লিজিয়া: হলিউডি এলান পো বিচার

359
এডগার এলান পো'স লিজিয়া
বিকল্প শিরোনাম দ্য টম্ব
ফিল্মমেকার মাইকেল স্টাইনিংগার
মূল গল্প লিজিয়া [এডগার এলান পো]
স্ক্রিনপ্লে জন শার্লি
মিউজিক প্যাট্রিক ক্যাসিডি
অভিনয় ওয়েজ বেন্টলে [জোনাথন]; ম্যাকেঞ্জি রজম্যান [লরেলি]; সোফিয়া স্কাইয়া [লিজিয়া]; কাইটলিন ডাবললেডি [রোয়েনা]
মুক্তি ১৪ মে ২০০৯যুক্তরাষ্ট্র

লিখেছেন জাহেদ সরওয়ার


 

যৌনতা এই সময়ের সবচাইতে লাভজনক ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইটের সিংহভাগই যৌনতাকেন্দ্রিক মানুষের কল্পিত বা অকল্পিত যতরকম যৌনবাসনা আছে,  সেসবের বাস্তবরূপ এই ওয়েবসাইটগুলো মানুষ হিসাবে নারীর মর্যাদা সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করার মূর্ত প্রতীক যেহেতু মূল সভ্যতাটাই এখন দাঁড়িয়ে আছে ডাকাতি, রাহাজানি বা নির্বিচারি বাণিজ্যের ওপরএই ব্যবসাটাকেও তাদের ভাষায় দেখতে হবে স্রেফ লাভজনক ব্যবসা হিসাবে কারণ, মূর্তবিমূর্ত সবকিছুই এখন ব্যবসা শুধু ওয়েবসাইটগুলো নয়, সারা পৃথিবীতে প্রভাববিস্তারি বিশাল চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি– হলিউডের অধিকাংশ ছায়াছবিরও বিষয় এই যৌনতা এমনকি হলিউডের ভারতীয় ভার্সন– বলিউডি ছায়াছবিরও অধিকাংশ এখন যৌনতানির্ভর সমস্ত মানবিক অমানবিক কাহিনীর ভেতরই তারা এই যৌনতা প্রয়োগ করেএবং দর্শকদের এই আদিম বাসনাকে উসকে দিয়ে মত্ত করে রাখে সম্প্রতি লিজিয়া ছবিটা দেখে এই ধারণা আরও বদ্ধমুল হলো লিজিয়া ছবিটা মূলত কিনেছিলাম এডগার এলান পোর নাম দেখে ডিভিডির কাভারে  লেখা ছিল এডগার এলান পো’স লিজিয়া।

লিজিয়া । এ রকম ক্ল্যাসিক রহস্য-গল্প নিয়েও হলিউডিরা যৌনতা আর হত্যাব্যবসা করে
লিজিয়া । এ রকম ক্ল্যাসিক রহস্য-গল্প নিয়েও হলিউডিরা যৌনতা আর হত্যাব্যবসা করে

এডগার এলান পো লেখক হিসাবে বড় কিনা– সে প্রশ্ন অবান্তর প্রায় পাঠকের ছোটবেলায় পড়া এলান পোর লোমহর্ষক গল্পগুলো আর ফরাসি কবিগুরু মহাত্মা শার্ল বোদলেয়ারের এলান পোর কবিতা নিয়ে মাতামাতি, এলান পোকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে একটা আলাদা আসন দেয় এলান পোর  গল্পগুলোর আঙ্গিক বিষয়বস্তুর কারণে ইতিমধ্যে ক্ল্যাসিক পর্যায়ে উন্নীত এলান পোর গল্পগুলোর মধ্যে ভয়ের আবহ থাকলেও ভায়োলেন্স প্রকাশ্য নয় যৌনতা তো নাই বললেই চলে কিন্তু হলিউডি পরিচালক মাইকেল স্টাইনিংগার এই লিজিয়া গল্পটিকে একটি ভায়োলেন্স যৌনতাকেন্দ্রিক হলিউডি হরর থ্রিলারে পরিণত করেছেন

এলান পোর রচনাসমগ্র পড়েছিলাম বেশ আগে ছবিটা দেখে অবিশ্বাস্য ঠেকায় ফের লিজিয়া গল্পটা পড়ে অবাক হয়ে যেতে হলো গল্পটার মধ্যে যা নাই, তা দিয়ে ছবিটা বানানো গল্পটার সমগ্র স্বকীয়তা, সমস্ত সম্ভাবনাকে ধুলিসাৎ করে রূপান্তর করা হয়েছে একটা রগরগে যৌন ফ্যান্টাসিতে

এলান পোর লিজিয়া গল্পটা বলতে গেলে পুরোটাই আফিম সেবনকারী এক কত্থকের বয়ান এলান পো দুর্দান্ত সংবেদনশীল কবি গল্পকার তিনি বুঝেছিলেন, তার বানানো এই গল্পটার যদি বৈজ্ঞানিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন কী হবে তাই তিনি এই লোমহর্ষক গল্পটা বলিয়েছেন এক আফিম সেবনকারী স্মৃতিভুককে দিয়ে গল্পটায় লিজিয়া চরিত্রটি অষ্টাদশ শতকের কোনো ইউরোপীয় বিদুুষীর চিত্র গল্পটার কত্থকের মুখ থেকে শুনলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে

অবশ্য লিজিয়ার সৌন্দর্যের বিষয়ে আমার স্মৃতি লোপ পায় নাই সে ছিল দীর্ঘ, একহারা, শেষের দিকে কিছুটা ক্ষীণকায়া তার আচরণে মাহাত্ম্য শান্ত সরলতা তার চালচলনে মসৃণতা যতক্ষণ সে শ্বেতমর্মরোপম হাতখানি আমার কাঁধে রেখে মধুর সুরে আমার নাম ধরে না ডাকত, ততক্ষণ পর্যন্ত সে যে আমার ঘরে ঢুকেছে– তা আমি বুঝতেই পারতাম না সে যেন আফিম ফুলের স্বপ্নে ভরা উজ্জ্বলতা, এক বায়বীয় আত্মিক সৌন্দর্য– যা দেবত্বের মহিমায় মহিমান্বিতরূপের কথা রেখে এবার লিজিয়ার জ্ঞানের কথায় আসি অগাধ পাণ্ডিত্য– কোনো নারীর মধ্যে এমনটি আমি দেখিনি প্রাচীন ভাষায় তার দক্ষতা সুগভীর আর ইউরোপের আধুনিক ভাষাসমূহ আমি যতদূর জানি, তাতে কখনও কোথাও তাকে ভুল করতে দেখিনি যত দিন কেটেছে, ততই তার বিদ্যাবৈদগ্ধে আমি মুগ্ধ হয়েছি

লিজিয়া । মানুষকে হত্যা করে তার প্রাণবায়ুকে বন্দি করে রাখে
লিজিয়া । মানুষকে হত্যা করে তার প্রাণবায়ুকে বন্দি করে রাখে

অবশেষে সেই লিজিয়া যখন মরে যায়, তখন নায়কের অবস্থা হয়েছিল খানিকটা মজনু বা দেবদাসের মতো কিন্তু তবুও এরপর সে বিয়ে করে লেডি রোয়েনাকে সে রোয়েনাকে ধীরে ধীরে লিজিয়া হয়ে উঠতে দেখে আশ্চর্য হয় এবং পাঠকদের চমকিত করে এখন আমরা যদি প্রশ্ন করি এলান পো মশাইকে, ইহা কি সম্ভব? তখন তিনি বলবেন, সম্ভবের প্রশ্ন নহে হে! নায়ক কিন্তু আফিমসেবী মাতাল একটা কী দেখতে কি দেখেছে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! এখানেই গল্পকারের শ্রেষ্ঠত্ব

কিন্তু মাইকেল স্টাইনিংগার পরিচালিত লিজিয়া লিজিয়া চরিত্রটাই একটা উদ্ভট ব্ল্যাক ম্যাজিক জানা মহিলা, যে মানুষকে হত্যা করে তার প্রাণবায়ুকে বন্দি করে রাখে আর তা দিয়ে ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করে মারাত্মক যৌনপ্রবণ লিজিয়া যৌনদৃশ্য দেখে হলিউডি প্রথম শ্রেণির পর্ণছবি দেখার অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় সমস্ত ছবির কেন্দ্রবিন্দু দুটি সঙ্গমদৃশ্যএবং সামগ্রিকভাবে লিজিয়া চরিত্রটাকে স্বাভাবিক পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমনভাবে চিত্রায়ণ করা হয়েছে যে, সমস্ত মহিলাদের প্রতিই একটা বিরূপ ধারণা তৈরি হতে বাধ্য কারণ লিজিয়া নায়ককে তার গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বিয়ে করে এমনভাবে কবজা করে রাখে যে, সে লিজিয়ার ইশারা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না একের পর এক হত্যা তো আছেই

এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, কেন এমন ঘটে? এ রকম ক্ল্যাসিক রহস্য-গল্প নিয়েও কেন হলিউডিরা যৌনতা আর হত্যাব্যবসা করে? এর সবকিছুর জবাব এক ব্যবসায় হত্যা যৌনতা এখন সবচাইতে বড় ব্যবসা— যা মার্কিনিরা গোটা দুনিয়াজুড়ে প্রসারিত করেছে তাদের ছবি দেখে মনে হতে পারে, নারী কেবলই একটা যৌনযন্ত্র নারীদের মানুষ ভাবার সমস্ত সম্ভাবনাকে ধ্বংস  করে দেয় হলিউড তথা আমেরিকা যৌন স্বাধীনতাই একমাত্র নারী স্বাধীনতা– এই তাদের বলবার বিষয় না হলে এডগার এলান পোর লিজিয়ার মতো এত অসাধারণ একটা নারী চরিত্রকে বেশ্যা আর পেশাদার খুনীতে রূপান্তরিত করতে তাদের হাত এতটুকু হলেও কি কুণ্ঠিত হতো না?

Print Friendly, PDF & Email
কবি ও সমালোচক। সম্পাদক : ঢাকা রিভিউ। www.Dhakareview.org। জন্ম : ১৯৭৬; মহেশখালী, কক্সবাজার, বাংলাদেশ। কাব্যগ্রন্থ : এই মিছা কবি জীবন; আততায়ী একটি কবর; বিকালের দাসবাজার; আরো একটি কবিতা শোনাও কবি; সূর্যের নিচে শুধু ভয়; নির্বাচিত কবিতা। উপন্যাস : পায়ুবাসনার জনগণ। গল্পগ্রন্থ : দস্তইয়েভস্কির বই ও কোটিপতির সকাল; সম্পর্কের সন্ত্রাস ও অন্যান্য গল্প। প্রবন্ধ গ্রন্থ : রাজ্য ও সাম্রাজ্য [রাজ্যচিন্তার কারখানা-১]; সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ [রাজ্যচিন্তার কারখানা-২]; কবিতা পড়ুয়ার নোটবই। জীবনীগ্রন্থ : ফিদেল কাস্ত্রো; নেলসন ম্যান্ডেলা

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here