মিসরীয় ফিল্মমেকার ইউসরি নাসরাল্লাহ’র সাক্ষাৎকার । ইতিহাসও ভীতিকর হয়ে ওঠতে পারে

263

সাক্ষাৎকার : জ্যঁ-মিচেল ফ্রদোঁ অনুবাদ : রুদ্র আরিফ

ইউসরি নাসরাল্লাহ। ১৯৫২ সালে কায়রোতে জন্ম নেওয়া মিসরীয় ফিল্মমেকার। লেফটিজম, ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম ও এক্সপার্টিয়েশন তার সিনেমার মূল থিম। ২০১২ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, সর্বোচ্চ পদক ‘পাম দিঅর’-এর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তার ফিল্ম আফটার দ্য ব্যাটল [Baad el Mawkeaa] ঘিরেই মূলত এ সাক্ষাৎকার। আরব সিনেমার অন্যতম এই ‘অথর’ ফিল্মমেকার নির্মিত অন্যান্য সিনেমা– সামার থেফটস [Sariqat Sayfiyya; ১৯৮৫], দ্য মার্সিডিজ [The Mercedes; ১৯৯৩], অন বয়েজ, গার্লস অ্যান্ড দ্য ভেইল [On Boys, Girls and the Veil; ১৯৯৫]; দ্য সিটি [al-Madina; ১৯৯৯]; দ্য গেট অব সান [Bab el Chams; ২০০৩]; একুরিয়াম [Genenet al Asmak; ২০০৮]; শেহেরজাদে টেল মি অ্যা স্টোরি [Ehki ya shahrazade; ২০০৯]; ব্রুক, মিডোস অ্যান্ড লাভলি ফেস [Al Ma’ wal Khodra wal Wajh al Hassan; ২০১৬]

 

ইউসরি নাসরাল্লাহ
ইউসরি নাসরাল্লাহ

আফটার দ্য ব্যাটল-এর শুরুটা কীভাবে?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ 
২০১১ সালের জানুয়ারির ঘটনা। একটি স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ করে শুটিং করার অবস্থায় পৌঁছে সত্যিকার অর্থেই খুশি ছিলাম। মিসরীয় প্রডিউসার ওয়ালিদ এল-কুর্দির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট সাইন করলাম। আর এরপরই বিপ্লব এলো। সেটিকে পাত্তা না দিয়ে এগোনো সম্ভব ছিল না। আমি আমার অন্য ফিল্মমেকার বন্ধুদের শুটিং স্পটে হাজির হলাম, আর টের পেলাম, রাজপথে যা হচ্ছে– সে ব্যাপারে তারা অনেক আগ্রহী। পরিবর্তনের দাবীর একটি নতুন মেজাজ তখন বাতাসে বাতাসে। আর সেটিকে নিয়ে কাজ করা আমাদের জন্য অপরিহার্য ছিল।

কেন?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ 
আমার জন্য এটা অনিবার্য ছিল। [রোবের্তো] রোসেল্লিনির প্রথম দিককার ফিল্মগুলোর প্রতি, এবং ফিকশনের মধ্য দিয়ে সমকালীন ঘটনাবলিকে ফুটিয়ে তোলার যে পন্থা তার ছিল– সেটির প্রতি আমার মগ্নতা ছিল। রোম ওপেন সিটি, পাইজান ও জার্মানি ইয়ার জিরোর মতো ফিল্মগুলো ব্যক্তিগত ডায়মেনশনের পাশাপাশি সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক ডায়মনশনকেও ছড়িয়ে দিয়েছে; এবং কোনো ঘটনাকে একটি ফিকশনাল ন্যারেটিভের ভেতর দিয়ে জাহির করেছে। দ্য গ্রেটেস্ট লাভ তেমন একটি দেশের জরাজীর্ণ আত্মাকে প্রকাশ করে দিয়েছে– যে দেশটি চালিত হয়েছে ইতিহাসের ভুল পথে, যে দেশটি খুইয়েছে আত্মমর্যাদা। তবে আমাদের বিপ্লবের যে জিনিসটি আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে, তা হালো সেই স্লোগান– ‘খাদ্য, স্বাধীনতা, মানুষের মর্যাদা’ –যার প্রতিধ্বনি আমরা প্রতিদিন শুনতে পেয়েছি। এই তিনটি জিনিসের সমন্বয় আপনি কীভাবে করবেন? হারানো মানব-মর্যাদাকে পুনরুদ্ধারই বা করবেন কীভাবে? যে মানুষেরা কোনো-না-কোনোভাবে ভুলপথে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পক্ষে এই ফিরে পাওয়াটা বিশেষভাবে দুরূহ।

[হুসনে] মুবারকের পতনের পরপরই এইটিন ডেজ নামের একটি যৌথ-নির্মিত ফিল্মের অংশ হিসেবে আপনি ইন্টারিয়র/এক্সটারিয়র শর্টফিল্মটি বানিয়েছিলেন। সেটির পরিকল্পনা করেছিলেন কীভাবে?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ 
সেই ঘটনাবলির প্রতি আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল ছিল এটি। ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের মধ্যকার সম্পর্ক– এই ফান্ডামেন্টাল ইস্যুটির প্রতিও নজর ছিল ফিল্মটির। কোনো-না-কোনোভাবে এটি হলো সামার থেফটস-এর পর থেকে আমার সব ফিল্মেই পুনরাবৃত্ত হওয়া থিম। অবশ্য শেহেরজাদ, টেল মি অ্যা স্টোরি বানানোর সময়ই কেবল তা টের পেয়েছি আমি। যে সব ভীতির মুখোমুখি আমাকে হতেই হবে এবং সেগুলোকে চিরতরে বিতাড়িত করতে হবে– সেটিই আমার সব ফিল্মের ভিত্তিসামার থেফটস-এ পরিবার-ভীতি, মার্সেডিজ-এ নারী-ভীতি, অন বয়েজ, গার্লস অ্যান্ড দ্য ভেইল-এ ইসলামপন্থা-ভীতি, দ্য সিটিতে শহর-ভীতি, দ্য গেট অব সান-এ দমন-পীড়ন ও ব্ল্যাকমেইলের নিমিত্তে ফিলিস্তিনি সমস্যাজনিত ভীতি, অ্যাকুরিয়াম ও শেহেরজাদ, টেল মি অ্যা স্টোরিতে স্বয়ং ভীতিরই ভীতি, মানে, আসলে দর্শক-ভীতি হাজির ছিল। তাছাড়া, আমি মনে করি, ভীতির অনুভূতি প্রত্যেক মানুষের নিজ মতামতকে জোরালো করতে বাধ্য করে। আর, এই সাম্প্রতিক ফিল্মটিতে [আফটার দ্য ব্যাটল] আমার মনোযোগ ছিল বিপ্লবের দিকে। ইতিহাসও ভীতিকর হয়ে ওঠতে পারে; এটি আপনাকে ধ্বংস করে দিতে পারে

আফটার দ্য ব্যাটল
আফটার দ্য ব্যাটল

শর্টফিল্মটি আর ফিচার ফিল্মটির মধ্যে কি কোনো লিংক আছে?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ
ইন্টারিয়র/এক্সটারিয়রআফটার দ্য ব্যাটলকে অনুপ্রাণিত করেছে। ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে তাহরির স্কয়ারে ‘ব্যাটল অব দ্য ক্যামেলস’ [বাংলায়, উটের লড়াই] সংগঠিত হওয়ার পরপরেই কাহিনী এটি। টিভিতে আমি ঘোড়া আর উটগুলোর অন্তত দেড়’শোবার হামলা করার ইমেজ দেখেছি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, সেই লোকগুলোর পিঠে অস্ত্র লুকানো আছে। আসলে এই লোকগুলোর কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না, আর আরোহীরাই সবচেয়ে বেশি পিটুনির শিকার হয়েছেন– এটা বুঝতে পেরে আমি চমকে গিয়েছিলাম; আর এই ইমেজগুলো আমার শর্টফিল্মে জুড়ে দেওয়ার কথা ভাবলাম। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, এই লোকগুলোর মধ্যে কয়েকজন আমার চেনা; তাদের গ্রাম– নাজলেত এল-সাম্মানে অন বয়েজ, গার্লস অ্যান্ড দ্য ভেইল ফিল্মটির শুটিং করার সময় এরা আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। যে মানুষগুলোকে আমি ভালোবাসতাম, তাদেরকে এখন দুষ্টের শিরোমণি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে– এ কথা ভেবে আজব এক অনুভূতি হচ্ছিল আমার। পরে বুঝতে পারলাম, তারা আসলে দুইবার করে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বশ মেনেছে : তাহরির স্কয়ারে আন্দোলনকারীদের ওপর তাদেরকে হামলা করতে পাঠানোর মাধ্যমে, এবং আন্দোলনকারীদের উপর পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও আড়াল থেকে গুলি করার মতো আরও গুরুতর কিছু করার পরিকল্পনা সম্বলিত আসন্ন ঘটনাবলি থেকে মিডিয়ার মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু এই বাস্তবতার কথা কখনোই উচ্চারণ করা হয়নি। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল উট আর ঘোড়াগুলো।

আমি জানতাম, নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে এইসব ঘটনাকে ব্যবহার করে একটা ফিল্ম আমাকে বানাতেই হবে। আমি আমার মিসরীয় প্রডিউসারের কাছে গেলাম। তিনি স্ক্রিপ্ট দেখতে চাইলেন। কিন্তু স্ক্রিপ্ট তো লিখিনি। আমি শুধু জানতাম, উনিশে মার্চ অনুষ্ঠিত আভ্যন্তরীন গণভোট থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বরে পরিকল্পিত নির্বাচন পর্যন্ত ঘটনাবলিকে ধারণ করে একটি সিনেমা বানাতে চাই। আমাকে অবাক করে দিয়ে, সেই মিসরীয় প্রডিউসার এবং জর্জ-মার্ক বেনাম্যু নামের এক ফরাসি প্রডিউসার– দুজনেই রাজি হয়ে গেলেন। জর্জ-মার্ক চাইলেন ফ্রান্সে জেরোমি ক্লেমাঁকেও সম্পৃক্ত করতে। দ্য গেট অব সান বানানোর সময় আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন এবং একটি নিশ্চিত সংবেদনশীলতা জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তারা সবাই বললেন, ‘এগিয়ে যান, ফিল্মটা বানান; পরে কী হবে– সেটা আমরা দেখব।’ এমন ঘটনা আমার জন্য এই প্রথম ছিল।

শুটিং করতে শেষ পর্যন্ত কত সময় লেগেছে?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ
আট মাসের শুটিং-পিরিয়ডে আমরা ৪৬ দিন শুটিং করেছি। এই টানা আটমাস সব অভিনেতা ও কলা-কুশলী সদাপ্রস্তুত অবস্থায় ছিলেন; শুটিংয়ের মাঝখানে মাঝে মধ্যে লম্বা বিরতি পড়লেও তারা অন্যকিছুতে ব্যস্ত হননি।

আফটার দ্য ব্যাটল
আফটার দ্য ব্যাটল

বিপ্লব চলাকালে আপনি নিজেও তাহরির স্কয়ারে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন। আপনি কী দেখেছেন?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ 
প্রথমত, স্কয়ারটিতে জনসমুদ্রের স্লোগান-মুখরতা এবং তাদের অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি ও উত্তেজনা। তবে একইসঙ্গে, সেখানে এমন কিছু ছিল যা আমার কাছে যথেষ্ট ঠিক বলে মনে হয়নি : একই দাবীতে আমজনতা ও আর্মির একত্রে সংগঠিত হতে আসাকে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। এই দেশটি তো আর্মিরই দখলে, এটিকে তো আর্মিরাই নিয়ন্ত্রণ করে বলে সেই নাসেরের [জামাল আবদেল নাসের : মিসরীয় প্রেসিডেন্ট (শাসনকাল : ১৯৫৬-১৯৭০)] সময়কাল থেকে এখনো এর এত বাজে অবস্থা। লোকজন যা দেখেছে তা বিশ্বাস করেছে কিনা, নাকি এ সবই ছিল স্রেফ ভণ্ডামি– ভেবে অবাক হই। ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের একটি ঘনঘটা দেখতে পেলাম আমি; তা হলো– উনিশে মার্চের গণভোটের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়নের পরিকল্পনা। আমার মতে, এটি ছিল একটি অস্থায়ী সংবিধান– যা কোনো কাজেই লাগবে না। ইসলামপন্থিরা এটি করার জন্য চাপ দিচ্ছিল, আর একে ব্যবহার করছিল জনগণকে বোকা বানাতে। ৯ মার্চেরও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। আয়রনিক্যালি, দিনটি ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস; আর এদিন মিসরীয় নারীরা সহিংস আক্রমণ ও পিটুনির শিকার হয়। এইসব হামলা চালিয়েছে ইসলামপন্থিরা– যারা দাবী করে, নারীর কন্ঠস্বর শোনা হারাম। এটি আমার ফিল্মটির স্টার্টিং পয়েন্ট হয়ে ওঠেছে।

ভিডি-শেয়ারিং ওয়েবসাইট ও টেলিভিশনে দেখানো এত-শত ইমেজের সবই কি আপনি দেখেছেন?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ 
মোটেও না। ফিল্মটির কাজ শুরু করার সময় আমি প্রচুর পরিমাণ ভিজ্যুয়াল ম্যাটেরিয়াল জড়ো করেছিলাম, আর তখনই এই ইমেজগুলোকে আবিষ্কার করি। তবে সিনেমাটিতে এগুলো তেমন বড় কোনো ভূমিকা পালন করেনি। বেশিরভাগ গবেষণাই করা হয়েছে নাজলেত এল-সাম্মানে– এলাকাবাসী ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একত্রিত করে ওয়ার্কশপ করানো ও আলোচনাসভার মাধ্যমে। স্ক্রিনপ্লে যৌথভাবে লিখেছি আমি আর ওমর শামা। পরে দৃশ্যাবলি লিখেছি ঘটনাগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করে। তবে তা একটানা ন্যারেটিভ হিসেবে নয়, বরং স্রেফ নোট টুকে রেখেছি। অভিনেতারা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘ফিল্মটি কোন দিকে যাচ্ছে?’ আমি বলে দিয়েছি, ‘জানি না!’ কায়রোর মাসপেরোর ঘটনাগুলো ঘটার আগপর্যন্ত সত্যিকার অর্থেই আমি তা জানতাম না।

কী হয়েছিল সেখানে?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ 
মিসরের দক্ষিণাঞ্চলে, আসুয়ানের কাছে দুটি কপ্ট চার্চ জ্বালিয়ে দেওয়ার পর, অক্টোবরের ৯ তারিখে মাসপেরোতে এক বিশাল বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। শান্তিপ্রিয় বিক্ষোভটিতে অনেক মুসলমানও অংশ নেয়। সেই জনসমাগমে আর্মি এলোপাথারি হামলা করে; ট্যাংকের পর ট্যাংক নিয়ে এসে সেখানকার হতভম্ব ও ছুটন্ত মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করে। টেলিভিশন ভবনের সামনে নিহত হয় ত্রিশজন লোক; আর সেই একই সময়ে মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জনগণকে উস্কানি দিচ্ছিল খ্রিস্টানদের উপর হামলা করার জন্য। সেই দিনটির মর্মার্থ খুবই স্পষ্ট ছিল। এটি আর্মির প্রতি থাকা আমজনতার নূন্যতম আস্থাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। পরে আমি উপলব্ধি করলাম, এই ঘটনাটিকে দিয়ে আমার ফিল্মটির কাহিনীর সমাপ্তি টানা যাক।

কিন্তু সেখানেই তো শেষ করেননি? কেন?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ
৯ মার্চ থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালটি কাভার করার ব্যবস্থা আমি করে রেখেছিলাম। তার মানে, শুটিংকৃত অংশ থেকে অনেক দৃশ্য আমাকে ফেলে দিতে হয়েছে। শুটিংকৃত অগুনতি ইমেজ থেকে আমি আক্ষরিকভাবেই অনেকগুলো ফেলে দিয়েছি– কোনো রকম ধারাবাহিকতা কিংবা সেগুলোর মধ্যে লিংক খোঁজা নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই। পোস্ট-ইট নোটে একটা দেয়াল ভরা ছিল আমাদের। প্রত্যেকটি দৃশ্য সম্পর্কেই আলাদা আলাদা মন্তব্য ছিল আর নিজেদের কাছে যেগুলোকে সেরা সিকুয়েন্স মনে হয়েছে, সেগুলোই রেখেছি। দেখা গেল, এক সিকুয়েন্স থেকে পরের সিকুয়েন্সে কোনো চরিত্রের পরনে সেই একই টিশার্টটি নেই; কিন্তু তাতে কী যায়-আসে! ন্যারেটিভে যে যুক্তি আছে, সেটিই বরং এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুটিং শেষ হওয়ার পর আমি টের পেলাম, ফিল্মটিকে পাকিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অল্প কয়েকটি দৃশ্য বাদ পড়ে গেছে। সেই দৃশ্যগুলোর শুটিং আমরা জানুয়ারিতে করি।

আফটার দ্য ব্যাটল
আফটার দ্য ব্যাটল

এমন কোনো কিছু কি আছে, যেগুলো আপনি ফিল্মটিতে জুড়ে দিতে চাইলেও শুট করতে পারেননি?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ
আছে। তাহরির স্কয়ারে আমরা সেট ফেলেছিলাম, কিন্তু শুটিং থামিয়ে দিতে হয়েছিল। এটা ৮ জুলাইয়ের ঘটনা; ‘বেলুন থিয়েটার ইনসিডেন্ট’-এর পরপরের। বিপ্লবে শহীদদের পরিবারের সদস্যরা স্কয়ারটিতে জড়ো হয়েছিল। সাদা পোশাকের পুলিশেরা তাদেরকে ঝামেলায় ফেলছিল। পরে আর্মি তাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং মিলিটারি ট্রাইবুনালে বিচারের মুখোমুখি করে। ৮ তারিখের বিক্ষোভটা ব্যাপক ছিল। এটি আসলে হঠকারিতামূলক সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছিল। মুসলিম ব্রাদারহুড বলেছিল, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়াবে; কিন্তু তারা সবাইকে ভুলেও সংবিধানের প্রসঙ্গ মুখে আনতে বারণ করে দিয়েছিল। তাহরির স্কয়ারে রিমের সঙ্গে ফাতমার দেখা করার দৃশ্যটির শুটিং করতে আমরা সেখানে ছিলাম। পুলিশ আর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আবহাওয়া অবিশ্বাস্যরকম উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। আর তখনই আমরা, ফিল্মের কলাকুশলীরা আক্রমণের মুখে পড়ি। প্রথমে তারা আমাদের সঙ্গে থাকা নারীদের ওপর হামলা করে। তারা মেন্নাকে অপমান করে এবং বেশ্যা বলে ডাকে; এবং সিনেমার অভিনেত্রী হওয়ায় তাকে যাচ্ছেতাই গালমন্দ করে। আমি জানি না, লোকগুলো কারা ছিল। আমাকে চলে আসতেই হলো; কেননা, কোনো নারীকে বিপদে ফেলতে চাইনি আমি।

আরও একবার এ রকম ঘটনা ঘটেছে। সেটিও স্কয়ারটির কাছে। মসজিদের ভেতরেও আমাদেরকে শুটিং করতে দেওয়া হয়নি; এমনটা এর আগে কখনোই ঘটেনি। এ ক্ষেত্রে অফিসিয়াল সেন্সরশিপও জারি হলো। ২০১১ সালের বসন্তে এসে নিয়ন্ত্রণ যদিও রিল্যাক্স হয়েছে, তবু সেই থেকে কঠোর সেন্সরশিপ বহাল তবিয়তে আছে। [ফলে] বিপ্লব এখনো শেষ হয়নি…।

বিপ্লব কি আদৌ শুরু হয়েছে এখনো?

 ইউসরি নাসরাল্লাহ
না, এখনো হয়নি। তবে যা শুরু হয়েছে, তা হলো– বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা। একটা ভিন্ন জীবনের সম্ভাবনা। আর এই ফিল্মটি সে বিষয়কে নিয়েই।


সূত্র : কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ওয়েব সাইট
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

১টি কমেন্ট

  1. […] মাঝখানে : ইউসেফ শাহিন [১৯২৫-২০০৮], ইউসরি নাসরাল্লাহ [১৯৫২-], সামির নাসরি ও অনেকেই। মিসরের […]

Leave a Reply to স্বামী, ফিল্মমেকার অথবা দ্রষ্টা । অভিনেত্রী-স্ত্রীর দৃষ্টিতে লেবাননের মাস্টার ফিল্মমেকার মারো

Please enter your comment!
Please enter your name here