অ্যানিয়েস ভার্দা: ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ সিনেমার ‘গ্র্যান্ডমাদার’

604
অ্যানিয়েস ভার্দা

লিখেছেন । হেলেন কার্টার
অনুবাদ । রুদ্র আরিফ

অনুবাদকের নোট
সদ্যই প্রয়াত হলেন সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম সেরা কারিগর অ্যানিয়েস ভার্দা। তার সৃষ্টিময় জীবনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে, সিনেমার ভীষণ সমৃদ্ধ এক জার্নালে তাকে নিয়ে ১৭ বছর আগে প্রকাশ পাওয়া এই গদ্যটি বাংলায় হাজির করা হলো…

অ্যানিয়েস ভার্দা
জন্ম । ৩০ মে ১৯২৮; ইক্সেলা, বেলজিয়াম
মৃত্যু । ২৯ মার্চ ২০১৯; প্যারিস, ফ্রান্স

২০০১ সালের সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অ্যানিয়েস ভার্দার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। আমি ভেবেছিলাম দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই একটি ড্রামা ফিচার ফিল্ম; অথচ এটি ছিল ডকুমেন্টারি। এই ফিল্মমেকার সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমার। কোনো কারণে, “ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের এই গ্র্যান্ডমাদার বা নানী” আমার জানাশোনার গণ্ডি ধরা পড়েননি! ডকুমেন্টারি ক্লাসে তার নাম কোনোদিন নেননি কোনো শিক্ষক। ফেস্টিভ্যাল প্রোগ্রামেও তার কোনো সিনেমার উল্লেখ পাইনি। এ কারণেই হয়তো তার খোঁজ পাইনি আগে।

দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই একটি সুচিন্তিত আত্মকেন্দ্রিক ডকুমেন্টারি; এখানে সিনেমাটিক পোয়েটি অ্যাশে বা ফিল্মি কাব্যিক প্রবন্ধের কাঠামো গ্রহণ করে এই ফিল্মমেকার নিজেকেই এক অনভ্যস্থ পন্থায় উপস্থাপন করেছেন। ফিল্মটির শিরোনামের আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ দাঁড়ায়, “দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড দ্য গ্লিনার’। এই কাহিনিটির মধ্যে ভার্দা সচেতন ও সুনিশ্চিতভাবে নিজেকে অন্তর্নিহিতভাবে জুড়ে দিয়েছেন। শুটিংয়ের বর্ণনা তিনি নিজেই করেছেন ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে; আর আমরা টের পাই, তিনি যে বুড়ো হয়ে গেছেন, সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক– সম্প্রতি মিনি ডিভি ক্যামেরার সন্ধান পেয়ে, অবাক হয়ে ভাবছেন নিজের বয়স বেড়ে যাওয়ার কথা, আর এ সময়ের সঙ্গে কোনো অনুমানযোগ্য সংযোগ-স্থাপনের প্রতি তার ভেতর রয়ে গেছে সুতীব্র ঝোঁক। তিনি বলছেন, ‘রঙিন বাঁধাকপির সঙ্গে নিজের ছোট্ট ক্যামেরাটা আমি বয়ে বেড়াব।’

দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই

জমিন থেকে ফসলের উচ্ছিষ্ট “গ্লিন” বা সংগ্রহকারী মানুষের প্রতিরূপ ফুটিয়ে তুলেছে এই সিনেমা। ভার্দা বলেন, ‘কুড়িয়ে নেওয়া মানে ভিক্ষা করা নয়’। ফলে ফিল্মটি ফসল ফলানো, পরিচর্যা করা ও ফলস কুড়ানোর নানা চর্চার অতীত ও বর্তমানের প্রেক্ষাপট ধারণ করেছে। আর সেটি দেখাতে গিয়ে, সুপারমার্কেটের রক্তচোষা মজুতদার, জমিনের জিপসি, মধ্যবিত্ত নৈরাজ্যবাদী, মানসিক ব্যাধি ও বিধির কারবার করা জনৈক মদ-উৎপাদকসহ নানা ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য মানুষকে ফরাসি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেকেলে পোশাক ও রীতিনীতির মাপকাঠিতে মেপে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এই ফিল্মমেকার।


বলেছেন,
‘বুড়ো হয়ে যাচ্ছি;
বিনাশ নিকটেই’

ভার্দা নিজে এক ঝুড়ি হৃৎপিণ্ড-আকৃতিক আলু সংগ্রহ করে সেগুলো পুঁতে দিয়েছেন বালুকাচরে। নিজেকে ক্ষয়িষ্ণু সবজির সঙ্গে তুলনা করে মৃত্যু, ক্ষয়িষ্ণুতা ও নিজের মরণের থিমগুলোকে এখানে হাজির করেছেন ভার্দা। নিজ ত্বক ও ধূসর চুলের শরীরে নিজের ডিভি ক্যামেরায় সেই ইমেজগুলো জড়ো করেছেন তিনি; এবং কথা বলেছেন চলতে চলতে। বলেছেন, ‘বুড়ো হয়ে যাচ্ছি; বিনাশ নিকটেই।’ এ বেলা নিজের সম্পত্তিগুলোর একটি হিসেবে, অনাদরে পড়ে থাকা একটি ফিতাছাড়া ঘড়ি কুড়িয়ে নেন তিনি। তাকে আমরা দেখতে পাই একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য আয়নায় : হাতে ক্যামেরা ধরা, অথচ দেখতে অতটা বুড়ো লাগছে না। অবজেক্টিভিটি বা নৈর্ব্যক্তিকতাকে ধরে রাখার প্রচেষ্টায়, ফিল্মটির আত্ম-অসংলগ্ন হয়ে ওঠা রোধ করেছেন এই ফিল্মমেকার; আর তাতে সম্ভবত ভূমিকা রেখেছে অন্য সিনেমাটোগ্রাফার ও এডিটরদের সহায়তা– যদিও সে ক্ষেত্রে ফিল্মমেকিং সংক্রান্ত তার নিজের প্রজ্ঞা ও কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

কাহিনি-বিন্যাসের হাতিয়ার হিসেবে পেইন্টিংয়ের প্রতি তার ভালোবাসা এই ফিল্মে সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে; আর তা তিনি সুনিপুণভাবে করেছেন [ভিনসেন্ট] ভ্যান গঘ, [জুল] ব্রেতোঁ ও [জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া] মিলের মতো শিল্পীদের পেইন্টিং জড়ো করে। এই সিনেমায় ভার্দা বলেন, ‘পেইন্টিংয়ের প্রতি নিজের ভালোবাসা আমি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম।’ এই আইডিয়ার চরম প্রতিফলন ঘটে তখন, যখন তিনি ভ্যান গঘের একটি পেইন্টিং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, দুই নারীর সহায়তায় বাতাসের সুতীব্র ঝাপটার ভেতর শুট করতে থাকেন। তার প্রাথমিক ভিজ্যুয়াল অনুপ্রেরণা অবশ্য হাজির হয়েছে সরাসরি সিনে-ইতিহাস থেকে : রাশিয়ান সিনেমা আর্থ-এর [আলেকসান্দর দভঝেঙ্কো; ১৯৩০] চমৎকার সাদা-কালো ফুটেজ ‘কুড়িয়ে নেওয়ার’ মধ্য দিয়ে।

সবচেয়ে আনন্দদায়ক ব্যাপারটি হলো, এই ফিল্মে মস্করা ও নাটকের বোধটি ভার্দা যেভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সেটি। ক্যামেরা যখন দুর্ঘটনাক্রমে বাম দিকে চলতে শুরু করে, লেন্স ক্যাপ ঢুকে যায় ভেতরে, আর চলে যায় ফ্রেমের বাইরে; সে ক্ষেত্রে ভার্দা এটিকে সৌভাগ্যমূলক হিসেবে বর্ণনা করেছেন, ‘লেন্স ক্যাপের নৃত্য’ অভিধায়। এই ফুটেজটি ভার্দা যদি জড়ো না করতেন, তাহলে এটি নষ্ট হয়ে যেত। একইভাবে, একটি চলমান যানবাহনের ভেতর নিজের হাতে ক্যামেরা রেখে উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে ট্রাকের যে শিশুতোষ আনন্দময় শটগুলো তিনি নিয়েছেন, সে ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ভার্দা নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছেন ইমেজ ও “ডানমুখী মস্তিষ্কের” আইডিয়ার একজন সংগ্রাহক হিসেবে; দেখিয়েছেন, দরিদ্র হওয়ার, বিবেচনাবোধ রাখার, রেগে যাওয়ার কিংবা মজা কুড়ানোর নানা রাস্তা এ জগতে রয়েছে অনেক।


খুব সম্ভবত
মদের
মতোই,
যত পুরনো
হয়,
ততই গুণ বাড়ে
সিনেমাটোগ্রাফারদের

এই সিনেমা দেখে অ্যানিয়েস ভার্দাকে নিয়ে আরও গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। হাজির হলাম অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম, টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও স্কুলের লাইব্রেরিতে। জানতে পারলাম, ভার্দার বয়স এখন [তখন] ৭৪ বছর; তিনি সিনেমা বানাচ্ছেন ১৯৫০ দশক থেকে। অনেক মাস্টার ফিল্মমেকারের সঙ্গে কাজের যোগাযোগ রয়েছে তার। এদের মধ্যে আইজ ওয়াইড শাট [১৯৯৯] নির্মাণের পরের দিনই মারা গেছেন [স্ট্যানলি] কুব্রিক। [পিটার] গ্রিনঅ্যাওয়ের জন্য সাশা ভিয়ের্নি তার শেষ ফিচার ফিল্মের শুট করেছেন ৭৫ বছর বয়সে। খুব সম্ভবত মদের মতোই, যত পুরনো হয়, ততই গুণ বাড়ে সিনেমাটোগ্রাফারদের। ভার্দাও যে নিজের মধ্যে তারুণ্য ধরে রেখেছেন, সেটি তার সিনেমা দেখলেই টের পাওয়া যায়; এবং তার যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়ে আছে নানা জায়গায়, সেখানে তাকে দেখতে লাগে সতেজ, কালো চুলোর এক তরুণীর মতো।

কুংফু মাস্টার

লাইব্রেরিতে কুংফু মাস্টার [১৯৮৮/৭] ও কয়েকটি শর্টফিল্ম পাওয়া গেল। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, কুংফু মুভিটি মোটেও ডকুমেন্টারি নয়, বরং ম্যাথ্যু দ্যুমি অভিনীত জুলিয়াঁ নামের এক তরুণের প্রেমে পড়ে যাওয়া এক বয়ষ্ক নারীকে [ভার্দার বান্ধবী ও অভিনেত্রী জেন বার্কিন অভিনীত] ঘিরে বানানো একটি ফিচার লেন্থ ড্রামা ফিল্ম এটি। ফিল্মটিকে জনৈক সমালোচক বর্ণনা করেছেন, ‘ব্রিটিশ ডিস্ট্রিবিউটরদের আতঙ্কগ্রস্ত করে দিতে, বিশেষ ভাবে কল্পনাপ্রসূত একটি সবিশেষ উপযুক্ত বিষয়বস্তু’ হিসেবে। দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই-এ দেখা মেলা বেশ কিছু থিম ধারণ করে আছে এই ফিল্মটি; যেমন, জানতে চাওয়া– বুড়ো হয়ে যাওয়ার মানে কী? কাকে ভালোবাসতে পারি আমরা? কোন কোন কাহিনি দেখানোর বাকি আছে সিনেমার?

যদিও এই ফিল্মটিতে দৃশ্যমান নন, তবু এই কাহিনিতে ভার্দা ভীষণ রকম উপস্থিত। ভয়েস-ওভার শুনে তার কণ্ঠ বলেই মনে হয়; অন্যদিকে, বার্কিনকে ভীষণ রকম ভার্দার মতোই লাগে দেখতে। বস্তুত, আমি আবিষ্কার করলাম, বালকটির চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্বয়ং ভার্দার ছেলে, এবং ছেলেটির বোনদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বার্কিনের দুই কন্যা– শার্লট গেইন্সবুর্গ ও লু দোয়াইলোঁ। এটি টের পেয়ে, ফিল্মটি দেখার নতুন এক তাৎপর্য্য ও আনন্দ ধরা দিলো আমার কাছে। সমালোচক রুথ হটেলের মতে, ‘ভার্দার সিনেমা হলো বিষয়বস্তগত অন্তর্ভুক্তিকরণের [সাবজেক্টিভ ইনক্লুশন] একটি প্রকাশ : নিজের সিনেমাগুলোতে তিনি নিজেকে, নিজের বন্ধুদের ও পরিবারের সদস্যদের সরাসরি ও পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত করে যান।’ ফিল্মটির প্রাণোচ্ছ্বল ভূমিকাপর্ব জানান দেয়, যথাযোগ্য ইলেকট্রনিক সাউন্ডের সহকারে, জার্কি মুভমেন্টে হাজির হওয়া টিনএজার জুলিয়্যাঁ একটি গেম ক্যারেক্টারের মতো। এটিকে কমিক স্টাইলে পরিণত করতে, দৃশ্যটি হাজির হয় এক দোকানের জানালার সামনে।

ডায়েরি অব অ্যা প্রেগন্যান্ট ওম্যান

প্রথম সন্তান রোজালিকে গর্ভে ধারণ করে, প্রেগন্যান্ট অবস্থাতেই ডায়েরি অব অ্যা প্রেগন্যান্ট ওম্যান [১৯৫৮] নির্মাণ করেছিলেন ভার্দা। গর্ভধারণ ও প্যারিসের রু মুফতা স্ট্রিটের জীবন ঘিরে নির্মিত চমৎকার এক ফেমিনিন সিনেমা এটি। এখানে এক নারীর ফুলে ওঠা তলপেটকে একটি বিশাল আকৃতির কুমড়োর সঙ্গে জাক্সটাপজ করে দেখানো হয়েছে। ফল ও সবজির বাজারের মধ্যে, কেনাকাটারত বুড়ো মানুষদের মুখোচ্ছবির ইন্টারকাটের মধ্য দিয়ে এখানে যে মন্তাজটি জাহির করা হয়েছে, সেটি দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই-এর কথা আরও একবার মনে করিয়ে দেয়। ডায়েরি অব অ্যা প্রেগন্যান্ট ওম্যানকে বিভক্ত করা হয়েছে কয়েকটি আলাদা অধ্যায়ে; সেগুলোর হাতে লেখা সাবটাইটেলগুলোও ভীষণ রকম ভার্দাধর্মী। এ রকম বহুদিক থেকে, নিজের সিনেমাগুলোতে নিজেরই জীবনচক্রকে পরিপূর্ণ করেছেন এই ফিল্মমেকার।


‘নিজ
ভঙ্গিমায়
আত্মরতির
[নার্সিসিজম]
ভেতর দিয়ে নয়,
বরং সততার ভেতর
দিয়ে আমি বরাবরই নিজের
সিনেমায়
নিজেকে ভীষণ
যথাযথভাবে জুড়ে দিয়ে গেছি’

অন্যদিকে, আঙ্কেল ইয়াঙ্কো [১৯৬৭] ফিল্মটিকে ভার্দার ক্ষেত্রে তুলনামূলক গতানুগতিক কাজ বলে মনে হতে পারে। এই ফিল্মমেকার এই ডকুমেন্টারিটিতে নিজ পরিবারের ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন। সান ফ্র্যান্সিস্কোর এক সেঁতুর ওপর শিল্পীদের সঙ্গে বসবাসকারী ভবঘুরে ইয়াঙ্কো [জ্যঁ (ইয়াঙ্কো) ভার্দা] আঙ্কেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন এখানে তিনি; আর যথারীতি সঙ্গে নিয়ে গেছেন ক্যামেরা। তিনি যে একটি ফিল্ম বানাচ্ছেন, এবং আরও একবার ফিল্মের কাহিনির সঙ্গে নিজেকেই জুড়ে দিচ্ছেন– এই বিষয়টি গোপন রাখার কোনো চেষ্টাই ভার্দা এখানে করেননি। শিল্পীরা যখন বিশাল এক ভোজসভায় বসেছেন, ভার্দা আর ইয়াঙ্কো তখন জায়গা করে নিয়েছেন টেবিলের দুই মাথায়। ভোজনপর্বের এক পর্যায়ে তিনি শিস দিয়ে ক্যামেরা চালু করিয়েছেন, আর ইশারা দিয়ে উপস্থিত কারও সাহায্যে সেটিকে করেছেন বন্ধ। এটি তার সততার এক পরিচায়ক; যার মাধ্যমে ফিল্মমেকিং প্রক্রিয়া ও স্টোরি টেলিংয়ে সুস্পষ্টতার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন তিনি। পরিহাসের ব্যাপার হলো, এটি দর্শকের সামনে একটি বৃহত্তর অবজেক্টেভিটিকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, ইয়াঙ্কো চিৎকার করে ভার্দাকে বলছেন, ‘অ্যানিয়েস, তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি; কিন্তু এবার আমাকে একটু ঘুমোতে দাও বাছা!’ ক্ল্যাপার-বোর্ড আর শিল্পীদের পরতে “ভিভা ভার্দা” ব্যাজ পরা একটি পরাবাস্তব সিক্যুয়েন্সের মধ্য দিয়ে ফিল্মটি চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে পৌঁছায়, যখন ভার্দার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে সহযোগিতা করার জন্য ক্রুদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন [বলা বাহুল্য, দুই বছর পর এ রকম দৃশ্যেরই ব্যবহার ঘটতে আমরা দেখি (রবার্ট) অ্যাল্টমানের মাস (১৯৭০) সিনেমায়]। ভার্দা স্বেচ্ছায় স্বীকার করেছেন, ‘নিজ ভঙ্গিমায় আত্মরতির [নার্সিসিজম] ভেতর দিয়ে নয়, বরং সততার ভেতর দিয়ে আমি বরাবরই নিজের সিনেমায় নিজেকে ভীষণ যথাযথভাবে জুড়ে দিয়ে গেছি।’ সততাই ভার্দার শক্তি ও মৌলিকত্ব; এবং এটি দর্শকদেরকে একটি অপ্রত্যাশিত পরিপ্রেক্ষিত সহকারে লাভবান করে তোলে। সিনেমার চরিত্রগুলোকে বিচার করার বদলে বরং সেগুলোর পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের ব্যক্তিজীবনের একটি সংযোগ খুঁজে নেওয়ার প্রতিই মনোযোগ ছিল এই ফিল্মমেকারের। নিজ সিনেমায় তার অবস্থান এখানেই নিহিত।

আঙ্কেল ইয়াঙ্কো

ইউ হেভ গট বিউটিফুল স্টেয়ারস, ইউ নোকে [১৯৮৬] দৃশ্যতই সিনেমার একটি জাদুঘর ঘিরে নির্মিত ডকুমেন্টারি বলে মনে হয়, যেখানে [অরসন] ওয়েলস, [আকিরা] কুরোসাওয়া, [ফ্রাঁসোয়া] ত্রুফো, [জ্যঁ লুক] গোদার ও [কিং] ভিডরের বানানো সিনেমার তুখোড় ইতিহাসের ইঙ্গিত রয়েছে। এই সিনেমায় ওদিসার [ইউক্রেন] পটেমকিন স্টেপ সিক্যুয়েন্স ও প্যারিস মিউজিয়ামের প্রতি ত্রুফোর অ্যানার্কিস্ট স্টেপের প্রাণবন্ত পুনর্বিধান করেছেন এই ফিল্মমেকার। সিনে-সংস্কৃতির প্রতি একটি প্রেমময় শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদর্শন করা এই ফিল্মটিতে ভার্দার সিনেমার সকল নিয়মিত উপাদানগুলোরও রয়েছে উপস্থিতি। [জানালার] পর্দার মধ্য দিয়ে ফ্রেমের ব্যবহার, দোকানের জানালা ও দরজার ফাঁক দিয়ে শুটিং করা এবং আরও অন্যান্য নিত্য-নৈমিত্ত নিজস্ব কৌশলের দেখা তার সব সিনেমাতেই পাওয়া যায়। যেমন, পাইওনিয়র ইতিয়ান-জুল মারের [ফরাসি বিজ্ঞানী] মুভিং ইমেজের শর্ট ক্লিপস তিনি জুড়ে দিয়েছেন দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই-এ; আবার ডায়েরি অব অ্যা প্রেগন্যান্ট ওম্যান-এর সমাপ্তি ঘটতে দেখা যায় ফ্রেমে একটি রোলার ডোরের গ্রাসকালের মধ্য দিয়ে। আঙ্কেল ইয়াঙ্কোতে রয়েছে এমন একটি দৃশ্য, যেখানে এই ভাতিজি ও চাচার পুনর্মিলনীর দেখা মেলে; ক্ল্যাপার-বোর্ড ও এডিটরের চায়না গ্রাফ সিঙ্ক মার্কের মধ্যে একাধিক টেকে পুনরাবৃত্ত হয়ে দৃশ্যটি হয়ে ওঠে পরাবাস্তব।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে, অনাদরে পড়ে থাকা পুরনো সিনেমা পেপারস ম্যাগাজিনের একটি বাক্স পেলাম। অন্ধের মতো হাতড়িয়ে, কয়েকটি সংখ্যা কবজা করে নিলাম আমি; এর মধ্যে একটিতে ছিল ১৯৮৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে ভার্দার দেওয়া এক সাক্ষাৎকার। সেখানে তিনি আর্তনাদের স্বরে বলেছেন, ‘ডকুমেন্টারি শব্দটি নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি বলবেন ডকুমেন্টারি, আর লোকে বলবে, কী বোরিং ব্যাপার রে বাবা! [ফলে] এর মাঝামাঝি কোনো শব্দ বেছে নিতে হবে আমাদের।’ এ পর্যায়ে আমার জানা ছিল না, ইংরেজি ভাষায় ভার্দাকে নিয়ে কোনো লেখা খুঁজে পাওয়া আমার জন্য কতটা দুরূহ হবে। অনলাইনে, নানা ওয়েব সাইটে, একেবারেই সংক্ষিপ্ত জীবনীভিত্তিক তথ্যসহ সেই একই সক্ষাৎকারগুলো নানা রূপে খুঁজে পেলাম কেবল।

লা পোয়াঁত কোর্ত

অ্যানিয়েস ভার্দার জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ মে; বেলজিয়ামের ইক্সেলা পৌরসভায়। বেড়ে উঠেছেন স্যেৎ মফস্বল অঞ্চলের একটি সমুদ্র বন্দরে। ইকোল দু লুভ্যতে শিল্প-ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করে, অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে চাকরি করেছেন থিয়েটার ন্যাশনাল পপুলারে। ‘লেফট ব্যাংক’ সহযোদ্ধা ক্রিস মার্কার ও অ্যালাঁ রেনে তাকে উৎসাহিত করেছেন নিজের প্রথম ফিচার ফিল্ম, লা পোয়াঁত কোর্ত [১৯৫৪] নির্মাণ করতে– যেটি ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ সংগঠিত হওয়ার আগের ঘটনা। অবশ্য এর আগে ফিল্মমেকিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। আর দর্শক হিসেবে দেখা ছিল মাত্র বিশটির মতো সিনেমা। ১৯৬২ সালে তিনি, লোলা [১৯৬০] সিনেমা বানিয়ে ভীষণ খ্যাতিমান হয়ে ওঠা ফরাসি ফিল্মমেকার জ্যাক দ্যুমিকে বিয়ে করেন। ১৯৭২ সালে এই দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় ছেলে-সন্তান– ম্যাথ্যু। ম্যাথুকে ভার্দার অনেক সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা গেছে। যে বছর স্বামীর প্রথম জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনমূলক জাকু দু নোতাঁ ফিল্মটি নির্মাণ করেন ভার্দা, সেই ১৯৯০ সালেই মারা যান জ্যাক। সিনেমাটি দৃশ্যতই জ্যাকের খুব পছন্দ হয়েছিল; এখানে কৈশোরের স্মৃতিচারণারত ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন নিজেই। রোজালি নামে এক কন্যাও আছে ভার্দার; তবে তার জন্ম ভার্দার বিয়ের আগেই; আর তার জন্মদাতা আঁতোয়ান বাসিলা। তাকে দত্তক নিয়েছিলেন জ্যাক। ১৯৭৭ সালে নিজের প্রোডাকশন কোম্পানি, সিনে-তামারি প্রতিষ্ঠা করেন ভার্দা; এর ফলে ইচ্ছেমতো সিনেমা বানানোর স্বাধীনতা তিনি পেয়ে যান। ইরান, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবায় নিজের সিনেমাগুলোর শুটিং করেছেন। রু দাগায়েরেতে তিনি বসবাস ও কাজ করছেন ৪০ বছরেরও অধিককাল ধরে। এই স্ট্রিটে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার আলোকেই দাগায়েরাটাইপস [১৯৭৫] ফিল্মটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন।


সিনেমাকে
নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার
ক্ষেত্র হিসেবে তিনি গ্রহণ করেননি,
বরং ছিলেন এ ব্যাপারটির ঘোরবিরোধী

কাইয়ে দ্যু সিনেমায় লেখালেখি করা তার সমসাময়িক ফিল্মমেকারদের তুলনায় ভার্দা ছিলেন আলাদা; কেননা, সিনেমাকে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে তিনি গ্রহণ করেননি, বরং ছিলেন এ ব্যাপারটির ঘোরবিরোধী। অবশ্য নিজস্ব ‘সিনেক্রিয়েচার’ মতধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন, যেটিকে তিনি সিনে-রাইটিংয়ের প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহীত করে থাকেন; তবে বৃহৎ অর্থে ভাবলে, এটি শুধু সিনে-রাইটিং নয়, বরং এডিটিং স্টাইল, ভয়েস ওভার কমেন্টারি এবং স্থান-কাল-পাত্র, ক্রু ও লাইট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ১৯৯৪ সালে নিজের জীবন ও কর্ম নিয়ে ভার্দা পার অ্যানিয়েস নামে একটি বই লিখেন তিনি। বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করে সিনে-তামারি ও কাইয়ে দ্যু সিনেমা। যদিও ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েব ফিল্মমেকারদের সঙ্গে ওঠা-বসা ছিল, তবে ডকুমেন্টারি, ড্রামা, শর্ট কিংবা ফিচার ফিল্ম– সব ক্ষেত্রেই তার পথচলা ছিল সেই ফিল্মমেকারদের চেয়ে আলাদা।

ভার্দার কাজ নিয়ে ছাপা হওয়া বেশির ভাগ আর্টিক্যালেই বিতর্ক উঠেছে– তিনি নারীবাদী ফিল্মমেকার কি না। জার্মেইন দুলাক, মার্গারিতা দুরাস, চান্তাল আকেরমান ও আলিস জ্যি-ব্লাশে [যাকে সিনে-ইতিহাসের প্রথম নারী ফিল্মমেকার হিসেবে গণ্য করা হয়] প্রমুখ ফিল্মমেকারের সঙ্গে, তাকেও ফেঞ্চভাষী সিনেমার দীর্ঘ ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নারী ফিল্মমেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। সমালোচক ক্লেয়া জনস্টন যদিও ভার্দাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল, এবং নিঃসন্দেহে নারীবাদী নন’– এমন দায়ে অভিযুক্ত করে খারিজ করে দিয়েছেন, তবু নারী মুখ্যচরিত্রদের সঙ্গতিপূর্ণ করায় এবং একটি নারী সিনেমাটিক ভয়েস সৃষ্টির কারিগর হিসেবে তাকে নারীবাদী ফিল্মমেকিংয়ের একটি অনস্বীকার্য উদাহরণ হিসেবে গণ্য করাই যায়। নিজেকে নারীবাদী ভাবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ভার্দা বলেছিলেন, ‘বৈষম্যের ব্যাপারে কখনোই আমার স্বচ্ছ ধারণা ছিল না, এবং এটি ঠিক আমার ভাবমূর্তিও নয়’। গোদার, রেনে, [ক্লুদ] লুলুশ প্রমুখ ফ্রান্সের কিছু বিখ্যাত ফিল্মমেকারকে জড়ো করে, ১৯৬৭ সালে ফার ফ্রম ভিয়েতনাম শিরোনামে একটি যুদ্ধবিরোধী সিনেমা প্রডিউস করেছিলেন ক্রিস মার্কার। ফিল্মমেকার হিসেবে এ দলে অ্যানিয়েস ভার্দাও ছিলেন, তবে সিনেমাটির আলোচকেরা তার ব্যাপারে খুব একটা আলোকপাত করেননি। সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের জিল ফোর্বসের ভাষ্যমতে, ‘এই নীরবতার অর্থ ভীষণ নিয়মানুগ; কেননা, ভার্দাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ তিনি একজন নারী।’ ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ-এর কোনো আলোচনায় নিজেকে কখনো জড়াননি তিনি। তার সিনেমা নারীবাদী হোক বা না-হোক, সেগুলো নিশ্চিতভাবেই নারীকেন্দ্রিক; সেগুলোতে নারীর সমাজ-রাজনৈতিক, দার্শনিক ও সমকালীন থিমের সমারোহ ঘটানো হয়েছে দর্শকদের বিনোদিত করার ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় না দিয়েই।

জাকু দু নোতাঁ

১৯৮৭ সালে ডিপটিক ডেডিকেটেড টু জেন বার্কিন ওয়ান অ্যান্ড টু থিমকে ঘিরে নিজের দুটি সিনেমা জেন বি. ফর অ্যানিয়েস ভি.কুংফু মাস্টার নির্মাণ করেন ভার্দা। এই দ্বিতীয় সিনেমাটি ঠিক ডকুমেন্টারি কি না– সেই দ্বিধায় কম-বেশি সব দর্শককেই পড়তে হয়েছে; কেননা, এটি শুধু ভিডিও ফরম্যাটে, ফ্রেঞ্চ ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল। প্রথম সিনেমাটি বার্কিনের একটি ক্যারেক্টার স্কেচ; অন্যদিকে দ্বিতীয় সিনেমাটি স্বয়ং বার্কিনকে অভিনয়ে নিয়েই নির্মিত একটি ফিকশন। এই ফিকশন ফিল্মটির উদ্ভব ঘটে তখন, যখন ডকুমেন্টারিটির শুটিংয়ের সময় ভার্দাকে ১০ পৃষ্ঠার একটি ক্যারেক্টার স্কেচ দিয়েছিলেন বার্কিন– যেটির উপর নির্ভর করেই একটি ফিচার লেন্থ ড্রামার স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলেন ভার্দা। কুংফু মাস্টার-এ বার্কিন ও ভার্দা– উভয়ের সন্তানেরাই অভিনয় করেছেন– বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে একটি দুর্বোধ্য হেঁয়ালি তৈরি করতে। এই দুটি সিনেমায় পড়েছে পারস্পরিক প্রতিফলন, এবং প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে বড়পর্দা, ফিকশন ও বাস্তবতায় নারীর প্রতিনিধিত্বের প্রতি। সিনেমা দুটির প্রত্যেকটিরই রয়েছে নিজস্ব ভাষ্য; তবু দুটি একসঙ্গে যেন তারচেয়েও বেশি কিছু বলে। দুর্ভাগ্যক্রমে ডকুমেন্টারির ভাগ্যে কোনো ডিস্ট্রিবিউটর জুটেনি; আর ফিকশনাল ফিল্মটি মুক্তি পেয়েছে শুধু ভিডিও ফরম্যাটে। ফলে দর্শকের ওপর এগুলোর পরিপূর্ণ প্রভাব পড়েনি।

জাকু দু নোতাঁ ফিল্মটি নিজের স্বামী ও ফিল্মমেকার জ্যাক দ্যুমির প্রতি ভার্দার একটি ভালোবাসাপূর্ণ স্মারক। কখনো কখনো ডকুমেন্টারি হিসেবে অভিহীত করা হলেও, এটি মূলত জ্যাকের শৈশব-স্মৃতির একটি পুনর্নির্মাণ। শুটিং নোতাঁয় হওয়ায় ফিল্মটি দেখতে সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। চমৎকার ৯.৫ এমএম হ্যান্ড ড্রয়িং ইমেজসহ জ্যাকের প্রথম সিনে-রোমাঞ্চের ক্লিপসগুলো ফিল্মটিকে করেছে ঋদ্ধ। ডেমি স্বয়ং এখানে ক্যামেরার [কিংবা ভার্দার] দিকে তাকিয়ে সরাসরি নিজের জীবনকাহিনি শুনিয়েছেন। ক্যামেরা বিনম্রভাবে প্যান করে ধারণ করেছে তার ত্বক, দেখিয়েছে সবগুলো লোমকূপ, চুল ও বয়সের ছাপ। দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই-এও একই ধরনের শটের দেখা মেলে; যদিও এই দুটি ফিল্ম একেবারেই আলাদা, তবু একসঙ্গে এ দুটি ভার্দার জীবনের একটি অধ্যায়ের প্রতিনিধি। জাকু দু নোতাঁ শুরু হয় ভার্দার সেই চিরচেনা কণ্ঠস্বর দিয়ে– যেখানে তিনি ব্যক্ত করতে থাকেন নিজের প্রেমিকের কথা। এটি অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতাগুলোকে জাহির করেছে– দর্শকের সঙ্গে সেগুলোর সম্পৃক্ততা ঘটাতে। লোকটি [দ্যুমি] শুয়ে থাকেন মহাসমুদ্রের ধারের এক বিস্তীর্ণ বালুকা-সৈকতে, তার আঙ্গুলের ফাঁকে অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ে হলুদ আভা। মানবতার অসীম বালুরাশির মধ্যে জ্যাক দ্যুমিকে উপস্থাপন করে তার প্রতি এভাবেই সম্মান দেখিয়েছেন ভার্দা।

ফিল্মমেকার দম্পতি
অ্যানিয়েস ভার্দা ও জ্যাক দ্যুমি

ভার্দার সবচেয়ে সফল ও সবচেয়ে বিখ্যাত ফিচার ফিল্ম হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা ভেগাবন্ড [১৯৮৫)] পেয়েছে ঠিকই, তবে তার দ্বিতীয় [ফিকশনাল] ফিচার ফিল্ম ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭কেও [১৯৬১] পিছিয়ে রাখার উপায় নেই। ক্যান্সার টেস্টের ফল হাতে পাওয়ার জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষায় থাকা এক পপ-সিঙ্গারের কাহিনি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই সিনেমায়। ফিল্মটি বস্তুত ৯০ মিনিটের; তবে রানিংটাইমের প্রত্যেকটি মুহূর্ত বাস্তবের প্রত্যেকটি মুহূর্তকেই যেন অনুভব করিয়েছে। ফিল্মটির শুরুতে দেখা যায়, জনৈক বৃদ্ধ পড়ছেন ক্লিওর [করিন মার্শা অভিনীত] ভাগ্যলিপি : ক্লিওর জীবন স্পষ্টতই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শুরুর দৃশ্যটি রঙিন হলেও, বাকি সময়ের পুরোটাই রয়ে যায় সাদা-কালো। এ সিনেমায় ডায়েরি অব অ্যা প্রেগন্যান্ট ওম্যান-এ অনেক কিছুরই অনুরণন ঘটেছে; যেমন, প্যারিসের রাস্তায় ক্লিওর উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে এখানকার মানুষদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতার সঙ্গে ন্যারেটিভের একটি টিপিক্যাল সম্মিলন ঘটিয়েছেন এই ফিল্মমেকার। ক্লিওর গানগুলো ভার্দা নিজে লিখেছেন, এবং মাইনর চরিত্রে অভিনয় করিয়েছেন নিজের দুই বিখ্যাত বন্ধু– ফিল্মমেকার গোদার ও মিউজিক কম্পোজার মিশেল লোগ্রাঁকে। ফিল্মটিকে ভাগ করা হয়েছে সময়ের বহমানতাকে নির্দেশ করা অধ্যায় অনুসারে।

[কার্ল] ইয়ুংধর্মী প্রতীকে ফিল্মটি ঋদ্ধ : ক্লিও একটা হ্যাট কিনে নিজের এক বন্ধুকে দিয়ে দেয়, এবং পরে নিজের প্রকৃত সৌন্দর্য বা সাধারণত্বকে প্রকাশ করে দিতে পপ-সিঙ্গারের পরচুলাটি খুলে ফেলে; সে যে এখন একটি ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত– এটি তারই ইঙ্গিত। সিঁড়ির [অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক] উপস্থিতি ভার্দার সব সিনেমাতেই দেখা মেলে; আর এখানে এগুলো রাস্তাঘাট ও সমকালীন সংস্কৃতি থেকে প্রভাবিত হয়ে সৃষ্ট নিজের সিনেমার চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মনস্তত্ব ও সমাজের প্রতি ভার্দার আগ্রহেরই ইঙ্গিত রাখে। ক্লিওর ঘড়ির মধ্যে একটি বানরের ছবি আছে– এটি এই নারীর পেছনে আসলে সময়কে বানর হিসেবে প্রতিকৃত করার একটি চিহ্ন। রাস্তাগুলো ভরে আছে সিনেমার পোস্টারে; আর এখানে, এই টিপিক্যাল ফিল্ম-উইদিন-অ্যা-ফিল্মের ভেতর ক্লিওকে নিজের আত্ম-আচ্ছন্নতা থেকে সরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত পাই আমরা। বয়স বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ভার্দার যে উপলব্ধি, সেটিরই অনুরণন ঘটে এখানে : ‘ক্যান্সার আর হৃদরোগের ব্যাপারে মানুষ ভীষণ ঘোরগ্রস্ত। [আর] আমার অসুখ হলো– কাজ করে যাওয়া, ফোনে কথা বলা ও অ্যাপয়েনমেন্ট দেওয়া-নেওয়া’। ভার্দার মতে, ‘সে সময়ে ক্যান্সারভীতি ছিল সার্বজনীন– ঠিক যেন এখনকার পারমাণবিক বোমা বা যুদ্ধভীতির মতো।’

ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭

ফিল্মমেকিং টেকনিক ও স্টাইল এবং এমনকি রাজনৈতিক ধারাভাষ্যের বিবেচনায় নিজ সময়ের চেয়ে বরাবরই এগিয়ে থেকেছেন অ্যানিয়েস ভার্দা। দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই যেমন ডিজিটাল সিনেমাটোগ্রাফির সর্বশেষ উদ্ভাবনকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদ ও শহুরে জীবনের প্রতি একটি সমকালীন দৃষ্টিপাত, তেমনই কুংফু মাস্টার স্বস্তির সঙ্গে আসন গ্রহণ করে আছে ১৯৮০ দশকে বানানো [কেন] লোচ, [ইংমার] বারিমন ও গ্রিনঅ্যাওয়ের মতো মাস্টার ফিল্মমেকারদের সিনেমাগুলোর পাশে। আঙ্কেল ইয়াঙ্কো যেমন ধারণ করে আছে ১৯৬০ দশকের শেষভাগের বোহেমিয়ান, ড্রাগ-আসক্তি ও নৈতিকতাবিরোধী জীবনবোধকে; তেমনই ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭-এ ফুটে উঠেছে গাড়ি, ফ্যাশন ও আত্মপরিচয়ের প্রতি ফরাসিদের ঘোরগ্রস্ততা। ফিল্মমেকারদের বিশ্ব-সম্প্রদায়ের গ্র্যান্ডমাদার এই অ্যানিয়েস ভার্দা। এ বয়সেও নিজের ফিল্মমেকিং অভিজ্ঞতাকে পরখ করে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহের কমতি নেই তার; বিস্ময়করভাবে বানিয়ে যাচ্ছেন সিনেমা। ‘শুধু ভালোবাসার মধ্যেই নয়, বরং কাজের মধ্যে, কারও সন্তানদের সঙ্গে সস্পর্কের মধ্যে, কারও সহজাত মনোভাবের সঙ্গে সংযোগ-স্থাপন খুব দুরূহ হলেও জরুরি বিষয় বলে আমি মনে করি।’ –এমনটাই তার ভাষ্য। কেউ কেউ যথার্থই বলেন, একটা মানুষ এক জীবনে একটা বই-ই লিখেন কিংবা একটা সিনেমাই বানান; কিন্তু একজন লেখক, ফিল্মমেকার ও সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের পাঁচ-ছয় দশকের প্রত্যেকটিতে অন্তত একটি করে স্বতন্ত্র স্তর গড়ে তুলেছেন ভার্দা। তার কাজগুলোকে একসঙ্গে কোনো একটি ধারায়– হোক সেটি ফিকশন বা রিয়েলিস্টিক– তাতে ফেলা যাবে না। কেউ কেউ ধরেই নিয়েছিলেন, দ্য গ্লিনারস অ্যান্ড আই সম্ভবত হতে যাচ্ছে তার শেষ সিনেমা, কিন্তু জীবনের শেষ রসদটুকু টেনে নিতে উদগ্রীব এই মাস্টার নিজের যাত্রা থামিয়ে দেননি। এখন পর্যন্ত তার সর্বশেষ সিনেমা, নিজের ৮০ম জন্মদিনকে সামনে রেখে, ২০০৮ সালে নির্মিত আত্মজৈবনিক ডকুমেন্টারি দ্য বিচেস অব অ্যানিয়েস

অনুবাদকের সংযোজন
হায়, দীর্ঘজীবন কাটিয়ে, ২৯ মার্চ ২০১৯, মহাপ্রয়াণ ঘটেছে আমৃত্যু সৃজনশীল এই মাস্টার ফিল্মমেকারের।


হেলেন কার্টার : শিক্ষার্থী, অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম টেলিভিশন এন্ড রেডিও স্কুল, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
সূত্র : সেন্সেস অব সিনেমা। অনলাইন ফিল্ম জার্নাল, অস্ট্রেলিয়া
প্রকাশ : অক্টোবর ২০০২

ভ্যাগাবন্ড

অ্যানিয়েস ভার্দার ফিল্মোগ্রাফি

ফিচার ফিল্ম
লা পোয়াঁত কোর্ত [La Pointe Courte] । ১৯৫৫
ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭ [Cléo de 5 à 7] । ১৯৬২
হ্যাপিনেস [Le Bonheur] । ১৯৬৫
দ্য ক্রিয়েচারস [Les Créatures] । ১৯৬৬
ফার ফ্রম ভিয়েতনাম [Loin du Vietnam] । ১৯৬৭
লায়নস লাভ [Lions Love] । ১৯৬৯
দাগায়েরাটাইপস [Daguerréotypes] । ১৯৭৫
ওয়ান সিংস, দ্য আদার ডাজেন্ট [L’Une chante, l’autre pas] । ১৯৭৭
মুরাল মুরালস [Mur murs]। ১৯৮১
দকুমেন্তুর [Documenteur] । ১৯৮১
ভ্যাগাবন্ড [Sans toit ni loi] । ১৯৮৫
জেন বি. ফর অ্যানিয়েস ভি. [Jane B. par Agnes V] । ১৯৮৮
কুংফু মাস্টার [Le petit amour] । ১৯৮৮
জাকু দু নোতাঁ [Jacquot de Nantes] । ১৯৯১
দ্য ইয়ং গার্লস টার্ন ২৫ [Les demoiselles ont eu 25 ans] । ১৯৯৩
অ্যা হানড্রেড অ্যান্ড ওয়ান নাইট [Les Cent et une nuits de Simon Cinéma] । ১৯৯৪
দ্য ওয়ার্ল্ড অব জ্যাক দ্যুমি [L’univers de Jacques Demy] । ১৯৯৫
দ্য গ্লিনার্স অ্যান্ড আই [Les Glaneurs et la glaneuse] । ২০০০
দ্য গ্লিনার্স অ্যান্ড আই : টু ইয়ারস লেটারস [Les Glaneurs et la glaneuse… deux ans après] । ২০০২
সিনেভার্দাফটো [Cinévardaphoto] । ২০০৪
সাম উইন্ডোস অব নোয়্যাঁমুতিয়া [Quelques veuves de Noirmoutier] । ২০০৬
দ্য বিচেস অব অ্যানিয়েস [Les plages d’Agnès] । ২০০৮
ফেইসেস প্লেসেস [Visages Villages] । ২০১৭
ভার্দা বাই অ্যানিয়েস [Varda par Agnès] । ২০১৯

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here