টু
স্ক্রিনপ্লে, ফিল্মমেকিং ও মিউজিক । সত্যজিৎ রায়
প্রডিউসার । ইএসএসও ওয়ার্ল্ড থিয়েটার
সিনেমাটোগ্রাফার । সৌমেন্দু রায়
এডিটর । দুলাল দত্ত
অভিনেতা । রবি কিরণ ও জনৈক স্ট্রিট-কিড
ধরণ । সাইলেন্ট ফিল্ম
রঙ । সাদা-কালো
রানিংটাইম । ১৫ মিনিট
দেশ । ভারত
মুক্তি । ১৯৬৪
ভূমিকা ও সংগ্রহ । আলম কোরায়শী
ই.এস.এস.ও. [ESSO] কোম্পানি একবার টেলিভিশনে প্রদর্শনের জন্য ওয়ার্ল্ড থিয়েটার পর্যায়ের একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করে। সেই চলচ্চিত্রটি ছিল বিভিন্ন দেশে থেকে সংগৃহীত নানা বিষয়ের উপর। গ্রীস, সুইডেন, ইংল্যান্ড থেকেও কিছু কিছু বিষয় সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই ছবির একটি অংশ ছিল ব্যালে নৃত্যের উপর এবং অপর অংশ ছিল ওস্তাদ রবিশঙ্করের সেতার বাদন এবং সেইসঙ্গে পরিচালকের বীরভাষ্য। ছবি দুটির মাঝখানে জুড়ে দেওয়ার জন্য কোম্পানি সত্যজিৎ রায়কে ১৬ মিলিমিটার ফিল্মে ইংরেজি ভাষায় একটি ছোট্ট কাহিনীচিত্র নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়।
তাদের সেই অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে ইংরেজি সংলাপে বাংলা ছবি নির্মাণে সত্যজিৎ রায়ের মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। তাই তিনি অনেক চিন্তাভাবনার পর শেষ পর্যন্ত দুটিমাত্র শিশু চরিত্রকে নিয়ে একটি নির্বাক ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ছবিটি ছিল ১৫ মিনিটের এবং তাতে কোনো সংলাপ ছিল না।
ছবিটি তিনদিনের মধ্যে শেষ করতে হয়েছিল। সেজন্য শিশু দুটিকে আগে থেকে ছবির কাহিনী বা চরিত্র বলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিচালকের নির্দেশ মতোই শিশু দুটি অভিনয় করে গিয়েছিল, এবং পরে এডিটিং টেবিলে বসে ছবিটিকে দাঁড় করানো হয়।
এ ছবির কাহিনী ছিল এক ধনীলোকের ছেলে আর এক দরিদ্রলোকের ছেলেকে নিয়ে। আগের দিন ধনী ছেলেটির বাড়িতে উৎসব হয়ে গেছে। তার রেশ তখনও সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছেলেটিকে একা বাড়িতে রেখে ছেলের মা বাইরে যায়। তখন ছেলেটি দোতলায় তার ঘরে ঢুকে তার খেলনাগুলো নিয়ে খেলতে থাকে। তারপর একটা বাঁশির সুর শুনে জানালা দিয়ে বাইরে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে, এক দরিদ্র কিশোর ছেলে একটি বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে। তা দেখে সে একটি খেলনা ক্লারিওনেট নিয়ে বাজাতে থাকে। তখন দরিদ্র কিশোর ছেলেটি একটি খেলনা ঢোল নিয়ে এসে বাজাতে থাকে। তখন ধনী ছেলেটি একটি মাংকি-ড্রাম বাজায়। তখন দরিদ্র ছেলেটি জংলীদের মতো একটি মুখোশ পরে ধনী ছেলেটিকে একটি বর্শা দেখাতে থাকে। ধনী ছেলেটি তখন জানালা দিয়ে দেখে, দরিদ্র ছেলেটি একটি ঘুড়ি ওড়াতে। এবার ধনী ছেলেটি এয়ারগান দিয়ে ঘুড়িটাকে ফাঁসিয়ে দেয় এবং সে খুশিতে জয়ের টীকা হিসাবে রোবটের কপালে চুইংগাম লাগিয়ে দেয়। কিন্তু নিচে থেকে আবার বাঁশির সুর বেজে ওঠে।
এই গল্পের ওপরই সত্যজিৎ রায় প্রথমে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করেন। তবে সাধারণত যেভাবে চিত্রনাট্য লেখা হয়, এটা ঠিক সেভাবে লেখা হয়নি। কোনো সংলাপ না থাকায় এবং তাড়াতাড়ি করার জন্য তিনি শুধু কয়েকটি শটের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। সত্যজিৎ রায় ঠিক যেভাবে এই চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, এখানে হুবহু সেভাবেই উদ্ধৃত করা হলো :

স্ক্রিপ্ট
শট ১
দিন। মধ্য কলকাতার একটি দোতলা বাড়ির পের্টিকো। ক্যামেরা দোতলার খোলা বারান্দায় ধরা। ধনী কিশোরটি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে। ছেলেটার মাথায় একটা মিকি মাউস ক্যাপ এবং বাম হাতে একটা কোকাকোলার বোতল। নেপথ্যে একটা গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শোনা যায়।
শট ২
ক্যামেরা উপরের বারান্দা থেকে নিচে বেরিয়ে যাওয়া গাড়িটিকে দেখে। ধনী ছেলেটা সামনে। একটা বড় শেভ্রলে গাড়ি গেটের দিকে যায়। গাড়ি থেকে এক মহিলা ছেলেটার দিকে হাত নাড়ে। ধনী ছেলেটার ক্লোজ-আপ। সেও হাত নাড়ায়। তারপর সে একজন মদ্যপের মতো কোকাকোলার বোতল থেকে এক ঢোক পান করে এবং চলে যাওয়ার জন্য মুভ করে।
শট ৩
দোতলার সিঁড়ি। ধনী ছেলেটা বারান্দা থেকে ভেতরে আসে এবং ডানদিকে হাঁটতে হাঁটতে তার সামনে পড়ে থাকা একটা রাবারের বলকে লাথি মেরে তার পথ থেকে সরিয়ে দেয়।
শট ৪
বেশ বড় ড্রয়িংরুম। ভালোভাবে সাজানো। আগের দিন হয়ে যাওয়া একটা পার্টির চিহ্ন রয়েছে; সারা ঘরে বেলুন, খেলনা ইত্যাদি। ধনী ছেলেটা ঘরের মধ্যে ঢুকে লাফ দিয়ে সোফায় বসে, তারপর বেশ আরাম করে সিলিংয়ের দিকে তাকায়।
শট ৫
ইলেকট্রিক ফ্যান থেকে ঝোলানো একগুচ্ছ বেলুনের শট।
শট ৬
ধনী ছেলেটার ক্লোজ-আপ শট। সে কোকাকোলার বোতল শেষ করে, তারপর তার হাত ডানদিকে ছড়িয়ে দেয়।
শট ৭
টেবিলের ক্লোজ-আপ শট। ধনী ছেলেটা কোকাকোলার বোতল নামিয়ে রাখে। একটা দেয়াশলাই তুলে নেয়।
শট ৮
ধনী ছেলেটার ক্লোজ-আপ। সোফায় শুয়ে আছে। মেঝে থেকে তিনটা বেলুনের একটা গোছা তুলে নেয় সে। দেয়াশলাই থেকে একটা করে কাঠি বার করে একটা করে বেলুনে আগুন দেয়। বেলুনগুলো সশব্দে ফেটে যায়। ধনী ছেলেটা উঠে বসে।
শট ৯
ড্রয়িংরুমের লংশট। ধনী ছেলেটা সোফা থেকে উঠে তার ডান হাত পকেটে ঢোকায়; একটু চুইংগাম বার করে আনে। সে ডানদিকে হাঁটতে থাকে।
শট ১০
ধনী ছেলেটার ঘর। ছেলেটা চুইংগাম চিবাতে চিবাতে ঘরে ঢোকে। সেফল ডিভান এবং মেঝেতে অনেক নতুন খেলনায় ভর্তি। মেঝেতে প্লাস্টিক ইটের একটা মনুমেন্ট। ধনী ছেলেটা মনুমেন্টের কাছে যায় এবং আর একটা প্লাস্টিকখণ্ড মনুমেন্টের ওপর স্থাপন করে।

শট ১১
ধনী ছেলেটা এবার সেলফের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় এবং সেলফের উপর থরে থরে সাজানো যান্ত্রিক খেলনাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে। একটা মাংকি ড্রাম, একটা রোবট, একটা পাইপার, একটা ভালোলিন বাদক। নেপথ্যে থেকে একটা বাঁশের বাঁশির সুর ভেসে আসে। ধনী ছেলেটা শোনে এবং ডানদিকে যায়।
শট ১২
জানালার বাইরে থেকে শুটিং। ধনী ছেলেটা জানালায় আসে এবং জানালা দিয়ে বাইরে নিচের দিকে তাকায়।
শট ১৩
ধনী ছেলেটার দৃষ্টিকোণ থেকে শট : একটা পোড়া জমিতে একটা ঝুপড়ি। একটা দরিদ্র ছেলে একটা বাঁশঝাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে।
শট ১৪
ধনী ছেলেটা কৌতুহলভরে তা দেখে শট থেকে বেরিয়ে যায়।
শট ১৫
ধনী ছেলেটা সেলফ থেকে একটা খেলনা ক্লারিওনেট তুলে নেয় এবং জানালার দিকে যায়।
শট ১৬
ধনী ছেলেটা জানালায় ফিরে ক্লারিওনেটটা ফুঁ দিয়ে বাজাতে থাকে।
শট ১৭
গরিব ছেলেটা দেখে। বাঁশি বাজানো থামায়। ঝুপড়ির দিকে চলে যায়।
শট ১৮
ধনী ছেলেটা ক্লারিওনেট বাজানো থামায়। পরে কী হয়– দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
শট ১৯
গরিব ছেলেটা দৌড়ে বাইরে আসে, একটা খেলা ঢোল বাজায়।
শট ২০
ধনী ছেলেটা দেখে এবং বেরিয়ে যায়।

শট ২১
ধনী ছেলেটা সেফল থেকে মাংকি ড্রামটা তুলে নেয়, জানালার দিকে যায়।
শট ২২
ধনী ছেলেটা জানালার সামনে। গরিব ছেলেটা অনেক দূরে ঢোল বাজাচ্ছে। ধনী ছেলেটা মাংকি ড্রামে চাবি চালিয়ে দেয়। ঢোল এবং ড্রাম একসঙ্গে বাজতে থাকে।
শট ২৩
গরিব ছেলেটা দেখে। চোখে মুখে প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটে। ঢোল বাজানো থামায়; দৌড়ে ঝুপড়ির ভেতরে ঢোকে। তারপর একটা মুখোশ পরে এবং একটা বর্শা হাতে বেরিয়ে এসে জংলীদের মতো লাফাতে লাফাতে ধনী ছেলেটাকে বর্শা দেখাতে থাকে।
শট ২৪
ধনী ছেলেটার প্রতিক্রিয়া; এবং সে বেরিয়ে যায়।
শট ২৫
গরিব ছেলেটা লাফানো থামায়। অপেক্ষা করে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শট ২৬
ধনী ছেলেটাকে জানালায় দেখা যায়, একটা মুখোশ পরা। সে গরিব ছেলেটাকে একটা তলোয়ার দেখায়।
শট ২৭-২৯
ধনী ছেলেটার নানারকম মুখোশ পরা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখানোর মন্তাজ শট।
শট ৩০
গরিব ছেলেটাকে বিধ্বস্ত এবং পরাজিত মনে হয়। সে ঝুপড়ির ভেতরে চলে যায়।
শট ৩১
ধনী ছেলেটা বিজয়ের আনন্দে ঘরের ভেতর চলে যায়।

শট ৩২
ধনী ছেলেটা সেলফের সামনে গিযে দাঁড়ায়; একটা চুইংগাম তুলে নেয়; সেটা রোবটের কপালে লাগিয়ে দেয় এবং বামদিকে চলে যায়।
শট ৩৩
ধনী ছেলেটা ড্রইংরুমের মধ্যে দিয়ে হেঁটে প্যানট্রির দিকে যায়।
শট ৩৪
ধনী ছেলেটা প্যানট্রির মধ্যে ঢোকে, রেফ্রিজারেটর খোলে, একটা আপেল নেয় এবং বামদিকে বেরিয়ে যায়।
শট ৩৫
ধনী ছেলেটা তার ঘরে আসে; পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে আপেলটা চিবাতে থাকে।
শট ৩৬
জানালা। জানালা দিয়ে একটা ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়। ঘুড়িটা জানালার কাছে ঘুরে ফিরে এবং গোত্তা খেয়ে যেন ব্যঙ্গ করে উড়তে থাকে।
শট ৩৭
ধনী ছেলেটা চিন্তিতভাবে জানালার দিকে যায়।
শট ৩৮
গরিব ছেলেটাকে ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যায়। সে ধনী ছেলেটাকে দেখে এবং হাসে।
শট ৩৯
ধনী ছেলেটার প্রতিক্রিয়া তার মুখ লাল হয়ে যায়। সে আকাশের দিকে তাকায়।
শট ৪০
আকাশে ঘুড়ি উড়ছে।

শট ৪১
গরিব ছেলেটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, মাঝে মাঝে ধনী ছেলেটার দিকে তাকাচ্ছে।
শট ৪২
ধনী ছেলেটা জানালা থেকে সরে যায়। সে একটা গুলতি নিয়ে ফিরে আসে। সে ঘুড়িটার দিকে তাক করে গুলতি ছোড়ে।
শট ৪৩
গুলোগুলো ঘুড়ির গায়ে লাগে না।
শট ৪৪
গরিব ছেলেটা ধনী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসে।
শট ৪৫
ধনী ছেলেটা আবার গুলতি ছোড়ে। কিন্তু এবারও লাগে না।
শট ৪৬
রাগে ধনী ছেলেটার কপাল কুঞ্চিত হয়।
শট ৪৭
ধনী ছেলেটা গুলতি ফেলে দিয়ে একটা নতুন এয়ারগান তুলে নেয় এবং গুলি ভরে, জানালার দিকে যায়।
শট ৪৮
আকাশে ঘুড়ি।
শট ৪৯
গরিব ছেলেটা উপরের দিকে তাকিয়ে ধনী ছেলেটাকে দেখে, বন্দুক দেখে ভীত হয়।
শট ৫০
বন্দুকসহ ধনী ছেলেটার লংশট।

শট ৫১
ধনী ছেলেটার বন্দুক দিয়ে ঘুড়িটাকে লক্ষ করার ক্লোজ-শট। সে গুলি ছোড়ে।
শট ৫২
ঘুড়িতে গুলি লাগে এবং ঘুড়িটা ফেঁসে যায়।
শট ৫৩
গরিব ছেলেটা কঠিন মুখে ধনী ছেলেটার দিকে তাকায়।
শট ৫৪
ধনী ছেলেটা গর্বভাবে হাসে।
শট ৫৫
গরিব ছেলেটা সুতো গোটাতে থাকে।
শট ৫৬
গরিব ছেলেটা নিজের দিকে ছেঁড়া ঘুড়িটা টেনে আনে। সে ঘুড়িটাকে হাতে তুলে নেয়; ভারাক্রান্ত মনে ধীরে ধীরে চলে যায়।
শট ৫৭
ধনী ছেলেটা জানালা থেকে চলে যায়।
শট ৫৮
ধনী ছেলেটা সেলফের কাছে আসে; সব যান্ত্রিক খেলনাগুলোকে দম দিয়ে চালিয়ে দেয়। তারপর সে রোবটটাকে তুলে নেয়, দম দিয়ে মেঝেতে ছেড়ে দেয়। রোবটটা হাঁটতে শুরু করে।
শট ৫৯
ধনী ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়; সুখী কিন্তু তার কপাল সংশয়ে কুঞ্চিত হয়। নেপথ্য থেকে একটা বাঁশির সুর শুনতে পায়।
শট ৬০
রোবটটা হাঁটতে থাকে।
শট ৬১
ধনী ছেলেটার ঘরে লংশট। গরিব ছেলেটার বাঁশিতে আনন্দের সুর বাজতে থাকে। ধনী ছেলেটা বিরক্তি এবং বিভ্রান্তিতে সোফার ওপর শুয়ে পড়ে। রোবটটা হাঁটতে হাঁটতে মনুমেন্টটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। প্লাস্টিকের ইটগুলো সশব্দে মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ে।
বাঁশির সুখী সুর চলতে থাকে।
গ্রন্থ-সূত্র »» চলচ্চিত্রের নানা কথা-- এফডিসিতে ৩০ বছর/ আলম কোরায়শী
প্রকাশক : এডর্ন পাবলিকেশন; ঢাকা। প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১২ । পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১১০ । মূল্য : ২০০ টাকা