সিনেমা

328

 

লিখেছেন । অমিতাভ পাল


সিনেমাকে সাহিত্যের মতোই বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ক্লাসিক, সিরিয়াস, বিনোদন, গোয়েন্দা, হরর, অভিযান– সাহিত্যের প্রায় সবগুলি বিষয়কেই অবলম্বন করেছে সিনেমা। এটা হয়তো করা হয়েছে শিল্প হিসাবে শুরুর দিনগুলিতে স্বাবলম্বনের প্রয়োজনেই– সিনেমা তখন সাহিত্যকে আশ্রয় করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। আসলে গল্প শোনানোর যে বিষয়টা মানব সভ্যতার শুরুর থেকে জড়িয়ে আছে মানুষের সাথে– এটাই একসাথে যুক্ত করেছে সাহিত্য এবং সিনেমাকে। কিন্তু সিনেমারও একটা আলাদা ব্যাপার আছে। সেটা তার প্রকাশভঙ্গিতে। কোনো গল্প বা ঘটনা সাহিত্যে প্রকাশিত হয় পাঠকের সামনে সবটুকু কল্পনার সম্ভাবনাকে ছড়িয়ে রেখে। কিন্তু সিনেমায় যেহেতু দৃশ্যের ছবি তুলতে হয়, তাই কোনো একটা পরিপ্রেক্ষিতের সামনে দাঁড় করাতে হয় চরিত্রগুলিকে। আমি বলতে চাইছি সাহিত্যে যা রচিত হয়, তাকে প্রত্যেক পাঠকের নিজস্বতা দিয়ে মিলিয়ে দেখার সুযোগ থাকে। অর্থাৎ কোনো একটা মাকোন্দো শহরকে আমি নিজের দেখা কোনো শহরের সাথে মিলিয়ে নিতেই পারি উদাহরণত। কিন্তু সিনেমায় ওই মাকোন্দোকে যে ফর্মে দেখানো হবে– কল্পনাকেও প্রভাবিত করবে সেই আকৃতিই। অর্থাৎ সাহিত্য একজন পাঠককে ছাড় দিলেও সিনেমা সেটা দিতে নারাজ। সিনেমা পাঠককে আষ্টেপৃষ্টে গিলে খেতে চায়। সিনেমার এটা খুব বড় শক্তি। আরো স্পষ্ট করে বললে– দৃশ্যশ্রুতিরই বড় শক্তি এটা। বাইরের তথ্যকে গ্রহণ করবার যে দুটি প্রধান ইন্দ্রিয় আছে মানুষের– সেই চোখ আর কানকে সবটা দখল করে নিতে না পারা পর্যন্ত শান্তি পায় না দৃশ্যশ্রুতি। ফলে মূহূর্তের মধ্যে মানবহৃদয় দখল করে নেবার যে ক্ষমতা গানের আছে, সেটা সিনেমাতেও বিদ্যমান। তাই গানের সঙ্গে সিনেমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সবাক চলচ্চিত্রের জন্মসময় থেকেই।

গান : রেইন ড্রপস ফলেন ইন মাই হেড। ফিল্ম : বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড সানড্যান্স কিড। ফিল্মমেকার : জর্জ রয় হিল। যুক্তরাষ্ট্র; ১৯৬৯
গান : রেইন ড্রপস ফলেন ইন মাই হেড। ফিল্ম : বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড সানড্যান্স কিড। ফিল্মমেকার : জর্জ রয় হিলযুক্তরাষ্ট্র; ১৯৬৯

ভারতীয় উপমহাদেশের সিনেমাগুলিতে গান অকথিত কথা বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অকথন প্রেমের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ প্রেমাস্পদকে স্পষ্ট করে যে কথাটা বলতে পারি না আমরা, গান সেটাই বলে দেয়। ফলে এই অঞ্চলের সিনেমার গান আমাদের হৃদয়ের বুদবুদ। তাই এরকম প্রায়ই দেখা যায়, সিনেমার চেয়েও সিনেমার গান বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। পাশ্চাত্যে অবশ্য গানের চেয়েও সঙ্গীতের প্রভাব বেশি। এই সঙ্গীত দৃশ্যগুলির আবহ তৈরি করে তাদের আরো জীবন্ত করে। বাস্তব পৃথিবীতে যেমন কোনো মুক দৃশ্য নেই, সিনেমাতেও সেটাই তৈরি করা হয়। আর সেটা করতে গিয়ে তৈরি হয় আরেকটা সুযোগ- নিরবতাকে অভিঘাত হিসাবে ব্যবহার করার। তবে পাশ্চাত্যেও যে গান সিনেমাকে অন্য মাত্রা দেয় সেটা বুঝতে বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড সানড্যান্স কিড-এর সেই বিখ্যাত গানটির দৃশ্য দেখলেই বোঝা যাবে। রেইন ড্রপস ফলেন ইন মাই হেড ক্লাসিক উদাহরণের মর্যাদা পেতেই পারে।

আমাদের সিনেমায় গানের ভূমিকা অপরিসীম। গান ছাড়া সিনেমা আমাদের হৃদয় গ্রহণ করতে পারে না। এডিটিং হোক যাচ্ছেতাই, অভিনয়ে থাকুক যাত্রার প্রভাব– কিন্তু গানগুলি হতে হবে মনমাতানো। সেটা যদি হয়– লগ্নি করা টাকার দুঃশ্চিন্তা অনেকটাই কমে যায় প্রযোজকের। আর যদি একটা নিটোল গল্প থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। আমাদের এখানকার ফিল্মি গানের গায়করা নায়কদের চেয়ে কম জনপ্রিয় না। বিশেষ করে ষাট/সত্তরের দশকেতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে গায়ক পেয়েছে নায়কের চেয়ে বেশি সম্মান।

এই যে সিনেমাতে গানের ব্যবহার– এটা আমাদের বৈশিষ্ট। আমাদের প্রাচীন পারফর্মিং আর্ট যাত্রাতেও এটা দেখা যায়। সিনেমায় গানের ব্যবহারের উৎকর্ষ শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমায়। এই বৈশিষ্ট্যটাকে ভারতের ফিল্প ইন্ডাস্ট্রি বলিউড ব্যবহার করেছে চরম দক্ষতায়। বাণিজ্যিক সিনেমার বিশাল বাজার দখল করতে এর কোন বিকল্পও ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমায় এ জিনিসের পরিবর্ধন, পরিমার্জন খুব একটা হয়নি; কারণ আমরা শুরু থেকেই ভারতীয় সিনেমাকে অনুসরণ করে গেছি। ফলে আমাদের সিনেমা এবং তার গানের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়নি।

গান : আয়নাতে অই মুখ দেখবে যখন। গায়ক : মাহমুদুন্নবী। ফিল্ম : নাচের পুতুল। ফিল্মমেকার : অশোক ঘোষ। বাংলাদেশ; ১৯৭১
গান : আয়নাতে অই মুখ দেখবে যখন। গায়ক : মাহমুদুন্নবী। ফিল্ম : নাচের পুতুল। ফিল্মমেকার : অশোক ঘোষ বাংলাদেশ; ১৯৭১

গান এবং সিনেমা একই জিনিসের দুই উৎসারণ যেহেতু, তাই এদের একসাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এমন এক পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন– যাতে গান আর সিনেমা একে অপরের প্রভাবক হয়ে ওঠে; পাঞ্জা লড়ার টেবিল না হয়। আর এই কাজটি করার জন্য সিনেমা যিনি বানাবেন, তাকে গান সম্বন্ধে ভালো ধারণা রাখতেই হবে। এক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলা যায়– বিশেষজ্ঞদের যুগ এটা, সঙ্গীত পরিচালকই তো যথেষ্ট। তবে আমি নিশ্চিত, সিনেমা বোঝা কোনো পরিচালকই এই যুক্তি মানতে চাইবেন না। সিনেমার সঙ্গীত ব্যাপারটা তো কেবল কিছু সুর রচনা না; বরং দৃশ্যের সহযাত্রী হওয়াই তার অন্তিম লক্ষ্য। এই সময়ও আরেকটা পাল্টা যুক্তি খেলে যায় মাথার ভিতরে– পরিচালককে যদি গান সম্বন্ধে ধারণা রাখতে হয়, তাহলে সঙ্গীত পরিচালককে সিনেমা সম্বন্ধে ধারণা রাখতে হবে না কেন? এই যুক্তি অকাট্য। আমি মনে করি, একটা সিনেমায় যারা কাজ করবে, সে অভিনেতাই হোক আর প্রোডাকশন বয়– সবাইকে সিনেমা সম্বন্ধে একটা মোটাদাগের হলেও ধারণা অর্জন করতে হবে। কোনো পরিচালক যদি তার টিমে সবাইকেই সিনেমার ধারণাওয়ালা হিসাবে পান, তাহলে সেই সিনেমা শ্রেষ্ঠ না হয়ে পারে?

সিনেমার সঙ্গে টেকনোলজির সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়াটাই বাতুলতা। কারণ টেকনোলজির গর্ভেই জন্ম হয়েছে সিনেমার। কিন্তু টেকনোলজিই সিনেমার শেষকথা কখনো হতে পারে না; বরং সিনেমার শেষকথা হওয়া উচিত টেকনোলজিকে ছাপিয়ে যাওয়াটাই। এই ছাপিয়ে যাওয়া মানে কি? যন্ত্র দিয়ে তৈরি করা জিনিসের শরীরে যখন মেলে মানুষের হাতের ছাপ, তখনই জিনিসটা যন্ত্রকে ছাপিয়ে যেতে পারে। এই যে মোবাইল ফোনে এত সেলফি তুলছি আমরা এবং সবাইকে দেখাতে ব্যাকুল হয়ে পড়ছি, তাতেও কিন্তু মন চায় মানুষের হাতের ছাপ যোগ করতে। আর সেই ইচ্ছাটাই প্রিজমা অ্যাপের জন্ম দিয়েছে–অস্বীকার করতে পারবো?

সিনেমাও যান্ত্রিক অমানুষিকতাকে বাদ দিয়ে মানুষের কাজ হয়ে উঠুক– এটাই আমাদের চাওয়া।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here