জহির রায়হান: একজন পূর্বসূরী ও আমরা

857
জহির রায়হান
জন্ম । ১৯ আগস্ট ১৯৩৫; ফেনী, বাংলাদেশ
অন্তর্ধান । ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২; ঢাকা, বাংলাদেশ

লিখেছেন । প্রসূন রহমান


 

কোনো সৃজনশীল প্রাণ যখন দেহত্যাগ করে, তখন সেদিনটাকে আমরা মনে রাখি তার মৃত্যুদিন বা প্রয়াণ দিবস হিসেবে। একমাত্র জহির রায়হান এর বেলায় এটি ‘অন্তর্ধান দিবস’। আভিধানিক অর্থে ‘মৃত্যু’ বা ‘প্রয়াণ’-এর সাথে ‘অর্ন্তধান’-এর তেমন পার্থক্য না থাকলেও শব্দটি আর কারো বেলায় ব্যবহার করা হয় না। এই অন্তর্ধান শব্দটি যে ব্যঞ্জনা ও হাহাকার তৈরি করে, তা যেমন মৃত্যুর চেয়ে খানিকটা বেশী; তেমনি আবার এর মাঝে লুকিয়ে থাকে খানিকটা ফিরে পাওয়ার আশাবাদ। ব্যতিক্রমী এই শব্দবন্ধটি তার বেলায় কে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন– জানা নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি আর ফিরবেন না। কিন্তু তিনি আছেন তার সৃজনশীল কাজের মাঝে। তিনি আছেন তার উত্তরসূরীদের চেতনায়, কাজে, মননে ও চর্চায়।

জহির রায়হান আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন চলচ্চিত্রকার। আ কমপ্লিট ফিল্মমেকার অব দিস সয়েল। জহির রায়হান এমন একটি সৃজনশীল স্পন্দনের নাম, যা আমাদের অনেকের শিরায় প্রবাহিত। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মূলধারা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসা জহির রায়হান তার লেখনীর মতো চলচ্চিত্রেও বইয়েছিলেন শিল্পের স্নিগ্ধ সুবাতাস। আর শুধু নির্মাণের মাঝেও সীমাবব্ধ রাখেননি নিজেকে। পাশাপাশি কাজ করেছেন উত্তর প্রজন্ম তৈরিতে, উদ্যোগ নিয়েছেন চলচ্চিত্র শিল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়নের।

johir raihan
জহির রায়হান । ‘কখনো আসেনি’র সেটে

জহির রায়হান বেঁচে থাকলে এ বছর তার বয়স হতো ৮২। এতো বছর বেঁচে থেকেও সব জীবন খুব কার্যকরী হয় না। কিন্তু মাত্র ৩৭ বছরের জীবনকালে যার এত অর্জন, তার সৃজনশীল সক্রিয় দীর্ঘ জীবন কে না আশা করবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নিজে অসাধারণ দুটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। প্রযোজনা করেছিলেন আরো দুটি। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর অন্তত একটা দশক বেঁচে থাকলে হয়তো আজ এখনো ‘মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র না থাকার আফসোসটা করতে হতো না। তাকে যারা দৃশ্যপট থেকে উধাও করে দিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্য কী এটাই ছিল? জাতির যুদ্ধদিনের জলজ্যান্ত ইতিহাস পরম মমতায় সেলুলয়েডে ধরে রাখবেন, এটা তাদের কাম্য ছিল না। সেই পরাজিত শক্তির দোসরদের অনেকের বিচার হযেছে। কিন্তু যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, চলচ্চিত্র মাধ্যমে আমাদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস তৈরিতে যে বিলম্ব, সেই শূণ্যতা পূরণ করব কী করে!

…অমিত সম্ভাবনার যে স্বপ্ন,
সে স্বপ্ন ছড়িয়ে যায়
প্রাণ থেকে প্রাণে। যথাযথ
সৃজনশীল যে ভাবনা, যে
ভাবনার পেছনে দর্শন
থাকে, যে ভাবনার পেছনে মাটির
প্রতি দায় থাকে, আত্মপরিচয়ের
অনুসন্ধান থাকে, সে ভাবনা
নতুন প্রাণে আলো খুঁজে
পায়…

বলা প্রয়োজন, অমিত সম্ভাবনার যে স্বপ্ন, সে স্বপ্ন ছড়িয়ে যায় প্রাণ থেকে প্রাণে। যথাযথ সৃজনশীল যে ভাবনা, যে ভাবনার পেছনে দর্শন থাকে, যে ভাবনার পেছনে মাটির প্রতি দায় থাকে, আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান থাকে, সে ভাবনা নতুন প্রাণে আলো খুঁজে পায়। জহির রায়হানের যারা প্রধান উত্তরসূরী ছিলেন তাদের মধ্যে আলমগীর কবিরকে আমরা পেয়েছি তারই মতো প্রবলরূপে। আর তার আলোক-বর্তিকাটি বহন করেছেন তারেক মাসুদসহ তার পরের প্রজন্মের আরো কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। যারা এখনো পর্যন্ত সক্রিয়। মাঝখান থেকে শুধু হারিয়ে গেছেন তারেক মাসুদ।

johir raihan
জহির রায়হান । ‘বেহুলা’র শুটে…

জাতির জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষগুলোই কেন জানি হারিয়ে গেছেন অসময়ে। হারিয়ে গেছেন দূর্ঘটনায়, অথবা খুন হয়েছেন নির্মমভাবে। জহির রায়হান, আলমগীর কবির কিংবা তারেক মাসুদ– কারোরই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি। আমরা যারা তাদের উত্তরসূরী তাদের জন্যে কেমন মৃত্যু লেখা আছে, জানি না। শুধু জানি, শত প্রতিকূলতার মাঝেও সে আলোকবর্তিকাটি বয়ে নেয়ার দায় আমরা অনুভব করি।

জহির রায়হান, আলমগীর কবির কিংবা তারেক মাসুদের মতো মহাপ্রাণদের স্মরণ করবার জন্যে হয়তো আলাদা করে জন্ম-মৃত্যুর দিন হিসেব করবার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু আমাদের ভুলোমনের চেতনায় শান দেয়ার জন্যে উপলক্ষগুলোকে ঢেউ হিসেবে ব্যবহার করতে বোধহয় অসুবিধে নেই।

কালের আবর্তে সবকিছুই একসময় হারিয়ে যায়। শূণ্য থেকে যা কিছুর উৎপত্তি, তা আবার মহাশূণ্যে বিলীন হয়ে যায়। সেই হারিয়ে যাওয়া বৈশ্বিক উপাদান, লেখা-নালেখা ইতিহাস অথবা প্রাণের স্পন্দন পরিবর্তিত রূপে তবুও কিছু কিছু থেকে যায় বছরের পর বছর ধরে। থেকে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। যা আমরা অবচেতনে বহন করে চলি আমাদের জিনে, আমাদের চেতনায়, মৌন করোটিতে। বিশ্বাস করি, জহির রায়হান নামের সৃজনশীল প্রাণের স্পন্দন আরো কয়েকটি প্রজন্মে একইভাবে প্রবাহমান থাকবে।

Print Friendly, PDF & Email
লেখক ও ফিল্মমেকার; ঢাকা, বাংলাদেশ ।। ফিচার-ফিল্ম: সুতপার ঠিকানা [২০১৫]; জন্মভূমি [২০১৮]; ঢাকা ড্রিম [২০২১] । ডকু-ফিল্ম: ধান ও প্রার্থণা [২০০৮]; দ্য ওয়াল [২০০৯]; ফেরা [২০১২]; নিগ্রহকাল [২০১৯]; নদী ও নির্মাতা [২০১৯]; ব্যালাড অব রোহিঙ্গা পিপল [২০২০]; এই পুরাতন আখরগুলি [২০২০] ।। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান: ইমেশন ক্রিয়েটর ।। উপন্যাস: ধূলার অক্ষর [২০০৯]। কাব্যগল্প: ঈশ্বরের ইচ্ছে নেই বলে [২০০৯]। কলাম সংকলন: সৃজনশীলতার সংকটে স্যাটেলাইট চ্যানেল [২০১২]। ফিল্ম-বুক [সম্পাদনা]: চলচ্চিত্রযাত্রা [তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখার সংকলন]। ওয়েবসাইট: www.imationcreator.com

3 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here