রাসেল আহমেদ সেই জাদুনগরের ‘ফিল্ম স্কুল’ যেথা প্রাণ বাজি রাখা বোধেরা জন্মায়

1296

লিখেছেন ঈয়ন


 

সৃষ্টিশীল আত্মা’রা খসে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে, জীবন থেকে; সভ্যতা থেকে তাদের প্রাপ্য বুঝে নেবার আগেই। অন্তরালে অন্তরীণে হয়তো এমনটাই হয়, এমনটাই হবে; আত্মা যদি অবিনশ্বর হয়। আমরা জানি ঈয়ন, দৃশ্যমান ছেড়ে চলে যাওয়া আত্মারাজি আসলে আমাদের থেকে কখনোই দূরে চলে যায় না। তাদের না বলা কথাগুলো বলে যায় অবিরত, বাতাসের ফিসফিসানিতে, বৃষ্টির কান্নায়, দুঃসহ দমকে। আমাদের দায়বোধকে স্মরণ করিয়ে দিতে; স্মরণ করিয়ে দিতে, প্রতি মুহুর্তে।— প্রায় আট বছর আগের এক সকালে এই কথাগুলো বলছিলেন রাসেল ভাই, মানে প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। আরো বলেছিলেন, স্যালুট জানাই– এসব অমূল্য আত্মাদের, যারা তথাকথিত বাস্তব জীবনকে সরাসরি উপেক্ষা করে এসেছেন– কাজ আর দায়বোধের প্রেরণায়। আমাদের মনে রাখতে হবে– তাদের না বলা কথাগুলো, না করা কাজগুলোর প্রতি আমাদেরও দায়, নেহাৎ কম নয়।

মূলত আমাদের দুজনের পুরানো সহযোদ্ধা সাংবাদিক এসএম সোহাগের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালীর প্রতিষ্ঠাতা এবং অসমাপ্ত চলচ্চিত্র নৃ-এর স্রষ্টা এই রাসেল। নিজের প্রথম চলচ্চিত্র সম্পর্কে এই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা বলতেন, নৃ শুধু চলচ্চিত্র নয়, এটি একটি আন্দোলন। নিজের জীবন দিয়েই তিনি এ কথার প্রমাণ দিয়ে গেলেন। বাংলাদেশি স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের এই মহান যোদ্ধার মৃত্যু আমায় স্মরণ করিয়ে দেয় শ্রদ্ধেয় জহির রায়হান, আলমগীর কবির বা তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের অকাল প্রস্থান। যদিও নিখাদ চলচ্চিত্রের প্রেমে বা চাপে নিহত নির্মাতার সংখ্যা এ দেশ বা দুনিয়ায় কয়জন– তা আমার জানা নেই।

rasel ahmed
রাসেল আহমেদ । প্রোর্টেট : আল নোমান

গত বছর বাবার মস্তিস্কে আঘাত পাওয়ার খবরটা সম্ভবত সহযোদ্ধা চিত্রগ্রাহক ড্যানিয়েল ড্যানির কাছ থেকে শুনেছিলেন রাসেল ভাই, মানে প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেল আহমেদ। আমার অসহায়ত্বটা তার চেয়ে আর কেই-বা ভালো বুঝেছিল তখন। অথচ ভাইয়ার ক্রমবর্ধমান দেনার চাপের কথা মাথায় থাকায় তাকে কিছুই জানাতে চাইনি; তিনিও কিছু জানতে চাননি। ইতিপূর্বে বহুবার মুখ ফুটে বলার আগেই সমস্যা বুঝে নিয়ে যেভাবে সমাধান করেছেন, এবারও তা’ই করলেন। ‘বিকাশ’ অ্যাকাউন্টে দুই হাজার টাকা পাঠানোর পরও তার জিজ্ঞাসা ছিল শুধু– “পাইছিস?”, এটুকুই। তখনও ভেতরবাক্স খুলে দেখিনি। তবে কথাযন্ত্রে তার ‘কল’ আসার সামান্য আগে একটি বার্তা আসার সংকেত পেয়েছিলাম। তাই আন্দাজ করেই বললাম, “ভাই পাইছি মনে হয়। তা’ও দেইখা জানাইতেছি।” সেদিন আসলে আরো টাকা যোগাড় করার তাড়ায় পরেও আর খুব বেশি কথা হয়নি তার সাথে। মূলত বাবার অসুস্থতার সংবাদে অস্থির ছিলাম।

…তখনও বুঝিনি– নিয়মিত
লাশ বহন, দাফন আর
কুলখানি আয়োজনের
বয়সে পৌঁছে গেছি
আসলে…

এরপরও অবশ্য একবার কথা হয়েছে আমাদের, মানে আমার আর রাসেল ভাইয়ের। সে গল্পে একটু পরে আসছি। বলছি ২০১৭ সালের এপ্রিলের কথা। মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির মুখ্য সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন এবং এক পরমাত্মীয়ের কাছ থেকে আরও বেশ কিছু টাকা যোগাড় করে ১৩ এপ্রিল সকালে বরিশালে পৌঁছাই। এরপর কয়েকটা দিন সব কর্ম-চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু বাবাকে সময় দেই। সারাক্ষণ তার সাথে কাটাই। তার মুখ থেকে এমন সব পারিবারিক গল্প শুনি, যা আগে কখনো শোনা হয়নি। এরই মাঝে ১৭ এপ্রিল প্রয়াত দাদী সৈয়দুন্নেছা বেগমের ছোটবোন হাফিজা বেগম লালন দেহত্যাগ করেন। তারা ছিলেন ঝালকাঠীর বারৈয়ারা গ্রামের রাজনীতিবিদ মীর মমতাজ উদ্দিন এবং তার ধর্মভীরু পত্নী সৈয়দা হাকিমুন্নেছা বেগমের কন্যা। লালন দাদুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যাদের কোনো সন্তানই আর দুনিয়ায় রইলেন না। বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এড়াতে এই সংবাদ তার কাছে চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যে কারণে পারিবারিকভাবে বাবার অনেক দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়। এমন সব দায়িত্ব, যা পালনের কথা আগে কখনো ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি। তখনও বুঝিনি– নিয়মিত লাশ বহন, দাফন আর কুলখানি আয়োজনের বয়সে পৌঁছে গেছি আসলে। বাবা কিছুটা সুস্থ বোধ করায় ২১ এপ্রিল রাতে ঢাকা ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। প্রচণ্ড ঝড়ের সেই রাতে বাসার কেউই যেতে দিতে চায়নি। কিন্তু কেন জানি কারো কথা শুনলাম না!

রাত এগারোটায় নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে রওনা করা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসটি দৌলতিয়া ফেরি ঘাটে পৌঁছায় ঠিক আড়াইটায়। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফেরি চলাচল কয়েক দফা বন্ধ থাকায় ঘাটে তখন বিশাল জট। চারটা পাঁচ নাগাদ বাসটি ফেরিতে পৌঁছায়। সাকুরা পরিবহনের বাস, ঢাকা-বরিশাল রুটে ‘রাফ’ ড্রাইভিংয়ের জন্য যারা কুখ্যাতির শীর্ষে। পদ্মা তখনও উত্তাল। ঢেউয়ের তালে তালে সামনে-পিছনে আসছে বাসগুলো, দুলছে পুরো ফেরি। মৃদু ঘুমের ঘোরে আমাদের বাসের সব যাত্রীও তখন দুলছে। এমন সময়ে গল্পের নায়ক হিসেবে আবির্ভাব আলী হায়দারের। আমাদের চালকের সহকারীই শুরু করেন তার উপাখ্যান। একই কোম্পানির এই চালকের সাথে তিনি চারটি ‘ট্রিপ’ মেরেছেন, চার দফা ঢাকা-বরিশাল আসা-যাওয়ায় তার সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তার মতে, হায়দার মোটামুটি ‘সুপারহিরো কোয়ালিটির ড্রাইভার’। তার বাসকে অন্য কোনো গাড়ি ওভারটেক করতে পারে না। বরং তার বাসই সামনের সবাইকে ছাড়িয়ে সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছায়। সহকারীর সাথে চালকও যোগ করেন, “হায়দার যে গাড়িডা চালায়, হেইডাও অনেক ভালো। আমিও ওইডা লইয়া দুইডা ট্রিপ মারছি। তহন আমারেও কেউ ওভারটেক করতে পারে নাই।” আমার সিট নম্বর ছিল ‘বি-টু’, ড্রাইভারের থেকে বড়জোর চার ফিট দূরত্বে। তাই বেশ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল এই আলাপ। আর আমিও কেন জানি অযাচিত কৌতূহল নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনছিলাম।

পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি থেকে নামার পর আমাদের ড্রাইভারের ওপর সম্ভবত আলী হায়দারের ভূত সাওয়ার হয়। একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করে তিনি যখন এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন একদম সামনের সিটে বসা এক যাত্রী বলেন, “ভাই, সবাই আলী হায়দার হতে চাইলে কিন্তু যাত্রীদের খবর আছে!” এর খানিকবাদই মোড় ঘোরার সময় একটা ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে করে বিপরীত দিক থেকে আসা দুটি ট্রাকের সামনে পরে বাসটি। দূর্ঘটনার আগে আমার কানে হেলপারের শেষ যে কথাটি ভেসে আসে, তা হচ্ছে– “ওস্তাদ, দুইডা”! পরম দক্ষতায় মুহুর্তের মধ্যে ব্রেক কষে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করেন ড্রাইভার। উল্টে গিয়ে ডিগবাজি খায় বাসটি। চিরচির শব্দে ভেঙে যায় বাসের সামনের আর একপাশের সবগুলো জানালার কাঁচ। পাঁচ-সাত সেকেন্ডের মাথায় বাসটিকে সজোরে ধাক্কা মারে সামনের ট্রাকটি। ততক্ষণে বাসের মধ্যে আতঙ্কে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। বিশ সেকেন্ডের মধ্যে সব স্থির হয়ে যায়। তারও বেশ কিছুক্ষণ পর সবাই বুঝতে পারে– বাসটি মহাসড়কের ওপরেই আছে; পাশের খাদে পরে যায়নি। ড্রাইভার-হেলপার ততক্ষণে হাওয়া। যাত্রীরা একজন আরেকজনের গায়ের ওপরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। আতঙ্কে চিৎকার করছেন অনেকে। কেউ কেউ কথাযন্ত্রে থাকা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সিটের নিচে আটকে যাওয়া সহযাত্রীকে উদ্ধার করছেন। কেউ বিলাপ করতে করতে নিজের ব্যাগ খুঁজছেন। চল্লিশ সেকেন্ডের মাথায় বাসের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয় কেউ একজন।

…জীবনে প্রথমবারের মতো
মহাসড়কে দূর্ঘটনা কবলিত
হওয়ার অভিজ্ঞতা দেয়া সেই
২২ এপ্রিল সকালের কথোপকথনই
যে আমাদের জীবনের শেষ
বাতচিৎ হবে– তা মহাপ্রকৃতি
তখনও নিশ্চয় জানতেন…

রাস্তার দু’পাশে ততক্ষণে জ্যাম তৈরি হয়ে গেছে। বেশ কয়েকজন উদ্ধারকারী এসে যাত্রীদের দ্রুত বেড়িয়ে আসতে বলছেন। অবশেষে বের হয়ে উল্টে থাকা বাস থেকে অন্যান্যদের বের হওয়ার ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-এ আপলোড করে লিখি– “বহু কাজ বাকি/ তাই বেঁচে থাকি”। দূর্ঘটনাস্থল থেকে মিরপুরে বাসায় ফেরার আগেই কথাযন্ত্রে ফের রাসেল ভাইয়ের ডাক। কণ্ঠ শুনে বুঝলাম, তিনি ঘুম থেকে উঠেই আমার ছবি দেখে বেশ উদ্বিগ্ন। জানালাম, তেমন কিছু হয়নি। তবুও তিনি ঠিক আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলো না। জীবনে প্রথমবারের মতো মহাসড়কে দূর্ঘটনা কবলিত হওয়ার অভিজ্ঞতা দেয়া সেই ২২ এপ্রিল সকালের কথোপকথনই যে আমাদের জীবনের শেষ বাতচিৎ হবে– তা মহাপ্রকৃতি তখনও নিশ্চয় জানতেন। ভাইয়ার শেষ কথা ছিল– আইয়া পড়িস, আইয়া পড়িস, আইয়া পড়িস। বাড্ডা এলাকায় ভাড়া নেয়া নতুন বাসায় দাওয়াত দিতে গিয়ে তিনি এভাবেই বলেছিলেন। জবাবে আমি শুধু বলেছিলাম– “হ, ভাই”! এরপর গিয়েছিলামও সেই বাসায়। যার প্রতিটি কক্ষ ও সামগ্রীতে ছিল রাসেল ভাইয়ের সৌরভ। আহা, নিখাদ মানুষের গন্ধ।

rasel ahmed
প্রসঙ্গ : নৃ ।। টিভি অনষ্ঠানে উপস্থাপিকা, অভিনেত্রী তাসনোভা তামান্না ও ফিল্মমেকার রাসেল আহমেদ; ২১ জুলাই ২০১৫

বাস দূর্ঘটনার ঠিক আট দিনের মাথায় পহেলা মে রাতে আরো এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। সেদিনও ঝড়ের রাত, সন্ধ্যা থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময়ে ঢাকার জলাবদ্ধ রাজসড়কের খোলা ম্যানহোলে ডুব দিয়ে উঠে জানলাম, কিছুদিন আগে একই গর্তে এক শিশু নিখোঁজ হয়েছে। পরে যার লাশও পাওয়া যায়নি। সেদিন আবার বাবাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছেন ছোট চাচা। তাকে ঢাকাই ডাক্তার দেখানোর সব বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল। অথচ জলে ভিজে আমার মুঠোফোন তখন বন্ধ। পোশাকে তীব্র দূর্গন্ধযুক্ত ময়লা। বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, মহাফাঁড়া যাচ্ছে আসলে। না জানি নিকট ভবিষ্যতে আরো কত কি দেখতে হয়। পরক্ষণে নিজেই নিজেকে সাহস দিতে বলেছিলাম, যা হবে সামলে নেয়া যাবে। অথচ শঙ্কা সত্য করে মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় যখন আরেক ঝড়ের রাত আমার মুখোমুখি, কোনোভাবেই নিজেকে সামলে নিতে পারিনি।

…রাস্তায় ঝাঁকুনিতে
কফিনটা
আচমকা নড়ে উঠলেও ভাবছিলাম,
ভাই
জেগে উঠলেন নাকি…

তামাম চিন্তা-ভাবনার ভিত কাঁপিয়ে দেয়া ২০১৭ সালের সেই ১৫ মে রাতে খুব চেষ্টা করেও কোনোভাবেই শক্ত রাখতে পারিনি নিজেকে। বারবার ভেঙে পড়ছিলাম, আদতে তখন ভাঙছিল অজস্র যৌথস্বপ্ন, আশা-প্রত্যাশা। এরচেয়ে ভারি কোনো সময় বেয়ে ঢাকা থেকে বরিশাল যাইনি কখনো। জীবনসম গ্লাণি, হতাশা আর শোকের ভারে পুরোটা পথ শুধু ভেবেছি– শেষ সাত বছরে কতবার এই পথ একইসঙ্গে পাড়ি দিয়েছি আমি আর রাসেল ভাই। একদিন তার নিথর দেহ নিয়ে ফেরার জন্যও যে আমিই মনোনীত হবো, তা কি কখনো ঘুর্ণাক্ষরেও ভেবেছিলাম! রাস্তায় ঝাঁকুনিতে কফিনটা আচমকা নড়ে উঠলেও ভাবছিলাম, ভাই জেগে উঠলেন নাকি। কিন্তু নাহ, সে আশায় গুড়েবালি। তিনি উঠলেন না। তবুও ভাবছিলাম, তিনি জেগে উঠে নিজেকে কফিনের মধ্যে কর্পুর আর চাপাতায় ঢাকায় কফিনে মোড়ানো দেখলে কি ভয় পাবেন? সম্ভবত না। কারণ তার কোনো ভয় ছিল না। বরং শত মনে সাহস জাগানিয়া প্রাণ ছিল তার। এসব ভাবতে ভাবতেই রাসেল ভাইয়ের প্রিয় চন্দ্রদ্বীপের পথে এগিয়ে চলছি আমরা। মাঝরাত পেরুনোর পরও ঝড়-বৃষ্টি থামছেই না।

 

‘স’মিল রাসেল, এরিডোনাসের রাসেল

আদি চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে বরিশাল শহর জন্মের ইতিহাসটা খুব বেশিদিনের নয়। এর বয়স মাত্র ২১৮ বছর। বাকেরগঞ্জ সংলগ্ন নদীতে চরপড়ার কারণে ১৮০১ সালে এই স্থানে জেলা সদর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন। তারও ত্রিশ বছর পর ১৮৩১ সালে রামকানাই রায় নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে বরিশাল মৌজার সব জমি কিনে নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৬৯ সালে বরিশাল টাউন কমিটি, পরে ১৮৮৫ সালে মিউনিসিপ্যালটি বোর্ড প্রবর্তিত হয়। দেড়শ বছর আগেও প্রথাগত শিক্ষায় বেশ পশ্চাৎপদ ছিল নদী-খাল বেষ্টিত এ শহরের ছেলেমেয়েরা। ইংরেজরা ১৮৫৪ সালে জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর বরিশাল অঞ্চলে কলোনিয়াল শিক্ষার জাগরণ শুরু হয়। এর তিন দশক পর ১৮৮৪ সালে স্বদেশি চেতনার ধারক দানবীর মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত তার পিতা ব্রজমোহন দত্তের নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ব্রজমোহন নয়, বিএম স্কুল নামেই পরিচিত পায় কালীবাড়ি রোডের এ স্কুলটি। তখনও প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর বরিশালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আর সুযোগ ছিল না। যে কারণে পরে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুরোধে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন ওই স্কুল কম্পাউন্ডেই বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন মহাত্মা অশ্বিনী। ‘সত্য প্রেম পবিত্রতা’ আদর্শ নিয়ে পথ চলা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বিএম স্কুল কম্পাউন্ড থেকে ১৯১৭ সালে কলেজ রোডের বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা হয় বিএম কলেজ। প্রায় ৬২.০২ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই নিজস্ব ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র গড়ে ওঠে যে আবাসিক এলাকা, তার বয়স আজ ঠিক ১০১ বছর। গত বছর জন্মশতবর্ষে দাঁড়িয়ে নিজের অন্যতম এক গুণী সন্তানের অভিমানী প্রস্থান দেখেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এই পাড়া। যাকে ‘শ্রেষ্ঠতম’ লিখেও ফের মুছে ফেললাম। কারণ, শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাই তিনি সহ্য করতে পারতেন না। প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন প্রতিযোগিতা। বলতেন, হে মানুষ– মানবজন্মই তোমার বড় সার্থকতা। যদি শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করতে চাও, প্রমাণ করো তোমার মানবিকতার।

দৃশ্য । নৃ

জায়গাটির নাম– কলেজ পাড়া। বরিশাল মহানগরীর শহরের বৃহৎ এলাকাগুলোর একটি। যার পশ্চিমে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল, সিএন্ডবি রোড, পূর্বে নতুনবাজার, উত্তরে  জেল খাল এবং দক্ষিণে গোরস্থান রোড। মধ্যে অজস্র গলি আর মহল্লা। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, বিপ্লবী চিত্তরঞ্জন, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, মুকুন্দ দাস, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, ফজলুল কাদের চৌধুরী, কবি জীবনানন্দ দাশ, আবুল হাসান, হুমায়ুন কবির, সিরাজ শিকদার, বিডি হাবিবুল্লাহসহ অসংখ্য গুণীজনের স্মৃতিবিজড়িত এ পাড়ায় শিক্ষিত মানুষের হার শুরু থেকেই একটু বেশি। যে কারণে চিন্তা-চেতনায়ও সব সময় অগ্রগামী ছিল এলাকাটি। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএম কলেজের শিক্ষক-কর্মকতা-কর্মচারী-শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কলেজ পাড়ার সচেতন বাসিন্দারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সামাজিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা ও সাংগঠনিকচর্চার জন্য দুটি খেলাঘর ও দুটি ক্লাব ছিল এখানে। মাত্র দুই দশক আগেও পুরো পাড়াই হয়ে ছিল এক বৃহৎ পরিবার। যার রেশ আজও পুরোপুরি কেটে যায়নি হয়তো। এখানেই বেড়ে উঠেছেন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ আন্দোলনের মহান যোদ্ধা– রাসেল আহমেদ। যিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষই একে অপরের আত্মার আত্মীয়। মরহুম মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান ও সৈয়দ সখিনা বেগমের এই কনিষ্ঠ সন্তান ১৯৭৬ সালের ৫ জুলাই কলেজ পাড়াতেই জন্ম নেন। পারিবারিক কাঠের ব্যবসার কারণে তার কৈশোরে পাওয়া বিশেষণ ছিল “স’মিল”; অর্থাৎ বন্ধুগোত্রীদের কাছে তিনি “স’মিল রাসেল” নামে পরিচিত ছিলেন। ব্যবসায়ী পিতার আহ্লাদ আর শিল্পনুরাগী মায়ের পরম মমতায় বড় হওয়া কর্কট রাশির এই জাতক একদিন বলেছিলেন, ব্যাপ্টিশ মিশন আর জিলা স্কুল বাদে বরিশালের প্রায় সবগুলো স্কুলেই তিনি পড়েছেন।

একই এলাকায় বেড়ে ওঠার কারণে শৈশব থেকেই চিনতাম রাসেল ভাইকে। তিনি ছিলেন আমার ছোট চাচার বন্ধু। তবু কেন জানি তাকে ‘ভাই’ সম্বোধন করেছি আশৈশব। আমার বাল্যবন্ধু কাজী মোসলেহউদ্দিন সোহাগের বড় বোনের রুমে তার আঁকা একটি স্কেচ দেখে অবাক হয়েছিলাম সেই কবে। পরে যখন তাকে আবার ব্যান্ডদল এরিডোনাস-এর লিড ভোকাল হিসেবে দেখি, আরেক দফা বিস্মিত হই। আসলে আমি স্কুলে পড়ার সময় থেকে দেখেছি, গুণী ছেলে হিসেবে নিজস্ব বন্ধুমহলে বেশ কদর রাসেল ভাইয়ের। তবে দিন যত গিয়েছে, বিস্ময়ের মাত্রা ততই বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ে তিনি নতুন নতুন রূপে হাজির হয়ে চমকে দিয়েছেন। তবে মানুষটির সাথে আমার আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে অনেক পরে। এর মূল কারণ, তার চুপচাপ স্বভাব। একটা সময় পর্যন্ত, খেয়াল করে দেখলাম, মূলত সিনেমা তৈরি শুরুর আগে অবধি তিনি খুবই কম কথা বলতেন। সেই রাসেল ভাই কি-না এক সময় একটি আস্ত ‘ফিল্ম স্কুল’ হয়ে উঠলেন!

…লিটলম্যাগসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়
আমৃত্যু লিখে গেছেন, করেছেন
বিভিন্ন প্রকাশনার প্রচ্ছদ
ও অলংকরণের কাজ। ক্লাবের
যেকোনো টুকরো কাজ থেকে
শুরু করে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
আয়োজন– সব জায়গাতেই নিজেকে
সবচেয়ে কাজের মানুষ হিসাবে
প্রমাণই স্বভাব ছিল তার…

প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসাবে রাসেল ভাই তার শৈশব-কৈশোরে অনুশাসনের পাশাপাশি পেয়েছেন এক সুস্থ সাংস্কৃতিক বলয়। বই পড়া আর আঁকাআঁকির অভ্যাস হয়েছে তখনই। মায়ের কাছ থেকে ছবি আঁকা শিখেছিলেন রাসেল আহমেদ। ছোটদের সংগঠন– আগুয়ান খেলাঘর করতে গিয়ে তার পরিচয় হয় মঞ্চনাটকের সাথে। কৈশোর কেটেছে ব্যান্ড মিউজিক, স্টেজ শো আর সাহিত্য পত্রিকা করে। তারুণ্যে এসব চর্চা অব্যাহত রেখেই মেতেছেন ক্যামেরা-কম্পিউটার নিয়ে। ফটোগ্রাফি-ভিডিওগ্রাফির পাশাপাশি আর্টওয়ার্ক, এডিটিং, গ্রাফিক্স ও এনিমেশন চর্চা করেছেন, করিয়েছেন। এরই ফাঁকে দৈনিক পত্রিকায় শিল্প-নির্দেশক ও সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করেছেন। সংগঠক আর আয়োজকের ভূমিকায়ও তাকে দেখা গেছে বহুবার। লিটলম্যাগসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমৃত্যু লিখে গেছেন, করেছেন বিভিন্ন প্রকাশনার প্রচ্ছদ ও অলংকরণের কাজ। ক্লাবের যেকোনো টুকরো কাজ থেকে শুরু করে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আয়োজন– সব জায়গাতেই নিজেকে সবচেয়ে কাজের মানুষ হিসাবে প্রমাণই স্বভাব ছিল তার। এসব করতে করতেই কখন যে চলচ্চিত্র নির্মাণের ভূতটা রাসেলের মাথায় চেপে বসেছে, তা কেউ জানতেও পারেনি। বরিশালে বসেই তিনি নিভৃতে অডিও-ভিজুয়াল কাজের উপযোগী একটি দল গড়ে তুলতে শুরু করেন। চলচ্চিত্র চর্চার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে– থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালী

ফরাশগঞ্জে, টোকন ঠাকুরের বাসায়, আড্ডায় রাসেল আহমেদ, তার স্ত্রী ও অন্যরা ।। ছবি, টোকন ঠাকুরের সৌজন্যে

সময়টা সম্ভবত ২০০৩/০৪। আমার আরেক অভিমানী প্রয়াত বন্ধু মার্সেল অনুপ গুদাসহ কয়েকজনকে নিয়ে একটা ব্যান্ড গঠন করে একের পর এক নতুন গান তৈরি করে চলেছি তখন। তবে নিজেদের ‘প্রাকটিস প্যাড’ নেই। অনুপদের হাসপাতাল রোডের বাসার গোডাউন বা অন্যদের ‘প্যাড’ ভাড়া নিয়ে প্র্যাকটিস করি। একই সময়ে ব্যক্তি কলহের জেরে এরিডোনাস ভেঙে যায়। দল থেকে বেরিয়ে যান রাসেল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট সুদেব মণ্ডলসহ কয়েকজন। তখন ড্রামার নাসির ভাই [মোঃ নাসির] একদিন আমাকে আর অনুপকে রাসেল ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাদের বললেন, তোরা আমাদের সাথে চলে আয়, মানে এরিডোনাস-এ জয়েন কর। তখন রাসেল ভাই আর নাসির ভাই ছাড়াও তখন ব্যান্ডে ছিলেন বেইজিস্ট রোমেল ভাই [আহসান উদ্দিন রোমেল]। নিজস্ব প্র্যাকটিস রুম পাওয়ার আনন্দে আমরা মহোৎসাহে যোগ দিলাম তাদের সাথে। তারও আগে এই এরিডোনাস-এর সাথেই প্রথম মঞ্চে উঠেছিলাম। তখন আমার ব্যান্ডের নাম ছিল এ্যাম, মানে এ্যাবসট্রাক মিউজ। তখন অবশ্য সাথে অনুপ ছিল না। নিজেদের গানও ছিল না কোনো। গিটারিস্ট ছিল আরেক বাল্যবন্ধু হিমেল রায়, বেইজিস্ট ছিল জর্জ [ডিজে], আর ড্রামার– মিলন। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য করা সেই অনুষ্ঠানটির শিরোনাম ছিল– ‘বাঁচাও বিধাতা’। আইয়ূব বাচ্চুর এই গানটি সেদিন কভার করেছিলেন রাসেল ভাই আর আশিষ’দা [আশিষ দে]। তখন অবশ্য রাসেল ভাইয়ের চেয়ে সুবেদ’দার সাথেই ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল আমার। তিনি আবার আমার জাগৃতি খেলাঘর-এর বড়ভাই ছিলেন। সম্ভবত তার বন্ধু হিসেবেই প্রথম রাসেল ভাইকে চিনেছিলাম। পরে জানতে পারি, তারা দুজনেই আমার ছোট চাচারও বন্ধু। রাসেল ভাই আর সুদেব’দা মিলে কলেজ রোডে ক্যাকটাস নামের একটি সাইবার ক্যাফের ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। পরে রাসেল ভাই তার সমবয়সী ভাগ্নে রুবেলকে সাথে নিয়ে ঘেরের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পটুয়াখালীর একটি নদী লিজ নিয়ে শুরু করেছিলেন এই ব্যবসা। সেই সময়ে খুব কম সময়ের জন্য তাকে শহরে পাওয়া যেত। অধিকাংশ সময় ঘেরেই কাটাতেন। শুনেছি সেখানে তিনি এক রাজকীয় বজরা তৈরি করেছিলেন। মাঝনদীতে গিয়ে হাল তুলে দিয়ে সেটাতেই রাত কাটাতেন। মোটরসাইকেল ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় বাহন। সেই সময়ে তিনি খুব দ্রুত মডেল বদলাতেন। পরে জেনেছি ‘হাইসাঙের এক্স-সেল’ তার সবচেয়ে প্রিয় বাইক।

 

প্রিন্ট থেকে ভিজুয়াল মিডিয়ার জার্নি

সময়টা ২০০৫-০৬ সাল। আমি যখন সাংবাদিকতা নিয়ে মহাব্যস্ত, একদিন খুব সকালে রাসেল ভাই আমার বাসায় এসে হাজির। ঠিক তার আগের দিন ঘটনাক্রমে তিনি আমার ‘ইয়াসিকা থ্রিটুওয়ানজিরো’ মডেলের ডিজিটাল ক্যামেরাটি দেখেছিলেন। সেই সূত্রে এসেই বললেন, তোর ক্যামেরাটা একটু দিতে পারবি? যেকোনো মুহূর্তে লাগতে পারে বলে প্রথমে এড়ানোর চেষ্টা করতেই তিনি জানালেন, সন্ধ্যায় ভাগ্নির জন্মদিনের ছবি তুলে দিয়ে যাবেন। আর কোনো অজুহাত না দেখিয়ে কেন জানি দিয়ে দিলাম ক্যামেরাটা। বললাম, রাতে অনেক দেরি করে ফিরি। তাই কাল সকালে দিয়ে গেলেই হবে। পরদিন তিনি একই সময়ে এলেন। ডেকে ঘুম থেকে তুলে আমায় বিএম কলেজের মধ্যে নিয়ে গেলেন। আমরা পূর্ব গেট দিয়ে ঢুকে বাম দিকের পুকুর সংলগ্ন আদি ব্যায়ামাগারের পাশের পুরানো পিচের ট্যাঙ্কির ওপরে গিয়ে বসলাম। তখন শীতের দিন। ভাইয়া জ্যাকেটের পকেট থেকে আমার ক্যামেরাটা বের করে ফেরত দিলেন। এরপর অন্য পকেট থেকে আরেকটা ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে বললেন, এইটা আমার ভাগ্নি ইতালি থেকে পাঠাইছে। তুই চাইলে নিয়া কয়দিন ইউজ করতে পারস। ততক্ষণে ক্যামেরাটা আমি হাতে নিয়ে দেখে ফেলেছি, ওটা ‘সনি সাইবার শট’ সিরিজের ফাইভ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা। আমার ইয়াসিকা ছিল মাত্র থ্রি পয়েন্ট টু মেগাপিক্সেল রেজুলেসনের। তাই তার এ প্রস্তুাবে আমি আনন্দে আটখানা হয়ে যাই।

rasel ahmed
রাসেল আহমেদ ।। ছবি : ঈয়ন

মূলত সেইদিন থেকেই রাসেল ভাই ও আমার আলোকচিত্র-বিষয়ক আন্তঃআলাপ শুরু হয়। আমাদের পরবর্তী ক্যামেরা ছিল ক্যাসিও’র এক্সিম মডেলের আট মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা। পরে অবশ্য এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে সদর রোডের এস রহমান মার্কেট থেকে ভিডিও ক্যামেরা ভাড়া এনেও নষ্ট করেছি আমরা। এখানে আসলে ‘আমি’ই বলা উচিত। কারণ, সেবার মনসা-মঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের বাড়ি ভিডিও করার সময় ক্যামেরা আমার হাত থেকে পরেই নষ্ট হয়েছিল। রাসেল ভাই অবশ্য পুরো দোষটা নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন। তখন তার একটা ল্যাপটপ ছিল, আইবিএম’র। ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা ল্যাপটপ না থাকায় ওটায় ছিল আমার ডিজিটাল ফটোগ্রাফির ব্যাকআপ আর্কাইভ। ছবি রাখতে প্রায়ই মাঝরাতে গিয়ে হাজির হতাম ভাইয়ের ডেরায়। এতে সবচেয়ে বিরক্ত হতেন ইথেল আপু। রাসেল ভাই যার নাম দিয়েছিলেন– ইরা আহমেদ। এই অকাল বিধবা স্ত্রীর সাথে তখন ভাইয়ার প্রেমপর্ব চলছিল। সারারাত ফোনের কথা বলতেন দুজনে। তাদের যৌথকাহিনিতে পরে আসছি। ওই সময়টায় আমি এলে ইথেল আপুর কাছ থেকে ছুটি নিতেন রাসেল ভাই। এরপর সারারাত বিএম কলেজের মধ্যে আড্ডা দিয়ে ভোরে নথুল্লবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে ডিম-পরোটা খেয়ে যে যার বাসায় ফিরতাম। এই খাবারটা বেশ প্রিয় ছিল ভাইয়ার। আসলে এটাই ছিল তার প্রধান খাবার। কারণ, বাড়িতে থাকলেও তিনি মূলত তখন বাইরে খেতেন। কাকতালীয়ভাবে একই দশায় ছিলাম আমিও।

শৈশবে পাড়ায় চিরহরিৎ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে দেখেছি, যা মূলত ছিল বিএম কলেজ ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ভাইয়ার বাল্যবন্ধু, ধণাঢ্য ব্যবসায়ী ও প্রকৌশলী এসএম পলাশ। যার সাথে ভাইয়ার সম্পর্কটা আমৃত্যু সুদৃঢ় ছিল। তার কাছে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করেই সিনেমার কাজ শুরু করেছিলেন রাসেল ভাই। এছাড়া যেকোনো বিপদে-আপদে তার ভরসার জায়গায় ছিলেন এই পলাশ। এমনকি বিয়েতে তার উকিল বাপও তিনি। সেই চিরহিৎ পত্রিকার স্মরণে থেকে যাওয়ার কারণেই রাসেল ভাইকে দৈনিক পত্রিকায় জড়ানোর ফন্দি এঁটেছিলাম। তখনও আমি বরিশালে থাকি। স্থানীয় দৈনিকের পাশাপাশি সাপ্তাহিক ২০০০ নামের একটি ঢাকাই ম্যাগাজিনে কাজ করি। শুরু থেকে এর প্রিন্টার্স লাইনে থাকা ‘শিল্প নির্দেশক’ পদটি আমার মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করেছিল। এই পদে তখন সেখানে কাজ করতেন কনক আদিত্য। মানে জলের গান, প্রাচ্যনাট বা দেশাল-এর কনক’দা।  প্রথমবার সম্পাদকের মুখোমুখি হওয়ার পর আমার জিজ্ঞাসা ছিল তাকে নিয়ে। মানে, পত্রিকায় এই শিল্প নির্দেশকের কাজটা আসলে কী? ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক গোলাম মর্তুজা প্রশ্ন শুনে একটু হাসলেন। এরপর খুব ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বললেন, তার সাথে কিছুটা যোগ করলেন সহ-সম্পাদক জব্বার হোসেন। তাদের কথা শুনে খেয়াল করে দেখি, তখন বরিশালের সবগুলো দৈনিক কোনো আর্টিস্ট বা শিল্প নির্দেশক ছাড়াই প্রকাশিত হচ্ছে। এরপর যখন একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশের সাথে সংযুক্ত হই, তখন এই অভাব পূরণের বিষয়টি মাথায় আসে। একই সাথে চিন্তায় আসেন রাসেল আহমেদ। কারণ, ওই যে চিরহরিৎ। আমার পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত মীর মনিরুজ্জামান ও বার্তা সম্পাদক শাকিব বিপ্লবকেও রাজি করাতে পারলাম এ ব্যাপারে। তবে সবচেয়ে দুরূহ কাজ ছিল রাসেল ভাইকে রাজি করানো। কারণ, তখন তিনি নিজের মাছের ব্যবসা গুটিয়ে বিএম কলেজের সামনের কমটেক কম্পিউটার সেন্টারের প্রশিক্ষক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তবে তার সবচেয়ে জনপ্রিয়তা ছিল নির্ভুলভাবে ডিভি লটারির ফরম পূরণে। তার মাধ্যমে পাঠিয়ে অনেকে লটারি জেতায় বিষয়টি বেশ চাউড় ছিল তখন। তাছাড়া তিনি তখন দিনরাত কমটেকে থাকার অন্যতম কারণ ছিল, ওদের কম্পিউটারগুলোর কনফিগারেশন। ওইগুলোয় গ্রাফিক্সের কাজ করে খুবই মজা পেতেন রাসেল ভাই। এসব ছেড়ে তিনি পত্রিকায় কাজ করবেন কি-না, সেটাই ছিল আমার দুশ্চিন্তা। কারণ, তখন পত্রিকা মানেই অনিশ্চয়তা। একমাস বেতন হবে তো দুই মাস নাই দশা। অবশেষে তাকে রাজি করাতে পেরেছিলাম। পরে সেই দৈনিক সত্য সংবাদ থেকে শুরু করে দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশ, দৈনিক বাংলার বনেআমাদের বরিশাল ডটকমসহ বরিশালের অজস্র লিটলম্যাগ, ভাঁজপত্র ও কাব্যগ্রন্থের নামাঙ্কণ করার পাশাপাশি শিল্প নির্দেশক হিসাবেও তিনি কাজ করেছেন।

দৃশ্য । নৃ 

গত দশক থেকে নিজ হাতে তিল তিল করে গড়তে থাকা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান– থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালীর দাপ্তরিক প্রস্তাবণার সূচনায় রাসেল আহমেদ লিখেছেন– মহাকাল ও মহাবিশ্ব এক মহাযাদুতে আক্রান্ত। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি কণার মাঝে লুকিয়ে আছে অসীম রহস্যজাল, আবিষ্কার, সম্ভাবনা, প্রয়োগ ও উৎকর্ষতা। মূলত প্রকৃতিলব্ধ প্রতিটি ক্ষুদ্রতম কণা বিশ্লেষণ দ্বারাই মানবসভ্যতার চলমান পদযাত্রা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়– ‘ছোট ছোট বালু কণা/ বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ে তোলে মহাদেশ/ সাগর অতল’। ক্ষুদ্রতার সম্মিলনেই বিশালতার প্রকাশ; মূলত এই চিন্তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই মানুষ ঘটিয়ে যাচ্ছে মিরাকল। একের পর এক বেরিয়ে আসছে সৃষ্টিজগতের অজানা সব বিষয়বস্তু। সৃষ্টির অপার যাদুতে বাকরুদ্ধ, বুদ্ধিমান ও কল্যাণমুখী মানবাত্মা ঝাঁপ দেয় সৃষ্টিশীল মগ্নতায়। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তুতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভিন্ন ভিন্ন যুগেই নিমগ্ন ছিলেন সেই সব যাদুকরগণ। আর তাই ভিন্ন ভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত তাঁরা। সাধারণের কারিগর, আমাদের যাদুকর। সভ্যতার মোড়ে মোড়ে এই যাদুকরদেরই মাইলস্টোন গাঁথা। স্বপ্নের পৃথিবীর যে উৎকর্ষিত রূপ আমাদের প্রতিনিয়ত প্রলুব্ধ করে, যাদুকররা সেই স্বপ্নের কারিগর হবার স্বপ্নে বিভোর।

…দেখি,
তার কবরের ওপরে এক
বুনোফুলের গাছ জন্মেছে। তাতে
একটি মাত্র হলুদ রঙের
ফুল। মৃদু বাতালে দুলছে। আমার
মনে হচ্ছিল, ফুলটা হেসে হেসে
কত কি বলছে…

মা, মাটি ও মানুষে মাখামাখি হওয়ার গল্প নিয়ে রচিত নৃ চলচ্চিত্রের কারিগর– রাসেল। টিজার/ট্রেইলর প্রকাশের কারণে ২০১৪ সাল থেকেই বহুল আলোচনায় আসা এই সিনেমাটি যখন সম্পাদনার টেবিলে মুক্তির শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই [১৫ মে ২০১৭] তিনি দুনিয়া ছাড়লেন। প্রচণ্ড ঝড়ের সেই রাতে যখন বরিশালে রওনা করে তার নিথর দেহ; হয়তো সহযাত্রী ছিলেন তার অশরীরী সত্তাও। পরদিন সকালে পৌঁছে যান প্রিয় কলেজ পাড়ায়। বন্ধু-স্বজনরা অপেক্ষায় ছিল তার। কফিনটি যখন অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হচ্ছে, তখন ভাইয়ার বাল্যবন্ধু শাহীন কাকা [রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী শাহীন] আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। দেখি, উপস্থিত সকলের চোখেই তখন পানি। কেউ কেউ নিজেকে ঠেকাতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন। সেদিন দুপুরেই নগরীর মুসলিম গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। সেদিন পিতার কবরের মৃত্তিকায় মিশে যাওয়ার অপেক্ষায় শুইয়ে রেখে এসেছিলাম এক মাটির সন্তানকে। লিখে রেখে এসেছিলাম– ‘ঘুমাও রাসেল আহমেদ, জাগুক স্বপ্নেরা তোমার।’ মৃত্যুর কিছুদিন আগে নিজের পয়সায় তিনি ওই কবরটি বাঁধাই করে টাইলস লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েক মাস পর বরিশালে গিয়ে দেখি, তার কবরের ওপরে এক বুনোফুলের গাছ জন্মেছে। তাতে একটি মাত্র হলুদ রঙের ফুল। মৃদু বাতালে দুলছে। আমার মনে হচ্ছিল, ফুলটা হেসে হেসে কত কি বলছে!

রাসেল আহমেদ যখন বাসা খোঁজার জন্য ২০০৯ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন, তখন আমি শান্তিবাগ এলাকায় একটা টিনশেড বাসা ভাড়া নিয়ে একাই থাকি। আমার তখনকার অফিস ছিল মগবাজার। যে কারণে এর আশেপাশেই থাকতে চাইতাম। কিন্তু ঘুরেফিরে রাসেল ভাইয়ের ওই এলাকাটি খুব একটা পছন্দ হয়নি। একে ওই এলাকায় বাসা ভাড়া বেশি, তাছাড়া তিনি একটু কোলাহলমুক্ত এলাকায় ঘাঁটি গাড়তে চেয়েছিলেন। অবশেষে মোহম্মদপুর শেখেরটেক এলাকাটি তার পছন্দ হলো। বরিশাল ছেড়ে ২০১০ সালের শুরুতে তিনি পুরোপুরি ঢাকায় এসে পড়েন। সরকারি নিবন্ধনসহ সামগ্রিক কাগজপত্র তৈরি করে আনুষ্ঠানিকভাবে দাপ্তরিক কর্ম শুরু করে দেয়, চলচ্চিত্র নির্মাণকারী সংস্থা– থিম থিয়েটার উইজার্ড ভ্যালী। তৈরি হয় একখণ্ডের নাটক– ফ্লাই-ওভারদেশ টিভিতে প্রচারিত এ নাটকটি প্রচুর প্রশংসা-আলোচনা-সমালোচনা কুড়ালেও তিনি আর তখন টিভি নাটক নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হননি। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ভাষায় দেশের অন্তর্ভূক্তিকরণকল্পে শুদ্ধ চলচ্চিত্র চর্চায় শিল্পের নন্দনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে নিজেকে এবং নিজের টিমকে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন। চলচ্চিত্র পাঠ, শিক্ষা ও চর্চার সাথে সাথে ক্যামেরা, রিগস, লাইটস, সাউন্ড ও এডিট প্যানেল সমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি কারিগরি ইউনিট তৈরি করেন।

চর্চার ক্ষেত্রে উইজার্ড ভ্যালী শিল্প শুদ্ধতার মানে বিশ্বাসী; এমনটা দাবি করে রাসেল বলতেন– “আমরা চাই চলচ্চিত্রে শিক্ষিত ও দক্ষ পেশাদার কর্মী তৈরি হোক। সে কারণে শিল্প বা সাহিত্যের নন্দনে অবগাহনই মূল কথা নয়। চলচ্চিত্রে নন্দনকে যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে কারিগরি মাধ্যমের ভেতর দিয়েই যেতে হয়। কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্য ও মেধার গাথুনিতে আমাদের সিনেমা একদিন পৃথিবী শাসন করবে। এমন আকাঙ্ক্ষা আমাদেরও।” অবশেষে ২০১২ সালের আগস্টে রাসেল পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নৃ‘র কাজে হাত দেন এবং এভাবেই চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন। অডিও-ভিজুয়ালের খেলাটা আরো ভালো করে আত্মস্থ করতে একই বছরের জুনে আমিও সাংবাদিকতা ছেড়ে দেই। জুলাই থেকেই আমরা একসাথে থাকা শুরু করি। এরপর সাড়ে চার বছর আমরা একসাথে ছিলাম, মানে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর অবধি। এর আগেও আসলে বহু দিন-রাত আমরা একসাথে কাটিয়েছি স্রেফ আলাপের জন্য। জীবনে তার সাথে যত কথা বলেছি, একমাত্র প্রেমিকা ছাড়া আর কেউই আমার অত কথা শোনেনি। একইভাবে তিনিও কম বলেননি। যার কিছু স্মৃতিতে রয়ে গেছে, কিছু মেইল, ম্যাসেঞ্জার ও ফোনের রেকর্ডে। প্রায়ই পড়ি বা শুনি। মাঝে মাঝে দেখিও। কত-শত ‘স্টিল আর ভিডিও’ আমাদের সময়ের সাক্ষী হয়ে এখনও টিকে আছে এই নশ্বর পৃথিবীতে।

রাসেল আহমেদঈয়ন ।। ছবি : আবু বরকত

আসলে রাসেল ভাইকে নিয়ে খুব সুশৃঙ্খলভাবে বলার ক্ষমতা আমার এখনও হয়নি। কখনো হবে বলেও মনে হয় না।  তথাপি স্মরণে আসে কত কিছু! মাত্র দুই বছর আগে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন, জগৎজুড়ে এতসব দিবসের ফাঁকফোকড় গলে বছরব্যাপি ক্রমশ শোকদিবসের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এই হতভাগা জাতির। আর কত শোকদিবস চাই???  অথচ পরবর্তী অক্টোবর আসার আগে তিনিই নতুন এক শোকদিবস উপহার দিয়ে গেলেন! তিনি আমার ভাই, বন্ধু, শিক্ষক, সহযোদ্ধা– কখনো কখনো পিতৃসম যত্নে আগলে রেখেছেন। শৈশবের খেলাঘর বা কৈশোরের ব্যান্ড জীবন থেকে শুরু করে পত্রিকা, নাটক, সিনেমা। আহা– জীবনের কতগুলো পর্বে এমন এক মানুষের সাহচর্য পেয়েছি, যিনি বলতেন– আমরা জানি– সময় কখনোই পেরোয় না– মানুষকে তার মানবতার সঠিক বোধে দাঁড় করিয়ে দেবার। মানুষকে মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার। যে মানুষটাকে নিজের অজান্তেই সে খুঁজে চলে নিরন্তর। আসুন সেই সত্যিকারের মানুষটাকে খুঁজে বার করি, উদ্ধার করে আনি নিজের ভেতর থেকে। আর শান্ত করি সময়কে।

এমন ভাবনা থেকেই মূলত নৃ সিনেমার জন্ম। লোকেশনে বসে বসেই গল্প বুনেছেন তিনি। সিনেমাটি চিত্রায়নের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং তা শেষ হয় ২০১৫ সালের একই মাসে। তিন বছরে প্রায় ৯০ দিন শুটিং হয়েছে। বরিশালের কমপক্ষে ২৫টি স্থানে কাজ হয়। আমাদের প্রথম দৃশ্যকে ধারণ করতে তিনদিন লেগেছিল। আরো স্পেসিফিকভাবে বললে প্রথম শটটি ওকে হয়েছিল আড়াই দিনের মাথায়। তখনই আমরা বুঝেছিলাম, এই সিনেমা শেষ করতে আমাদের বহু হ্যাঁপা পাড়ি দিতে হবে। তবু আমরা গান গাইতাম, ‘আমরা হারব না হারব না, এই সিনেমার একটি শটও ছাড়ব না।’ আসলে চিত্রনাট্যে রাসেল একের পর এক দৃশ্য গেথে যেভাবে গল্পটা সাজিয়ে ছিলেন, সেটি পড়ে সামান্য ছাড় দিতে ইচ্ছে করছিল না আমাদের। তবুও পরে বহু ছাড় দিতে হয়েছে। মূলত অর্থাভাবে।

 

‘অলটাইম বাটারবন’ বা একবেলা খিচুড়ি

রাসেল ভাইয়ের সাথে যে জায়গায় আমি আসলে ঐকমতে পৌঁছেছিলাম, তা মূলত আমাদের চিন্তা ও কর্ম। বরিশালে একত্রে দিনযাপনকালেই আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন আমরা কেউ না থাকলেও এখন করে যাওয়া কাজগুলোই আমাদের কথা বলবে। সিনেমাটি করতে গিয়ে দুই বেলা ‘অলটাইম বাটারবন’ বা একবেলা খিচুড়ি খেয়ে কাটানো সেই বছরগুলোতে রাসেলের স্বাস্থ্য ক্রমাগত ভাঙতে দেখেছি। প্রায়ই শ্বাসকষ্টে ভুগতেন। বিশেষত প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় তার শরীর প্রচণ্ড খারাপ থাকত। যদিও শরীরকে থোরাই কেয়ার করেছে রাসেলের বেপরোয়া মন। সে মারা যাওয়ার পর ডাক্তার যখন বললেন, কারণটা হার্ট-অ্যাটাক; সাথে সাথে স্মরণে এলো– স্বরূপকাঠীর প্রত্যন্ত গ্রাম রাজবাড়িতে আমাদের সিনেমার শেষভাগের শুট চলাকালে তার অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা। শেষদিকে তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, নিজের ঘর থেকেই বের হতে পারছিলেন না। ঠিক ওই সময় রাসেল ভাইয়ের একযুগের ‘লং ডিসটেন্স’ প্রেমের সফল পরিণতি ঘটে; তাও বেশ সিনেমাটিক কায়দায়। সুদূর রাজশাহী থেকে সেখানে চলে এসেছিলেন তার প্রেয়সী– চৌধুরী দিলনাসিত আনজুম ইথেল ওরফে ইথেল। ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন অচেনা জনপদে মাঝরাতে নৌকায় চড়ে পাড়ি দিয়েছেন সন্ধ্যানদী। এরপর থেকে এই টোনাটুনি, মানে ইথেল-রাসেল একমুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন করতে চাননি নিজেদের। যে কারণে মহানন্দে থিতু হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন রাসেলও। আরো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে, নিজের সব কাজগুলো। প্রস্তুত হচ্ছিলেন ভয়াবহ বিপদসংকুল এক দীর্ঘযাত্রার। যোগ্যসঙ্গী পেয়ে হয়তো আগের চেয়েও দুঃসাহসী স্বপ্নবাজ হয়ে উঠেছিলেন এই জুয়ারি জাদুকর। স্ত্রীর সাথে রাসেলের প্রথম পরিচয় হয়েছিল ইয়াহু মেসেঞ্জারের চ্যাটরুমে। সেই গল্পটা ইথেল আপু নিজেই হয়তো শোনাবেন কখনও।

আয়ু লম্বা করার
গোপন মন্ত্র জানার
তাড়া দিলে কচ্ছপ বাবা
বললেন, একটু ধীরে…
বাছা…

রাসেল ভাই চলে যাওয়ার ঠিক এক বছর পরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, তাকে নিয়ে আজীবন লিখে গেলেও লেখাটি অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে আসে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আসন্ন মৃত্যুটা টের পেয়েছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী রাসেল। মৃত্যুর সন্নিকটে দাঁড়িয়ে তিনি লিখেছেন, ক্ষুদ্র-মস্ত অদেখা-দেখা/ শূন্যই থাকে ঘিরে,/ শূন্য হতে আসে সবই/ শূন্যেতে যায় ফিরে। এর আগে লিখেছেন, মৃত্যুর আগে– জীবনের গল্পটা সম্পূর্ণ হয় না। আরেকদিন লিখেছেন, আয়ু লম্বা করার গোপন মন্ত্র জানার তাড়া দিলে কচ্ছপ বাবা বললেন, একটু ধীরে… বাছা!

অতীত ঘাঁটতে গেলে হায় কত কি-ই-না খুঁজে পাওয়া যায়। মাত্রই খেয়াল করলাম, ফেসবুক-এ ভাইয়ার  প্রকাশ করা প্রথম ছবিটি আমার! আপলোডের বহুদিন আগেই তিনি তুলেছিলেন এটি। ওই, যখন আমরা বরিশালে দৈনিক সত্য সংবাদ নামের একটি পত্রিকায় কাজ করতাম। যদিও অফিসিয়ালি পত্রিকাটির প্রধান প্রতিবেদক ছিলাম আমি আর ভাই শিল্প নির্দেশক; তবে আন-অফিসিয়ালি হেন কাজ নেই, যা আমরা না করতাম। সদর রোডের অনামী লেনের সেই পত্রিকা অফিসের সামনের সামনের দোকানের বসে চা খাওয়ার ছবিটি দেখেই স্মরণে এলো, এই দোকানের মালিককে তার ছোট সাত ইঞ্চি টিভিতে সারাদিন বাংলা ডিসকভারি আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখতে দেখেই আমরা প্রথম ভিজুয়াল কাজ করা কথা ভেবেছিলাম। সেদিন ভোরে ভোলার লঞ্চের উদ্দেশ্যে পত্রিকা পাঠিয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এলাকায় ফিরতে ফিরতে ভাইকে বলছিলাম, যাদের জন্য পত্রিকায় লিখছি, তাদের অনেকে পত্রিকা পড়তেও পারে না। কিন্তু এরা ভিডিও দেখে সবই বুঝতে পারে। আরেক দিন ফেরার পথে রাসেল ভাই বললেন, বুইড়াদের জন্য কিছু কইরা লাভ নাই। ওরা কংক্রিটের মাঝে গাথা পাতলা ইস্পাতের পাতের মতো। কিছু বললে তার প্রভাবে কিছুক্ষণ নড়বে হয়তো, কিন্তু আবার ঠিক আগের জায়গায় এসে থেমে যাবে। আর শিশুরা হচ্ছে কাঁদামাটি। ওদের নিজের মতো করে গড়াও সম্ভব। যে কারণে ওদের মাথায় রেখে সব কিছু করতে হবে আমাদের। আর এই কথাটি আমার প্রচণ্ড মনে ধরে।

দৃশ্য । নৃ

একত্রে থাকার সময় আমরা বেশ কয়েকটি বাসায় থেকেছি। তবে সবচেয়ে বেশি সময় ছিলাম আদাবরের মনুসরাবাদের আরোরা হাইটস অ্যাপার্টমেন্টের ৫০২ নম্বর ফ্ল্যাটে। আকতার প্রোপার্টিজের চেয়ারম্যান নাসরিন আকতারের সহমর্মী মনোভাবের কারণেই সেখানে থাকতে পেরেছিলাম আমরা। তবে তিনি এক সময় অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছিলেন। তাকে লেখা একটি চিঠির একাংশ এখানে তুলে ধরছি– সাক্ষাতেই আপনাকে জানিয়েছিলাম, ব্যবসায়িক সংকটজনিত দুরাবস্থার জেরেই আমার ফ্ল্যাটের ভাড়া প্রদান অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। ভাড়াটিয়ার এমন মনোভাব অভদ্রোচিত বা অস্বাভাবিক মনে হওয়াটা স্বাভাবিক জেনেও নিতান্ত বাধ্য হয়েই এমন আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি। আপনার অজ্ঞাত নয় যে, মূলত নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নৃ নির্মাণ করতে গিয়েই আমি এই বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। যুগে যুগে সুস্থধারার নির্মাতারা এমন সমস্যায় পড়েছিলেন জেনেই হতাশাগ্রস্ত হইনি। আশা রেখেছি বলেই সহায়তা পেয়েছি। শিল্পমনারা এগিয়ে এসেছেন বা দূরে থেকেও সাহায্য করেছেন বলেই নৃ আজ শেষের পথে। আপনি বা আপনারা, অর্থাৎ আকতার প্রোপার্টিজও আমাকে বা আমাদের এতদিন ধরে সহ্য করেছেন বলে আমরা নিঃসন্দেহে কৃতজ্ঞ। তবে এবারের নোটিশ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে, আপনাদের সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। কারণ, এর আগে প্রায় দুই লাখ টাকা বকেয়া থাকাকালীনও আমরা এই জাতীয় কোনো নোটিশ পাইনি। অতএব এবার বুঝতেই পারছি, সময় এসে গেছে। যেভাবে হোক হিসেব চুকিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারলেই এখন আপনারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। আমি বা আমরাও আপনাদের নিরাশ করব না। কারণ, পরোক্ষভাবে আকতার প্রোপার্টিজ বা আপনিও আমাদের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গী হয়েছেন। যে কারণে আমরা নৈতিকভাবেও অনেক ঋণী।

 

সিনেমার অন্তরালের অদ্ভূত সব সিনেমা

একটা সিনেমা। অনেক অনেক কিছুর সন্নিবেশিত এক ভিন্নরূপে প্রকাশের প্রচেষ্টা। সিনেমায় তাই মাত্রা বা স্তরের খেলার মাধ্যমে সাধারণ/অসাধারণ সব বৈচিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তবে মজার ব্যাপারটা এখানে– অনেক সময় একটা সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে অন্তরালে অদ্ভুত সব সিনেমা তৈরি হতে থাকে। অদ্ভূত আর অনাকাঙ্ক্ষিত বিচিত্রও বটে। দেখতে দেখতে ওটা সিনেমাকেও ছাড়িয়ে যায়। অনেকটা বরফের দেশে নীল সমুদ্রে ভাসমান ধবল আইসবার্গের মতোই। যে আইসবার্গের পানির ওপরে ভাসমান দৃশ্যমান অংশটুকু, পানির নিচের বিশাল অংশের তুলনায় ক্ষুদ্র হয়ে থাকে। নৃ সিনেমার অন্তরালের মহা-সিনেমাটা/সিনেমাগুলো সেভাবেই ডানা মেলছে। এক সময় আমরা পর্দায় পূর্ণাঙ্গ একটা কাহিনিচিত্র আকারে নৃ দেখে ফেলব। কিন্তু ক’জন জানবে অন্তরালের সাগরে ডুবে থাকা আইসবার্গের সেই বিশাল স্তরের কথা? –চলচ্চিত্র নৃ‘র ফেসবুক পেইজে এক রাতজাগা ভোরে এই কথাগুলোই লিখেছিলেন রাসেল।

পেইজটি ‘ডিঅ্যাক্টিভ’ করে রাখা হয়েছিল। এর আগে ভাইয়া মান-অভিমানের কোনো এক পর্বে পেইজের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের ‘অ্যাডমিন প্যানেল’ থেকে ‘রিমুভ’ করেছিলেন। পরবর্তীকালে প্রবাসে থাকা বরিশালের এক কবি, রাসেল ভাইয়ের মৃত্যুর কিছু সময় পরই বিষয়টি ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানালে, তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টটি ‘রিমেম্বারিং আইডি’ হয়ে যায়। যে কারণে যারা তার আইডি-পাসওয়ার্ড জানতেন, তারাও কেউ আর facebook.com/cinema.nree‘তে ঢুকতে পারেননি। এই পেইজে লেখা ছিল আমাদের, মানে এই সিনেমার প্রায় প্রতিটি দিনের গল্প। ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে বারবার জানানো হয়েছে। তারা প্রথমে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও পরবর্তীকালে কিছুই করেনি। পেইজটি হারিয়ে ফেলার কথা মনে পড়লে মনটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। এই মুখবই পাতার পরতে পরতে রাসেল ছিলেন।

কিছু মজার গল্পও আপনাদের জানাতে ইচ্ছে করছে। যেমন ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বরের ফেসবুকে একটি ‘স্ট্যাটাস’ দেয়ার মাত্র নয় মিনিটের মাথায় ‘অনলি মি’ করে রাখতে বাধ্য হই রাসেল ভাইয়ের নির্দেশে। স্ট্যাটাসটি ছিল– “সন্ধ্যায় বরিশালের আলেকান্দার বাংলাবাজার এলাকায় হিমু তালুকদার নামের এক ভদ্রলোক আমাকে ধারালো অস্ত্র [কুড়াল] দিয়ে কোপানোর চেষ্টা করেছেন। কারণ হিসাবে বলেছেন, তার দিকে ভাব নিয়ে তাকানো হয়েছে। তার নাম আর ক্ষমতা সম্পর্কে কেন শুনি নাই বা জানি না– তা নিয়েও তিনি ক্ষিপ্ত। তছনছের চেষ্টা করেছেন চলচ্চিত্র নৃ ইউনিটের অস্থায়ী সম্পাদনা কক্ষ। এটা দুঃখজনক যে, তিনি আমাদের বাড়িওয়ালা, মানে স্থানীয় ফখরুদ্দিন চৌধুরী লেনের দয়াল টাওয়ারের মালিক। তার এ ভবনেই আমাদের ইউনিটের বর্তমান ক্যাম্প। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।” ঘটনার সময় রাসেল ভাই ক্যাম্পে ছিলেন না। পরে এসে মালিকের সাথে সমঝোতা করায় আমার খুবই মেজাজ খারাপ হয়। এ নিয়ে পরে অনেক তর্কও হয় আমাদের। বস্তুতপক্ষে ওই সময়ে আলোচ্য ঘটনা নিয়ে হৈচৈ-অস্থিরতা করার চেয়ে, নিরিবিলি কাজ শেষ করাই মুখ্য ছিল আমাদের কাছে। বরিশালে নৃ পরিবারের প্রথম আস্তানাটিও ছিল এই বাংলাবাজার এলাকায়। পরবর্তীকালে দুটি, যথাক্রমে– গোরস্থান রোড ও কাশীপুরে। অবশেষে ফের পুরানো এলাকায় ফিরেছিলাম আমরা। ওই সময় প্রতিদিনই এমন অসংখ্য গল্প তৈরি হয়েছে আসলে। কখনো সময় সুযোগ হলে হয়তো আরো বলা হবে।

দৃশ্য । নৃ

তার আগে যখন চিত্রায়নের মাত্র ১৫ ভাগ কাজ বাকি, কোনোভাবেই টাকা যোগার হচ্ছিল না, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ওপার বাংলায় জন্মানো ‘বরিশাইল্যা’ ফিল্মমেকার অমিত সেন। তিনি বিজ্ঞাপনের কাজ যোগার করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নগদ অর্থও দিয়েছেন ঢের। বাংলাদেশের ২০ জন বিজ্ঞাপন নির্মাতার কাছ থেকে আমাদের জন্য টাকা তোলার চেষ্টা করেছিলেন এ দেশের বিজ্ঞাপন নির্মাতা পিপলু আর খান। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তিনি আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন মোস্তফা সয়রার ফারুকীও। আমরা মোরশেদুল ইসলামের সাথে দেখা করে আমাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানোর পর তিনি বলেছিলেন, “শেষ করে ফেলতে পারবে মনে হচ্ছে।” তথাপি অমিত সেন না এগিয়ে আসা অবধি মোটেই স্বস্তিতে ছিল না নৃ নির্মাতা ও তার ইউনিট।

এর আগে রাসেল পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির টাকায় ২০১২ সালের আগস্টে শুরু করে নৃ‘র কাজ। প্রাথমিক মূলধন হিসাবে ওই টাকা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। এখানেও আবার একটা ছোট্ট অনুগল্প আছে। রাসেল বন্ধুত্বে ও খাতিরে বিদ্যমান বাজারদর নয়, ১০ বছর আগে প্রথমবারের মতো জমি বিক্রির ব্যাপারে যখন কথা হয়েছিল– সেইসময়ের দর নিয়েছিলেন। যে কারণে ছয়-সাত মাসের প্রস্তুতির পর ২০ দিনের শুটিংয়ে [গত বছরের এপ্রিলে] তা শেষ হয়ে যায়। তীব্র অর্থসঙ্কটে পরে নৃ ইউনিট। ওই সময়ে উইজার্ড ভ্যালীকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসেন সৌদিপ্রবাসী ব্যবসায়ী ডা. আরিফুর রহমান। আমার বন্ধু পারভেজ অভির আমাদের বরিশাল ডটকম নামক একটি অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ দেখেই তিনি নৃ সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। পরে ফেসবুক পেইজ আর  আমাদের সুহৃদ এমএস জাকির হোসাইনের কল্যাণে তার সাথে নৃ টিমের যোগাযোগ হয়। পরে ‘বরিশাইল্যাইজম’ তাকে এই টিমের পাশে এনে দেয়। গল্পের মূলভিত্তি বরিশালকেন্দ্রিক হওয়ার কারণেই চলচ্চিত্রটির পাশে দাঁড়াবার ইচ্ছা পোষণ করেন বরিশালের সন্তান ডা. আরিফ।

এর আগে নৃ‘র অবস্থা নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক কূলদা রায় ফেসবুকে এক দীর্ঘ ‘স্ট্যাটাস’ দেন। তিনি লিখেছিলেন, “মাধবপাশা বরিশাল শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমি বহুবার গেছি। এই পথে গুঠিয়া, চাখার, বানারীপাড়া স্বরূপকাঠি যেতে আসতে মাধবপাশায় নেমে পড়তাম। আমার পিঠে শিবকালী ভট্টাচার্যের এগার খণ্ড। আমি ঔষধি গাছ খুঁজতে বেরিয়েছি। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দুর্গাসাগর। শান্তশ্রী এই দীঘির সিঁড়িতে বসে থেকে দেখেছি– জলের উপরে পাখি এসে নামে। তার ছায়া উড়ে যায়। মাঝখানে একটুকু দ্বীপ। হাওয়ায় কাঁপে। এই মাধবপাশায় স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে অনশন করেছিল গ্রামের মানুষ। পঞ্চাশের দাঙ্গায় একদিনে মেরে ফেলা হয়েছিল ২০০ জনকে। কিন্তু দুর্গাসাগর এখনো সুন্দর হয়ে আছে। হয়তো সুন্দর এরকমই। সুন্দরকে সুন্দরই থাকতে হয়। তাকে শ্রী বলে ডাকি। দুর্গাসাগর নিয়ে একটি ফিল্ম হচ্ছে। নাম নৃ। কোনো তরুণ করছেন। আমি তাকে চিনি না। কিন্তু দুর্গাসাগরকে চিনি বলেই তাকে অচেনা মনে হয় না। ফিল্মটি আটকে আছে ৮৫ ভাগ হওয়ার পর। টাকা নেই। ভালো কাজে টাকা থাকে না– এটা খুব স্বাভাবিক। তবু তাকিয়ে আছি দুর্গাসাগরের দিকে। কেউ হয়তো আসবেন। তখন নৃ ফিল্মটি দুর্গা সাগরকে নিয়ে শ্রী হয়ে উঠবে।”

১৪ আগস্ট, ২০১৩। কাশীপুর, বরিশাল। নৃ পরিবারের তিন নম্বর ক্যাম্প-হাউস তখন বেশ সরগরম। সবচেয়ে ব্যস্ত আর্ট ডিরেক্টর থিওফিলাস ও তার দলবল। সকাল থেকে মধ্যরাত, একের পর এক সেটের কাজ যেন শেষই হচ্ছে না। এমনই এক সকালে পরিবারের অন্যতম অভিভাবক ডা. আরিফুর রহমান এসে হাজির। উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সবাই। কোথায় কখন কি যে জানায় প্রকৃতি, কোন ইশারায়। ঠিক ওই সময়ই সূর্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক পূর্ণবৃত্তের রঙধনু, কে জানে কিসের ইশারায়। তার সহায়তায় ২০১৩ সালের২৫ অক্টোবর বরিশালের বানারীপাড়ার নরোত্তমপুর গ্রামে সিনেমার তৃতীয় দফা চিত্রায়নের কাজ শুরু হয়। এর আগে প্রথম দু’দফায় [একই বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে] মোট ২০ দিনে সিনেমার ইনডোরের অধিকাংশ কাজ শেষ করেছিল নৃ ইউনিট। তাই শেষ দফার বেশিরভাগ কাজই ছিল আউটডোর নির্ভর। প্রথম দু’দিন বৈরি আবহাওয়ায় বিঘ্নিত হয় কাজ। তৃতীয় দিনে বৃষ্টি কমলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। টানা হরতালে বিঘ্নিত হয় শুটিং।

টানা হরতালের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে করে সিনেমার কলাকুশলী থেকে মালপত্র আনা-নেয়া করতে হয়েছে। এ সময় পুলিশি হয়রানিরও শিকার হন নৃ ইউনিটের সদস্যরা। এসব বাধা পেরিয়েই বানারীপাড়াসহ বরিশাল মহানগরীর এপিফা্নি গির্জা, মহাশ্মশান, নগর উপকণ্ঠের ঐতিহাসিক জলাধার দূর্গাসাগর এবং এর আশেপাশের এলাকায় কাজ চলেছে। তবে বেড়েছিল খরচ। এরই প্রেক্ষিতে নভেম্বরে আবারো টাকা শেষ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় চিত্রায়নের কাজ। পুনরায় অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে উইজার্ড ভ্যালী। নতুন কো-প্রডিউসার খোঁজা হয়। এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও সহায়তা চাওয়ার পরিকল্পনা করি আমরা।

লাগামছাড়া দুঃসাহস

চলচ্চিত্রের জন্য নিজস্ব উৎসর্গ
ব্যতিরেকে একটা পূর্ণাঙ্গ
চলচ্চিত্রের বিকাশ সম্ভব
না…

আমরা তখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেও কেউই হতাশ ছিলাম না। ততদিনে আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মেছে, কোনো-না-কোনোভাবে এবারের আর্থিক সঙ্কটও কেটে যাবে। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মূল্যবোধ জাগানিয়া গল্পের এই সিনেমার কাজ দ্রুতই শেষ হবে। এই সময় পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে রাসেলের বক্তব্য ছিল, চলচ্চিত্রটি শুরু করেই আমি টের পেয়েছি– এ অঞ্চলে স্বকীয়তা ও নিজস্ব ভাষা শৈলী নিয়ে একটি আন্তর্জাতিকমানের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র পরিস্ফূটনে রয়েছে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু সাথে সাথে আমি এটাও বুঝতে পেরেছি– লাগামছাড়া দুঃসাহস ও চলচ্চিত্রের জন্য নিজস্ব উৎসর্গ ব্যতিরেকে একটা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের বিকাশ সম্ভব না। তাই জেনেবুঝেই ঝাঁপ দেয়া। প্রতিবন্ধকতাকে পথের অংশ মেনেই আগাচ্ছি। যাই হোক, অনেকখানি পথ পেরিয়ে শেষ পর্যায়ে এসে আমাদের আত্মবিশ্বাসের কোনো অভাব আছে, এটা কেউ বলতে পারবে না। রাসেল ভাই আরো বলেছিলেন, ইতিমধ্যে আমাদের ভিজুয়াল সম্পাদনার কাজ অনেকখানি এগিয়েছে। সাউন্ড ডিজাইন, গানসহ পূর্ণাঙ্গ মিউজিক ডিজাইনের কাজও চলছে। কালার গ্রেডের জন্য ইংল্যান্ডের এক কালারিস্টের সাথে কথাবার্তা চলছে। সবকিছু মিলিয়ে চলচ্চিত্র নৃ’র কাজ থেমে নেই। অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এগিয়ে চলছি আমরা।

rasel ahmed
স্ত্রী ইথেল আহমেদের সঙ্গে রাসেল আহমেদ ।। ছবি, ইথেলের ফেসবুক থেকে

আরও একটা মজার গল্প বলি, তৎকালে দেশব্যাপী চলমান পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসে তটস্থ বরিশালও। টানা ২৮ দিন শুটিং করে এসে এক বিকেলে বরিশালের গোরস্থান রোডে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম আমরা ক’জন। এমন সময়ে কোতয়ালী থানা পুলিশের এক টহল দলের বিচক্ষণতার সুবাদে তাদের ভ্যানে কাটানোর সুযোগ হালো আমার। প্রথম অপরাধ, উদভ্রান্ত [পুলিশের মতে, নেশাখোরের মতো] চেহারা। আরো অপরাধ, জিজ্ঞাসাবাদের কারণ জানতে চাওয়া। এরপরই আমার পকেট, মানিব্যাগ থেকে কাগজ ও পয়সা বের করে তারা দাবি করেন, ওসব গাজা আর হেরোইন সেবনের আলামত। এরই জেরে বাদানুবাদ জোরাল হয়। অবশেষে তারা আমাকে ভ্যানে উঠতে বলেন। পরবর্তীকালে এ ছবিটি তোলার সময় ফ্রেমে আসার অনুরোধ করায় পুলিশ ভাইয়েরা আরো ক্ষেপে যান। তারা বলেন, “এ ব্যাটার মাথায়ও ঝামেলা আছে।” ছেড়ে যাওয়ার আগে এসআই মজিবুর আচরণ শুধরানোরও পরামর্শ দিলেন। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম, তিনি কখনো শেখ সাদির গল্পটি পড়েছেন বা শুনেছেন কি-না।

ব্লগ দুনিয়ার মানুষদের জেনে হয়তো ভালো লাগবে; সামু, মানে বাংলা ব্লগ– সামহোয়্যার ইন-এর বেশ পুরানো ব্লগার ছিলেন নির্মাতা রাসেল আহমেদ । ‘যাদুকর’ নিকের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। তার নৃ‘র পাশে দাঁড়িয়ে মানসিকভাবে শক্তি যারা যুগিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আনোয়ার শাহাদাত, কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুর, নির্মাতা আসিফ ইসলাম ও ফয়সাল রদ্দি এবং শিল্পী ও নির্মাতা অং রাখাইনসহ নৃ-সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তির পরিবার। গত বছরের মে মাসে নিজস্ব এডিটিং টেবিলে সিনেমাটির চূড়ান্ত সম্পাদনা চলছে, ঠিক সেই মুহুর্তে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন রাসেল। নির্মাণ শুরুর প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় আবার থমকে যায় নৃ। আটকে যায় কাজ। তৈরি হয় নানামুখী শঙ্কা। এ নিয়ে যখন নানাবিধ হতাশায় ডুবে যাচ্ছি, ঠিক তখনই আবার কাঁধে হাত রেখেছিলেন অমিত সেন। জানতে চাইলেন সিনেমাটির সর্বশেষ অবস্থা, জানালেন তার চিন্তার কথাও। আবার আশাবাদী হলো আমার চলচ্চিত্র শ্রমিক সত্তা। তবে এই কথা আর বেশিদূর আগায়নি সে দফা। যার কারণ, আরেক চলচ্চিত্র নির্মাতার মাতৃভূমিতে ফিরতে না পারার হাহাকার। সে গল্প শোনানো যাবে অন্য কখনো। আশার কথা হচ্ছে, হলিউডের একটি প্রতিষ্ঠান নৃ‘র ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে। তবে আপাতত বিষয়টি একটু গোপন থাকাই বোধকরি ভালো। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটির নাম, কিংবা তাদের সাথে আমাদের সংযোগকারী মানুষটির নামও উহ্য রাখলাম। শুধু এইটুকু বলতে পারি, তিনিও একজন ফিল্মমেকার। তবে যারাই সাহায্য করুক, মূল কাজটি করতে হবে ড্যানিয়েল ড্যানি, শাহরিয়ার শাওনসহ যারা নৃ‘র ‘কোর টিম’-এ ছিলেন, তাদেরই। এক্ষেত্রে ইথেল আপুও যথেষ্ট সাহায্য করতে পারবেন, আশা করি। কারণ, রাসেল ভাইয়ের সর্বশেষ চিন্তাটা তিনিই সবচেয়ে ভালো জানতেন।

 

সময় মতো ‘নৃ’ নিয়ে হাজির হয়ে যাব

রাসেল ভাইয়ের ওপর অনেক অভিমান জমেছিল আমার। কত কিছুই না বলছি তারে এ জীবনে! আমার কত বাজে আচরণের শিকার হয়েছে তিনি। তবু বলতেন, পাগল, জীবনে তোর উপ্রে শেষতক কখনোই আমি গোস্বা করতে পারি না। আমার একটাই ছোটভাই– ঈয়ন। আমি যে বড়ভাই হইছি। চাইলেও তো গোস্বা করতে পারি না। সত্যিটা প্রকাশ্যেই বলি। তার প্রতি আমার অভিযোগ ছিল, পুরো শেষ না করেই তার আনুষ্ঠানিকভাবে সংসার শুরুর সিদ্ধান্ত সিনেমাটার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ কারণেই কাজ শেষ হতে বিলম্ব হচ্ছে। জবাবে তার বক্তব্য ছিল, ‘সিনেমা’র ভাষাতেই বলি– তুই তোর পয়েন্ট অব ভিউ বললি। ঘুরে আমার পয়েন্ট অব ভিউটাও দেখার চেষ্টা করিস। দোয়া করিস আমার জন্য। সময়মতো নৃ’ নিয়ে হাজির হয়ে যাব। এত সময় পার হয়ে, এটাকে আর যেনতেন রূপে না এনে, নিজের রূপেই দাঁড় করাবার প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন ভাবি, তিনি যদি তখন বিয়েটা না করতেন, তবে নিজের সংসার গড়ার স্বাদ পাওয়াই হতো না তার। তাছাড়া রাসেলের সিনেমার চেয়েও পুরানো প্রেম ইথেল। সেদিন ভাই পাল্টা অভিযোগ করে বলেছিলেন, আমাদের সিনেমাটা সত্যিই কি আমাদের সবার হাত ধরে পাড়ি দিচ্ছে পথ? নাকি আমার একার পিঠেই গোটা ওজন চাপিয়ে সওয়ার হইছে? একটু ভালা কইরা ভাইবা দেহিস। মুহুর্তে মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের তামাম স্বার্থপরতা। অপরাধবোধে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই হয়তো বলেছিলেন, ঈয়ন, মানুষ বুঝলো না, চলচ্চিত্রের এই আকালে নির্মাতাদের নার্সিং দরকার। উৎসাহ প্রেরণার দূর্ভিক্ষে যেন কাউকে নিরুৎসাহিত না করা হয়। সবকিছুতে তোর যে তুমুল উৎসাহ দেখেছি, সেই ঈয়নটাই আবার আবির্ভূত হোক। এই দোয়াই করি। তখন স্মরণে আসে বহু আগে রাসেল ভাই আমাদের দুজনের একটি ছবির ক্যাপসনে লিখেছিলেন, “বিভ্রান্ত হতেই পারি/ তবে দিকভ্রান্ত নই/আমরা দুই ভাই”। তবুও এই বিভ্রান্তি কাটাতে বড় দেরি করা হয়ে গিয়েছে হয়তো। যদিও আমরা বিশ্বাস করি, যা হওয়ার তা’ই হয়, হবে।

রাসেল ভাইয়ের মৃত্যুর কয়েক দিন পরই মারা যায় আমাদের আলোকচিত্রী বন্ধু হান। তারপরই বরিশালের সহযোদ্ধা সাংবাদিক লিটন বাশার। এসব দেখে-শুনে আমার আরেক অগ্রজ বান্ধব নূরুল আলম আতিক বলেছিলেন, “তোমার বন্ধু হওয়া-তো আসলেই দুশ্চিন্তার!” একই কথা এক পরমাত্মীয়ও একটু অন্যভাবে বলেছিলেন। তার প্রশ্ন ছিল, “তুই বেছে বেছে শুধু এমন মানুষদের সাথেই কিভাবে বন্ধুত্ব করিস, যারা অকালে চলে যায়?” ভেবে দেখলাম, বন্ধুত্বও আদতে প্রেমের মতো। করা যায় না, হয়; আর মনে মন মিলে গেলে তা টিকেও যায়। যাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব এভাবে টিকে গেছে; চেয়ে দেখি তাদের কেউই ছাপোষা জীবনে অভ্যস্ত নন। প্রত্যেকের পথ ভিন্ন হলেও সকলেই পুড়েছেন বা পুড়ছেন; নানাবিধ দহনে। যার একমাত্র কারণ তারা প্রত্যেকই প্রচ- স্পর্শকাতর। মূলত প্রখর অনুভূতিই তাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে, করছে। গত দেড় দশকে আমি যে দুই ডজন বন্ধু-সহযোদ্ধা হারিয়েছি, তাদের সিংহভাগই মূলত আত্মহত্যাকারী। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের ম্যাক্সিম সিরিজের একটা লেখা এখানে প্রাসঙ্গিক; যার শিরোনাম– আত্মহত্যা। যেখানে লেখা হয়েছে– “পৃথিবীর মানুষেরা আত্মহত্যার অনেক কৌশল আবিষ্কার করেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালোটি হচ্ছে মরবার অপেক্ষা করতে করতে একদিন মরে যাওয়া।” হয়তো আমাদের সময়টাই পতনগামী।

আড্ডায় রাসেল আহমেদ ।। ছবি, টোকন ঠাকুরের সৌজন্যে

রাসেল ভাইয়ের মতো নিভৃতচারী মানুষের মৃত্যুতে এতটা তোলপাড় হবে, ভাবিনি। কিন্তু হয়েছে। খবরটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। মোস্তফা সয়রার ফারুকী, মাসুদ হাসান উজ্জলসহ অনেক নির্মাতা, লেখক, কবি, মূলত অজস্র পুরানো সহযোদ্ধা ও শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে নিয়ে বললেন, লিখলেন। রাসেলের মৃত্যুর ১১ দিনের মাথায়, গত বছরের ২৬ মে বিকেলে শাহবাগের ছবির হাটে [সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারুকলা ইনিস্টিটিউট সংলগ্ন গেটের সামনে] রাসেল স্মরণ বৈঠকে তার সুহৃদ-বন্ধু, স্বজন ও সহকর্মীরা বললেন, নির্মাণাধীন চলচ্চিত্র নৃ শেষ করার দায়িত্ব এখন আমাদের সকলের।

…তিনি স্রেফ বাণিজ্যিক
উদ্দেশ্যে নয়, মানুষের
বোধ ও চিন্তাকে উন্নত
করতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে
নেমেছিলেন…

বৈঠকে বলা হয়, রাসেল আহমেদ ছিলেন এক স্বপ্নবাজ জাদুকর। শৈশব থেকেই চিন্তাশীল এই মানুষটি যে কোনো মানুষের কষ্টেই ব্যথিত হতেন। তবে তার মনের এ স্পর্শকাতরতা পরিবারের সদস্য, এমনকি বন্ধুদের অনেকেও ঠিক বোঝেনি। পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্তকেও পাগলামি ভেবেছেন কেউ কেউ। তবে এখন তাদের মনে হচ্ছে, রাসেলের জন্য অনেক কিছুই করার ছিল। অন্তত তার সিনেমাটির পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিল। কারণ, তিনি স্রেফ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, মানুষের বোধ ও চিন্তাকে উন্নত করতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে নেমেছিলেন। আমৃত্যু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। বক্তারা আরো বলেন, রাসেল ও তার টিমের সদস্যরা খেয়ে না খেয়ে যেভাবে নিজেদের সিনেমার করেছেন, সে ইতিহাস একসময় চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের পাঠ্য হবে নিশ্চিত। রাসেলের সহযোদ্ধারা বাংলাদেশের সিনেমায় আগামীতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে– এমনটাও আশা অনেকের। তবে সকলেই একমত যে, সবার আগে নৃ সিনেমাটিকে মুক্তির আলোয় নিয়ে আসতে হবে।

বৈঠকে বক্তব্য রাখেন কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুর, প্রকাশক রবীন আহসান, কবি ও আবৃত্তিকার সাফিয়া খন্দকার রেখা, অভিনেতা ম ম মোর্শেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা ফয়সাল রদ্দি, চলচ্চিত্র নির্মাতা অং রাখাইন, মাহবুব হোসেন, ইফতেখার শিশির, ইমতিয়াজ পাভেল, সাংবাদিক সাইফ ইবনে রফিক, ভাস্কর ও লেখক গোঁসাই পাহলভী, কবি ও সাংবাদিক রুদ্র আরিফ, আবদুল্লাহ মাহফুজ অভি, সঙ্গীত শিল্পী সম্রাট, কিম্বেল অভি, সিনা হাসান, কবি মাহমুদ মিটুল, কিং সউদ, রাসেলের মেঝভাই মোহাম্মদ শফিকুল আলম মুকুল, শৈশবের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার এসএম পলাসহ আরো অনেকে। দুঃখভারাক্রান্ত মনে পরম শ্রদ্ধার সাথে রাসেলকে স্মরণ করেন তারা।

সেদিন টোকন ঠাকুর বলেন, “রাসেল সিনেমাটি [নৃ] প্রায় শেষ করে এনেছিলেন, কিন্তু এর মুক্তি দেখে যেতে পারলেন না। এটি মুক্তি না পাওয়া অবধি তার আত্মা শান্তি পাবে না।” রবীন আহসান বলেন, “বাজারি ধারায় সবাই যেভাবে সিনেমা বানাচ্ছে, রাসেল সেভাবে বানাতে চায়নি। নিজের মতো করেই গল্প বলতে চেয়েছে। এই প্রবণতা দেখেই বুঝেছিলাম, সে আসলে শিল্পী।” রাসেলের মেঝভাই মুকুল বলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, সে আমাদের মাঝে বড় হলেও আমরা তাকে চিনতে পারিনি। আজ আপনাদের মাঝে এসে, কাজের কথা শুনে তাকে নতুন করে চিনলাম।”

রাসেল স্মরণ

গত দশকে যখন রাসেল ভাইয়ের সাথে বরিশালের আঞ্চলিক পত্রিকায় কাজ করি; তখন থেকেই দেখেছিলাম দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম আলোর প্রতি এক ধরনের বাড়তি মমত্ব বা ভালোলাগা কাজ করে তার। তাদের সংবাদ তৈরি ও পরিবেশনার ঢঙ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের ঘোর প্রশংসাকারী ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে আমরা যখন কাজের মিডিয়াম বদলে চলচ্চিত্রে মনোযোগী হই, ঢাকায় একসঙ্গে থাকা শুরু করি, তখনও বাসায় প্রথম আলো পত্রিকাই রাখা হতো। রাসেল ভাই বিশ্বাস করতেন– আসলেই “যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো“।

২০১৩ সালের জুনে যখন নির্মাণাধীন চলচ্চিত্র নৃ নিয়ে আমরা প্রেসের সামনে হাজির হই; এর আগে ও পরে অজস্র গণমাধ্যম সিনেমাটি নিয়ে একাধিকবার সংবাদ প্রকাশ করে, কিন্তু প্রথম আলো কেন জানি চুপ ছিল। তাদের নীরবতা ভাঙাতে আমাদের সাংবাদিক বন্ধু রঞ্জু চৌধুরী [সমকাল] খোদ রাসেল ভাইকেই নিয়ে গিয়েছিলেন পত্রিকাটির বিনোদন বিভাগের প্রধানের কাছে। সম্ভবত মেহেদী [আগে/পরে কিছু আছে], ভদ্রলোকের নাম। ভাইকে তিনি বলেছিলেন, “আগে সিনেমাটি শেষ করে তারপরে আসেন।” তার আগে নৃ নিয়ে কিছু না লেখার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, পত্রিকাটি ইতিপূর্বে যেসব ইন্ডিফিল্মকে শুরুতেই প্রচুর সাপোর্ট দিয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই পরে কাজ শেষ করেনি। প্রথম আলোর ওই আচরণে রাসেল ভাই বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন; যদিও বুঝতে দিতে চাননি। বাসায় ফেরার পর শুধু বলেছিলেন, নৃ মুক্তির আগে প্রথম আলোতে আর কোনো সংবাদবিজ্ঞপ্তি পাঠাইস না। তারা বিরক্ত হতে পারে। আমিও আর পাঠাইনি। অথচ সেই পত্রিকায় মুক্তির আগেই সিনেমাটি নিয়ে, মূলত ভাইয়ার মৃত্যুর গল্প নিয়েই প্রকাশিত হলো এক বিশেষ রচনা। অবশেষে প্রিয় প্রথম আলো তাকে, তার সৃষ্টিকে স্থান দিয়েছে। কোথাও বসে এসব দেখে তিনি খুব হেসেছেন নিশ্চয়ই।

বিভিন্ন সময়ে নানা বয়স ও পেশার অনেকেই চলচ্চিত্র নির্মাতা রাসেলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। একাত্ম হয়েছেন নৃ পরিবারের সাথে। অংশ হয়েছেন এ প্রচেষ্টার। মানবতাবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বার্তা ছড়ানোর তাগিদে সহযোদ্ধা হয়েছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাদেরই মধ্যে রবিন শামস, গোলাম রব্বানী, কামরুল ইসলাম রিফাত, দিল আফরোজ জাহান, শিমুল সালাউদ্দিন ও রাগিব রেজা অন্যতম। তাদের স্ব-উদ্যোগী বহু প্রয়াস আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে বহুবার। নৃ‘র খবর প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তর-এ। লিখেছিলেন ইশতিয়াক নামের এক সাংবাদিক। রাসেল ভাই খুবই পছন্দ করতেন তাকে। এর আগে তিনি রাসেল ভাইয়ের তোলা ছবি নিয়েও পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। তবে যেদিন নৃ নিয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়, সেদিন আমাদের দুজনের কারোই আট টাকা দিয়ে একটি পত্রিকা কেনার সামর্থ্য ছিল না। তবে দুজনেরই ভরসার জায়গা ছিল নিজ নিজ প্রেয়সীরা। দূরে থেকেও যারা সার্বক্ষণিক আমাদের সাথে থেকেছে। বছরের পর বছর শত দুর্ব্যবহার মেনে নিয়ে মূলত সবচেয়ে কঠোর সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করে গেছে। হয়তো আমরা দুজনেই মনোগামী বলে, সহযাত্রাটা সহজ হয়েছে। তবে বহুগামীদের প্রতিও আমাদের কোনো অনুযোগ ছিল না। বিষয়টা রুচির ভেদ বলেই আমরা ভাবতাম। তবে হ্যাঁ, মনোগামিতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ছিল নিশ্চয়ই।

 

রাসেল ভাইয়ের সাথে কত আলাপ বাকি!

অনলাইন জার্নাল ফিল্মফ্রি সম্পাদক, কবি রুদ্র আরিফের তাগাদায় এই লেখাটা শুরু করেছিলাম; রাসেল ভাইকে কবরে শুইয়ে আসার মাত্র তিনদিন পর। প্রায় এক বছরেও এটি শেষ করতে পারিনি মূলত একটি কারণে। বারবারই মনে হয়েছে, কতকিছুই না লেখা বাকি! এই যেমন, বয়সে মাত্র পাঁচ বছরের বড় এসএম তুষারের নির্দেশনায় প্রথম মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন আগুয়ান খেলাঘরের শিশু শিল্পী রাসেল। পরে আবার তারই নির্দেশনায় জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান তুষার। আমৃত্যু তাকেই নিজের ওস্তাদ বলতেন নৃ নির্মাতা। তিনি বলতেন, চিন্তার দারিদ্রতা দূর করতে তাকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন এই মানুষটি। ভেতরের শৈল্পিক সত্তাকে শক্তিশালী করার তাগিদও তিনি পেয়েছেন তুষারকে দেখে। কাকতালীয়ভাবে একই ঘটনা আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। পাড়ার হাশেম কুটিরের এই মানুষটি আমাদের অনেক ‘পোলাপাইনের মাথা খাইছে’ বলে কথিত রয়েছে। তিনি মূলত একজন লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক। সর্বহারা পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮-৮৯ সালে তিনি বিতর্কিত বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের কবিতা অবলম্বণে গণযুদ্ধের পটভূমি নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তারও আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আইজেনেস্টাইন ফিল্ম সোসাইটি। যেদিন রাসেল ভাই ও আমি টের পেয়েছিলাম যে, আমাদের ওস্তাদ একই, সেদিনটার কথা মনে আছে এখনো। এসএম তুষারকে নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছিল আমাদের। পরে আমরা তার একটা লম্বা ভিজুয়াল সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। রাসেল ভাইয়ের কোনো হার্ডড্রাইভ বা কম্পিউটারে সেটা পাওয়া যাবে নিশ্চিত। নৃ সিনেমায় তুষার ভাইকে অভিনয় করানোর পাশাপাশি তার লেখা তিনটি গানও ব্যবহার করা হয়েছে।

রাসেল আহমেদ

এখানে পাঠকদের জন্য আরও কিছু তথ্য টুকে রাখি। প্রবাহ নামের যে ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিলেন রাসেল, সেই ক্লাবটি এখন মসজিদ। তারও আগে রাসেল ছিলেন আগুয়ান খেলাঘর-এর সদস্য। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ডিভি লটারী, ব্যাক টু দ্য প্যাভলিয়নবর্ণমালা যোদ্ধার স্ক্রিপ্ট ডেভেলপ, সিনেমাটোগ্রাফি, ভিডিও সম্পাদনা করেছেন রাসেল। তা স্বরচিত ও পরিচালিত ‘মাইক্রো মুভি’ ব্রেকিং নিউজ, ব্রেক দ্য ভার্টিকাল লাইন, লুক ওয়াইডলি; প্রামাণ্যচিত্র চারণ সম্রাট, মনোরমা বসু মাসিমা এবং মিউজিক্যাল ফিল্ম সোনাই নদীর কাজ– অবশ্য একটিও শেষ করে যেতে পারেননি। ফ্লাই-ওভার ছাড়াও রাসেল আরো যেসব নাটক নির্মাণ করেছেন, তার মধ্যে হোমো-এলিয়েন্সকনফেশন অন্যতম। রাসেল আরো যেসব সিনেমার গল্প বুঁনেছেন, তার মধ্যে ডানা, নিড়ানী, পিকু পালাচ্ছে, ছোট কুমার, বুমেরাং আর ড. মঙ্গালুর কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। সারা দুনিয়ায় রাসেল নামের যত ব্যক্তি আছেন, তাদের সকলকে একত্রিত করে রাসেল উৎসব করার ইচ্ছে ছিল তার। আপাতত আমাদের ইচ্ছে, তার প্রতি জন্মদিনে রাসেল উৎসব করার। যদিও তা ঠিক কোন বছরে শুরু করা যাবে, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

…নৃ’র
পথটাই
আলাদা…

নৃ আসলে মূলত সম্পূর্ণ নতুনদের একটি নির্মাণ প্রয়াস। এর সাথে জড়িতদের মধ্যে দুয়েকজন অভিনয়শিল্পী ছাড়া আর কারোই চলচ্চিত্রে কাজের অভিজ্ঞতা নেই। এই যেমন নিজের কথাই বলি, এত দ্রুত সিনেমায় ক্যামেরা চালাতে হবে– তা আসলে কাজটি শুরুর আগে কল্পনাও করিনি। আর তাই সিনেমা নির্মাণের কাজ যে এতটা সিনেমাটিক, তাও আগে আন্দাজ করতে পারিনি। মেইনস্ট্রিম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে কাজ হয় বা কোন ফর্মুলায় সেখানাকার চলচ্চিত্রগুলো তৈরি হচ্ছে– তা নিয়ে নিজেদের মতো করে গবেষণা করা হয়েছে। ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে দেশ-বিদেশের স্বাধীন নির্মাতাদের নির্মাণকৌশল নিয়েও। এরপর ঠিক করা হয়েছে– নৃ কিভাবে তৈরি হবে। মানে, আমাদের নির্মাণকৌশল কী হবে। এক্ষেত্রে আমাদের ঝুঁকিটাও ছিল অনেক বেশি। কারণ, প্রথমদিন শুট শুরুর পরই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা যতটা নিখুঁতভাবে গল্পটা বুনতে চাচ্ছি, তা এত কম টাকায় সম্ভব না। তখন আমাদের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় বহুকিছু ছাড় দিতে হবে, নয়তো অভাব মেনে নিয়ে কষ্ট করে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র টাকার অভাবে যে আরো কতকিছু ঘটেছে। এখনও যে অভাব কাটেনি। তবে শেষের দিকের এক আলাপে ভাই বলেছিলেন, নৃ‘র পথটাই আলাদা। নৃ মুক্তি পাবে। যাবতীয় দেনা শোধ হবে। রাসেল আহমেদ স্বকীয়রূপে ফিরবে। ইনশাল্লাহ্। তারপর তো.. গোটা পৃথিবীই আমাদের জন্য।

সম্ভবত রুদ্র আরিফই মৃত্যুসংবাদ জেনে বলেছিলেন, “সিরিয়াসলি, ঈয়ন? রাসেল ভাইয়ের সাথে আলাপ বাকি তো অনেক!” আমারও লেখার অনেক বাকি, প্রিয় সম্পাদক। তবুও এইটুকু পাঠিয়েই দিলাম। কারণ আজ ৫ জুলাই [২০১৮] রাসেলের ৪২তম জন্মদিন। বিশদিন আগে তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পেরিয়ে গেছে। তবুও রাসেল ভাইকে ট্রিবিউট করে খোলা ফিল্মফ্রির পেইজে  নতুন কোনো লেখা যুক্ত হয়নি। অতএব, চলবে…

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here