সার্গেই পারাজানভ: সোভিয়েত সিনেমার রাগি কবি

428

সার্গেই পারাজানভের সিনেমাগুলোর কথা ভাবলেই, সবসময় ভীষণ কৃতজ্ঞতাবোধ ও আনন্দ কাজ করে [আমার মনে]; এগুলো ভীষণ প্রিয় আমার। তার ভাবনার ধরণ, তার প্যারাডক্সিকেল, কাব্যিকতা… সৌন্দর্য্যকে ভালোবাসার ক্ষমতা, আর তার নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা [ভালোবাসি আমি]।
আন্দ্রেই তারকোভস্কি। ফিল্মমেকার। রাশিয়া; ১৯৩২-১৯৮৬

সিনেমার যে মন্দিরে থাকে ইমেজ, লাইট আর বাস্তবতা– সার্গেই পারাজানভ ছিলেন সেই মন্দিরের পুরোহিত।
জ্যঁ-লুক গোদার। ফিল্মমেকার। ফ্রান্স; ১৯৩০-

তার পুরো নাম সার্কিস ইয়োসিফোভিচ পারাজানিয়ান। আর্মেনিয়ান দম্পতির ঘরে, সোভিয়েত সাম্রাজ্যে, ১৯২৪ সালের ৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করা, সার্গেই পারাজানভ নামে খ্যাত এই মানুষটি ছিলেন সোভিয়েত-রাশিয়ার ধ্যানী ফিল্মমেকার আন্দ্রেই তারকোভস্কির ভীষণ শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় ফিল্মমেকার। পারাজানভের জন্মস্থান– তিবিলিসি [বর্তমান জর্জিয়ার রাজধানী]। শিল্পমনা বাবা-মায়ের আদরে, ছোটবেলা থেকেই শিল্পের প্রতি তীব্র ঝোঁক অনুভব করেন তিনি। ফলে, ১৯৪২ সালে ‘তিবিলিসি ইনস্টিটিউট ফর রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং’ থেকে ট্রান্সফার হয়ে, ভর্তি হন ‘তিবিলিসি কনজারভেটরি অব মিউজিক’-এ [১৯৪৩-৪৫], গান ও ভায়োলিন বিষয়ে পড়াশোনা করতে। আর ১৯৪৬ সালে নাম ওঠান ‘ভিজিআইকে– দ্য সোভিয়েত অল-ইউনিয়ন স্টেট স্কুল ফর ফিল্ম আর্ট অ্যান্ড সিনেমাটোগ্রাফি’ [ওরফে, ‘মস্কো ফিল্ম স্কুল’] নামের, সিনেমার ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠে। এখান থেকে ১৯৫১ সালে ফিল্ম ডিরেক্টর হিসেবে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন ইউক্রেনিয়ান ফিল্মমেকার ইগোর সাভচেঙ্কো [১৯০৬-১৯৫০] ও আলেক্সান্দর দভচেঙ্কোর [১৮৯৪-১৯৫৬] অধীনে। পরে চাকরি নেন ‘কিয়েভ ফিল্ম স্টুডিও’তে [বর্তমান নাম, ‘দ্য আলেক্সান্দর দভচেঙ্কো স্টুডিও’]।

পারাজানভের ফিল্ম ক্যারিয়ার শুরু হয় ইয়াকভ বাজেয়ানের [১৯২৫-১৯৯০; ইউক্রেন] সঙ্গে যৌথ পরিচালনায় দুটি সিনেমা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। নিজেদের তৃতীয় ডিপ্লোমা ফিল্ম, ইউক্রেনে শুটিংকৃত মলভাদিয়ান টেল [Moldavskaya Skazka;১৯৫১] নির্মাণের অল্প কিছুদিন পরই, তারাস শেভচেঙ্কো [১৯৫১] সিনেমায় নিজের মেন্টর ইগোর সাভচেঙ্কোর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। এরপর বাজেয়ানের সঙ্গে যৌথভাবে, নিজেদের গ্রাজুয়েশন শর্টফিল্ম হিসেবে, আন্দ্রিয়েশ [Andriesh; ১৯৫৪] নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য শিশুতোষ সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি। ধরে নেওয়া হয়, মলদাভিয়ান টেল সিনেমাটি চিরতরে হারিয়ে গেছে; যদিও পারাজানভ দাবী করতেন, ফিল্মটির একটি কপি তিনি তিবিলিসে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। যাহোক, এরপর তিনটি ডকুমেন্টারি বানান তিনি : রুশ বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে, একটি কোরাল গ্রুপের ওপর ব্যালাড [Dumka; ১৯৫৭]; আরও দুইজন ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারের সঙ্গে যৌথ পরিচালনায়, ফোক আর্টের ওপর গোল্ডেন হ্যান্ডস [Zolotye ruki; ১৯৫৮]; এবং ইউক্রেনের বিশিষ্ট মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর ওপর ভিত্তি করে– নাতালিয়া উশভ্যি [Natalia Uzhvij]। এই তিনটি ডকুমেন্টারি কিয়েভ আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে। এরপর দভচেঙ্কো স্টুডিও থেকে তিনটি ফিচার ফিল্ম নির্মাণ করেন পারাজানভ– দ্য ফার্স্ট ল্যাড [Pervyj paren; ১৯৫৯]; ইউক্রেনিয়ান র‌্যাপসোডি [Ukrainskaya rapsodiya; ১৯৬১] ও ফ্লাওয়ার অন দ্য স্টোন [Tsvetok na kamne; ১৯৬২]। ফিল্ম তিনটি মূলত সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ বা স্যোসালিস্ট রিয়ালিজমের মতাদর্শকে প্রচার করলেও, তার অন্তরালে এর বিরোধিতার বীজও দক্ষতার সঙ্গে বপন করেছেন এই ফিল্ম-মাস্টার।

পারাজানভ তার নবম ফিল্মটি নির্মাণ করেন কিয়েভে [ইউক্রেনের রাজধানী]; শ্যাডোজ অব আওয়ার ফরগোটেন অ্যানসেস্টরস [Tini zabutykh predkiv; ১৯৬৪] শিরোনামের এই ফিল্মটি সোভিয়েত সিনেমার স্যোসালিস্ট রিয়ালিজমের মূল আদর্শগুলোকে ভীষণ গর্জনের সঙ্গে ভেঙে-চুরে খানখান করে দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হলেও, সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিল্মটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে কেবলমাত্র স্বল্প পরিসরে। ইউক্রেনিয়ান কবি ও বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া পারাজানভ, একদা তিবিলিসে জীবনযাপন ও কাজ করা আর্মেনিয়ান পোর্ট্রেট পেইন্টার হাকোপ হাভনাতানিয়ানের [১৮০৬-১৮৮১] ওপর সিনেমা বানানোর প্রস্তাব ইয়েরেভান [আর্মেনিয়ার রাজধানী] থেকে পেলে, গ্রহণ করেন। এরই ফল– হাকোপ হাভনাতানিয়ান [Hakob Hovnatanyan] শিরোনামের, ১০ মিনিটের, শর্ট ডকুমেন্টারিটি। এটিকে পরে কিয়েভ ফ্রেস্কোস [Kievskie Freski; ১৯৬৬] সিনেমার দৃশাবলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়; বলে রাখা ভালো, দভচেঙ্কো স্টুডিওতে এই শেষোক্ত ফিল্মর শুটিং কয়েক সপ্তাহ করার পর, কর্তৃপক্ষ এ সিনেমার সব কাজ বাতিল করে দেয়। বর্তমানে হাকোপ হাভনাতানিয়ান ও কিয়েভ ফ্রেস্কোস ফিল্ম দুটির খুব সামান্য অংশেরই অস্তিত্ব রয়েছে। একই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয় আর্মেনিয়াতে মৌলিক শর্তের অধীনে বানাতে থাকা সায়াৎ নোভা ফিল্মটিকে। ফিল্মটির ডিরেক্টর’স কাট ভার্সন বাজেয়াপ্ত করে, আরেক ফিল্মমেকার সের্গেই ইয়ুৎকেভিচকে [১৯০৪-১৯৮৫; রাশিয়া] দিয়ে এডিট করিয়ে, অরিজিনাল ভার্সন থেকে ২০ মিনিটের ফুটেজ বাদ দিয়ে, দ্য কালার অব পোমাগ্রেনেটস [Nran guyne; ১৯৬৯] শিরোনামে শুধুমাত্র মস্কোতে মুক্তি দেওয়া হয়। আমার মাস্টারপিস ফিল্মটির আর অস্তিত্ব রইল না– এ ঘটনায়, এমন আকুতি ঝরে পড়েছিল পারাজানভের কণ্ঠ থেকে; যদিও সম্প্রতি আর্মেনিয়ায় ফিল্মটির অরিজিনাল ভার্সনের রিকনস্ট্রাকশন করার প্রচেষ্টার কথা জানা গেছে।

এরপর সিনেমা বানানোর জন্য এই ফিল্মমেকারের অসংখ্য প্রচেষ্টা বারবার পর্যুদস্ত হয়েছে। উল্টো, দীর্ঘদিনের চক্রান্ত ও সন্দেহ পোষণ শেষে, ১৯৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর, কিয়েভ থেকে গ্রেফতার হন এই ফিল্মমেকার। আদালতে শুনানির পর, ১৯৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দাগী আসামীদের কারাগার– নেপ্রোপেত্রোভস্ক [ইউক্রেন] বন্দিশিবিরে। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ছিল– ‘আর্ট অবজেক্টের বাণিজ্য’, ‘সমকামিতার পক্ষপাত’, ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা’ ও ‘কালোবাজারি’। বন্ধু ও শিল্পীদের বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৭৮ সালে মুক্তি দেওয়া হয় তাকে; এবং তিবিলিসে নিজের পারিবারিক বাসায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেও, ফিল্ম স্টুডিওতে কাজ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আবারও গ্রেফতার হন তিনি। কেজিবি [প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান সিকিউরিটি এজেন্সি (১৯৫৪-১৯৯১)] তাকে গ্রেফতার করে, নিজের ভাতিজাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিতে ‘জনৈক সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়া’র অপরাধে; সে বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ভরোশিলভগ্রাদ [ইউক্রেন] কারাগারে বন্দি থাকেন তিনি।

১৫ বছরেরও অধিককাল কালোতালিকাভুক্ত হয়ে থাকার পর, জর্জিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি– এদুয়ার্দ শেভার্নাজের সহায়তায়, তিবিলিসের গ্রুজিয়াফিল্ম স্টুডিওর হয়ে, অভিনেতা ডোডো আবাখিজের [১৯২৪-১৯৯০; জর্জিয়া] সঙ্গে যৌথ পরিচালনায় ফিচার ফিল্ম দ্য লিজেন্ড অব সুরাম ফর্ট্রেস [Ambavi Suramis tsikhisa; ১৯৮৫] বানাতে সক্ষম হন পারাজানভ; আর বানান আরাবেস্কুস অন দ্য থিম পিরোসমানি [Arabeski na temu Pirosmani; ১৯৮৬] শিরোনামে একটি শর্ট ডকুমেন্টারি। তার শেষ ফিল্ম আশিক কেরিব [Ashiki Keribi; ১৯৮৮] একটি জর্জিয়ান-আর্মেনিয়ান-আজারবাইজান কো-প্রোডাকশন হলেও, দেশ তিনটিতে সীমিত পরিসরেই মুক্তি পায় এটি। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন, আত্মজৈবনিক ফিল্ম কনফেশন-এর [Khostovanank] প্রথম দৃশ্যের শুটিং তিনি শুরু করেন তিবিলিসে অবস্থিত নিজের পারিবারিক বাড়িতে। এর তিনদিন পরে, শ্বাসকষ্টের কারণে, হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এরপর ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি অপারেশন করা হয় মস্কোতে; তারপর রেডিয়েশন ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয় প্যারিসে। তবুও বাঁচানো যায়নি তাকে। ১৯৯০ সালের ২০ জুলাই, ৬৬ বছর বয়সে, ইয়েভানে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সেখানেই সমাহিত করা হয়েছে আন্দ্রেই তারকোভস্কি, মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, জ্যঁ-লুক গোদার, মার্টিন স্করসেজি, মিখাইল ভার্তানভ, ফেদেরিকো ফেল্লিনি, ফ্রান্সেস্কো রসি, বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি, থিও অ্যাঙ্গেলোপোলোস, বেলা তার, মোহসেন মাখমালবাফ প্রমুখের মতো পৃথিবীর নানাপ্রান্তে মাস্টার ফিল্মমেকারদের মুগ্ধ করা সিনেমার এই রাগি কবিকে।


সূত্র : কিনেমা। ফিল্ম জার্নাল। কানাডা; এবং অন্যান্য

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৩ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here