ফিল্ম ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই: মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি

330

অনুবাদ রুদ্র আরিফ

 অনুবাদকের নোট 
মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি [২৯ সেপ্টেম্বর ১৯১২-৩০ জুলাই ২০০৭]। সিনেমার ‘বিচ্ছিন্নতাবোধের কবি’খ্যাত ইতালিয়ান মাস্টার ফিল্মমেকার। সম্মানজনক ‘অস্কার’ ছাড়াও পেয়েছেন বিশ্ব-সিনেমার সবচেয়ে মর্যাদাকর চারটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সর্বোচ্চ পদক– পাম দি-অর [কান, ফ্রান্স], গোল্ডেন লিওপার্ড [লোকার্নো, সুইজারল্যান্ড], গোল্ডেন লায়ন [ভেনিস, ইতালি], গোল্ডেন বিয়ার [বার্লিন, জার্মানি]। এক্লিপ্স [১৯৬২], রেড ডিজার্ট [১৯৬৪], ব্লোআপ [১৯৬৬], দ্য প্যাসেঞ্জার [১৯৭৫] প্রভৃতি সিনেমার এই নির্মাতা, ১৯৬০ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, সে বছর মুক্তি পাওয়া নিজের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার’ ফিল্মটির অংশগ্রহণ উপলক্ষ্যে দিয়েছিলেন এই বিবৃতি…

র্তমান পৃথিবীতে একদিকে বিজ্ঞানের মধ্যে একটি ভীষণ মারাত্মক ভাঙচুর ঘটছে, সবসময়ই আলোকপাত করা হচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে, এবং প্রত্যেকটি দিনই আগের দিনের বিষয়আশয়কে অস্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকছে– যেন এ ব্যাপারটিই নিজেকে নিজের ভবিষ্যৎ-জয়ের দিয়ে এগিয়ে দিতে পারবে; তা অংশত হলেও। অন্যদিকে আছে একটি অনড় ও অনমনীয় নৈতিকতাবোধ– যার ত্রুটিবিচ্যুতি মানুষের সামনে যথাযথভাবে দৃশ্যমান হয়, কিন্তু যা এখনো থিতু হতে পারেনি।

একটা মানুষ যখন জন্মায়, তখন সে অনুভূতির একটি বিশাল চাপে বাঁধা পড়ে। এইসব অনুভূতিকে সেকেলে কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বলছি না আমি; তবে এগুলো তার [লোকটির] প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। এগুলো তাকে কোনো শুশ্রুষা ছাড়াই শর্ত দেয়; সমস্যাবলি থেকে বেরোনোর কোনো পথ না দেখিয়েই শিকল পরিয়ে দেয় তার পায়ে। দেখে মনে হয়, এই উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে এখনো মুক্তি দিতে পারেনি মানুষ। সে ভান করে, ঘৃণা করে এবং ভোগে সেই নৈতিক শক্তির ও পুরাণের তাড়নায়– যা কিনা [মহাকবি] হোমারের সময়েই সেকেলে হয়ে গিয়েছিল। চাঁদে মানুষের প্রথম যাত্রার ঠিক আগমুহূর্তে আমাদের সময়ে এ এক হাস্যকর ব্যাপার। তবু তা ঘটছেই!

দ্য অ্যাডভেঞ্চার
দ্য অ্যাডভেঞ্চার

নিজের কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যখন মিথ্যে প্রমাণিত হয়, তখন সেটি থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত থাকে মানুষ। নিজের [বিজ্ঞানের] বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যানে ক্ষেত্রে বিজ্ঞান আগে কখনোই এতটা বিনম্র, এতটা প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আবেগের রাজত্বে শাসন করে একটি পূর্ণাঙ্গ সাদৃশ্য।

গত কয়েক বছর ধরে আমরা আবেগ বিষয়ে যতোদূর সম্ভব পরীক্ষা ও গবেষণা করে নিঃশেষিত অবস্থায় পৌঁছেছি। আমাদের সক্ষমতার সবটুকুই দিয়েছি আমরা। কিন্তু না পেরেছি নতুন কোনো আবেগ খুঁজে বের করতে, না পেরেছি সমস্যাটির সমাধানের কোনো সূত্রও বের করতে। সমাধান খুঁজে পাওয়ার মিথ্যে দাবি আমি করতে পারব না। সেটা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। আমি কোনো নৈতিকতাবাদি নই।

আমার দ্য অ্যাডভেঞ্চার ফিল্মটি না কোনো প্রকাশ্য-নিন্দাভাষ্য, না কোনো ধর্মীয়-বয়ান। এটি একটি কাহিনী– যা বলা হয়েছে ইমেজের মাধ্যমে। আমি আশা করি, লোকজন এটিকে কোনো প্রবঞ্চক আবেগের জন্ম নয়, বরং যে পদ্ধতিতে এটি কাউকে তার নিজের অনুভূতিমালার প্লাবনে ভাসার সম্ভাবনা দেখায়– সে হিসেবেই দেখতে সমর্থ্য হবে। আমি আবারও বলছি, একটি পুরনো নৈতিকতার, সেকেলে পুরাণের, সুপ্রাচীন চিরাচরিত রীতির ব্যবহার আমরা করি। আর তা করি একেবারেই সচেতনভাবে। কেন এ ধরনের নৈতিকতাকে ভক্তি করি আমরা?

দ্য অ্যাডভেঞ্চার
দ্য অ্যাডভেঞ্চার

আমার চরিত্রগুলো যে উপসংহারে পৌঁছেছে, সেটি এ ধরনের নৈতিক অরাজকতা নয়। তারা পৌঁছেছে সবচেয়ে সেরা জায়গায় : এক ধরনের পারস্পরিক সহানুভূতির মধ্যে। এ ব্যাপারটিকেও আপনারা সেকেলে বলতে পারেন। কিন্তু আমার জন্য আর কী-ই-বা বাকি আছে? যেমন ধরুন, সাহিত্য ও পারফর্মিং আর্ট দখল করে আছে যে ইরোটিসিজম, সেটির সত্যিকারের অর্থ কী বলে মনে করেন আপনি? এটি একটি লক্ষণ, এবং বোধগত পার্থক্য নির্ণয়ের সম্ভবত সবচেয়ে সহজ লক্ষণ– যেটির অসুখে ভুগছে সব আবেগ।

ইরোসের [কামদেব কিউপিডের অন্যনাম] অধীনস্থ অসুস্থ লোকগুলোর মতো ইরোটিক হতে ইচ্ছুক নই আমরা– যেখানে ইরোস নিজেই কিনা সুস্বাস্থ্যবান। আর আমি যখন সুস্বাস্থ্যবান বলছি, তখন সেই মানুষটির হাল-হকিকত ও প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অঢেল পরিমাণ থাকার কথাই বোঝাচ্ছি কেবল। সুতরাং, অস্বস্তির বিষয়টি এখানেই। তাছাড়া, কেউ যখন অস্বস্তিবোধ করে, তখন সে প্রতিক্রিয়া দেখায়ই। তবে সেই প্রতিক্রিয়া দেখায় বাজেভাবে, এবং এ ব্যাপারে সে অখুশি থাকে।
সস্তা, মূল্যহীন, হতভাগ্য– এইসব প্রসঙ্গের একটি ইরোটিক প্রবণতা দ্য অ্যাডভেঞ্চার-এ একটি চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। তাছাড়া, এ বিষয়গুলো যে এভাবেই ঘটে– সে কথা জানাটাও যথেষ্ট নয়। আমার ফিল্মের হিরো [কী হাস্যকর শব্দ রে বাবা!] রূঢ় স্বভাব, অর্থহীনতা এবং তাকে ভালোভাবে করায়ত্ত্ব করতে সক্ষম ইরোটিক প্রবণতাটির ব্যাপারে নিখুঁতভাবে অবগত। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। এখানে এরপরে আরেকটি পতিত পুরাণ ও বিভ্রম রয়েছে– যা কাউকে জানার জন্য, আত্মার সবচেয়ে গোপন জায়গায় কাউকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য যথেষ্ট।

না, এ যথেষ্ট নয়! আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি দিনই অতিবাহিত হয় একটা ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র ভেতর দিয়ে– তা সেটি কোনো ভাবপ্রবণ ব্যাপারই হোক, কিংবা নৈতিক অথবা ভাবাদর্শগত ব্যাপারই হোক না কেন। কিন্তু আমরা যদি জেনে যাই, দেওয়ার মতো আইনের পুরনো ছকের আর কিছুই বাকি নেই– অবিরত পঠিত ও পুনরাবৃত্ত হওয়া শব্দগুচ্ছ ছাড়া; তবুও এইসব ছকের প্রতি আস্থা রাখি কেন আমরা? এই একগুয়েমিতা আমাকে করুণভাবে আঘাত করে। বৈজ্ঞানিক অজানাকে নিয়ে যে মানুষের কোনো ভয় নেই, নৈতিক অজানাকে নিয়ে সে-ই কিনা আতঙ্কিত!

দ্য অ্যাডভেঞ্চার
দ্য অ্যাডভেঞ্চার

আপনার যদি কোনো শত্রু থাকে, তাকে হারানোর চেষ্টা আপনি করবেন না, করবেন না অপমান, দেবেন না অভিশাপ, করবেন না অপদস্ত, আশা করবেন না সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর; একেবারে সাটামাটাভাবে আকাঙ্ক্ষা করুন– যেন সে কর্মহীন থাকে! একজন মানুষকে স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কষ্ট এটিই। যে কোনো ছুটির সময়, এমনকি তা ছুটির দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার হলেও, এর একমাত্র অর্থ দাঁড়ায়– লোকটির অবসাদকে একটি স্থির রূপ দেওয়ার।

আমি মানি, যে কাজ আমার ভালোলাগে, সে কাজ করি আমি, সেটির বিশেষভাবে বিশেষ সুবিধা নিজে লাভ করেছি। তবে এমন দাবি করতে পারবে– এ রকম খুব বেশিজন ইতালিয়ানকে চেনা নেই আমার। এই কাজই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এটি আমাকে কী দেয়– তা জানতে চাওয়া বাহুল্য। এটি সবই দেয়। এটি নিজেকে প্রকাশ করার এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার সম্ভাবনা দেয়। যেসব কথা মুখে বলা আমার পক্ষে মুশকিল, সেগুলোর বিবেচনায় টের পাই– ফিল্ম ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন।


সূত্র : কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৯৬০
গ্রন্থসূত্র : আন্তোনিওনির সিনে-জগৎ/ রুদ্র আরিফ । প্রকাশক : ভাষাচিত্র; ঢাকা, বাংলাদেশ
Print Friendly, PDF & Email
সম্পাদক: ফিল্মফ্রি । ঢাকা, বাংলাদেশ।। সিনেমার বই [সম্পাদনা/অনুবাদ]: ফিল্মমেকারের ভাষা [৪ খণ্ড: ইরান, লাতিন, আফ্রিকা, কোরিয়া]; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো: প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; তারকোভস্কির ডায়েরি; স্মৃতির তারকোভস্কি; হিচকক-ত্রুফো কথোপকথন; কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী; আন্তোনিওনির সিনে-জগত; কিয়ারোস্তামির সিনে-রাস্তা; সিনেঅলা [৪ খণ্ড]; বার্গম্যান/বারিমন; ডেভিড লিঞ্চের নোটবুক; ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ফেদেরিকো ফেল্লিনি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার চান্তাল আকেরমান; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার বেলা তার; সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার নুরি বিলগে জিলান; ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কি; বেলা তার; সের্গেই পারাজানোভ; ভেরা খিতিলোভা; সিনেমা সন্তরণ ।। কবিতার বই: ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা; র‍্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ; হাড়ের গ্যারেজ; মেনিকিনের লাল ইতিহাস ।। মিউজিকের বই [অনুবাদ]: আমার জন লেনন [মূল : সিনথিয়া লেনন]; আমার বব মার্লি [মূল: রিটা মার্লি] ।। সম্পাদিত অনলাইন রক মিউজিক জার্নাল: লালগান

3 মন্তব্যগুলো

Leave a Reply to আন্তোনিওনি ও গোদার । মুখোমুখি ২ মাস্টার ফিল্মমেকার | ফিল্মফ্রি

Please enter your comment!
Please enter your name here