কিয়ারোস্তামি : শেষ জন্মোৎসব ও অন্যান্য স্মৃতি

255

মূল : থমাস এর্ডব্রিঙ্ক । অনুবাদ : মুনতাসির রশিদ খান


ত বছরের [২০১৫] জুন মাসের এক সন্ধ্যা। তেহরানে প্রচণ্ড গরম। ছাদের বাগানে আয়োজিত ছোটখাট এক আয়োজনে সস্ত্রীক হাজির থাকার নিমন্ত্রণ পাই আমি। তেমন গুরুত্ব দেওয়ার মতো অনুষ্ঠান মনে হয়নি যদিও; তবু কোনো উপহার না নিয়েই হাজির হয়েছিলাম। পৌঁছে দেখি, কৃতী ফিল্মমেকার আব্বাস কিয়ারোস্তামির ৭৫তম জন্মোৎসব। চমক লাগানো এক মিলনমেলা ছিল সেটি। মধ্যমণি– ফিল্মমেকার, ফটোগ্রাফার ও কবি আব্বাস কিয়ারোস্তামি নীরবে, অত্যন্ত নম্রভাবে সবার অভিনন্দন গ্রহণ করছিলেন, ঠিক যেভাবে তিনি ডজন-ডজন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছেন তার ফিল্মগুলোর জন্য।

তার বিশ্বস্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট– হামিদে রাজাভি নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী, সিনেমাটোগ্রাফার, অভিনেতা-অভিনেত্রী আর আমার মতো সাংবাদিকদের, যেন জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ইরানি ফিল্মমেকার– আব্বাস কিয়ারোস্তামির জন্মদিন উদযাপন করা যায়। রাজাভি যখন আতিথ্যপনায় ব্যস্ত, কিয়ারোস্তামি তখন বসে ছিলেন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যমণি হয়ে; চোখে তার– চিরচেনা কালো সানগ্লাস। তাকে অনেকটা নিশ্চুপ আর লাজুক দেখাচ্ছিল, ঠিক বরাবরের মতোই।

কিয়ারোস্তামি । হাসপাতালের দিনগুলিতে...
কিয়ারোস্তামি । হাসপাতালের দিনগুলিতে…

নারী-পুরুষ মেলামেশা করছে কোনো সমাবেশে– এমন দৃশ্য ভাবাই যায় না কিয়ারোস্তামির ইরানে বানানো ডজনখানেক ফিল্মের কোনোটিতে। কেননা, তাকে সিনেমা বানাতে হয়েছে ইরানি সেন্সর-বোর্ডের অহেতুক রোষানল এড়িয়ে। সে চেষ্টায় সফল ছিলেন তিনি। সবসময় বাস্তবতাবাদ ও কাব্যময়তার মধ্যে ভারসাম্য রেখে, দর্শকদের কল্পনার জন্য যথাসম্ভব জায়গা রেখে দিয়েছেন তার সিনেমায়।

তার অনেক সিনেমাই আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পরিচিত, আর সমালোচকদের কাছে হয়ে উঠেছে ভীষণ প্রিয়। টেন ফিল্মে যেমন উঠে এসেছে তেহরানের রাস্তার এক নারী ট্যাক্সি চালকের গল্প, দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস-এ আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করা এক টেলিভিশন-কর্মীর কথা, এবং সার্টিফাইড কপিতে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ অভিনেত্রী জুলিয়েট বিনোশে। তবে ইরানে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দূত; সবাইকে দেখিয়েছেন– সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব নয়। নানাবিধ বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন আন্তর্জাতিক মহলে, দেশ-বিদেশের দর্শকদের কাছে।

প্রাচ্যের নানা রকম নেতিবাচক জিনিস দেখিয়ে সহজেই তিনি জিততে পারতেন পাশ্চাত্যের সহানুভূতি; কিন্তু তা না করে বরং কাজ করেছেন সার্বজনীন বিষয়বস্তু নিয়ে। তার সিনেমা ছিল ভালোবাসা, জীবন আর মৃত্যু ঘিরে নির্মিত; যদিও এসব সিনেমার পটভূমি হিসেবে তিনি ইরানকে ব্যবহার করেছেন, তবে নিশ্চয়ই ইরানই তার সিনেমার সাবজেক্ট হয়ে থাকেনি।

নিজের অরাজনৈতিক অবস্থানের পরও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দ্বন্দ্বে জড়াতে হয়েছে তাকে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের কাছে, বিদেশিদের সঙ্গে তার সম্পর্কই যথেষ্ট ছিল তাকে অবিশ্বস্ত ভাবার জন্য। সিনেমার মধ্য দিয়ে বৃহৎ একটা দর্শকগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করার সহজাত ক্ষমতা তিনি রাখতেন বলে, তার বেশকিছু সিনেমাকে বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করেছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ

১৯৯৭ সালে, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সর্বোচ্চ পদক পাম দি অর জিতে নেন তিনি টেস্ট অব চেরি সিনেমার জন্য– যেখানে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করতে থাকা এক লোক খুঁজে বেড়ায় এমন একজনকে, যে তাকে এ কাজে সহায়তা করবে। কানে পুরস্কার জিতে তিনি তেহরানে ফিরলে, নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে বাধ্য করে বিমানবন্দরের পেছন দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে। কেননা, তার এমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ক্ষেপিয়ে তুলেছিল উগ্রবাদীদের; তারা জড়ো হয়েছিল সেখানে।

চাপ সহ্য করে ইরানে থাকবেন, নাকি অন্য কোনো দেশের নতুন সংস্কৃতিতে যোগ দিয়ে নিজের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলবেন– এই উভয়সঙ্কটে ভোগা সব ইরানি শিল্পীর প্রতিরূপ ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইরানেই থেকে গেছেন; আর কাজ করে হয়ে উঠেছেন অনেক ইরানি শিল্পীর অনুপ্রেরণার উৎস।

২০১৩ সালে, শিল্পীদের জন্য কঠিন দীর্ঘ একটা সময় পার করে, প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহম্মেদিনেজাদের শাসনামলের শেষ সময়ে তিনি নির্মাণ করেন ইরানের বাইরে নিজের দ্বিতীয় সিনেমা। সেটির শুটিং হয় জাপানে। লাইক সামওয়ান ইন লাভ ফিল্মটির কেন্দ্রে আছে এক পতিতাকে ঘিরে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প : একজন তার প্রেমিক, আর আরেকজন এক বুড়ো খদ্দের। ফিল্মটি নির্মাণের সময় চরম নিঃসঙ্গতায় ভুগতে শুরু করেন তিনি। ডাচ সংবাদ পত্র দে ভোলস্কার্ট-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রতি রাতে না হলেও, অধিকাংশ রাতেই আমি কেঁদেছি এমনই এক সময়ে তার সাথে দেখা হয় আমার, তেহরান বিমানবন্দরে; তিনি তখন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দেশে ফিরেছেন, শুটিংয়ের ফাঁকে।

আসগর ফরহাদি । শোকসভায় কিয়ারোস্তামির ছবির পাশে; বিমর্ষ, অশ্রুসিক্ত
আসগর ফরহাদি । শোকসভায় কিয়ারোস্তামির ছবির পাশে; বিমর্ষ, অশ্রুসিক্ত

গত ডিসেম্বরে, কিয়ারোস্তামির অ্যাসিস্ট্যান্ট, হাসি-খুশি মানুষ হামিদে রাজাভি মারা যান এক সড়ক দুর্ঘটনায়। তার মৃত্যুতে অনেকটাই ভেঙে পড়েন কিয়ারোস্তামি। এর কিছুদিন পরই পেটের ব্যথা নিয়ে, তেহরান হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। ডাক্তারদের ভুলে একটি ভাইরাসে আক্রান্ত হন তিনি– যা থেকে শেষ পর্যন্ত পাননি রেহাই। শেষ মুহূর্তে, চিকিৎসার জন্য তাকে স্থানান্তর করা হয় প্যারিসে; সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মাস্টার ফিল্মমেকার।  

সোমবার [৪ জুলাই ২০১৬] সকালে, তেহরানে তার মৃত্যুর খবর পৌঁছুলে, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমগুলো ভেসে যায় ভক্ত আর শুভানুধ্যায়িদের শোকবার্তায়। ২০১২ সালে দ্য সেপারেশন-এর জন্য অস্কারজয়ী স্বদেশি ফিল্মমেকার আসগর ফরহাদির বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল এ মৃত্যুসংবাদ। তিনি বলেন, সপ্তাহখানেক আগেই তার [কিয়ারোস্তামির] সাথে দেখা হয়েছিল আমার। তিনি স্মরণ করেন, ল্যাপটপ হাতে বিছানায় শুয়ে ছিলেন কিয়ারোস্তামি; দেখাচ্ছিলেন চীনে তার বানানো চার মিনিট দৈর্ঘ্যের ফিল্মটি। ফরহাদি আরও বলেন, তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন; আর তা শুধু ইরানিদের জন্য নয়, বরং সারা পৃথিবীর জন্য

মঙ্গলবার হাজার হাজার ইরানি জনতা তেহরানের ফিল্ম মিউজিয়ামে জড়ো হন এ ফিল্মমেকারের প্রতি সম্মান জানাতে। এমনকি বৃদ্ধদেরও কাঁদতে দেখা যায় সেখানে। তরুণেরা জ্বালিয়ে রাখেন মোমবাতি।


থমাস এর্ডব্রিঙ্ক । জন্ম : ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৬, নেদারল্যান্ড । তেহরান ব্যুরো চিফ, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

সূত্র : দ্য নিউইয়র্ক টাইমস । ৫ জুলাই ২০১৬
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here