আফ্রিকান সিনেমা: পরিচয়, সঙ্কট ও উত্তরণের পথ…

445

মূল হ্যান্স-ক্রিশ্চিয়ান মানকে ।। অনুবাদ রুদ্র আরিফ


আধুনিক সমাজ তথ্য নির্ভর ও তথ্য-চালিত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তার একটি হলো– সিনেমা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও অন্যান্য গণমাধ্যমের সাহায্যে আমাদের সমাজগুলোতে প্রবেশপথ খোঁজার শক্তিধর সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদে নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে পরিহার করা। এই চ্যালেঞ্জটির প্রতি জবাবের অংশ হিসেবে, বর্তমানের গণমাধ্যমগুলোতে হাজির থাকা কর্তৃত্বপরায়ণ সংস্কৃতিগুলো থেকে আলাদা করে ও নির্ভুলভাবে আমাদেরকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম– এমন সাহিত্য, সিনেমা, ক্রিয়েটিভ আর্ট প্রোডাকশনগুলোর নির্মাণ ও বিস্তার ঘটানোর মধ্য দিয়ে, আমাদের ভ্যালু সিস্টেমগুলোর চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
• থাবো এমবেকি; সাবেক রাষ্ট্রপতি, দক্ষিণ আফ্রিকা
[কিউবার হাভানা ইউনিভার্সিটিতে, ২৭ মার্চ ২০০১ তারিখে প্রদত্ত, দ্য আফ্রিকান রেনেসাঁ : আফ্রিকানস ডিফাইনিং দেমসেলভস শীর্ষক বক্তৃতা]

ফ্রিকান সিনেমা : আফ্রিকান চোখে আফ্রিকা ও বিশ্বকে দেখা

আফ্রিকান সিনেমা– একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অভিব্যক্তি; আফ্রিকান সিনেমা– একটি সুনির্দিষ্ট স্টাইলের অনুসন্ধান এবং এলিয়েন ইনফ্লুয়েন্স বা বহিরাগত প্রভাবপ্রতিপত্তি থেকে বের হয়ে আসার একটি রাস্তা। তাছাড়া, আফ্রিকান সিনেমা পালন করে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা– সমাজের স্বদেশি পরিমণ্ডলে [শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি/বিনিয়োগের প্রশ্নে] যার একটি প্রভাব রয়েছে। আর, আফ্রিকান সিনেমা হলো একটি উঁচুমানের শৈল্পিক সিনে-নির্দিষ্ট মৌলিকত্বের প্রক্রিয়া– যেটি কিনা বিশ্ব-সিনেমায় একটি টাটকা স্বরের যোগান দিতে সক্ষম।

আফ্রিকান ফিল্মমেকারদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ হলো– নিজেদের বাস্তবতাকে নিজেদের চোখ দিয়েই পরীক্ষা করে দেখা, এবং সেটিকে অকৃত্রিমভাবে ফুটিয়ে তোলা। আফ্রিকান শুদ্ধতা, ত্রুটি, বিবেক, পাগলামি, দ্বিধা, ভালোবাসা, বেপরোয়াপনা, উদ্বেগ, কর্মদক্ষতা, গণমানুষ… সবকিছু ঠিক যে রকম, সে রকমভাবেই দেখানো।

এই উপনিবেশোত্তর যুগে, আফ্রিকান দেশগুলোর অধিকাংশই যদিও দরিদ্র অর্থনীতি ও কাঠামোগত নানাবিধ ঝামেলায় জর্জরিত, সামাজিকভাবে সঙ্ককটপূর্ণ; তবুও নান্দনিকতা ও প্রাণচাঞ্চল্যের সঙ্গে ফিল্মিধারার একটি উচ্চতর বাস্তবধর্মী বৈশিষ্ট্যের বিকাশ  এখানে ঘটেছে। আর আত্মপরিচয় নিয়েই এখানকার ফিল্মগুলো জায়গা করে নিচ্ছে উগাডুগু [বুরকিনা ফাসো], ডারবান, কেপ টাউন [দক্ষিণ আফ্রিকা], এডিনবার্গ [স্কটল্যান্ড], কান [ফ্রান্স], টরোন্টো [কানাডা] ও বার্লিনের [জার্মান] মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বিশেষ করে আফ্রিকান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে। তবে দায়বদ্ধতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে কমবেশি জড়িত।

যদিও আমরা একটা গ্লোবাল-ভিলেজের বাসিন্দা, এবং এটি ই-ইনফরমেশন চালিত সময়, তথ্যের ওয়ার্ল্ড-ওয়াইড-ওয়েব ও ডাউনলোড এখন কেবলই একটি ক্লিকের মামলা, আর সামাজিক গণমাধ্যমের কর্তৃত্বে সামাজিক অভ্যুত্থান ঘটে যাচ্ছে মুহূর্তে, সরকার পড়ছে মুখ থুবড়ে; তবু, ভিডিওশপ, সিনেমা হল এবং ‘অ্যামাজন’-এর মতো অনলাইন সেল এজেন্সিগুলোতে আফ্রিকান সিনেমা খুঁজে পাওয়াটা এখনো দুরূহই রয়ে গেছে। আর, শুধুমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে, এই দ্রুতবিস্তারী অথচ অকালপক্ক প্রশংসিত ভিডিও-অন-ডিমান্ড প্লাটফর্মগুলো কোনো রকম দ্বিধাহীন সম্ভাবনাকে ধারণ করতে পারবে কিনা– যার মধ্য দিয়ে আফ্রিকান সিনেমার জন্য দীর্ঘ প্রতিক্ষীত ‘ব্রেকথ্রু’র দেখা মেলতে পারে

লাইফ, অ্যাবোভ অল । অলিভার সমিৎস; দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০১০
লাইফ, অ্যাবোভ অল । অলিভার সমিৎস; দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০১০

আফ্রিকান সিনেমা : লড়াই চলমান…

এ মহাদেশের ফিল্মমেকারেরা সবসময়ই যে সব ঘটনা ও চ্যালেঞ্জের একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি, পূর্বাভাস, সাফল্য, এবং বাধা-বিপত্তি ও নৈরাশ্যের একটি সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে এগিয়েছেন, আফ্রিকান সিনেমার ক্ষেত্রে, গত দশ থেকে বিশ বছরের নানা বিকাশ সত্ত্বেও, সেগুলো আজো বর্তমান। নিজেদের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত দর্শকের সামনে হাজির করতে গিয়ে, প্রয়োজনীয় ফান্ডের অভাব, ডিস্ট্রিবিউশন সম্ভাব্যতার অভাব, আর সিনেমা-হলে দর্শকের অভাব– এ সব সমস্যার সঙ্গে এই মহাদেশে, আফ্রিকান ফিল্মমেকারদের দশকের পর দশক ধরে লড়ে যেতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারগুলোতে উৎপাদিত সস্তামানের প্রোডাকশনের ছড়াছড়ি অব্যাহত থাকায়, আর একটি সাংস্কৃতিক এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রভাবে, আফ্রিকায় সিনেমা ও টেলিভিশনের অন্তর্নিহিত উন্নতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এ উন্নয়ন কোনো বিলাসিতা নয়– যেমনটি নিজেদের নাটকীয় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে কিছু আফ্রিকান রাষ্ট্রে ঘটতে দেখা যায়। এটি একটি আশু প্রয়োজনীয়তা; এমনকি তা অপরিহার্যও বটে। সিনেমা ও টেলিভিশন প্রোডাকশনে আফ্রিকার নিজস্ব সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমেই শুধুমাত্র কারও পক্ষে জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সাংস্কৃতিক ভেদাভেদ ও সামাজিক বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।

আফ্রিকাকে নিজের দুর্দশা কিংবা একধরনের উদ্ভটত্বের মধ্যে সঙ্কুচিত করে নির্মিত ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান মাস-মিডিয়া প্রোডাকশনগুলোর সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকে পেরিয়ে এসে, আফ্রিকান সিনেমাগুলো এ মহাদেশের বৈচিত্র্যময়তা এবং এর চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলোকে একটি ভিন্নতর অন্তর্দৃষ্টি-সহকারে জাহির করে। উসমান সেমবেন ও তার ভাই-বন্ধুদের সিনেমাগুলো– যা কিনা বর্তমান বিশ্ব-সিনেমার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে যথার্থই বিবেচিত হচ্ছে, তা এখন পর্যন্ত গ্লোবাল মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপে শুধুমাত্র একটি প্রান্তিক ভূমিকাই পালন করতে পেরেছে। যদিও সাম্প্রতিক আফ্রিকান সিনেমাগুলো নিয়মিতই জায়গা করে নিতে পারছে নানা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, এবং জিতে গেছে বেশ কয়েকটি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড; কিন্তু তা ঘটছে শুধুমাত্র একটি বিক্ষিপ্ত ও আনসিস্টেমিক ভিত্তিতে।

অবশ্য, প্রচলিত এই  প্রবণতার কিছু ব্যতিক্রমও আমরা দেখেছি– ইউ-কারমেন ইখায়েলিস্তা [মার্ক ডর্নফোর্ড-মে; ব্রিটেন-দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০০৫], সৎসি [গ্যাভিন হুড; দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০০৫], স্কিন [অ্যান্থনি ফ্যাবিয়ান; ব্রিটেন-দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০০৮], লাইফ, অ্যাবোভ অল [অলিভার সমিৎস; দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০১০] কিংবা ভিভা রিভা!র [জো তুন্ডা ওয়া মুঙ্গা; কঙ্গো; ২০১০] মতো ফিল্মগুলোর মাধ্যমে; তবে এগুলো অর্জন কিন্তু ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবেই রয়ে গেছে। আর হ্যাঁ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার মতো আরও কিছু দেশও আছে, যেখানে চ্যালেঞ্জগুলোকে বেশ সাফল্যের সঙ্গেই উৎরে আসা গেছে বলে মনে হয়– যদিও তা ভিন্ন উপায়ে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং ভিন্ন ফল নিয়ে; কিন্তু মহাদেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতি রয়ে গেছে অনেকটা ১৯৭০-১৯৮০ দশকের মতোই।

ইউ-কারমেন ইখায়েলিস্তা . মার্ক ডর্নফোর্ড-মে; ব্রিটেন-দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০০৫
ইউ-কারমেন ইখায়েলিস্তা । মার্ক ডর্নফোর্ড-মে; ব্রিটেন-দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০০৫

উসমান সেমবেন [১৯২৩-২০০৭; সেনেগাল], জোলা মাসেকো [১৯৬৭-; স্কজিল্যান্ড], জ্যঁ-পিয়ের বেকোলো [১৯৬৬-; ক্যামেরুন], সিৎসি দাঙ্গানেম্বগা [১৯৫৯-; জিম্বাবুয়ে], বালুফু বাকুপা-কানিয়ান্দা [১৯৫৮-; কঙ্গো] ও জিহান এল-তাহরি’র [মিসর] মতো ফিল্মমেকারদের আইডিয়া ও প্রণোদনার ওপর ভিত্তি করে, এবং ‘দ্য সওয়ানে ডিক্লেয়ারেশন’ [২০০৬] ও ‘দ্য এইউ ডাকার ডিক্লেয়ারেশন’ ও ‘ দ্য ঢাকার প্ল্যান অব অ্যাকশন অন দ্য প্রমোশন অব এসিপি কালচারস অ্যান্ড কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর [২০০৩] মতো ডিক্লেয়ারেশনগুলোর রূপরেখার উদ্দেশ্যগুলো বিবেচনা করে বলা যায়– যেখানে পৌঁছানো উচিত ছিল, সেখান অব্দি পৌঁছুতে পারেনি আফ্রিকান সিনেমা

কোনো ভিনদেশীয় ইন্টারেস্টিং স্ট্যাটাসের চেয়ে বরং ভীষণ রকম কদাচিৎ সিদ্ধিলাভ করা এবং শুধুমাত্র সীমিতসংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছানো যে আফ্রিকান সিনেমার পক্ষে সম্ভব, তা আমরা দেখেছি। পৃথিবীর নানাপ্রান্তের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে পুরস্কার জয় করা সত্ত্বেও, স্থানীয় টিভি চ্যানেল কিংবা সিনেমা-হলে এই ফিল্মগুলোর নিয়মিত প্রদর্শন বলতে গেলে হয়ই না। যদিও আফ্রিকান সিনেমা দেখানোর মাধ্যমে পৃথিবীর নানাপ্রান্তের ফেস্টিভ্যালগুলোতে আফ্রিকান সিনেমার একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে; তবু সেই ফিল্মগুলোই আফ্রিকান দেশগুলোর আফ্রিকান জনগণের সামনে বলতে গেলে হাজির হওয়ার সুযোগই পায় না। আফ্রিকান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও সাম্প্রতিক ভিডিও-অন-ডিমান্ড [ভিওডি] প্ল্যাটফর্ম ফেনোমেনার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও, আফ্রিকান দর্শকেরা ব্যাপক পরিসরে বঞ্চিতই রয়ে যান। আফ্রিকা মহাদেশে ডিস্ট্রিবিউশনের কোনো যথাযথ চ্যানেল এখনো নেই। মহাদেশটিতে যে অল্প কয়েকটি সিনেমা-হল এখনো টিকে আছে, সেগুলোতে আফ্রিকান সিনেমা বলতে গেলে চালানোই হয় না। ভিডিওশপগুলোতে মূলত বিক্রি হয় অ-অফ্রিকান সিনেমা; অথচ আফ্রিকান ভোক্তাদের এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। তারা এইসব ভিডিওশপে ভিড় করেন এবং দোকান মালিকদের বিত্তবান করে তোলেন ঠিকই; কিন্তু সেখানে আফ্রিকান সিনেমা পাওয়া যায় না। তাছাড়া, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানে চান যারা, স্থানীয় সেই উদ্যোক্তাদের রয়েছে অর্থ-ঘাটতি; তাদের অবস্থাও ঠিক যেন এ অঞ্চলের ফিল্মমেকারদের মতোই

সিনেমা প্রদর্শনীর ন্যূনতম খরচ বহন করতেই হিমশিম খেতে হয় এমনতর উদ্যোক্তাদের; অথচ, প্যারিস বা ব্রাসেলস, কিংবা এমনেট-এর কোনো আরামদায়ক অফিসে বসে থাকা ডিস্ট্রিবিউটরেরা বোঝেন না, কিংবা বুঝতে চান না এই উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য ও সীমাবদ্ধতার কথা। ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান কোনো বড় শহরে আফ্রিকান সিনেমার প্রদর্শনীর আয়োজন করলে হয়তো সেটা সফল হয়; কেননা, সে ক্ষেত্রে আফ্রিকান অভিবাসী ও বুদ্ধিজীবী এবং আফ্রিকার প্রতি আগ্রহী অ-অফ্রিকান লোকজন টিকেট কেটে তা দেখার সামর্থ্য রাখেন। কিন্তু আফ্রিকায় টিকেট বিক্রির হিসেবটি এইসব উদ্যোগের প্রতি সমুচিত সাড়া দেয় না মোটেও। এইসব উদ্যোগ অর্থনৈতিকভাবে নিশ্চিত করেই কোনো টেকসই সমাধান নয়; এবং তা যেন আফ্রিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মহাসমুদ্রে এক ফোঁটা জলবিন্দুর মতোই রয়ে যায়

এ মহাদেশের ফিলমেকারদের মতো, এইসব সিনেমা প্রদর্শনীর উদ্যোগও নির্ভর করে বিদেশি ফান্ডিংয়ের ওপর; আর বিদেশি দাতাতের হাতের খেলার পুতুলের মতোই অবস্থা দাঁড়ায় এর। এ ক্ষেত্রে আফ্রিকান সরকারগুলো ও তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিকে আমরা দোষারোপ করতেই পারি। আফ্রিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এমন অক্ষমতার জন্য হলিউডের কর্তৃত্বপরায়নতাকেও দোষারোপ করা যায়। আরও দোষারোপ করতে পারি সেইসব পশ্চিমা দাতা ও প্রডিউসারদের– যাদের নিজেদের পশ্চিমা বাজার ও ফেস্টিভ্যালগুলোর প্রতি তাদের নিজেদেরই তেমন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

এর পাশাপাশি দুর্ভাগ্যক্রমে , আফ্রিকান ফিল্মমেকার ও তাদের প্রডিসারদের কর্মকাণ্ড দেখেও মনে হয়, সিনেমা প্রদর্শনের স্থানীয় উদ্যোগ, স্থানীয় ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং মহাদেশটি জুড়ে সিনেমা প্রদর্শন ও ডিস্ট্রিবিউশনের নানা পথকে গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে, বরং আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান মার্কেটের প্রতিই যেন তাদের আগ্রহ বেশি। এর কারণটা হয়তো অর্থনৈতিক; কিন্তু মাঝে মধ্যে মনে হয়, আফ্রিকান দর্শককে প্রাথমিক গুরুত্বটা দেওয়া হয় না।

সৎসি । গ্যাভিন হুড; দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০০৫
সৎসি । গ্যাভিন হুড; দক্ষিণ আফ্রিকা; ২০০৫

উত্তরণের পথ…

তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, ভিওডি প্ল্যাটফর্মই সম্ভবত এ সকল সমস্যা সমাধানের পথ ও ভবিষ্যৎ; কিন্তু বাস্তবে সাফল্য পেতে হলে, আফ্রিকান নগর ও প্রান্তিক অঞ্চলের মধ্যে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও ক্রয়ক্ষমতার একটি সমান্তরাল বিকাশ ঘটানো দরকার। তাছাড়া, আফ্রিকান ফিল্মমেকারদের উচিত ‘প্যানাফ্রিকান ফেডারেশন অব ফিল্মমেকারস’কে [এফইপিএসিআই] শক্তিশালী ও পুনরুজ্জীবিত করা; এবং নিজ দেশের সরকার, নিজ দেশের দর্শক, নিজ দেশের সিনেমা-হল, নিজ দেশের ভিডিওশপ, নিজ দেশের ডিভিডি সেলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আফ্রিকান ফিল্ম প্রোডাকশনগুলো কেনা, বেচা, দেখা এবং অবশ্যই উপভোগ করার ব্যবস্থা করা।

সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আশাজাগানিয়া উত্তরণের দেখা মেলছে দর্শকের অর্থে নেওয়া উদ্যোগগুলোয়; গত দশ বছরে এর বেশ উত্থান ঘটেছে। গণ-অর্থায়নের এই উদ্যোগই সম্ভবত আফ্রিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রাণবায়ু বাঁচিয়ে রাখছে। ফান্ডিং, প্রোডাকশন ও ডিস্ট্রিবিউশনকে সুরক্ষা দেয় এটি। এই গণ-অর্থায়নে, ব্যক্তিমানুষদের নিজ নিজ জায়গা থেকে রাখা ছোট ছোট অবদানগুলো জড়ো হয়ে বড় একটা রূপ ধারণ করছে। এইসব অবদান একত্রিত হয়ে, ফিল্মটির পূর্ণাঙ্গ বাজেটের একটি বড় অংশের ভার ভাগ করে নিতে সক্ষম। তাছাড়া, যেহেতু সিনেমায় অর্থায়নের কাজে প্রচুর মানুষ জড়িত, তাই এ ক্ষেত্রে তারাও প্রোডাকশনটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে– নিজেদের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার ও অন্যান্য পরিচিতজনের সঙ্গে এ উদ্যোগের বিনিময় করে। ফলে, ফিল্মের মার্কেটিং ও ডিস্ট্রিবিউশনে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সোস্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক যেহেতু মানুষকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, ফলে এভাবেই এ কাজটি সফল হতে পারে।

তাছাড়া, কোনো ফিল্মমেকার যদি তার ফিল্মটির ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি করতে পারেব, এবং প্রোডাকশনের শুরুতেই অল্প  অল্প করে হলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ডোনেশন সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে নিজের ফিল্মটিতে প্রয়োজনীয় অর্থলগ্নির জন্য অর্থলগ্নিকারীকে আগ্রহী করে তুলতে পারবেন তিনি; এবং সেটি শেষ পর্যন্ত সেই অর্থলগ্নিকারীকে সামান্য হলেও মুনাফা তুলে নেওয়ার নিশ্চয়তা দেবে।

স্থানীয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের উচিত নিজেদের দর্শক ও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কথা মাথায় রেখে স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় পর্যায়ে মুভি কালেকশন তৈরি, এবং ভিডিওশপ ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা। আফ্রিকান দর্শক/ভোক্তাদের জন্য এমনকিছু অবকাঠামোগত জায়গা সৃষ্টি করা উচিত– যেখানে গিয়ে তারা স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় সিনে-মেটেরিয়ালের দেখা পাবেন। মুভি কালেকশন তৈরি করে, ভিডিওশপ ও লাইব্রেরি থেকে সিনেমার ডিভিডি/ভিসিডি কপি ভাড়া দেওয়া-নেওয়ার; স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক কিংবা মহাদেশিয় টিভি চ্যানেলগুলোতে [শুধুমাত্র পে-টিভি চ্যানেলেই নয়] সিনেমা সম্প্রচারের; এবং স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও মহাদেশিয় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করার ব্যবস্থা করা উচিত।

ভিভা রিভা! । জো তুন্ডা ওয়া মুঙ্গা; কঙ্গো; ২০১০
ভিভা রিভা! । জো তুন্ডা ওয়া মুঙ্গা; কঙ্গো; ২০১০

এছাড়াও, আমাদের প্রয়োজন একটি আঞ্চলিক ও একটি শক্তিধর প্যান-আফ্রিকান সম্মিলনের। হতে পারে নামিবিয়ায় নির্মিত কোনো একটি সিনেমা আটকে গেল নামিবিয়ান সীমান্তে; কাঁটাতার পেরিয়ে জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, অ্যাঙ্গোলা, দক্ষিণ আফ্রিকা, বোটসওয়ানা প্রভৃতি দেশে পৌঁছুতে পারল না সেটি। হতে পারে জিম্বাবুয়েতে নির্মিত কোনো একটি সিনেমা হয়তো প্রাথমিকভাবে জিম্বাবুয়েয়ান সীমান্তের ভেতরেই প্রদর্শন ও বিপনন করা হলো; তারপর নির্দিষ্ট দেশের সীমারেখা পেরিয়ে, বাইরের, বিশেষ করে আফ্রিকার অন্যান্য দেশের দর্শকের কাছেও তো সিনেমাটিকে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। ন্যাশনাল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলোর এই আঞ্চলিক সম্মিলনটি ঘটা আবশ্যক; এবং এতে করে স্থানীয় ফিল্মমেকারদের দর্শক পরিধির সীমানা বেড়ে যাবে। কেননা, শুধুমাত্র নিজ দেশের সীমারেখার মধ্যে সিনেমাকে আটকে রাখলে, আদতে আফ্রিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো ছোটই রয়ে যাবে

আফ্রিকান দর্শকরা গড়পরতাভাবে পশ্চিমা সিনেমার অনুরাগী। তারা সুযোগ পেলেই পশ্চিমা সিনেমা দেখতে চান এবং সাম্প্রতিক নলিউডি [নাইজেরিয়া] ফিল্মগুলো তার অনুকরণের দেখা মেলে। কিন্তু দর্শকেরও রুচি বদলের দরকার আছে। স্থানীয় ভিডিওশপ, সিনেমা-হল ও জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তারা সচরাচর আফ্রিকান সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন না। যদি এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে, যদি আফ্রিকান দর্শক তথা ভোক্তারা জেগে ওঠেন, তাহলে আফ্রিকান সিনেমার থেমে যাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। কেননা, জগতে আফ্রিকানদের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি; তার মানে, ১০০ কোটিরও বেশি ভোক্তা রয়েছে এ খাতে। এ হিসেবটিকে হেলা করা ঠিক হবে না নিশ্চয়ই।


হ্যান্স-ক্রিশ্চিয়ান মানকে। জন্ম : ১৯৭৮। নামিবিয়ান ফিল্মমেকার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সিনে-উদ্যোক্তা

সূত্র : আফ্রিকান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিউইয়র্ক

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here