চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান: দুরন্ত সময়ের অফুরান প্রাণ

905

লিখেছেন । বেলায়াত হোসেন মামুন

বাদল রহমান
জন্ম । ৪ জুন ১৯৪৯; করাচি, পাকিস্তান
প্রয়াণ । ১১ জুন ২০১০; ঢাকা, বাংলাদেশ

বাংলার সবুজ প্রান্তরকে স্বপ্নময় বিচরণভূমি ভাবলে, বিচরণকারী ভূমিপুত্রদের চন্দ্রগ্রস্থ রাখাল ভাবা যেতেই পারে। সেই রাখালদের কাজ কেবল গো-চারণ নয়; মনের খেয়ালে তারা বাঁশিতে সুর তুলে বাঁচিয়ে রাখে জীবনের সঞ্জীবনী। বাংলার যে কোনো মাঠের পায়ে চলা পথ আমাকে টানে। আমি কেবলি ভাবতে থাকি মানুষ কেন এমন চন্দ্রগ্রস্থের মতো এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে যায় অজানায়!

জ্যামিত্যিক কোনো বিশুদ্ধ রেখায় আমাদের পদক্ষেপ হয় না। আমরা হেঁটে চলি আমাদের মনের অদ্ভুত ঘোরলাগা মায়ায়! দেখুন আমাদের যে কোনো মাঠের-তেপান্তরের মানুষের হাঁটা পথ; কোথাও সরলরেখায় এই পথ এগিয়ে যায় না। আমাদের পায়ে চলার পথ হয়তো অনেকক্ষেত্রে আমাদের জীবনের গ্রাফ হয়ে ওঠে…

আমাদের দেশে এবং জাতিতে একটি দুরন্ত কাল এসেছিল। সেই কালের মানুষেরা ছিলেন চন্দ্রগ্রস্থ ঘোরলাগা বিশুদ্ধ মানুষ। এদের অন্তর বিশুদ্ধ ছিল বলেই জাতির ভূমিখন্ডের মুক্তি এসেছে। যদিও মানুষের মুক্তি আজও আসেনি। লড়াইয়ে যদিও চাওয়া ছিল আরও বেশি। কিন্তু সব চাওয়া তো একবারে পূরণ হয় না। ইতিহাসের কোনো অধ্যায়ে মুক্তির স্বাদ না পাওয়া একটি জাতিকে মুক্তি এনে দেয়া একটি প্রজন্ম জন্মেছিলেন প্রবল অঙ্গিকার নিয়ে। চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান সেই প্রজন্মের অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন।


তিনি
সমষ্টির
স্বপ্নকে বিকিয়ে
দেননি ব্যক্তিগত
লাভালাভের মুলোর পেছনে

প্রয়াণের প্রায় ৭ বছর পরে [স্মরণ করছি ২০১০ সালের ১১ জুনকে, যে দিন ভোরে বাদল রহমান প্রয়াত হয়েছেন] আমরা যখন তাঁর জীবন সময়ের মানচিত্রে ফেলে দেখতে বসি তখন বিস্মিত হই যে তিনি কেমন করে বাংলার পায়ে চলা পথের মতো এক ঘোরলাগা গ্রাফের জীবন যাপন করেছেন সামষ্টিক স্বপ্ন এবং আদর্শিক মূল্যবোধে পূর্ণ হৃদয় নিয়ে… বাদল রহমানের জীবনে কোনো আপস নেই। তিনি সমষ্টির স্বপ্নকে বিকিয়ে দেননি ব্যক্তিগত লাভালাভের মুলোর পেছনে। বরং ব্যক্তিগত বহু অর্জনকে হাসতে হাসতে বিলিয়ে দিয়েছেন সমষ্টির স্বপ্নকে গড়ে তুলতে। এই যে বলছি ‘সমষ্টি’র ‘স্বপ্ন’ তা আসলে কি? এই আলাপ চলবে তার আগে চলুন বাদল রহমানকে একটু জেনে নেই।

বাদল রহমান
বাদল রহমান : স্ত্রী রুমা ও পুত্র অভিষেক রহমানের সঙ্গে

জন্ম এবং বেড়ে ওঠা

পিতার কর্মস্থল করাচিতে ১৯৪৯ সালের ৪ জুন জন্মগ্রহণ করেন মাহবুবুর রহমান। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মাঝে মাহবুবুর রহমান ছিলেন জেষ্ঠ্য। ১৯৫৭ সালে পিতার কর্মস্থল বদলি হয় খুলনায়। সাথে মাহবুবুর রহমান এবং তাঁর পুরো পরিবারের খুলনায় বসবাস শুরু। মাহবুবুর রহমান ১৯৫৮ সালে খুলনার সেন্ট জোসেফ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেন্ট জোসেফ স্কুলে পড়াকালিন তিনি বাম ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়ন’-এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। স্কুলের কড়া নিয়ম উপেক্ষা করে তিনি মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সেন্ট জোসেফ স্কুলের প্রিন্সিপাল ফাদার ব্রুনোর বিশেষ স্নেহের কারণে তিনি সেই সময় বেশ কয়েকবার স্কুল থেকে বহিষ্কারের হাত থেকে বেঁচে যান। পিতার কর্মস্থলের বদলির ধারাবাহিকতায় তিনি বেশ কয়েকটি জেলার বেশ কয়েকটি স্কুলে পাঠদান সম্পন্ন করে অবশেষে ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহের নান্দিনা পাইলট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর পিতার আবারও চাকরি স্থল বদলির কারণে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। কিন্তু কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে তুখোড় ছাত্র আন্দোলনে তিনি সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দানসহ তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তিনি স্থানীয় প্রশাসনের কোপানলে পড়েন। মিছিলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের কারণে তিনি গ্রেফতার হন। ছাত্র জীবন থেকেই সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কারনে তিনি বিকল্প নামে লেখালিখি এবং রাজনৈতিক ছদ্মনাম ‘বাদল রহমান’ গ্রহণ করেন। মূলত সেই সময় থেকেই তিনি মাহবুবুর রহমানের পরিবর্তে বাদল রহমান নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

কুষ্টিয়ায় গ্রেফতারের ঘটনা ঘটায় বাদল রহমানের পিতা লুৎফর রহমান শিকদার তাঁকে জামিনে মুক্ত করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন এবং তিনি ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজ থেকেই ১৯৬৭ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং বি.এ ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখককে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

“ঢাকায় এসে যখন [১৯৬৫ সালে] জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলাম তখন এখানে একেবারে গণগণে অবস্থা। ছাত্র রাজনীতি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তখন জগন্নাথ কলেজ কেন্দ্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ! কি বাম রাজনীতি, কি আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ফলে আমি আরও বেশি করে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেলাম। যখন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলাম [১৯৬৭] তখন ভাবলাম যেহেতু বাড়ি থেকে টাকা আসে সেই টাকায় রাজনীতি করি তাই ছাত্রত্ব ধরে রাখা জরুরি। কিন্তু এই পড়ালেখাকে খুব সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নাই। কারণ তখন আমাদের মনে হচ্ছিল দেশে বিপ্লব প্রায় এসেই গেল বলে! আর বিপ্লব হয়ে গেলে এই শিক্ষার তো কোনো মূল্য থাকবে না। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা তো বিপ্লবী আদর্শে নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে। তাই এই ছাতার মাতা শিক্ষা দিয়ে কি হবে! তাই ছাত্রত্ব ধরে রাখতে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। ক্লাস-টলাস করি না। পুরো টাইম বিপ্লব করি!”

মাহবুবুর রহমান বা বাদল রহমান তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের তুখোড় কর্মী। অপর দিকে ছাত্র ইউনিয়ন তখন মতিয়া গ্রুপ ও মেনন গ্রুপে বিভক্ত। বাদল রহমান সাক্ষাৎকারে বলছেন,

“আমি প্রথমে মতিয়া আপার গ্রুপে থাকলাম কিছুদিন; কিন্তু কিছুদিন পরে আমি মেনন ভাইয়ের গ্রুপের সাথে কাজ করতে শুরু করি। কাজ করতে করতে অল্পদিনের মধ্যেই আমি মেনন ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। ফলে তিনি আমাকে প্রায়ই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লোকের কাছে পাঠাতেন। যাদের তখন সরাসরি বাম রাজনীতির সাথে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। অনেকের কাছেই সেই সময় নিয়মিত যেতে হতো। হয়তো কোনো বিশেষ চিঠি অথবা অন্য কোনো কিছু নিয়ে; আবার ওনারাও কোনো চিঠি বা অন্য কোনো কিছু আমাদের হাতে দিয়ে দিতেন। আমাদের দায়িত্ব ছিল সতর্কতার সাথে কিছু নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসা। সে সময় কাজটি খুব সতর্কতার সাথেই করতে হতো। কারণ বাম রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এবং আমাদের ওপর সারাক্ষণই গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি থাকত। আমার মতো আরও দুই একজন ছিল যাদের ওপর এই গোপন দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিল। এই দায়িত্ব পালন করতে করতেই বেশ অনেকবার জহির রায়হানের কাছে আমাকে যেতে হয়েছিল। ওনার কাছে যাওয়ার এবং সাক্ষাতে টুকটাক আলাপ আমাকে অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছিল। যা পরবর্তীতে আমার মনে হয়েছে।”


ছাত্র রাজনীতির
সাথে প্রবল যুক্ততার
ফলে সেই ষাটের দশকেই
আরো দুই তিনবার বাদল রহমান
গ্রেফতার হন এবং
জেলজীবন
কাটান

জগন্নাথ কলেজের পড়াকালিন এই ছাত্র রাজনীতির সাথে প্রবল যুক্ততার ফলে সেই ষাটের দশকেই আরো দুই তিনবার বাদল রহমান গ্রেফতার হন এবং জেলজীবন কাটান। এছাড়াও তিনি তখন সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’র সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন মূলত কামাল লোহানীর হাত ধরেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর অনুপ্রবেশ হয়েছে। বাদল রহমান বলেন,

“ছায়ানটে কোনো একটি মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ছায়ানট থেকে লোহানী ভাই বেরিয়ে আসেন। তিনি তখন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন। ক্রান্তির সাথে ছাত্র ইউনিয়নের খুব প্রচ্ছন্ন একটি যোগাযোগ তৈরি হয়। লোহানী ভাই, কে জি ভাই [কে জি মোস্তফা], রনো ভাইদের সাথে মেনন ভাইয়ের যোগাযোগ খুব গভীর ছিল। ফলে আমাদের সহজ যাতায়াত ছিল ক্রান্তিতে। প্রথম দিকে আমি তেমন প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হইনি কিন্তু ধীরে ধীরে লোহানী ভাই কেমন করে যেন আমাকে মোহাবিষ্ট করে ফেললেন এবং আমি ক্রান্তিতে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। মূলত লোহানী ভাইয়ের হাত ধরেই আমার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অনুপ্রবেশ। তখন ক্রান্তি অনেক অসাধারণ সব কাজ করেছে। এই যেমন ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেত্রে খামারে’ বলে একটি নৃত্যনাট্য হয়েছিল পল্টন ময়দানে। উন্মুক্ত প্রান্তরে এবং ৩৫ জন ছেলে মেয়ে নাচবে! এটা তো তখন ভাবাই যেত না! বিশেষ করে আমাদের মেয়েরা ওপেন এয়ার নাচবে এটা সেই সময়ে কল্পনা করা যেত না! প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সামনে সেটা হয়েছিল তখন! এছাড়াও ক্রান্তিতে আইপিটিএর গান-নাটকগুলো করা হতো। আলতাফ মাহমুদ ছিলেন এসবের পুরোভাগে!”

একদিকে ছাত্র রাজনীতি এবং অন্য দিকে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রবল সক্রিয়তার কারণে বাদল রহমানের পিতা তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়ে তাঁকে প্রায় ‘ত্যাজ্য’ করে দেন বলে তিনি বলেন। সেই সময় বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন। ফলে এক রকম বাধ্য হয়েই বাদল রহমান নিজের খরচ চালানোর প্রয়োজনে টিউশনি করতে শুরু করেন। টিউশনি করার এই সময়েই তিনি এক আত্মীয়ের পরিচয়সূত্রে রেডিওতে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৬৭ সালে বাদল রহমান রেডিওতে ছোটদের অনুষ্ঠানের জন্য চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন,

“তখন খেলাঘর বলে রেডিওতে একটি ছোটদের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে ১০ মিনিটের একটি নাটিকা প্রচার করা হতো। এর প্রযোজক ছিলেন দিলরুবা খানম বলে একজন ভদ্রমহিলা। সেখানে আমি যুক্ত হয়ে গেলাম। আমি তখন সিন্ডেরেলা গল্পটিকে ভেঙ্গে ছোটদের উপযোগী করে ভাষান্তর করে ফেললাম। মাসে চারটি পর্ব প্রচার হতো। প্রতি পর্বের চিত্রনাট্যকার হিসেবে আমি ৩২ টাকা করে পেতাম। যেখানে সারা মাস টিউশনি করে পেতাম ৪০/৫০ টাকা। এর সাথে মাসে চারটি পর্বের জন্য আরও ১২৮ টাকা রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে গেল। সেই আমলে এটা অনেক টাকা!”

ফলে উত্তাল ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাদল রহমানের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের লড়াই চলতে থাকে সমান তালে। রেডিওতে সিন্ডেরেলার বাংলা রূপান্তর প্রচারের মাধ্যমে বাদল রহমানের সুনাম হয়। সেই সময়েই বাদল রহমান পড়াতেন টেলিভিশনের ডাকসাইটে প্রযোজক খালেদা ফাহমির ভাই ওয়ালিউল্লাহ ফাহমির ছোট দুই ছেলেমেয়েকে। বাদল রহমানের সাথে পরিচয়সূত্রে খালেদা ফাহমি রেডিওতে প্রচারিত সিন্ডেরেলা শোনেন এবং বাদল রহমানকে টেলিভিশনে ছোটদের জন্য অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লেখার প্রস্তাব দেন। এ প্রসঙ্গে বাদল রহমান বলেন,

“আমরা তখন নিয়মিত আড্ডা দেই মালিবাগ-মৌচাকের ক্যাফে ডি তাজ হোটেলে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আমি, মামুনুর রশিদ, নির্মলেন্দু গুণ, কবির আনোয়ার, কেরামত মওলাসহ বন্ধুদের অনেকেই। তখন আমার কাছে দুটো বাচ্চাকে পড়ানোর প্রস্তাব আসে। ক্যাফে ডি তাজের খুব কাছেই মিটিয়া বুরুজ নামে একটি বাড়ি আছে। সেখানে টেলিভিশনের জাঁদরেল প্রডিওসার খালেদা ফাহমির ছোট ভাই ওয়ালিউল্লাহ ফাহমি থাকতেন। তাঁর দুটো বাচ্চাকে পড়ানোর প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে যাই। সন্ধ্যায় আড্ডা থেকে উঠে চট করে এক ঘন্টা পড়িয়ে আসা কোনো সমস্যা ছিল না। পরে বন্ধুদের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরে আসতাম। মূলত এই টিউশনি থেকেই টেলিভিশনে কাজ করার প্রস্তাব আসে।”

পরে ১৯৬৭ সাল থেকেই বাদল রহমান রেডিও’র পাশাপাশি টেলিভিশনেও ছোটদের জন্য অনুষ্ঠানে চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। টেলিভিশনে কাজের সূত্রেই পরবর্তীকালে তিনি আরও বেশি করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততাও ছিল। এর মাঝে তিনি নিজেই বলছেন,

“তখনও সিনেমা নিয়ে সত্যিকার অর্থে তেমন কিছু পারিকল্পনা ছিল না। সিনেমা দেখতাম প্রচুর কিন্তু তখনও চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো বা এই বিষয়ে আলাদা করে কাজ করবো তেমন কিছু ভাবিনি। বরং আমি তখন রাজনীতি নিয়ে অনেক সিরিয়াস ছিলাম। ভাবতাম রাজনীতিতেই সিরিয়াসলি থাকব।”

বাদল রহমান
বাদল রহমান
ছবি । আনোয়ার হোসেন

স্বাধীনতার পূর্বক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের সময়

রেডিও ও টেলিভিশনের ছোটদের অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লেখার সুবাদে টেলিভিশনের অনেকের সাথেই তখন খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। টেলিভিশনের করিডরেই দেখা হয় আমিরুজ্জামান সাহেবের সাথে। তিনি সম্পর্কের দিক থেকে ছিলেন বাদল রহমানের মায়ের চাচা। সেই সূত্রে নানা হন। আমিরুজ্জামান সাহেব তখন টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রর জিএম। তিনি টেলিভিশনে স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব দেন। বাদল রহমানকে চাকরি দেয়া যেতে পারে কি-না তা যাচাইয়ের ভার দেন নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। কিন্তু বাদল রহমান স্থায়ী চাকরির বিষয়ে অনাগ্রহী ছিলেন। পরে তিনি তাঁর মায়ের কথায় চাকরিতে জয়েন করেন ১৯৬৮ সালে। তখন টেলিভিশনে বাদল রহমান সিনিয়র হিসেবে পান মোস্তফা মনোয়ার, আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ অনেককে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

“আমি তো আসলে লিখতে পারতাম মোটামুটি ভালোই। কিন্তু টেলিভিশনের কারিগরি বিষয়গুলো তো কিছুই জানতাম না। কিন্তু আমি যাদের সাথে কাজ করতাম তাঁরা তো সবাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আর তাঁরা সবাই ছিলেন আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের লোক। ফলে তাদের সাথে আমার একটা অন জব ট্রেনিং চলছিল।”

চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার যোগসূত্রও তৈরি হয় টেলিভিশনে চাকরি থেকেই। তখন টেলিভিশনের আর্ট ডিজাইন সেকশনের চিফ ডিজাইনার ছিলেন ভাষাসৈনিক এমদাদ হোসেন। এমদাদ হোসেনের কাছে মুহম্মদ খসরু যাতায়াত করতেন। সেই সুবাদে মুহম্মদ খসরুর সাথে পরিচয় হয় বাদল রহমানের। সেটাও ১৯৬৮ সালেই। এই বিষয়ে তিনি বলেন,

“টেলিভিশনের কাজ করার সুবাদে প্রচুর মানুষের সাথে নতুন করে পরিচয় হয় আমার। এটা তখন ভীষণ লোভনীয় পেশা। লোকজন বেশ সম্মান করত। আমাদের টেলিভিশনের আর্ট ডিজাইন সেকশনের প্রধান ছিলেন ভাষাসৈনিক শিল্পী এমদাদ হোসেন। এমদাদ ভাইয়ের কাছে তাদের গ্রামের ছেলে মুহম্মদ খসরু আসতেন। খসরু ভাই চলচ্চিত্র সংসদ করতেন এবং টেলিভিশনে এসে তিনি সদস্য সংগ্রহের কাজটাও করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতেন। তখন প্রায়ই খসরু ভাই বলতেন, টেলিভিশনে পড়ে না থেকে সিনেমার সাথে যুক্ত হতে। এভাবেই তখন পাকিস্থান ফিল্ম সোসাইটির সাথে জড়িয়ে যাই। মাঝে মাঝে ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখতাম। ভালো লাগত। খসরু ভাই ছাড়াও তখন সক্রিয় দেখতাম জামাল খান, ইয়াসিন ভাই, তোফাজ্জল ভাই, হানিফ ভাই বলেও একজন ছিলেন। কিন্তু মূলত কাজটা খসরু ভাইকেই করতে দেখতাম। তখনও আমি সিরিয়াস ছিলাম রাজনীতি নিয়েই। চাকরি করতাম। অনান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরো সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু বরাবরই আমাকে রাজনীতিটাই খুব টেনেছে।”


জহির রায়হান
বাদল রহমানকে
বড় পর্দায় কাজ করার কথা বলেন

মনে রাখতে হবে আমরা ১৯৬৮/১৯৬৯ সালের উত্তাল সময়ের কথা আলোচনা করছি। তখন বাদল রহমান একদিকে বাম রাজনীতি অন্যদিকে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী এবং রেডিও টেলিভিশনে কাজ করছেন। এর মাঝে একবার টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে আসেন জহির রায়হান। যে অনুষ্ঠানের আলোচক হিসেবে তিনি এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন বাদল রহমান। অনুষ্ঠানের সেটে জহির রায়হান বাদল রহমানকে বড় পর্দায় কাজ করার কথা বলেন। বলেন মানুষের কথা বলতে হলে ‘বড় পর্দায়’ যেতে হবে; টেলিভিশনে তা সম্ভব নয়। এতে বাদল রহমান অনুপ্রাণিত হন এবং তাৎক্ষণিক জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন। জহির রায়হান প্রস্তাবে রাজি হন। পরবর্তীকালে জহির রায়হানের সুপারিশে বাদল রহমান চলচ্চিত্র নির্মাতা মমতাজ আলীর সাথে নতুন নামে ডাকো চলচ্চিত্রে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এ প্রসঙ্গে বাদল রহমান বলেন,

“যদি চলচ্চিত্রের কারিগরি বিষয়ে কোনো স্পষ্ট জ্ঞান কিছু শিখে থাকি তাহলে তা শিখেছি মমতাজ আলী সাহেবের কাছ থেকে। ওনার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে একটি প্রডাকশান ডিজাইন করতে হয় এবং পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হয়। তিনি অসম্ভব গুণী একজন মানুষ ছিলেন।”

এভাবেই ১৯৭০ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে চলে আসে। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাতে টেলিভিশনে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের নেতৃত্বে হায়দার রিজভী ও বাদল রহমানসহ আরও কয়েকজন মিলে পাকিস্থানের পতাকা না দেখানোর জন্য রাতের অনুষ্ঠান চালিয়ে গেছেন ২৪ মার্চ পর্যন্ত। এরপর ২৫ মার্চ রাতে মুস্তাফা মনোয়ার, বাদল রহমান ও হায়দার রিজভী আশ্রয় নেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টো পাশে মুস্তাফা মনোয়ারের বোনের বাসা হাসনা আপার বাসায়। এ সময়ের স্মৃতিচারণ করে বাদল রহমান বলেন,

“আমরা টেলিভিশন থেকে সেদিন রাতে আশ্রয় নিয়েছিলাম মুস্তাফা মনোয়ারের বোনের বাসা হাসনা আপার বাসায়। হাসনা আপা নিমা রহমানের মা হন। বাড়িটা পুলিশ লাইনের ঠিক উল্টো পাশে। ২৫ মার্চ রাতে যখন হেভি ফায়ারিং হয় তখন আমরা সবাই সেই বাড়িতে। গোলাগুলিতে বাড়িটা পুরো তছনচ হয়ে যায়। কারণ বাড়িটা ফায়ারিং রেঞ্জের ভেতরে পরে গিয়ে ছিল। পরে রাতে আমরা সবাই বাড়িটা থেকে পেছনের দেয়াল টপকে পেছনের বাড়িটায় গিয়ে আশ্রয় নেই। সেখানেও গোলাগুলি হচ্ছিল। আমরা সেই বাড়িটারও পেছনের দেয়াল টপকে একেবারে পেছনের বাড়িতে আশ্রয় নেই। পরে ২৭ মার্চ পর্যন্ত আমরা সবাই ঐ বাড়িতেই ছিলাম। ২৭ মার্চ ওখান থেকে বেরিয়ে যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ি। মুস্তাফা মনোয়ার সাহেব আগরতলায় চলে যান। আমি কিছুদিনের মধ্যেই ক্রান্তির কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করি। কমলাপুরের আজম খান, মাহবুবসহ আরও বেশ কয়েকজন মিলে একটা দল করে বডার ক্রস করি। আমরা মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টরের ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেই। আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়। সেক্টর টু তে ‘এমএলএ ইনচার্জ’ ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা সাহেব। গাজী সাহেবের বাসা এবং আমাদের বাসা একই গলিতে। শান্তিনগরে। তিনি আমাকে ট্রেনিং ক্যাম্পে দেখে বলেন, ‘তুমি এখানে কি করছ? চলো আমার সাথে।’ আমি বললাম, ‘ট্রেনিং চলছে।’ তিনি বললেন, ‘ও দিকে মান্নান সাহেব লোকজন পাচ্ছেন না, যারা টেলিভিশন বা রেডিওতে কাজ করেছে এমন লোক লাগবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালাতে লোকজন লাগবে।’ তিনি আমাকে ওখান থেকে একটা চিঠি লিখে আগরতলা এবং তারপর আগরতলা থেকে এয়ারফোর্সের বিমানে করে কলকাতায় পাঠালেন। কলকাতায় গিয়ে আমি জয়বাংলা অফিসে মান্নান সাহেবের সাথে দেখা করলাম। এরপর গেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দেখা হলো আমিনুল হক বাদশার সাথে। এর মধ্যে আমাদের সরকারের শপথ গ্রহণ হয়ে গেল। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হল। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসটা করা হলো পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশানের অফিসটাকে। তখন অবশ্য সেটা আর পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিস ছিল না। তার আগেই তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্সাটারনাল পাবলিসিটি উইং বলে একটি ডিপার্টমেন্ট চালু হলো। সেখানেই আমি, বাদশা ভাইসহ বেশ কয়েকজন লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে জয়েন করলাম। আমাদের কাজ ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অবহিত করা। বর্হিবিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রচার করা। এছাড়া আমি তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান করতাম।”

বাদল রহমান
আনোয়ার হোসেন ও বাদল রহমান : সিনেমাটোগ্রাফার ও ফিল্মমেকার
এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র শুটে

স্বাধীন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে বাদল রহমানের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। স্বাধীন দেশে ফিরে বাদল রহমান বাংলাদেশ টেলিভিশনে জয়েন করলেন। সাথে সক্রিয় হলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদে। স্বাধীনতার পর দেশে চলচ্চিত্র সংসদ কার্যক্রমে নবজোয়ারের সূচনা হয়। বিভিন্ন নামে অনেকগুলো ফিল্ম সোসাইটি গড়ে ওঠে। অনেক ধরণের কর্মসূচিও গৃহীত হয়। এই অনেকগুলো চলচ্চিত্র সংসদ ও এদের কার্যক্রমের সমন্বয় করার জন্য একটি ফেডারেশন গঠনের ভাবনা চিন্তা শুরু হয়। এর মধ্যেই ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদার আসেন বাংলাদেশে পালঙ্ক চলচ্চিত্রটি নির্মাণের উদ্দেশ্যে। মুহম্মদ খসরু এবং বাদল রহমান পালঙ্ক চলচ্চিত্রে সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এ সময় বাদল রহমান সিনেমা বিষয়ে এতটা সিরিয়াস হয়ে ওঠেন যে টেলিভিশনের চাকরি ছেড়ে দেন। রাজেন তরফদারই মুহম্মদ খসরু এবং বাদল রহমানকে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়তে যেতে উৎসাহিত করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে মুহম্মদ খসরুর উৎসাহে এবং তৎপরতায় বাদল রহমান ও সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে বৃত্তি নিয়ে ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্রবিদ্যা অর্জনে পাড়ি দেন। ভারতে পাড়ি দেয়ার পূর্বেই বাদল রহমান বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদসমূহের একটি ফেডারেশন গঠন করার জন্য মুহম্মদ খসরুর সাথে তৎপরতা শুরু করেন। পরবর্তীকালে পুনেতে থাকা অবস্থায় মুহম্মদ খসরুর সাথে চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ গঠনে বাদল রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।


বাদল রহমান
বাংলাদেশে হওয়া
প্রথম ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন
কোর্সের পরিকল্পক ও সমন্বয়ক ছিলেন

বাদল রহমান বাংলাদেশে হওয়া প্রথম ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের পরিকল্পক ও সমন্বয়ক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক সতীশ বাহাদুরকে দিয়ে বাদল রহমান ঢাকায় একটি তিন বা চার সপ্তাহের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স আয়োজনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। অধ্যাপক সতীশ বাহাদুর বাদল রহমানের এই প্রস্তাব আন্তরিক উৎসাহে গ্রহণ করেন। বিষয়টি বাদল রহমান চিঠিতে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ খসরুকে অবহিত করেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। কিন্তু বিষয়টি খুব সহজ ছিল না। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স’ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এই কোর্সটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে নতুন ধরনের প্রাণসঞ্চার করে। চলচ্চিত্রচর্চায় ও চলচ্চিত্র শিক্ষার নতুন বাতাবরণ তৈরি হয়। তৈরি হয় বাংলাদেশে ফিল্ম আর্কাইভ স্থাপনের দাবি, গড়ে ওঠে চলচ্চিত্র কেন্দ্র স্থাপনের দাবি এবং ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরির আন্দোলন। যে আন্দোলনের বার্তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এসব ভাবনার সূত্রপাতে বাদল রহমানের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাদল রহমান শুধু যে এসব ভাবনার সূত্রপাতেই ভূমিকা রেখেছেন তা নয়। তিনি আমৃত্যু এসব ভাবনার বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

বাদল রহমান
মিঠুন চক্রবর্তী ও বাদল রহমান
১৯৭৩-৭৪; পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের দিনগুলোতে

প্রামাণ্যচলচ্চিত্র নির্মাণকাল ও সামরিক শাসনের খড়গ

বাদল রহমান ও সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী যৌথভাবে প্রথম নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচলচ্চিত্র প্রত্যাশার সূর্য। এই প্রামাণ্যচলচ্চিত্রটি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারের জন্য নির্মাণ করা হয়। বর্হিবিশ্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরের সময় এই প্রামাণ্যচলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের পরিচিতি হিসেবে সে দেশের সাংবাদিক ও অন্যান্য অতিথিদের দেখানো হতো। ছবিটি খুব প্রশংসিত হয়েছিল। ছবিটি ‘তাসখন্দ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ বিশেষ সম্মাননা অর্জন করেছিল। এই ছবিটি যখন বাদল রহমান ও সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী নির্মাণ করেন তখনও তাঁরা পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। দেশে তাঁদের চলচ্চিত্র শিক্ষাগ্রহণ ও সরকারের বিশেষ প্রয়োজনে প্রামাণ্যচলচ্চিত্র নির্মাণের এই ঘটনায় বেশ আলোচনা তৈরি হয়। বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিত্রা তাদের নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এইসব আলোচনা ও ব্যাপক প্রচারণা মূলত দেশে চলচ্চিত্র শিক্ষার গুরুত্ব তৈরিতে বেশ প্রভাব রাখে বলে আমার মনে হয়েছে।

সরকারি অর্থায়নে এরপরেও একটি প্রামাণ্যচলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বাদল রহমান। ১৯৭৭ সালে সেলফ পোর্ট্রেট বাংলাদেশ নামে ৫০ মিনিটের দীর্ঘ প্রামাণ্যচলচ্চিত্র বাদল রহমান নির্মাণ করেন। ছবিটি ৩টি পর্বে বিভক্ত ছিল। ২০ মিনিট, ২০ মিনিট ও ১০ মিনিট। বাদল রহমান এই প্রামাণ্যচলচ্চিত্রটি নির্মাণ বিষয়ে বলেন,

“জিয়াউর রহমানের সরকারের জন্য আমি প্রামাণ্যচিত্র বানাতে চাইনি। যখন আমাকে বলা হয়েছিল তখন আমি বলেছি আমি এখন অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি, পারব না। পরে দেখলাম প্রায় প্রতিদিন বাড়িতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাকে খুঁজতে আসে। অনেকের পরামর্শে তখন আমি বেশ কিছুদিন বাড়িতে থাকিনি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমার মা-বাবা খুব দুঃশ্চিন্তা করছিলেন এবং ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা আমার ক্ষতির আশঙ্কা করছিলেন। এক পর্যায়ে আমি কাজটি কিছু কঠিন শর্তে করতে রাজি হই। আমার ধারণা ছিল আমার অত্যাধিক বাজেট প্রস্তাব এবং শর্তের কারণে তারা আমাকে রেহাই দিবে… কিন্তু দেখা গেল আমার সব রকম শর্ত মেনেই সামরিক বাহিনীর লোকজন আমাকে দিয়েই কাজটি করাতে চায়। ছবিটি রঙিন ছিল এবং আমিও যথেচ্ছ ব্যবহার করে হাত পাকানোর একটা সুযোগ নিয়েছিলাম। কারণ রঙিন ফরমেটে আমি তখনও কোনো কাজ করিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কাজটি ভালো হয়েছে! এতে জিয়াউর রহমান খুব খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানান। সেই সাক্ষাতে তিনি আমাকে খুশি হয়ে কিছু উপহার দিতে চান। বলেন আমি কিছু চাই কি-না? আমি তখন খুব ভেবে দেখেছিলাম যে, একজন সামরিক শাসকের কাছ থেকে আমি কোনো ব্যক্তিগত সুযোগ গ্রহণ করতে পারি না। এটা আমার আদর্শ ও মূল্যবোধের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আর আমি তো জানি যে এই সেনাবাহিনীর লোকজন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী। তাই আমি বরাবরই অস্বস্থিবোধ করেছি তাদের যে কোনো প্রস্তাবে। আমি তখন জিয়াউর রহমান সাহেবকে বললাম, ‘আপনি আমাদের একটি ফিল্ম আর্কাইভ করে দিন। এটা খুব প্রয়োজন।’ কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না এটা কি… তিনি বলেন, ‘হোয়াট ইজ দ্যাট?’ আমি তখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে এটা একটা মিউজিয়াম। চলচ্চিত্রের মিউজিয়াম। এখানে একটা দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত থাকে। গবেষণা হয়। বিষয়টা তার কাছে পছন্দ হয় এবং তিনি তখন তার সচিব কর্ণেল অলিকে বিষয়টা বুঝে তাকে জানানোর জন্য বলেন। আমি দেখলাম অলি নোট নিলেন। এর কিছুদিন পরে অলি আহাদ আমাকে ফোন করেন আর্কাইভ বিষয়টা জানতে। আমি তাকে যা যা জানানোর দরকার জানালাম। পরে আমি জানলাম যে জিয়াউর রহমান সেই দায়িত্ব দেন জয়েন্ট সেক্রেটারি এবিএম গোলাম মোস্তফা সাহেবকে। একদিন সকালে এবিএম গোলাম মোস্তফা সাহেব আমাকে ফোন দিয়ে বাসায় গাড়ি পাঠিয়ে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘বলো তো কি আইডিয়া দিয়ে আসছো? এই ফিল্ম আর্কাইভ বিষয়টা কি! লিখে দাও!’ আমি তখন ওনাকে ফিল্ম আর্কাইভ করার প্রস্তাবনার একটি চিঠি লিখে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি থেকে অধ্যাপক সতীশ বাহাদুরের নেতৃত্বে করা ফিল্ম আর্কাইভের প্রস্তাবনা, অর্গানোগ্রাম সংযুক্ত করে একটা পুরো ফাইল করে দেই। তখন তিনি খুশি হয়ে বলেন, ‘ঠিক আছে।’ আমি তখন ওনাকে বলি, ‘স্যার, ঠিক আছে বললে তো হবে না। আপনি এটার বেসিসে একটি ছোট্ট কমিটি করে দেন। না হলে আমি এটার অনুমোদনটা পাব কি করে?’ তখন জিন্নাত আলী সাহেব ছিলেন জয়েন সেক্রেটারি। জিন্নাত আলী সাহেবকে কনভেনর করে আমাকেসহ আরও পাঁচ-ছয়জনকে মেম্বার করে একটি ছোট্ট কমিটি করে দেন। এটাকে বলা হয় ড্রাফট কমিটি। যে ড্রাফটটা আমি জমা দিয়েছি এটাকে মূল ধরে ফর্মালাইজ করার জন্য এই কমিটি করা হয়। ড্রাফটাকে মিটিংয়ে ফর্মালাইজ করে জিয়াউর রহমানের কাছে প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয়।

এছাড়াও জিয়াইর রহমান সাহেবের সেই বৈঠকে আমাকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও বলেন। তিনি বলেন, ‘তুমি ছবি বানাচ্ছো না কেন?’ আমি অর্থসঙ্কটের কথা বলি। তিনি বলেন, ‘একটা ছবি করতে কত টাকা লাগে?’ আমি বলেছিলাম, আড়াই লাখ টাকার মতো! তিনি আমাকে বললেন টাকা তিনি দিবেন। আমি তাকে সেদিন বলেছিলাম যে, আপনি একটা নিয়ম করে দেন যে ভালো চলচ্চিত্রের জন্য প্রতিবছর কয়েকটি ছবি বানাতে সরকার টাকা দেবে। তিনি তাতে সম্মত হয়েছিলেন।

এর কিছুদিন পরে জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে দিলেন আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার; সাথে সাথে অনুদানের এবং উনি অনুদানের একটি ছবিকে শিশুদের জন্য মাস্ট করে দিলেন। এই দাবিগুলো আমাদের সামষ্টিক দাবি ছিল। এগুলোর বাস্তবায়নে আমরা সবাই খুশি হয়েছিলাম। এখানে বলে রাখা দরকার যে আমরা কিন্তু ফিল্ম আর্কাইভ করার প্রস্তাব ১৯৭৫ সালেই বঙ্গন্ধুকে দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ফিল্ম আর্কাইভ হবে। তখন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। আমাদের লিখিত প্রস্তাব তার কাছেও দিয়েছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের পর পুরো রাজনীতি চলে গেল বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাতে। আমাদের সেই প্রস্তাবও তখন সচিবালয়ের কোনো ড্রয়ারে হারিয়ে গিয়েছিল।”

এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী
ফিল্মমেকার । বাদল রহমান

‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নির্মাণ এবং…

বাদল রহমান নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের প্রথম সার্থক শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীএমিলের গোয়েন্দা বাহিনী জার্মান কথাসাহিত্যিক এরিখ কাস্টনারের অমর উপন্যাস। কিন্তু আমরা যখন বাংলায় বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী দেখি তখন অবাক হয়ে লক্ষ করি এ ছবি সত্যিকার অর্থে জার্মান কথাসাহিত্য নয়! এ ছবি একেবারে বাংলাদেশের গল্প হয়ে ওঠে। বাদল রহমান এরিখ কাস্টনারের কাছ থেকে বড়জোড় কাহিনীর কাঠামোটুকু ধার করেছেন। এর বেশি নয়। আমরা যখন গভীর মনোযোগের সাথে এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী দেখি তখন আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি এতে বাদল রহমানের নিজের জীবনের ছায়া খুব স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। খুলনার সেন্ট জোসেফ স্কুলের সেই দুরন্ত কৈশোরকালটাই যেন তিনি তুলে ধরেন এই ছবিতে। এমিল বা পার্থ তো আসলে বাদল রহমান নিজেই!

এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর গল্পটি খুব সহজ এবং সকলের জানা। এটি বাংলাদেশের বহুল প্রশংসিত ও নন্দিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র। কিন্তু আমরা এই চলচ্চিত্রটি দেখতে গিয়ে বেমালুম ভুলে যাই মুক্তিযোদ্ধা বাদল রহমানকে। মনে রাখতে হবে যে এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হচ্ছে ১৯৭৯ সালে।


বাদল রহমানের
এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী
সাধারণ শিশুতোষ চলচ্চিত্রের বাতাবরণে
একটি রাজনৈতিক
সিনেমা হয়ে
ওঠে

সরকারি প্রথম অনুদানে বা অর্থায়নে এবং আমরা তো জানিই যে কেমন ছিল তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হয়েছেন, জাতীয় চার নেতা খুন হয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হচ্ছে এবং রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীরা জেল থেকে ফুলের মালা গলায় বেরিয়ে আসছে। আর তখন দেশের চলচ্চিত্রে ইরান-তুরান-আবে হায়াত বিষয়ক সিনেমার রমরমা বাণিজ্য। মাত্র ৭/৮ বছরের ব্যবধানে মুক্তিযুদ্ধ নির্বাসিত! এবং দেশে টু-শব্দটি করার কারো সাহস নেই। সামরিক শাসনের নানা গুপ্ত হত্যা চলছে। সেই পরিস্থিতিতে বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী সাধারণ শিশুতোষ চলচ্চিত্রের বাতাবরণে একটি রাজনৈতিক সিনেমা হয়ে ওঠে। এমিল একজন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। যার পিতাকে রাজাকাররা মেরে ফেলেছে। সেই এমিল এবং তার ছয়-সাত বছর বয়সী সঙ্গীদের নিয়ে ব্যাংক লুট করা ডাকাতদের ধরে ফেলে! ছবিতে বারবার এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, এসেছে ব্যাংক ডাকাতির কথা [যা সেই সময়কার নিত্যঘটনা] এবং মনে রাখতে হবে যে এমিলের সঙ্গী সাথীদের বয়স কিন্তু ছয়-সাত! যা দেশের বয়সকেই প্রতিকায়িত করে। নিশ্চয়ই এসব বক্তব্য এরিখ কাস্টনার লিখেননি। এছাড়াও এই ছবি মানবতার কথা বলে। বলে মুক্তির কথা। যা পাখিদের বন্দিত্বের অবসানের কথা বলে। এমিল সব বন্দি পাখিদের মুক্ত করে দিতে চায়! এই বন্দিত্ব কি কেবলি পাখিদের? মানুষের সামরিক শাসনের বন্দিত্ব নয়! সকল অশুভের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবান এমিলের গোয়েন্দা বাহনীতে আমরা খুঁজে পাই। এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীতে আমরা আনোয়ার হোসেনকেও পেয়েছিলাম। শিশুর মনোজগৎকে ক্যামেরার ভাষায় এমন রূপান্তর আর কেই-বা করেছে আমাদের জন্য!

সত্যিকার অর্থে বাদল রহমান কখনও শিশুদের ভোলেননি। স্মরণ করুন তাঁর টিউশনি করা, রেডিওতে চিত্রনাট্য লেখা, টেলিভিশনে চিত্রনাট্য লেখা সবই শিশুদের সাথে! শিশুদের জন্য! ফলে শিশু মনোজগৎ খুব ভালো ভাবে বাদল রহমান অনুভব করতে পারতেন। সহজে শিশুদের সাথে মিশে যেতে পারার ক্ষমতা তার ছিল। যে কারণে তাঁর হাত দিয়ে যে কেবল এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী এসেছে, তা নয়। এসেছে ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্রে। এসেছে কাঁঠাল বুড়ির বাগান নামে আরও একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্রে। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তাঁর নির্মিতব্য চলচ্চিত্র ছিল মুজিবের ছেলেবেলা এবং সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে গায়ত্রী সন্ধ্যা

ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ
ফিল্মমেকার । বাদল রহমান

সংগঠক ও নেতা হিসেবে বাদল রহমান

মূলত বাদল রহমান সংগঠক ছিলেন। একজন ভবিষৎদ্রষ্টা চিন্তাশীল সংগঠক। তিনি আগামী দিন দেখতে পেতেন। যে কারণে যখন আমাদের অন্য প্রায় সকল নির্মাতারা কেবল নির্মাণে ব্যস্ত ভূমিকা পালন করছিলেন তখন তিনি দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় চলচ্চিত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার পেছনে নিরলসভাবে শ্রম দিয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর সময় দিয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বুঝিয়েছেন– চলচ্চিত্র কি এবং কেন এই সকল প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। যদিও তিনি কখনও এ সকল প্রতিষ্ঠানের কর্তা হওয়ার বাসনা রাখেননি।


যখন
আমাদের
অন্য প্রায় সকল
নির্মাতারা কেবল নির্মাণে
ব্যস্ত ভূমিকা পালন করছিলেন
তখন তিনি দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে
জাতীয় চলচ্চিত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো
গড়ে
তোলার পেছনে
নিরলসভাবে শ্রম দিয়েছেন

বাদল রহমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ সমূহের ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন একাধিকবার। তিনি ফেডারেশনের সভাপতিও ছিলেন একাধিকবার। মৃত্যুর পূর্বেও তিনি ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে গুণগত ও আদর্শিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপসহীন, লড়াকু এই মানুষ ছিলেন ভীষণ আবেগপ্রবণ এবং অভিমানী। জীবনের একটি বড় সময় তিনি কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি কেবল অভিমান থেকে। সেই অভিমান খুব কাছের মানুষদের ওপর। যা বাদল রহমান কখনও তাদের বুঝতেও দেননি। বাদল রহমানের মৃত্যুর পরে তাঁর দ্বিতীয় বছরের স্মরণ আয়োজনে তেমনি একজন কাছের মানুষ বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই লেখকের কাছে যে বাদল রহমান তাকেও কখনও বুঝতে দেননি যে তাঁর একটি বিষয়ে বাদল রহমান এক সময় আহত হয়েছিলেন।

বাদল রহমান আজীবন একজন রাজনীতিমনস্ক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। স্বাধীনতার পর এ দেশের নাট্যআন্দোলনেও তাঁর অসামান্য ভূমিকা ছিল। যা তিনি কখনও তেমন উচ্চকন্ঠে বলেননি। দেশের প্রথম পর্যায়ের সম্মানীত নাট্যদল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ গঠনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দেশে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী শুরুর পেছনেও তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন।

বাদল রহমান নিজেকে বা তাঁর কাজকে কখনও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবতেন না। গণমানুষের জন্য শিল্প-সংস্কৃতি এমন ভাবনা তাকে তাড়িত করত। প্রথম জীবনে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের কথায় আলোড়িত হয়েছিলেন বলে তিনি সবসময় বলতেন। তিনি বলতেন, মানুষের কথা বলতে হলে বড়ভাবেই বলতে হবে। স্বৈরশাসনবিরোধী নব্বইয়ের গণআন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিলেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে ‘জনতার মঞ্চ’র ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাদল রহমান এই ‘জনতার মঞ্চ’র অন্যতম সংগঠক ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে শহীদ জননী জাহানারা ইমামে নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। আমরা দেখতে পাই, তিনি একজন সক্রিয় চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে বরাবরই কার্যকর ভূমিকা রাখার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন।

বাদল রহমান
বাদল রহমান যখন সংগঠক

নীতি-নির্ধারকের ভূমিকায় বাদল রহমান

কেবল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নীতি নির্ধারণ নয়; বাদল রহমান তাঁর সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম নীতি নির্ধারক ছিলেন। তিনি ছিলেন আন্তরিক সদাহাস্যময় সদালাপী মানুষ। সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারতেন। ভীষণ আড্ডারু ছিলেন, বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারতেন মুহূর্তেই। আর এ কারণেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে যে ধরনের চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তাতে মোটেও আস্থা না থাকার পরেও তিনি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির একজন বড় নীতি-নির্ধারক। সকলের কাছ থেকে সেই সম্মান ও মর্যাদা তিনি সহজেই অর্জন করতে পারতেন। সরকারের আমলাদের সাথে বাকবিতণ্ডা করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়নের লড়াইতে আলমগীর কবির, বাদল রহমান, সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী– এরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন । যে নীতিমালা এখনও বাস্তবায়ন করানো যায়নি। এখনও খসড়া আকারে সেই নীতিমালার প্রস্তাব সচিবালয়ে ফাইলে বাক্সবন্দি।


‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’
প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সকল কাজ
বাদল রহমান
করে গেছেন

বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের আধুনিকায়নের যে নীতিমালা চূড়ান্ত হয়েছে তাতে বাদল রহমানের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ফিল্ম সেন্সর বোর্ড বাতিল করে ‘ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠনের বিষয়ে যে নীতিমালা এখনও আটকে আছে তাতেও বাদল রহমানে ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়াণের সময়েও তিনি ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ নীতিমালা চূড়ান্ত করতে ও পাশ করানোতে বাদল রহমানের ভূমিকা নেতৃত্বের পর্যায়ের। বাদল রহমান চলচ্চিত্র সংসদসমূহের জন্য ‘চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ গড়ে তুলতে সরকারের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিভিন্ন সংলাপ উপস্থাপনে সবসময় ছিলেন উচ্চকন্ঠ। বর্তমান সরকারের গড়ে তোলা ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সকল কাজ বাদল রহমান করে গেছেন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ওপর চাপানো দমনমূলক আইন ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮০’ বাতিল করার দাবি পুরোটা বাস্তবায়ন করতে না পারলেও আইনটিকে সংস্কার করে এর ‘নিয়ন্ত্রণমূলক’ অংশগুলো বাতিল করে আইনটি সংস্কার করার ক্ষেত্রে বাদল রহমানের ভূমিকাই প্রধান।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে ১৯৭৪ সালে। তখন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের একটি বিভাগ আছে চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু চলচ্চিত্রের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি কখনও কিছু করেনি। মৃত্যুর মাত্র ৩ দিন আগে ২০১০ সালের ৭ জুন বাদল রহমান আমাকে নিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কামাল লোহানীর কাছে যান। বাদল রহমান প্রস্তাব দেন শিল্পকলা একাডেমির চলচ্চিত্র বিভাগটিকে সক্রিয় করার এবং অনেক ধরনের কর্মসূচি প্রণয়নের। কামাল লোহানীও ভীষণ উৎসাহিত হন এবং তিনি বলেন, ‘বাদল তুমি যা যা করতে চাও সব হবে।’ কিন্তু আফসোস হল যে, এর মাত্র তিন দিন পরেই বাদল রহমান প্রয়াত হন। ফলে সেই কাঙ্ক্ষিত কার্যক্রম তখন আর শুরু হতে পারেনি।

চলচ্চিত্র সংসদের আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সম্পর্কের সেতু রচনার সূত্রপাত বাদল রহমানই করেছেন। আজ যখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি চলচ্চিত্রচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যা বাদল ভাই স্বপ্ন দেখেছিলেন।

বাদল রহমান
৬২তম জন্মবার্ষিকীতে বাদল রহমান; কে জানত সাতদিন পরই আচমকা প্রয়াণ ঘটবে তাঁর
৪ জুন ২০১০, সেমিনার কক্ষ, পাবলিক লাইব্রেরি

চলচ্চিত্র শিক্ষক, চিন্তাচর্চাকারী ও লেখক বাদল রহমান

চিন্তার চর্চাকারী হিসেবে বাদল রহমান সবসময় কলম হাতে সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ন ছিলেন। তিনি লিখেছেন প্রচুর। বাংলা ভাষায় প্রথম চলচ্চিত্র ভাষা বিষয়ক গ্রন্থের প্রণেতা বাদল রহমান। বইটি ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। বাদল রহমান চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতেন। লিখতেন চলচ্চিত্র বিষয়ক মননশীল প্রবন্ধ। বাদল রহমানের অন্যতম প্রিয় চলচ্চিত্রকার ছিলেন বিশ্বচলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল কস্তা গাভরাস। কস্তা গাভরাস বিশ্বে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ও সম্মনীত। ১৯৮৪ সালে বাদল রহমান ফ্রান্সে গিয়ে কস্তা গাভরাসের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন গভীর উৎসাহে।

বাদল রহমান চলচ্চিত্রের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন বহুল প্রশংসিত। তিনি অনেক সহজ করে চলচ্চিত্র পাঠদানের সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন যা তাঁর স্বনামধন্য ছাত্ররা সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশের প্রথম যুগের চারজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র শিক্ষক আজও বিস্ময় উদ্রেককারী। তারা হলেন আলমগীর কবির, বাদল রহমান, সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী এবং আনোয়ার হোসেন। বাদল রহমানের জীবনের খুব কাছাকাছি যারা ছিলেন তারা জানেন যে এই মানুষটি সারাক্ষণ সৃজনীচিন্তায় সক্রিয় থাকতেন এবং তা কেবল নিজের জন্য নয়!

আমার এই আলোচনায় আজকের মতো সমাপ্তি টানতে হবে। আরও বহু কিছু বিস্তৃতভাবে বলা সম্ভব। এই লেখায় বাদল রহমানের একটি স্কেচ আঁকার চেষ্টা করেছি মাত্র। বাদল রহমানের জীবন বর্ণাঢ্য। বহু ঘটনা এবং অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। সবটা বলার সুযোগ এখানে নেই।


বাদল রহমানের প্রবল হাস্যময়
মুখখানির আড়ালে যে
বেদনার নদী তার
খবর কেউ
রাখতেন
না

যা বলবার চেষ্টা করেছি তা হলো, বাদল রহমান তাঁর জীবনজুড়েই কাজ করেছেন, তবে তা নিজের জন্য নয়। তাঁর কীর্তি শুধু এই নয় যে তিনি দেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্রের নির্মাতা। এবং এই বলেও আক্ষেপ করার কিছু নেই যে বাদল রহমান কেন অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন না! বাদল রহমান অন্য যে কোনো শিল্পীর মতোই ভীষণ আবেগপ্রবণ এবং অভিমানী মানুষ ছিলেন। খুব কাছের মানুষের দেয়া কষ্ট তিনি ভুলতে পারেননি। যে কারণে এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর মতো প্রশংসিত ও নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাণের পর টানা বহুবছর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি। তিনি ভীষণ বন্ধুবৎসল ছিলেন; ফলে বন্ধুদের বহু আঘাত নিরবে সয়ে গেছেন, বহু প্রতারণার শিকার হয়েছেন এবং বহুজন কথা দিয়ে কথা না রাখার পরেও পারতপক্ষে কারও সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়– এমন আচরণ করেননি। বাদল রহমান যতখানি বর্হিমুখী ছিলেন ঠিক ততখানি ছিলেন অর্ন্তমুখী। সে কারণে বাদল রহমানের প্রবল হাস্যময় মুখখানির আড়ালে যে বেদনার নদী তার খবর কেউ রাখতেন না। রাজনৈতিক ক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেও কখনও ব্যক্তিগত লাভালাভের মুনাফা কষতেন না। সে কারণে বাদল রহমানের কোনো আখের ছিল না। এই সাধনা সহজ নয়। খুব কঠিন এই পথ। বাদল রহমান তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব দিয়েই এই পথে জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি আজও রাষ্ট্রের একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদকের মতো সম্মানে ভূষিত হননি। যদিও তিনি এই সম্মান পাওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন বহুকাল পূর্বেই। দুঃখজনক হলো এই যে, রাষ্ট্রীয় সম্মানের ঢালি সবসময় কেবল চাটুকারদের দিকেই ঝুঁকে থাকে। আনন্দের বিষয় এই যে বাদল রহমান তেমন মানুষ ছিলেন না।

বাদল রহমানের কীর্তি এই যে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি বিনির্মাণে আজীবন পুরোধার ভূমিকা পালন করেছেন। আজ যখন রাষ্ট্রের সেই সকল প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠছে যার পেছনে এই মানুষগুলোর আজীবনের শ্রম-ঘাম মিশে আছে তখন আমরা সামষ্টিকভাবে উপকৃত হচ্ছি। আমাদের ভবিষতের সূচনা হচ্ছে, আমরা আশাবাদি হতে পারছি। আমাদের পায়ের তলার জমিনটুকু গড়ে দিয়েছেন আমাদের এই পূর্বজনরা।

এমন মানুষের জীবনে কতগুলো চলচ্চিত্র হলো, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এমন সেলফলেস মানুষ আমাদের অভিভাবক পর্যায়ে আর ক’জন আছেন? বাদল রহমান নিজের পরিবারের জন্য সময় দেননি, নিজের জন্যও সময় দেননি। সমষ্টির জন্য কাজ করতে গিয়ে, স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আহত হয়ে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন সুরার আশ্রয়ে। কিন্তু তা তাঁর উচ্চ আদর্শের সাথে কোনো রকম আপস ছাড়াই। বাদল রহমান নিজেকে ভেঙ্গেছেন কিন্তু আদর্শ ভাঙ্গতে দেননি। বাদল রহমানের শির চিরকাল উচ্চ দেখতে পেয়েছি। এটাই সবচেয়ে গৌরবের যে একজন প্রকৃত শিল্পী কখনও কোথাও আপস করে না!

বাদল রহমানকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়!


সাক্ষাৎকারসূত্র:
এই প্রবন্ধে উল্লেখিত সকল কোটেশন বাদল রহমানের সাক্ষাৎকার থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। লেখক বাদল রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন ২০১০ সালের মে মাস থেকে জুনের ৭ তারিখের মধ্যে।

গ্রন্থসূত্র 
স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ [বরেণ্য চলচ্চিত্রকারদের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ]
সম্পাদক : ফাহমিদুল হক
প্রকাশক : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
প্রকাশকাল : ২০১৯

লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত

Print Friendly, PDF & Email
লেখক; চলচ্চিত্র নির্মাতা; চলচ্চিত্র সংগঠক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ। সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র : অনিবার্য [ পোশাক শ্রমিক আন্দোলন; ২০১১]; পথিকৃৎ [চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের জীবন ও কর্মভিত্তিক; ২০১২ (যৌথ নির্মাণ)]; সময়ের মুখ [জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন অবলম্বনে; ২০১৮]। সম্পাদিত ফিল্ম-ম্যাগাজিন : ম্যুভিয়ানা; চিত্ররূপ। সিনে-গ্রান্থ : চলচ্চিত্রপাঠ [সম্পাদনা]; চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়া; স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; চলচ্চিত্রকথা [তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার; সম্পাদনা]। পরিকল্পক ও উৎসব পরিচালক : নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্র উৎসব

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here