সাক্ষাৎকার : হ্যারি কার; ১৯২৫
হলিউডের একটি আনুষ্ঠানিক ভোজসভা শেষে, অনেকটাই খালি পড়ে থাকা ডাইনিংরুমটিতে একজন ছোটখাট ও সংকুচিত তবে আত্মসচেতন ব্যক্তিত্ব ঢুকে পড়লেন। ওয়েটারদের মনে বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়ে আমরা দুই-তিনজন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম।
তিনি চার্লি চ্যাপলিন। আমাদের দিকে তাকিয়ে লাজুক মাথা নাড়ালেন। তারপর বসে পড়লেন পেছনের সিটে। সময়টা কোনো-না-কোনোভাবে দৃঢ়চেতা ছিল। চাঁদনি আলোর সে রাতে, অর্ধেক-খালি-হয়ে যাওয়া একটি ক্যাফে ছাড়া বেশি কিছু মনে হচ্ছিল না জায়গাটিকে।

‘দ্য গোল্ড রাশ’-এর জন্য কেউ একজন তাকে অভিনন্দন জানালেন। জবাবে চার্লি মাথা নাড়িয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন, ‘আপনি আমার সিনেমাটি সম্পর্কে কিছু কড়া আর কিছু ভালো কথা লিখেছেন।’ মুচকি হাসির ছায়া ছড়িয়ে দিয়ে আরও বললেন, ‘দুই ক্ষেত্রেই আপনার কথা একেবারে ঠিক…।’ তারপর যোগ করলেন, ‘…তবে আপনি যে বলেছিলেন, আমি নাকি সফিস্টিকেটেড হয়ে যাচ্ছি_ সে কথাটি ছাড়া।’
‘হচ্ছেন না?’
চার্লি মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘কখনোই না। কিছুতেই সফিস্টিকেটেড নই আমি। পত্রিকায় পড়েছি, এ সব করার পেছনে আমার নাকি বড় ধরনের মতলব আছে; কিন্তু তাদের ধারণা ভুল। আমার এই সহজাত প্রবৃত্তিটি নিখাঁদ; নাটকীয় প্রবৃত্তি। আমি এটাকে খেটেখুটে বানিয়ে তুলিনি; বরং স্রেফ জানি_ এটা ঠিক নাকি ভুল।’
“কিন্তু ‘অ্যা ওম্যান অব প্যারিস’-এ আপনি ভীষণ সফিস্টিকেটেড ছিলেন বলেই ফিল্মটি ফ্লপ খেয়েছে।”
‘আহ, ওটা তেমন একটা ফ্লপ খায়নি। এক হাজার ডলার আয় করেছে ফিল্মটি।’
‘কী ধরনের তর্ক করছেন আপনি? এই সিনেমাটি পুরো সিনেমা-চর্চাকে বদলে দিয়েছে, অথচ বক্স অফিসে তেমন সাড়া ফেলতেই পারল না।’
‘এর কারণ এই নয়, এটা ভীষণ সফিস্টিকেটেড ছিল; বরং কারণটা হলো, এটি অলীক কোনো আশার পথ ধারণ করেনি। ব্যাপারটি স্রেফ জীবনের মতোই। লোকজন দেখতে
চেয়েছিল_ ছেলেটি আত্মহনন থেকে রক্ষা পাক, আর মেয়েটি ছেলেটির কাছে ফিরে যাক; তারপর তারা সারাজীবন সুখে-শান্তিতে বসবাস করুক।’
‘অন্যভাবে বললে, এটি ট্রাজেডি ছিল।’
‘হ্যাঁ, এটি ট্রাজেডি ছিল’ _বলে খানিকটা ইতস্তত করলেন চার্লি; তারপর বললেন, ‘ট্রাজেডি আমার ভালোলাগে। কমেডি আমি পছন্দ করি না।’
‘মানে কী! আপনি কমেডি পছন্দ করেন না?’
‘না। আমি ট্রাজেডি পছন্দ করি; এটি চমৎকার জিনিস। কমেডি শুধুমাত্র তখনই অর্থবহ হয়, যখন সেটির মধ্যে সৌন্দর্য থাকে। সৌন্দর্যই জীবনের সবকিছু। তার দেখা যদি পেয়ে যান, তাহলে সবকিছুই দেখা হয়ে যাবে আপনার। তবে এর দেখা পাওয়া দুরূহ খুব।’
তার ড্রামা, বিশেষ করে ‘অ্যা ওম্যান অব প্যারিস’-এর মতো ড্রামাগুলো ইউরোপে তেমন একটা চলেনি_ এ প্রসঙ্গে কথা তুললেন কেউ একজন।
এ কথায় সহসাই আগ্রহ দেখালেন চার্লি। বললেন, ‘ইউরোপের একেক অংশে আমার ড্রামাগুলো যে একেকভাবে চলেছে, সে প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। আমি মনে করি, শুরু থেকেই এমনটা ঘটেছে; নিজেকে আমি সবচেয়ে ভালোভাবে জানি। যেমন ধরুন, অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে রাশিয়াতে আমার ড্রামাগুলো ভালো চলেছে, তবু তারা কিন্তু আমাকে ফানি লোক বলে একেবারেই মনে করে না। লোকজন চিঠিতে আমাকে জানিয়েছে, ‘দ্য পিলগ্রিম’ দেখে দর্শকরা হল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়েছিল। তারা আমাকে জীবনের একজন ইন্টারপ্রিটার হিসেবেই বিবেচনা করে। জার্মানিতে আমার কাজগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়ে থাকে। আর ইংল্যান্ডের লোকজন এগুলোকে ক্লাউনের মতো, ফানি হিসেবে দেখতে পছন্দ করে।’
চার্লি খুব একটা কথা বলেন না। কিন্তু আমি শুনেছি, রাশিয়াতে সাধারণত সেন্ট ও জার ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য যেখানে স্থান দেওয়া হয়, তেমনতর জায়গায় তার ভাস্কর্য বসানো হয়েছে। জীবনের এক ভীষণ ধ্যানী ছাত্র হিসেবে তাকে এতটাই মান্য করা হয় যে, জার্মানির একজন সম্ভ্রান্ত দার্শনিকের সঙ্গে তার তুলনা টেনে, জনৈক রাশিয়ান লেখক তাকে নিয়ে একটি বই লিখে ফেলেছেন।
কথায় কথায় আবারও কথা ঘুরল সিনেমার দিকে। আমাদের একজন বলে উঠলেন, ‘চার্লি, সিনেমার আসলে হয়েছেটা কী? যা-তা রকম সিনেমা হচ্ছে আজকাল।’
চার্লি বললেন, ‘না, তা নয়। ড্রামার যত রকম পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা আছে, তার সবই সিনেমায় বুননিতে লক্ষ লক্ষবার ব্যবহৃত হয়ে একেবারে জীর্ণ হয়ে গেছে : শুধুমাত্র এ ব্যাপারটি ছাড়া আর কিছুই হয়নি সিনেমার।’
‘এ থেকে বের হওয়ার পথ কী? কী করা যেতে পারে?’
‘পরবর্তী গতিপথ হলো, সিনেমায় ন্যারেটিভকে জায়গা করে দিতে হবে। এই ভীষণ এপিসোডধর্মী নাট্যগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। ‘দ্য গোল্ড রাশ’-এর মতো ড্রামাফিল্মগুলো স্রেফ একটি কাহিনী_ আলাস্কায় একেবারেই একা একা, নিজের সাধ্যমতো ‘বাঁচার’ চেষ্টারত এক হতভাগ্যের। চিত্রনাট্যে এ রকম ক্যারেক্টার-স্টাডিজ থাকতে হবে।’
‘পর্দায় কেন বড় মাপের [কোনো নতুন] অভিনেতার দেখা মেলে না? বড় মাপের সব অভিনেতাই কেন আগেকার দিনের?’
‘কারণ, তারা সবাই একে অন্যকে নকল করেন। নতুনদের উচিত পুরনো যে তারকাদের প্রতি নিজের মুগ্ধতা আছে, তাদের অনুকরণ করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা।’
চোখে মুখে স্বাপ্নিক দ্যুতি ছড়িয়ে চার্লি আরও বললেন, ‘এ সময়েরই কোনো একদিন নতুন কোনো এক স্ক্রিন-জিনিয়াসের আচমকা আবির্ভাব ঘটবে, আর তিনি পুরো পৃথিবীর বাঁক বদলিয়ে দেবেন। তিনি কে, তা আমি জানি না ঠিকই; তবে তিনি যে ঘাড়ত্যাড়া হবেন_ সে ব্যাপারে স্বাচ্ছন্দেই বাজি ধরতে রাজি আছি।’
‘দ্য গোল্ড রাশ’-এর কোন জিনিসটিকে সেরা হিসেবে মনে করেন_ সেই জিজ্ঞাসা রাখলাম চার্লির কাছে। খানিক দম নিয়ে জবাব দিলেন, মিউজিক হলে, মানুষের ভীড়ে মেয়েটি যখন অস্থিরভাবে একজন সত্যিকারের পুরুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, হতভাগ্য ‘পুচকে’টা ভাবল, মেয়েটি সরাসরি তাকেই বুঝি দেখছে; পরে সে বুঝতে পারল, মেয়েটির দৃষ্টি তাকে পেরিয়ে গেছে_ সেই মুহূর্তটিই সেরা, জানালেন তিনি।
নিজ বিবেচনায় তার সেরা কাজ কোনটি_ এমন প্রশ্নে কোনো দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিলেন, ‘ইজি স্ট্রিট’।
‘আর সেরা সিঙ্গেল সিন?’
এই বেলা তাকে ইতস্তত ও বিরক্ত মনে হলো। বললেন, ‘দেখুন… আমি জানি না; তবে আমার ধারণা, সেটি ‘দ্য কিড’-এর একটি দৃশ্য।’
এ পর্যন্ত নির্মিত সিনেমা থেকে তার বিবেচনায় সেরাগুলোর নাম জানতে চাইলে তিনি এই তালিকা পেশ করলেন [সবই ডব্লিউ. ডি. গ্রিফিথের বানানো] :
‘দ্য বার্থ অব অ্যা ন্যাশন’,
‘ইনটলারেন্স’,
‘হার্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’।
চ্যাপলিন আমাদের দিকে মার্জনার চোখে তাকালেন, যেন শেষ পর্যন্ত সংযত থাকার প্রচেষ্টা তার মধ্যে। জানালেন, ভন স্টের্নবার্গের ‘স্যালভেশন হান্টারস’কে তিনি এখনো এ যাবত নির্মিত সেরা সিনেমাগুলোর একটি মনে করেন। ‘ফিল্মটির চরিত্রগুলো আসল মানুষ ছিল না_ এই বিষয়টিকে অনেকে অভিযুক্ত করলেও নিঃসন্দেহে এটিই এই সিনেমার শ্রেষ্ঠতম দিক। তাদেরকে বাস্তব-মানুষ হওয়ার তো দরকার নেই। তারা তো প্রতীক, ভাবনা।’

চার্লির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ করলাম আমরা। তিনি জানালেন, পর্যাপ্ত টাকা জোগাতে পারলে দীর্ঘদিন স্থগিত করে রাখা, জনৈক ক্লাউনের বিষাদি-জীবনের কাহিনী নিয়ে ভেবে রাখা সিনেমাটি সম্পন্ন করবেন। তিনি জানেন, লোকজন ফিল্মটি পছন্দ করবে না; তবু যে করেই হোক, এটি তিনি বানাবেনই।
চার্লির আরও একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। বিষয়টি ওপেন-সিক্রেট : জ্যুভান্নি পাপিনির ‘লাইফ অব ক্রাইস্ট’ বইটি নিয়ে সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা তার বিয়ের অপ্রীতিকর প্রচারণার কারণে থেমে আছে। প্রধান চরিত্রে নিজের অসাধারণ অভিনয়-শিল্প থেকে কিছু ভাবনা ধার নিয়ে রেখেছেনও তিনি।
ক্রাইস্ট বা যীশুর চরিত্রটি নিয়ে কথা বলেছেন চার্লি। না সাহিত্যে, না মঞ্চে_ কোথাও যীশুর যথার্থ প্রতিনিধিত্ব কিংবা পারফরম্যান্সের দেখা এখনো মেলেনি। চার্লি বললেন, “আধা-জার্মান আর আধা-জাপানি সাদাকিচি হার্টমানের লেখাগুলোকেই আমার কাছে সবচেয়ে সুগভীর ট্রাজিক ও ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়েছে। তার ‘দ্য লাস্ট থার্টি ডেজ’ হলো যীশুকে নিয়ে এখন পর্যন্ত লেখা সবচেয়ে চমৎকার বই।”
চার্লি জানালেন, মঞ্চে সচরাচর দেখা মেলা সাধু, ধার্মিক ও বিষণ্ন-চোখের যীশুর তুলনায় তার যীশুর কনসেপশনটি একেবারেই আলাদা। ‘যীশু সুস্পষ্টতই রসবোধসম্পন্ন একজন চরম সামাজিক মন্ত্রমুগ্ধকারী মানুষ ছিলেন। বাইবেলে ধনী ও গরিবের বাড়িতে একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে তার মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াতে যাওয়ার কথা জানতে পারবেন আপনি। আমরা যেটাকে মিক্সার বলি, তিনি আদতে তা থাকলেও সর্বদাই ছিলেন নিঃসঙ্গ। পৃথিবীতে তিনি তার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন, কিন্তু কেউ তাকে বুঝত না। এটাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি।’
‘চার্লি, জীবন কি অর্থময়?’ _জানতে চাইলাম।
‘কখনো কখনো’ _দিলেন জবাব।
‘যেমন?’
‘যেমন ধরুন, সমুদ্র সৈকতে শুয়ে আছি আমি, দেখছি খোলা আকাশ; কোনো ভাবনা নেই_ এ এক পরম সুখ। তখন আমার পেট জানান দিলো, খাওয়ার সময় হয়েছে। আমি খেলাম। তারপর আবার শুয়ে পড়লাম বালুকাবেলায়। জীবন তখন অর্থময়।’
————————–
সূত্র : মোশন পিকচার ম্যাগাজিন। যুক্তরাষ্ট্র। নভেম্বর ১৯২৫
অনুবাদ : রুদ্র আরিফ