আমার ভাই ঋত্বিক ঘটক: প্রতীতি দেবী

1255
ঋত্বিক ঘটক

লিখেছেন । প্রতীতি দেবী

ঋত্বিক ঘটক ও আমি যমজ ভাই-বোন। আমরা একই সঙ্গে মাতৃজঠর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আলো দেখি। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের জন্ম হয় ঢাকার ২, ঋষিকেশ দাশ রোডের ঝুলন বাড়িতে। আমার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক তখন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ঋত্বিকের কথা বলতে গেলে, আমাদের পরিবার সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। আমাদের পূর্বপুরুষ সোয়া দু’শ বছর আগে কাশ্মীর থেকে পাবনা এসে বসতি করেন। আমার মাতুল বংশও একইসঙ্গে আসেন। তারা রাজশাহীতে বসতি স্থাপন করেন। বাবার মুখে শুনেছি, নেহরু ও রবীন্দ্রনাথদের পরিবারও একই সময় কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন।

আমার বাবা অত্যন্ত সুদর্শন ও মেধাবী ছিলেন। জীবনে কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। আটটি ভাষায় এম.এ. করেন। ঢাকায় পোস্টিংয়ের সময় বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। প্রতি মাসে ছয়টি লেকচার দিতে হতো। ঢাকা থেকে বদলির সময় বাবা তার গ্রিক লিটারেচারের সমস্ত কালেকশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে যান। আমার বড় ভাই মনীশ ঘটক, কল্লোল যুগে যুবনাশ্ব নামে খ্যাত ছিলেন। তার কন্যা খুকু, যিনি সাহিত্য মহলে মহাশ্বেতা দেবী নামে সুপরিচিত, আমাদের চাইতে মাত্র আড়াই মাসের ছোট। আমার মেজদা সুধীশ ঘটক লন্ডন ও জার্মানি থেকে সিনেমাটোগ্রাফির ওপর কোর্স করেন। বোম্বের বিমল রায় তারই কাছ থেকে ছবি বানানোর শিক্ষা নেন। প্রতি মাসে তিনটে পত্রিকা বেরুতো আমাদের বাড়ি থেকে। অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্ররা হরহামেশা আসা-যাওয়া করতেন, আড্ডা দিতেন। ঋষিকেশ রোডের ঝুলন বাড়ি গুণীজনদের মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঝুলন বাড়িতে গিয়েছিলেন, আমার বাবার অতিথি হয়ে। সে ছবি বলধা গার্ডেনে রয়েছে। শুধু আড্ডা নয়, নিয়মিত গানের আসরও বসত। প্রতি সন্ধ্যায় আমার মা পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতেন। বাবা পাশে দাঁড়িয়ে শুনতেন। আমরা সবাই লাইন দিয়ে চুপ করে সেই গান শুনে যেতাম। এই রুটিনের একচুল এদিক-ওদিক নড়াচড়ার উপায় ছিল না। নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে আমাদের চলতে হতো।

ঋত্বিক ঘটক
ঋত্বিক ঘটক
অল্প বয়সে

বাবার বদলির চাকরি ছিল বলে ঋত্বিক আর আমার পড়াশোনা ভীষণ ব্যাহত হয়। সে সময় ভাইদের কেউ কেউ সংসারী হয়ে যার যার কর্মস্থলে ব্যস্ত। কেউ কেউ বিদেশে পড়াশোনা করছেন। দিদিদেরও সবাইর বিয়ে হয়ে গেছে। পাঁচ ভাই, চার বোনের মধ্যে আমরা দুজন কনিষ্ঠতম। আমাদের বড় যে ভাই– লোকেশ ঘটক, তিনিও আমাদের চাইতে আট বছরের বড়। সুতরাং আমাদের দুজনকে ছেলেবেলাতেই দার্জিলিং পাঠানো হলো পড়তে। আমাদের দুজনের ডাকনাম ছিল ভারি মজার। আমার নাম ছিল ভবি আর ঋত্বিকের ডাক ছিল ভবা।

আমার তিন মাস বয়সে বাবা বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন মেদিনীপুর। ঢাকার কথা আমি যা শুনেছি, সব বাবা-মা-ভাই-বোনদের মুখে। তাদের কাছে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ‘ঝুলন পূজো’। এই পূজো শ্রাবণ মাসে হয়। ঢাকার ব্যবসায়ী শ্রেণি সাহা ও বসাকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পূজো হতো। কিন্তু সাজানোর মাল-মশলা আসত নবাববাড়ি থেকে। সোনা, রূপোর গাছ হাতির ওপরে বসিয়ে মিছিল যেত নবাবপুর রোড দিয়ে। আর মহররমের ‘তাজিয়া’ বের হতো খুব ধুমধামের সঙ্গে। আমার বাবা ঢাকার খুব প্রশংসা করতেন। তার মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী কলেজকে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে তুলনা করতেন। আর করবেন না কেন, আমি ওই কলেজে পড়েছি। সে সময় ড. স্নেহময় দত্ত ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল, আবু হেনা পড়াতেন ইংরেজি সাহিত্য, ড. এমদাদুল ইসলাম ছিলেন অঙ্কের অধ্যাপক। সে সময় রাজশাহী কলেজ থেকে অধ্যাপকরা বদলি হয়ে যেতেন প্রেসিডেন্সিতে। প্রেসিডেন্সি থেকে আসতেন রাজশাহী কলেজে।

বাবা বদলি হওয়ার পর রাজশাহী এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করলেন। ঘোড়ামারায় আমাদের বিশাল বাড়ি। কাছেই সাবার পাড়ায় থাকতেন আমার মাতামহ, নামকরা অ্যাডভোকেট শ্রী মহেশ্বর ভট্টাচার্য, ব্রজেন্দ্র মৈত্র পাকিস্তানের সংসদ সদস্য, সুরেণ মৈত্ররা ছিলেন আমার মায়ের পিসতুতো ভাই। অখণ্ড ভারতের সংসদ সদস্য কিশোরী মোহন চৌধুরী ছিলেন আমার মায়ের পিসতুতো কাকা।

ঋত্বিক ঘটক
ঋত্বিক ঘটক
১৯৪০ দশকে

আমরা যখন রাজশাহী, সে সময় সেখানকার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উঁচু মানের। পুটিয়ার রাজা, নাটোরের মহারাজা, দীঘাপাতিয়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর শীতকালে সাহিত্য-সঙ্গীত সম্মেলন হতো। এইসব সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আমার বড় ভাই মনীশ ঘটক। আমাদের রাজশাহীর বাড়িতে এইসূত্রে পদার্পণ ঘটেছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ কুমার সান্যালের। শরৎচন্দ্রের কথা আমার মনে আছে। তিনি চা-কফি ছাড়া কিছু খেতেন না। এত শান্ত আর কথা এত কম বলতেন যে, আমার আমার দাদাকে বলি– ‘এই তোমাদের শরৎচন্দ্র? ইনি তো কথাই বলেন না!’ আমার বড় দাদার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ মুজতবা আলী; শেষোক্তজনের চাচা আইসিএস এস.এম. আলী ছিলেন আমার বাবার বিশিষ্ট বন্ধু।

সে সময় রাজশাহীতে হিন্দু-মুসলমানের কোনো বিভেদ ছিল না। ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটাই কখনো শুনিনি। আমাদের বাড়িতে মুসলমান সম্প্রদায়ের জ্ঞানী-গুণীজনরা তো আসতেনই। সাধারণ শ্রেণিরও ছিল অবাধ প্রবেশ। হিন্দু ছেলেতের পাশে বহু মুসলমান ছেলে আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। শিল্পী জয়নুল আবেদীনও আমাদের বাড়িতে থেকেছেন। মিউজিক কনফারেন্সে যোগ দিতে ১৯৩৫ সালে এসেছিলেন ফয়েজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, ওঙ্কার নাথ ঠাকুর, তারাপদ ঠাকুর, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। তারা আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসেন। উদয় শঙ্করও এসেছেন। তার সঙ্গে ঋত্বিকে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে ঋত্বিক উদয় শঙ্করের কলকাতার বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেছে।


পাশে
শুয়ে পড়ে
বলল, ‘তোকে ছাড়া
একদম ভালো লাগছিল
নারে। অসুখ হয়ে ভালোই হলো!’

শিশুকাল অবসানের পর, রাজশাহীর আলো-বাতাস টেনেই আমাদের কৈশোর-তারুণ্যের সবুজ পাতা উর্ধ্বমুখী হয়েছিল। আমরা দুই ভাই-বোন ছিলাম দুজনের পরম বন্ধু। এক সঙ্গে এক স্কুলে পড়েছি। এক সঙ্গে খেলেছি। এক সঙ্গে ঘুমিয়েছি। একই রকম পোশাক পরেছি। একই সঙ্গে সাইকেল চালিয়েছি। ঘোড়া দাবড়িয়েছি। ঘুড়ি উড়িয়েছি। এক মুহূর্তের জন্যও আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। আট বছর বয়সে আমার ডিপথেরিয়া হলো। ভয়ানক ছোঁয়াচে বলে আলাদা ঘরে আমাকে রাখা হয়। সকলের ও-ঘরে ঢোকা বারণ। কিন্তু ঋত্বিক লুকিয়ে আমাকে ঠিকই দেখে যেত। ধরা পড়লে মা বকুনি দিতেন। চারদিনের দিন ওকেও ডিপথেরিয়ায় ধরল। ও তো মহাখুশী। আমার পাশে শুয়ে পড়ে বলল, ‘তোকে ছাড়া একদম ভালো লাগছিল নারে। অসুখ হয়ে ভালোই হলো!’ যে ছেলে ইনজেকশন দেখে ভয়ে মরত, সে-ই কি-না দাঁতে দাঁত চেপে বড় বড় সিরাম ইনজেকশনগুলো হজম করত। ওর জন্য কি যে কষ্ট হতো তখন আমার!

নয় বছর বয়সে আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলাম। সে যুগে টাইফয়েডের কোনো ওষুধ ছিল না। ৮৬ দিন পর আমার জ্বর সারল। পরে শুনেছি, আমার অসুখের সময় ঋত্বিক ঘরের সব জিনিসপত্র পাগলের মতো ভেঙ্গে ফেলত। আমার খেলনা, বই বুকে চেপে আমাদের খেলাঘরে বসে বসে শুধু কাঁদত।

এগারো বছর বয়সের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের রাজশাহীর বাড়ির বিশাল ছাদের ওপরে আমরা দুই ভাই-বোন ঘুড়ি ওড়াতাম। বাড়ির কাজের লোকেরা কাঁচ গুড়ো করে সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে দিত। আমাদের ঘুড়িটা হঠাৎ কেটে যায়। সেটির সুতো ধরতে গিয়ে আমি ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান হাত দু’টুকরো হয়ে গেল। কিন্তু ঋত্বিকের ‘মা…মা…’ করে বুক ফাটা কান্না শুনে সবাই ওকে নিয়েই টানাটানি করছে। সবাই ভাবছে ঋত্বিকের কিছু হয়েছে। আর আমি? ওই ভাঙা হাত ব্যান্ডেজ করে আবার ছুটেছি ছাদে, ঘুড়ি ওড়াতে!

ঋত্বিক ঘটক
ঋত্বিক ঘটক ও সুরমা ঘটক [স্ত্রী]
১৯৬০ দশকে

দুপুর হলেই ঋত্বিক আর আমি ছাদে চলে যেতাম। আমার কণ্ঠে ওর প্রিয় গান ছিল– ‘মধ্য দিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি/ হে রাখাল, বেনু তবে বাজাও একাকী।’ ছাদের নহবতখানায় বসে ও বাঁশি বাজাত। আর আমাকে বারবার গাইতে হতো ওই গানখানি। ঋত্বিক খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারত। আড়বাঁশি। রাগসঙ্গীতেও ওর ছিল সহজাত দক্ষতা। ভালো আঁকত। পাঁচ বছর বয়সে ও ছাদের ঘুরন্ত ফ্যানের ছবি এঁকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ঋত্বিক যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, তখন দেশ পত্রিকায় ওর কবিতা ছাপা হয়। পঞ্চাশ বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনে ঋত্বিকের কবিতাও আছে। গল্প লিখত। নাটক করত। এত প্রতিভা নিয়ে ও ক্রমান্বয়ে ছন্নছাড়া হয়ে ওঠে। টেক্সটবুক ও ছুঁয়েও দেখত না। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে কবিতা মুখস্থ করে ফেলত। ওর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত বাবার কাছে এসে আফসোস করতেন, ও যদি একটু বই খুলে দেখত তো ফার্স্ট হতো।

পড়ালেখার প্রতি অমনোযোগিতার জন্য ও যখন নাইনে পড়ে, বয়স কত আর, বড়জোর পনের, টেকনিক্যাল লেখাপড়া শেখার জন্য ওকে কানপুর পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ছয় মাস পর আমার চাইতে আধ-হাত লম্বা হয়ে ফিরে এলো। না, মাকে ছাড়া ও কানপুরে থাকবে না। মাকে ও ভীষণ ভালোবাসত।


বিকাল হলেই সাইকেলের
পেছনে বসিয়ে ওকে
নিয়ে পদ্মার
চর চলে
যেতাম

আবার আমাদের যৌথ অভিযান শুরু হলো। পদ্মা নদীর চরে বেড়াতে ও খুব ভালোবাসত। বিকাল হলেই সাইকেলের পেছনে বসিয়ে ওকে নিয়ে পদ্মার চর চলে যেতাম। বালির ওপর দিয়ে সাইকেল চালানো সোজা কথা নয়। ও পারত না। আমাকে চালাতে হতো।

শ্রমজীবী মানুষ ছিল ওর প্রাণ। রাজশাহীতে থাকতে থাকতেই ঋত্বিক বাম রাজনীতির ভাবদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। মহাশ্বেতা যেমন উপজাতিদের নিয়ে কাজ করেছে, ঋত্বিক ডুয়ার্সের শ্রমিকদের ভেতর বহুদিন কাজ করেছে।

রাজশাহীর পদ্মার চরের একটা ঘটনা আজও আমার চোখের ওপর আবছা আবছা ভাসে। একদিন পদ্মার চরে বেড়াতে যাওয়ার সময় দেখি, ও টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়েছে। ভাবলাম, আমাদের জন্যে। কিন্তু না; সেই খাবার সে বড় পদ্মার চরে, খেঁজুর পাটির একটা ঘরে দিয়ে এলো। বেশ কতদিন ধরে ও সেই খেঁজুর পাটির ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসত। কাকে দিত, কোনোদিন সে তার নাম বলেনি।

১৯৫০ সালে আমার বিয়ে আর ওর বি.এ. পাশ একত্রে হলো। ও কলকাতায় রয়ে গেল। আমি শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায় চলে এলাম। ও জীবনে দুটো জিনিস কখনো মেনে নিতে পারেনি। এক. দেশভাগ; দুই. আমার বিয়ে।

ঋত্বিক ঘটক
নাগরিক
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

যাইহোক। ঋত্বিক তখন গণনাট্যের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়লে যে কি হতো, ভাবতে পারি না। ক্রমে নাটক হয়ে উঠল ওর জীবন। নাটক করতে করতেই ঋত্বিকের একদিন সিনেমা বানানোর চিন্তা মাথায় চাপল। কিন্তু ওইটুকুন ছেলেকে কোন প্রডিউসার পয়সা দেবে? মেজদা সুধীশ ঘটক ওর পাশে এসে সেদিন না দাঁড়ালে আজকে চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের নাম হয়তো কেউ জানতে পেত না। পরিবারের আর্থিক সাহায্যে তৈরি হলো নাগরিক

ছবি করার আগে আমাকে চিঠি লিখে ওর সঙ্গে কাজ করার জন্য আহবান জানাল। কিন্তু আমার শ্বশুর মশাই ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত আমার ওপর এত দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন যে, সেসব ছেড়ে একচুল নড়ার ক্ষমতা ছিল না। মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৬০ সালে আমি কলকাতা গেলাম। সুচিত্রা সেনের শ্বশুরবাড়ি ‘বালিগঞ্জ প্যালেস’-এ ঋত্বিক পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করত। ওর কাছে গিয়ে উঠলাম। আমাকে দেখে প্রথমেই বলল, ‘এই মহিলার এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কোনো যুক্তি দেখি না!’ সে সময় ওর কাছে যতদিন ছিলাম, ওকে নেশার বস্তু স্পর্শ করতে পর্যন্ত দেখিনি। একমাত্র নেশা তার ছবি বানানো।


‘মাতৃজঠর
থেকে পৃথিবী
ভ্রমণ করার জন্য
দুজনে একত্রে ল্যান্ড করেছি।’

মেঘে ঢাকা তারা সবেমাত্র মুক্তি পেয়েছে। টিকেট কেটে আমাকে নিয়ে গেল ছবি দেখাতে। অযান্ত্রিকও আমাকে দেখাল। ওর নতুন বন্ধু-বান্ধব-সহকর্মীদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, ‘এই আমার ইন্টারন্যাশনাল পেয়ার। মাতৃজঠর থেকে পৃথিবী ভ্রমণ করার জন্য দুজনে একত্রে ল্যান্ড করেছি।’

ঋত্বিক ঘটক
সুবর্ণরেখা
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

ঋত্বিক সুবর্ণরেখার নির্মাণ-প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি গেলাম বেড়াতে ওর ওখানে। ও আমাকে দেখে মহাখুশি। সুবর্ণরেখার স্ক্রিপ্ট আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘বিকেলে একটি মেয়ে আসবে; দেখিস তো এই গল্পের সঙ্গে মানাবে কি-না।’ সত্যি বিকেলবেলা দেখি আটপৌরে শাড়ি পরা একটি মেয়ে ম্লান মুখে গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভেতরে আসার সাহস পাচ্ছে না। ওর ভীরু, ম্রিয়মান করুণ চেহারা দেখে একটুও ভাবিনি যে, ঋত্বিক ওর কথাই আমাকে বলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি এ বাড়িতে এসেছেন?’ মেয়েটির বিনম্র উত্তর, ‘হ্যাঁ, ঋত্বিকদা আমাকে আসতে বলেছিলেন।’

ঋত্বিক ঘরে ছিল না। আমি মেয়েটিকে ঘরে নিয়ে এলাম। সঙ্কুচিতভাবে মেয়েটি তার নাম জানাল মাধুরী মুখোপাধ্যায়। বরিশাল থেকে এসে রিফ্যুইজি কলোনিতে বাসা বেঁধেছে। সরকার একটা সেলাই-কল দিয়েছে। তা দিয়েই মা-মেয়েদের দু’বেলার আহার জোটে। একটা ছবি করেছে– বাইশে শ্রাবণ। ভীরুতার সঙ্গে বিনয়-নম্রতার মাখামাখি মেয়েটির মুখে যে ব্যক্তিত্ব সেদিন দেখেছিলাম, ঋত্বিক ফিরতেই বললাম, ‘তোমার গল্পের জন্য এ মেয়েটিই যথার্থ।’

বেনু, মানে সুপ্রিয়া চৌধুরীর মেঘে ঢাকা তারা করে খুব নাম-ডাক হয়েছে তখন। ওরও খুব লোভ ছিল সুবর্ণরেখার জন্য। কিন্তু ঋত্বিককে এ কথা জানানোর সাহস ওর ছিল না। বেনু আমাকে বলেছিল, ‘ঋত্বিকদা ভুল করেন না। যাকে যে চরিত্রে মানাবে, তাকেই নেবেন। অনুরোধ সেখানে অচল।’ হাসতে হাসতে আরও বলেছিল, মেঘে ঢাকা তারায় অভিনয় করার সময় ঋত্বিক তাকে কিভাবে ছিপ দিয়ে মেরেছিল। অবশ্য এটাও স্বীকার করেছিল যে, ওভাবে না শেখালে কিছুই হয়তো হতো না। ঋত্বিককে ঘটনাটি অবহিত করলে ও জানিয়েছিল, এ রকম মানসিকতা না থাকলে কিছু শেখা যায় না।

ঋত্বিক ঘটক
মেঘে ঢাকা তারা
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত– এই দীর্ঘ সময় ঋত্বিকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল কম। ১৯৬৪-তে আমার শ্বশুর রাজরোষে পড়লেন। তাকে জেলে নিয়ে গেল। হাইকোর্টে রিট করে তাকে বের করে আনলাম। আবার ’৬৫ সালে জেলে নিয়ে গেল। একাত্তরের ২৮ মার্চ। সাড়ে সাত শত মিলিটারি আমাদের কুমিল্লার বাড়ি ঘেরাও করল। নৃশংসভাবে ওরা আমার শ্বশুরকে হত্যা করল [তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম আইনসভার সদস্য ও প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, এবং ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তোলা ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে সেদিন বাড়ি থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়; তিনি মারা যান ২৯ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিলের মধ্যে কোনো এক সময়ে]। আমার দশ বছরের ছেলেটাও সেদিন ওদের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। সেই জের আজও বয়ে চলেছে আমার নিরপরাধ পুত্র সন্তানটি।

শ্বশুরের রক্তের ওপর দিয়ে দুটি সন্তানের হাত ধরে সেদিন একবস্ত্রে বাড়ি ত্যাগ করি। কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি আমার চার ভাই আর তিন বোন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ঋত্বিককে দেখে কেঁদে ফেললাম : ‘আমি আজ সর্বহারা। আমার আর কেউ রইল না।’ আসলে আমার শ্বশুর ছিলেন নরোত্তম। তার স্নেহ, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ছায়ায় আসতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। আমার পিতৃপুরুষরা কাশ্মিরী ব্রাহ্মণ ছিলেন। রক্ষণশীলতা ভঙ্গ করে ওই পরিবারের আমিই ছিলাম প্রথম বিদ্রোহিনী। কায়স্ত ঘরে বিয়ে করার জন্য আমার বাবা মনের দুঃখে মৃত্যুবরণ করেন। সমস্ত বিচ্ছেদ যন্ত্রণা আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার শ্বশুরের স্নেহময় ব্যবহারে। ঋত্বিক আমার যন্ত্রণা বুঝেছিল। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘তোর সব আছে। আমরা আছি। তোর ছেলে আছে। মেয়ে আছে। স্বামী আছে। আর কি চাই? আবার সব হবে।’

১৯৭৩-এর প্রথম দিকেই আমি ঢাকায় ফিরে আসি। কিছুদিনের মধ্যে ও এলো। আমাকে বলল, ও এবার পদ্মা নদীর মাঝি বানাবে। কিন্তু সে সময় রাজশাহী ছাড়া পদ্মা করা মুশকিল। রাজশাহীর যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনও ঠিক হয়নি। ব্রিজ ভেঙ্গে গেছে। রাস্তা উড়ে গেছে।


আমাকে
দেখে সুবোধ
বালকের মতো
মুখ করে বলল, ‘কে
তোমাকে খবর দিয়েছে?
আমার কিচ্ছু
হয়নি’

আমি ঋত্বিককে কুমিল্লায় আমার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে এলাম। সব লুটপাট হয়ে গেছে। আমার শ্বশুরের বিশাল লাইব্রেরি ছিল। সেটাও শেষ। কয়েকখানা বই কুড়িয়ে পেলাম, বাড়ির আশপাশে খানা-ডোবার মধ্যে। তার মধ্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম বইটি ছিল। অদ্বৈত কুমিল্লার জেলে সম্প্রদায়ের সন্তান। লেখাপড়া শিখে নিজের সমাজ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠিকে নিয়ে এই উপন্যাসখানা লেখেন। ঋত্বিক তাকে চিনত না। ওর হাতে বইটি দিয়ে পড়তে বললাম। আমার পাশে শুয়ে শুয়ে বইটি যখন শেষ করল, রাত তখন প্রায় তিনটে। বলল, ‘দ্য আইডিয়া! এটিই ছবি বানাব।’ তক্ষুণি স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য বসে গেল। কলম আছে। কিন্তু কাগজ নেই। এত রাতে দোকানও খোলা নেই। শেষে আমার পরার একটা সাদা কাপড় দিলাম। তাতেই ও তিতাস…-এর স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করল। একটানা পাঁচ দিন বসে ও তিতাস…-এর স্ক্রিপ্ট লিখে শেষ করল। বিশ্বাস করবেন কি-না, জানি না; এ পাঁচ দিনের মধ্যে একটি দিনও ও মদ্যপান করেনি। নেশার প্রতি কোনো ঝোঁক আমি দেখিনি। তাই তিতাস… করতে করতে অসুস্থ হয়ে মহাখালী ভর্তি হলো, যেদিন চিত্রালীর এস এম পারভেজের টেলিগ্রাম পাই, সেদিন আমি সত্যি অবাক না হয়ে পারিনি। আমি কুমিল্লা থেকে ছুটে গেলাম মহাখালিতে। আমাকে দেখে সুবোধ বালকের মতো মুখ করে বলল, ‘কে তোমাকে খবর দিয়েছে? আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি সুস্থ আছি। ওরা আমাকে ভালোবাসে, তাই এখানে নিয়ে এসেছে।’ কি আর করা, আমি ফিরে গেলাম কুমিল্লায়। ও চলে গেল কলকাতায়। শেষবারের মতো চলে যাওয়ার স্মৃতি কোনোদিন ভুলব না। কখনো যদি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়ি, তবু ওই দিনের স্মৃতি আমার মন থেকে মুছবে না। আজও ছবির মতো সেই স্মৃতি আমার চোখের সামনে ভাসে।

ঋত্বিক ঘটক
তিতাস একটি নদীর নাম
ফিল্মমেকার । ঋত্বিক ঘটক

সকালেই আমি কুমিল্লা থেকে ঢাকা পৌঁছেছি। এসেই ছুটে গেলাম সাইয়ীদ আতিকুল্লাহর বাসায়। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘এইমাত্র ঋত্বিক এয়ারপোর্টে চলে গেল।’ গাড়ি নিয়ে আমিও এয়ারপোর্টে ছুটে গেলাম। প্লেন তখনও ছেড়ে যায়নি। দৌড়ে ভেতরে ঢুকে দেখি, ঋত্বিক আর ক্যামেরাম্যান মহেন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে। পাঞ্জাবি ছেলে মহেন্দ্রর পাশে ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা ঋত্বিককে সেদিন এত সুন্দর লাগছিল যে, আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। বহুদিন পর ওকে দেখলাম ধবধবে ধূতি আর গরদের পাঞ্জাবিতে।

আমার দু’চোখ বেয়ে অবিরল জল পড়ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। তারপর জড়িয়ে ধরে কান্না আর কান্না। এয়ার ইন্ডিয়াকে বলল, দশ মিনিট অপেক্ষা করতে। পাগলের মতো বকে চলেছে, ‘তোকে এখানে রেখে যাব না। আমার সঙ্গে এক্ষুণি যাবি। পাসপোর্টের কোনো অসুবিধা হবে না…’ ইত্যাদি। এভাবে দু’ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। প্লেন তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। লোকজন কেউ সামনে আসছে না। অনেক কষ্টে শান্ত করে বললাম, ‘তুমি যাও। আমি দুয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতা যাচ্ছি।’


আজ
একা বসে
ভাবি, মরে যাবে
বলেই কি সেদিন ও
আমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি?

তারপর সিঁড়িতে এক পা রাখে, আর আমাকে ঘুরে দেখে। সেই আমাদের শেষ দেখা। আজ একা বসে ভাবি, মরে যাবে বলেই কি সেদিন ও আমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি?

মাতৃজঠর ভাগ করে নিয়েছিলাম দুজনে। মৃত্যুকে ভাগ করাও তো আমাদের ভবিতব্য ছিল?

১৯৭৬ সালে ঋত্বিকের মৃত্যু হলো। একই সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আমাকে নিয়ে চলছে যমে-মানুষে টানাটানি। একটানা ছয় মাস পর, বসার মতো একটু শক্তি এলো শরীরে। প্রতিদিন, বহু বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন-শুভার্থীরা আমাকে দেখতে আসত। কিন্তু ঋত্বিকের মৃত্যুর খবর সবাই সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে। ডাক্তার-নার্সরা পর্যন্ত আমার ঘর থেকে রেডিও সরিয়ে নিয়ে যায়। আমাকে যম দেবতা রেখে গেলেন বটে; কিন্তু আমাদের বড় ভাই লোকেশ ঋত্বিকের সহযাত্রী হলেন।

ঋত্বিক ঘটক
ঋত্বিক ঘটক ও ঋতবান ঘটক [পুত্র]
১৯৬০ দশকে

তারপর কলকাতায় গিয়েছি। ঋত্বিকের ছেলে-মেয়েরা শান্তি নিকেতনে পড়ছে তখন। আমার অশক্ত দেহ শান্তি নিকেতন পর্যন্ত যাওয়ার মতো ছিল না। ভাইঝি-ভাইপোদের খোঁজ-খবর করা আর হয়নি। বছর পাঁচেক আগে, ঋত্বিকের ছেলে ঋতবান ঘটক ঢাকায় এলো। তিতাস…-এর একটা কপি কেনার জন্য। শিল্পী কালিদাস চক্রবর্তীর ছেলে ওর বন্ধু। শান্তি নিকেতনে একত্রে পড়াশোনা করেছে। আমি কুমিল্লা থেকে ফোন করলাম। বললাম, ‘তুমি এসো। আমার কাছে না এলে যে তোমার আসাই হতো না।’ চলে যাওয়ার ঠিক আগের দিন দুপুরে ঋতবান এলো প্রবলভাবে কড়া নাড়িয়ে। পরের দিন সকালবেলাই প্লেন। রাত ন’টা পর্যন্ত একটি কথা না বলে, শুধু আমার দিকে চেয়ে রইল। চলে যাওয়ার সময় আমার গলার লাল তিলটি দেখিয়ে বলল, ‘বাবার গলাতেও এ রকম একটা তিল ছিল।’ সামান্য একটা কথায় আমার বুকে ঝড়-তুফান তুলে ঋতবান চলে গেল।

ছেলে-মেয়েরা ঋত্বিকের কাছে ছিল ভীষণ প্রিয়। মেঘে ঢাকা তারায় ঋত্বিকের বড় মেয়ে শিশু অবস্থায় অভিনয় করেছে। এছাড়া ওর ছবিতেই শিশুরা ছিল আশার প্রতীক। বাড়ি থেকে পালিয়ে বাচ্চাদের জন্য করা ছবি। ছবির ব্যাপারে ও ছিল একেবারেই আনকম্প্রোমাইজিং। আবেগপ্রবণ ছিল অসম্ভব; বাস্তব জ্ঞান-বুদ্ধি একেবারেই ছিল না। ওর সরলতার সুযোগ নিয়েছে অন্যরা। ওর সবচেয়ে ভালো সময়ে কেটেছে পুনার ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। ও ছিল ওখানকার প্রথম প্রিন্সিপ্যাল। ওর মৃত্যুর পর শত্রুঘ্ন সিনহা চমৎকার একটা প্রবন্ধ লিখেছিল। আমার একটাই দুঃখ, ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে ওর পাশে আমি থাকতে পারিনি।


অনুলিখন : মাহমুদা চৌধুরী
প্রথম প্রকাশ : বিচিত্রা, ২১ জুন ১৯৯১
গ্রন্থসূত্র : ঋত্বিকমঙ্গল [বাংলাদেশে ঋত্বিক-চর্চার দলিল : ১৯৭২-২০০০]/ সম্পাদনা : সাজেদুল আউয়াল
প্রকাশক : বাংলা একাডেমি, ঢাকা, জুন ২০০১
Print Friendly, PDF & Email

১টি কমেন্ট

  1. চমৎকার ‘বেশ কিছু অজানা তথ্য জানলাম

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here