ঋত্বিক ঘটকের সংস্কৃতি বিচার

2383
ঋত্বিক ঘটক
জন্ম : ৪ নভেম্বর ১৯২৫ । ঢাকা, বাংলাদেশ
মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ । কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

লিখেছেন । সাখাওয়াত টিপু


বাংলা চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটক একটি ঘরানার নাম। ঘরানার কথাটার ভেতর ‘সংস্কৃতির রাজনীতি’ আছে। শিল্পের পোশাক যেভাবে দর্শক কিংবা মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তাতে হয়ত দৃষ্টি নন্দন বা সৌন্দর্যের স্বাদটুকু মেলে। এটা ঠিক ভোক্তার বাহ্যিক সংস্কৃতির রাজনীতি। কিন্তু পোষাকের ভেতরের মর্মবস্তু বা ভাব কেমন তা খতিয়ে দেখা তো সংস্কৃতির অন্তর্গত কাঠামোর রূপেরই সন্ধান। এই সন্ধান কি ঋত্বিক করেছিলেন? ঋত্বিক ঘটককে নিছক শিল্পী-লেখক-চলচ্চিত্রকার বলতে পারলে একটা সহজ সমাধান আমরা পেতে পারতাম। কিন্তু তিনি তারও বেশিকিছু। সেটা কেমন? ঋত্বিক নিয়ে লিখতে গিয়ে গেল দশকের একটা ঘটনা মনে পড়ল। ঢাকার এক ঘরোয় আড্ডায় কলকাতার নামজাদা অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ পাই। তাতে চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম কলকাতার আরেক লেখক দেবেশ রায় প্রণীত শিল্পের প্রত্যেহে বইয়ের একখানা লেখার দৌলতে। তবে দেবেশ রায়ের উছিলায় সংস্কৃতি বিচারকে খানিক বাজিয়ে দেখাই ছিল আমার ইচ্ছা। দেবেশের বইয়ের স্মৃতি থেকে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘সত্যজিৎ রায়ের কোন কোন চলচ্চিত্র ইউরোপের চোখ দিয়ে বানানো। সেইখানে ঋত্বিক অনেক স্বদেশি।’ এই বিষয়ে আপনার মত কি? প্রশ্নটা আচমকা ছিল না, তবুও এমন প্রশ্নে তিনি বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। এবং বললেন, ‘কোথাকার কোন লোক সত্যজিৎ সম্পর্কে কি বললো তাতে কি আসে যায়।’ সেদিন সন্ধ্যায় বাতাস খানিকটা গম্ভীর হয়ে যাওয়ায় আমরা অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই। ঘন বাতাসে সত্যজিৎ রায় আর ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে আমার জিজ্ঞাসারও সুরাহা হয় নাই। তবে আমার কাছে বাংলা চলচ্চিত্রে দুটি ঘরানা বেশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের না জবারের ভেতর দিয়ে। আমার প্রশ্ন ছিল নিছক নিরীহ গোছের। কাউকে ছোট বা বড় করার জন্য নয়। সবাই বড় শিল্পী। সত্যজিতের সাথে ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের তুলনার প্রশ্ন ভিন্ন, কেবল বুঝতে চেয়েছিলাম সংস্কৃতির রাজনীতিটা আসলে কেমন।

ঋত্বিক ঘটক

‘সংস্কৃতির রাজনীতি’ আর ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ দুটো এক পদ আর পদার্থ নয়। সাধারণ চিন্তায় বলা চলে ‘সংস্কৃতির রাজনীতি’ হচ্ছে সংস্কৃতি ক্রিয়ার রাজনৈতিক ফলাফল। মানে চলতি সংস্কৃতিক তৎপরতা সমাজে কি রকম রাজনৈতিক অর্থ উৎপাদন করে। এটা অনেকাংশে পরিমাণবাচক ফলাফল। অন্যদিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শের ধারণা বা ধারার ভেতর যে সংস্কৃতি জন্ম লাভ করে। মানে আদর্শের গুণবাচক চিন্তার ফসল। কাঠামোগত দিক থেকে বিচার করলে দুটোই রাজনৈতিকভাবে সমাজের সাথে সম্বন্ধবাচক। সংস্কৃতির এই দুটোদিক নিয়ে ঋত্বিক ঘটকও প্রশ্ন তুলেছিলেন ১৯৫৪ সালে। তাঁর বিখ্যাত থিসিসের নাম অন দা কালচারাল ফ্রন্ট বা সংস্কৃতির সীমানা প্রসঙ্গে। থিসিসের উদ্ভব হয় তৎকালীন গণনাট্য সংঘের কর্ম তৎপরতা নিয়ে। কিন্তু ঋত্বিকের থিসিস গড়ায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির তাত্ত্বিক ভিত আর কর্ম পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে। ঋত্বিক ঘটকের জীবনাঙ্গ ও গবেষক সুরমা ঘটক জানান, ‘যদিও এই দলিলে আমার আর মমতাজ আহমেদ খানের নাম উল্লেখিত হয়েছে, তথাপিও আমি বলব, এই দলিলটি সম্পূর্ণ এককভাবেই ঋত্বিককুমার ঘটক রচনা করেছিলেন।’ দলিলটি মূলত কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বোঝাপড়া, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার দিকনির্দেশনা। মজার ব্যাপার হল, ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়। তার দুই বছর পর ১৯৫১ সালে গোপন পার্টি সভায় ঋত্বিককে দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের [আইপিটিএ] ‘রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ আর কর্মকৌশল কি হবে’ তা নিয়ে একটি দলিল লিখতে। ঋত্বিক এই দলিল পার্টিতে জমা দেবার পর রব ওঠে, তাকে পার্টি থেকে বাদ দেয় হবে। সে সময় ঋত্বিকের প্রতি বামপন্থিনেতা জ্যোতি বসুর সমর্থন থাকার পরও ম্যাক্সিম গোর্কির লোয়ার ডেপথস্ নাটকের রিহের্সাল বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। সবচে’ বেদনাদায়ক ব্যাপার এক বছরের মাথায়। ঋত্বিক ও ঋত্বিক: পদ্মা থেকে তিতাস বইয়ে সুমরা ঘটকের ভাষ্য, ‘১৯৫৫ সালের অক্টোবরের শেষে ঋত্বিক একটি চিঠি পেলেন। চিঠিতে তাকে বলা হয়েছে, তিনি আর কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য নন।’ দলিলটি ১৯৯৬ সাল নাগাদ ফাইল চাপায় ছিল। তবে উদ্ধার করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আর শেষ নাগাদ ইংরেজিতে লেখা দলিলটি ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট প্রকাশ করে। কমিউনিস্ট পার্টি ভেতরগত সমস্যার কথা নাইবা বললাম, কিন্তু কি আছে অন দা কালচারাল ফ্রন্ট দলিলে?

ঋত্বিক ঘটক

ছোট্ট পরিসরে এই দলিলের পর্যালোচনা সম্ভব নয়। আলোচনার জন্য আরও বিস্তারিত পরিসর দরকার। তবে আমরা দেখবো ঋত্বিক কিভাবে সংকট চিহ্নিত করেছেন। আর কিভাবে চিন্তা খাটিয়েছেন। প্রস্তাবনা আর উপসংহার বাদে দলিলটি তিন পর্বের– প্রথমপর্ব ‘কমিউনিস্ট শিল্পীরা ও পার্টি’, দ্বিতীয়পর্ব ‘কমিউনিস্ট শিল্পীরা ও জনগণ’ আর তৃতীয়পর্ব ‘কমিউনিস্ট শিল্পীরা ও শিল্প’। প্রস্তাবনায় ঋত্বিক গণসংযোগের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। তার মত, ‘‘শিল্প সংগঠক’ বলে কিছু নেই। এটা একটা অতি-ব্যবহৃত ভয়ংকর শব্দ। এই ধরনের কোন কাজের অস্তিত্ব নেই। আমাদের যা করণীয় তার চরিত্রই বলে দিচ্ছে যে একমাত্র শিল্পীরা একাজ করতে পারেন। শিল্পী নয় এমন সংগঠকদের ওপর একাজের দায়িত্ব দেওয়া আর এস্কিমোদের শিকার-সঙ্গীত দিয়ে হটেনটটদের বিপ্লবী কাজে উদ্বুদ্ধ করা একই ব্যাপার। এটা গণসংগঠন নয়, এর সমস্যাগুলোর চরিত্রও সাধারণ নয়। যদি সেরকম মনে করা হয়, তাহলে তা হবে নির্বোধের মত গিলে ফেলার ব্যাপার। সংগঠন তৈরির ক্ষেত্রে তা বিপজ্জনক এক দৃষ্টিভঙ্গি।’ প্রস্তাবনার অন্যত্রে আবার বলেন, ‘কোনও সংশয় না রেখে ঘোষণা করা যেতে পারে, সাংস্কৃতিক সমস্যাটা হল মূলত পার্টি স্তরে, প্লাটফর্ম স্তরে এবং শিল্পস্তরে সংগঠনের সমস্যা। দ্বিধাহীনভাবে, কোনও সংশয় না রেখে ঘোষণা করা যেতে পারে, যতই নিষ্ঠা থাকুক, পার্টি কমরেডদের এই যে সংশয়ী মনোভাব, এই মনোভাবই পার্টি এবং সংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে।’ আবেগী ঋত্বিক দারুণভাবে সমস্যা চিহ্নিত করলেন। এমনকি ‘শিল্প সংগঠক’ নিয়ে তার তত্ত্ব যুৎসই। ‘উপরি-কাঠামো’র ভিত দিয়ে তিনি সমস্যার বিচার করলেন। কিন্তু সাধারণ জনগণের জায়গা দেখলে সেটা আরও যুৎসই হতো বৈকি। ‘সাধারণ গণসংগঠন’ আর ‘সাংস্কৃতিক গণসংগঠন’ এক পদার্থ নয়। চিন্তা আর কাজের ধরনের কারণেই সেটা আলাদা আকারেই আছে। আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকার পরও ‘আদর্শিক সমন্বয়’ বিবেচনায় নিতে পারতেন তিনি। হয়ত তিনি পার্টির ভেতরে দেখতে পাননি বলেই খানিকটা উষ্ণ ছিলেন। ফলে পার্টি আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভেদরেখা ‘সংশয়’ আকারে দেখেছেন। দর্শনের দিক থেকে ‘সংশয়’ থেকে দুটি দিকের উদয় হতে পারে। একদিক সমস্যাগত প্রশ্ন, আরেকদিক সন্দেহগত দূরত্ব। তবে ঋত্বিক সন্দেহগত দূরত্বকে ‘দ্বিধাহীনভাবে’ সমস্যা আকারে চিহ্নিত করেছেন।
দলিলের প্রথম পর্বে ‘কমিউনিস্ট শিল্পীরা ও পার্টি’ অধ্যায়ে ঋত্বিক ফ্রিদেরিক এঙ্গেলসের সহায় নিয়েছেন। সহায়পন্থার একদিকে ‘সাবজেক্টিভ’ আর দিক ‘অবজেক্টিভ’। পার্টি-লাইনের মওকা হিসেবে দুইভাব বিশেষ মার্কামারা। চালু বাংলায় এই ভাবকে ‘বিষয়ীগত’ আর ‘উদ্দেশ্যগত’ চিন্তা আকারে দেখা হয়। আরও সহজ বাংলায় বলা চলে ‘আপন’ আর ‘আকার’। এঙ্গেলস ‘আকার’ ভাবের অংশ হিসেবে ‘আপন’ ভাবকে দেখেছিলেন। আপন আকারকে চিহ্নিত করে ঠিকই, কিন্তু আপন নিয়ন্ত্রিত হয় আকার দিয়েই। যে ভিতের উপর পার্টি দাঁড়ায় ঋত্বিক সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এহেন কর্ম পদ্ধতিকে বলা হয় ‘পার্টি-টাস্ক’। প্রশ্ন হচ্ছে, পার্টির সাথে শিল্পী বা সংস্কৃতির সম্বন্ধ কি? এই বেলায় ঋত্বিক ভ্লাদিমির লেনিনের ১৯২৩ সালের ভাষণ ‘ইয়ং কমিউনিস্ট লিগের থার্ড অল রাশিয়ান কনফারেন্সে’ প্রদত্ত ভাষণ আমলে নিয়েছেন। লেনিন বলেছেন, ‘সংস্কৃতি সমাপ্তিহীন একরেখায় এগিয়ে চলে।’ তবে ঋত্বিক লেনিনের কথাকে আগবাড়িয়ে বললেন, ‘পূর্বতন শ্রেণী সমস্যাগুলোতে মানুষের আহরিত জ্ঞানকে চিত্রিত করাই হল নতুন সংস্কৃতি।’ তিনি এও বলেছেন, ‘ক্ষমতার প্রশ্নটাই হল সমস্ত সমস্যার চাবিকাঠি। বুঝতে হবে, বিপ্লব হল পরিণত মনস্কের কাজ।’ ফলে তিনি চাইতেন, জাতীয় বুর্জোয়া মানবতাবাদী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে মতৈক্য গড়ে তুলতে। তাদের কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে আসা। আদর্শিক পতাকাতলে সামিল করা। তিনি সমালোচনা করেছেন ‘সেক্টেরিয়ানিজম’কে। এও বলেছেন, ‘এটা আজকের সংস্কৃতির প্রস্তরশষ্যা। উপরে মাটি, নিচে কঠিন পাথর।’ সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সরল নয়। শুধু উৎপাদন-কাঠামোও তার নিয়ন্তা নয়। উৎপাদন কাঠামোকে ভোক্তার দিক থেকে দেখা যায়। মানুষের যে অপার সৃষ্টিশীলতা সেটা তো সংস্কৃতি আকারে জায়মান থাকে। ফলে সম্পর্কটাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ঋত্বিক এই ক্ষেত্রে মনে করতেন, ‘পার্টি-শিল্পীদের কাজ হল সকলকে জড়ো করা।’

ঋত্বিক ঘটক

দ্বিতীয়পর্ব, ‘কমিউনিস্ট শিল্পীরা ও জনগণ’ অধ্যায়ে তিনি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন, ‘শিল্পী সংগঠনগুলো কি গণসংগঠন? এই মঞ্চ কি গণমঞ্চ?, একটি গণফ্রন্ট?’ তবে লেনিন জনগণের দিক থেকে সাংস্কৃতিক এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘এটা মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার। গণসংগঠনের বুনিয়াদও তাই।’ কিন্তু সংস্কৃতির প্রশ্নে ঋত্বিক এই পন্থা অবলম্বন করলেন। বললেন, সমগ্রের সৃজনশীলতাকে একীভূত করা। আর পন্থাটাই গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মাধ্যমেই। এবং বিমূর্তবাদী শিল্পভাবনা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ ভাবাদর্শকে সংঘবদ্ধ করার কথা। গণনাট্যের দলিলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘নিদিষ্ট একটি বৃত্তের ক্ষেত্রে তদন্ত কোন সুফল বয়ে আনতে পারে না।’ ফলে গণনাট্যের সমস্যাকে সংস্কৃতির সমস্যা আকারে দেখিয়েছেন। তবে মানুষের কল্পনা বা মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আমলে না নিলে সংস্কৃতির রূপ অধরা থেকে যায়। সংকট মোকাবেলায় সাংগঠনিকভাবে তিনি নামও দিয়েছিলেন ‘ফেডারেশন অব কালেকটিভ আর্টস’। শিল্পীর তরফ থেকে সংকটকে যেভাবে ঋত্বিক দেখেছেন, সেটা ‘জনগণের সংকট’ বলে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু জনগণের যে অপর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি জন্মাতে পারে সেটা বিবেচনায় নেননি তিনি। ফলে শিল্প বা শিল্পীর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক খানিকটা অধরাই থেকেছে। আমরা কার্ল মার্কসের কথা ধুনবো। মার্কস বলেছেন, ‘জনগণ যখন তত্ত¡কে আয়ত্ব করে, তখন তা পরিণত হয় বাস্তব শক্তিতে।’

ঋত্বিক ঘটক

দলিলের তৃতীয়পর্ব ‘কমিউনিস্ট শিল্পীরা ও শিল্প’। নাটকের নানা বিষয়-আশয় নিয়ে এপর্বের কথাগাঁথা। তবে তিনি কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভস্কির চিন্তা দিয়ে দারুণ প্রভাবিত হয়েছেন। নাটককে সংজ্ঞায়নও করেছেন তিনি, ‘ম্যাড মেথডের মূলনীতি’কে আশ্রয় করে। বলেছেন, ‘সব শিল্পের প্রচ্ছন্ন আবিষ্কার যাত্রা হল ‘স্টাইল’ নির্মাণ। একে সংজ্ঞায় ধরা যায় না, কিন্তু বোঝা যায়। যা কোন দক্ষতাকে বা বৃত্তিকে শিল্পের জায়গায় পৌঁছে দেয়।’ অন্য দুই অধ্যায়ে সাংগঠনিক তাত্ত্বিক ও কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা করলেও বিভিন্ন নাটকের কাঠামোই এই পর্বের ভাববস্তু। নাটকের সংস্কৃতি মানুষের চিন্তার কেমন প্রভাব ফেলে, তা যে সাধারণ কথার চেয়ে নাটক বেশি প্রভাবক তার উল্লেখ করেছেন তিনি। আদতে নাটককে তিনি দেখেছেন ‘সংস্কৃতির গতি’ আকারে। মনে করতেন, ‘আমাদের জনগণ, আমাদের বাস্তবতার জগতের সঙ্গে একে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে যুক্ত করতে হবে এবং অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।’ বলা চলে, ঋত্বিকের ছোট্ট দলিলে ‘পার্টি’, ‘শিল্প’ ও ‘জনগণ’ নিয়ে নানা বিষয়ের অবতারনা করেছেন। মূলত নাটকের বিষয়ে প্রাধান্য থাকলেও এহেন চিন্তার পেছনে কাজ করেছে ‘ভারতীয় উপমহাদেশে বামপন্থি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নির্মাণ’। দলিলে তিনি বারবার বলেছেন, ‘বিপ্লব পরিণত মনস্কের কাজ, শিল্পও তাই।’ তার বিবেচনায় ‘পরিণত চিন্তা থেকে উদ্ভূত পরিণত কাজই আজ দরকার’। ঋত্বিকের কোন কোন চিন্তা অচল হলেও কিছু প্রশ্ন বিবেচনায় আনা যেতে পারে। রাজনৈতিক আন্দোলনে সংস্কৃতির ভূমিকা কেমন? তার সংকটের সূত্রগুলো কি? পার্টি সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক কি? দায়ইবা কতটুকু? যদি এমন প্রশ্নের সুরাহা হয়, ভবিষ্যতে সংস্কৃতির নয়া পথ মিলবেই। এ আশা বাতুলতা নয়।


হদিস
 ১. অন দা কালচারাল ফ্রন্ট: ঋত্বিক ঘটক; অনুবাদ: রথীন চক্রবর্তী; নাট্য চিন্তা, কলকাতা
 ২. From Marx to Mao Tse Tung: George Tomson, China polisy study Grup, london
Print Friendly, PDF & Email
কবি; সমালোচক; চিন্তাবিদ। বাংলাদেশ।। কাব্যগ্রন্থ : এলা হি বরষা । যাহ বে এই বাক্য পরকালে হবে । শ্রী চরণে সু । বুদ্ধিজীবী দেখ সবে । কার্ল মার্কসের ধর্ম ।। সম্পাদনা ও গবেষণা গ্রন্থ : জাতীয় সাহিত্য [ভাষা ও দর্শনের কাগজ] । চাড়ালনামা [নাসির আলী মামুনসহ যৌথ]

15 মন্তব্যগুলো

  1. […] ঋত্বিক ঘটক, দুনিয়াখ্যাত এক বাঙালি চলচ্চিত্র প্রণেতার নাম। চলচ্চিত্রে ‘মহাকাব্যিক’ আঙ্গিক প্রণয়ন করে তিনি বিশ্বচলচ্চিত্র ইতিহাসে স্বনামধন্য। তার চলচ্চিত্রে ‘অতিনাটকীয়’ উপাদানের উপস্থিতি তাকে কিংবদন্তি করেছে। নির্মাণের নিজস্বতায়, তিনি বাংলা এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রকে এক নতুন দিগন্তে উদ্ভাসিত করেছেন। […]

  2. […] ঋত্বিক ঘটক ও আমি যমজ ভাই-বোন। আমরা একই সঙ্গে মাতৃজঠর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আলো দেখি। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের জন্ম হয় ঢাকার ২, ঋষিকেশ দাশ রোডের ঝুলন বাড়িতে। আমার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক তখন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ঋত্বিকের কথা বলতে গেলে, আমাদের পরিবার সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। আমাদের পূর্বপুরুষ সোয়া দু’শ বছর আগে কাশ্মীর থেকে পাবনা এসে বসতি করেন। আমার মাতুল বংশও একইসঙ্গে আসেন। তারা রাজশাহীতে বসতি স্থাপন করেন। বাবার মুখে শুনেছি, নেহরু ও রবীন্দ্রনাথদের পরিবারও একই সময় কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন। […]

মন্তব্য লিখুন

Please enter your comment!
Please enter your name here