৮ জুলাই ২০১৬। আব্বাস কিয়ারোস্তামির মৃতদেহ প্যারিস থেকে তেহরানে এসে পৌঁছুলে, এই কিংবদন্তী ফিল্মমেকারের প্রতি শেষ-শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ইরানের শত শত ফিল্মমেকার, প্রডিউসার, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ নানা শিল্পমাধ্যমের আরও অনেক গুণীজন উপস্থিত হয়েছিলেন…
লেখা : রেডিও জামানা প্রতিবেদক । অনুবাদ : আশিকুর রহমান তানিম
কিয়ারোস্তামি, যিনি তার সিনেমা দিয়ে সাধারণ ইরানি মানুষদের জীবনে কাব্যিক আবহের সূচনা ঘটিয়েছিলেন, জুলাইয়ের ৪ তারিখ, প্যারিসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ৭৬ বছর বয়সী এ ফিল্মমেকার বেশ কিছুদিন ধরেই আন্ত্রিক ক্যান্সারে ভুগছিলেন। কিয়েরোস্তামির শবদেহ বিমানযোগে প্যারিস ত্যাগের পূর্বে, তার দুই পুত্র আহমাদ ও বাহমান সেখানেই তার জন্য একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যারা এই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছিলেন, তারা প্যারিসের সিন নদীর তীরে সারারাত জেগে কাটিয়েছেন। অতঃপর কিয়ারোস্তামির ভক্তকূলের আনা, প্রিয় ফিল্মমেকারের শত শত ছবি সিন নদীর ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই ইরানের সবচেয়ে বিখ্যাত ফিল্মমেকার শত শত প্রবাসী ইরানির কাছ থেকে পান শেষ বিদায়!
কিয়ারোস্তামির আরেকটি শেষকৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল তেহরানে, জুলাইয়ের ১০ তারিখে। তার শবদেহ সেই ইনস্টিটিউট অব ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডাল্ট প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখান থেকে ফিল্মমেকার হিসেবে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। কিয়ারোস্তামি তার অনেক সাক্ষাৎকারেই এই ইনস্টিটিউটের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, এখানেই তিনি ফিল্মমেকার হিসেবে তৈরি হয়েছেন; এই জায়গাটিকে তিনি অভিহীত করতেন ‘শিল্পী তৈরির কারখানা’ বলে।

অবশ্য তেহরানে আয়োজিত শেষকৃত্যে হাজির হতে পারেননি কিয়ারোস্তামির পুত্র আহমাদ। রাজনৈতিক কারণে দেশে ফেরা নিয়ে নিরাপত্তাজনিত শংকা ছিল তার। তবে এক আবেগঘন ফেসবুক স্ট্যাটাসে আহমাদ কিয়ারোস্তামি তার বাবার শেষকৃত্যে যারাই উপস্থিত থাকবেন, তাদের সবচেয়ে সুন্দর সাজসজ্জায় আসার আহবান জানিয়ে রেখেছিলেন। তিনি লিখেছেন,
আপনারা যদি আমার বাবাকে বিদায় জানাতে আসতে চান, দয়া করে আপনাদের সবচেয়ে সুন্দর জামাটাই পরে আসবেন। সেটা হবে আমার বাবার সৃষ্টিশীল ও পরিপূর্ণ জীবনের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান।
অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতা-অভিনেত্রীই তেহরানের হাউস অব আর্টিস্ট-এ জড়ো হয়েছিলেন; সেখান থেকে তারা বিমানবন্দরে যান শ্রদ্ধেয় ফিল্মমেকারের শবদেহ গ্রহণ করতে। ইরানের মুসলিম উপদেষ্টা মন্ত্রণালয়ের সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন; তারা লাল গালিচা পেতেই প্রিয় এই মানুষের নিথর দেহ বরণ করে নেন। ফিল্মমেকার, স্ক্রিপ্ট রাইটার ও ইরানিয়ান হাউস অব সিনেমা’র বর্তমান সিইও রাজা মীরকারিমি অবশ্য ইরানি সরকারের এই লাল গালিচা সংবর্ধনাকে সমালোচনা করে আবেগঘন একটি বিবৃতি দেন। মীরকারিমি ইরানি সরকারদলীয় লোকদের উপস্থিতিকে ব্যঙ্গ করেই তার বক্তৃতায় বলেন,
স্বাগতম গৃহকর্তা! আমাদের এমন স্বাগতম গ্রহণ করুন, যেটা কখনোই আপনার কাছে পৌঁছাবে না!
![তেহরান । ফিল্মমেকার দারিউশ মেহরজুই-সহ [ডানে] অন্য ফিল্মমেকার-শিল্পীদের বিমর্ষ অপেক্ষা](https://www.filmfree.org/wp-content/uploads/2016/08/ff_Abbas-Kiarostami-body-arrives-in-Tehran-10.jpg)
কিয়ারোস্তামির আরেক পুত্র বাহমান তার বাবার মৃতদেহ ফ্রান্স থেকে নিয়ে এলেও, সুস্থ বোধ না করায় কোনো বিবৃতি দেননি। কিয়ারোস্তামির মৃতদেহ দেশে পৌছানোর আগেই, শত শত ইরানি জনগণ দীপ জ্বেলে তেহরানের রাস্তায় শোক প্রকাশ করতে থাকে। ইরানি রাজনীতিকরা, বেশিরভাগই মডারেট রিফর্মিস্ট গ্রুপের, টুইটারে তাদের প্রিয় পরিচালকের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে টুইট করেন। রাষ্ট্রপতি হাসান রোহানি জুলাইয়ের ৫ তারিখে করা একটি টুইটে লিখেন,
গভীর জীবনবোধ ও বন্ধুত্ব এবং শান্তির বার্তাই কিয়ারোস্তামির কীর্তি হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
এই কিংবদন্তি ফিল্মমেকারের ফিল্মগুলো মূলত কষ্ট ও মৃত্যুকালীন মানবিক সম্পর্কের দিকটিতে আলোকপাত করেছে। তার বেশিরভাগ ফিল্মই জীবনঘনিষ্ঠ; তার ফিল্মে বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি ও একের প্রতি অন্যের অনুভূতি ফুটে উঠেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। তার মৃত্যু তাই দেশের ও দেশের বাইরের প্রায় সব মিডিয়ায়ই শিরোনাম হয়েছে। সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ তার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ন্যুব্জ হয়ে, শোকবার্তা প্রকাশ করেছে।
কিয়ারোস্তামির প্রায় সব সিনেমাই ইরানে বানানো; তবু এগুলোতে মানবিক সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটেছে বলেই সারা বিশ্বের দর্শকদের মনে দাগ কেটে গেছে। তার টেস্ট অব চেরি ফিল্মটিতে যেখানে একজন হতাশ মানুষকে আত্মহত্যার জন্য সাহায্যকারী খুঁজতে দেখা যায়, সেটি ১৯৯৭ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার– পাম দি’অর জয় করেছিল।
সূত্র : রেডিও জামানা'র ওয়েবসাইট। ৯ জুলাই ২০১৬