ফিল্মমেকারের চোখে ফিল্মমেকার, অথবা, আমার কুব্রিক: মার্টিন স্করসেজি

886

লিখেছেন মার্টিন স্করসেজি ।। অনুবাদ রুদ্র আরিফ


স্ট্যানলি কুব্রিক • আমেরিকান ফিল্মমেকার। জন্ম : ২৬ জুলাই ১৯২৮; ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। মৃত্যু : ৭ মার্চ ১৯৯৯; হারপেন্ডেন, হার্টফোর্ডশায়ার, ইংল্যান্ড। ফিল্ম : ডে অব দ্য ফাইট [১৯৫১], ফ্লাইং পাড্রে [১৯৫১], দ্য সিফেরার্স [১৯৫২], ফিয়ার অ্যান্ড ডিজায়ার [১৯৫৩], কিলার’স কিস [১৯৫৫], দ্য কিলিং [১৯৫৬], পাথস অব গ্লোরি [১৯৫৭], স্পার্টাকাস [১৯৬০], ললিতা [১৯৬২], ড. স্ট্রেঞ্জলাভ অর : হাউ আই লার্নড টু স্টপ ওরিং অ্যান্ড লাভ দ্য বোম্ব [১৯৬৪], ২০০১ : অ্যা স্পেস অডিসি [১৯৬৮], অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ [১৯৭১], ব্যারি লিন্ডন [১৯৭৫], দ্য শাইনিং [১৯৮০], ফুল মেটাল জ্যাকেট [১৯৮৭], আইজ ওয়াইড শাট [১৯৯৯]।
মার্টিন স্করসেজি • আমেরিকান ফিল্মমেকার। জন্ম : ১৭ নভেম্বর ১৯৪২; ফ্লাশিং, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। উলে­খযোগ্য ফিল্ম : টেক্সি ড্রাইভার [১৯৭৬], র‌্যাগিং বুল [১৯৮০], দ্য কালার অব মানি [১৯৮৬], দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট [১৯৮৮], গুডফেলাস [১৯৯০], দ্য এইজ অব ইনোসেন্স [১৯৯৩], গ্যাংস অব নিউ ইয়র্ক [২০০৩], দ্য অ্যাভিয়েটর [২০০৪], সাটার আইল্যান্ড [২০১০], দ্য ওলফ অব ওয়ালস্ট্রিট [২০১৩]।

স্ট্যানলি কুব্রিক
স্ট্যানলি কুব্রিক

৯৯৯ সালে স্ট্যানলি কুব্রিক মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর তার আইজ ওয়াইড শাট যখন মুক্তি পেল, তখন ফিল্মটি যে বেশ কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবতারণা করেছিল– তাতে চমকানোর কিছু নেই। কুব্রিকের সিনেমার [শুধুমাত্র প্রথমদিকেরগুলো বাদ দিয়ে] দিকে ফিরে, সেগুলো সম্পর্কে সমকালীন প্রতিক্রিয়ার দিকে যদি তাকান, তাহলে খেয়াল করবেন, তার সব ফিল্মই প্রাথমিকভাবে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে। তবে পাঁচ কিংবা দশ বছর কেটে যাওয়ার পর সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছে, ২০০১ : অ্যা স্পেস অডিসি, বেরি লিন্ডন কিংবা দ্য শাইনিং-এর মতো ফিল্ম আগে কিংবা এখনও দ্বিতীয়টি আর হয়নি।

নিজের শেষ ফিল্মটির ওপেনিং শো দেখার জন্য কুব্রিক যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এইসব যুদ্ধংদেহী প্রতিক্রিয়া দেখে নিশ্চয়ই নিরাশ হতেন তিনি। তবে আমি নিশ্চিত, বিষয়টিকে শেষ পর্যন্ত তিনি হাল্কাভাবেই নিতেন, এবং এগিয়ে যেতেন নিজের পথে।শিরার ভেতরের কাজকারবারকে বাকিরা যেভাবে দেখে, সত্যিকারের কোনো স্বপ্নদ্রষ্টা ঠিক তেমনিভাবে দেখেন না। কুব্রিকের মতো শিল্পীদের যথেষ্ট সুদূরপ্রসারী ও প্রাণবন্ত মানসিকতা থাকে– পৃথিবীর ছবিকে মোশনের মধ্যে আঁকতে, এবং এটি আছে কোথায়– তা নয়, বরং কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে– তা উপলব্ধি করতে।

আইজ ওয়াইড শাট
আইজ ওয়াইড শাট

আইজ ওয়াইড শাট-এর কথাই ধরুন। নিউইয়র্কের রাস্তাগুলো একটু বেশিই বড়, রগরগে দৃশ্যটি একেবারেই কল্পনা-মুখর, ফিল্মটির গতি ধীর ও স্বেচ্ছাচারি– অবাস্তবতার এমনতর দায় চাপিয়ে ফিল্মটিকে এড়িয়ে গেছেন অনেকেই। কথাগুলো সত্য; তবে ফিল্মটির ডিজাইন যদি বাস্তবধর্মী করা হতো, তাহলেই কেবল এগুলোকে ব্যর্থতার দায়ে একেবারে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার করা সম্ভব ছিল। কিন্তু আইজ ওয়াইড শাট বানানো হয়েছে [অস্ট্রিয়ান সাহিত্যিক অর্থার] স্নাইৎজারের ড্রিম স্টোরি উপন্যাসিকা অবলম্বনে। একটি স্বপ্নের যুক্তিতে একটি দাম্পত্যে ধরা ভাঙ্গনের গল্প এটি। আর, যে কোনো স্বপ্নের মতো এ বেলায়ও আপনার পক্ষে ঠিক বলা সম্ভব নয়– কখন এর মধ্যে নিজেই ঢুকে গেছেন। সবকিছুকে এখানে বাস্তব ও জীবনের মতো মনে হয়; তবে পার্থক্য হলো– এগুলো সামান্য অতিরঞ্জিত, সামান্য দূরবর্তী। জিনিসগুলো এমন অনিবার্য ভঙ্গিতে, কখনো কখনো এমন বিস্ময়কর ছন্দে হাজির হয় যে, এর থেকে পালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে ফিল্মটি নিজের অবস্থান ড্রিম ফিল্ম হিসেবে ঘোষণা দেয়নি, উড়ুক্কু কুয়াশা আর নির্দিষ্ট কিংবা ভাসমান প্রেক্ষাপটে লোকজনের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হওয়া– [ড্রিম ফিল্মের] এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত ছাড়াই দর্শকদের পক্ষে সেটিকে তেমন হিসেবে ধরে নেওয়ার প্রস্তুতি সত্যিই ছিল না। নিজ সময়ে এ রকম অনেকগুলো ভুল বোঝাবুঝির অবতারণা করা আরেকটি ফিল্ম– রোবের্তো রোসেল্লিনির ভোয়েজ টু ইতালির [Viaggio in Italia; ১৯৫৪] মতো আইজ ওয়াইড শাটও গিয়েছে বেশ কিছু বিরক্তি-জাগানিয়া ভ্রমণের ভেতর দিয়ে; এর শেষ বেলায় উভয় ফিল্মই একটি অন্যটির প্রতি রয়ে গেছে অনুগত। এ দুটিই ভয়ংকর রকম স্ব-আলোকিত ফিল্ম। দুটিই ছুড়ে দিয়েছে এ জিজ্ঞাসা : আরেকজন মানুষের ওপর আপনি সত্যিই কতটুকু বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে পারেন? আর, দুটি ফিল্মই শেষ হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে, তবে আশাবাদ নিয়ে। আর তা সত্যিকার অর্থেই।

কুব্রিকের ফিল্ম দেখা মানে হলো পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দাঁড়ানোর মতো ব্যাপার। আপনি তাকাবেন আর অবাক হবেন– কী করে একজন মানুষ এতটা উপরে ওঠতে পারে? তার ফিল্মগুলো জুড়ে থাকা আবেগী প্যাসেজ, ইমেজ ও স্পেসের রয়েছে একটি ব্যাখ্যাতীত ক্ষমতা; একটি চৌম্বক শক্তি আপনাকে চালিত করবে ধীরলয়ে, রহস্যময়ভাবে। যেমন, দ্য শাইনিং-এ বৃহৎ চাকায় চড়ে, হোটেলের অশেষ করিডোর ধরে একটি ছেলের ছুটে যাওয়া; ২০০১ : অ্যা স্পেস অডিসিতে অন্য গ্রহের মহাকাব্যিক নীরবতা; ফুল মেটাল জ্যাকেট-এর প্রথমার্ধের অমানবিক গতির মাধ্যমে ফিল্মটির যৌক্তিক ও নির্দয় পরিসমাপ্তিকে গড়ে তোলা; ড. স্ট্রেঞ্জলাভ-এর যুদ্ধ-কক্ষটির জাকজমক অবস্থাকে একই সঙ্গে আতঙ্ক ও হাস্য-রসাত্মক করে তোলা; অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ-এ পাশবিক বিদীর্ণ ভবিষ্যত; আইজ ওয়াইড শাট-এ টম ক্রুজ ও নিকোল কিডম্যানের [অভিনীত কেন্দ্রীয় চরিত্র দুটির] মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের অমার্জিত অন্তরঙ্গতা।

ব্যারি লিন্ডন
ব্যারি লিন্ডন

কুব্রিকের কোন সিনেমাটি আমার প্রিয়, সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারব না; তবে কোনো না কোনো কারণে ব্যারি লিন্ডন-এর কথা মাথায় চলে আসে। আমার মনে হয়, এটিই বেশি প্রিয়; কেননা, এটি একটি গভীরতর আবেগিক অভিজ্ঞতা। এখানে ক্যামেরার মুভমেন্ট, গতির ধীরজপনা, নিজেদের ঘিরে রাখা সম্পর্কের প্রতি চরিত্রগুলোর আচরণ– সবকিছুতেই আবেগ বহমান। মুক্তি পাওয়ার পর লোকজন ফিল্মটি বুঝতে পারেনি। এখনো বোঝে না অনেকেই। মূলত, একটির পর আরেকটি নিখুত সুন্দর ইমেজের মাধ্যমে আপনি একজন মানুষের নিখাঁদ নিষ্পাপ অবস্থা থেকে শীতলতম বিপথগামী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া, এবং শেষ পর্যন্ত একেবারেই তিক্ততার দেখা পাবেন এখানে। আর এর কারণ খুবই সাদামাটা; তা হলো– বেঁচেবর্তে থাকা। এ এক ভয়ংকর সিনেমা; কেননা, এখানে মোমবাতির সৌন্দর্য আর কিছুই নয়, বরং ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার একটি আবরণ মাত্র। তবে এ হলো সত্যিকারের নিষ্ঠুরতা– যার দেখা আপনি প্রতিদিনই পাবেন ভদ্র সমাজে।

আমাদের একেবারেই আধুনিক মাস্টার ফিল্মমেকারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্ট্যানলি কুব্রিক। ব্যক্তিগতভাবে কুব্রিকের কাজ বছরের পর বছর ধরে বারবার দেখেছি এবং গবেষণা করেছি আমি। যে ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ছিলেন, তা হলো– প্রতিটি নতুন ফিল্মে তিনি [ফিল্ম] মাধ্যম ও এর সম্ভাব্যতা নিয়ে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করতেন। [এ ক্ষেত্রে] স্রেফ একজন টেকনিক্যাল ইনভেন্টরের চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন তিনি। অন্যসব স্বপ্নদ্রষ্টার মতোই সত্য বলতেন। সেই সত্যকে আমরা কতটা স্বস্তির সঙ্গে নিই– তাতে কিছু যায় আসে না; বরং আমরা যখন এর [সত্যের] মুখোমুখি হতে যাই, তখন এটি সবসময়ই একটি গভীরতর ধাক্কা দেয় আমাদের।


গ্রন্থসূত্র  কুব্রিক : দ্য ডেফিনিটিভ এডিশন/ মাইকেল সিমেন্ট
ফেবার অ্যান্ড ফেবার [পাবলিশিং হাউস]; যুক্তরাজ্য । ২০০৩

Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

4 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to অ্যানিয়েস ভার্দা : ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ সিনেমার ‘গ্র্যান্ডমাদার’ | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here