বীরেন দাশশর্মা: একজন শুদ্ধ চলচ্চিত্র শিক্ষক

451
বীরেন দাশশর্মা

লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

সময়টা ২০০৪ সাল। তখন আমরা দলবেঁধে চলচ্চিত্র অনুধাবনের প্রয়াসে মশগুল। আমাদের গন্তব্য সর্বত্র। ঘরে এবং বাইরে যেখানেই চলচ্চিত্র তৎপরতা সেখানেই আমাদের উপস্থিতি। দল করি না, কোনো চলচ্চিত্র সংসদের সদস্য নই; তথাপি আমরা চলচ্চিত্র উন্মাদ। তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমাদের বহুদিনের আশ্রয়। কেন্দ্রের চলচ্চিত্র চক্র বলে একটি কর্মসূচি আছে সেখানে বহুদিন ধরেই সম্পৃক্ত। প্রতি সপ্তাহে চলচ্চিত্র দেখার আয়োজন সাধারণত মিস করি না। কেন্দ্রে শুক্র ও শনিবারের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর তৎপরতার বাইরে তখন গ্যাটে ইনস্টিটিউট, আঁলিয়স ফ্রঁসেস, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার, ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র– সবখানেই আমাদের দৌঁড়ঝাপ। এই দৌঁড়ঝাপের মাঝেই একদিন জানলাম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স অনুষ্ঠিত হবে। কোর্সের শিক্ষক কলকাতা থেকে আসবেন। তিনি কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক।

চলচ্চিত্র চক্রে নিয়মিত হওয়ায় তখন কেন্দ্র আমাদের ঘরবাড়ি। আমরা কয়েকজন খুব আগ্রহী হলাম এই ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের বিষয়ে। কেন্দ্রে তখন চলচ্চিত্র-বিষয়ক কর্মসূচির দায়ভার নকীব ভাইয়ের ওপর। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গেলাম নকীব ভাইয়ের কাছে। নকীব ভাই কোর্সের অংশগ্রহণকারী না করে প্রস্তাব দিলেন কোর্স আয়োজনে সহযোগিতা করার। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আর এভাবেই বীরেন দাশশর্মার পরিচালনায় কোর্সে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী না হয়ে, হলাম কোর্সের আয়োজনের অংশীদার।

যাহোক, কোর্সের তারিখ একাধিকবার পিছিয়ে হলেও একদিন সব কিছু ঠিকঠাক হলো। জানলাম বীরেন দাশশর্মা একজন বরেণ্য চলচ্চিত্র শিক্ষক। তিনি দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র শিক্ষকতার সাথে যুক্ত। ব্যস এ পর্যন্তই। মানুষটাকে জানার বোঝার সুযোগ হলো এরও বহু পরে।

বীরেন দা ঢাকায় এলেন এবং এক নির্ধারিত দিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কোর্সের ক্লাস শুরু হলো। আয়োজনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে কোর্সের ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে বীরেন দা’র সাথে মেশার, আলোচনা করবার বহু অবসর পেয়েছিলাম। সে অবসর এবং আলোচনা নিরবে আমাদের মন ও মনন গড়ে দিচ্ছিল তা জানবার বা বুঝবার সুযোগ তখন হয়নি। এখন যখন পেছনে ফিরে দেখি, তখন আশ্চর্য হই, দেখি যে বীরেন দা কী অবলীলায় আমাদের মনে স্থায়ী ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।


বীরেন দা
বললেন, ‘তোমরা
তো দেখছি চলচ্চিত্র
বিষয়ে ভালো রকম সিরিয়াস।
তাহলে তোমরা কিছু
করছো না
কেন?’

সে দফায় বীরেন দা’র সাথে আমরা একটি দুপুর এবং বিকেল নিজেদের মতো কাটাতে পেরেছিলাম। আমি এবং আমাদের দুইজন বন্ধু ছিলেন সে আড্ডা এবং ঘোরাঘুরির সঙ্গী। পুরো দুপুর এবং বিকেল ঘোরাঘুরি শেষে যখন বীরেন দা’কে তাঁর হোটেল কক্ষে পৌছে দিতে গেলাম, তখন বীরেন দা বললেন, ‘তোমরা তো দেখছি চলচ্চিত্র বিষয়ে ভালো রকম সিরিয়াস। তাহলে তোমরা কিছু করছো না কেন?’

আমাদের তেমন কোনো শক্ত জবাব ছিল না। আমি বলেছিলাম, ‘এখনও তো জানা-বোঝার প্রক্রিয়া যথেষ্ট হয়নি; এত কম জানা-বোঝা নিয়ে কী করে কিছু করব?’ তিনি বললেন, ‘দেখো, গত তিন-চারদিনে তোমাদের যতটুকু বুঝলাম, তাতে তোমাদের বোঝাপড়া একেবারে কম কিছু নয়। এটুকু প্রস্তুতিও আজ বহু মানুষের নেই, যারা হয়তো অনেক কিছু করছে। আমার কথা হলো, তোমরা যদি সিরিয়াসই হও, তাহলে দেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির জন্য কিছু করো। সংঘবদ্ধভাবে কাজ করো।’

বীরেন দাশশর্মা
বীরেন দাশশর্মা

এ কথার উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘আমরা হয়তো করব, আসলে তেমনটা ভাবছিও। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আরও কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েই শুরু করব। এখনও ঠিক সেভাবে নিজেদের প্রস্তুত ভাবছি না।’

এ কথার প্রেক্ষিতে বীরেন দা যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা আমার দেখার দৃষ্টিকেই বদলে দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বেশ, ধরো ঠিক তোমার বয়সী এবং তোমার সমান প্রস্তুতি নিয়েই প্যারিসে একটি ছেলে, নিউইয়র্কে একটি ছেলে এবং মুম্বাইয়ের একটি মেয়ে আজ থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। তুমি কিন্তু শুরু করলে না। তুমি অপেক্ষা করলে আরও প্রস্তুতির। ধরো তুমি আরও পাঁচ বছর প্রস্তুতি নিলে। তারপর একদিন ভাবলে, ঠিক আছে, আজ তবে শুরু করা যাক। যেদিন ভাবলে তুমি আজ শুরু করবে, ততদিনে কিন্তু পাঁচ বছর সময় চলে গেছে। ঠিক তোমার বয়সী একটি ছেলে প্যারিসে, একটি ছেলে নিউইয়র্কে এবং একটি মেয়ে মুম্বাইতে তোমার শুরুর সময় থেকে পাঁচ বছর এগিয়ে থাকল। হ্যাঁ, তুমি বলতে পারো যে তুমি এই পাঁচ বছরে আরও পরিপক্ক হয়েছো, তাই হয়তো তুমি কাজও ওদের চেয়ে ভালো করবে। কিন্তু ওরা তো পাঁচ বছর ধরেই কাজ করছে। ওদের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা এবং কাজের ধারাবাহিকতা ওদের সবসময় তোমার থেকে এগিয়ে রাখবে। সংগঠিতভাবে কিছু করতে চাইলে তার জন্য সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না। আজ শুরু করলে তো আগামীকাল দেখবে তুমি একদিন এগিয়ে আছো। আর যারা তোমার মতো করে ভাবছে, তারা কিন্তু একদিন পিছিয়ে থাকল। তাই আমি বলি কি, একদম সময় নষ্ট করো না। শুরু করো। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক কাজ হওয়া দরকার। তোমরা শুরু করো, দেখবে আরও অনেকে তোমাদের দেখে অনুপ্রাণিত হবে। তারাও কাজ করতে চাইবে। তখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পরিবেশটা আরও সুন্দর হবে।’


সংগঠিতভাবে কিছু
করতে চাইলে
তার জন্য
সময়
নষ্ট
করার কোনো
অর্থ হয়
না

এই বক্তব্যের প্রতিটি কথা আমার আজও মনে আছে। মনে আছে বলেই আমরা আর সময় নষ্ট করতে চাইনি। আমরা তখন ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আজ যখন পেছনে ফিরে দেখি, তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ম্যুভিয়ানা’র বয়স ১৪ বছর হয়ে গেছে। বিস্মিত হই এই ভেবে যে, বীরেন দা কতটা সত্যি ছিলেন। কতটা আন্তরিক পরামর্শ তিনি সেদিন দিয়েছিলেন। সেদিনের সে আলোচনায় ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি’র জন্মবীজ ভূমি পেয়েছিল। না হলে কে জানে আমরা হয়তো এভাবে শুরু করে দেওয়ার প্রেরণা কখনও পেতাম না।

২.

বীরেন দাশশর্মার এমন আন্তরিক অবদানের পর সত্যিকারঅর্থে মানুষটিকে জানার তাগিদ অনুভব করেছি। অবাক হয়েছি, যতটা জেনেছি। বলে রাখি যে, বীরেন দাশশর্মা বাংলাদেশেরই মানুষ। তাঁর পূর্ব-প্রজন্মের আদিনিবাস যশোর জেলায়। দেশভাগের কিছুকাল আগে ওনার পূর্ব-প্রজন্ম কর্মসূত্রে পশ্চিমবাংলার বাসিন্দা হন। বাংলাদেশে বীরেন দা’র সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। তাঁরা দু’জনেই সত্তরের দশকের শেষ প্রান্তে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক ফাদার গাঁস্ত রোবেজের ছাত্র ছিলেন। ফাদার গাঁস্ত রোবেজ তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র স্কুল চিত্রবানীতে এই দুইজন চলচ্চিত্রপ্রেমী তরুণকে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র বিদ্যায় হাতেখড়ি। তারেক মাসুদ তো সে কোর্স শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু বীরেন দাশশর্মা পরবর্তীকালে দীর্ঘসময় চিত্রবানীর সমন্বয়ক ও চলচ্চিত্র শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ফাদার গাঁস্ত রোবেজের সাথে। তারেক মাসুদ এবং বীরেন দাশশর্মার এই বন্ধুত্ব স্থায়ী হয়েছিল তাঁদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় যখন বীরেন দাকে আমরা আমন্ত্রণ জানাই ‘তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা’ প্রদানের জন্য, তখন তিনি সে আমন্ত্রণ অত্যন্ত আবেগপ্রবণভাবে গ্রহণ করেন। ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে সে বক্তৃতা প্রদানের শুরুতে বীরেন দা বারবার কেঁদে ফেলেন বন্ধু তারেকের অকাল প্রয়াণের বেদনায়।

৩.

বীরেন দা ভারতের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অন্যতম সৎ সংগঠক ছিলেন। পশ্চিমবাংলার নৈহাটি চলচ্চিত্র সংসদের একজন কর্মী ও সংগঠক হিসেবে তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় সক্রিয় ছিলেন। বীরেন দা’র কাছ থেকে শোনার সুযোগ হয়েছে কি নিষ্ঠা এবং শ্রমে তারা তাদের তারুণ্যের দিনগুলোতে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।


আজীবন
তিনি চলচ্চিত্র
সংসদ আন্দোলনের
শুদ্ধতা ধরে রেখেছিলেন

আজীবন তিনি চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের শুদ্ধতা ধরে রেখেছিলেন। যারা জানেন তারা সবাই বীরেন দা’র ধীরস্থির মৃদু আলাপে মুগ্ধ হতেন। এত স্থির, শান্ত মানুষ আমি আমার জীবনে খুব বেশি দেখিনি। রুচিবান, স্নিগ্ধ মানুষ ছিলেন বীরেন দাশশর্মা। বীরেন দাশশর্মা একজন সাংগঠনিক মানুষ ছিলেন। সব কাজ তিনি পরিকল্পনা অনুসারে করতেন। অগোছালো, খামখেয়ালের কিছু কখনও দেখিনি তার মাঝে। জানতেন চলচ্চিত্রের নাড়িনক্ষত্র সবই। কিন্তু বিনয়ে ছিলেন মূর্তিমান অবতার। মৃদু হাসিতে সবসময় রসিকতা করতে ভালোবাসতেন। কঠিন কঠিন পরিস্থিতিতেও দেখেছি খুব শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার পরামর্শ দিয়েছেন। এমন বিরল মানুষ আজ আর কোথায়!

বীরেন দাশশর্মা
বেলায়াত হোসেন মামুন ও বীরেন দাশশর্মা

৪.

২০১৬ সালে যখন আমাদের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন, আমরা তখন তিনটি কাজ করেছিলাম। তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা ২০১৬-এর বক্তা ছিলেন বীরেন দা। এছাড়া তিনি এ সফরে একটি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স এবং একটি চিত্রনাট্য রচনাবিষয়ক কর্মশালা পরিচালনা করেছেন। ১০/১২ বছর আগে আমার যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল বীরেন দা’র পাঠদানে, দেখলাম এত বছর পরেও নতুন শিক্ষার্থীদের সেই একই অনুভব-অনুভূতি হলো। বীরেন দা’র পার্থক্য বলতে যতটুকু দেখলাম তা একেবারেই কারিগরি। তিনি আগে হাতে লেখা কাগজের নোটের স্লাইড ওভারহেড প্রজেক্টরে প্রজেক্ট করে ক্লাস নিতেন, আর এবার দেখেছি তিনি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে প্রেজেন্টটেশন দিয়ে ক্লাস নিলেন। এর বাইরে তিনি আর এতটুকু বদলাননি। সেই ধীর-স্থির শান্তভাবে স্পষ্ট উচ্চারণে খুব শাণিত বাক্যে চলচ্চিত্রবোধ সৃষ্টির প্রেরণায় উজ্জীবিত বীরেন দাশশর্মা।

৫.

চলচ্চিত্র সমালোচক, লেখক, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও সংগঠক– এসব পরিচয়ের বাইরে বীরেন দা’র সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন চলচ্চিত্র শিক্ষক। তিনি সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসেবে তার শিক্ষকতার জীবন সমাপ্ত করেছিলেন। গত ১৮-২০ বছরে আমি আরও বহু চলচ্চিত্র শিক্ষক দেখেছি, তাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে খুব গভীর সম্পর্কও আমার আছে– যারা দেশে ও বিদেশের বহু সম্মান ও খ্যাতিতে উজ্জ্বল। কিন্তু বীরেন দা’র মতো এমন শুদ্ধ চলচ্চিত্র শিক্ষক আমি আর একজনকেও দেখিনি। বীরেন দা’র সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি আজীবন চলচ্চিত্রকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। চলচ্চিত্রের ভাষা ও এর ঐতিহ্য বিষয়ে ছিলেন একজন আদর্শ পণ্ডিত-মানুষ। বীরেন দা’র অন্যান্য গুণের সমাবেশ তৈরি হয়েছে এই ভালোবাসা থেকে। চলচ্চিত্রকে জেনে-বুঝে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন বলেই তিনি যখন চলচ্চিত্র বিষয়ে আলোচনা বা পাঠদান করতেন, তখন তা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতো। ওনার বিশ্বাস এবং অনুরাগ অতি জানা বিষয়কেও মহার্ঘ্য জ্ঞানে পরিণত করত। উনি ভালোবাসতেন বলেই ওনার পাঠের সংস্পর্শে আসা মানুষও চলচ্চিত্রকে ভালোবাসত। ভালোবাসা যে সংক্রামক তা বীরেন দাকে বোঝার মধ্য দিয়েই অনুভব করেছি।

বীরেন দাশশর্মা

বীরেন দাশশর্মা আমাকে বহু কিছু শিখিয়েছেন অনায়াসে। শেখানোর জন্য উনি কোনো চেষ্টাই করেননি। কিন্তু দিনশেষে অনুভব করেছি, আমি কিছুটা ঋদ্ধ হলাম। এমন আদর্শ চলচ্চিত্র শিক্ষকের গল্প আমি শুনেছি আরেকবার। ওনার নাম অধ্যাপক সতীশ বাহাদুর। তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন, যেটিকে বাংলাদেশে সবাই পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট হিসেবে চেনেন। ওনার গল্প বাংলাদেশে বহুভাবে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আমরা ওনাকে কখনও পাইনি। আমরা পেয়েছি অধ্যাপক বীরেন দাশশর্মাকে। অধ্যাপক বীরেন দাশশর্মা আমাদের বহুজনের হৃদয়ে চলচ্চিত্রবোধ সৃষ্টি করেছেন। অধ্যাপক সতীশ বাহাদুর দুইবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। একবার ১৯৭৫ সালে, অন্যবার ১৯৭৯ সালে। অবাক হবার বিষয় যে, অধ্যাপক বীরেন দাশশর্মাকে চলচ্চিত্র শিক্ষক হিসেবে আমি দু’বার পেয়েছিলাম। কোনোবারই আমি সরাসরি ওনার ছাত্র ছিলাম না। একবার ছিলাম আয়োজকদের অংশ আর অন্যবার নিজেই আয়োজক। অধ্যাপক বীরেন দাশশর্মার সরাসরি ছাত্র না হয়েও আমি ওনার জ্ঞান-পাণ্ডিত্য এবং মননের স্পর্শে ঋদ্ধ হয়েছি। সম্ভবত আমিই হয়েছিলাম তার একমাত্র ছাত্র। কারণ শেখার-জানার মনটা আমার তৈরি ছিল। তিনি সেই তৈরি হওয়া মনে স্থায়ী ছাপ রেখেছিলেন।

৬.

২০১৬ সালের মার্চ মাসে তিনি আমাদের আমন্ত্রণে মাত্র পাঁচ দিন বাংলাদেশে ছিলেন। এই পাঁচ দিনে আমরা বহু কিছু করবার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। তিনি বলেছিলেন তিনি আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে অবসরে যাচ্ছেন। এরপর তিনি মুক্তভাবে নিয়মিত বাংলাদেশে আসতে পারবেন। আমি ওনাকে বাংলাদেশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’-এ অধ্যাপনার জন্য আসবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাই, তবে অবশ্যই আমি আসব।’ আমি এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট এবং সরকারের দায়িত্বশীল মহলে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। এছাড়া এই সফরে আমাদের একটি উদ্যোগের উদ্বোধন করেছিলেন বীরেন দা। আমরা বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের জন্য চলচ্চিত্র শিক্ষার একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই স্কুলের নাম ‘বাংলাদেশ ফিল্ম স্কুল’। বীরেন দা সানন্দে আমাদের এ কাজে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন অবসরে যাওয়ার বিষয়ে অনেক কাজের চাপে থাকবেন আগামী কয়েকটি মাস। এরপর তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম স্কুলের জন্য একাধিক মডিউল তৈরি করে দেবেন। কিন্তু সে সুযোগটি তিনি পাননি। ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে কলকাতায় তিনি প্রয়াত হন। হৃদরোগের এই হামলা যে শুধু বীরেন দাকে পরাস্ত করেছিল– তা নয়; এই হামলা আমাদের অনেককে পরাস্ত করেছিল। ভাবতেই পারিনি এভাবে আচমকা বীরেন দা চলে যাবেন। সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে অবসরের সাথে সাথে তিনি জীবন থেকেও অবসর নেবেন, তা আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। এ আমাদের জন্য এক কঠিন আঘাত। এমন একজন মানুষের কাছ থেকে আমাদের আরও বহু কিছু শেখার, জানার ছিল– যা আমরা পেলাম না। এ অপূরণীয় ক্ষতি।

বীরেন দাশশর্মা
বীরেন দাশশর্মা

৭.

অধ্যাপক বীরেন দাশশর্মা একজন অসাধারণ ভালো মানুষ ছিলেন। আর ভালো মানুষ ছিলেন বলেই তার চলচ্চিত্রচিন্তা ও বৃদ্ধিবৃত্তিক মননে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। সহজ, স্পষ্টভাবে তিনি বলতেন, লিখতেন এবং পড়াতেন। এমন আদর্শ মানুষ, আদর্শ শিক্ষক কালেভদ্রে মেলে। আমি ভাগ্যবান ছিলাম, যে কারণে আমার দেখা হয়েছিল অধ্যাপক বীরেন দাশশর্মার সাথে। আমি নিশ্চিত যারা ওনার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারাও স্বীকার করবেন, এমন আদর্শ মানুষ ও চলচ্চিত্র শিক্ষক তারা খুব একটা দেখেননি।

বীরেন দা’র প্রতি আমার এবং আমাদের ভালোবাসা কখনও কম হবে না। আমরা তাকে স্মরণ করি সবসময়।

Print Friendly, PDF & Email
লেখক; চলচ্চিত্র নির্মাতা; চলচ্চিত্র সংগঠক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র : অনিবার্য [ পোশাক শ্রমিক আন্দোলন; ২০১১]; পথিকৃৎ [চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক; ২০১২ (যৌথ নির্মাণ)]; সময়ের মুখ [জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন অবলম্বনে; ২০১৮]। সম্পাদিত ফিল্ম-ম্যাগাজিন : ম্যুভিয়ানা; চিত্ররূপ। সিনে-গ্রান্থ : চলচ্চিত্রপাঠ [সম্পাদনা]; চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়া; স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; চলচ্চিত্রকথা [তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার; সম্পাদনা]। পরিকল্পক ও উৎসব পরিচালক : নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্র উৎসব

2 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here