উঁকি দিয়ে দেখছেন মৃণাল সেন, হয়তো

648
মৃণাল সেন

লিখেছেন । দেবাশীষ মজুমদার

“কুমার নদের ওপর কাঠের সেঁতু। পাশেই বাজার। বড় বড় লঞ্চ, গয়না নৌকা যাতায়াত করত। পদ্মার ইলিশ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মনে হতো চকচকে জ্যান্ত ইলিশ। সেবার ফরিদপুর গিয়েছিলাম গীতাকে নিয়ে। তার প্রথম ফরিদপুর ভ্রমণ। আগে অনেকবার সে যেতে চেয়েছিল, হয়নি। আমি ঢাকায় এসে নানা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থেকে ফিরে আসতাম কলকাতায়। ফরিদপুর গিয়ে ছবির মতো মনে পড়তে লাগল। দেখা হলো অনেক পুরনো মানুষের সঙ্গে। বেঁচে ছিলেন না অনেকেই। আমার দাদা বলেছিলেন, ফরিদপুর গিয়ে অনাথদা’র [অনাথের আচারের দোকানের প্রতিষ্ঠাতা] সঙ্গে যেন দেখা করে আসি। দেখা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথমে চিনতে পারেননি আমাকে। তারপর মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরলাম। আমার শিক্ষিকা কিরণদি’র সঙ্গে দেখা। এমন আবহ তৈরি হলো আমার মধ্যে, একদিনের ভ্রমণে আমি ভুলে যাচ্ছিলাম আমি ফরিদপুরের, নাকি কলকাতার। মানুষের জীবনে কখনো অতীত এসে এমনভাবে উপস্থিত হয়। সবকিছুকে তার প্রিয় ও আপন মনে হয় তাৎক্ষণিকভাবে। অতীতকে আমি মনে করি। কিন্তু নিজেকে দুর্দশাগ্রস্ত হতে দিই না। আমি সিনেমার মানুষ। কাতর হয়ে গেলে শিল্প ক্ষুণ্ণ হয়, এটা আমি দেখেছি। চল্লিশে যখন কলকাতায় এলাম, ফরিদপুরে যেতে খুব ইচ্ছে হতো, কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম কলকাতাকে।”

–২০১৩ সালের ১৪ই মে কলকাতার গোর্কি সদনে নাসির আল মামুনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন সদ্যপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন; আরও বলেছিলেন তার আদিনিবাস ফরিদপুরে বসবাসকালীন সময়কার কথা, পল্লীকবি জসীমউদদীনের সাথে তাদের পারিবারিক বন্ধুত্বের কথা।

ভুবন সোম

বাংলা সিনেমার প্রধান তিন শেরপা– সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃনাল– এ বিষয়টা এখন এতটাই চর্বিত চর্বন, এখন ক্ষেত্রবিশেষে খুব ক্লিশে মনে হয় এই আলোচনা। বরং যদি এদের তিনজনের মধ্যে আলাদা কী বৈশিষ্ট্য ছিল– এমন প্রশ্নে একটু নড়েচড়ে বসি, ঠিক যে উত্তরটা হুট করে মাথায় আসে, তা হলো– সত্যজিৎ সেরা তার পরিমিতিবোধের কারণে। ঋত্বিকের ছিল তুমুল আবেগ, যে আবেগ দর্শককে বাধ্য করেছে ডুবে যেতে, আর মৃণাল এদের চাইতে যে দিকটায় আলাদা– তা হলো তার নিরীক্ষার মেজাজ। তিনি কখনই কোনো বিশেষ ঘরানায় আঁটকে থাকেননি।

তার তৈরি প্রায় প্রতিটি ছবিই ছিল সমাজ-দর্পণ। দর্শককে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বারবার তাদেরই গল্পের সামনে। নির্মাণে নতুন ভাবনাকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন, আর তাই হয়তো ২০০৪ সালে কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করে চমকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আপনার নাম শ্রীজাত? আপনার একটি বই পড়ে ফোনটা করলাম। আপনি আমাকে চমকে দিয়েছেন। আসলে কী জানেন, ফর্ম নিয়ে নতুন ধরনের কাজ করলে আমার ভালো লাগে। আপনার এ বইটাতে অনেক জায়গায় ঝুঁকি নেওয়া আছে। এক্সপেরিমেন্ট আছে। নতুনত্ব আছে। আমি কবিতা খুব নিয়মিত পড়ি। কারও লেখা ভালো লাগলে জানাই আরকি। এই যেমন আপনাকে জানালাম। ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ, লেখা চালিয়ে যান।”


তার
প্রতিটা
সিনেমাই চিন্তার
প্রগাঢ় প্রতিফলন এবং
খুব সহজেই এগুলোর মাধ্যমে
তার
সমসাময়িক
চলচ্চিত্র নির্মাতাদের
[যেমন সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক]
থেকে তাকে আলাদা করে ফেলা যায়

তার প্রতিটা সিনেমাই চিন্তার প্রগাঢ় প্রতিফলন এবং খুব সহজেই এগুলোর মাধ্যমে তার সমসাময়িক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের [যেমন সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক] থেকে তাকে আলাদা করে ফেলা যায়। সত্যজিৎকে অবশ্য রাজনীতিবিমুখ বলা যেতেই পারে আর ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা যুক্তি তক্ক আর গপ্পোর আগ পর্যন্ত ঋত্বিকও এর থেকে দূরে ছিলেন। এমন বলতে চাইছি না যে রাজনৈতিক সিনেমা বানানোটাই একজন পরিচালকের মুখ্য কাজ। কিন্তু, পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ মনের মধ্যে যে দ্যোতনা তৈরি করে তা ফুটিয়ে তোলাই তো একজন শিল্পীর প্রকৃত লক্ষ্য। তার কলকাতা ট্রিলজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ [১৯৭১], কলকাতা ৭১ [১৯৭২] এবং পদাতিক [১৯৭৩]– ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন।

কলকাতা ৭১

আবার চলচ্চিত্রে কোন ছবিটা সমকালীন হবে, এই ব্যাপারে মৃণাল সেনের একটা সুস্পষ্ট চিন্তাধারা ছিল। কেবল ঘটমান সামাজিক বা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে ছবি করলেই সেটা সমকালীন ছবি হবে, এমনটা নয়। তিনি এ বিষয়ে একটা উদাহরণ টেনেছেন তার এক নিবন্ধে; লিখেছেন, ‘‘ ‘অ্যান্ড্রক্লিস্‌ ও সিংহে’র গল্প আজকের নয়, গল্পটি প্রাচীন ও অতিপরিচিত। সেই গল্পটি নিয়ে বার্নার্ড শ একটি নাটক লিখলেন। নাম Androcles and Lion। নাটকটি যখন জার্মানির কোথাও মঞ্চস্থ হয়, খুব সম্ভবত বার্লিনেই, তখন এক ডাকসাইটে রাজপুরুষ অভিনয় দেখতে দেখতে এতই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে নাটক শেষ হওয়ার আগে এক সময় তিনি হল থেকে বেরিয়ে যান। শ’ শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলেন, বলেছিলেন যাক ভদ্রলোক তাহলে আমাকে বুঝতে পেরেছেন। শাসকের নোংরা অস্বাস্থ্যকর চেহারাটা দেখানোই নাট্যকারের উদ্দেশ্য। এখানে এসেই গোটা কাহিনীটা একটা তাৎপর্য পেল। সঙ্গে সঙ্গে রাজপ্রতিনিধি নিজেকে দেখতে পেলেন শাসনযন্ত্রের রূপটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সে মঞ্চে এতগুলো লোকের সামনে তাকে বিদ্রূপ করতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত ভয়ে রাগে ও লজ্জায় ভদ্রলোক পালিয়ে বাঁচলেন এবং এ যুগের নাট্যকার শ’ আশ্বস্ত হলেন। পুরানো কোনও গল্প আজকের মানুষকে আজকের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে, আজকের কথা ভাবিয়ে তুলতে পারে, আজকের বাস্তবজীবনের সঙ্গে একটা যোগসূত্র খুঁজে বার করে দিতে পারে, তবে সেটা হবে সমকালীন।’’ অথচ, তিনিই আবার এক সাক্ষাৎকারে পথের পাঁচালী সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ ছবি বলে ভাবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “নাহ্‌, সত্যজিৎ-এর শ্রেষ্ঠ ছবি আমার মতে, অপরাজিত— এটা এমন একটা ছবি, যা প্রমাণ করে সমকালিনতা মোটেও সেই পিরিয়ডের উপর নির্ভর করে না, বরং এটিচ্যুডের উপর নির্ভর করে।”

এই যে আজকের দিনে কম বাজেটের সিনেমা তৈরির হিড়িক এবং অনেক বড় বাজেটের সিনেমাকেও ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে সামান্য বাজেটের সিনেমা, তা কিন্তু কেবল ইদানিং ঘটছে এমন নয়, এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। কারিগরি উন্নয়নের পাশাপাশি সিনেমা বলবার ভাষাতেও উন্নয়ন ঘটেছে, এটা সময়ের সাথে তাল মিলিয়েই  সিনেমার মূল রসায়নের পরিবর্তন আনছে। সেন এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘‘যুদ্ধোত্তর যুগে দুটি ধারা ‘নিওরিয়েলিজম’ এবং ‘নিউওয়েভ’ বিশ্বের চলচ্চিত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। নিওরিয়েলিজমের যেমন একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল যেটা যুদ্ধের পরেই ইতালিতে এসেছিল, নিউওয়েভের সে রকম সামাজিক বা রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। নিওরিয়েলিজম যেমন বিদ্রোহ, সামাজিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং একই সঙ্গে সে সিনেমার প্রথাসিদ্ধ নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সেই সময় ইতালির স্টুডিওগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত। কোনো ব্যাপারই না– এরকম ভাবনা নিয়ে স্টুডিও ছেড়ে ক্যামেরা হাতে রাস্তায় নেমে পড়লেন [ফিল্মমেকারেরা]। বসতবাড়িতে শুটিং করলেন, সিনেমা তৈরি করলেন।’’ নিউওয়েভও সেনের মতে একটা প্রতিবাদ এবং ‘‘অনেকটা দাপটের সঙ্গে যাবতীয় নিয়ম ভেঙেই এরা এগিয়ে এলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন– সিনেমাটা কারও কুক্ষিগত নয়। হতে পারে না। নিউওয়েভ পরিচালকদের মধ্যে একমাত্র ক্লুদ শাব্রল ছাড়া আর কেউই সিনেমার লোক নন, সাংবাদিক। তাই এদের কোনো মতাদর্শ ছিল না, ওরা তাই সিনেমার নিয়মগুলো ভাঙতে শুরু করলেন। এবং খুবই কম পয়সায় ছবি করতে আরম্ভ করলেন।’’ তিনি এই ধারাগুলোর যূথবদ্ধটা বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘Call it Italian Neorealism or French Newwave or Cinema of Britain. They are all labeled by the jou.’’

কথাবার্তায় মৃণাল বরাবরই চাঁছাছোলা, তার মধ্যে কোনো ভান ছিল না। সত্যজিতের সাথে তার খিটমিট লেগেই থাকত। একবার গৌতম ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাইলেন, ‘‘আচ্ছা কখনও মনে হয়েছে আপনার যে সত্যজিৎ রায় পর্যায়ের প্রতিভার সমকালীন বড় পরিচালকের কাজ সম্পর্কে আরও দয়ালু হওয়া উচিত ছিল? কোথাও অন্তত পিঠ চাপড়ানির হাত রাখা যেত!’’ উত্তরে মৃণাল বললেন, ‘‘যতদিন পর্যন্ত জানা আছে এ আমার চেয়ে উপরে উঠবে না, ততক্ষণ পিঠ চাপড়ানো যায়। যে মুহূর্তে আমি জানি, এ আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তখন আমি আর হাতটা তুলব না। বলে না, বেশি বড় হয়ে গেলে অনেক মুশকিল হয়।’’

অথচ, এই মৃণালকেই যখন আবার বলা হলো, ‘‘এখনও দেখা যাচ্ছে সত্যজিৎয়ের উপর আপনার প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে।’’ উত্তরে বললেন, ‘‘দেখুন, ওর সঙ্গে আমার নানা সময়ে বিতর্ক এক্সচেঞ্জ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এটা মানতেই হবে টোটালিটি নিয়ে সত্যজিত্‌ রায়ের ধারে কাছে কেউ নেই। ওর পাশে আমি নেহাত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছি।’’


দুর্ভিক্ষ,
দাঙ্গা, দেশভাগ
সমস্তকিছুর ভেতর
দিয়েই তাকে যেতে হয়েছে
এবং এ সমস্ত কিছুর গল্পই
তিনি তার সিনেমায়
বলতে চেয়েছেন
বিভিন্ন
সময়ে

রাজনৈতিক এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার সিনেমাতেও তাই এর প্রতিফলন ঘটেছে। জন্ম ফরিদপুরে, পড়াশোনাও ফরিদপুর কলেজে। তারপরে যান কলকাতায়। সে সময়টা বিশ্বজুড়েই একটা অস্থিরতার। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অর্থনীতির বেহাল দশা। এর আঁচ এশিয়ার দেশগুলোতেও পড়েছে। এই দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ সমস্তকিছুর ভেতর দিয়েই তাকে যেতে হয়েছে এবং এ সমস্ত কিছুর গল্পই তিনি তার সিনেমায় বলতে চেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণও তার মনে খুব প্রভাব ফেলেছিল।  ১৯৪১ এর ৭ আগস্ট [বাংলা ক্যালেন্ডারে বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৮] বিশ্বকবি দেহত্যাগ করেন। তার শেষযাত্রায় প্রচুর মানুষের ঢল নেমেছিল রাস্তায়। মৃণালও ছিলেন সেই ভিড়ে। ভিড়কে পেছনে ফেলে উনি চেয়েছিলেন আগেই শ্মশানে পৌঁছে যেতে, এগিয়ে গিয়ে শ্মশানে চলে গিয়েছিলেন। ওখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, একজন মাঝবয়সী লোক তার সন্তানের দেহ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন তার মৃত সন্তানকে দাহ করবেন বলে। সেই ভিড়ে হঠাৎই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মানুষ সামনে এগুতে চাইলে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান অনেকেই। মৃণাল হারিয়ে ফেলেন ওই মানুষটাকে। হয়তো সেই লোকটিও মারা গেছেন।

বিষয়টা তাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, আত্মজীবনী তৃতীয় ভুবন-এ তিনি লিখেছেন, “গঙ্গার ধারে এই নিমতলা ঘাটটি ক’দিন ধরেই সরকারি নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে, যাতে কবির দেহের সৎকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। পুলিশের কর্ডন ঘাটের গেটের সামনে। বাধ্য হয়েই আমি দূরে দাঁড়ালাম। আমার মতো আরও অনেকে উপায় না-দেখে দাঁড়িয়ে রইলো একটু দূরে। একটু তফাতে। কিন্তু সেই পুলিশ কর্ডনের ভেতর একটি লম্বা সুদর্শন যুবককে দেখে আমি একটু অবাকই হলাম। কতই বা বয়স হবে পঁচিশ-ছাব্বিশ। সাদা একটা ধুতি তার পরনে আর গায়ে একটা কুর্তা। বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কর্ডনের ভেতরে। সেই যুবকের দুটি হাতের ওপর সাদা কাপড়ে মোড়া একটি মৃত শিশু, যাকে শ্মশানে দাহ করতে এনেছে যুবকটি। নিশ্চয়ই সে-ই শিশুটির বাবা।কিন্তু এখানে এসে এই নিষ্ঠুর পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সে যুবকটি দ্বিধাগ্রস্ত। ও অন্য কোনও শ্মশানে গেলো না কেন!ভাবলাম আমি। যুবকটি একাই এসেছে মনে হলো। হয়তো কোনও ব্যাপার আছে যে, এই নিমতলা ঘাটেই তার শিশুটিকে দাহ করতে হবে। হয়তো মনের ভেতর কোনও ইচ্ছে, যুবকটির কোনও বিশেষ অভিমান কাজ করছে। হঠাৎ ভিড়ের ঢেউ। সবদিক দিয়ে। কাতারে কাতার মানুষ শ্মশানঘাট অতিক্রম করতে চলেছে। অসংখ্য মানুষ ছুটে আসছে শ্মশানের দিকে। পুলিশের সবরকম রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ভেঙেচুড়ে চুরমার হয়ে গেলো জনতার মিছিলে। চারদিকে বিশৃঙ্খলা। ভিড়ের চাপে মানুষের মৃত্যু। কোনোরকম বড় দুর্ঘটনা ঘটছে! কিন্তু মৃত ঐ শিশুটি! শিশুটি হারিয়ে গিয়েছে, ভিড়ের চাপে মৃতশিশুটি পদপিষ্ট হয়েছে! ঐ যুবকটি কি একমাত্র সন্তানের পিতা হয়তো, ‘হ্যাঁ’ হয়তো বা ‘না’।”

বাইশে শ্রাবণ

১৯৪৩ সাল সাধারণত পঞ্চাশের মন্বন্তর [বাংলা ১৩৫০ সালে] হিসেবে পরিচিত গুরুতর দুর্যোগের জন্য খ্যাত। এতে প্রদেশের প্রায় সাত লক্ষ পরিবারের অথবা ৩৮ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদার লক্ষণীয় অবনতি ঘটে। এর কারণ হলো, তারা তাদের যাবতীয় সম্পত্তি তথা ভূমি, লাঙল, গবাদিপশু, গহনা, বাসন-কোসন, যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং এভাবে সাড়ে তিন লক্ষ পরিবার চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষে এবং এর ফলে সৃষ্ট মহামারিতে ৩৫ থেকে ৩৮ লক্ষ লোক মারা গেছে। এ মৃত্যুর হার ছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক বেশি। প্রকৃত পক্ষে, এ উপমহাদেশের যেকোনও অংশে ১৭৭০ সালের পর যেসব দুর্ভিক্ষ আঘাত হানে, তার মধ্যে এটি ছিল চরমতম। এই দুর্বিষহ অবস্থা মাথায় রেখেই মৃণাল নির্মাণ করেন বাইশে শ্রাবণ। এটি সারাবিশ্বে খুব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এই সিনেমার সুবাদেই তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা পরিচালক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।

এই সিনেমাটা নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি। সেন্সর বোর্ড বাধ সেধেছিল সিনেমাটির নাম নিয়ে। কিন্তু মৃণাল অনড় ছিলেন। পরে অনেক কাঠখড় পুরিয়ে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে এক মাঝবয়সী ফেরিওয়ালা ও তার ষোড়শী বধূর মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের অম্লমধুর কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই বিখ্যাত সিনেমা। বাইশে শ্রাবণ এই অসমবয়সী দম্পতির বিবাহের তারিখ, কিন্তু কেন বাইশে শ্রাবণ? সেন্সর বোর্ডের আপত্তির জায়গাটা এখানেই। তারা মৃণালকে অনুরোধ করেছিলেন নাম পাল্টাবার জন্য। এ বিষয়ে মৃণাল মোটেও আপস করেননি। একজন মহাপুরুষের মৃত্যুর তারিখ বাইশে শ্রাবণ বলেই সেটা কারো বিয়ের বা অন্য কিছুর তারিখ হতে পারবে না, এমন তো কোনো কথা নেই!

বাইশে শ্রাবণ মূলত সমাজের প্রচলিত ট্যাবুকে ধাক্কা দেওয়া ছবি। তিনি এ ছবি নিয়ে আরও বলেছেন, ‘‘বাইশে শ্রাবণ-এ দেখবেন অল্প বয়সের একটি মেয়ের সঙ্গে মাঝবয়সী একজন পুরুষের বিয়ে হয়। পুরুষটি সুদর্শন নয়। মেয়েটির সঙ্গে পুরুষটির সম্পর্কের জন্য ইরোশন ঘটে সম্পর্ক, যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তখন সেটা ঘটে যুদ্ধের ভেতর, দুর্ভিক্ষের সময়। যেখানে মেয়েটা বলে, না খেয়ে থাকাটা আমার কাছে বড় কথা নয়, আমি অনেকদিন না খেয়ে থেকেছি, যেটা আমাকে ভাবায়, আমাকে পীড়িত করে, তা হলো মানুষটা এখন পালটে গেছে। আমি আমার শুভদৃষ্টির সময় ভেঙে পড়িনি; কিন্তু আজ আর সহ্য করতে পারছি না মানুষটাকে। ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়ে একটি সত্য কথা বেরিয়ে পড়লো মেয়েটির মুখে। She has been denied of a woman existence. সেটা সে পরে বুঝতে পেরেছে।’’

গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসমৃণাল সেন

গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেবার মতন মানসিকতা তার ছিল না। মার্কেজের মতন সাহিত্যিকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবার মতন দৃঢ়তা ক’জনের থাকে? বিখ্যাত সাহিত্যিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলেন মৃণাল! মার্কেজ সবসময় মনে করতেন, তার গল্পের যা গঠন, সেটিকে উপজীব্য করে সিনেমা বানানো খুব দুরূহ। তাই, অনেক প্রস্তাবেও তিনি রাজি হননি। ১৯৮২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি বোর্ডে দু’জনের পরিচয় হয়, সেটা বন্ধুত্বতে গড়াতে বেশি সময় লাগেনি। এর কিছুদিন পর হাভানাতে এক আড্ডায় মার্কেজ মৃণালকে জানান তার অটম অব দ্য পের্টিয়াক গল্পটা তিনি লিখেছিলেন ছোটদের একটা বইতে ভারতীয় একটা বাড়ির ছবি দেখে। মৃণাল তাকে জানান, এই গল্প ভারতীয় সেই ছবিটা মাথায় রেখে লেখা হলেও গল্পের সমস্তটাই লাতিন আমেরিকা নির্ভর, এটাকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটের রূপ দেওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং তিনি এ ছবি বানাবেন না।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করবার সময়ে মৃণাল সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। এরপর সমাজবাদী সংস্থা আইপিটিএ’র [ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন] সঙ্গে যুক্ত হন। পড়াশোনা শেষে প্রথমে সাংবাদিকতা ও পরবর্তীকালে একটি ওষুধ কোম্পানির বিপণনকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এরপর সিনেমার শব্দ-কৌশলী  হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। ফিল্মমেকার হিসেনে তার প্রথম সিনেমা– রাতভোর। এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমার। এই সিনেমা একদমই সাফল্য পায়নি। যদিও জানা যায়, এই রাতভোর সিনেমার আগে তিনি দুধারা [১৯৫০] নামের একটি সিনেমা পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন, কিন্তু সেটির ক্রেডিট লাইনে তার নাম যায়নি। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম মুখ্যভূমিকায় ছিলেন গীতা সোম– পরবর্তীকালে যিনি মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা সেন।

রাত-ভোর

প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার পরিচালনা করবার কথা থাকলেও পরবর্তীকালে নীল আকাশের নীচে [১৯৫৯] সিনেমাটা পরিচালনা করেন মৃণাল। এই সিনেমাটাই তাকে আপামর দর্শকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’– হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই যুগান্তকারী গানটাও এই সিনেমায় প্রথম ব্যবহৃত হয়। সিনেমায় দুটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল, যদিও মৃণাল নিজে এর ঘোরবিরোধী ছিলেন। কিন্তু হেমন্তবাবুর পরামর্শে গান দুটি সংযোজনের পরে এর জনপ্রিয়তা দেখে পরবর্তী সিনেমা বাইশে শ্রাবণ-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেই সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন।

ছবি পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রনাট্য লেখাতেও মৃণাল ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার লেখা চিত্রনাট্য অবলম্বনে কানামাছি [১৯৬১], জোড়া দিঘীর চৌধুরী পরিবার [১৯৬৬] ও কাচ কাটা হীরে [১৯৬৬] নির্মাণ করেন যথাক্রমে নির্মল মিত্র, টাস ইউনিট ও অজিত লাহিড়ী। এই ছবিগুলো বেশ সমাদৃত হয়। তার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র মোট চারটি– মুভিং পারস্পেকটিভস [১৯৬৭], ত্রিপুরা প্রসঙ্গ [১৯৮২], ক্যালকাটা মাই এলডোরাডো [১৯৮৯] ও অ্যান্ড দ্য শো গোজ অন [১৯৯৬]। বাংলা ভাষার পাশাপাশি মৃণাল সেন হিন্দি, ওড়িয়া এবং তেলেগু ভাষায়ও সিনেমা নির্মাণ করেছেন। আমার ভুবন-এর [২০০২] পরে আর কোনো সিনেমা পরিচালনা করেননি তিনি, কিন্তু সিনেমার প্রতি যে তার ভালোবাসা অটুট ছিল সবসময়, সেটা তার এই কথাতেই প্রতিফলিত হয়ে– ‘I am full of Cinema now. That is all.’।


জেনেসিস-এ
এই স্পেস-টাইমের
ব্যাপারটা আগাগোড়াই
ভেঙেছি,
ভাঙতে হয়েছে,
ভাঙতে গিয়ে মজা পেয়েছি

তাঁর জেনেসিস সিনেমাটার কথা উল্লেখ না করলে এই লেখা কিছুতেই পূর্ণতা পাবে না। এই সিনেমা সম্পর্কে তার বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি, “আমার নতুন ছবিতে জেনেসিস-এ এই স্পেস-টাইমের ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভেঙেছি, ভাঙতে হয়েছে, ভাঙতে গিয়ে মজা পেয়েছি। হয়তো খানিকটা সাহসের পরিচয় দিয়েছি। ব্যাপারটা বলি, রাজস্থানের মরুভূমির যে অঞ্চলে আমরা কাজ করেছি তা এক বিশাল পরিত্যক্ত গ্রাম। বিশাল ছড়ানো, কোনকালে জমজমাট ছিল। বর্তমানে হতশ্রী শ্মশান… সেখানে তিনটিমাত্র চরিত্রের বাস আমাদের ছবিতে। দুই পুরুষ এক নারী, একমাত্র জলাধার একটা বিশাল কুয়ো অনেক দূরে। তিনজনের বাস তিনটে ঘরে। ফারাক অনেকখানি। অথচ তিনজনেই থাকে একসঙ্গে। রান্নাঘরও দূরে। একসঙ্গে থাকে বলেই খাওয়াদাওয়াও একসঙ্গে। জলতোলা খাওয়া দাওয়া কাজ করা সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের physical compactness আনতে হবে, অথচ অসম্ভব ছড়ানো ব্যাপারটাকেও দর্শকের চোখে ধরিয়ে দিতে হবে। এই দুটোর মধ্যে একটা বিরোধ বা বৈপরীত্য পরিষ্কার physical compactness and sprawling topography এবং এই দুটোকেই ছবিতে তুলে ধরা এবং ঘটনা ও চরিত্র তিনটের মধ্যে একটা ঘনত্ব আনা আমার কাছে একটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং তা সম্ভব হয়েছে ছবি তোলা, কম্পোজিশন নেওয়া আর সম্পাদনা– এই তিনের ব্যবহারে।’’

জেনেসিস

৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, ৯৫ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগে প্রয়াত হন ভারতের প্যারালাল সিনেমার জনক হিসেবে খ্যাত এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার মৃত্যুতে আরেক মাস্টার ফিল্মমেকার শ্যাম বেনেগাল বলেছেন, “সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ভারতীয় সিনেমার তিন দিকপাল ও কিছুটা সমসাময়িক ঠিকই। কিন্তু তারা একে অন্যের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ঘরানার– আর মৃণাল’দার কাজ তো তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য!… সত্যজিৎ রায়কে যেমন সারা দুনিয়া পথের পাঁচালীর জন্য চেনে, তেমনি কেবল ভুবন সোম-এর জন্য হলেও মানুষ মৃণাল সেনকে মনে রাখবে।’’

২০১৩ সালে গৌতম ঘোষের নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারের শেষ প্রশ্ন ছিল, “আজ থেকে পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর বাদে মৃণাল সেনের কাজ কীভাবে স্মরণ করা যাবে বলে নব্বই ছোঁয়া মৃণাল সেনের মনে হয়?’’ উত্তরে মৃণাল বলেছিলেন, “জানি না। সেজন্যই মাঝে মাঝে কৌতূহল হয়, যদি উঁকি দিয়ে দেখতে পারতাম, কে কী বলছে-টলছে তখন আমার সম্পর্কে!’’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here