ইন্টারভিউ : ঔপনিবেশিক জড়তার বিপরীতে মৃণালের প্রতিবাদ

1808
Mrinal Sen
Mrinal Senইন্টারভিউ
[Interview]
ফিল্মমেকার  মৃণাল সেন
কাহিনি আশীষ বর্মণ
সিনেমাটোগ্রাফি  কে. কে. মহাজন
মিউজিক  বিজয় রাঘব রাও
প্রডিউসার  মৃণাল সেন প্রোডাকশন
অভিনয়  রঞ্জিত মল্লিক; করুণা ব্যানার্জি; শেখর চ্যাটার্জি; বুলবুল মুখার্জি; মমতা
রঙ সাদাকালো
রানিংটাইম  ১০১ মিনিট
ভাষা  বাংলা
দেশ ভারত
মুক্তি ১৯৭০/৭১
অ্যাওয়ার্ড  ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড [শ্রীলঙ্কা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল]

লিখেছেন বিধান রিবেরু


 

যে বছর, ১৯৬৭ সালে, বামফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়, সেই বছরই নকশালবাড়িতে সংগঠিত হয় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরে পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাঞ্চল, কেরালা ও পূর্ব উড়িষ্যায়। এই সময়ে ভারতে বিভিন্ন ভাষায় বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে যেমন সাহিত্য রচিত হয়, তেমনি কলকাতাতেও ছবি বানান সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন। যদিও মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে নকশালবাড়ি আন্দোলন বা নকশালপন্থী আন্দোলন কোনো প্রসঙ্গই উঠে আসতে দেখা যায়নি। ঋত্বিকের ছবিতে এসব বিষয় তাঁর মতো করেই এসেছে, দেশভাগের বেদনা সেখানে মিশে আছে, আর সত্যজিৎ বিষয়টিকে দেখেছেন একজন আগন্তুকের চোখে। এই দুজনের তুলনায় মৃণাল যেন কলকাতার রাজনীতির মনোস্তত্ত্বে প্রবেশ করতে চাইলেন, সেকালের তরুণদের চোখ দিয়ে কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে চাইলেন। নির্মাণ করলেন একে একে তিনটি ছবি : ইন্টারভিউ [১৯৭০], কলকাতা ৭১ [১৯৭২] ও পদাতিক [১৯৭৩]– যা কলকাতা ত্রয়ী নামে পরিচিতি পায়।

…চাকরিপ্রার্থী কি
চাকরিদাতা দুই পক্ষের
মগজেই সদ্য বিদায়
হওয়া ব্রিটিশ প্রভুদের
প্রেত্মাতা
ভর করে আছে…

এই নিবন্ধে আমরা আলাপ করব আশীষ বর্মনের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ইন্টারভিউ ছবিটি নিয়ে। ইন্টারভিউ বা সাক্ষাৎকারকে ঘিরেই ইন্টারভিউ ছবিটি এগিয়েছে। যারা ছবিটি দেখেছেন, তারা জানেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পুষে রাখার প্রবণতাকে তীব্র সমালোচনা করেছেন পরিচালক। পশ্চিমা পোশাক– কমপ্লিট সুট পরতে পারেনি বা জোগাড় করতে পারেনি বলে চাকরি হয়নি রণজিৎ মল্লিকের। যদিও পুরো ছবিতে একটি কমপ্লিট সুট জোগাড়ের জন্য প্রায় অর্ধেক কলকাতা চষে ফেলে রণজিৎ। একটি প্রেসে কাজ করে সে, কিন্তু আরো একটু ভালো থাকার প্রত্যাশায় প্রাণপণে সে সুট জোগাড়ে নেমে পড়ে। চাকরিপ্রার্থী কি চাকরিদাতা দুই পক্ষের মগজেই সদ্য বিদায় হওয়া ব্রিটিশ প্রভুদের প্রেত্মাতা ভর করে আছে। তাই চাকরি পাওয়ার জন্য অন্যসব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু পোশাকের কারণে চাকরি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় রণজিৎ। অবশ্য এই ক্ষোভ ভেতর থেকে বের করে আনতে সাহায্য করেছে দর্শকদের প্রশ্ন।

Mrinal Sen
ইন্টারভিউ

ছবির শেষ প্রান্তে দেখা যায়, দর্শক প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলছে রণজিৎকে। প্রথমে রণজিৎ চাকরিটি পায়নি বলে বেশ নির্লিপ্ত ভাব দেখাচ্ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে সে আফসোস আর ক্ষোভের আগুনে পুড়ছিল– সেটা বেরিয়ে আসে দর্শকের উসকানিতেই। তাই সবশেষে কাচ ঘেরা সুট-টাই-টুপি পরা এক মানেক্যন বা পুতুলের উপর হামলা চালায় রণজিৎ। ভেঙে চুরমার করে কাঁচ, টেনে ছিড়ে ফেলে পুতুলের গায়ের পশ্চিমা কাপড়। এই কর্মটি করার আগে সে ওই পুতুলের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে– কমপ্লিট সুটে। পরে পুতুলকে নগ্ন করার মধ্য দিয়ে রণজিৎ নিজের ভেতরকার পশ্চিমা প্রভুর প্রতি যে অবনত ভাব সেটাকে দূর করে, ঔপনিবেশিক মানসিকতার অবসান ঘটাতে চায় রণজিৎ। এখানটায় ছবির শুরুতে যেসব দৃশ্য দেখানো হয়েছিল, সেগুলোই আবার পুনরায় দেখানো হয়। দেখানো হয়, কলকাতার রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ব্রিটিশ রাজের বসানো বড়লাটের মূর্তি। গলায় দড়ি বেঁধে নামানো হয় বড়লাটকে। ছবির শুরুতেও মূর্তি অপসারণ ও ভিক্টোরিয়া ম্যামোরিয়ালের দৃশ্য দেখানো হয়।

রণজিৎ শেষ দৃশ্যে যখন সব ভাঙচুর করছে, তখন হঠাৎ করেই দেখা যায়, একজন স্লোগান দিচ্ছেন ‘ইনকিলাব…’, সাথে সাথে ক্যামেরা চলে যায় কৃষকদের মিছিলে, ভিয়েতনামের যুদ্ধে, ভিনদেশের বিপ্লবে, আবার ফেরে কলকাতার রাজপথে, প্রতিবাদ মুখর শ্রমিক কৃষক জনতার ভিড়ে, মারমুখী তারা, রঞ্জিতের মতোই, তারাও প্রচলিত সবকিছুকে ভেঙে ফেলতে চায়, রণজিৎ যেমনটা চাইছে। সমাজের মনে গেড়ে বসা ঔপনিবেশিক প্রতিমাকে গুড়িয়ে দিতে চায় রণজিৎ। শেষ দৃশ্যটি অঙ্কিত হওয়ার আগে বা দর্শক রণজিৎকে উসকে দেয়ার আগে রঞ্জিতের যে সামাজিক চরিত্র দেখা যায়, সেটা দোদুল্যমান মাঝারি বুর্জোয়ার চরিত্র।

… বিপ্লবী হয়ে
ওঠার মন্ত্র যেন
বুক থেকে টেনে
মুখে, তারপর
ক্রোধে
পরিণত করা হয়…

দোদুল্যমান মাঝারি বুর্জোয়া চরিত্র বলার কারণ হলো, রণজিৎ ছবির শুরুতেই মাকে বলছে, সে নতুন চাকরিতে বর্তমান চাকরির চেয়েও অনেক বেশি বেতন পাবে। আর বাড়তি কমিশন তো থাকবেই। মানে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে রণজিৎ, তার অবস্থা যদি হয় মধ্যবিত্ত, সে উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রেমিকাকে বিয়ে করে আর দশটা বুর্জোয়া পরিবার যেমন, ঠিক তেমনটি হওয়ার ইচ্ছা তারও আছে। মনে করে দেখুন, রণজিৎ সাক্ষাৎকারেরর দিন সকালে গুণগুণ করে গাইছে– ‘আমার সোনার হরিণ চাই’, ঠাকুরের এই সোনার হরিণ বুর্জোয়া সমাজে ফ্যাটিশ বা বাড়তি ভোগলিপ্সা বৈ কিছু নয়। এই ফ্যাটিশ বা বাড়তি চাকচিক্যময় জীবন যা জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য নয়, সেই জীবন যাপনের জন্য রঞ্জিতের একখানা ‘জাতে ওঠার’ মতো চাকরির দরকার ছিল। এই দিকটাই এক দর্শক রণজিৎকে ধরিয়ে দেন ছবির শেষ পর্বে। এখানে যেন রণজিতের ভেতরকার প্রতিবাদী মানুষটাকে টেনেহিচড়ে বের করে আনা হয়– প্রতিবাদ করার জন্য– অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে। বিপ্লবী হয়ে ওঠার মন্ত্র যেন বুক থেকে টেনে মুখে, তারপর ক্রোধে পরিণত করা হয়। যে ক্রোধ সামিল হয় বিশ্বের আরো সংগ্রামী মানুষগুলোর সাথে।

Mrinal Sen
ইন্টারভিউ

এই দোদুল্যমান মাঝারি বুর্জোয়া সম্পর্কে মহাত্মা মাও সেতুঙ বলেছিলেন, এরা আসলে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি। এই শ্রেণিটি তখনই অসহায় বোধ করে যখন বিদেশি পুঁজির আঘাতে নিদারুণ উৎপীড়ন ভোগ করে। রণজিৎ কিন্তু বিদেশি কোম্পানির মোটা অঙ্কের মাইনে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু কোম্পানির ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে সে বঞ্চিত হয়, এটা উৎপীড়নই বটে। মাও সেতুঙ বলছেন, উৎপীড়িত হলে তখন এই মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণিটি ‘বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সমরনায়কদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করে।’ সমরনায়কের বিষয়টি ইন্টারভিউতে নেই, তবে সাম্রাজ্যবাদ কিন্তু আগাগোড়াই আছে। এই সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই বিরোধিতা করেছে রণজিৎ।

মৃণাল সেন ছবির নায়ক রণজিৎ সম্পর্কে বলছেন, শেষ ভাগে রণজিৎ যখন ভাংচুর শুরু করে, তখন রণজিৎ আর সেই চাকুরিপ্রার্থী রণজিৎ নেই, ‘সে তখন সেই মুহূর্তে একটি আইডিয়া, একটা কনসেপ্ট। সে যখন সমস্ত কিছু ভাঙতে আরম্ভ করে তখন একটা কনসেপ্টের স্তরে তার উত্তরণ ঘটেছে, মানুষের চেহারা নিয়ে একটা আইডিয়াতে এসে দাঁড়িয়েছে। সে যখন ভাঙতে আরম্ভ করে, তখন সমস্ত ব্যাপারটা একটা সিম্বলের পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়।’

মাও সেতুঙের কথা অনুযায়ী, রণজিতের মতো এই মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণিই বিপ্লবের শত্রু হয়ে উঠতে পারে, নিজেদের সুযোগ সুবিধা পেলে। শত্রু হওয়া মানে অসহযোগিতা করা, নিজেদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা। আর সেটা করতে গেলে অবধারিতভাবেই বিরোধিতা করতে হবে তাদের, যারা এই ঔপনিবেশিক শক্তির পুরোপুরি অবসান চায়। সুবিধা বঞ্চিত হয়ে রণজিৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু এক পর্যায়ে রণজিৎ বারবারই নিজেকে কল্পনা করছিল পশ্চিমা সাহেবদের পোশাকে, তখন কিন্তু এই শ্রেণির দোদুল্যমানতাই ফুটে ওঠে, দৃশ্যমান হয় মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণির শ্রেণিচরিত্র। ধরুন, রণজিৎ চাকরিটা পেয়ে গিয়েছে, সে কি বিদ্রোহী হয়ে উঠত? উঠত না। সে চাকরি পেয়ে বিয়ে করে আর দশটা সুবিধাভোগী মানুষের মতো জীবন কাটাতো। সেই স্বপ্নই দেখে আসছিল রণজিৎ। তবে তেমনটি হয়নি। আমরা দেখি, বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কালে মৃণাল সেন আমাদের কয়েক ফ্রেমের বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখালেন, ঠিক যেন সেই মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির জ্যাবরিস্কি পয়েন্ট-এর শেষ দৃশ্য, যেখানে বুর্জোয়া স্থাপনাকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়া হয়, সেরকমই এক মূর্তিভঙ্গকারী দৃশ্য আমরা রচিত হতে দেখি ইন্টারভিউতে। পরিচালক বিষয়টিকে একটি প্রতীক বা সিম্বলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন বলেই ছবিতে রণজিৎ শেষ পর্যন্ত রণমূর্তি ধারণ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে।

…পর্যটকের দৃষ্টিতে নয়, বরং
স্থানীয় বাসিন্দা হয়েই
সংবেদনশীল শিল্পীর মতো
কলকাতা শহরের
নানা সঙ্কটের ভেতর এই
ঔপনিবেশিক মানসিকতার সঙ্কটকে
চিহ্নিত করতে চেয়েছেন
মৃণাল সেন…

পর্যটকের দৃষ্টিতে নয়, বরং স্থানীয় বাসিন্দা হয়েই সংবেদনশীল শিল্পীর মতো কলকাতা শহরের নানা সঙ্কটের ভেতর এই ঔপনিবেশিক মানসিকতার সঙ্কটকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন মৃণাল সেন। এবং এটাকে একটি ধারণা বা কনসেপ্ট হিসেবে নিয়ে কিছু প্রতীক হাজির করতে চাইলেন দর্শকের সামনে। এবং এই প্রতীকে দুটি প্রতিপক্ষকে যতটা সম্ভব শৈল্পিক করে তুলতে চাইলেন তিনি, আর এতে অনুসরণ করলেন পূর্বসুরীদের দেখানো পথ। বলছি জর্মন কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ নির্দেশক বেরটল্ট ব্রেখটের কথা। নাটক সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত চিন্তামালার ভেতর তিনি মঞ্চে অ্যালিয়েনেশন এফেক্ট বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছিলেন এই কৌশলটি মূলত নতুন সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পক্ষে হাজিরা দিয়ে যায়, যে পদ্ধতি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। অ্যালিয়েনেশন এফেক্ট নতুন কিছু নয়, চীনের মঞ্চে এটি পুরনো একটি বিষয়, ‘অ্যালিয়েনেশন এফেক্টস ইন চাইনিজ অ্যাক্টিং’ শিরোনামের বিখ্যাত প্রবন্ধে ব্রেখট সেটা আলোচনা করেছেন। কিন্তু এটিকে নতুন করে মঞ্চে প্রবেশ ঘটানোর উদ্দেশ্য কিন্তু দর্শককে আধুনিক সময়ের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মুখোমুখি করা। বিচ্ছিন্ন করার নয়া কৌশল প্রয়োগের ফলে, ব্রেখট বলছেন, দর্শক মঞ্চে উপস্থাপিত বিষয়টিকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে। সে কল্পিত চতুর্থ দেয়ালের ওপারে অদৃশ্য অবস্থায় বসে আছে, এমন ভ্রমের মধ্যে থাকে না। অভিনেতারা কৌশলটির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন দর্শকের একটি ভিন্ন অবস্থান রয়েছে, তার অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হওয়া বা চরিত্রের অধীন হওয়ার দরকার নেই।

Mrinal Sen
ইন্টারভিউ’র সেট । বুলবুলকে শট বোঝাচ্ছেন মৃণাল

ব্রেখট চীনা অভিনয় ও বিচ্ছিন্ন করার কৌশল সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন, বুর্জোয়া নাটক পুরো মানবজাতির কথা বলতে চায়, ভুলিয়ে দিতে চায় দর্শকের বিশেষ পরিস্থিতির কথা। ‘অভিনয়ের নয়া কৌশলের উপর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা’ রচনায় ব্রেখট এই অ্যালিয়েনেশন এফেক্ট জিনিসটা আসলে কেমন সেটা বুঝাতে গিয়ে উদাহরণ টানেন প্রাত্যহিক জীবন থেকে। তিনি বলেন, এই কৌশল অনেকটা এমন প্রশ্নের মতো– তুমি কি কখনও তোমার ঘড়ির দিকে ভালো করে তাকিয়েছ? আমরা ঘড়ির দিকে সারাদিনে বহুবার তাকাই, সময় দেখার প্রয়োজনে, কিন্তু ঘড়িটিকে লক্ষ্য করার জন্য কি তাকানো হয়? সময়টাকে লক্ষ্য করা হয়, কিন্তু সময়দানকারী যন্ত্রটির দিকে আমরা নজর দেই না। বিচ্ছিন্ন করার কৌশলটি অনেকটা সেরকমই।

মানুষকে নাটকের চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম করে, দর্শককে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ভুলিয়ে দিয়ে এক ধরনের ক্যাথারসিস ঘটাতে নারাজি ব্রেখট। তাঁর দেখানো এই ভাবনার দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়েই আমরা দেখি ইন্টারভিউ ছবিতে ‘বাস দৃশ্য’ রচনা করছেন মৃণাল সেন। সেই দৃশ্যে ব্রেখটিয় কায়দায় রণজিৎ হুট করে দর্শকের দিকে, মানে ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলতে শুরু করে তার আসল নাম, এবং পেশার কথা। তখন তিনি অভিনেতা রণজিৎ। আরো বলতে থাকেন, রণজিতের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা নারীটিও একজন অভিনেত্রী। তখন পথের পাাঁচালির কিছু দৃশ্য দেখিয়ে দেওয়া হয়। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ছবিতে সর্বজয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই দৃশ্যে রণজিৎ যে শুধু নিজেদের অভিনয়ের কথা ফাঁস করেন তা নয়, পরিচালক মৃণাল সেনকেও এখানে দৃশ্য ধারণ করতে দেখা যায়। মানে, দর্শক যে একটি কাহিনিচিত্র দেখছেন সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়া হয় কৌশলটির মাধ্যমে। এমনটা করা হলো কেন?

…দর্শক
যেন নিষ্ক্রিয়
না থেকে, সক্রিয় হয়ে
ওঠে, একটা মিথষ্ক্রিয়া
যেন তৈরি হয়, সেই
প্রয়াসটাই আমরা
দেখি…

কারণ, মৃণাল সেন রণজিতের ভেতর দিয়ে মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণির মনোবাসনা পূরণ করতে চাননি, বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, পরিচালক হিসেবে তিনি কিছু কথা বলতে চান, এবং সেসব কথা কয়েকটি চরিত্র ও কাহিনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চান। এভাবেই তিনি একটি ধারণাকে রূপক আকারে হাজির করার কথা বলতে চান, সেটা দর্শককে অদৃশ্য চতুর্থ দেয়ালের ওপারে রেখে নয়, দর্শককে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করেই বলতে চান। দর্শক যেন নিষ্ক্রিয় না থেকে, সক্রিয় হয়ে ওঠে, একটা মিথষ্ক্রিয়া যেন তৈরি হয়, সেই প্রয়াসটাই আমরা দেখি ‘বাস দৃশ্যে’। একই রকম দৃশ্য রচিত হতে দেখা যায় শেষ পর্যায়ে। যখন দর্শকের পক্ষে দর্শকরূপী একজন বাহাসে যায় রণজিতের সঙ্গে। রণজিৎ চরিত্রটি একটি চরিত্রই মাত্র। মৃণাল সেন কাহিনিচিত্রটি সাজিয়েছেন শুধু উদাহরণ দেয়ার জন্য, বলতে পারেন রণজিতের চাকরির জন্য হন্যে হয়ে পশ্চিমা পোশাক খোঁজা একটি উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য হল বাঙালির ঔপনিবেশিক মনোভাব, ভৃত্যের জীবনকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতাকে কটাক্ষ করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই আবার খুব খোলামেলাভাবেই দেখাতে চেয়েছেন সেন। আগেই বলেছি চলচ্চিত্রের চরিত্র ও দর্শকের মাঝে যে কল্পিত চতুর্থ দেয়ালটি থাকে সেটিকে তিনি ভেঙে দিয়েছেন ওই একটি কারণেই।

Mrinal Sen
ইন্টারভিউ

চলচ্চিত্রে নানা মাত্রিক নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে মৃণাল ঘা মেরে দর্শক জাগানোর কাজটি করতে চেয়েছেন। আমাদের বিচারে ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও, শিল্পের বিচারে মৃণাল শতভাগ সফল হয়েছেন, তাই তাঁর সৃষ্টি অতিক্রম করেছে কালকে।


প্রথম প্রকাশ • বাংলা ট্রিবিউন । নিউজ পোর্টাল, বাংলাদেশ ।। ১৫ মে ২০১৭
মৃণাল সেনের জন্মদিন [১৪ মে] উপলক্ষে লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হলো
Print Friendly, PDF & Email
লেখক, সাংবাদিক, সিনে-সমালোচক। ঢাকা, বাংলাদেশ। সিনে-গ্রন্থ : চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা; চলচ্চিত্র বিচার; বলিউড বাহাস; উসমান সেমবেনের চলচ্চিত্র হালা

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here