ব্ল্যাক মিরর–ব্যান্ডারস্ন্যাচ: মাধ্যম ছাপিয়ে ভিন্নস্তরে উত্তরণের চেষ্টা

449
black mirror bandersnatch

লিখেছেন । সায়ন্তন দত্ত

ব্ল্যাক মিরর : ব্যান্ডারস্ন্যাচ
Black Mirror: Bandersnatch
ফিল্মমেকার । ডেভিড স্লেড
স্ক্রিনরাইটার । চার্লি ব্রুকার
প্রডিউসার । রাসেল ম্যাকলিন
কাস্ট [ক্যারেক্টার] । ফিয়ন হোয়াইটহেড [স্টেফান বাটলার]; উইল পুল্টার [কলিন রিটম্যান]; অসীম চৌধুরী [মোহন ঠাকুর]; ক্রেগ পারকিনসন [পিটার বাটলার]; অ্যালিস লো [ড. হেনস]; টালুলা হ্যাডন [কিটি]
সিনেমাটোগ্রাফার । অ্যারন মর্টন; জ্যাক পোলান্সকি
ফিল্ম এডিটর । টনি কার্নস
মিউজিক স্কোর । ব্রায়ান রেইটজেল
রানিংটাইম । ৯০ মিনিট
ভাষা । ইংরেজি
দেশ । যুক্তরাজ্য
রিলিজ । ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

ব্ল্যাক মিরর : ব্যান্ডারস্ন্যাচ

সাহিত্য এবং শিল্পসংক্রান্ত পড়াশোনা যারা করেন, তারা কোনো একটি টেক্সট [টেক্সট শব্দের কষ্টকর বাংলা হয় ‘পাঠ’। কিন্তু, সাহিত্য কিংবা শিল্প তত্ত্বে ইংরেজি ‘টেক্সট’ শব্দের যে তাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং অর্থগত দ্যোতনা, বাংলায় ‘পাঠ’ অর্থে ঠিক তাকেই বোঝায় না। তাই আমরা ইংরেজি শব্দটিই ব্যবহার করব।] পড়ার সময় শুধুমাত্র টেক্সটটুকুই নয়, বরং বিভিন্ন মাধ্যমে নির্মিত সেই টেক্সট কীভাবে পাঠকের কাছে গৃহীত হচ্ছে, সেই গৃহীত হওয়ার পর্বটিকেও পড়েন। অর্থাৎ একটি টেক্সট শুধু ছিন্ন সময়ের ছিন্ন কোনো আখ্যানই নয়, কেবল রূপগত মাহাত্ম কিংবা ব্যর্থতা নয়; বরং সময়ের নির্মাণ এবং পাঠক/দর্শক/শ্রোতা– সকলের মিলিত পরিগ্রহণ [রিসেপশন] সেই টেক্সটটের শরীর হিসেবে সাহিত্য-শিল্প তত্ত্বে বিবেচিত হয়। তাই ক্লাসরুমে আমরা বলি, পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী আসলে পঞ্চাশটি আলাদা আলাদা টেক্সট পড়ছেন এবং আলাদা আলাদা টেক্সট পরিগ্রহণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। একই বই থেকে পঠন এবং আলোচনা চললেও, জমজ ভাইবোনের সুক্ষ্ম পার্থক্যের মতন আসলে তৈরি হচ্ছে নানা মুখ, নানা পথ, নানা ছবি। এক থেকে জন্ম নিচ্ছে বহু।

কিন্তু পরিগ্রহণের ভিন্নতা থাকলেও এ সমস্ত আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে আমরা ধরেই নিই, টেক্সট জিনিসটা আদতে স্থির। পঠনের আওতার এই টেক্সট হতে পারে যা কিছু, হতে পারে কোনো নাটক, থিয়েটার, ছবি, চলচ্চিত্র, গল্প, কবিতা– যাই হোক না কেন, আমরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট কাঠামো এবং রূপের স্থিরতায় আসলে টেক্সট নিয়ে আলোচনা করি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কখনও বদলে যায় যন্ত্র, বদলে যান শিল্পী, তাতে টেক্সটের অনেকখানি বদল ঘটলেও মূলগতভাবে বিষয়টি একই থাকে; কথা এবং সুরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থিরতা থাকেই। কিন্তু পরিগ্রহণের বিভিন্নতা এবং তার উৎস টেক্সটের স্থিরতা– এই আপাত অমোঘ সত্য দুটো বিষয়কেই যদি উল্টেপাল্টে দেওয়া হয়, যদি লালনের গান কিংবা ইলিয়াসের উপন্যাসের মতো নিজের সময়ে আপাত স্থির কোনো টেক্সটটের অস্তিত্বই না থাকে, যদি সময়ে বিস্তার লাভ করতে করতে কোনো টেক্সট বিভিন্ন পথ, বিভিন্ন সত্তা, বিভিন্ন বাস্তবের স্তরে স্তরে বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং যার ফলে টেক্সটের স্থিতাবস্থার মূল তাত্ত্বিক কাঠামোটিই নড়ে যায়? তবে কী হবে? পাঠ এবং তত্ত্বের আপাত একাডেমিক স্থিতাবস্থার সমস্যার ফলে কি আমাদের পঠন এবং তাত্ত্বিক চর্চাই একরকম ব্যহত হবে, না-কি পাঠ এবং তত্ত্বের নিজস্ব দুনিয়া এর ফলে নতুন ভাবে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে?

ব্ল্যাক মিরর : ব্যান্ডারস্ন্যাচ

প্রশ্নগুলো টেক্সটের উৎসেই ভেঙে যাওয়ার মতো বহুস্তরীয় এবং বহুসম্ভাবনাময়। উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি; কারণ সদ্য একদিনমাত্র হলো, বিশ্বজুড়ে নেটফ্লিক্স অনলাইন প্লাটফর্মে রিলিজ পেয়েছে ব্রিটিশ সায়েন্স ফিকশন সিরিজ ব্ল্যাক মিরর-এর নবতম সংযোজন– ব্যান্ডারস্ন্যাচ। এবং আপাত জনপ্রিয় মোড়ক এবং বিনোদনের মাত্রার আড়ালে সাহিত্য এবং শিল্পসংক্রান্ত বহুস্তরীয় এই প্রশ্নগুলো ব্ল্যাক মিরর তুলে ফেলেছে, যেমন তারা বিগত চার সিজন ধরেই করে এসেছে। আপাত থ্রিলারের কাঠামোয় ফেলা এই গল্পের যথাসম্ভব স্পয়লার ছাড়া সংক্ষিপ্তসার আমরা দেওয়ার চেষ্টা করব, এবং সার্থক শিল্পের যেমন হয়, যা দেখছি সেটুকুই নয়, যা শুনছি সেটুকুই নয়, বরং দেখা এবং শোনার অতীত কোনো পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, এখানেও তেমনই গল্প কিছুই নয়, বরং গল্প পেরিয়ে মনস্তত্ত্ব এবং দর্শনের স্তরে কীভাবে এই কাহিনি নিয়ে যেতে পারে, তাও আমরা খানিক বোঝার চেষ্টা করব। সঙ্গে থাকবে টেক্সট সংক্রান্ত এই প্রাথমিক স্তরের জিজ্ঞাস্য গুলো।

ব্রেকফাস্টের খাওয়া
কিংবা মিউজিক প্লেয়ারে
গান শোনার মতো আপাত
তুচ্ছ ব্যপারে মজা লাগতে শুরু
করা দর্শক যখন প্রথম সিরিয়াস
প্রশ্নটিও মজার ছলে দিতে
থাকে, তখনই, একটি
প্রশ্নের ‘হ্যাঁ’ এবং
‘না’-এর জন্য
দুটি ভিন্ন
কাহিনি
অপেক্ষা করে থাকে

স্টেফান বাটলার, ১৯৮৪ সালের ইংল্যান্ডের এক যুবক তার মায়ের বইয়ের সংগ্রহ থেকে ব্যান্ডারস্ন্যাচ নামের এক বই খুঁজে পায়, যার বিশষত্ব হলো, আমাদের দেখতে থাকা কাহিনির মতোই তার কোনো নিজস্ব শেষ নেই; পাঠক পড়তে পড়তে চরিত্রকে যে পথে চালনা করবেন, সেই পথে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে কাহিনি এগোবে। যদিও ব্যান্ডারস্ন্যাচকে আমরা আপাত অর্থে ছবি কিংবা চলচ্চিত্র বলতে পারি না, তাও, শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমারা বুঝে যাই– কী হচ্ছে; কাহিনি নিজেই মেটান্যারেটিভ নির্মাণ করতে শুরু করেছে, নিজের সম্পর্কে নিজেই কথা বলছে। স্টেফান ব্যান্ডারস্ন্যাচ নামের উপন্যাস থেকে বিংশ শতকের প্রাথমিক স্তরের ভিডিও গেমিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি গেম নির্মাণ করতে চায়। সেই গেমটি, বলা বাহুল্য, উপন্যাসটির [এবং আমাদের দেখা এপিসোডের ] মতোই প্লেয়ার নিয়ন্ত্রিত। এখানে বলে রাখা দরকার, ভিডিও গেম এখনও পর্যন্ত আমাদের দেখা একমাত্র মাধ্যম, যেখানে যিনি বা যারা খেলছেন, তাদের স্বয়ংক্রিয় উপস্থিতি এবং নির্দেশের ফলেই নিজের পথ পায়। শুরুর মিনিট পনেরোর মধ্যে এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্তরের সম্ভাবনাকে একসাথে নিয়ে এসে ব্যান্ডারস্ন্যাচ দর্শককে স্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন করার পর [যেমন : ব্রেকফাস্টে কী খাবে, কী গান শুনবে] নিয়ে ফেলে আসল জায়গায়, যেখানে কাহিনির মূল মোচড় নির্ভর করে দর্শকের কমান্ডের ওপর। ব্রেকফাস্টের খাওয়া কিংবা মিউজিক প্লেয়ারে গান শোনার মতো আপাত তুচ্ছ ব্যপারে মজা লাগতে শুরু করা দর্শক যখন প্রথম সিরিয়াস প্রশ্নটিও মজার ছলে দিতে থাকে, তখনই, একটি প্রশ্নের ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর জন্য দুটি ভিন্ন কাহিনি অপেক্ষা করে থাকে। এই ভিন্ন ভিন্ন শেষের মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনে ভিন্ন ভিন্ন পথে গল্প এগোতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে উনিশ বছরের যুবকের গেম তৈরি করা নিয়ে আপাত সরল গল্প বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে বিস্তার লাভ করতে থাকে। একটি সম্ভাব্য শেষের পরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকে আবার শুরুতে, যেখান থেকে দ্রুত এগিয়ে এসে আবার আরেকটি সম্ভাবনা আমাদের সামনে রাখা হয়।

ব্ল্যাক মিরর : ব্যান্ডারস্ন্যাচ

ব্যান্ডারস্ন্যাচ আধা-ভিডিও গেম আধা-চলচ্চিত্র মেশানো বিশ্বের প্রথম কোনো কাজ যা আমাদের তার মাধ্যমের সম্ভাবনায় অভাবনীয় অর্থে উত্তেজিত করে নানান দিক থেকে; গল্প কিংবা থ্রিলারের সমাপ্তি থেকেও আমাদের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি না, পরীক্ষামূলক এই বহুস্তরীয় অনেক আখ্যানের সমষ্টিকে কীভাবে গ্রহণ করব।

প্রথমত, ব্যান্ডারস্ন্যাচ শুরু থেকেই নিজের সম্পর্কে কথা বলে চলে। আধুনিকতাবাদের সময় থেকে চলে আসা সেলফ রিফ্লেক্সিভিটি এবং মেটান্যারেটিভের ধারণা– অর্থাৎ শিল্পকর্মের নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়ে সচেতন হওয়া এবং গল্পের মধ্যে গল্প, তার মধ্যে গল্প– এইভাবে প্রতিটি গল্পের আসলে নিজ অস্তিত্বের দিকে আঙুল তুলে দেওয়া– শিল্পের এই ডিভাইসগুলি আমাদের অপরিচিত নয়। কিন্তু ব্যান্ডারস্ন্যাচ-এর অবিশ্বাস্য সফলতা এখানে– এটি শুধু কাহিনিতেই নয়, বরং তার রূপায়নের বিষয়ই করে ফেলে এই বহুটেক্সট ও বহু সম্ভাবনার উপস্থিতিকে। অর্থাৎ এপিসোডটির বিষয় হয়ে উঠেছে– কীভাবে মনস্তত্ত্বগতভাবে বাস্তবের বিভিন্ন সম্ভাবনাকে গ্রহণ করা আমাদের বিভিন্ন বাস্তবের দিকে ঠেলে দিতে পারে। মেটান্যারেটিভের শেষ পর্যায়ে বসে একজন দর্শক যা করছেন, অর্থাৎ, বিভিন্ন চয়েস বেছে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে এগিয়ে চলেছেন– সেইটিই গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। আমাদের নায়ক স্টেফান বিভিন্ন রিয়েলিটির মধ্যে দিয়ে যায়, তাই এক চয়েস [এবং রিয়েলিটিতে] যদি তার বাবা মৃত হয়, আরেক চয়েস [এবং রিয়েলিটিতে] তার বাবা ফিরে আসে; একটি সম্ভাব্য শেষ দেখার পরে আরেকটি সম্ভাবতার দিকে আমরা এগিয়ে যাই– কাহিনির চরিত্র হয়ে ওঠে দর্শকই।

ব্ল্যাক মিরর : ব্যান্ডারস্ন্যাচ

শিরদাঁড়া
দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত
বয়ে যায় আমাদের,
যদি আমরা এই আপাত
নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রক-নিয়ন্ত্রণের
দ্বন্দ্বকে ইতিহাসের চোখ দিয়ে দেখি

এই ভিন্ন ভিন্ন স্তরে এবং বাস্তবের মাত্রায় কাহিনিকে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে স্বভাবতই দর্শক-মনে প্রশ্ন জাগে, আসলে কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করছে– দর্শক চরিত্রকে, না-কি চরিত্র [এবং নির্মাতা] দর্শককে? এই প্রসঙ্গেও ব্যান্ডারস্ন্যাচ এক বাজি জিতে নেয়; কারণ সে স্বয়ং তার চরিত্রকে দিয়ে এই একই প্রশ্ন করায়। স্টেফান তার অফিসের বসের কাছে নিজের গেম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে বসে, প্লেয়ারকে এই ইলিউশন দেওয়া তার উদ্দেশ্য, যে গেমের চরিত্রকে আসলে প্লেয়ার নিয়ন্ত্রণ করছে; কিন্তু আসল নিয়ন্ত্রক সেই, নির্মাতা, যে আসলে সম্ভাব্য সকলরকম সমাপ্তিকে আগে থেকেই সাজিয়ে  রেখেছে। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় আমাদের, যদি আমরা এই আপাত নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রক-নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বকে ইতিহাসের চোখ দিয়ে দেখি। নোয়াম চমস্কি যখন আমেরিকার বিশ্বজোড়া গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কনেসেন্ট’র কথা, যেখানে গণতন্ত্রের কাঠামো আসলে বিতর্কের মূল বিষয়টিকেই আগে থেকে বেছে নিয়েছে– বহুচর্চিত ফ্রি স্পিচ আসলে ইলিউশন-মাত্র; কারণ টিভিতে তর্ক করা দুপক্ষীয় বক্তা আসলে তর্ক করছেন অমুক দেশে মার্কিন সেনার কতটা নিষ্ঠুরতা সঠিক, তা-ই নিয়ে। অন্য দেশে আমেরিকার সৈন্য থাকবেই বা কেন– এই মূলগত প্রশ্নটি গণতন্ত্রের মুক্তকন্ঠের মুক্তিচর্চার আওতা থেকে বেরিয়ে গেছে; আসলে তর্ক চলছে কম হিংস্রতা কিংবা খুন করার তুলনামূলক কম খারাপ পদ্ধতি নিয়ে। খুন যে করতেই হবে– এ বিষয়ে সকলে নিশ্চিত। তাই দর্শক কিংবা প্লেয়ারদের আপাত নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি এবং বৃহত্তর অর্থে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকার এই দান্দ্বিক বিন্যাসটি আমাদের সামনে এই আধা-চলচ্চিত্র আধা-ভিডিও গেম মাধ্যমটি খুলে দেয়। দর্শক চয়েস করেন ঠিকই, কিন্তু তার সম্ভাব্য সব ক’টি চয়েস আসলে আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে।

ব্ল্যাক মিরর : ব্যান্ডারস্ন্যাচ

গল্পের ভেতর গল্প, মাধ্যমকেই গল্পের বিষয় করে তোলা, একের পর এক সম্ভাব্য শেষের দরজা খুলে দেওয়া– এর মধ্যেই আমাদের প্রথম প্রশ্ন লুকিয়ে আছে– টেক্সট আসলে কী? ব্যান্ডারস্ন্যাচ-এর এই অভাবনীয় পরীক্ষা তবে কী ‘সিনেমা’ মাধ্যমের কোনো নতুন দরজা খুলে দিলো– যেখানে দর্শক সরাসরি কোনো টেক্সটের বিনির্মাণে অংশগ্রহণ করতে পারবেন? কিংবা, আমরা কি আদৌ বিনির্মাণ শব্দটিই আর ব্যবহার করতে পারব– যদি টেক্সট নামক কোনো একক, অপরিবর্তনীয় বস্তুর নির্মাণই না হয়ে থাকে? বস্তুত এই পদ্ধতিতে বিপ্লবাত্মক বিষয়টি এটাই, টেক্সটের যে ক্ষমতাবান অবস্থানকে আধুনিকতা-উত্তর তাত্ত্বিক-দার্শনিকেরা প্রশ্ন করে আসছিলেন, তারই আরও এক ধাপ অগ্রসরণ। রোলা বার্থ কিংবা মিশেল ফুকো যখন অথরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, যখন ক্ষমতার অবস্থান থেকে দার্শনিকভাবে অথরকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যখন ‘ন্যারেটর’ ও ‘অথর’– এই দুই সত্ত্বাকে আলাদা করা হয়– আমরা বুঝতে পারি শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে; কেন্দ্র থেকে ক্ষমতা এবং শিল্প-আলোচনার ক্ষেত্র বহুস্তরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দার্শনিক বা তাত্ত্বিক স্তরে এই বিষয়টি চলতে থাকলেও, ভিডিও গেম ছাড়া এখনও পর্যন্ত কোনো টেক্সটের জন্মক্ষণেই দর্শকের উপস্থিতি এভাবে জরুরি হয়ে নেই, যে দর্শকের চয়েস ছাড়া সেই চলচ্চিত্র/কবিতা/ছবি এগোবেই না। তাই টেক্সটের নির্মাণকেই অস্বীকার করে ফেলার এই স্পর্ধার প্রশংসা ব্ল্যাক মিরর টিভি সিরিজের অবশ্যপ্রাপ্য।

তবে, সব শেষে প্রশ্ন থেকেই যায়, এত কিছু করে মূল শিল্পবস্তুর অবস্থাটা কী হলো? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ব্ল্যাক মিরর তার চারটি আলাদা আলাদা সিজন জুড়ে যত এপিসোড করেছে, এবারের ক্ষেত্রে শৈল্পিক গুণমানের জায়গাটা মাধ্যমের অভিনবত্বের ফাঁকে পড়ে একটু হলেও যেন নড়ে গেছে। গল্পের নিঁখুত বুনন, থ্রিলারের চলন, চলচ্চিত্রীয় ক্যামেরা এবং শব্দের ব্যবহার, দার্শনিক বহুস্তরীর মাত্রাবিশিষ্ট্য ভাবনার যে অতুলনীয় অনুভব ব্ল্যাক মিরর-এর অন্যান্য অনেক এপিসোড রাখতে পেরেছে, ধারে ভারে ব্যান্ডারস্ন্যাচ এখনও অনেকটাই কম। তৃতীয় সিজনের হেটেড ইন দ্য নেশন কিংবা মেন এগেইন্সট ফায়ার অথবা চতুর্থ সিজনের ক্রোকোডাইল-এর মতো শৈল্পিক গুণসম্পন্ন এপিসোডের কাছে গতকালের ব্যান্ডারস্ন্যাচ কতটা সার্থক– এই প্রশ্ন থেকেই যায়। বুঝতে অসুবিধে হয় না, মাধ্যমের অভিনবত্ব গল্পের বিষয় হিসেবে ব্যবহার করে যে শৈল্পিক চমক নির্মাতারা রাখতে পেরেছেন, সেখানে মূল কাহিনির বিন্যাস খানিকটা হয়তো প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তবে মাধ্যম– ন্যারেটিভ– গল্পসংক্রান্ত নতুন আলোচনার দিগন্ত খুলে দেওয়া কাজের সামনে এসে এইটুকু দোষ মাফ করে দেওয়াই যায়। পরীক্ষা করতে গেলে সামান্য পা হড়কানোর আশঙ্কা থেকেই যায়; তবে সেটুকু ভয়কে জয় করতে না পারলে তো অভিধান থেক আবিষ্কার শব্দটাই অচল হয়ে যেত।

ব্ল্যাক মিরর : ব্যান্ডারস্ন্যাচ

তাই ভবিষ্যতের চলচ্চিত্র একটি টেক্সট হয়ে ডানা মেলবে, না-কি বহু সম্ভাব্য গল্পে বিভাজিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন দর্শকের কাছে শুধু পরিগ্রহণই নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন টেক্সট হয়ে উঠবে– তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে নির্দিষ্ট দর্শকের নির্দিষ্ট রুচি, মনস্তত্ত্ব এবং শিল্পচর্চা স্বয়ং শিল্পের বিষয় এবং বিশ্লেষণ হয়ে উঠতে পারে কি-না। ব্যান্ডারস্ন্যাচ একটি সার্থক সম্ভাবনাকে যে উসকে দিয়েছেই– কোনো সন্দেহ নেই।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here