সময় : ১৯১৫ । সাক্ষাৎকার : ভিক্টর ইউব্যাংক । অনুবাদ : রুদ্র আরিফ
মিস্টার চ্যাপলিন হাত নাড়লেন। বললেন, এসেনে স্টুডিও থেকে মাত্র পনের মিনিট আগে বের হয়েছি। কোনোকিছু সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। আমি শুনেছি চার্লি চ্যাপলিন এসেনে কোম্পানিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন। আর, নতুন কমেডির ব্যাপারে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য শিকাগোর এসেনে স্টুডিওতে আসার তাড়া পেয়ে তার এ আগমন। বুঝতে পারছি, তার অবস্থা শ্বাসরুদ্ধকর। একজন কমেডিয়ানের সঙ্গে আলাপ করতে এসে, ঘন-কালো চুলের এই সুদর্শন পুরুষটির বাদামি চোখের এমন সিরিয়াস চাহনি আমাকে ঘাবড়ে দিল। আসলে, পর্দায় কমেডিতে তাকে অনেক বার দেখলেও এবার [সামনাসামনি দেখে] ঠিক চিনতে পারিনি। ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই চল্লিশ বছরের বুড়ো, লম্বা ও হাস্যকর ভঙ্গিমার একটি লোকের দেখা পাবো। [অথচ] তিনি বেটে; তাছাড়া, যে আধঘন্টা তার সঙ্গে কথা বললাম, তাতে হাসিমুখের দেখা খুব একটা পাইনি। একজন ‘গুরুগম্ভীর’ লোকের পক্ষে কাজকে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া লাগে, তিনিও সেভাবেই নিয়েছেন। কোনো অলংকার তিনি পরেননি : না স্টিক-পিন, না রিং, না কোনো ঘড়ি, নয় অলংকারের কোনো ছিটেফোঁটা। আমার ধারণা, তার [পরনের] স্যুটটির দাম বড়জোর ১৫ ডলার হবে; অবশ্য দাম জানতে চাওয়ার সাহস আমার হয়ে ওঠেনি। তবে স্রেফ চোখের পাতা একবার মিটমিট করে নিজেই জানালেন, শিকাগোতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে চিনতে পেরে এক সংবাদকর্মী জঘন্যরকম অপমান করে বসেছে! বললেন, পোশাক নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। ট্রেন থেকে আমি নামতেই এক সংবাদকর্মী আমাকে চিনে ফেলে। সে চিৎকার করে তার সহকর্মীদেরকে বলে, ‘এই হতচ্ছাড়াকে কী বলবে তোমরা? বছরে এক লাখ ডলার কামাই করে, অথচ পরেছে ভবঘুরের পোশাক’।
চ্যাপলিনের কাছে তার জীবনের ইতিহাস জানতে চাইতেই আমার সঙ্গে অনেকটা হেয়ালি করে কথা বললেন তিনি। বললেন, বলার তেমন কিছু নেই। লন্ডনের একটি শহরতলীতে জন্মেছি আমি, পঁচিশ বছর আগে। তখন আর কিছু করার ছিল না বলেই মঞ্চে যেতাম। আসলে, আর কিছুই পারতাম না আমি। আমার বাবা-মা– দুজনেই মঞ্চের মানুষ। শুধু তাই নয়, নিজের পরিবারপুঞ্জির যতদূর আমি জানি, তাতে দেখা যায়– পূর্বপুরুষেরা সবাই ছিলেন মঞ্চের লোক। বাস্তবিক অর্থেই মঞ্চে জন্ম আমার। মঞ্চে আমার ক্যারিয়ার শুরু সাত বছর বয়সে। লন্ডনের একটি থিয়েটারে ক্লগ-ড্যান্স করতাম। এরপর ‘র্যাগস টু রিচেস’ নামের একটি আমেরিকান প্রোডাকশনের ব্রিটিশ-ভার্সনে অভিনয় করি। এরপর লন্ডনের কাছাকাছির হার্ন বয়েজেস কলেজে ভর্তি হতে মঞ্চ ছাড়ি। সেখানে দুই বছর থাকার পর পাদপ্রদীপের প্রলোভন আমাকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনে। তিন বছর লন্ডনের দ্য চার্লস ফ্রোম্যান কোম্পানিতে কাজ করেছি আমি, উইলিয়াম জিলেটের সঙ্গে; সেখানে শার্লক হোমস-এর বিলি চরিত্রে অভিনয় করতাম। ফ্রেড কার্নোর অ্যা নাইট ইন অ্যান ইংলিশ মিউজিক হল-এর প্রধান কমেডি চরিত্রে অভিনয় করার সময় আমেরিকাতে আমার প্রথমবার আসা।
সিনেমায় আমি ভালো করব– এমনটা কারও পক্ষে ভাবা সম্ভব হয়েছে মাত্র এক বছর একদিন আগে; আর আজ আমি এখানে। হ্যাঁ, কমেডির একটি নতুন লাইন আমি শিগগিরই করতে যাচ্ছি; আমার বিশ্বাস, এ পর্যন্ত যা যা করেছি, তা ছাড়িয়ে যাবে এটি। নিজেকে যখন পর্দায় প্রথমবার দেখেছিলাম, তখন অবশ্য এ কাজ ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। [দেখে] মনে হয়েছিল, না, এটা আমি না। পরে যখন বুঝতে পারলাম, এটা আমি-ই, তখন বললাম– ‘শুভ রাত্রি’! অবাক ব্যাপার হলো, সেই সিনেমাটা নিয়ে সোরগোল হয়েছিল। নাটকে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা আমার সবসময়ই ছিল; কমেডি নিয়ে তা থেকে দূরে সরে যাওয়াটা আমার জীবনের একটি সন্দেহাতীত বিস্ময়।
নিজেই বলছি বলে মাফ করবেন, আমি জানি, কেন আমার কমেডি এখন ভালো হয় [কমেডি নিয়ে কথা বলার সময় চ্যাপলিনের সেই দক্ষতা আমি দেখলাম]; তবে শুরুতে কিন্তু ভালো ছিল না। একবার সান ফ্রান্সিস্কো থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে যাচ্ছিলাম ট্রেনে। এক সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ হলো। নামার সময় তিনি বললেন, ‘আপনাকে একটা সিনেমা ও এক ফুলবাবুকে দেখাতে নিয়ে যেতে চাই।’ তার সঙ্গে গিয়ে পর্দায় দেখলাম, আরে, এটা তো আমি! তিনি বললেন, ‘লোকটা একেবারেই পাগলা; তবে কমেডিতে তাকে নিশ্চিত মানাবে।’ তিনি আমাকে একদমই চিনতে পারেননি। ভাবলাম, আপনারা আমেরিকানরা যেটিকে ‘শিয়ালের মতো পাগলা’ বলেন, সেটিকে আমি যতদিন পারি পাগলাগারদের বাইরে, কিন্তু পর্দার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়ে বেড়াব।
কমেডি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই চ্যাপলিনের মুখটা বড় হতে থাকল। বললেন, এটি সত্যিকার অর্থেই একটি সিরিয়াস গবেষণা হলেও এটিকে সিরিয়াস হিসেবে নেওয়া যাবে না। এটিকে প্যারাডক্সের মতো লাগলেও আসলে তা নয়। চরিত্রগুলো বোঝার ক্ষেত্রে এটি একটি সিরিয়াস গবেষণা; এটি একটি কঠিন গবেষণা। কিন্তু কমেডিকে সফল করে তুলতে হলে সেটি সহজ ও এর অভিনয় এত স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া প্রয়োজন– যাতে সিরিয়াসনেসের কোনো বালাই না থাকে। আমার প্লটের লে-আউট ও চরিত্রের গবেষণা আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করি। এমনকি যে চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করি, তাকে দূর থেকে কিংবা সামনে বসে অনুসরণ করে বুঝে নিই। যেমন ধরুন, সম্প্রতি আমি নাপিতের চরিত্রে অভিনয় করেছি। এমনকি আমার প্রিয় চুলগুলোও তাদের কাছে গিয়ে কাটিয়েছি। আসলে, রাস্তার বাচ্চা-কাচ্চারা হাসি-ঠাট্টা করার মতো বড় না হওয়া পর্যন্ত চুল কাটি না আমি। এমন অবস্থায় পৌঁছানোর পরই কেবল চুল কাটতে যাই। এক্ষেত্রে আমি একটি ব্যস্ত সেলুনকে বেছে নিয়েছিলাম, যেন আমার পালা আসার আগপর্যন্ত বহুক্ষণ সম্ভব বসে থাকতে পারি। নাপিতের কাজের সবগুলো ধরন আমি দেখেছি। সে আসলে কী করে, এবং আমার স্ক্রিপ্টে সে কী আশা করবে– সেটি নিয়ে গবেষণা করেছি। এরপর রাতে তাকে অনুসরণ করেছি তার বাসা পর্যন্ত। সে হেঁটে যেত, তার বাসা ছিল তিন মাইল দূরে; তাতে কী? তার খুঁটিনাটি সবকিছু বুঝতে চেয়েছি আমি।
মাথায় একটি প্লট নিয়ে ক্যামেরার সামনে যখন দাঁড়াই, তখন আসলে কী করতে যাচ্ছি– সে ব্যাপারো কোনো ধারণা থাকে না আমার। নিজেকে হারিয়ে ফেলার চেষ্টা করি। যে চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছি, আমি সে-ই; আর এই পরিস্থিতিতে চরিত্রটি কী করবে বলে আগে যেমনটা ভেবে রেখেছি, স্রেফ তা করারই চেষ্টা করি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ক্যামেরা যখন চালু হয়ে যায়, তখন ভাবার মতো সময় থাকে না হাতে। কাঁটায় কাঁটায় সেই মুহূর্তটিতেই আপনাকে অভিনয় করতে হবে। ১০০ কিংবা তারও কম ফুট দৈর্ঘ্যরে ফিল্মের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত থাকার জন্য কোনো সময় থাকে না। আমি মনে করি, এভাবেই আপনি আপনার কাজটিতে আগে করা সব গবেষণার বিস্তারিত ফল পাওয়ার প্রচেষ্টা করার চেয়ে বরং অধিক স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারবেন। আমার মতে, এটিই নিয়তি। এটি সিনেমা চেহারা নিশ্চল ও অবাস্তব করে তোলে।
আসলে, ন্যাচারালনেস হলো কমেডির সবচেয়ে অপরিহার্য বিষয়। এটিকে জীবনের ক্ষেত্রে বাস্তব ও সত্য হতে হবে। বাস্তবতাবাদের প্রতি নিখাদ আস্থা আছে আমার। হাস্যকর জিনিসের চেয়ে বরং বাস্তব জিনিস মানুষকে বেশি দ্রুত আকৃষ্ট করে। আমার কমেডি হলো বাস্তবিক-জীবন; তাতে যে একটুখানি মোচড় কিংবা অতিরঞ্জনের দেখা আপনি পাবেন, তার উদ্ভব আসলে নির্দিষ্ট পরিস্থিতির কারণে। মানুষ সত্যকে চায়। মানুষের হৃদয়ে কোনো না কোনো কারণে সত্যের জন্য ভালোবাসা রয়েছে। কমেডির মধ্য দিয়ে তাদের সামনে সত্যকেই হাজির করাটা বাঞ্চনীয়। গবেষণা লব্ধ অভিনয় যেখানে সত্যকে ছুঁতে গিয়ে প্রায়শই হারিয়ে ফেলে, সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় প্রতি দশবারের মধ্যে নয়বারই ছুঁয়ে যায়। তবে সবকিছুরই একটি সময় এবং স্থান রয়েছে। এমনকি সস্তা-কমেডির মধ্যেও একটি শিল্প আছে। কোনো লোক যদি অন্যদেরকে একদম সঠিক মনস্তাত্ত্বিক মুহূর্তটিকে আঘাত করতে পারে, তাহলে তা মজার হয়। কিন্তু কাজটি যদি সে বেশি আগে কিংবা বেশি পরে করে, তাহলে সেই মজাটা আর থাকে না। তাছাড়া, হাসি যোগানোর জন্য একটি কারণ থাকা জরুরি। কোনো অপ্রত্যাশিত ট্রিককে যদি দর্শকরা কোনো যৌক্তিক সিকুয়েন্স হিসেবে দেখে, তাহলে তা বাড়িটিতে [সিনেমা-হলে] পতন বয়ে আনবে। ছোটখাট জিনিসই সবসময় হাসির খোড়াক যোগায়। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে যাওয়া উদ্ভট লাফ-ঝাঁপের মতো ছোটখাট কর্মকাণ্ডই হিট করে দেয় [কমেডিকে]।
সিনেমা জগতে কমেডি এখনো শৈশবকাল পার করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমি এমন অনেক উন্নতি দেখার আশা রাখি, যেখানে এখনকার দিনের কমেডিগুলোর দেখা আপনি খুব একটা পাবেন না।
সূত্র : মোশন পিকচার ম্যাগাজিন। মার্চ ১৯১৫
[…] বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম চার্লস চ্যাপলিন, কিন্তু তাঁর কাজ সিনেমার ইতিহাস থেকে […]