নিস্তোর আলমেন্দ্রোসের সিনেমাটোগ্রাফিক পাঠ । প্রযুক্তি ভালো, তবে সারল্য আরও ভালো

641
দ্য কালেক্টর । ১৯৬৭
মূল । শন শিনাভিরাত্নে ।। অনুবাদ । মাহবুব খান

নিস্তোর আলমেন্দ্রোস এর বেশ কিছু ফিল্মোগ্রাফি রয়েছে: বেশিরভাগই এরিক রোমার’র ফিল্ম; তাছাড়া ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর কয়েকটি ফিল্ম, আর ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার, সোফি’স চয়েস ও ডেজ অব হেভেন [যাকে তার সিনেমাটোগ্রাফিতে তৈরি সবচেয়ে সুন্দর ফিল্ম হিসেবে গণ্য করা হয়] তো রয়েছেই। তার ফিল্মোগ্রাফি হয়তো অনেক বড় নয়। তবে তিনি গণ্য হন কারিগরিভাবে দক্ষ এবং কাজের পদ্ধতিতে অসম্ভব খুঁতখুঁতে এক মাস্টার সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে। এটা বললে ভুল হবে না– তার সিনেমাটোগ্রাফি কৌশলে তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্যরকমের অন্তর্জ্ঞানী। বিশেষ করে স্বল্প বাজেট ও টাইট শিডিউলে কাজ করার সময়, এখনো, একইসাথে পরিচালক ও সিনেমাটোগ্রাফাররা আলমেন্দ্রোসের কর্মপদ্ধতি থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন…
শুটিংয়ে নিস্তোর আলমেন্দ্রোস [বামে]
শুটিংয়ে নিস্তোর আলমেন্দ্রোস [বামে]

লাইটিং অবশ্যই সমর্থনযোগ্য হতে হবে

আলমেন্দ্রোস বিশ্বাস করতেন, লাইটিং অভিনেতাদের জন্যই, অন্যকিছুর জন্য নয়। লাইটিং সেটআপে অতিমার্জিত হওয়াকে সমর্থন করতেন না তিনি। যুদ্ধপূর্ববর্তী ফ্রেঞ্চ ফিল্মের অতীত চিন্তা করে আলমেন্দ্রোস বলেছেন, তখন

লাইট [অভিনেতাদের] দুই চোখের মাঝখানে প্রক্ষেপণ করা হতো, এক ‘শৈল্পিক’ আভা লুকিয়ে থাকত তাদের বাকি চেহারায়, তাদের শরীর আলাদাভাবে আলোকিত করা হতো, রোবটের মতো বাকি সব অভিনয় এবং নড়াচড়া চলতো সেটে

তিনি বিশ্বাস করতেন, লাইটিং অবশ্যই সবসময় সমর্থযোগ্য হতে হবে :

আমি বিশ্বাস করি, যা কিছু প্রাকৃতিক– তাই সুন্দর; প্রাকৃতিক আলোই সুন্দর আলো। আমি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করি, আমার লাইটিং যেন নান্দনিকার চাইতে বরং যৌক্তিক হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক সেটে যে আলো থাকে, আমি সেটাই ব্যবহার করি; প্রয়োজন হলে বাড়িয়ে নিই। স্টুডিও সেটে আমি কল্পনা করি, বাইরে থেকে সূর্য একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে আলো ছড়াচ্ছে; এবং সিদ্ধান্ত নিই, জানালা দিয়ে আসলে তা কীভাবে আসবে। বাকিটা সহজ।

দেজ অব হেভেন । ১৯৭৮
ডেজ অব হেভেন । ১৯৭৮

অন্ধের মতো নিয়মানুবর্তিতা নয়

নিয়ম জানা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার দাস হওয়ার দরকার নেই কারও। তার ভাষ্য :

রেনেসাঁ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কম্পোজিশনের নিয়মের ব্যাপারে অনেক বড় বড় গ্রন্থ লেখা হয়েছে। একজন সিনেমাটোগ্রাফারের প্রথমত সেগুলো জানা এবং পরে তা ভুলে যাওয়া উচিত; অথবা অন্তত সবসময় সেগুলো নিয়ে সচেতনভাবে চিন্তা করার দরকার নেই। যদি তা করেন, তাহলে তার সিনেমাটোগ্রাফিক গল্প থেকে সব স্বাভাবিকতা বর্জন করার ঝুঁকি রয়ে যায়।

কিছু কিছু পেশাদার টেকনিশিয়ান হয়তো এটা বুঝবেন না, এবং আপনাকে আপনার পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসবেন। তাই, যদি আপনি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করে থাকেন, সে অবস্থানে অনড় থাকা ইতিবাচক। যখন আলমেন্দ্রোস দ্য কালেক্টর [La Collectionneuse; ১৯৬৭] সিনেমার কালার-টাইমিং করছিলেন, নবাগত হওয়ার কারণে তাকে ল্যাবে সিরিয়াসলি নেওয়া হয়নি। আলমেন্দ্রোস বলেন,

সূর্যাস্তের সময় নেওয়া দৃশ্যটিতে কমলা রঙের প্রাধান্য ছিল প্রবল, ল্যাবরেটরিতে যখন ফিল্মটি টাইমিং করছিলাম, টেকনিশিয়ান আমাকে বুঝতে পারেননি এবং রঙ ঠিক করতে চাইছিলেন; আর কমলা রঙ বাদ দিতে চাইছিলেন [ঐ সময় প্রবল উষ্ণ রঙ ব্যবহার করা হতো না; ধারণা করা হতো যেন তাদের টমেটোর মতন দেখাবে]। তাকে বোঝানো অসম্ভব ছিল, তাই আমাকে কর্তৃত্ব ফলাতে হয়েছিল আমাকে।

ফিল্মটি সফল হবার পর সবকিছু বদলে গিয়েছিল, আর এরপর থেকে এই উষ্ণ রঙের ব্যবহার ফ্যাশন্যাবল হয়ে গেছে। সবেমাত্র ক্যারিয়ার শুরু করা ফিল্মমেকারদের সমস্যা হচ্ছে, তাদেরকে সেই টেকনিশিয়ানদের সাথে সংগ্রাম করতে হয়– যারা সবসময় নান্দনিক সৃষ্টিকে বাতিল করে দিতে চান এবং অন্ধের মতো ম্যানুয়ালে লেখা নিয়ম মেনে চলেন।

ক্লেয়ার'স নী । ১৯৭০
ক্লেয়ার’স নী । ১৯৭০

নতুন প্রযুক্তি ভালো, তবে সারল্য ভালো তারচেয়েও বেশি

টেরেন্স মালিকের ডেজ অব হেভেন ছিল স্টেডিক্যামের প্যানাভিশন ভার্সন প্যানাগ্লাইড ব্যবহারে নির্মিত অন্যতম প্রথম ফিল্ম। আলমান্দ্রোসের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়–

প্রথমে টেরি নতুন ডিভাইস এতটাই ভালোভাবেই নিয়েছিলেন যে, পুরো ফিল্মটিই প্যানাগ্লাইড দিয়েই শ্যুট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সহসাই আমরা বুঝতে পারলাম, যদিও এটি খুব কার্যকরী এবং কিছু ক্ষেত্রে আবশ্যক ছিল, তবে একচেটিয়া ব্যবহারের মতো ছিল না।…  রাশ কাজগুলো চমৎকারভাবে সম্পন্ন করা হয়েছিল, তবে খুব দক্ষতার সাথে; ক্যামেরাটা যেন নিজেই একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে দৃশ্যের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে! সহসাই আমরা দেখতে পেলাম, অবিরাম শক্ত-স্টেডি ট্রাইপড শট কিংবা ধীর, অদৃশ্য, চাকার মধ্যে ক্লাসিক ডলির নিয়মিত চলাফেরার সাথে কোনোকিছুই টক্কর দিতে পারে না।

দ্য কালেক্টর দিয়েই আলমেন্দ্রোসের প্রকৃত শুরু। এখানেই তিনি সবকিছু সাধারণ রাখার সৌন্দর্য দ্রুতই শিখে ফেলেন। এমন নয় যে, তার অন্যকোনো সুযোগ ছিল; কেননা, ফিল্মটি ছিল মাত্র ৩৫মিমি’র ১৫,০০০ ফুট। রোমার এবং আলমেন্দ্রোস অতিসতর্ক পরিকল্পনা ও কঠোর শুটিং নীতির মাধ্যমে কাজটি করেছেন। কারণ, তাদের কাছে ১.৫:১ শুটিং রেসিউ’র একটি ক্যান ছিল তাদের সম্বল :

ছোট বাজেট ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফিকে দ্রুত কাজ করতে এবং সহজ সমাধান খুঁজে বের করতে বাধ্য করে। এটি অতি ভদ্র-বাতিকগ্রস্ত হওয়া থেকেও বিরত রাখে; যখন মানুষের বড় প্রোডাকশনে জটিল পদ্ধতির স্বপ্ন দেখার সময় থাকে, তখন সেটি হয়তো সম্ভব।

দ্য ব্লু লেগুন । ১৯৮০
দ্য ব্লু লেগুন । ১৯৮০

সাংস্কৃতিগতভাবে সম্পৃক্ত হোন; করুন এক্সপেরিমেন্ট; দেখুন সিনেমা

আলমেন্দ্রোস তার ঐতিহ্যগত সিনেমাটোগ্রাফিক শিক্ষা প্রত্যাখ্যানের প্রায় কৌশল বিরোধী ছিলেন। তার মতে, একজন সহকারী সবসময় টেকনিকাল উপাদান– লাইট সেট করা, ফোকাস নির্ণয় করা ইত্যাদির দেখাশুনা করতে পারে। গল্পের প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং যে সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে আঁকা হয়েছে, তা দৃঢ় করা ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফির কাজ। যেমন তিনি বলেন, একবার কিছু বেসিক কৌশল শেখা হয়ে গেলে কাজটা তেমন জটিল কিছু নয়। শেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, যে কোনো কিছু কিংবা সবকিছু শ্যুট করে ফেলা; কেননা, ভুল করা থেকেই শেখা সম্ভব; এবং আরও কাজ হলো, অসংখ্য ভালো সিনেমা দেখা


শন শিনাভিরাত্নে । যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শ্রীলঙ্কান ফিল্মমেকার, এডিটর ও টিচিং আর্টস্ট

সূত্র : ফিল্মমেকার ম্যাগাজিন । ফিল্ম ম্যাগাজিন । যুক্তরাষ্ট্র । ৩০ আগস্ট ২০১৩
Print Friendly, PDF & Email

১টি কমেন্ট

  1. আলমেন্দ্রোস সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আপনাদের কল্যানে জানা হলো। ক্রেমার ভারসাস ক্রেমার সেই কবে দেখেছি,কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে একটুও ভাবিনি। Days of Heaven ছবিটা আপনাদের কাছ থেকে জানার পর নেট থেকে নামিয়ে দেখলাম। এক কথায় মুগ্ধ। আপনাদেরকে অজস্র ধন্যবাদ।

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here