অন্তর্যাত্রা । ইংরেজি শিরোনাম : Homeland । ফিল্মমেকার : তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ । স্ক্রিপ্ট : তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ । প্রডিউসার : তারেক মাসুদ । অভিনয় : সারা যাকের, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, আবদুল মমিন চৌধুরী প্রমুখ । সিনেমাটোগ্রাফি : গাতেন রসো । মিউজিক : হ্যারল্ড রশীদ ও বুনো । এডিটিং : ক্যাথেরিন মাসুদ । ভাষা : ইংলিশ, বাংলা, সিলেটি । রানিংটাইম : ৮৫ মিনিট । মুক্তি : ২৯ জানুয়ারি ২০০৬ । দেশ : বাংলাদেশ
লিখেছেন । আবদুল্লাহ আল মুক্তাদির
সৎ চলচ্চিত্র এবং সৎ চলচ্চিত্র নির্মাতা বলে একটা কথা প্রচলতি আছে। এর ব্যাখ্যাটা আমাদের সবার জানা। একজন নির্মাতার সবচেয়ে বড়গুণ শুধু বেস্ট কনসেপ্ট বা স্টোরি সিলেকশন না, সুন্দর সুন্দর ফ্রেম ধরা না; বরং গল্প বলার সৌর্ন্দযটাও, প্রাণবন্ত অভিনয় বের করানোটাও।
‘অর্ন্তযাত্রার কথা ভেবে দেখেন, এর ওয়ান লাইনার ভেবে দেখেন, আর উপলব্ধি এবং তার উপস্থাপনের কথা ভেবে দেখেন। আসলে ‘অর্ন্তযাত্রা’ নিয়ে একটা বই লিখলে হয়তো তার প্রতি সুবিচার করা হবে। এই সিনেমা নিয়ে যে কত কথা বলার আছে!
আচ্ছা, আগে কপালে কালো টিপ আঁকা যাক। এই ছবিতে শিরীনদের বাসার কেয়ারটেকার লক্ষণদা, গায়িকা আনুশেহ এবং বুনোর ক্যামেরার সামনের উপস্থিতি অসন্তোষজনক। তারা কেউই আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অন্যান্য চরিত্রগুলো বেশ প্রাণবন্ত। প্রত্যেকেই নিজেকে ভেঙ্গে পরিচালকের ভাবনার চরিত্রটি হয়ে উঠেছেন। সারা যাকের থেকে শুরু করে সোহেলের দাদা র্পযন্ত।
আমাদের সাবকন্টিনেন্টালে কম বাজেট, বক্স অফিসে কত কোটি কামালো অথবা ছবিটা কয়টা ফেস্টিভ্যালে ট্রাভেল করলো, সেটা দিয়ে ছবির ভালো-মন্দ বিচার করা হয় অথবা হালকা/গাঢ়ভাবে নেয়া হয়। আসলে ছবি বিচার করার মূল ভাবনা থেকে আমরা সরে এসেছি। সেটা হতে পারে–
–ছবির গল্প বলা কতটা সুন্দর/মার্জিত/সাবলীল/পরিমিত,
–পরিচালক আসলেই গল্পটা বলতে পেরেছে কিনা,
–ছবির মিউজিক কতটা পেরেছে গল্পের বাড়িপর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিতে,
–ছবির গল্পের ডিজাইনের সাথে এডিট, কালার গ্রেড, আর্ট কতটা বন্ধুত্ব করতে পেরেছে,
–ছবির একেকটা ইনসার্ট গল্প বলায় কতটুকু মার্ধুয সংযুক্ত করতে পেরেছে ইত্যাদি।
আমার কাছে ‘কম বাজেট’ ভাবনাটাই অসভ্য মনে হয়! তারেক মাসুদ প্রথম সিকুয়েন্সে বিদেশ যেভাবে দেখিয়েছেন তাতে ক্ষতি কী? এখানে ভাবনার বিষয় হতে পারে, তিনি ব্যাপারটা কতটা গ্রহণযোগ্য করতে পেরেছেন। ছবিটা নিশ্চয়ই লন্ডনের প্রামাণ্যচিত্র ছিলো না। বলা যেতে পারে, সিকুয়েন্সটা আরও সুন্দর হতে পারতো। আমি শুধু বিদেশের দৃশ্যায়ন নিয়ে যাদের কষ্ট রয়ে গেছে, তাদের পয়েন্ট থেকে কথাটা বলছি। কারণ, জীবনের কোনো কমতি সেখানে ছিলো না।
এবার আসা যাক অন্তরের যাত্রায়। প্রবাসীরা ঢাকায় প্রবেশের কিছুক্ষণের মধ্যেই যে তাদের মুগ্ধতা কেটে যায়– তার একটা সুন্দর চিত্রায়ন নির্মাতা করেছেন। ‘অর্ন্তযাত্রা’ নির্মাতা তারেক মাসুদের সবচেয়ে পরিণত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। পরিচালক ততদিনে নির্মোহভাবে গল্প বলাটা আয়ত্ব করে ফেলেছেন অথবা এই চলচ্চিত্রে তার পরিপূর্ণ প্রয়োগ তিনি করতে পেরেছেন।
আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনায় আরেকটা স্থূলতা আছে; সেটা হচ্ছে– হয় ফেরেশতা অথবা শয়তান, হয় নায়ক না হলে ভিলেন, হয় খুব ভালো না হয় খুব খারাপ। এটা অবশ্য গান-বাজনা আর ঢিসুম-ঢিসুমের মতো পাশের দেশ থেকে ধার করা। আর অনুকরণ করতে গেলে যে স্থূলতা আরও বেড়ে যায়, তা তো আমাদের সবারই জানা। সিনেমা যদি জীবনের আয়না হয়, তাহলে সিনেমার মানুষগুলোও বাস্তবের মতো হবে; মানুষের চরিত্রে ভালো-মন্দ– দুই-ই থাকবে। সিনেমার মানুষগুলো বাস্তবের মানুষের মতো কথা বলবে; বাস্তবে যেভাবে হাঁটে, সেভাবে হাঁটবে, খাবে, ঘুমাবে, মারা যাবে।
ভাষার ব্যবহারে এই নির্মাতা সম্পূর্ণ স্বার্থক বলে আমার মনে হয়েছে। ইংরেজির উচ্চারণ, সিলেটি ভাষার উচ্চারণ, তথাকথিত প্রমিত উচ্চারণ– সব খুব নিখুঁত। আবার সিলেটের মানুষ অন্যদের সাথে কথা বলতে গেলে যেভাবে কথা বলে, সিনেমার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভাষার এই সেপারেশন বজায় রাখা খুব সহজ ব্যাপার না। আজকে আমরা যারা বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকায় থাকি, তারা আঞ্চলিকতা ছাড়ার জন্য অথবা প্রচলিত ভাষা শুনতে শুনতে নিজেদের মধ্যে যে ভাষাকে ধারন করে ফেলি, সে ভাষাই কিন্তু আমাদের ভাষা হয়ে উঠে। এখন একজন নির্মাতা যখন এই লোকগুলার গল্প বলবে, তখন নিশ্চয় এই ভাষাকেই ব্যবহার করবে? কিন্তু না; কিছু প্রগতিশীল মানুষ সিনেমার জন্য তাদের পছন্দের ভাষাকে মনে মনে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে নিয়েছে। মনে রাখবেন সুধী, এটা সিনেমার স্ট্যান্ডার্ড না; এটা আপনার জানার এবং বোঝার স্ট্যান্ডার্ড। সিলেটের মানুষ সলেটি ভাষায় কথা বললে আর তা সিনেমায় ধারন করলে যদি ভাষার বিকৃতি না হয়, তবে ঢাকার সেই মানুষগুলো যারা বহুল প্রচলিত ভাষার মানুষ, তাদের ভাষাকে সিনেমায় দেখালে ভাষার বিকৃতি কেন হবে? আপনাদের কাছে প্রশ্ন রইলো। আপনারা নিশ্চয়ই এই বিষয়ে সোহেলের বাবার মতো প্রগতিশীল হবেন না?
তারেক মাসুদ আসলে একজন নিখুঁত কারিগর। তিনি প্রগতিশীল সেই মানুষটাকে ভিলেন বানাননি। তাকেও বাস্তবের মানুষ বানিয়েছেন। শিরীনের নিজেরও যে গোঁড়ামি ছিলো, সেটা সিনেমার মাঝে এবং শেষভাগে পরিমিতভাবে চরিত্রায়ন করেছেন।
আহা! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়! নির্মাতা পুরো মানবজাতির কাছে একটা প্রশ্ন করে গেছেন– বাড়ি ফেরা। কোন বাড়ি ফেরা? এখন তোমার র্বতমান যে ঠিকানা, সেটাই কি তোমার বাড়ি, নাকি যে দেশে তুমি জন্মেছ, সেটাই তোমার বাড়ি?
লুডু খেলার ছলে নির্মাতা গল্পে এক ধরনের আইরনি তৈরি করেছেন সোহেলের বাড়ি ফেরা নিয়ে। আরেকটা করেছেন ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার সময় যখন সোহেল তার সৎমা আর বোনের সাথে একই গাড়িতে যেতে চেয়েছিলো। শিরীন তখন এই প্রস্তাব যেভাবে বাতিল করে দেয় এবং তখন সোহেলের যে উপলব্ধি হয় তার মায়ের প্রতি, সেটা আসলে নিখুঁতভাবে শিরীনের ক্যারেক্টারাইযজেশ– নির্মাতা যার প্রকৃত ব্যবহার করেছেন আবার শেষ দৃশ্যে।
প্রকৃত নির্মাতারা সিনেমায় অদ্ভুত কিছু মোমেন্ট তৈরি করেন। যারা কানেক্ট করতে পারে, তারা নির্মাতার বশ মেনে যায়। ‘অর্ন্তযাত্রা’য় যেমন সোহেলের বাবার কবরে সোহেল এবং তার দাদার মোনাজাত, মিলাদের পরদিন সকালে সোহেলের দুই মায়ের কথোপকথন, শিরীন আর বীথির কথোপকথন এবং মিলাদের দিন রাতে খাওয়ার টেবিলের সিকুয়েন্স। আমরা যারা সিনেমার জীবন মানে ভাবি রূপকথার জীবন, তাদেরকে তারেক মাসুদ সিনেমায় বাস্তব জীবন দেখালেন। সোহেলের দাদার বুক-ভার করা উচ্চারণ–
“জীবন আমাদের বিভক্ত করে আর মৃত্যু একত্রিত করে।”
মূলত ছেলের দুই বউকে একত্রে পাওয়া, নাতি-নাতনীকে একত্রে পাওয়া, মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে একত্রে পেয়ে তিনি এই প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। কিন্তু জীবন তাকে দেখিয়ে দেয়, মানুষের একত্রে থাকার সীমাবদ্ধতা কতটা নিষ্ঠুর। এখানেও নির্মাতা দারুণভাবে স্বার্থক।
মাঝে মাঝে মনে হয়, মানুষ তার নিজ প্রয়োজনে যেমন সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে, ঠিক তেমনি মনের ও ব্যক্তি প্রয়োজনের স্বার্থেও সে স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটতে ভালোবাসে। আমাদের দেশের নির্মাতাদের কথাই ধরা যাক। একটা সিনেমা নির্মাণ থেকে শুরু করে তার সারা ক্যারিয়ারজীবনে তাকে কেবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই হাঁটতে হয়। তবুও মনরে টানে সব কিছু ছেড়ে তারা সিনেমা বানায়। এই প্রেমটাকে আমরা কজনই পারি উপলব্ধি করতে?
আমরা প্রত্যেকেই আসলে স্বাভাবিক জীবন চাই। স্বাভাবিক জীবনের সংজ্ঞা আসলে কী? বিয়ে হওয়া? সারাজীবন ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরাধীন থেকে সংসার করা? নাকি শুধুমাত্র নিজের মতো করে বাঁচা? শিরীন স্বামী ছাড়া যতটুকু স্বাভাবিক, শিরীনের বান্ধবী বীথি হয়তো পরিপূর্ণ জীবন নিয়েও বিষাদের জীবনযাপন করছে।

ওস্তাদ বংশীওয়ালার বাঁশি বাজানো শেষ হলেও তার ঘোর যেমন অনকক্ষণ রয়ে যায়, তারেক মাসুদের এই সিনেমার কিছু দৃশ্য শেষ হয়ে গেলেও তার ব্যাপকতা অনেকক্ষণ ধরে দর্শকের মাথায় ঘুরতে থাকে। বিথী আর শিরীনের আলাপের শেষ অংশের কথা যদি বলি–
বিথীঃ এত লড়াই করে তুই নিজে কী পেলি?
শিরীনঃ কেন? স্বাধীনতা!
বিথীঃ তোর একা লাগে না?
শিরীনঃ কেন?… তোর লাগে না?
বিথীঃ লাগে; তবে সব সময় না। মাঝে মাঝে…
–জীবনের এই বোধটা শিখড়ে তুলে নির্মাতা দর্শকদের কিছু সময় দিলেন। সূর্যাস্ত হলো; রাত গড়ালো…। জী সুন্দর, জড পরিমিত তার গল্প বলা!
মানুষের মনের অনেক চাইল্ডিশ চাওয়ার মধ্যে অন্যতম– ছোট/বড় সবকিছুতেই জয়ী হওয়া; ক্ষুদ্রতম বিষ্য থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত। আমরা শুধু বুঝি হার অথবা জিত। এমন এক হার-জিতের জেদ থেকেই শিরীনের ডিভোর্স, বাবার কাছ থেকে ছেলেকে আলাদা করা, বিদেশ চলে যাওয়া। শিরীন এখন চায়– সোহেল তার নিজস্ব পরিবেশে বড় হোক। অথচ সন্তানের কাছে তার বাবা-মার থেকে নিজস্ব আর কি হতে পারে? সোহেলের জীবন থেকে শিরীন তার বাবার আদর কেড়ে নিয়েছে সামান্য জয়ী হওয়ার আশায়। মানুষ আসলে এমনই। চলচ্চিত্রে মানুষকে মোটা দাগে ভালো-মন্দ তো সহজেই দেখানো যায়; কিন্তু সবচেয়ে কঠিন– মানুষকে মানুষের মতো করে দেখানো। এটাই আমাদের নির্মাতাদের অনেক বড় সাধনার বিষয়।
অর্ন্তযাত্রা আসলে কী? এর সংজ্ঞা হয়তো একেকজনের কাছে একেক রকম। কিন্তু এক কথায় বলা যায়– বেলা শেষে মানুষ আসলে যেখানে যেতে চায় অথবা মানুষ আসলে যেখানে ফিরতে চায়। ছবির শেষ দৃশ্যে আপনার মনে একটা ভাব উদয় হতে পারে– প্রতিশোধ কোনোদিন জীবনকে সুন্দর করতে শেখায় না। আপনার আজকের ক্ষুদ্র জয় হয়তো আগামীদিনের সবচেয়ে বড় পরাজইয়ের কারণ। তাই সাইজি বলে গেছেন– “সময় গেলে সাধন হবে না।” আসুন, সময় থাকতেই সাধনাটা করি।
মৃত্যুই সবকিছুর শেষ না। আমাদের এই ‘সময়’একদিন শেষ হয়ে গেলেও হয়তো নতুন এক জগত নতুন এক সমইয়ের সৃষ্টি হবে অথবা সময় তার মতো চলতে থাকবে; মানুষের ফিরে আসার চেষ্টা, ফিরে আসার যাত্রা, অর্ন্তযাত্রা চলতেই থাকবে। শেষ-টাইটেল উঠে যাওয়ার পরও যেমন আমরা যাত্রার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমাদের তো শেষ হলো; কারও কারও যাত্রা হয়তো এখনো শেষ হয়নি।
আরেকটা কথা– জীবনকে যে এমনভাবে দেখাতে জানে, পর্দায় ঠিক ঠিক তা বলতে জানে, এমন একজন নির্মাতার জীবন কখনো শেষ হয়ে যায় না। তার যাত্রা নতুন করে শুরু হয় নতুনদের সাথে। বাংলার আকাশে এমন নির্মাতা আরও আসুক, অনেক আসুক।
বাহ!! সুন্দর। নতুন কিছু পড়লাম
আমাদের তো শেষ হলো; কারও কারও যাত্রা হয়তো এখনো শেষ হয়নি।’
অনবদ্য লেখনী।
চলুক..
“চলচ্চিত্রে মানুষকে মোটা দােগ ভােলা-মন্দ তো সহজেই দেখােনা যায়; কিন্তু সবচেয়ে কঠিন– মানুষকে মানুেষর মতো করে দেখােনা। এটা দেখােনাই আমােদর নির্মাতাদের অনেক বড় সাধনার বিষয়”
-লেখকের উপলব্ধি এবং লেখনী চমৎকার।
মানুষকে মোটা দাগে ভালা-মন্দ তো সহজেই দেখােনা যায়; কিন্তু সবচেয়ে কঠিন– মানুষকে মানুেষর মতো করে দেখােনা। এটা দেখানোই আমােদর নির্মাতাদের অনেক বড় সাধনার বিষয়”