লিখেছেন । জাহেদ সরওয়ার
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বইপ্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। দেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক খুব বেশি বইপত্র নাই এটা পীড়াদায়ক। ঘুরে ফিরে সেই বাণীশিল্পের বই। একটা পরিকল্পনা করেছিলাম। দেশে যারা চলচ্চিত্র নিয়ে গভীরভাবে কাজ করছেন, তাদের দিয়ে কিছু বইপত্র লেখাবো। তারই সূত্র ধরে প্রথম তারেক মাসুদের সঙ্গে পরিচয়। ফোনালাপের পরদিনই বাসায় যেতে বললেন। আমার চাইতেও উনি বেশি উৎসাহী। প্রথম সাক্ষাতে যা জানলাম, তা হচ্ছে, উনিও বহুদিন ধরে এ ধরনের একটা প্রজেক্টের কথা ভাবছেন। আর নিজের লেখাগুলোও গোছাচ্ছেন। উনি গ্রহণ করতে জানতেন। একেবারে নিখাদভাবে।
ফেব্রুয়ারি বইমেলা এলো বলে। বইটা গোছানোর সংকটকালীন বেদনার চাইতেও আনন্দিত হই তার সঙ্গ পাওয়ায়। কারণ, চলচ্চিত্র পরিচালক হলেও তারেক মাসুদের সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো বিশ্বসাহিত্য নিয়ে। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া যে কত বড় সহনশীলতার পরিচায়ক, তাকে দেখে আরেকবার অনুভব করি। বলা যায় যিনি আমাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন, তিনি গাব্রিয়েল গাসিয়া মার্কেজ। মার্কেজের হেন বই নাই, যা তারেক মাসুদের পড়া ছিল না। বলা যায় মুখস্থ। নিজেও এক সময় পাগলের মতো মার্কেজ পড়েছি। সে সব দিনকে মার্কেজময় বললেও অত্যুক্তি হয় না। যদিও মার্কেজকে এখন উপন্যাসের আঙ্গিকের কারণে যত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, বিষয় বা বক্তব্যের জন্য তত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।
যাইহোক, তখন রানওয়ে রিলিজ হয়েছে। অদ্ভুত পরিকল্পনা তার। এ ছবি হলে দেখানো হবে না। এমনকি ঢাকায়ও দেখানো হবে না। তাহলে দেখব কেমনে? তিনি বলেন, রাজধানীতে দেখানো হবে সারাদেশে দেখানো পর। তিনি নিজের পরিকল্পনা মতো কাজ করেছিলেন। ছবিটা নিয়ে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। আমার জানা নেই এই রকম কমিটেড কোনো পরিচালকের কথা। তিনি বলেন, যাদের জন্য ছবিটা বানিয়েছি, তারা যদি দেখতে না পেলো, তো কাজটাই অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। যখন যেখানে যাচ্ছেন, ম্যাসেজ লিখে জানাচ্ছেন। একদিন চট্টগ্রাম থেকে ফোন দিচ্ছেন, অন্যদিন খুলনা থেকে ফোন দিচ্ছেন। শিশুর মতো উচ্ছ্বল তারেক মাসুদকে দেখতে থাকি। বলছেন, তিনি ছবি দেখাচ্ছেন; মানুষ ছবি দেখতে আসছে– এটাও আসলে তার গবেষণার বিষয়। সে সব দৃশ্যও তিনি চিত্রায়ণ করছেন নিয়মিত। এটাও হতে পারে আরেকটা ছবি।
এর মাঝেই একদিন ফোন করে বলেন, অমুক তারিখ তুমি এসো। আলী রিয়াজও আসবে; রানওয়েটা দেখে ফেলো। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রানওয়ে দেখতে যাই। মার্কিন প্রবাসী রিয়াজ ভাই তারেক মাসুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তুই-তোকারি সম্পর্ক। [জানি না এই সংবাদ শুনে তার কী অবস্থা হয়েছিলো]। রিয়াজ ভাইসহ সেদিন বসে রানওয়ে দেখি তারেক মাসুদের বসার ঘরে প্রজেক্টরে। রানওয়ে দেখতে গিয়ে প্রথম যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছিলাম, তা হচ্ছে– ক্যামেরার কাজ। এত পরিপক্ক নিপুণ ক্যামেরার কাজ দেখে মনটা ভরে উঠল আশায়। এত উন্নতি হয়েছে আমাদের ছবির। তখনই জানতে পারলাম মিশুক মুনীরের কথা।

যাইহোক, রানওয়ে দেখার পর আমাদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। অসাধারণ বাগ্মী রিয়াজ ভাই যে দৃষ্টিকোণ থেকে ছবিটিকে দেখলেন এবং ব্যাখ্যা করলেন, মুগ্ধ হয়ে আমরা শুনলাম। নিজের পালা এলে বললাম, লিখিত জানাব। এরপর রানওয়ে নিয়ে তৎকালীন সাপ্তাহিক মিডিয়াওয়াচে একটা লেখা লিখি– রানওয়ে : পথ জানে না পথের দিশা নামে। পরে লেখাটা প্রবন্ধ সংকলন রাজ্য ও সাম্রাজেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রকাশিত হবার পর তারেক ভাইকে ম্যাসেজ পাঠাই। বিকালের দিকে তিনি ফোন করে বলেন, তোমার বিতর্কেও জায়গাটা বুঝতে পেরেছি। আমি আসলে ছবিটাতে কোনো সমাধানই দেখাতে চাইনি। যাইহোক, সে বিতর্ক তার বাসায় বসেও আমরা করেছি দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে বিতর্কে অংশ নিতেন ক্যাথরিনও। শিশু নিষাদও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াত বসার ঘরে।
আমার কথা ছিল, রানওয়ের জঙ্গী হতে যাওয়া ছেলেটা ফিলসফিক্যালি কনভার্টেট। সে কিন্তু সঙ্গদোষে জঙ্গী বা মুক্তির পথ খুঁজতে যায়নি। তার বাবা সৌদি আরব গেছে কাজের খোঁজে গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে। মা গ্রামীণ ব্যাংকের লোন শোধ করতে করতে শেষ। ছোটবোনটি ১৫০০ টাকায় গার্মেন্টে চাকরি করে সারাদিন; মাঝে মাঝে রাতেও। টাকার অভাবে তার আর মাদ্রাসায় পড়া হলো না। কোথায় তার মুক্তি। সে মামার কম্পিউটারের দোকানে কর্মরত জঙ্গী ছেলেটার সাথে চলে যায়। পরে সে দেখে জঙ্গীদের কাজকর্ম। তারা সিনেমা হল উড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে, তাদের সাথে আবার জড়িত মধ্যপন্থীদলগুলো। স্রেফ রক্ত দেখেই কি ছেলেটা ভয় পেয়েছিল? এই হানাহানি দেখে সে ফিরে আসে আবার। কিন্তু সে কোথায় ফিরল। একটি অমীমাংসিত সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে। এর মানে, প্রচলিত ব্যবস্থাকে সে মেনে নিলো। এই ছিল বিতর্কের জায়গা।
তিনি বলেছিলেন, এখানে নয়, অন্য কোনোভাবে আসবে মুক্তি। সেই অন্য কোনোটা দেখানোর দায়িত্ব চলচ্চিত্র পরিচালকের নয়। আমি বললাম, তাহলে তো এটা সেই পুরানো কেচ্ছাই হয়ে গেলো যে, অবশেষে তারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল। এরপর আসত ইলমাজ গুনের কথা, আসত ওসমান সেমবেনের কথা– যারা ক্যামেরাকে বুলেটের মতো ব্যবহার করেছেন, তাদের কথা। আমি বললাম, আমি খুশি হতাম যদি ছেলেটা জঙ্গী হামলায় মারা যেতো। চলচ্চিত্র মানে তো শুধু ছবি তোলা নয়; চলচ্চিত্রওতো কিছু একটা বলতে চায়। এভাবেই বারবার তার সাথে আমার তর্কটা জমে ওঠলেও শেষে হতো না। কিন্তু নিজেকে উৎরানোর প্রচেষ্টা তার মজ্জাগত। সেটা তার ছবিগুলো পরপর দেখলে বুঝা যায়। হেঁটে যাবার অনেক পথ সম্মুখে তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি; হেঁটে যেতেনও– যতদূর যাওয়া যায়। তিনি বলতেনও, আমি পথ পেয়ে গেছি জীবনের; এবার শুধু চলা। কিন্তু কে আসলে তাকে চলতে দিল না– আমার বোধগম্য নয়। এ দেশে জন্ম নেওয়াটাই কি তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর একমাত্র কারণ?