বার্গম্যান অথবা বারিমনের আত্মজীবনী [কিস্তি-৩]

394

ইংমার বারিমন। ইংরেজি উচ্চারণ ইঙ্গমার বার্গম্যান নামে অধিক পরিচিত সুইডিস মাস্টার ফিল্মমেকার। দ্য ম্যাজিক লেন্টার্ন শিরোনামে প্রকাশিত তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি সিনেবিশ্বের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটবুকও বটে। সেই গ্রন্থের এই ধারাবাহিক অনুবাদ…

 আগের কিস্তি । মা যেদিন মারা গেলেন


আমার পাপ, আমার প্রতারণা

মাদের প্রজন্মের বেশিরভাগেরই বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে, শিশু ও বাবা-মা আর ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্কগুলো ছিল পাপ, পাপ-স্বীকার, শাস্তি, ক্ষমা ও অনুগ্রহের কংক্রিট বিষয়আশয়ে ভরা। আমরা যা যা মেনে নিয়েছি এবং উপলব্ধি করতে পেরেছি, তার মধ্যে এইসব বিষয়ের সপক্ষে একটি সহজাত যুক্তি ছিল। নাৎসিবাদকে আমাদের বিস্ময়করভাবে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সম্ভবত এ বিষয়টিই কাজ করেছে। স্বাধীনতার কথা কোনোদিনই শুনিনি আমরা; এর স্বাদই বা কেমন– সে কথা এতটুকুও জানা হয়নি। একটি ধর্মীয় অনুশাসনের ভেতর সবগুলো দরজাই ছিল [আমাদের জন্য] বন্ধ। ফলে শাস্তি ছিল এমনই এক সুস্পষ্ট জিনিস, যেটি নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন তুলিনি। সেগুলো ছিল হয়তো সুতীব্র ও সোজাসাপ্টা, হয়তো মুখে একটা চড় কিংবা পশ্চাতে একটা চাবক; কিন্তু তা [মাঝে মধ্যে] চরম বিভ্রান্তিকরও হয়ে ওঠত– প্রজন্মান্তরে তাড়িয়ে বেড়ানোর মতো।

[শাস্তিকালে] প্রায়শই, খুব সহজেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলতাম আমি। আর সেদিনের বাকিটা সময় একটা লালরঙা হাটু-অব্দি লম্বা স্কার্ট পরে কাটিয়ে দিতে হতো আমাকে। [শাস্তি] জিনিসটাকে নির্দোষ ও মজার হিসেবেই দেখতাম আমরা। [অবশ্য] বড় ধরনের অপরাধের জন্য ছিল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; আর তা শুরু হয়ে যেত অপরাধটি ধরা পরার পর থেকেই। ছোটখাট অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী তা নানা সময়ে স্বীকার করত কাজের মহিলা, কিংবা মাদার, কিংবা পাদ্রীর বাড়িতে থাকা অসংখ্য নারীদের কারও একজনের কাছে।

স্বীকারোক্তিকালের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সবাই চুপসে যেত
স্বীকারোক্তিকালের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সবাই চুপসে যেত

স্বীকারোক্তিকালের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সবাই চুপসে যেত। কেউ কিছু বলত না কিংবা জবাব দিত না। যতদূর মনে পড়ে, অপরাধীকে শাস্তি ও ক্ষমা পাওয়ার জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হতো। সান্ধ্যভোজ ও কফি খাওয়া শেষে, সবাইকে জড়ো করা হতো ফাদারের রুমে; সেখানে নতুন করে চলত জেরা আর স্বীকারোক্তি পর্ব। এরপর আনা হতো বেত, আর অপরাধ বিবেচনায় কতগুলো বাড়ি পাওনা– সেই হিসেব দিতে হতো অপরাধীকেই। শাস্তির মাত্রা নির্ধারিত হওয়ার পরে আনা হতো একটা সবুজরঙা শক্ত গদি। প্যান্ট আর আন্ডারওয়্যার খুলে, শুয়ে পড়তে হতো সেই গদির ওপর। তখন কেউ একজন এসে শক্ত করে ধরত অপরাধীর ঘাড়; আর কার্যকর করা বেতের বাড়ি।

ব্যাপারটা এতই যন্ত্রণাদায়ক ছিল যে, আমার সহ্য হতো না। এই ধর্মাচার আর অপমান ছিল খুব যন্ত্রণার। আর তা সবচেয়ে নিকৃষ্টভাবে পেয়েছেন আমার ভাইয়া। [এমন সময়ে] মা প্রায়শই ওর বিছানার পাশে বসে থাকতেন, বেতের আঘাতে চামড়া উঠে যাওয়া ওর পিঠ ধুয়ে দিতেন; রক্ত জমে গিয়ে ওর পিঠে বসে যেত ডোরাকাটা দাগ। ভাইয়াকে যেহেতু অপছন্দ করতাম, আর ওর হুট করে খেপে যাওয়াটাকে ভয় পেতাম খুব, তাই ঘন ঘন ওকে শাস্তি পেতে দেখে আমার বেশ তৃপ্তি হতো।

বেতের বাড়ি কার্যকর করার পর অপরাধীকে ফাদারের হাতে চুমু খেতে হতো; আর তাতে ক্ষমার ঘোষণা প্রকাশিত হতো ও অপরাধের বোঝা পড়ত ঝরে; মিলত পরিত্রাণ ও কৃপা। যদিও এ কারণে অপরাধীকে নৈশভোজ ও সান্ধ্যকালীন পাঠ ছাড়াই যেতে হতো বিছানায়; তবু এই পরিত্রাণের মানেটা ছিল অনেক বড়।

১৯২৫ সাল । বারিমনরা তিন ভাইবোন । বা থেকে ড্যাগ, মারিয়ারিটা ও ইংমার । ইংমারের বয়স তখন ৭
১৯২৫ সাল । বারিমনরা তিন ভাইবোন । বা থেকে ড্যাগ, মারিয়ারিটা ও ইংমার । ইংমারের বয়স তখন ৭

এক ধরনের স্বেচ্ছাবৃত শাস্তিরও ব্যবস্থা ছিল এখানে। আর তা যেকোনো শিশুর জন্য অন্ধকার-ভীতিতে হয়ে উঠত চরম ভয়ানক নির্যাতন। এটি হলো : বিশেষ একটি আলমারিতে [অপরাধীকে] আটকে রাখা। রান্নাঘরে অ্যালমা আমাদের আগেই বলেছেন, সেই সবিশেষ আলমারিতে থাকে একধরনের ছোট পোকা, যারা খেয়ে ফেলে দুষ্টু শিশুদের পায়ের আঙ্গুল। [এ পরিস্থিতিতে পড়ে] অন্ধকারে কিছু একটা নড়ার শব্দ আমি স্পষ্টই পেয়েছিলাম, আর ভয়ে হয়ে গিয়েছিলাম একেবারে টটস্থ। ঠিক কী করেছিলাম তখন, মনে নেই; পায়ের আঙ্গুল বাঁচাতে হয়তো উঠে গিয়েছিলাম তাকের উপর, কিংবা ঝুলে থেকেছিলাম হুক ধরে। তবে একটা সমাধান বের করে ফেলার পর, এ ধরনের শাস্তির প্রতি আতঙ্ক কেটে গিয়েছিল আমার। [সেবার] লাল-সবুজ আলোর একটা টর্চ লুকিয়ে রেখেছিলাম আলমারির এক কোণায়। [এরপর] যখন আটকে রাখা হলো আমাকে, তখন বের করলাম টর্চটা, আর [আলমারির] দেয়ালে ফেললাম আলো, আর মনে মনে ভাবলাম– সিনেমা হলে আছি। তারপর দরজা খুলতেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম ফ্লোরে; ভাব ধরলাম বেহুশ হওয়ার। মা ছাড়া বাকি সবাই বেশ ঘাবড়ে গেলেন; মা ভাবলেন, মৃগীরোগ হয়েছে বুঝি আমার। কিন্তু [টর্চের কথা] কথা কেউ টের পেল না। ফলে আর কোনো শাস্তি নেমে এলো না আমার ঘাড়ে।

[সেখানে] শাস্তি হিসেবে আরও ছিল– সিনেমা হলে যেতে না দেওয়া, কিছু খেতে না দেওয়া, বিছানায় কিংবা নিজের রুমে বসিয়ে রাখা, অতিরিক্ত হোমওয়ার্ক করানো, হাতে ভর দিয়ে হাঁটানো, চুল ধরে টানা, রান্নাঘরে কাজ করানো [এটা বেশ আনন্দের ছিল], একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কারও সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়া ইত্যাদি।

বর্তমানে এসে, বাবা-মার তখনকার হতাশাকে আমি বেশ বুঝতে পারি। অ্যাপাস্টোরের পরিবার বাস করে একটা চেপ্টা থালার ওপর; অন্যের চোখ থেকে অনিরাপদ অবস্থায়। জনতার কাছ থেকে আসা সমালোচনা ও মন্তব্যের জন্য সবসময়ই খোলা রাখতে হয় পাদ্রীর বাড়ির দরজা। এই অন্যায্য চাপে পিষ্ঠ মা ও বাবা– উভয়েই ছিলেন নিখুঁতচারী। তাদের কাজের সময়কাল ছিল অশেষ, তাদের দাম্পত্য-জীবন ছিল জটিল, তাদের আত্মসংযম ছিল ইস্পাত-কঠিন। তাদের দুই পুত্রের আচার-আচরণ তাদেরকে অবিরাম শাস্তি এনে দিত। ভাইয়া ছিলেন অবাধ্য, নিজেকে বাঁচাতে পারতেন না তিনি। তাকে পথে আনার জন্য সর্বশক্তি উজাড় করে দিয়েছিলেন বাবা; এবং সফলও হয়েছিলেন অনেকটা। আর আমার বোন ছিল বাবা-মা দুজনেরই ভীষণ প্রিয় ও বাধ্য। বিগলিত ও বিনম্র নাজুকভাবে সাড়া দিত সে।

'মিথ্যে বলার সময় মানুষ ঠিক কী করে– সেই ভাবনাটা স্পষ্ট মনে করতে পারি'
‘মিথ্যে বলার সময় মানুষ ঠিক কী করে– সেই ভাবনাটা স্পষ্ট মনে করতে পারি’

আমার ধারণা, মিথ্যুক হিসেবে নিজেকে সেরা করে তুলতে পেরেছিলাম আমি। নিজের মধ্যে করতে পেরেছিলাম এমন এক বাহ্যিক ব্যক্তিকে সৃষ্টি, যাকে ভেদ করে সত্যিকারের আমার দেখা মিলত না খুব একটা। আমার এই সৃষ্টি আর ব্যক্তি আমিকে আলাদা কী করে রাখব– তা জানতাম না বলে আমার জীবন ও সৃষ্টিশীলতা যৌবনের অনেকটা সময়জুড়ে পড়েছে ক্ষতির মুখে। মিথ্যের ভেতর বাস করে যে মানুষ, সে আসলে ভালোবাসে সত্যকে– মাঝে মধ্যে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে

আমার স্পষ্ট মনে আছে সচেতনভাবে মিথ্যে বলার প্রথম ঘটনাটি। বাবা তখন হয়েছেন হাসপাতালের চ্যাপলেইন। আমাদেরকে গিয়ে উঠতে হলো স্টকহোমের লিল-জ্যানসকোজেনকে ঘিরে রাখা বিশাল পার্কটির এক প্রান্তে, হলুদরঙা এক বাড়িতে। কনকনে শীতের দিন। পার্কের এক কোণায়, গ্রিনহাউজে ভাইয়া আর তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিলাম স্নোবল। আর তাতে গ্রিনহাউজটির অনেকটুকু কাচ গেল ভেঙে। আমাদেরকেই সন্দেহ করলেন মালী; নালিশ ঠুকে দিলেন বাবার কাছে। জেরা চলল। তিনি আর তার বন্ধুটা এ কাণ্ড করেছেন– স্বীকার করলেন ভাইয়া। আমি তখন রান্নাঘরে, দুধ খাচ্ছি; কিচেন-টেবিলের দিকে পেছন ফিরে ছিলেন অ্যালমা। কাজের মেয়ে সিরি এসে ঢুকল রান্নাঘরে; বয়ান করল, ভয়ানক শাস্তির অগ্রগতির কথা। এই দস্যুপনার সঙ্গে আমি যুক্ত কিনা– জানতে চাইল। আমি তো ততক্ষণে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই বসে আছি সবকিছু অস্বীকার করে [প্রমাণের অভাবে সাময়িক দায়মুক্তিও ঘটে গিয়েছিল আমার]। একটা কাচও ভাঙতে আমি সফল হয়েছিলাম কিনা– সিরি যখন এ কথা জানতে চাইল কৌতুক করে, তখনই বুঝে গেলাম, সে আসলে চাইছে আমাকে ফাঁদে ফেলতে। তাই শান্ত গলায় দিলাম জবাব : কী হচ্ছে– স্রেফ তা দেখতেই খানিক ক্ষণের জন্য গিয়েছিলাম সেখানে, আর স্নোবল মেরেছি অল্প কয়েকবার, তাও আস্তে করে– ভাইয়ার গায়ে; এরপরই চলে এসেছি, কারণ, ঠাণ্ডায় পা জমে যাচ্ছিল আমার। মিথ্যে বলার সময় মানুষ ঠিক কী করে– সেই ভাবনাটা আমি [এখনো] স্পষ্ট মনে করতে পারি।

এ ছিল এক ব্যাপক আবিষ্কার। মলিয়েরের ডন জুয়ান-এর মতো একই রকম যুক্তিসঙ্গতভাবে আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একজন ‘হিপোক্রেট’ হয়ে ওঠার। সফল যে সবসময়ই হয়েছি, তা বলব না : [তবে] অভিজ্ঞতার অভাবকে শোধ দিতে মাঝেমধ্যে হেঁটে গেছি আদ্যোপান্ত; আবার কখনো কখনো থমকে গেছি মাঝপথেই।

'সাদা পোশাক পরে, অতিকায় এক কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ে আছে অল্পবয়সী এক নারী'
‘সাদা পোশাক পরে, অতিকায় এক কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ে আছে অল্পবয়সী এক নারী’

আমাদের পরিবারে অ্যানা আন্টি নামের একজন ভীষণ ধনী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নানা ভেলকিবাজি ও আরও আরও বিনোদন যোগানো শিশুতোষ পার্টিগুলোতে তিনি আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন। সবসময় দামি দামি আর ভীষণ লোভনীয় ক্রিসমাস গিফট উপহার দিতেন আমাদের; আর প্রতি বছর জুরগার্ডেনে অনুষ্ঠিত দ্য স্কুমান সার্কাসের প্রিমিয়ার দেখাতে নিয়ে যেতেন। এই ঘটনা আমার মনে এক ধরনের বিলাসী রোমাঞ্চের জন্ম দিতো : অ্যানা আন্টির, ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভারের সঙ্গে গাড়িতে করে, বিশাল এক আলোকোজ্জ্বল কাঠের দালানে ঢোকা– কেমন গোপন-গোপন সব ঘ্রাণ, অ্যানা আন্টির সুবিশাল ও ঝমকালো হ্যাট, অর্কেস্ট্রার সুরমূর্চ্ছনা, নানা আয়োজনের জাদু আর সার্কাস এন্টারেন্সের লাল পর্দার আড়াল থেকে ভেসে আসা বাঘ ও সিংহের গর্জন। কেউ একজন ফিসফিসিয়ে বলেছিল, কাপুলা বা গোলাকার গম্বুজের নিচে, অন্ধকারে আচমকাই একটা সিংহ ঢুকে পড়েছিল, আর ক্লাউনেরা হয়ে পড়েছিল আতঙ্কিত ও মারমুখী। নির্ভেজাল আবেগে ভেসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি; আর জেগে উঠেছি চমৎকার সব মিউজিক শুনে : দেখি, সাদা পোশাক পরে, অতিকায় এক কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ে আছে অল্পবয়সী এক নারী।

আমি এই অল্পবয়সী নারীটির প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সব কল্পনার খেলায় জায়গা করে নিয়েছিল সে; তাকে আমি এসমেরাল্ডা নামে ডাকতাম [হয়তো এটাই তার নাম ছিল]। আমার কল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তব জগতে একটা সর্বগ্রাসী বিপজ্জনক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। স্কুলে আমার পাশে যে ছেলেটা বসত, নিসে নাম ছিল তার। গোপনীয়তার শপথ নিয়ে, তার ওপর ভরসা করলাম আমি। তাকে বলে দিয়েছিলাম, বাবা-মা আমাকে স্কুমানের সার্কাসে বেচে দিয়েছেন; বাড়ি ও স্কুল–শিগগিরই দুটোই ছাড়তে যাচ্ছি আমি– জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী, এসমেরাল্ডার সঙ্গে অ্যাক্রোব্যাটের ট্রেনিং করতে। পরের দিন আমার এ কল্পনা ফাঁস হয়ে গেল; ঘটে গেলো এর সম্ভ্রমহানি

বিষয়টিকে আমার ক্লাসটিচার এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন যে, মায়ের কাছে একটা কড়া চিঠি লিখে বসলেন। ভয়ানক এক দৃশ্য ছিল সেটি। বাড়িতে ও স্কুলে আচ্ছামতো অপদস্থ ও হেনস্থা হতে হতে, দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে গেল আমার।

ক্লাসরুমে ইংমার [বাঁ থেকে দ্বিতীয়]
ক্লাসরুমে ইংমার [বাঁ থেকে দ্বিতীয়]

এর ৫০ বছর পর মাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে সার্কাসে বিক্রি করে দিতে চাওয়ার সেই ঘটনাটা তার মনে আছে কিনা; তিনি জানালেন, বেশ ভালোভাবেই আছে। জানতে চাইলাম, এমনতর কল্পনা আর দুঃসাহসের পরিচয় পেয়ে কেন সেদিন কেউ হেসে ওঠেনি কিংবা অন্তত উষ্ণ আনন্দ পায়নি? সাত বছর বয়সী একটা ছেলে কেন বাড়ি ছাড়তে চায়, আর কেনই বা বিক্রি হয়ে যেতে চায় কোনো সার্কাসে– এর গভীর রহস্য কেউই কি চায়নি খুঁজে দেখতে? মা বললেন, আমার মিথ্যাচার আর অলীক কল্পনার কারণে ইতোমধ্যেই তাদেরকে বহুবার বহু ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। রাগে-ক্ষোভে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, চিকিৎসকের কাছে ধর্ণা দিতে হয়েছিল তাকে। চিকিৎসক জোর দিয়ে বলেছিলেন, কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারাটা অমন অল্পবয়সে একজন শিশুর জন্য শিখে নেওয়া কতটা জরুরি। যেহেতু তারা [বাবা-মা] এমন একটা ধৃষ্টতাপূর্ণ ও প্রকট মিথ্যের মুখোমুখি হয়ে পড়েছিলেন, সেটির জন্য শাস্তি আমার পাওনা ছিলই।

আমি আমার সেই পুরনো বন্ধুটির ওপর প্রতিশোধ নিয়েছিলাম– আমার ভাইয়ের খাপঅলা-ছুরিটা হাতে নিয়ে, স্কুলের পুরো প্লেগ্রাউন্ডে তাকে তাড়া করার মাধ্যমে। আমাদের দুজনের মাঝখানে একজন টিচার এসে দাঁড়ালে, সেই ভদ্রমহিলাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম আমি! এরপর কয়েক দফা আচ্ছামতো পেটানো হয়েছিল আমাকে; বের করে দেওয়া হয়েছিল স্কুল থেকে। পরে, আমার সেই নকল বন্ধুটা পোলিও আক্রান্ত হয়ে মরে গেলে, বেশ শান্তি পেয়েছিলাম! এর প্রতিক্রিয়ায় তিন সপ্তাহের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল পুরো স্কুলে; তারপর [আবার স্কুল খুলতেই,] বেমালুম ভুলে গেছি সবকিছু।

তবে তখনো এসমেরাল্ডাকে কল্পনা করা থামেনি আমার; আর তাতে আমাদের রোমাঞ্চ হয়ে ওঠে আরও বেশি বিপজ্জনক; আর আমাদের ভালোবাসা হয়ে ওঠে আরো বেশি সুতীব্র আবেগময়। এরইমধ্যে, আমার বিশ্বস্ত খেলার সাথী টিপ্যানের সঙ্গে প্রতারণা করে, আমাদের ক্লাসেরই ছাত্রী– গেন্ডিস নামের এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে নিই নিজেকে।

অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

পরের কিস্তিপ্রথম জ্বর, প্রথম শিহরণ
 
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

2 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here