিতে শুয়ে আছে এক তরুণী

এটা কোনো জটিল যন্ত্র ছিল না। আলোর উৎস ছিল একটা প্যারাফিন ল্যাম্প; আর ক্র্যাঙ্কটি সংযুক্ত ছিল একটা কগহুইল ও একটা ম্যাল্টেজ ক্রসের সঙ্গে। এই ম্যাটাল বক্সটির পেছন দিকে ছিল একটা সাদামাটা রিক্লেক্টিং মিরর; লেন্সটির পেছনে রঙিন ল্যানটার্ন স্লাইডের একটি স্লট। যন্ত্রপাতির মধ্যে আরও ছিল একটা চারকোণা পার্পেল বক্স– যেটিতে ছিল কয়েকটি গ্লাস স্লাইড আর একটি সেপিয়া-কালারের ফিল্ম স্ট্রিপ [থার্টি ফাইভ এমএম]। দৈর্ঘ্যে তিন মিটারের মতো ছিল এটা, আর একটা লুপের মধ্যে ছিল আঠা দিয়ে আটকানো। আবরণে লেখা থাকা তথ্য থেকে জানা যায়, ফিল্মটির নাম মিসেস হোল। এই মিসেস হোল যে কে– সে কথা তখন কেউ না জানলেও, পরবর্তী সময়ে জানতে পেরেছিলাম, ভূমধ্যাঞ্চলের দেশগুলোর ভালোবাসার দেবীর সমতুল্য জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।

পরের দিন সকালে নার্সারির প্রশস্ত ওয়ারড্রবে আবারও ঢুকে পড়ি আমি; একটা মিষ্টির বাক্সের মধ্যে সিনেমাটোগ্রাফটি জুড়ে দিই, জ্বালিয়ে দিই প্যারাফিন ল্যাম্প, আর আলোর কিরণের মুখ ঘুরিয়ে দিই সাদা দেয়ালের ওপর। তারপর লোড করি ফিল্মটা।

দেয়ালে ভেসে ওঠে একটা তৃণভূমির ছবি। তৃণভূমিতে শুয়ে আছে এক তরুণী; পরনে দৃশ্যতই স্বদেশি পোশাক। এরপর আমি হাতলটা ঘুরাই! সেই মুহূর্তটিতে বর্ণনা করা অসম্ভব আমার পক্ষে। আমার সে সময়ে উত্তেজনাকে প্রকাশ করার কোনো শব্দই খুঁজে পাব না আমি। তবে কোনো এক মুহূর্তে গরম ধাতবের গন্ধ, মথবলের সুবাস আমার নাকে এসে লেগেছিল, আর ওয়ারড্রবের ধুলায় নিজেকে মনে হয়েছিল যেন এক পাগলাটে মানুষ। দেয়ালে প্রকম্পিত সেই চতুষ্কোণের দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে আমার।

আমি হাতল ঘুরাতেই, মেয়েটি জেগে গেলো, উঠে বসলো, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো, আড়মোড়া দিয়ে টানটান করল হাত, উল্লসিত হলো, তারপর হারিয়ে গেল ডানদিকে। আবার হাতল ঘুরাতেই, সে শুয়ে পড়ল আবারও; তারপর ঠিক আগের মতোই, অবিকল একই কাণ্ড বারবার করে যেতে থাকল।

বাহ, সে তো নড়ছিল!

অনুবাদরুদ্র আরিফ

পরের কিস্তি । আতঙ্ক ও বিস্ময়ের পারদ

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

3 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here